নাহার মনিকা'র গল্প : টেক্কা



কেউ জোর করছে না।

তবু তুহিনের মনে হচ্ছে- ফাঁদ। অতিকায় ঘুড়ি বা শামিয়ানার মত শুধু তার উদ্দেশ্যে নেমে আসছে। যেন সে একটা ফাঁদের মধ্যে আটকে পড়া ঘুঘু, এক চুলা গনগনে আগুনে সম্পূর্ণ অনিচ্ছায় ঝাঁপ দেবে, আর প্যারৎ প্যারৎ শব্দে মূহূর্তে শরীর পুড়ে ছাই।

এই যে নিজের মধ্যে ঘুঘুভাব বোধ হচ্ছে, সেটা নিয়ে সে বসবে কোথায়, আর কি করে সেখান থেকে উড়ে যাওয়ার গন্তব্য ঠিক করবে! এসব সিদ্ধান্ত নিতেও তো সুস্থির হয়ে বসা দরকার।

নদীর পাড় ঘেষে একটা বিশাল পাথরের ওপর সবসময় বসে তুহিন, বসে নিজের চিন্তা সংহত করে। এখন তাজ্জব হয়ে দেখে, পাথরটা নেই! এই পাথর কবে যে এসেছিল, সে হিসেবের কোন গাছ পাথর নেই। সেটাকে সরানোর জন্য ক্রেন না হোক, জনা চল্লিশেক মানুষতো লাগবেই।

জগদ্দল পাথরটা মাথায় নিয়ে ঝড়ে বাসা ভেঙ্গে যাওয়া পাখির মত পাক খাচ্ছে শুধু।

পাথর বলতে তো আর সত্যি সত্যি পাথর না। এখানে সদরঘাটে হাজার রকম যানবাহনের ক্যাচালে বুড়িগঙ্গার পাড়ে পাথর টাথরের বালাই নেই, সেটা কি সে জানে না? জানে। তারপরও ওই পাথর তো তার সঙ্গে থাকে, যায় যেখানে তুহিন যায়। সুতরাং পাথরের কথা মাথায় থাকে তার। ছোটবেলায় একবার কোথাও দেখে থাকবে। কোথায় সেটাই কি ছাই মনে আছে! তবে ঐ বিশাল পাথর দেখে তার খুব ভরসা হয়েছিল। মনে হচ্ছিল যে ভেতরে অশেষ নিরেট নিয়ে পাথরটার অনেক সহ্য করার ক্ষমতা। কত মানুষ এসে উঠছে, বসছে, খোদাই করে নিজেদের নাম লিখছে, বন্যার পানি, ঝড় তুফান কিছুতেই কিছু যায় আসে না পাথরটার।

নিজেকে অমন একটা পাথরের মালিক ভাবলে কি ক্ষতি! কিন্তু সে ফুরসৎ এ মুহূর্তে কোথায়! কিন্তু আজকে যে ঘটনার মধ্যে সে আটকা পড়েছে তাতে পায়ের তলা থেকে পাথর সরে যাচ্ছে।

পকেটের টাকা তুহিনের আগেও গেছে, কিন্তু খরচপাতি ছাড়া এভাবে একদম নাই হয়ে যাবে, এ যে কল্পনার সীমা অতিক্রম করে গেল! বাসে উঠেও তো ব্যাগটা হাতিয়ে দেখেছে। ছিল, পেটমোটা দুটো খাকি খাম ছাড়া আর কিছু ছিল না ভেতরে। এখন ব্যাগটা হাওয়া ছেড়ে দেয়া সাইকেলের টায়ারের মত। সময় ঠিক কখন তার সঙ্গে এই বিটলামী করলো, ঠাহর করতে চেষ্টা করতে হচ্ছে দেখে তুহিন নিজের ওপর খাপ্পা হয়ে ওঠে।

মহাখালি থেকে সদরঘাট বাসে। গত ক’দিন পুরো টিমের কেউ সি এন জি বা উবার নিচ্ছে না। রাস্তায় টহল। থামিয়ে জিজ্ঞাসা, তল্লাশী।

