আকবরের ভাবনায় তোলপাড় চলছিল, লালন সাঁইয়ের দরগায় দোলপূর্ণিমার উৎসবে গেলে কেমন হয়! শুনেছে সেখানে বাউল বৈরাগী ফকির সাধকের মেলা বসে। রাতভর গান বাজনা হয়। সাঁইজিভক্ত সহজিয়া উদাসীনের সেই মচ্ছবে একটা রাত কাটিয়ে আসলে মন্দ কী! জ্যোৎস্নাকেও রাজি করিয়ে ফেলা গেল সঙ্গে যেতে।
খুব ভোরের বাস আধঘণ্টা পর পর মাত্র কয়েকখানা। আবার দুপুর দুটোয়। ফেরিতে যদি দেরি না হয় ওরা সন্ধ্যার আগেই পৌঁছে যেতে পারবে ছেঁউড়িয়ায়। দুপুরের গাড়িতে গেলে রাত কটা বাজবে কেউ বলতে পারে না। ঢাকা থেকে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া খুব দূরের পথ নয় কিন্তু ওদিকটায় যাতায়াত এখনো খুব-একটা সুবিধের হয় নি। লোকাল বাস না হলে প্রাইভেটে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।
আকবর জ্যোৎস্নাকে যতখানি চেনে ছেঁউড়িয়া যাওয়ার ওটুকু ঝক্কি সামলে নিতে পারবে বলে এ নিয়ে আর তেমন ভাবনা হয় না। ভাবনা হয় রাতে থাকা নিয়ে। হোটেলের বুকিং হয়েছে ফোনে। অতশত ভাবে নি সে তখন। ওখানে নাম, পরিচয় দিয়ে রেজিস্টার খাতায় কী লিখবে সে নিয়ে জ্যোৎস্নাকে কিছু বলাও হয় নি। মফস্বলের হোটেল, তা ছাড়া চেনা-জানা ওই শহরে তো কেউ নেই যার নাম-ঠিকানা বলবে। আর থাকেই যদি-বা যে মুখ নিবিড়ভাবে চেনা হয় নি তেমন অনাত্মীয় একটা মেয়েকে নিয়ে এক হোটেলে থাকার ঝুঁকিটা আকবর জানে। কিন্তু এটুকু সাহস আর সাধ জীবনে যদি না-ই থাকল!
এ অবস্থায় ওর মাথায় কিছু খেলছে না। মনের ইচ্ছাকে সফলতায় ঢেলে দিতে পারার নিটোল চেষ্টায় ইনিয়ে-বিনিয়ে তবে জ্যোৎস্নাকে কথাটা বলতেই হলো আকবরকে।
ফেরির দোতলায় উঠে সব শুনে মুহূর্তে বাইরের পৃথিবীর পিছে হারিয়ে গিয়ে মনের সকল নিস্তব্ধতাসহ জ্যোৎস্না একেবারে চুপ হয়ে আছে। মাথার ওপরে মস্ত একটা আকাশ, তাতে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ। বিস্তৃত নদীর জল ছুঁয়ে ঝিরঝির ঠান্ডা হাওয়া উঠে এসে আবার ফুরিয়ে যাচ্ছে, উঠে আসছে আবার...। ওপার বলে যেন কিছু নেই শুধু আকাশটা নেমে গিয়ে জলে ডুবে আছে! প্রকৃতির সকল আয়োজন নগরের ক্লান্তি ও হতাশা থেকে এতটা দূরে দু’দণ্ডের শান্তি এনে দিয়েছে।
আকবরও জ্যোৎস্নার কোনো বাদ-প্রতিবাদের অপেক্ষায় না থেকে বালু আর পলি-কাদার ঘোলা জলরাশির বিস্তীর্ণ শক্তিহীন স্রোতে চেয়ে থাকে। এবড়োথেবড়ো পথে প্রকাণ্ড গাড়িগুলো সাপের কুটিল গতির মতো এগিয়ে এসে জেটি ডিঙিয়ে কীভাবে জাহাজে চড়ছে জলের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে জ্যোৎস্নার এখন সেদিকটায় মন পাতা। যেমন লাবণ্যবতী, লক্ষণও তেমন মেয়েটির। এই পরিবেশে বৈদগ্ধময় অমন মুখ দেখে কিছু আন্দাজ করা বেশ শক্ত ঠেকল আকবরের।
দেখতে দেখতেই ফেরি মাঝ নদীতে। চারদিকে বিরামহীন জল ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। দোতলা-তিনতলার সিঁড়িতে যাত্রী, ড্রাইভার, ফেরিওয়ালার ওঠানামা, ঠেলা-ধাক্কা গুঁতোগুঁতির বিরাম নেই। চায়ের দোকানে মুচড়ে ওঠা ভিড়। উড়িয়ে নেওয়ার মতো হু হু বাতাস আর জাহাজের বিকট গর্জন। একেবারে পেছনে গিয়ে অফুরন্ত রৌদ্রে সূর্যের মুখোমুখি পাশাপাশি ছায়া ফেলে দাঁড়িয়েছে বলে বাতাসে শুঁটকি আর টয়লেটগুলোর বিশ্রী কড়া গন্ধ, পাটের বস্তার ঘ্রাণ, চিমনির কালো ধোঁয়া এগুলো এড়াবার উপায় নেই।
