আশরাফ জুয়েলের গল্প : সুখনিদ্রা পরিত্যাজে, জাগো মৃগগরাজতেজে

 


এই শুয়ে বসে থাকা। ভীষণ একা। কোথাও যাবার নেই। কোনো তাড়া নেই। ছোটো একটি কেবিন। নাকের ফুটোর মতো একটা জানালা। সেটা দিয়ে নেমে আসা আধুলির সমান এক টুকরো আকাশ; সন্ধে নামলে সেই আকাশে অন্ধকারের সুতোয় ঝুলতে থাকে বেড়ালের চোখের মতো সাতটা তারা; এক কপাট বন্ধ থাকলে তা নেমে আসে সাড়ে তিনটায়। দু-কপাট বন্ধ থাকলে মরে যায় আকাশটা। একটা ফ্যান, নিশ্চিত ফাঁসির আসামির মতো ঝুলে থাকে। দেড় ধাপ সমান না-মাজা দাঁতের মতো একটা বাথরুম। বিছানাটা কবরের সমান।

তা-ও ভাগ্য ভালো। ভালোই বা হলো কীভাবে? যদিও সর্বোচ্চ মনোযোগ পাচ্ছি। এ মনোযোগ অবহেলায় রূপ নিতে বেশি সময় হয়তো লাগবে না, কিন্তু একা একা কিছুই ভালো লাগে না। অথচ কদিন আগেও মাঝে মাঝে হাসপাতালের করিডোর, সিঁড়ি বেয়ে নিচে যাওয়া, এমনকি হাসপাতালের বাইরে যাওয়ার সুযোগও মিলত!

কথা বলার লোক নেই। অবশ্য যে দু-একজন অতিথি আসেন, তাঁদের সাথে কুশলাদি বিনিময় হয়; তাঁরা অল্প সময়ের জন্য এসেই চলে যান, ভাব জমে না। খুব অসহায় সময় কাটে। জানি না এভাবে কতদিন!

হাসপাতালের এই রুমে আমার সাথে আরেকজন থাকেন। তিনি অবশ্য নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত, বড়ো অদ্ভুত মানুষ, বড়োই অদ্ভুত; এই দুনিয়ায় নিজের সাথে কথা বলাই তাঁর একমাত্র কাজ। তবে জেগে থাকার চেয়ে ঘুমের মধ্যেই কথা বলেন, অনবরত। কার সাথে কথা বলেন, তিনিই জানেন।

হালকা গড়নের দেহ। পাড়ভাঙা নদীর মতো মুখ, মুখের চামড়া যেন পুরনো ইতিহাসের বইয়ের কুঁচকে যাওয়া পৃষ্ঠা। চোখে ভারী লেন্সের চশমা। মাথায় কাঁচাপাকা চুলের দৃশ্যমান লড়াই। দুই ঠোঁটের ফাঁকে সব সময় একটা পাইপ ঝুলতে থাকে। পাইপ টানেন, কেন টানেন তা জানার প্রয়োজনবোধ আছে বলে মনে হয় না। তবু টানেন। মাঝে মাঝে পাইপের ধোঁয়া আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে।

জেগে থাকি আমি। তিনিও জেগে থাকেন। তিনি ঘুমিয়ে থাকলে আমি ইচ্ছা করে জেগে থাকি। তিনি ঘুমের মধ্যেও জেগে থাকেন, কোথায় কোথায় যে চলে যান! অবাক হই, আমিও তার সাথে চলে যাই।

গতরাতে তিনি গিয়েছিলেন ঘনবর্ষার কোনো এক দেহ-উপচানো বিলের ধারে। বিলের ঢেউগুলোর সাথে কথা বলছিলেন, কথা বলছিলেন শ্যামল ঘাসেদের সাথে। আমিও গিয়েছিলাম, বসেছিলাম তাঁর পাশে। বিকেলটা সন্ধের বুকে ঝরে পড়লে তিনি উঠে দাঁড়ান, আমিও। আমরা পায়ে পায়ে এগোতে থাকি। তিনি এসে দাঁড়ান ঘোড়াঘাটের হাটে। মানুষ দেখেন, কথা শোনেন, কথা বলেন তাঁদের সাথে। কী এক অদ্ভুত যাত্রা! চারপাশে এত মানুষ, তবু তিনি একা, একার মধ্যে থেকেও যেন অনেকের। সেখান থেকে নাকাইহাট, গোবিন্দগঞ্জ হয়ে কোথায় যেন চলে যান। ঘুমের মধ্যে ঘুরে বেড়ান তিনি, আমি চিনি না এসব জায়গা, কিন্তু চিনে নিচ্ছি, আমার ভালো লাগছে। এই নতুন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছি। হাসপাতালের অসহ্য বিছানায় শুয়ে শুয়ে তিনি স্বপ্নের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন চন্দনবাইশা, পোড়াদহ।

সেদিন দুপুর, গভীর ঘুমে তিনি। সাধারণত দিনে ঘুমান না, সেদিন ঘুমিয়েছিলেন। আমারও তন্দ্রাভাব চলে এসেছিল। তিনি ঘুমের মধ্যে কথা বলছিলেন। একটু চাপচাপ মেঘ আকাশের বুকে অন্ধকারের ঘোড়া হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছিল, সেই মৃদু অন্ধকার হাসপাতালের এই ছোট্ট ঘরটাতেও সংক্রমণের মতো ছড়িয়ে পড়ছিল।

--বায়তুল্লাহ মুন্সি, দেখেছ পাকুড় গাছটা ক্যামন মন খারাপ করে বসে আছে?