বাসে তো সে হামেশাই চড়ে। নেহাৎ সঙ্গে সাপ্লাই থাকলে উবার, পাঠাও এইসব নেয়।

লঞ্চে কেবিন বুক করা নাই। দরকার মনে করেনি। ঝাড়া হাত পা একজন মানুষ, সঙ্গে গাট্টিবোচকা কিছু নাই, শুধু একটা কাঁধফেরতা ষ্ট্যাপ লাগানো চৌকোনা ব্যাগ, যেখানে পেটমোটা খামদুটো রাখার পরে আর কিছু তেমন আটে না। ষ্ট্র্যাপ ঘুরিয়ে পেটের ওপর ঝুলতে থাকলে সেটাকে নিজের শরীরের অংশ বলেই মনে হয় তুহিনের। কোনমতে লঞ্চের ডেকে উঠে বসলেই হলো। তারপর দাঁড়ালো, কি বসতে পারলো সেটা কোন ব্যাপার না। তার চলনে আর চেহারায় যে ফেউ ভাব আছে, তাতো, তুহিন জানে, মানুষ বুঝতে পারে না যে তার ঐ র‍্যাক্সিনের ব্যাগে ঠিক কি পরিমাণ লেন দেন হয়।

কিন্তু হিসাবে একটু ভুল হয়েছিল। কেবিন বুক না করে আসা ঠিক হয়নি। লঞ্চে উঠতে গিয়ে তুহিন দেখে ঢোকার মুখে সুনামি ধেয়ে আসার মত ভীড়। ঈদের ছুটি ঠিক আছে, পরিবারের সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয়নি, সেটাও মানা যায়। কিন্তু আগুনের দিকে পতঙ্গ যেভাবে ধেয়ে যায়, নদীর দিকে মানুষগুলি ঠিক তেমন করে যে ধেয়ে যাচ্ছে, এরা কি সব সাঁতার জানে? তুহিনের তাজ্জব লাগে। আর এত কিছুর ভেতরে তেলেসমাতির মত ব্যাগের দু দুটো খাম একসঙ্গে উধাও! পেছনের পকেট কিংবা পাঞ্জাবীর পকেট হলেও কথা ছিল।

এর নাম কি শুধু বিপদ? একদম নয় নম্বর বিপদ সংকেত। আকাশে ভয়াল মেঘের ঘনঘটা, বাতাসের ঘূর্ণিপাকে নিজেকে হারিয়ে ফেলার উপক্রম হচ্ছে।

নিজের শৃগাল চোখের ওপর অগাধ বিশ্বাস তুহিনের। পিঁপড়ারও সাধ্য নাই সে দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে তার সামনে দিয়ে যায়। সেটাই তার শক্তিশালী অস্ত্র, যা দিয়ে সে তার ময়দানে লাগাতার বিজেতা। পার্টি যদিও তাকে সরাসরি চলে যেতে বলছিল, কিন্তু তুহিন নিজের বিবেচনায় চলা মানুষ, ঝুঁকি নিতে চায় নি। সে ঘুরপথ করার জন্য আগে লঞ্চে কিছুদূর গিয়ে তারপর বাস বা ট্রেনে চড়বে।

টাকা তো আজকে নতুন নিজের কাছে রাখে না সে। মালিক না হলেও একমাত্র যা কাছে রাখতে সুখ লাগে তা বোধহয় টাকা পয়সা। টাকা পয়সার দিকে তার হাত স্বয়ংক্রিয়ভাবে দীর্ঘ হয়ে যায়।

অভ্যাসটা তুহিনের ছোটবেলা থেকেই, মানে যখন থেকে টাকা পয়সার দরকার-অদরকার বুঝতে শুরু করেছে।

মনে আছে, তাদের ফ্রি প্রাইমারী স্কুলের পিকনিক।তুহিনের ক্লাস ফাইভ।এক’শ টাকা চাঁদা। জমা দিতে হবে মোয়াজ্জেম স্যারের কাছে। পিকনিকের চাঁদা খুব আগ্রহ করে নিয়ে গুনে গুনে পকেটে রাখেন।তার কাঁচা পাকা গোঁফের নিচে হাসিমুখ।

