অনিশ্চয় চক্রবর্তী(১৯৬২) এক বোধের গল্প বলেন। এক সুস্থ পৃথিবীর সন্ধানে যান। হিংসা, ক্লেদ, বিচ্ছিন্নতা, আমাদের বিবেক ও চেতনা শূন্যতা থেকে শুভ বোধে ফিরে যান। তাঁর নির্মিত চরিত্ররা আত্মযন্ত্রণা, নষ্ট সমাজের দংশনে ক্ষতবিক্ষত হতে হতে আত্ম উপলব্ধির চেতনায় ফিরে যায়। জীবনানন্দের নায়কের মতো নিজেই নিজের বিসর্জন রচনা করে না, বরং এই আলো পৃথিবীর স্বপ্ন দেখে। অন্ধকারের বিপরীতে দাঁড়িয়ে, সমস্ত নষ্ট পদাবলির হাত থেকে বাঁচতে, বাঁচাতে বিপন্নতা, অস্থিরতা অতিক্রম করে পৃথিবীর সহজ সরল জীবন স্বপ্নে, বিশ্বাসে ফিরে যায়। আত্মস্বার্থ মানুষের হীনচেতনা, স্বার্থমনস্কতা সমাজ, সময়, প্রজন্মকে ক্রমেই ধ্বংসের মুখে নিয়ে যাচ্ছে, সেখানে কেউ কেউ সুস্থ পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেন, দেখান। সমাজ, পরিবেশ, ইতিহাস ক্রমেই মানুষকে অসুখগ্রস্ত করে তুলছে। এই রসায়নিক প্রক্রিয়া থেকে মানুষকে বাঁচতে হবে। মধ্যবিত্ত মন, আত্মক্ষয়ী বিবেক, এলিট জীবনচিন্তা, আপাত আত্মলোলুপ অহংকারী জীবন বিন্যাস যে কতখানি ভুল নর্মাল লাইফের ক্ষেত্রে তা অরণ্যের স্রষ্টা জানেন। সহজ লোকের মতো আর কে চায় বাঁচিতে, কে চায় নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখিতে। ‘আমি’র দংশন ক্ষত নায়ক ক্রমেই ডুবে যায় চোরাবালিতে। এতে কোনো বিবেক দংশন নেই। ফলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ভুলভুলাইয়া জগতে বিচরণ করতে করতে সুস্থ বোধ, জীবনস্বপ্নগুলিই ভুলে যায়। শিকড় থেকে বিচ্যুত হয়ে প্রজন্ম নতুন ইতিহাসে বিভোর থাকে। যার সঙ্গে উত্তরাধিকারের কোনো যোগ থাকে না, যা আমাদের সুস্থ স্বাভাবিক ঐতিহ্যকে বহন করে না। ‘জন্মের অসুখ’ গল্পে একদিকে ভাঙাচোরা মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের ভাঙন, তার বিপরীতে লেখকের নির্মিত অরণ্যের যাবতীয় ভাবনা-চিন্তা ও সুস্থ পৃথিবীর স্বপ্ন দেখা। অরণ্যরা জীবনসূত্রের ধারক ও বাহক। পূর্বপুরুষের উত্তরাধিকারকে উত্তরপুরুষে বহন করে দিয়ে যাচ্ছেন। যে নিজেই একদিন বাবা বলে ডেকেছিল কাউকে, সে আজ বাবা ডাক শোনার অপেক্ষায়। অথচ পৃথিবী ক্রমেই স্বার্থমগ্ন, অস্থির, জীর্ণ হয়ে চলেছে। সেই জীর্ণতা থেকে নতুন শিশুকে বাঁচতে হবে, কেননা ইতিহাস মানুষের। মানুষই ইতিহাস নির্মাণ করে। লেখকের বিশ্বাস সে ইতিহাস হোক সুস্থ পৃথিবীর, শুভ চেতনার।
অনিশ্চয় চক্রবর্তী আখ্যানকে চেতনার রাজ্যে উপনীত করেন। আমাদের অস্তিত্ব-অস্তিত্বহীনতা, সম্পর্ক-সম্পর্কহীনতা মিলিয়ে এমন এক বয়ান নির্মাণ করেন যেখানে ব্যক্তির অনুভূতি, চেতনা পৃথক স্বর ক্ষেপণ করেও মনস্তত্ত্বের অতল প্রদেশে হারিয়ে যায় বা নিজেই নিজের পৃথক সত্তা প্রতিষ্ঠা করতে অগ্রসর হয়। এরা কেউই জয়ী বা পরাজিত নয়। সুখ-দুঃখের আপাত আনন্দ-বেদনা হয়ত আছে, তবে তা অতিক্রম করে নিজেই নিজের অস্তিত্ব, বোধ, চেতনা, মন, চাহিদা সম্পর্কে হাজারো প্রশ্ন উত্থাপন করে। ঠিক-ভুলের অস্তিত্ব প্রমাণে কেউই অগ্রসর নয়, মনে কদচিৎ সন্দেহ জন্মে, তবে নিজের বোধকেই সত্য বলে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ‘স্পর্শকাতরতায়’ গল্পে দুই পুরুষ এক নারী ফ্রেমে রেখে আখ্যানকে লেখক মনস্তত্ত্বের গভীর প্রদেশে নিয়ে যান। প্রতিটি মানুষের অনুভূতি, জীবনচিন্তা পৃথক পৃথক। দাম্পত্য জীবনে যৌনতা আছে, কিন্তু যৌনতাকে অতিক্রম করেও মানুষ খোঁজে ভালোবাসার অতল স্পর্শ, পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা, বিশ্বাস, শ্রদ্ধা। যেখানে তা নেই সেখানে কেবল শরীর নিয়ে বাঁচা যায় না। শরীর তো কেবল রাতের উপভোক্তা, তা বাদ দিয়েও দিনের অনেকটা সময় বাকি। দিনই যেন রাতের যৌন জীবনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার অব্যর্থ পরিসর। ‘সন্তানের জন্ম দিতে-দিতে যাহাদের কেটে গেছে অনেক সময়’ জীবনানন্দের এই বাক্য মনে রেখেও বলা যায় সন্তান ধারণের ঊর্ধ্বে নারীর পৃথক অবস্থান আছে। জয়দীপ স্ত্রী পিউ এর কাছে শুধুই সন্তান কামনা করেছে। পিউ এর পূর্বের স্বামী সুজিত সন্তান অপেক্ষা দাম্পত্য জীবন উপভোগ করতে চেয়েছিল। সুজিতের কাছে যৌনতা স্পর্শের বিষয়, অনুভূতি, সম্পর্কের বন্ধন দৃঢ় করার পদক্ষেপ। জয়দীপের কাছে যৌনতা শুধুই সন্তান ধারণের স্থায়ী পথ। সুজিতের মৃত্যুতে পিউ হাত ধরেছিল জয়দীপের। আসলে পুরুষ স্পর্শ চেয়েছিল। কিন্তু সেখানে যে এতো যন্ত্রণা লুকিয়ে আছে জানা হয়নি—