প্রপেলারের পাখায় প্যাঁচ খেয়ে খলবলানো জলের প্রবল ঘূর্ণি আর ভয়ংকর উল্লাসের দিকে অতটা উঁচু থেকে তাকিয়ে বুক কাঁপছিল আকবরের। কিন্তু জ্যোৎস্না পটুয়াখালীর মেয়ে, অন্তত শৈশব তো তার পটুয়াখালীর খালে-জলে কেটেছে। রেলিংয়ে কোমর ঠেকিয়ে নরম বিমর্ষ চোখের তন্ময়তা নিয়ে তাকিয়ে আছে সে ওই দীর্ঘ জলরোলে। কয়েকটা গাঙচিল জলের তুমুল তুফানের ওপর কখনো বুক ভিজিয়ে কখনো একটু ওপর দিয়ে জাহাজের পেছন পেছন চলছে। মুক্ত বাতাসে পত পত করে উড়তে চাচ্ছে জ্যোৎস্নার শাড়ির আঁচল। কোনা ধরে রাখায় ওড়ার সুযোগ না পেয়ে ভরদুপুরের রোদ ভেঙে দূরে দূরে উজান ঠেলে এগোতে থাকা বেঢপ নৌকাগুলোর নিঃসঙ্গ পালের পেটের মতো ফুলে উঠছে। বারবার ফুঁসতে থাকা আঁচল সামলাতে গিয়ে জলের উথাল-পাথালে নিবিষ্টতা ভেঙে যাচ্ছে জ্যোৎস্নার।
চলো, চা নিয়ে সামনের দিকটায় গিয়ে দাঁড়াই—ওর হাত ধরে মৃদু টান দেয় আকবর, কী বিশ্রী গন্ধ এদিকটায়।
আর একটু থাকি না—জ্যোৎস্নার দৃষ্টি জলের উল্লাস ফেলে বেশ দূরের সুস্থির স্রোতের নীরবতায়, কচুরিপানায় কী যেন খুঁজছে। ওই যে, ঐদিকটায় দ্যাখেন, নদীর একদম মাঝখানটায়, গাঙশালিকগুলা উড়তেছে যেখানে, পিঠ উঁচায়া ভাসছে কত বড় চর, দ্যাখছেন! ভরা জোয়ারে ওগুলা কিন্তু দেখা যায় না। নিজের মনের ভেতরকার কী যেন কী কোলাহলের আলোড়নে নড়ে ওঠে সে। একটা দীর্ঘ হাহাকার নিয়ে ওই চরের শূন্য বালুর ভূমিতে, শালিকের ওড়াউড়িতে তাকিয়ে মনটা খলখল করছে তার। ছেলেবেলায় পাড়াগাঁয়ের পথে রোদে রোদে, চরের সর্ষের খেতে, অপরাজিতা ফুলে প্রজাপতির মতো ঘুরে বেড়াবার জীবনটাকে মনে হচ্ছে।
এখন পড়ন্ত ভাটা। দেখেশুনে বেশ ধীরেসুস্থে চলতে হচ্ছে জাহাজটাকে । একটু পরে ওই চরের কোল ঘেঁসে এগোবে তারা। আকবর আবারও তাড়া দেয় কিন্তু জ্যোৎস্না নড়তে চাইছে না, বরং ওর দিকে কিছুটা সরে গিয়ে ভারী গলায় আফসোসের সুরে বলে, এই হইলো পদ্মা আকবর ভাই, যার নাকি ক‚লকিনার নাই! সারা জীবন তো শুইনা আইলেন, এইবার `অকুল দরিয়ার রূপ দ্যাখলেন তো ?
জ্যোৎস্নার পর্যবেক্ষণে আকবরের ততখানি মন আছে কি নেই বোঝা যায় না, তবে সে আলগা উৎসাহ নিয়ে দূর দিগন্তে দৃষ্টি উঁচিয়ে ক‚লকিনারা খোঁজার চেষ্টা করে। হাসতে হাসতে বলে, দেখলাম তো। আরও দেখলাম একফোঁটা চরের মতো রূপ নিয়া সেই দরিয়ার কোথায় যেন ভাসতেছে জ্যোৎস্না!
খালি গাঙ বাইলেই কি তার খোঁজ মেলে আকবর ভাই ? জ্যোৎস্নার চোখের পাতা নড়ে না। ঘাড় ঘুরিয়ে ভেজা দৃষ্টি নিয়ে এবার আকবরকে নিরীক্ষণ করে সে। মিটিমিটি হাসে। মনে মনে বলে, ব্যাটা ছেলের যা স্বভাব... মাইয়ালোক পাইলেই হইছে, খালি এইটা খোঁজে সেইটা খোঁজে, হইন্যে হইয়া খুইজ্জা মরে!
সূর্যটা আকবরের কপালে চকচক করছে। কী-একটা গান আছে না, ওই যে, কার যেন গাওয়া —কোথায় পাব কলসি কইন্যা কোথায় পাব দড়ি। তুমি হও গহীন গাঙ্গ আমি ডুইব্যা মরি। চোখ কুঁচকে জ্যোৎস্নার নিবিড় উজ্জ্বল মুখখানার দিকে চেয়ে জানতে চায় সে।
কেন, মৈমনসিং গীতিকার গান। কতজনেই তো গাইছে, আপনে কার-কারটা শুনছেন ?
কারটা শুনছি বলতে পারব না, গানের কথাগুলো মনে পড়ল।
শাড়ির আঁচলটা হাতছাড়া হয়ে নিশানের মতো তুমুল বেগে উড়ে উড়ে শূন্যে ঝাঁপ দিতে চাইছে এখন। আকবর হাওয়া থেকে আঁচলটা ধরে এনে মুঠোয় গুঁজে দেয় জ্যোৎস্নার।
খাঁ খাঁ রোদ ঢেউয়ের ওপর ভেসে আছে। দূরে ঘন কাশবন আর বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ির ওপারটা ঝাপসা হয়ে নজরে পড়ে। জেগে ওঠা পুরোনো একটা চরের এধারে ওধারে নলখাগড়া, কচুরিপানা আর কলমিলতার নিবিড় জঙ্গলঘেঁসা স্রোতে ধীবরদের বাঁশ-পোঁতা মাছ ধরার ফাঁদ। সেখানে নেংটিপরা কালো কালো মানুষগুলো নাওয়ে চড়ে দীর্ঘ জাল নিয়ে জলের সঙ্গে জোরাজুরি করছে। এক ঝাঁক টিয়া পাখি মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেলে হাতের তালুতে রোদ ঠেকিয়ে চোখ চেপে ফ্যালফ্যাল করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে আকবর।
আপনি টিয়া ভালোবাসেন ? জিজ্ঞেস করে জ্যোৎস্না। ধাবমান পাখিদের ধূসর ছায়ায় নজর রেখে বলে, টিয়া পাখির রঙটা কিন্তু দারুণ, অদ্ভুত লাল আর কী ধারালো ঠোঁট!