তুহিন বাড়িতে ঘ্যান ঘ্যান করে টাকা এনেছে। দশটাকার দশটা নোট। যখন স্যার নাম লিখছিলেন, সে দাঁড়িয়ে নিজের নাম বলেছে। পরের দিন টাকা জমা দেয়ার কথা। পিকনিক শুক্রবার। মাত্র চারদিন বাকি। এর মধ্যে কতকিছুর যে ব্যবস্থা করতে হবে! খাসি কেনা, পোলাওয়ের চাল, ঘি, মসলাপাতি, নাস্তার আয়োজন। সবচে বড় কথা একটা আস্ত বাস ভাড়া করতে হবে। স্যারের হাতে রোলটানা খাতা। তাতে সব হিসাব নিকাশ লিখতে লিখতে মার্জিনে ছোট ছোট ফুলপাতা এঁকে রাখে স্যার। টেবিলের পাশে গিয়ে ছাত্ররা উঁকি মেরে দেখে।

স্যার তুহিনকে বলেন- ‘কইরে তুহিন্যা টাকা আইঞ্ছত নি’?
-‘স্যার, কালকে দেই’?
-‘ক্যান আইজকের দিন কি দুষ কইরচ্ছে’?
-‘আজকে স্যার সকালে বৃষ্টি ছিল, আব্বা দোকানে ছিল, আমি দোকানে যেতে পারি নাই’।
-‘ক্যান ফাইরলি না। বাসায় ছাত্তি আছিল না’?
-‘না, স্যার’।
-‘তাইলে বৃষ্টির ফাঁক দি ফাঁক দি ছলি যাইতি। পিকনিকের টাকা আইজগে না দিলে আইঁ কইত্তে ছাগল কিনমু? স্যারে তো হের ফকেট থেকি ফইসা দিতে ফারবো না’।

তুহিন গাঁইগুই করে হাফপ্যান্টের পকেট থেকে দুমড়ানো নোটগুলো বের করে।
-‘তাইলে যে বইললি ট্যাকা নাই’
-‘স্যার আব্বার কাছ থেকে কালকে নিয়ে আসছিলাম’।
-‘তাইলে আগে দিলি না ক্যান?’- স্যারের চোখে বিস্ময়।
-‘স্যার, টাকা পকেটে থাকলে ভালো লাগে’- তুহিনের শরীরটা ছোট হয়ে যায়। লাজুক, বিব্রত হাসি হাসে।

টাকা যে রাখতে শুধু ভালো লাগে তা না, হাতে টাকা পেলে সে যত্ন করে তার মায়ের নাম লিখে রাখে। দশটাকার দশটা নোটের গায়েই সে ক্ষুদে অক্ষরে লিখে রেখেছে তার মায়ের নাম। তুহিন জানে টাকা মানুষের হাত থেকে হাতে, পকেট থেকে পকেটে করে দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ায়। ঘুরতে ঘুরতে যদি তার মায়ের হাতে গিয়ে ওঠে, তাহলে নিজের নাম লেখা দেখে মা কেমন খুশী হয়ে উঠবে! তখন নাম লেখকের খোঁজ পড়লে কি তেলেসমাতি কান্ডই না হবে!

তাকে নিয়ে বিস্মিত হাসি হাসতে হাসতে, ক্লাসের সবার হাসির রোলে মোয়াজ্জেম স্যার টাকার ওপরে তুহিনের সইসাবুদ খেয়াল করে না।

সেই থেকে বন্ধুরা ক্ষ্যাপাতে শুরু করলো, কিপটা। পকেটে ট্যাকা থাকলে ভালো লাগে।

আচ্ছা, আবালের দল! তুহিন মনে মনে গজরায়- টাকা পকেটে থাকলে কার না ভালো লাগে? আছে এমন কোন হালার পো হালা, যে বলবে, না রে ভাই। পকেটে ট্যাকা থাকলে ভাল্লাগে না। মনে কয় বিলায়া দেই। আছে কোন সমুন্দির পুত? নাই। ত্রিভূবনে নাই।