--হ্যাঁ, কিন্তু বুঝতে পারছি না কেন? জিজ্ঞেস করে দেখি?

-- না, থাক। কাউকে জিজ্ঞেস করতে নেই কেন তার মন খারাপ। এটি একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার, বড়োজোর তার পাশে বসে থাকা যায়।

-- চলুন, পাকুড়ের ছায়ায় গিয়ে বসি। বায়তুল্লাহ মুন্সিচেয়ে থাকে তাঁর দিকে। যেন অনুমতি চাচ্ছে সে।

-- চ-লো, বসি।

--ওই দ্যাখেন, তমিজের বাপরে দ্যাখেন। গন্ধ শুইকা বেড়াচ্ছে এই দুপুরের। কী যে করে আর না করে!

--কুলসুম, কী হয়েছে তোমার?

--কিছু না। আড়াল থেকে বলে ওঠে কুলসুম।

--উহু, তুমি তো ভাবনার সাগরে ডুবে আছো। অবশ্য তোমাকে নিয়ে আমিও বিপদে। তমিজকে নিয়েও।

ঘুমের মধ্যে তৈরি করা জগতে তাঁর এই অবাধ বিচরণ অবাক করে আমাকে। আমিও তাঁর সাথে হারিয়ে যাই, ঘুরিফিরি, তাঁর আশপাশে থাকি, কিন্তু স্বপ্নে নয়, জেগেই।

মাঝে মাঝে তিনি খুব উদ্বিগ্ন থাকেন। জেগে থেকেও নিজের মধ্যে থাকেন না, নিজের মধ্যে তৈরি করা জগতে অনুপস্থিতির মোড়কে উপস্থিত থাকেন।

কুলসুম আর তমিজের দুশ্চিন্তায় তিনিও অস্থির থাকেন, তাঁদের সাথে সর্বক্ষণ কথা বলেন, তাদের সমস্যার গভীরে যান, উপলব্ধি করার চেষ্টা করেন ঠিক কী ধরনের জটিলতার মধ্য দিয়ে সময় পার করে তারা।

মাঝেমধ্যে চেরাগ আলী আর কেরামত গান নিয়ে হাজির হয় হাসপাতলের এই ছোট্ট ঘরে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলতে থাকে গানের আসর। তিনি গানের শব্দগুলো গুঁজে দেন কেরামত আর চেরাগের কণ্ঠে। তাঁর ভেতরের কবিসত্তা পুনরুজ্জীবিত করেন, কখনও কখনও শেলী, ইয়েটস বা অডেনের কবিতার অনুবাদ দিয়ে গান বানিয়ে সুর তুলে দেন কেরামত বা চেরাগের কণ্ঠে। তাদের কণ্ঠ মানিয়ে নেয় এসব গান।

আমি পাশে বসে তাঁদের কর্মকাণ্ড দেখি। ভালো লাগে; ভেতরের বিষণ্ন ভাব ধীরে ধীরে কেটে যায়। একা থাকা কী যে কষ্টের, কত যে বেদনার তা এই অদ্ভুত মানুষটিকে দেখে শিখছি। অবশ্য নিজ জগতে থাকার অন্যরকম আনন্দও আছে, তা এঁর সাথে না থাকলে শেখা হতো না।

রিপোস নার্সিংহোমের দুশো দুনম্বর কেবিনে আছি আমরা। ইদানীং শুয়েই থাকেন তিনি। অসুস্থ এক মানুষ, কিন্তু তাঁর মধ্যে কোনো খারাপ-লাগা বোধ নেই, কিংবা থাকলেও তা বোঝার উপায় নেই; যেন তাঁর একমাত্র সমস্যা এই শুয়ে থাকা, এই একা থাকা। কিন্তু আদতেও তিনি একা থাকেন না, একা থাকি আমি, ভীষণ একা। আমার ভালো লাগে না, বাইরে বেরুতে পারি না। অথচ এই মানুষটির সাথে আমার কত কত জায়গায় যাবার কথা ছিল, কত পথ দেখার ছিল, চেনার ছিল কত কিছু। কিছুই হলো না, মাঝে মাঝে চলে যেতে ইচ্ছে হয়, পারি না। কেন যেন মনে হয়, এই মানুষটা আমাকে শেখাচ্ছেন একা থাকার কৌশল।