মেয়েদের ঠোঁটের মতোন, তাই না ? ধার দিয়ে কথাকে পাকা লঙ্কার মতো কুঁচি কুঁচি করে কী সুন্দর কাটতে পারে, বলেই কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে এবার একটু হালকা হতে চায় আকবর।
ওদের আলাপের অবলম্বনের ভেতর জীবনের সমস্ত মাত্রাহীন তরলতা যেন কঠিন দানা বাঁধতে থাকে।
হঠাৎ প্রবল এক ঝাঁকুনি খেয়ে জাহাজটা থেমে গেলে কী-একটা গোলমাল কানে আসে। জাহাজের লোকজন ছোটাছুটি করছে, যাত্রীদের অনেকে রেলিংয়ের চারধারে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে ঝুঁকে মহাউৎসাহে নদীতে কিছু-একটা খুঁজছে যেন।
ইঞ্জিনের সর্বশক্তি দিয়ে বার বার চেষ্টা করেও আর নড়তে পারল না জাহাজটা। গোটা দশেক বাস, মালবোঝাই খানকয়েক ট্রাক, ছোট-বড় প্রাইভেট, গাদাগাদা মানুষ নিয়ে বিশাল দানবটি জলরাশির নিচের চোরা চরে খামি এঁটে থাকল।
কো-টাইপের ছোট ছোট ফেরিগুলো অল্প জলে যত্রতত্র চলতে পারে কিন্তু কম করেও সাড়ে ছ-ফিট পানি না হলে ছ-ফিটের টানা ফেরিগুলোর দম আটকে যায়। চোরা চরের যে সমস্যা মাওয়া-কাওরাকান্দির কইতরখোলা-কাউলিয়ায়, নওডোবা আর হাজরার চ্যানেলগুলায়, তা দেখি এখন পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ায়ও!
এ যাত্রায় সর্বনাশ যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। জোয়ার না আসা পর্যন্ত কাদার থাবা থেকে জেগে এ তরী যে আর ভাসবে না অভিজ্ঞ যাত্রীরা তা জানে। আর জানে বলেই অনেকে এখন এদিক-ওদিক অস্থির হয়ে ফিরছে। তাদের উদ্বেগেরও যেন অন্ত নেই।
ভরদুপুরের সূর্য একেবারে আকাশের মাঝখানটায় টাটাচ্ছে। এই ডুবোচরের ভয়েই শুকনো মৌসুমে বড় ফেরিগুলো বিশাল শরীর নিয়ে অনেক দূর ঘুরে তবে পদ্মা পার হয়। ড্রেজারগুলো রাতদিন অনবরত খুঁজেখুঁজে জমাটবাঁধা পলির ঢিপি কেটে চলে। কিন্তু বিস্তৃত জলের তলায় তারা কী কাটছে না কাটছে সে হিসাব কে রাখে ? ইতিমধ্যে এই নিয়ে খণ্ড খণ্ড তর্ক শুরু হয়েছে। সে তর্ক ভারত বাংলাদেশের পানি বণ্টন, পানিচুক্তি, ট্রানজিট, করিডর হয়ে দু-তিন দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
তর্কে নেমে উত্তেজনায় কাঁপছে একজন তোতলাগোছের লোক। গলা চরচর করছে তার, নদী খুঁইড়ে হইবেটা কী বলি ? গাঙ্গে স্রোত বইবি নি ? উজানে নাহয় ইন্ডিয়া বান দিছে। আপনেরা কী করছেন ? খাল-বিল সব দখলে নিছেন। কারণে অকারণে রোড দি, কালভার্ট সেতু দি পুরা দ্যাশটারে ছাইয়ে ফেলার সময় হুস আছেলে না নি ? খাল-বিলের দ্যাশে পানির পথ বাদ দি এই উন্নোওন কার স্বার্থে, কনছে দেহি ?
পরিবেশটা গরম হতে সময় লাগল না।
ততক্ষণে ভদ্রলোকের কথা কেড়ে নিয়েছে একজন, আপনি তো মেয়া ইন্ডিয়ার দালালের মতো কতা কন!
এর মধ্যি দালালিটার কী দ্যাখলেন, হ্যাঁ ? ইন্ডিয়া কি মোক খালু লাগে যে হের দালালি করমু?