ত্রিভূবন শব্দ মনে আসায় তাদের ছোটবেলায় রোজার দিনে সেহরী কাফেলার গান মনে আসে। ত্রিভূবনের প্রিয় মোহাম্মাদ, আমার কামলিওয়ালা কামলিওয়ালা। ভোররাত্রে মা ঠেলে তুহিনকে উঠিয়ে দিতো। তারপর নিজে লাকড়ির চুলা জ্বালিয়ে ভাত বসাতো। তুহিনের আলস্য লাগতো। তারপর মায়ের বিরতিহীন ডাকে একসময় উঠে পড়তে হতো। বাইরে উঠানে ওশ পড়া মৃদু ফিকে অন্ধকার। টিউবওয়েল চেপে মুখ ধুতে গেলে আম্মা সবসময় হ্যারিকেন নিতে বলতো। তুহিন নিতো না। সে তো এমনিই দেখতে পায়, এমনিতেই একলাফে ঘরের চৌকাঠ থেকে কলপাড়ে গিয়ে পড়তে পারে।

-এমনিই দেখতে পাস?
-হু পাই তো!

মা পাড়া প্রতিবেশীর কাছে ছেলের তীব্র দৃষ্টিশক্তি নিয়ে গর্ব করে। চাঁদ উঠলে উঠানে বই নিয়ে বসে যায় তার ছেলে। পাঠ্যবইয়ের ছোট অক্ষর তার কাছে স্পষ্ট তারার মত জ্বল জ্বল করে।

কিন্তু স্যারের ঐ বাক্যটা তার মাথায় গেঁথে গেল।‘বৃষ্টির ফাঁক দি ফাঁক দি ছলি আইসতি'।

বৃষ্টির এক ফোঁটার সঙ্গে আরেক ফোঁটার ব্যবধান আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু সেখানে তুহিনের শরীর গলিয়ে, না ভিজে আসা যাওয়া করতে হলে জাদুকর হতে হবে। নিজেকে হয় অদৃশ্য, নয়তো অণু পরমাণুর মত ক্ষুদ্র বানিয়ে ফেলতে হবে। কিন্তু সে ম্যাজিক আয়ত্বে আসার কোন উপায় কি আছে?

বৃষ্টি হলে, অথবা না হলেও বৃষ্টির ফাঁকে ফাঁকে যাতায়াতের জাদুকরী ভাবনা তুহিনকে ছাড়ে না।

তারপর বড় হতে হতে সে আবিস্কার করে, বৃষ্টিফোঁটার মধ্যের গ্যাপে একটা জিনিসই অনায়াসে আনা নেওয়া, যাওয়া আসা করতে পারে তা হচ্ছে চোখের দৃষ্টি। সাঁই করে যায় এবং কোন রকম গা ভেজানো ছাড়াই ফিরে আসে।

বৃষ্টির ফোঁটার দিকে তুহিন কত দিন নির্নিমেষ তাকিয়ে থেকেছে। বুঝতে চেষ্টা করেছে তাদের পতন, পতনোন্মুখ বিস্তার। ঠিক কতটুক ফাঁক রেখে তারা মাটি ছোঁয়, এবং নিজের বৃত্তের বাইরে ছড়ায়। এক পর্যায়ে সত্যি সত্যি নিজের দৃষ্টিকে একটুও না ভিজতে দিয়ে বৃষ্টির ভেতর পার করে দিতে শিখে গেল তুহিন। বৃষ্টির ফোঁটার রকমফের ও স্বাতন্ত্র্য বুঝে সে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারতো।

তুহিন তার বোঝাপড়াটা কাজে লাগাতে গিয়ে দেখে ওর চোখ শার্দুলের মত হয়ে উঠছে। দিনের বৃষ্টি কোন ছাড়, রাতের বেলাও বৃষ্টির মধ্যে পরিস্কার দেখতে পায় সে। বৃষ্টির ফোটার মধ্যবর্তী ব্যবধানে মানুষ যে কত কী করে ফেলতে পারে, দিনকে রাত করতে আর সূর্যকে পশ্চিমে উদয় করে দিতে পারে,  এতদিনে তুহিন সেসবের হাড়মজ্জা জেনে গেছে।

আজকে সেই তুহিনই কি না এমন ভ্যাবাচ্যাকা ধরা খেয়ে গেল!

নারী পুরুষ, শিশু বৃদ্ধের কাফেলা লঞ্চের সিঁড়ি বেয়ে অতিকায় সরীসৃপের মত উঠে যাচ্ছে। ভীড়ের ভেতর তার শেয়ালের মত চোখ অতি দ্রুত গতিতে ঘুরপাক খা।

এইসব মানুষের পরস্পর থেকে পরস্পরের মধ্যেকার ব্যবধান তো বৃষ্টির তুলনায় বিস্তর।

এই যে লঞ্চের জন্য ভীড়ের মানুষগুলো পরস্পরের গা বাঁচিয়ে ছুটছে তাদের মধ্যে কোন ভিন্নতা নেই কেন! সবাই একরোখা, রেয়াতছাড়া, ভাবলেশহীন। ছোটার নেশায় মত্ত। তুহিন কি করে শনাক্ত করবে কোন হারামীর পয়দা তার ব্যাগের মধ্যে রাখা বড় বড় পেটমোটা খাকি খামদুটো হাপিস করে দিলো?

এখন ওই পাথরটার ওপর বসে মনসংযোগ নিয়ে চিন্তা করা কী যে দরকার!

কিন্ত পাথরটাও তেলেসমাতির মত উধাও! এর মধ্যে বুড়িগঙ্গা নদীর পাড় ভেঙ্গে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের খবর আসেনি তো! কে জানে হয় তো তেমন কিছুই হয়েছে। সে কি আর খবরের কাগজ খুঁটিয়ে পড়ে? না টিভির সামনে বসে থাকার বান্দা। সরকারী বুলডোজার এসে পাথর উচ্ছেদ করার চেয়ে নদীর জোয়ারে ভেসে গেলে তুহিন বেশী খুশি হবে। ভেসে ভেসে যদি পাথরঘাটা গিয়ে থামে তাহলে তো কথাই নেই।

কবে যেন বাপের সঙ্গে কোন চেনা লোকের কথাবার্তায় সে শুনেছিল যে তার মা পাথরঘাটায় আছে।

আচ্ছা, লাইলিদের দেশের বাড়িও কি পাথরঘাটা না!

হ্যা, হ্যা। ওর বাবা তুহিনদের স্কুলের কাছেই তো বাসা ভাড়া নিয়েছিলো প্রথমে। সহসা স্কুলের সহপাঠী লাইলির কথা মনে আসে। হাত সাফাইয়ের এমন পারদর্শী কারুকাজ তো একমাত্র লাইলির পক্ষেই সম্ভব। যে কি না সেই ক্লাস এইটে থাকতে পিকনিকের চাঁদার বাক্স থেকে টাকা সরিয়েছিল, স্বয়ং স্যারও টের পায়নি। বরং খরচের হিসেবে টান পড়লে মোয়াজ্জেম স্যারকে আবার অংক শিখতে উপদেশ দিয়ে সীমাহীন বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন হেডস্যার। আর লাইলিকে কে সন্দেহ করবে? ক্লাসে ফার্ষ্ট হওয়া মেয়েকে কেউ করে না কি এসব সন্দেহ? মোয়াজ্জেম স্যার তো পারলে তুহিনকেই খপ করে ধরে ফেলে, কেন না তার টাকা পয়সা নিজের পকেটে রেখে দেয়ার শখ। তল্লাসী হলো সব ছাত্রদের প্যান্টের পকেটে, শরীরে। কারো কাছে পাওয়া গেল না। শেষমেষ হেডস্যারের ধমক খেয়ে নিজের পকেট থেকে হারানো টাকা ভর্তুকি দিলেন মোয়াজ্জেম স্যার।

তুহিন সেদিন স্কুল ছুটির পরে বুদ্ধি করে বাপের চুড়ি-ফিতার দোকানে হাজিরা দিয়েছিল। এমনিতে বাপ ডেকেও কুল পায় না। সেদিন তুহিনের ভাগ্য ভালো, নাকি তার বাপের ভাগ্য, কে জানে! সে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাপ ক্যাশের দায়িত্ব তাকে দিয়ে কি একটা কাজে প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে গেল। এত সহজে খোলা ক্যাশ বাক্স আয়ত্বের মধ্যে। উত্তেজনায় সোজা হয়ে বসে তুহিন। তক্কে তক্কে থাকে কখন সবার চোখ এড়িয়ে এক মুঠ খুচরো পয়সা হাফপ্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে ফেলবে।