“রাগ হত নিজেরই শরীরের ওপর। যেন তার শরীরের সমস্ত জাগরণ মিথ্যা, শুধু শিহরণটাই সত্য। যেন তার শরীর শুধু নিতে জানে, দিতে জানে না। যেন তার শরীরের কোনও গ্রহণ থেকে জন্ম হয় না কোনও প্রাণের। শুধু শরীরের জন্যই বুঝি, তার শরীর। আবরণে, আবরণহীনতায় ঘৃণা আসত নিজেরই শরীরের ওপর।” (স্পর্শকাতরতায়, গল্প পঁচিশ, অনিশ্চয় চক্রবর্তী, একুশ শতক, কলকাতা-৭৩, প্রথম প্রকাশ, বৈশাখ ১৪২১, পৃ. ৪৬)
আজ নিঃসঙ্গ বিছানায় পিউ স্পর্শহীনতায় ভুগছে। রাতের অন্ধকারে অতীত স্পর্শের অনুভূতি মনে শিহরণ তোলে। চোখ থেকে ঘুম ছিনিয়ে নেয়। সমস্ত চেতনা লুপ্ত হয়ে গেলে ঘুম আসে। অনিশ্চয় চক্রবর্তী চরিত্রের গভীর স্তর থেকে রক্ত মাংস সহ যাবতীয় অনুভূতি বের করে আনেন। মানব বোধের শীর্ষ স্তরে পৌঁছে ব্যক্তি মানুষের প্রবণতা, প্রবৃত্তির কেন্দ্রবিন্দু থেকে কী কী রহস্য উদ্ঘাটন হতে পারে তা আখ্যানে সজ্জিত করেন। মানব মনের বিবিধ প্রবৃত্তি, অনুভূতি, স্বপ্ন-স্বপ্নভঙ্গ, স্পর্শ-স্পর্শকাতরতা, স্পর্শের স্মৃতি নিয়ে অনিশ্চয় চক্রবর্তীর আখ্যান পরিকল্পনা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লেখক নিজেই কথক। গদ্যের জাদুতে চরিত্রগুলির বিবিধ অনুভূতি, মস্তিস্কজাত ভাবনা, জাগতিক জীবনের রহস্য এমন এক বয়ানে এমন মাত্রায় নিয়ে যান যা স্বতন্ত্রতার দাবি করে। গল্পপাঠের পর বহুক্ষণ মাথায় রেশ থেকে যায়। আমাদের জাগতিক জীবনে এমন বহু মুহূর্ত আছে যা মানুষ বহুদিন ধরে বয়ে বেড়াতে পারে। তেমনি সেইসব বহু মুহূর্ত থেকেই জন্ম হয় একাধিক স্মৃতির। সেইসব স্মৃতি বারবার ঘোরাফেরা করে ব্যক্তির বোধে, চেতনায়। এক স্মৃতির ছিন্নসূত্র যেন বন্ধন গড়ে দেয় অন্য স্মৃতির। সেই স্মৃতিই বারবার স্বপ্নে ফিরে আসে। স্বপ্নের জাগরণে স্মৃতির সঙ্গে শরীর এসে যায়। ‘স্বপ্নকাতরতায়’ গল্পে বুবুনের পরিচয় ‘স্বপ্নক্লান্ত এক মানবী’। বুবুনের জীবনে বয়ে চলা কিছু ঘটনার বিচ্ছুরণ স্বপ্নে ভেসে আসে। এই বিন্যাসকে ভিন্নমাত্রায় নিয়ে গেছেন গল্পকার অনিশ্চয় চক্রবর্তী। সহজাত দক্ষতায় মানব দর্শনের গভীর প্রদেশ থেকে তাঁর চরিত্ররা নির্মিত। কেউ উদ্ভট নয়। নেই কোনো বিক্ষিপ্ত বা অসমান্তরাল চেতনা। সবই আপতিক, আমাদের জীবনেরই ঘটনাপ্রবাহ। কিন্তু সেই ঘটনার যে বহু অতলন্ত, বহুমুখী বিন্যাস থাকে, তা যে ছড়িয়ে পড়তে পারে বহুকোণে, মানুষ বেঁচে থাকে সেই বহু দীর্ঘশ্বাস নিয়ে, সেইসব জীবনচেতনা ও ভাবনাবিশ্বকে অন্যমাত্রায় উত্তীর্ণ করেন অনিশ্চয় চক্রবর্তী। জীবনকে তিনি এমন রসদে ব্যাখ্যা করেন, অসম্পূর্ণ, অসফল প্রবণতা থেকে সফল প্রবণতায় উত্তরণের এমন পথ আবিষ্কার করেন যা এক বোধে নিয়ে যায়। তাঁর চরিত্ররা ব্যর্থতার জন্য কাউকে দায়ী করে না, সমাজের বিরুদ্ধে বিতৃষ্ণা উগড়ে দেয় না, বরং নিজেই নিজের বেঁচে থাকার পথ খুঁজে নেয়। তাঁর আখ্যানে ব্যক্তি নিঃসঙ্গ হয়ে যায়, নিঃসঙ্গতার মধ্যেই খুঁজে পায় জীবনের নতুন সোপান। গদ্যের জাদুতে বিষাদঘন পরিত্রাণহীন ব্যর্থ অনুভূতি হয়ে ওঠে মায়ামায়—
“কোনও একটি স্বপ্নেও যদি লেগে যায় গ্রহণ, তা ছড়িয়ে যায় জীবনের বাকি সব স্বপ্নের নিভৃতির মধ্যেই, তখন, পাখির কলরবহীন বনভূমির মতো পড়ে থাকে ব্যক্তির জীবন, পাতাহীন গাছের মতো অস্তিত্বে টিকে থাকে ব্যক্তির সমস্ত যাপন। কখনও বা ভেঙে পড়ে সমস্ত প্রতিরোধ আর আয়োজন, সংগঠন।” (স্বপ্নকাতরতায়, তদেব, পৃ. ৫৭)