আরে থামেন মেয়া। সব একলাই বোঝেন, আর সব চদু।
চদু না তো কী। চদুই তো।
আর একজন তরুণ, কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়ে বোধ হয়, খুব শান্তভাবে বোঝাবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, কী বলতে চান আপনি, উন্নতির চাকা কি পেছনের দিকে ঘোরে ? জাতির ভালোমোন্দের কোনো হুশই নাই, বক্তৃতা দিতাছেন! দেশে রোড-ঘাট হবে না ? যাতায়াত ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ঘটবে না, না-কি ? যোগাযোগ ব্যবস্থায় একটা পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে দেশে, এই আপনাদের মতো লোকদের জন্যই...।
ছেলেটির শান্ত ভদ্রলোকি বক্তৃতায় গা জ্বলে যাচ্ছে যার সে আর চুপ থাকে কী করে। মুখ খারাপ করে বলে, বালের আধুনিকায়ন। রোড বানায়, ব্রিজ তোলে, গাঙ খোঁড়ে সব হইছে গিয়া মন্ত্রী-এমপিগো হোগা ভরার খেইল।
এত চোট নিচ্ছেন কেন ? এই মন্ত্রী-এমপিগো পিছে ঘোরেন না ? ভোট দেন না ? হুস আছে নি চুতিয়া বাঙালির! বলে ওনার চেয়ে হয়তো আরও বেশি মুখ খারাপ করতে যায় আর একজন।
ততক্ষণে তোতলা ভদ্রলোক মরিয়া হয়ে উঠেছে। এরকম যুদ্ধে দর্শকের অভাব হয় না। তাদের আমোদে ভ্রুক্ষেপ নেই তার। গলার রগ দড়ির মতো ফুলিয়ে নিজ বিবেচনার সমর্থন আদায়ে চেঁচিয়ে যাচ্ছে সে, আপনেগো পরিবত্তোনের নিকুচি করি। খাল-বিল, নদী-নালা, জমি-জিরাতের এ্যাকেকটা স্বভাব আছে, বুঝলেন নি। হ্যাতের স্বভাব ধরি না চললি হেয় আপনের শাসন মানবে নি...।
দূরের অনন্ত প্রবাহের দিকে চেয়ে জ্যোৎস্না ওদের তপ্ত তর্কে কান পেতে থাকে। গাঙচিলগুলো জাহাজের পুবে-পশ্চিমে অনবরত পাক খাচ্ছে। ইতিমধ্যে আকবর জেনে নিয়েছে, জোয়ার আসতে এখনো ঘণ্টা দুয়েক বাকি। সে হিসেবে ওপারে যেতেই আরও আড়াই-তিন ঘণ্টা। নটা-দশটার আগে ছেঁউড়িয়ায় পৌঁছানো যাবে বলে মনে হয় না।
চায়ের দোকানে তর্কাতর্কিটা ভেঙে এসেছে এখন। দুপুরের খাবার সেরে নিতে এক এক করে যাত্রীরা ভাতের হোটেলে জড়ো হচ্ছে। হাতের কাপটা নামিয়ে রেখে শাড়ির আঁচল দিয়ে নাকের নিচে জমে ওঠা ঘামবিন্দু শুষে নিতে নিতে একটু গম্ভীর হয় জ্যোৎস্না—শুনলেন আকবর ভাই, লোকটা গুছায়া কইতে পারল না, ওর কথাগুলা কিন্তু ভাববার মতো। আমাদের গাঙের চরিত্রই আলাদা, ভাটির এই গাঙের সাথে আর কারও গাঙ মেলে না। ড্রেজিং দিয়া বাঁচান যাবে এরে ? হাস্যকর। ছোটবড় কত নদী-নালা-খাল-বিলের যত জল ঘাড়ে নিয়া শত শত বছর ছুটতেছে পদ্মা। সেই পদ্মার বুকেই পানি নাই। চর জাইগা ধু ধু মরুভ‚মি। গাঙ তো না গাঙের একখান কঙ্কাল পইড়া আছে!
কিন্তু আকবরের মাথায় এসব তেমন করে ঢুকছে না। জল-নালার কী-ই বা জানে সে! বৈষয়িক মানুষের বক্র ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধিতে বিরস তার ভাবনা এখন অন্যত্র। এবং তা জ্যোৎস্নাকে বুঝতে দিতে চাইছে না সে। অত রাত করে অপরিচিত শহরের একটা হোটেলে কোন বিড়ম্বনা উস্কে ওঠে তা ভেবে কিছুটা উদ্বেগে আচ্ছন্নও আকবর। এসব নিয়ে শেষমেশ তার ফূর্তির মুডটা না মাটি হয়ে যায়।
নিশ্চিন্তে জলের নিচে পিঠ ডুবিয়ে পাল তুলে উজান ধরেছে ধান, পাট আর মসলা বোঝাই প্রকাণ্ড নাওগুলো। প্রায় পঞ্চাশ-ষাট হাত দূর দিয়ে আর একটা টানা ফেরি এগিয়ে যাচ্ছে, পেছনে ছোট্ট আর একটা। ওটার যাত্রীরা এটার বেহাল অবস্থা দেখে মৌজ মেরে, তামাশা ছুড়ে হই হই করতে থাকে। এমন বিড়ম্বনা আর আপদের কালে এটার যাত্রীদেরও অনেককে সেই তামাশায় অংশ নিতে দেখে বিরক্ত হয় আকবর। বলে, দেখছো, মাঝনদীতে চ্যাঙদোলা হইয়া আছি আর বোকাচোদা পাবলিকের কাণ্ডটা দেখছো!
মুখ খারাপ করেন কেন্ আকবর ভাই ? বিশ্রী লাগে শুনতে।
সরি, বলে ওর হাত চেপে ধরে আকবর, চলো আমরা খেয়ে নিই।
গোগ্রাসে গিলে গিলে গাঁওগেরামের যাত্রীরা মাছের কাঁটা, মুরগির হাড্ডি, থকথকে ঝোল আর ছিটকে পড়া ডাল দিয়ে এমন নোংরা বানাচ্ছে টেবিলগুলো, মাছি ভন ভন করছে। বোটকা গন্ধভরা ভেজা ত্যানা দিয়ে মুছেটুছেও তেমন জুত করতে পারছে না ছেলে-ছোকরাগুলো। এক ধরনের ঘিনঘিনানিসহ জ্যোৎস্নাকে নিয়ে ওরই মধ্যে এক কোনায় জানলার পাশে বসে পড়ে আকবর।
তাতানো রোদ থাকলেও গরমটা তেমন নয়। তবু ইলিশ ভাজা আর মুরগির ঝাল-ঝোলে নেয়ে উঠেছে ওরা। শুধু দরদর করে ঘামছেই না, রীতিমতো হাঁসফাঁসাচ্ছে। ফেরির খাওয়া এমনই, খেতে খেতে ভাবে আকবর, এদের রান্নায় কী একটা মাজেজা আছে, একবার খেলে আর ভোলা যায় না। কেন্টিনের ছেলেটা ক্ষিপ্র হাতে কাঁচামরিচের পিরিচটা এগিয়ে আর এক পেয়ালা গরম ডাল ঢেলে দিয়ে যায়। জ্যোৎস্না ভাজা পেঁয়াজ আর নিজের ভাগ থেকে ইলিশ টুকরোর আধখানা আকবরকে তুলে দিয়ে বলল, মুরগির ঝোলটা আর নিয়েন না আকবর ভাই, যে হাল হয়েছে আপনার।
আরে দিচ্ছো কেন, খাও খাও, পদ্মায় বসে পদ্মার ইলিশ, বাড়িতে পাবে ?