এমন সময় লাইলি দোকানে এসে ঢোকে, এটা সেটা দেখতে চায়। তুহিন বের করে করে দেখায়। লাইলি লিপষ্টিক, নেইলপালিশ পছন্দ করে। কানের দুল পছন্দ হয় না। টিপের পাতা নেড়ে চেড়ে দেখে।

টাকা নেয়ার সময় তুহিনের মুখ হা হয়ে যায়। প্রতিটা দশটাকার নোটের কোনায় তার মায়ের নাম লেখা। একদম দশটা নোটই লাইলি দিয়েছে।

বাইরে তখন হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামে। তুহিন দোকানের ভেতর থেকে বৃষ্টি ফোঁটার পরস্পরের দূরত্ব মাপার চেষ্টা করে। আরো দু একজন লোক বৃষ্টির ছাঁট বাঁচাতে দোকানে এসে ঢুকেছে। লাইলির পরের কাষ্টমার তুহিনের সামনে।

তুহিন লাইলির হাত থেকে টাকাগুলো নিয়ে সোজা নিজের পকেটে চালান করে দেয়। মায়ের নাম লেখা টাকা দোকানের ক্যাশবাক্সে দেখলে তার বাপ ক্ষেপে যেতে পারে। যে ক্ষ্যাপাটেপনা দিয়ে সে বৌ তালাক দিয়েছে, তা দুনিয়ার মানুষের কাছ থেকে শুনে শুনে তুহিনও জানে।

হঠাৎ বৃষ্টির মধ্যে লাইলিকে বের হতে দেখে তুহিনও দ্রুত বেরিয়ে আসতে চায়, কিন্তু হাত যত দ্রুত লম্বা করা যায়, মাথা ততটা যায় না। সে কাস্টমার সামলিয়ে যখন বের হয় ততক্ষণে বৃষ্টি ধরে এসেছে, আর তার মধ্যে রাস্তার দু’পাশের ইলেক্ট্রিক খাম্বা, ঝুলন্ত তার, দোতলার কার্ণিশ, জানালার গ্রীল এসব একের পর এক টারজানের মত খপাখপ ধরে ধরে লাইলি প্রায় উড়ে উড়ে চলে যাচ্ছে। সেদিন নিজের হা হয়ে যাওয়া মুখ নিজের দু’হাত দিয়ে চেপে বন্ধ করেছিল তুহিন।

তবে এতকিছু যে সে দেখে ফেলেছে লাইলিকে কিছু বুঝতে দেয়নি। বললে কি হতো সে জানে না। কিন্তু লাইলিকে স্কুলে স্যারদের কাছে ধরিয়ে দিতে ভয় লেগেছে তার। এমন না যে সে কোন ডাকাবুকো মেয়ে। কিন্তু কি যেন একটা আছে, ওর চোখ চরকির মত ঘোরে। এই মেয়েও কি ‘বৃষ্টির ফাঁক দি ফাঁক দি’ যাওয়া আসার কসরত করে? কে জানে! তবে লাইলি যে সহজ জিনিস না তা তুহিন নিশ্চিত জানে।

একদিন স্কুলের পরে বাড়ি যাওয়ার বদলে লাইলিকে দূর থেকে অনুসরণ করেছে তুহিন। স্কুলের গলি থেকে সদর রাস্তায় উঠে কোথায় যেন নিরুদ্দেশ হয়ে যেতো মেয়েটা। ক্লাস নাইনে উঠে আর স্কুলে আসেনি।

পরে কতদিন লাইলির কথা মনে পড়তো। এমন এলেমদার একজন মাত্র ক্লাস নাইনে উঠে আর স্কুলে আসলো না!

অবশ্য তুহিনও আর স্কুলে যায়নি। বাপটা পট করে মরে গেলে কি আর ফ্রি স্কুলের হেডমাস্টার বাড়িতে খোঁজ নিতে আসে? আসে না।

আরো দেখা গেল, ঐ মনিহারী দোকান বাপের একলার ছিল না। তার পার্টনার সবকিছু জবরদখল নিলে তুহিনের চেহারায় ফেউ ভাব দেখা দিতে শুরু করলো।