গতরাতে খটখট শব্দে ঘুম ভাঙে আমার। অনবরত শব্দ, প্রথমে বিরক্তির উদ্রেক করলেও পরের দিকে মনে হচ্ছিল একটা কাঠঠোকরা নিবিড় শ্রমে ঠোঁট দিয়ে আঘাত করছে একটা কাঠের গুড়িতে। চোখ বন্ধ রেখেই শুনছিলাম সেই শব্দ, কিন্তু কৌতূহল বাড়লে চোখ খুলি, দেখি তিনি উঠে বসেছেন, বিছানায় বসে টেবিলের ওপর দুই হাত দিয়ে আঙুলগুলো এদিক-ওদিক চালাচ্ছেন, প্রথমে বুঝতে পারিনি, মনোযোগ দিলে বুঝতে পারি তিনি টাইপরাইটারে তাঁর ভাবনার অনুবাদ করছেন। মাঝে মাঝে থামছেন, পাইপে টান দিচ্ছেন, ক্লিনিকের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছেন আবার খটখট শব্দে সাদা কাগজে অনূদিত হচ্ছে তাঁর চিন্তার খেলা।

লিখতে লিখতে তিনি কোলকাতার নার্সিং হোমের এই ছোটো কেবিনকে বানিয়ে ফেলেছেন টিকাটুলির বাড়ি, তাঁর ছেলের ঘর। যেন সেখানে বসেই তিনি লিখছেন, যেন লিখছেন তাঁর তিনশো বছরের আয়ুর ইতিহাস।

টেবিলে খটাখট লিখতে লিখতেই হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাচ্ছেন পেছনে, মা তাঁর পিঠে ছায়া দিচ্ছেন; কিন্তু মা তো নেই, তবু আছেন। মা আর কয়েকটা দিন বেঁচে থাকলে কী এমন হতো?

শব্দ বন্ধ হয়, তিনি পড়া আরম্ভ করেন, সম্ভবত যা তিনি লিখেছেন তা শোনার জন্য আমি ব্যতীত এ ঘরে কেউ নেই আর।

‘বিলের শিয়রে পাকুড় গাছে বসে সকাল থেকে শকুনের চোখে মণি হয়ে মুনশি সূর্যের আকাশে পাড়ি দেওয়া দেখবে, দেখতে দেখতে হঠাৎ রোদের সঙ্গে রোদ হয়ে ওম দেবে বিলের গজার আর শোল আর রুই আর কাতলা আর পাবদা আর ট্যাংরা আর খলসে আর পুঁটির হিম হওয়া শরীরে’

এটুকু বলেই থামলেন, চারদিকে তাকালেন; এই বিল, এই পাকুড় গাছ, এই মুনশি, সূর্য, এই রোদ, আকাশ, মাছেরা প্রত্যেকেই যেন তাঁর আশপাশে বসে আছে, কোনো এক শীতসন্ধ্যায় গুটিসুটি মেরে বসে থাকা কাৎলাহার বিলের মতো। আমার এই একাকী জীবনে তিনি এভাবেই আনন্দের শিরশিরানি ছড়িয়ে দেন।

আবার পড়া আরম্ভ করেন,

‘আর হয়রান হয়ে পড়লে পাকুড় গাছের ঘন পাতার আড়ালে কোনো হরিয়াল পাখির ডানার নিচে ছোটো একটি লোম হয়ে নরম মাংসের ওমে টানা ঘুম দেন সারাটা বিকেল; এরপর ফিরে যান বিছানায়, ঢলে পড়েন।

আমার ঘুম আসে না। আমি চেয়ে থাকি আকাশের দিকে, আর ভাবতে থাকি কেউ না থাকলেও অনেকেই আছেন এই নিঃসঙ্গ মানুষটির। ভাবনার কাদা দিয়ে গড়েছেন এদের, ফুঁ দিয়ে জীবন দিয়েছেন চরিত্রগুলোর দেহে, যারা একাকিত্বে কথা বলে, দুঃখে কাঁদে, আনন্দে হাসে।

আমাদের সময় কেটে যায় এভাবেই। কখনও কখনও কেউ কেউ আসেন তাঁকে দেখতে; তিনি কথা বলেন, হাসেন। কিন্তু সেই প্রাণখোলা হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকে বিষাদের বিল। কেউ দেখতে পায়, কেউ পায় না। আমিও একাকিত্ব আড়াল করা শিখে গেছি।

একদিন এক যুবক আসে বাংলাদেশ থেকে। আমার দিকে বেদনাভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে সে। নাম শাহাদুজ্জামান, হাতে তাঁর নতুন বই ‘খোয়াবনামা।’

নিজের লেখা সদ্যপ্রকাশিত বইটি হাতে নিয়ে নতুন পাতার গন্ধ নিতে নিতে তিনি ভুলেই যান, মাত্র কয়েকদিন আগে তাঁর একটি পা কেটে ফেলে দিতে হয়েছে। ভুলে যান, প্রতিনিয়ত তাঁকে তাড়া করে ফেরা মৃত্যুভয়। ভুলে যান, হাসি আর কৌতুকের আড়ালে লুকিয়ে রাখা তাঁর আজন্মের একাকিত্ব।

একা হয়ে যাওয়ার বেদনা ভুলে যাই আমিও; প্রস্তুত হই তাঁর সাথে তিনশো বছর আয়ু পাড়ি দেবার জন‌্য একপাটি স্যান্ডেল এই আমি।
 

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