জ্যোৎস্নার বিশ্বাস হতে চায় না যে এটা এই নদীর মাছ, পেটির একটা লম্বা কাঁটা দুই ঠোঁটের মাঝ থেকে টেনে বার করতে করতে বলে, এমনও তো হইতে পারে এইটা পটুয়াখালীর ইলিশ। তা ছাড়া পদ্মার হইলেই কি ? ইলিশের স্বাদ-গন্ধ আছে কিছু ?
আকবরের পটুয়াখালী-পদ্মার জ্ঞান দুর্বল হলেও এটা সে বুঝতে পারে, মাছের মজা যেন মিইয়ে যাচ্ছে আজকাল।
গড়ানো বেলার আধখানা রোদে কেন্টিনটা খাঁ খাঁ করলেও কেমন একটা সোনালি আভায় পৃথিবীর ঘাস নদী মানুষের মুখ রঙিন হয়ে উঠেছে। মালিকের চেয়ারে কুণ্ডলী পাকিয়ে পরম আলস্যে চোখ মুদে রয়েছে একটা বেড়াল। অন্নভোজের পর পড়ন্ত দুপুরে অমন আলস্য আসে বাঙালির। জাহাজজুড়ে এখন সেই অলসতার ভার। অকস্মাৎই দোতারার টুং টাং মিহি আওয়াজে মধ্যগাঙের বিষণণ্ন নির্জনতা কেঁপে উঠল।
চা-বিস্কুটের দোকান যেখানে ঠিক তার বাঁ পাশের খোলা জায়গাটায়, উল্টে রাখা আধখানা ড্রামের ওপর বসে বাবরি চুল আর গোঁফ-দাড়িতে আচ্ছন্ন এক উদাস মানুষ মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে দোতারার তারে টোকা দিচ্ছে আর তাতেই গুমরে গুমরে উঠে আসছে ওই আওয়াজ। ড্রামের গা ঘেঁসে গুটিয়ে রাখা একরাশ মোটা দড়ির ওপর আসন নিয়েছে তার উন্মনা সঙ্গিনীটি। চোখ মুদে মৃদু তাল দিচ্ছে হাতের খঞ্জনি ঠুকে। দুয়ের গলায়, হাতের কব্জিতে ছোট-বড় দানার নানা রঙের মালা। রং শাদা হলেও নারীটির মলিন শাড়ি আর পুরুষটির ফতুয়ার ওপর কারুকাজের মতো ফুটতে পেরেছে ওই মালা-মঞ্জুরি।
ভিড় জমতে সময় লাগল না। দেখতে দেখতেই আসর জমে উঠল।
ইতিমধ্যে জটলা ঠেলে গভীর আগ্রহে মেয়েটির পাশে জায়গা করে নিয়েছে জ্যোৎস্না। আকবরও দাঁড়িয়েছে ওর পেছনটায়। উত্তরা বাতাসে গলা ছেড়ে দিয়েছে লোকটা। তার চোখের কোণে সুরের ধ্যান দেখা দিয়েছে। গাইছে সে, সহজ মানুষ ভজে দ্যাখ না রে মন দিব্যজ্ঞানে/ পাবিরে অমূল্য নিধি বর্তমানে... গাইছে আর থেমে থেমে কী-এক তাড়না থেকে যন্ত্রটার তারে যেন নিজের অন্তরটাকে খুঁড়ে যাচ্ছে সে!
ছোটবেলা থেকে দোতারা বাজিয়ে নানাভাইয়ের গাওয়া ভাওয়াইয়া, মুর্শিদি শোনা কান জ্যোৎস্নার কাঁচা নয়, তবুও লোকটির গলার হাহাকার, দেতারার এমন আর্তনাদ খুব বেশি শোনে নি সে। গাইয়ে লোকের চোখের মধ্যে সুরের যে অগ্নিকোণ থাকে তার আঁচে পুরো পরিবেশ আচ্ছন্ন করে গোটাচারেক গাইল সে। পরে যন্ত্রটা কপালে ঠেকিয়ে যখন বিনীত হলো কী বলবে ভেবে পেল না জ্যোৎস্না।
মৌজ পেয়ে পুরো আসর অধীর হয়ে আছে, আরও খানকয়েক হোক কিন্তু আবারও জড়ো করা দুই হাত কপালে ঠেকিয়ে সঙ্গিনীর দিকে একবার চাইল লোকটা। বলল, আর থাক, ছেঁউড়িয়ায় সাঁইজির চরণে রাইতভর গাইব যে। সাধুসঙ্গ হবে।
শুনছি বারোয়ারি মাইনষের ভিড়ে সাধুরা নাকাল হইতেছে। সত্য ?