সেসব তো গেল গোড়ার কথা, তখন তুহিনের নদীতে কতটুকই বা পানি যে কোথাকার জল কোথায় গিয়ে গড়াবে। বেশীদূর গড়ালো না, তার আগেই শুকিয়ে গেল, যেন এক ট্রাক বালিতে দুই বালতি পানি।

কিন্তু আজকে, এই এখন যে সে নদীর ওপরে সাহারা মরুভূমিতে দিকহারা হয়ে ঘুরে ফিরে মরছে তার কি হবে? স্যুটকেস ব্যাগ, ফলের ঝুড়ি, প্ল্যাস্টিকের প্যাকেট, ফেরিওলা, বোরখা, সালোয়ার শাড়ি পাঞ্জাবী শার্টের মিছিলের মধ্যে হতভম্ব দাঁড়িয়ে তুহিন একটু বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করে। বৃষ্টিফোঁটার মধ্য দিয়ে সে ঠিক ঠিক কিছু একটা দেখে ফেলতো। ঠিক লোকটাকে কলার ধরে দুই ঝাঁকি দিয়ে টাকার খাকি খামদুটো ঝড়িয়ে নিতো।

কিন্তু কোথায় বৃষ্টি, কোথায় কি? সূর্য যেন আরো তেতে উঠছে।

টার্মিনালের ভেতর একটু ঘুরে দেখবে ভেবে লঞ্চ থেকে নেমে পড়ে তুহিন। আর ঐ পাথরটারও হদিস করা দরকার। কিন্তু লঞ্চ যদি এর মধ্যে ছেড়ে দেয়?

দোনোমনা করে নেমেই পড়ে। হনহন করে টার্মিনালের এমাথা থেকে ওমাথা যেতে লোকজনের ধাক্কা বাঁচায়।

হঠাৎ লঞ্চের সিঁড়িতে একজনকে দেখে চমকে ওঠে তুহিন। ওড়না দিয়ে মাথা ঢাকা থাকলেও চিনতে এক মুহূর্ত ভুল হয় না তুহিনের। জোড়া ভ্রু, ছোট কপাল, মাজা রং, মনে হচ্ছে যেন তুহিনের দিকে তাকিয়ে হাসছে। লাইলি!

লঞ্চটা ছেড়ে দিচ্ছে।

তুহিন কষে একটা দৌড় দিয়ে লঞ্চের সিঁড়িতে উঠতে চায়। কিন্তু বাচ্চাকোলে এক মহিলা, তার পাশে বোরখা পরা মা বা শাশুড়ির হাত ধরা দুটো ছোটশিশু, পাশের লোকের হাতের ব্রীফকেইস, ব্যাগ, আর একবাক্স বিস্কুট চানাচুরের ব্যারিকেড ভেঙ্গে ধাক্কা বাঁচিয়ে দ্রুত ওপরে ওঠা সম্ভব হয় না। তুহিন প্রাণপণে এগিয়ে কাছে পৌঁছাতে চেষ্টা করে। লাইলির ঝাড়া হাত পা, সঙ্গে কোন ব্যাগ ট্যাগ নেই। পরনে লম্বা ঢোলা কামিজের ভেতরে কি টাকা ভর্তি খাম দুটোর অস্তিত্ব লুকিয়ে রেখেছে সে? বৃষ্টিভেদ করে দেখার চোখ তুহিনের আছে, কিন্তু বস্ত্রভেদী দৃষ্টিশক্তি সে কোথায় পাবে! চিৎকার দিতে গিয়েও থেমে যায় সে।

টার্মিনালের সঙ্গে লঞ্চের দূরত্বটা ছুটে যাওয়া কোন ট্রেনের সঙ্গে প্ল্যাটফরমের মত কেবল বেড়েই যাচ্ছে।





লেখক পরিচিতি
নাহার মনিকা
গল্পকার। কবি। অনুবাদক।
কানাডায় থাকেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. গল্পটা শেষের পরেও পাঠকের হাতে নাটাই ধরা গল্প। ফাঁকফোকরে নিজেই গল্প বানিয়ে নেওয়া যায় - এমন গল্প। যে গল্প পড়ার পরেও মনের কোণে ছায়া সরায় না সে গল্প আমার কাছে ভালো গল্প। Nahar Monica কে অভিনন্দন। আমি ভাবছি কেন? কীভাবে ? কে?

    উত্তরমুছুন