অনিশ্চয় চক্রবর্তী সারাজীবন ধরে আয়ত্ত করেছেন সংযম, সংবেদন, সহিষ্ণুতা শব্দগুলি। শুধু আয়ত্তই নয় জীবনচর্চায় প্রয়োগ করেছেন, জীবনের মূলধন হিসেবে বেছে নিয়েছেন। রাজনীতি, পার্টি, জীবনের সর্বত্রই এই শব্দগুলিকে জীবনবীমা করেছেন। এই শব্দগুলির ব্যবহারিক প্রয়োগে তিনি ধনী। সেজন্য বহু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, নেমে এসেছে মিথ্যার গ্লানি। তবুও তিনি লক্ষে অবিচল। আদর্শকে জীবনচেতনা, জীবনবোধ বলে তিনি মান্য করেন। ‘প্রতিপক্ষতায়’ গল্প তিনপুরুষের আখ্যান। দাদু-পিতা-সন্তান। কথকই ন্যারেটর। এক আশ্চর্য আদর্শবোধের গল্প, প্রাত্যহিক জীবনের স্থুল অসহিষ্ণুতা ত্যাগ করে জীবনচর্চার আদর্শ পরিমণ্ডল। সন্তান হয়ে উঠছে পিতার প্রতিপক্ষ। পিতা সাহিত্যিক হয়েও যে গুণগুলির অভাব ছিল তা পুত্র অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে চান। পিতা সাহিত্যিক হয়েও মাতার লক্ষ্মীর পাঁচালিতে অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করেছে। যা পুত্রের মনে শিল্পচর্চার ফাঁকগুলি স্পষ্ট করে দেয়—“শিল্প তো তাঁকে শেখাচ্ছে না, সহিষ্ণুতা, অন্যের প্রতি, অন্য মতের প্রতি সম্মান। শিল্প-সাহিত্যের প্রতি আমার শ্রদ্ধা বা ভরসা যে নেই খুব একটা, তার বড় কারণ তো এটাই।” (প্রতিপক্ষতায়, তদেব, পৃ. ৬৩) তবে পিতার আলমারিতে থাকা বহু বই পড়েছিল সে। পরে লাইব্রেরি থেকে বহু বই এনে পড়ে পিতা-পুত্র মিলে জ্ঞানচর্চা করেছে। জ্ঞানচর্চা মানুষকে বৃহৎ করে, মুক্ত করে। অনিশ্চয় চক্রবর্তীর ‘আমার অকমিউনিস্ট’ জীবন পড়লে বোঝা যাবে কমিউনিস্ট পিতা কীভাবে পুত্রকে জীবনচর্চার পথ দেখিয়ে দিচ্ছেন। পুত্র ভালোবেসে বিবাহ করেছে শ্রাবণীকে। সন্তান মাল্যবান পিতার প্রতিপক্ষ। এ নিয়ে মাতা শ্রাবণীর রাগ, অভিমান। এই কাহিনিকে ফ্রেমে রেখে লেখক জীবনচর্চা, সন্তান মানুষ করার এক আদর্শ বৃত্তান্ত রচনা করেন। পারিবারিক জীবনচর্চায় একটি সন্তানের ব্যক্তিত্ব কীভাবে গড়ে উঠতে পারে তা আবিষ্কার করেন। প্রাত্যহিক জীবনচর্চায় ক্লেদ আছে, মাতার অভিমান আছে, পুত্র পিতার প্রতিপক্ষ বলে মাতার অভিযোগ আছে, ব্যক্তির সংকট আছে, তবুও পিতা উত্তর দেন না। উত্তর দিতেই পারেন কিন্তু আদর্শ পিতা থেকে বিচ্যুত হয়ে অন্ধকার রচনা করতে চান না। অনবদ্য গদ্যে লেখেন—
“গ্রীক ট্র্যাজিডির নায়করা যেমন নিজেরই রক্তের ভেতর বহন করে নিজেদের সর্বনাশের বীজ। ওরা বলে, প্রতিটি মানুষেরই নাকি ওটা নিয়তি। আমিও টের পাই, আমার রক্তপ্রবাহে, ওই বীজ বয়ে বেড়ানোর পাশে সভ্যতার সব অর্জন মিথ্যে। ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব, সমাজতন্ত্র, গ্লাসনস্ত সবই মিথ্যে। অর্থহীন। মাঝে মাঝে সেই চেতনাপ্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন এক শরীরে জোটে তবু শ্রাবণীর উত্তাপ। আবার আবার।” (তদেব, পৃ. ৭১)
অশুভ, অসচেতনার অন্ধকার তিনি আখ্যানে দূর করতে চান। সভ্যতার সমস্ত অন্ধকারের মধ্যেও একটু আলোকবর্তিকা জ্বালিয়ে দিতে চান। সেই ছোট্ট পৃথিবীই অনিশ্চয়ের আখ্যান জগৎ। রাতের নক্ষত্রখোচিত আলোময় ভূমিতে বা দিনের সূর্যদেবের বিকশিত পৃথিবীতে চরিত্রের বিকাশ ঘটান। তাঁর সৃষ্ট চরিত্ররা হয়ে ওঠে আলো পৃথিবীর সন্তান। মনের অন্ধকার নানাভাবে দূর করার সচেষ্টায় সদা নিমগ্ন।
(২)
অনিশ্চয় চক্রবর্তীর গল্পে প্রবেশের আগে ‘আমার অকমিউনিস্ট জীবন’ পড়ে নিলে পাঠকের কাছে গল্পবলয় স্পষ্ট হবে। নিজে রাজনীতি করেছেন, পার্টির দায়িত্ব সামলেছেন, মিছিল, প্রচারে গিয়েছেন, পার্টির হয়ে কলম ধরেছেন। সব কিছুতেই ছিল নিষ্ঠা, আত্মত্যাগ, বিশ্বাস, আদর্শ, সংবেদন, সংযম, সহিষ্ণুতা, যুক্তিবোধ। মার্কসবাদ পড়ছেন জ্ঞানচর্চার সোপান হিসেবে, মার্কস, লেলিনকে জীবনের ধ্রুবতারা হিসেবে জীবনের চরমতম পথ পেরিয়ে এসেছেন। তবুও তাঁর কমিউনিস্ট হওয়া হয়নি। কমিউনিস্ট পার্টির মধ্য দিয়ে সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখেছিলেন, ধীরে ধীরে পার্টির দুর্নীতি, অন্যায়, অবৈধ কার্যকলাপ, মূর্খামি, সংকীর্ণতা দেখে মনে হয়েছিল এরা কখনোই কমিউনিস্ট হতে পারে না। গল্পের নাম ‘আত্মজিজ্ঞাসায়’। কেন ও কিসের আত্মজিজ্ঞাসা? কাকলি ও তাঁর স্বামী সারাজীবন কমিউনিস্ট পার্টি করে চলেছে। ব্যক্তি অপেক্ষা পার্টিকেই সত্য বলে মনে করেছে। সারাজীবন পার্টি নিবেদিত প্রাণ হয়ে জীবন কাটিয়ে এসেছে। পার্টিকেই মানুষের মুক্তির সোপান ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার ভেবেছে, জেনে এসেছে। স্বামী মৃত হলে সন্তানের পড়াশোনার দায়িত্ব নেয় পার্টি। মস্কো থেকে পড়াশোনা করে এসে ছেলে কলকাতায় থাকে, মাতা আসানসোলে। ক্রমেই মাতার মনে প্রশ্ন সমাজতন্ত্রের সেই দেশে গিয়ে ছেলে কী শিখলো? যে দেশ গোটা পৃথিবীকে সমাজতন্ত্রের