মানুষের আগ্রহ বাড়ছে, তা তো বাড়বেই কিন্তু সেই ভক্তি সেই আদি ভাব আর নাই। বড় বড় কোম্পানি কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢালতেছে। সব মডার্ন হচ্ছে। সাঁইজির আখড়া তো এখন মাজার। উৎসবের নামে মেলার মচ্ছব! কী আর বলব, চটোকে জগৎ মেতেছে, মা।
ওদের উঠতে চাওয়ার পথ আগলে জ্যোৎস্না অনুনয়ের সুরে বলল, আমরাও যাইতেছি সাঁইজির দরগায়, বসেন না আরেটটু, কথা কইতে কইতে চা খাই।
গান আর হচ্ছে না দেখে মুহূর্তে দর্শক পাতলা হয়ে এসেছে। সঙ্গিনীসহ ধীরে ধীরে উঠে পড়ল লোকটি। অচঞ্চল চোখে চেয়ে থেকে কোমল গলায় বলল, তেষ্টা নেই যে মা জননী। চারদিকে অফুরান জল আর কী খোলা হাওয়া, সম্মতি দেন তো ঘুরে দেখি। শুনে ওর সমস্ত হৃদয় কেঁপে উঠল যেন। ওদের দিকে আনমনে নির্নিমেষ তাকিয়ে থেকে জ্যোৎস্নার মনে হলো, সৃষ্টির পথে পথে যে বিরাট সুন্দর আর বিস্ময় তারই অন্য এক আরাধনায় মজে আছে এরা। এদের স্বাভাবিক গতি আর সহজ চলাচলে জীবনের সাড়া আছে ঠিকই, কিন্তু কোথাও কোনো তাড়া নেই।
আকাশটা এত কাছে আর ঝকঝকে নীল যেন হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে দেখা যাবে। জোয়ারের চাপে স্রোতের বেগ থিতু হয়ে এলেও মাটির থাবা থেকে জাহাজখানা ভেসে ওঠার মতো জল এসে গাঙে জমে নি এখনো। অনেকটা দূর দিয়ে আরও কয়েকটা ফেরি এল গেল। পালতোলা বড় বড় নৌকাগুলোও নিশ্চিন্তে চলে গেছে। কিন্তু দিকচিহ্নহীন মধ্যগাঙে এভাবে আটকে থেকে ভরা বাতাসের মধ্যেও কেমন দমবন্ধ লাগে আকবরের। তার ওপর সেদ্ধডিম, ঘটিগরম চানাচুর আর বাদামওয়ালার যন্ত্রণায় দুজনে যে নিরিবিলি দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ কথা বলবে এখানে এখন আর সে উপায় নেই। সময় যতই গড়াচ্ছে এদের উৎপাত বেড়ে যাচ্ছে ততই। এসবের মধ্যে একটু পর পর ফোন আসছে আকবরের। চরম বিরক্তি নিয়ে বারবার একটু দূরে সরে গিয়ে ফোন ধরছে সে, নিচু গলায় ধমকাচ্ছে, ঢাকায় কি বাচ্চাদের পেছন পেছন থাকি আমি ? তখন সামলাও না ? বাড়ির বাইর হইছি আর উপর্যুপরি ফোন দিতাছো।
ফোনের ওপার থেকে উড়ে আসা অযাচিত উদ্বেগে কিছুটা বিমর্ষতা ভর করলেও এ অবস্থায় জ্যোৎস্নার আমোদে উৎসাহী না হয়ে পারে না আকবর। ভিড়ভাট্টার তোয়াক্কা না করে গুনগুনিয়ে দু-এক লাইন গাওয়ার চেষ্টা করছে জ্যোৎস্না। আবারও আকবরের ফোন বেজে উঠতেই নির্মমভাবে রিংটোনের গলাটা চিপে দেয় সে। বলে, আর পারি না বুঝলা, পাগল নিয়া থাকি। দম ফেলতে দেয় না। বাচ্চা দুইটাও হইছে মাশাল্লা!
বলেন কী আকবর ভাই, আপনার বউ পাগল!
না তো কী। কোনোখানে যাওয়ার জো আছে! হাজারটা প্রশ্ন, হাজারটা ফ্যাকরা। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে একই প্যাঁচাল। বাদ দাও তো, চলো একটু নিরিবিলি বসি কোথাও।
যত বড়ই হোক একটা টানা ফেরিতে তেমন নিভৃতি দুর্লভ। একতলা দোতলা ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে তেতলার একেবারে পেছনে চলে এল ওরা। ফেলেরাখা কেরোসিন কাঠের কতগুলো খালি বাক্সের পাশে ছাদে ওঠার বন্ধ একটা সিঁড়ির নির্জনে জ্যোৎস্নাকে নিয়ে দাঁড়াল আকবর। তোমার গলা তো খুব মিষ্টি। গুনগুন করছিলে যে, গাওনা সে গানটা, আকবরের অনুরোধ উপচে পড়ে।
কী যে বলেন, আমার আবার গান!
তার মানে ? হাসিবের ছেলের জন্মদিনে না গাইলা তুমি ?
ওইটা গান গাওয়া হইলো, ফুর্তির দিন, সবার লগে চেঁচামেচি করলাম।
আরে দাম বাড়াইয়ো না। মিলি আমাকে বলছে তো, তোমার নানার কাছে গান শিখছো।
একটা হারমোনিয়াম কেনার সামর্থ্যও আছিলো না আমাগো। নানাভাইর কাছে কিছুদিন শিখছিলাম ঠিক। তারপর কোথায় ওস্তাদ, কোথায় গান, কোথায় কী! বাতাসের তুমুল ঝাপটায় ওর দীর্ঘশ্বাস আড়াল করার চেষ্টা আকবরের শ্রবণ এড়িয়ে যায়। হাওয়ার বেগ ঠেলে আবারও গুনগুনিয়ে ওঠে জ্যোৎস্না।
আকবর বলে, আরে ভাই, গান গাইলেই গায়ক-গায়িকা হইতে হবে এমন কোনো কথা আছে? সুন্দর গলা তোমার তাই বল্লাম। এই যে ওনারা গাইলেন, তোমার কি মনে হয় কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়া গাইছেন ?