পাঠ, পথ দেখাচ্ছে সে দেশে গিয়েও সন্তান কেন পার্টি বর্জিত হল। সন্তান অনিন্দ্যর কথা প্রথমে বিশ্বাস না হলেও পরে করেছে। আসলে তখন সোভিয়েত দেশ ভেঙে যায়। সমাজতান্ত্রিক রুশ দেশের ভিতরের সমস্ত সত্য সন্তান জানিয়েছে। সমস্ত স্বপ্ন ভেঙে গেছে। সারা জীবনের রাজনীতি, পার্টি, মিছিল, মিটিং করে মাতা আজ আত্মজিজ্ঞাসায়। অনবদ্য মুন্সিয়ানায় অনিশ্চয় চক্রবর্তী সোভিয়েত দেশের ভাঙন সহ এদেশের কমিউনিস্টদের জীবনচেতনা স্পষ্ট করেন। ব্যক্তির কথা পার্টি কোনদিন শোনেনি, বরং পার্টি শর্ত চাপিয়ে দিয়েছে মানুষের ওপর। যারা আদর্শ, বিশ্বাস, ভালোবাসা দিয়ে সারাজীবন পার্টি করে গেছে, তাদের আবেগ, বোধ, বিশ্বাস, যুক্তিকে পার্টি মর্যাদা দেয়নি। পরিণাম যা হবার তাই হয়েছে। আদর্শনিষ্ট মানুষ নিজের মুদ্রাদোষে নিজে হয়েছে একা। কেউ কেউ পার্টি লাইন থেকে সরে গেছে। কিন্তু নিজের ভালোবাসাকে বিসর্জন দেবে কী করে। হৃদয় খুঁড়ে শুধু বেদনা জেগে ওঠে। নিজের চোখের সামনে পার্টির পতন দেখে চোখে জল ভেসে যায়। আত্মজিজ্ঞাসায় শুধুই প্রশ্নের জাগরণ হয়। গল্প থেকে সামান্য তুলে ধরি—
“লালপতাকায় বিশ্বাস রেখে যদি কারুর মন ভেঙে যায়, সেই ভাঙা মনের কোনও দামই যে নেই লালপতাকার কাছে, বিপ্লবের কাছে, পার্টির কাছে, তখনও বিপ্লবীর কাছে। পার্টি মানেই কি এমন নিষ্ঠুর নৈর্ব্যক্তিকতা? তাহলে আর ব্যক্তি কেন যাবে পার্টিতে, কেন যায়? জীবনের এতগুলো বছর পার্টিতলে কাটিয়ে এখন সে প্রশ্ন কি আর কাকলিকে মানায়?” (আত্মজিজ্ঞাসায়, তদেব, পৃ. ৮১)
সন্তান পার্টির প্রতি আকৃষ্ট না হওয়ায় মাতা প্রথমে বেদনা পেয়েছিলেন, কিন্তু সোভিয়েত দেশের প্রকৃত সত্য শুনে আর বিমর্ষ হননি। আজ নিজের চেতনবিশ্বে শুধু অনুরণন তুলেছেন নিজের রাজনৈতিক দর্শন, পার্টি, বিশ্বাস নিয়ে। অনিশ্চয় চক্রবর্তী গভীর ভাবনা বলয়ের শিল্পী। নিছক জীবনের কথা নয়, জীবনের অতল প্রদেশে পৌঁছে গিয়ে নানা সমস্যা, সমস্যার উৎস খুঁজে চলেন। ব্যক্তি নিজেই নিজের ভুল খুঁজতে অগ্রসর হয়। নিজেই নিজের ভাবনাবলয়ে নানা প্রশ্ন তুলে, প্রকৃত পথ থেকে ব্যক্তির চিন্তা কোথায় সরে গেছে তা আবিষ্কার করে। সময়ের ব্যবধানে, প্রজন্মের ব্যবধানে নতুন প্রজন্ম কীভাবে পার্টি থেকে দূরে চলে যাচ্ছে তা দেখান। এর জন্য দায়ী কে? ব্যক্তি না পার্টি? অবধারিত উত্তর আসে পার্টি। কাকলিদের সারাজীবনের শ্রম, নিষ্ঠা ব্যর্থ হয়ে যায় পার্টির অপদার্থতায়, অপব্যয়ে, অপব্যবহারে। যে সত্য পার্টি কোনদিন শুনতেই চায়নি। সত্যকে ঢাকা দিতে নানা মিথ্যে বয়ান দিয়েছে। আপাত সত্য চাপা পড়েছে, কিন্তু মানুষ দূরে সরে গেছে। এসব অনিশ্চয় চক্রবর্তীর গভীর ভাবনাজাত ফসল। তেমনি পার্টির প্রতি গভীর ভালোবাসায়, পার্টির ভুলগুলি দেখেছেন অব্যর্থভাবে। সেইসব সত্য উঠে আসে আখ্যানে। গল্প রাজনৈতিক সত্যকে অতিক্রম করে হয়ে ওঠে গভীর চেতনার আখ্যান।
আদর্শ সচেতন মানুষ অনিশ্চয় চক্রবর্তী আদর্শ, আদর্শের ভাঙন, মূল্যবোধ, মূল্যবোধের বিপর্যয়, পার্টি আদর্শ, আদর্শের পতন, মানুষের ক্রম মুক্তি, মুক্তির স্বপ্ন থেকে দূরে চলে যাওয়া মানুষের নির্মাণ, অধঃপতনের গল্প লিখবেন এ স্বাভাবিক। সমাজতন্ত্র গঠনের স্বপ্ন দেখানো, মানুষের মুক্তির স্বপ্নে বিভোর মানুষগুলি কীভাবে পার্টি লাইন থেকে দূরে চলে গেল, কোন প্রয়াসে, কোন চেতনায়, এই দূরে-বহুদূরে, ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন চেতনায় জন্য দায়ী কে তা আবিষ্কার করতে সচেষ্ট হন। একজন ব্যক্তি কেন রাজনৈতিক দর্শন থেকে দূরে গেল, কোন ফাঁকি, বোধ, দ্বন্দ্ব-ধন্ধ ব্যক্তির বিশ্বাসে, চেতনায় সংশয়ের জন্ম দিল তা খুঁজতে অগ্রসর হন। মানুষের মুক্তির স্বপ্ন বিভোর প্রিয়নাথ পার্টি লাইন থেকে দূরে গিয়ে, আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে ব্যক্তিগত জীবনেও কীভাবে ভিন্ন সম্পর্কে জড়িয়ে গেল ও বোধে নানা প্রশ্ন, সংশয়ের জন্ম হল তা নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘পূর্ণগ্রাস’ গল্পটি। সোভিয়েতের ভাঙন ঘটে গেছে। ইতিহাসকে অস্বীকার করে বর্তমান নিয়ে বাঁচা যায় না। বর্তমান নিয়ে হতে পারে কিছু কর্মসূচি, মিছিল। তার মধ্যে বৃহৎ চেতনা থাকে না। বৃহৎ চেতনা ছাড়া অন্তত কমিউনিস্ট হওয়া যায় না। কমিউনিস্ট নাম নিয়ে ক্ষমতাতান্ত্রিক দলগুলি যে রাজনীতি করল তার সঙ্গে কমিউনিস্ট মতাদর্শ, মার্কস, লেনিনের কোন মিল নেই। সোভিয়েত দেশেই কি ছিল? পতনে অবধারিত পরিণাম ঘটেছে। এইসব গল্প অনিশ্চয় চক্রবর্তী লিখেছেন গত শতাব্দীর শেষ লগ্নে। যখন বঙ্গে বাম রাজনীতি শীর্ষে অবস্থান করছে। কিন্তু লেখকের কী দূরদর্শী ভাবনা, মর্তাদর্শ সম্পর্কে কী আশ্চর্য সচেতন প্রয়াস, কমিউনিস্ট চেতনা সম্পর্ক গভীর জীবনবেদ। পার্টির পতন ঘটতে দশ বছরও সময় লাগল না। মানুষ দূরে চলে গেল কমিউনিস্ট মতাদর্শ থেকে। প্রদীপের নীচের অন্ধকার সোভিয়েত, এবঙ্গ কেউ প্রত্যক্ষ করেনি, জানতে চায়নি। আদর্শচ্যুত প্রিয়নাথের ব্যক্তিগত জীবন পরিসর নিয়ে এই গল্প। স্ত্রী কৃষ্ণা থাকা সত্ত্বেও সে সুতপার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে। চল্লিশ বছরের দাম্পত্য জীবন, যা শুরু হয়েছিল আদর্শ দিয়ে তা আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। আদর্শ থেকে বিচ্যুত হলে যে পার্টির পতন ঘটে যায় তেমনি দাম্পত্য জীবনও ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ে। থাকে শুধু বেঁচে থাকার অভ্যাস। অবৈধ সম্পর্ক ধরা পড়েনি স্ত্রীর কাছে, ধরা পড়ার ভয়ও নেই, আছে শুধু ক্ষত-বিক্ষত মন, সংশয়, সন্দেহ। বৃহত্তর বলয়কে পারিবারিক বৃত্তে স্থাপন করে ব্যক্তির চেতনায় জাগরিত করে চলমান সময়ের ভিন্ন ক্যানভাস অঙ্কন করেন লেখক। সেই পতন থেকেই কি নতুন আদর্শের জন্ম হবে? অবধারিত উত্তর আসে জানা নেই। কেবলই নিঃশ্বাস দীর্ঘ হয়ে যায়—
“শুধু আছে এক আশ্চর্য সম্পর্কের শুকিয়ে, মজে যাওয়া অবশেষ, যা শুরু হয়েছিল আদর্শ দিয়ে, শেষও হয়ে গেছে আদর্শেরই সঙ্গে সঙ্গে। এখন পড়ে আছে অভ্যাস এক, আছে পালন, নিয়ম, কর্মসূচি। ওই মরা ফুলের স্তূপের ভেতর নতুন কোনও গুল্মের জন্ম হবে কিনা, কবে, তা কে বলতে পারে, এখন, এই হতাশায়, এই অস্থিরতায়?” (পূর্ণগ্রাস, তদেব, পৃ. ৯৮)
সমাজতন্ত্রের পতন, পার্টির পতন থেকে ব্যক্তির দাম্পত্য জীবনের ক্ষত। এসব নিয়েই ব্যক্তির বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়। পতন সম্পূর্ণ হয়। মেঘ চাঁদের সব আলো গ্রাস করে নেয়। অন্ধকার রচিত হয়। পূর্ণগ্রাস হয়। রাষ্ট্র কীভাবে নিজের ক্ষমতা ব্যক্তির ওপর প্রয়োগ করে তা বড় হয়ে উঠেছে ‘যখন সংসদ ভবনেও ছোটে বুলেট’ গল্পে। রাষ্ট্রের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কাছে ব্যক্তির ইচ্ছার কোনো মূল্য নেই। রাষ্ট্র ইচ্ছা করলেও ব্যক্তির অন্দরমহলে প্রবেশ করত পারে কোনো ভূমিকা ছাড়াই। সেখানে ব্যক্তির অধিকার বড় হয়ে ওঠে না, ব্যক্তির অস্তিত্বকে কোনো মূল্য দেওয়া হয় না। গণতন্ত্রের সেই নিষ্ঠুর পরিহাসকে লেখক অনবদ্য মুন্সিয়ানায় আখ্যানে পরিণত করেন। প্রধানমন্ত্রী আসবেন বলে সাতদিনের জন্য ফ্ল্যাট ছেড়ে দিতে হবে পৌলমীদের। এখানে পৌলমীদের বয়ান শোনা হয় না। স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক ক্রমেই যে রাষ্ট্রের হাতের পুতুল সেই বয়ান স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
‘মুখাবয়ব’ বিরল গোত্রের গল্প। ভারতীয় উপমাহাদেশের ভূগোলই যেখানে একটা বড় চরিত্র হয়ে ওঠে। জীবনবোধ, জীবনকে জানা, দেখা কোন উচ্চস্তরে পৌঁছে গেলে এমন গল্প লেখা যায় পড়ার শেষে শুধু বিস্মিত হতে হয়। স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধে একটি দেশ তিন টুকরো হয়ে গেল। সেই সঙ্গে আবহমান কাল ধরে চলছে দাঙ্গা, ফ্যাসিবাদ। কখনও হিন্দু-মুসলিম, হিন্দু-বিহারী বিবাদ ক্রমে লেগেই আছে। পিছন থেকে ইন্ধন জোগাচ্ছে কেউ কেউ। গল্পটিকে বিস্তৃত পরিসরে নিয়ে গেছেন লেখক। ভারতীয় উপমহাদেশের চরিত্র বুঝতে এই পরিসর প্রয়োজন ছিল। মানুষ ছাড়া দেশ, রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কোথায়? অথচ রাষ্ট্র নিজের প্রয়োজনে মানুষকে শোষণ করে। দেশ রক্ষার সীমান্তরক্ষীরা হয়ে ওঠেন ধর্ষক। সীমান্ত থেকে নারী মাংস তাদের বেশি আকৃষ্ট করে। গল্পটি শুরু হয়েছে সাধরণ ভাবে। আখ্যান যত এগিয়েছে জীবন তত জটিল হয়েছে। গল্প কথক শারদীয় সংখ্যাগুলির প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে দৈনিক পত্রের বিভিন্ন সংবাদ পড়ছেন। একটি সংবাদে চোখ আটকে যায়। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর থেকে বাঁচতে শাহনাজ ঝাপ দিয়েছিল ঝিলম নদীতে। নিয়তির এমনই পরিহাস মৃত্যুর কাছে গিয়েও ফিরে এল জীবনের কাছে। নদী দেহ এনে পৌঁছে দিল ভারত সীমান্তে। সেনাবাহিনী, জেলে ক্রমাগত ধর্ষণের ফলে জন্ম নিল কন্যা মবিন। আইন ব্যবস্থা মবিনকে ভারতীয় বলে, শাহনাজকে পাকিস্তান। তবে কন্যার স্বার্থে মাতা এদেশে থাকতে পারে। লেখক অনবদ্য মুন্সিয়ানায় লেখেন—“সীমান্তের ওপারের মরণ এপারে জীবন হয়ে বেঁচে থাকে, ওপারের মুক্তি এপারের কারাগারে অনিশ্চিত বন্দিত্বে বদলে যায়, ওপারের নিগ্রহ, নির্যাতনময় বিবাহ এপারে ধর্ষণে এসে ঠেকে।” (মুখাবয়ব, তদেব, পৃ. ১১৩) শাহনাজের মুখ লেখকের মনে আরেকটি মুখের কথা মনে করিয়ে দেয়। সে কাহিনি আরও বীভৎস। কমলা চক্রবর্তীকে ঝামেলা বিবি হয়ে পাড়ি দিতে হয়েছিল পূর্ববঙ্গ থেকে করাচিতে। মুক্তিযুদ্ধের সময় অত্যাচারে স্বামী রফিক সহ দুই সন্তান নিয়ে ঝামেলা বিবি ফিরে আসে বাংলাদেশে। ফেরার পথেই মারা যান স্বামী। সে দেশে কিছুদিন থাকার পর ঝামেলা বিবি আবার করাচিতে ফিরে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু বড় সন্তান মুনির যেতে অস্বীকার করায় ছোটো সন্তান হারুণকে নিয়ে ট্রেনে ওঠেন মাতা। নিয়তির পরিহাসে এসে পৌঁছান আসানসোলে। ভিন্ন স্থলে ভয় ছিল। ঝামেলা বিবির তো বিশ্বাস মানুষে। যে বিশ্বাস তাঁকে ধর্ম পরিবর্তন করেও বাঁচার প্রেরণা দেয়, যুক্তি দেয়, সাহস জোগায়—“তার তো কোনও দেশ নেই, সীমান্ত নেই, রাষ্ট্র নেই, পাহারা নেই, মানুষ আছে। ভরসা করার মতো মানুষ, মানুষের স্মৃতি, মানুষের মুখের কথা।” (তদেব, পৃ. ১১৭) সন্তানের টানে আবার সে বাংলাদেশ গেলেও ছোটো পুত্র হারুণ এদেশেই থেকে যায়।
শাহনাজকে দুটি দেশ, ঝামেলা বিবিকে তিনটি দেশে জীবন অতিবাহিত করতে হয়েছে। ঝামেলা বিবি কী আশ্চর্য নাম, অর্থবহ জীবন সংকেত। অথচ সে নিজে কোথাও ঝামেলা সৃষ্টি করেনি। রাষ্ট্রের ইচ্ছাকৃত ঝামেলার কাছে স্বামীকে বিসর্জন দিয়েছে, সন্তান নিখোঁজ। জীবনে বাঁচতে পরিবর্তন করতে হয়েছে ধর্মকে। তিনটি দেশ (ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ) আসলে যা একটি উপমহাদেশ ছিল তারই সন্তান এই শাহনাজ, ঝামেলা, হারুণরা। লেখক আশ্চর্য পরিসরে, অনবদ্য মুন্সিয়ানায়, শৈল্পিক দক্ষতায় আখ্যান সাজিয়ে তুলেছেন। ডজন ডজন গল্প তালিকায় স্বভাবতই পৃথক হয়ে যায় ‘মুখাবয়ব’ এর মতো গল্প। পৃথক হয়ে যায় আখ্যানের ভিন্নমাত্রার কারণেই। শাহনাজকে ধর্ষিত হতে হয়েছিল, ঝামেলাও অত্যাচারের স্বীকার। তবে সে স্বামী পেয়েছিল। ধর্ম ত্যাগ করেছিল। রাষ্ট্র, মৌলবাদ, ধর্মগুরু নিজের প্রয়োজনে বিভেদ সৃষ্টি করে। সাধারণ মানুষের মনে ধর্ম নিয়ে কোনো দোলাচল নেই। ঝামেলারা পৃথক ধর্ম গ্রহণ করতে অস্বীকার করেনি। তারা জানে জীবন যাপনই ধর্ম। লেখক নিজেও জানিয়ে দেন—“উপবীতধারী ব্রাহ্মণ নারায়ণ চক্রবর্তীর কন্যা কমলার কাছে কবে, কী করে আজানের ধ্বনি হয়ে যায় স্বজনের ধ্বনি, আশ্রয়-সংকেত, কে বলে দেবে সেকথা? সেই অবিশ্বাস্যের আছে কোন ব্যাখ্যা?”(তদেব, পৃ. ১১৭) পাকিস্তানে জন্ম নেওয়া হারুণ আজ ভারতের শ্রমিক। হায় কে কার জন্মবৃত্তান্ত মনে রাখে! কে জবাব দেবে কোনটা তার প্রকৃত দেশ, কোনটা স্বদেশ? শুধু ‘নেই’ এর মালা পিণ্ড আকার ধারণ করে। ভারতীয় উপমহাদেশের চালচিত্র ধরা আছে এই আখ্যানে ভিন্ন মাত্রায়। শাহনাজকে সামনে রেখে ঝামেলার মুখাবয়ব ভেসে ওঠে ঠিকই আসলে ভেসে ওঠে দেশের মানচিত্র। সেই মানচিত্র মনচিত্রের খোঁজ করেন লেখক। একটিও বাড়তি কথা নেই, একটি শব্দও বোধের বাইরে নয়। এমনই কৃপণ অনিশ্চয় চক্রবর্তী। শব্দ ব্যবহারে এমনই সচেতন।
(৩)