ওর কথায় জ্যোৎস্না একটু সচেতন হয়ে উঠল যেন। বলল, আপনে জানেন না, গুরু পরম্পরায় গায় ওনারা ? তা ছাড়া গান তো গায় না তারা। আমার নানাভাই কইতেন, ওরা যা বিশ্বাস করে, যা অন্বেষণ করে সুর-তাল-লয়ে ধইরা ধইরা তাই-ই উচ্চারণ করে। তাই-ই তাগো গান। গানই তাগো জিকির। বলতে বলতে জ্যোৎস্না হৃদয়ের কেমন একটা পীড়িত আবেগে আটকে গিয়ে চুপ করল।
চমৎকার হাওয়া বইছে। চারদিক আঁধারে জড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসতে দেরি নেই। শাড়ির আঁচল কোমরে প্যাঁচিয়ে ক্লিপ দিয়ে আটকানো খাটো চুলের খোঁপাটা ছেড়ে দিয়েছে জ্যোৎস্না। এক ফোঁটা শিশিরবিন্দুর মতো নাকফুল, লালটিপ, দুল, কমলার কোয়ার মতো টসটসে ঠোঁট বাতাসের ঝাপটায় উদ্ভ্রান্ত চুলের আড়ালে এই লুকায় তো এই বেরিয়ে পড়ে। অনেকক্ষণ ওই রূপের দিকে হাঁ করে অন্ধের মতো তাকিয়ে থাকে আকবর। এক সময় মনের সমস্ত অন্ধতা অতিক্রম করে ছুঁয়ে দিতে লোভ হয় তার। কিন্তু কাকে ছোঁবে সে ? জ্যোৎস্না অবাক বিস্ময়ে চেয়ে আছে বালুর ধু ধু সীমা ছাড়িয়ে দূর দিগন্তে বিস্তৃত জলরাশির অপার প্রবাহে, বুজে আসা রোদের শেষ আলোয় নিঃসঙ্গ চরে। মন থই থই করছে হয়তো, চোখ ছলছল করছে ওর। আর জ্যোৎস্নার এই নিস্তব্ধতার পীড়া কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না আকবরের।
গনগনে চুলা থেকে তুলে আনা লোহার বলের মতো সূর্যটা ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে জলে। ঝাঁক বেঁধে কোথা থেকে এসে কোথায় ফিরে যাচ্ছে পাখির দল। একঝাঁক যাচ্ছে তো পেছনে আর একঝাঁক, তারপর আবার...।
আকাশজুড়ে কাঁচা হলুদের রং ছড়িয়ে দিনের শেষ আলোটুকুও নিভছে এবার। জোয়ার এসে ভরে উঠছে গাঙ। কুড়োভাসা স্থবির জলের মৃদু ঢেউয়ের ওপর কলস ভরে ওই আলোর অনেকখানি যেন ঢেলে দিয়েছে কেউ। মানুষের চোখ স্নিগ্ধ করে রাখবার জন্যেই কি এই রং দিয়ে পৃথিবীটাকে এমন সরস করে তোলা হয়েছে ? পানির পর্দায় এমন নিসর্গশোভা আকবর এর আগে আর দেখে নি কখনো। ফলে কিছুটা অধীর হয়ে ওঠে সে। বলে, দারুণ, পৃথিবীর সব রং আর সব পাখি বুঝি জড়ো হয়েছে ওখানে!
দেখতে দেখতেই আঁধার হয়ে এল। কিছুটা দ্বিধায়, জড়তায় সন্ধ্যালগ্ন হয়ে পড়ল তারা। জ্যোৎস্নার কোমরে হাত রেখে ঘনিষ্ঠ হলো আকবর। বুঝে হোক কি না বুঝে পুরুষের এই স্পর্শ আলগোছে সরিয়ে দেয় জ্যোৎস্না। কিন্তু যা অবুঝ, অবাধ্য কী দিয়ে তাকে বোঝাবে সে! মননের পৃথিবীটা এড়িয়ে ভোগের উল্লাস কি তবে চরচরিয়ে উঠল আকবরের! তার আঙুল আবারও জ্যোৎস্নার পেটের মসৃণতায়, নাভীমূলের কোটরে পিঁপড়ের মতো হেঁটে হেঁটে কোমরের ভাঁজে চেপে স্থির হলো।
এতটা নৈকট্যের কারণে বাতাসের অস্থিরতায় বিলি কেটে ছড়িয়ে পড়া নারীগন্ধ মগজে ঘাই মারে আকবরের। জ্যোৎস্নার এলোমেলো চুল থেকে, শরীরের সবটুকু সুষমা নিংড়ে আসছে গন্ধটা। ফরফর করে উড়তে থাকা চুল শুঁকে শুঁকে ওর তালুতে নাক ঘষে আকবর।
কোমর জড়িয়ে ধরা বাঁ হাতের মৃদ সঞ্চরিত আঙুলের তলায় একটা ধাতব স্পর্শে হঠাৎই সমস্ত মনোযোগ স্থির ওর। তেমন কিছু নয়, শাড়ির দু-এক পরতের নিচে চিকন তাগায় লটকানো ইঞ্চিখানেক একটা মাদুলি। বস্তুটির স্পর্শে আকবরের মন গভীরভাবে নিবিষ্ট হলে জ্যোৎস্নার নির্লিপ্ত ঠান্ডা কণ্ঠস্বরে কেপে ওঠে সে। বলে, ওটা রক্ষাকবচ আকবর ভাই। কবচ-টবজে আমার আস্থা নাই, আম্মায় দিছে তাই পরি।
স্বতঃস্ফূর্ত বাকপটু আর রকমসকম জানা জ্যোৎস্না শীতল আর নিস্পৃহতা নিয়ে আকবরের কাছে আচমকা কেমন অচেনা হয়ে ওঠে। অন্ধকারের ভেতর তার অসীম আশ্চর্য দুটি চোখ বিস্ফারিত করে বলে, আপনারে কোনোদিন বলা হয় নাই, না! আব্বার মৃত্যুর কথা ? নানাভাইর মৃত্যুর মাস দেড়েক পর হঠাৎ একদিন আব্বাও চইলা গেলেন। আমারে আর আমার ছোটভাইটারে নিয়া আম্মায় তখন দিশাহারা। জীবনের অন্ধকার ঘাঁটতে ঘাঁটতে নিস্তব্ধ তিক্ত অবসন্ন মানুষটার মনের ভয় আর যায় না। ভয় একটা রোগ, সেই রোগ পরানে জড়ায়া আছে তার। বানের জলে খড়-কুটার মতোন যখন যা পায় আঁকড়ায়া ধরে। বুঝলেন আকবর ভাই, তাবিজ-তুবিজ, ঝাড়ফুঁক এগুলা আমার মায়ের অবলম্বন... বলতে বলতেই নিজের কথার আড়ালে আপনা থেকে হারিয়ে যায় জ্যোৎস্না। এক দূর অতীত পৃথিবী থেকে মাকড়সার জালের মতো ছিঁড়ে এসে তার কথাগুলো, ধূসর স্মৃতিগুলো চোখে চুলে জড়িয়ে যায়। ছলছল দৃষ্টি সম্মুখের সবকিছু ঝাপসা দেখে।
...দেবর-ননদদের সঙ্গেও তো কোনো সম্পর্ক ছিল না মায়ের। না থাকলেও আস্বাদের সৌন্দর্য নিয়ে যে জীবন, যে জীবন শান্তি নিয়ে, শত অভাব-অনটনেও বাবা বেঁচে থাকতে মা হয়তো তার দেখা পাইছিলেন। কিন্তু বাবার অবর্তমানে কোথায় টাকা, কোথায় পয়সা, কী খাবে, থাকবেই বা কোথায় ? বাচ্চাদের লেখাপড়ারই বা কী হবে ? একেবারে `অকুলপাথারে আছাড়ি-পিছাড়ি!