‘মানচিত্র’ গল্পটি ‘একুশ শতক’ পত্রিকায় শারদ সংখ্যায় ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। সময় পর্বটি গুরুত্বপূর্ণ। সেদিন পশ্চিমবঙ্গের বাম তথা কমিউনিস্ট শাসন উচ্চশিখরে। যদিও সেই অশৃঙ্খলি মিনারের পতন হতে বেশি সময় লাগেনি। পার্টি নিয়ে আদর্শবাদী বীজেশের আত্মসমীক্ষণ এই আখ্যান। পড়তে গিয়ে মনে হয় এ তো লেখকেরই চরিত্রের প্রতিরূপ। সারাজীবন আদর্শনিষ্ট লেখক বারবার খুঁজেছেন পার্টির কার্যকলাপের ব্যর্থতা কোথায়। ভুলগুলি কেন পার্টি শুধরে নেয় না, কেন আত্মজিজ্ঞাসায় যায় না, মানুষের কাছ থেকে কেন দূরে সরে যায়। গত শতকের শেষ দশকে সোভিয়েত দেশ ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে। বীজেশের স্বপ্নের দেশের এই পতন মনে বেদনার জন্ম দেয়। কেবলই চোরাবালিতে ডুবে যায়। চার দশক আগে যে দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিল, বিপ্লবের ডাক দিয়ে ঘর ছেড়েছিল সে দেশের এই পরিণতি কেন? সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা কীভাবে গোটা পৃথিবীর মানচিত্রে ছড়িয়ে যাবে বলে যে বীজেশ কেবলই মানচিত্র দেখতো সেই লাল মানচিত্র ভেঙে খণ্ড খণ্ড হয়ে গেল কেন? সোভিয়েত দেশের মার্কস, লেনিনবাদকে যারা মানুষের মুক্তির স্বপ্ন হিসেবে গ্রহণ করল এই বঙ্গে, সেই পার্টি কেন সোভিয়েত দেশের পতনে আত্মসমীক্ষণে যায় না। মর্তাদর্শ, কর্মসূচির কোন ব্যর্থতা দেশের পতন ঘটাল সেই ভ্রান্ত সূচি কেন এইবঙ্গের কমিউনিস্ট পার্টি জানতে চায় না। একদিন মানুষ এই বঙ্গের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি যে শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, মতাদর্শে ভক্তি করত সেখান থেকে কেন মানুষ দ্রুত সরে গেল। আজ অন্য পার্টির সঙ্গে কমিউনিস্টদেরও এক আসনে দেখা হয়, এর জন্য কে দায়ী? ব্যক্তি না পার্টি? তবে মানুষের মুক্তির স্বপ্ন ভুল ছিল? সমাজতন্ত্রের সত্য মানুষকে বোঝানো যায়নি? বিপ্লবের স্বপ্নে মানুষকে উজ্জীবিত করা যায়নি? নাকি সবই চোরাবালি? কে দেবে উত্তর? সময় বহিয়া যায় মা। বীজেশের এই চেতনা তো পার্টিই দান করেছিল। তবে সেই চেতনায় নানা সংশয়, জিজ্ঞাসা, প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? আত্মজিজ্ঞাসার নিরাসন কে করবে? লেখক আত্মসমীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রশ্ন করেন—
“পার্টিই তো স্বপ্ন দিল, অপরাজেয় এক মার্কসবাদের নাগাল দিল, এখন এই প্রশ্নাতুর, আলোড়িত বীজেশের কাছে মার্কসবাদের নিজস্ব অমীমাংসার সমাধান কেন দেবে না পার্টি? বীজেশ তো পার্টিকে দিয়েছে তার কৈশোর, তারুণ্য, যৌবন—সব, সব। কত সন্ধ্যা, দুপুর, সকাল, বিকেল, বিনোদন ও বিশ্রামবঞ্চিত কত কত দিন, তবে পার্টি কেন মীমাংসা দেবে না?” (মানচিত্র, তদেব, পৃ. ১২৮)
বীজেশের মতো এমন বহু আদর্শনিষ্ট বাঙালির মন ভেঙেছে। পার্টির প্রতি বিশ্বাস, ভালোবাসায় মরচে পড়েছে। আজ বীজেশ কেবলই চোরাবালিতে ডুবে যায়। কোন অভিমানে? ব্যক্তি স্বার্থ নয়, নিজের আত্মপ্রতিষ্ঠাও নয়। নিজের আত্মপ্রতিষ্ঠার স্বার্থে পার্টিকে ব্যক্তি কীভাবে ব্যবহার করেছে তাও দেখেছে। মনে সংশয় জাগে এরাও কমিউনিস্ট! কমিউনিস্ট হয়ে এতো নীচ, স্বার্থপর, আদর্শহীন। হা নিয়তি। স্বপ্ন বিধ্বস্ত বীজেশের মানচিত্র, মনচিত্র কেবলই ধূসর হয়ে আসে। না পারে পার্টির কাজকে সমর্থন করতে, না পারে পার্টিকে ত্যাগ করতে। কেবলই আত্মজিজ্ঞাসায়, আত্মসমীক্ষণে ক্ষতবিক্ষত হয়। ব্যক্তির সেই ক্ষতবিক্ষত চিত্র, যার মধ্যে লুকিয়ে থাকে আদর্শ, পার্টির প্রতি বিশ্বাস, কমিউনিস্ট মতাদর্শ ও সমাজতন্ত্রের পতন তা বিশ্লেষণে ধরা পড়ে আখ্যানে।
‘পদক্ষেপ’ গল্পেও গভীর বিশ্লেষণে পার্টির আদর্শ, মিছিল, মানুষের মুক্তির স্বপ্ন, বেকার যুবকের স্বপ্নভঙ্গ, বিশ্বয়নে আগ্রাসী মানুষের অনুভূতিবিচ্যুত, মানুষের বোধ ও অস্তিত্বের আখ্যান শুনিয়ে যান অনুভবময় ভাষায় ও সংবেদনে। কমিউনিস্ট পার্টির এই আদর্শচ্যুতি, পতন কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি অনিশ্চয় চক্রবর্তী। সারা যৌবনে পার্টির মধ্য দিয়ে মানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখা যুবকের সমস্ত স্বপ্ন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। কী নিয়ে বাঁচবে এক অনুভূতিশীল, সংযত, সংবেদন মানুষ? পার্টির কাছে কিছুই চাননি, এমনকি সদস্য পদও পাননি, পিতৃ আদর্শ, সমাজতন্ত্রের গভীর বোধ, মার্কস, লেনিন পাঠ তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল এক বোধে, বীক্ষণে। অথচ পার্টি আদর্শ থেকে দূরে