সেইসব পরিচিত ধূসর দিনগুলোর ওপর হাঁটতে হাঁটতে জ্যোৎস্না এখন আঁধারে তলানো জলের ওপর হঠাৎই যেন তার মা-ভাইয়ের মুখ ভেসে উঠতে দেখল।
...ওই তো, পিতৃহারা, স্বামীহারা তার মা তখন দূরসম্পর্কের এক ভাইকে নিয়ে একটা কাজের ধান্দায় হন্যে হয়ে ফিরছেন। বললেই কি আর কাজ হয় তবু ছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে নিরন্তর ছুটে বেড়াচ্ছেন। দ্বারে দ্বারে ধরনা দিচ্ছেন। সারা দিনের ছোটাছুটির পর এসে প্রায় দিন গোসলঘরে ঢুকে আর বেরোতে চাইতেন না। যখন বের হতেন, তার ঘন দীর্ঘ ভেজাচুল আর থমথমে ফরসা মুখের ওপর নিঃশব্দে কেঁদেকেটে ফুলিয়ে ফেলা টলটলে চোখ দুটো যেন ডাহুকের চোখ।
কাজ করতে করতে একা একা নিজের সঙ্গে কথা বলা মার অভ্যাস। একদিন সে বেদনাকুঞ্চিত মুখে বাসন মাজতে মাজতে সেভাবেই গজগজ করছিলেন, ...এতো ডলি মরার শরীর থেইকা পুরুষ মাইনষের গন্ধ আর যায় না!
পড়ার টেবিলে বসে অংক কষছিল জ্যোৎস্না। সবকিছু থেকে আলগা হয়ে কথাটা তিরের মতো গিয়ে কানে বিঁধল যেন তার। মনে হলো ভাই-বোন মিলে মরে গেলেই তো পারে, মার বোঝা কমে।
আর এখন রক্তমাংসের স্পন্দন নিয়ে, অতীতের সকল নিষ্পলতা ডিঙিয়ে কেমন আছে জ্যোৎস্না? যেমনই থাকুক আজ নিজের এক ফোঁটা সামর্থ্য স্বপ্ন আশা ভরসা বিশ্বাস তো আছে। ভাবতে তো পারছে, না মরে যে ভালোই হয়েছে, মরে কী লাভ!
জ্যোৎস্নার চোখ ছেড়ে চোয়াল বেয়ে নোনতা জল কখন নেমে পড়েছে থুতনিতে আকবরের তা চোখে পড়ে নি। সন্ধ্যার গাঢ় অন্ধকারের ভেতর একটা আচ্ছন্ন বাবলার চারার মতো দাঁড়িয়ে আছে সে। সব মিলে চোট খাওয়া একটা আবহে উছলে ওঠা অবাধ্য তাড়না তার থমকে গেছে, প্রাণের উৎসাহ নিভে গেছে, শিথিল হাত অন্ধকারের ভেতর গুটিয়ে আসছে। চাপা বিমর্ষতার বোঝা সরিয়ে কিছুতেই যেন চাঙ্গা হয়ে উঠতে পারছে না সে। আর ঘটনাটা ঘটে তখনই।
ওদের মাথার ওপরেই ছিল ভেঁপুটা, একটা প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে জাহাজের ইঞ্জিন চালু হতেই নেভানো সব বাতিগুলো জ্বালিয়ে বিকট আর্তনাদে বেজে উঠল সেটা। কান ফাটানো, বুক বিদীর্ণ করা আকস্মিক ওই আওয়াজে আতঙ্কিত ভীত হতভম্ব জ্যোৎস্না শিশুর মতো নিয়ন্ত্রণহারা শরীরের সবটুকু ওজন নিয়ে প্রায় ঝড়ের বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কোনো কিছুর জন্যই প্রস্তুত ছিল না আকবর, একই পরিস্থিতিতে দ্বিতীয়বার ভেঁপুটা বেজে উঠবার আগেই ওকে বুকের মধ্যে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে সে।
ঝিনুকের মতো ম্লান আলোয় পূর্ণিমার আকাশ ফরসা হয়ে উঠতে এখনো অনেক বাকি। ওপারে দৌলতদিয়ার ঘাটও আর দূরে নয়, মাঝদরিয়া থেকে যা ছিল আবছায়ার মতো, সন্ধ্যার ঘোর অন্ধকারে জ্বলে ওঠা শত আলোয় এখন তা স্পষ্ট। এদিকে ফেরির ঝকঝকে বাতিগুলোর দীর্ঘ দীর্ঘ জ্বলজ্বলে ছবি ছুটতে ছুটতে ঢেউয়ের ওপর থরথরিয়ে কাঁপছে। এই ক’ঘণ্টার বিরতিতে এলিয়ে পড়া যাত্রীরা তীরে পৌঁছার তাড়নায় টানটান হয়ে আছে। নিজেকে এখনো সামলে নিতে পারেনি জ্যোৎস্না। আকবর ওর হাত ধরে বসে আছে। ভাবছে, আর না যাই ছেঁউড়িয়ায়, ফিরতি ফেরিতে বাড়ি ফিরলেই তো হয়।
1 মন্তব্যসমূহ
পারভেজ হোসেনের গল্প পড়ে মুগ্ধ হয়ে থাকতে হয় অনেকক্ষণ।উনার গল্পসমগ্র-১ অর্ডার করেছি নেটে একটি গল্প পড়ে।
উত্তরমুছুন