গিয়ে আগ্রাসী হয়ে, মানুষ থেকে বিচ্ছন্ন হয়ে, মানুষের মুক্তির স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে দলতন্ত্রের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখলের প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। এই কী তবে কমিউনিস্ট বোধ? মনে নিতে পারেননি লেখক। সেই বিচ্যুতি সারাজীবন পীড়া দিয়ে যাচ্ছে লেখককে। এই গল্পগুলি সেই অনুভূতির বর্ণমালা। ‘পদক্ষেপ’ গল্পটি চিঠির আকারে লেখা। মুনিয়াপ্পানাকে চিঠি লিখছেন এক কমিউনিস্ট যুবক। যে মুনিয়াপ্পানা চাকুরি ছেড়ে পিছনে হাঁটা শুরু করেছে মানুষের অনুভূতিকে সজাগ করতে। আসানসোলের যুবকটি কলেজে উঠেই দেওয়ালে দেখেছে ‘একটু পা চালিয়ে ভাই’, নিজেই পড়েছে লেনিনের ‘এক পা আগে, দু’পা পিছনে’। কেন এতো মিছিল! যেখানে কোনো আদর্শ নেই, মিছিলের সত্য, স্বপ্ন নেই। তবে শুধুই কি অভ্যাস! ব্যক্তিগত বোধ, অভিজ্ঞতা, স্বপ্ন-স্বপ্নভঙ্গ নিয়ে এই চিঠির বয়ান। ক্ষমতা, প্রতিষ্ঠা মানুষকে দূরে ঠেলে দেয় আদর্শ, কার্য, শপথ থেকে। কথকের বক্তব্য মুনিয়াপ্পানা যেন দূরে সরে না যান। সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, মানুষের মুক্তির স্বপ্নে সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াসে আমরা সত্যি কি পিছিয়ে যায়নি? পিছন পানে কে আর ফিরতে চায়! হায় হৃদয় খুঁড়ে আর কে অতীত দেখতে চায়! এবঙ্গের কমিউনিস্ট পার্টি নিজের ভুল, কাজের সমালোচনা করলই না কোনোভাবে। এইভাবে কি মানুষের মুক্তি ঘটানো সম্ভব? ভুল ভুল, কেবলই ভুলের ভুলভুলাইয়া। গভীর বোধ থেকে আত্মসমীক্ষণে উপনীত হন—
“পদযাত্রা আর পদযাত্রায় সেই সময়টা কেটে গেছে কেবল হাঁটতে হাঁটতে, কি হল সেই হাঁটার ফলাফল, তা কি কেউ খতিয়ে দেখেছে কোনওদিন? বিরোধীরা একরকম কথা বলে গেছে, বিরোধীতার নিজস্ব ভাষায় ও ভঙ্গিমায়। আর পদযাত্রার উদ্যোক্তারা নিজেদের প্রতি জনসমর্থনের ঘোর কাটিয়ে আজ অবধি ভেবেই উঠতে পারলেন না, আদৌ সেই পদযাত্রার কোনও দাবি পূরণ হয়েছে কিনা। আদৌ সেই পদযাত্রার প্রয়োজনও ছিল কিনা। নিজেদের কোনও কাজের কোনও সমালোচনা শুনতে না পারার ক্ষমতা (নাকি অক্ষমতা) নিয়ে কি সমাজের ভাল করার অধিকার অথবা যোগ্যতা জন্মায়?” (পদক্ষেপ, তদেব, পৃ. ১৩৪)
যুবকটি ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছেন পৃথিবীর বদল ঘটাতে হবে। সমাজকে বদলে দিতে হবে। লেনিন, মার্কসের জীবনচিন্তাকে সঙ্গে নিয়ে যারা বদলের শ্লোগান দিয়েছিল তারাই বদলে গেল। এ কোন বিশ্বাসঘাতকতা, মোহমুক্তি? লেখক চেয়েছিলেন চেতনার বিস্তার। মানব মনের গভীর বোধে পার্টির সৎ আদর্শের বিস্তার। হয়নি। হবেও না। কেননা পার্টিই আদর্শ থেকে দূরে, বহুদূরে পর্যবসিত হয়েছে। মুনিয়াপ্পানাকে দেখে আজ তিনি খুশি। যে পিছন পানে ফিরে সভ্যতাকে দেখতে চায়, মানুষের অনুভূতির জাগরণ ঘটাতে চায়। মানুষের বিবেক, চেতনা, আদর্শ, সত্য উদঘাটন করতে চায়। সারাজীবন সেটাই তো চেয়েছিলেন সংবেদনশীল অনিশ্চয় চক্রবর্তী।
অনিশ্চয় চক্রবর্তীর আখ্যান যেন উদ্ধৃতিপূর্ণ। আখ্যান থেকে অজস্র উদ্ধৃতি দেওয়া যায়। এমনই তার ভাষা, জীবনবেদ, দর্শন, ভবনা। বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করে বিষয়কে এমন স্বাদু, নির্ভরযোগ্য, যুক্তিযুক্ত, অনুভবঘন গদ্য ও শব্দ চয়নে প্রতিটি বাক্য নির্মাণ করেন তার থেকে পাঠকের মুক্তি নেই। তবে চলতি বা বাজারি আখ্যান বলতে আমরা যা বুঝি তার থেকে লক্ষ যোজন দূরে তার অবস্থান। তীব্র সময়জ্ঞান, জীবনের ভিতর থেকে উঠে আসা দর্শনের লীলা, মস্তিষ্ক ও চিন্তা-চেতনার চোরাস্রোত, জীবন-সময়-পরিসর সম্পর্কে এক গভীর বোধ, যন্ত্রণা, আনন্দ ও সমীক্ষা সব মিলিয়ে তিনি এমন এক আখ্যান নির্মাণ করেন যা দেশ, সমাজ, মানুষের জীবনগাথা হয়েও দর্শনের কাছে পৌঁছে যায়। রচিত হয় ব্যক্তির দর্শন, বাঁচার দর্শন। ‘ঢেউয়ের মানুষ’ আখ্যানে প্রবেশের আগে কিছু উদ্ধৃতি দিতে হবে। লোভ সামলানো যাচ্ছে না। কে আর পারে এমন বোধকে উপেক্ষা করতে—
ক. “আমাগো নিয়তিই অইল ভাইস্যা বেড়ানো। কহনো জীবন টান দেয়, তাই ভাসি। কহনো সমুদ্র টান দেয়। একবার ভাসি জীবনের ঢেউয়ে, আর একবার ভাসি সমুদ্রের ঢেউয়ে।” (ঢেউয়ের মানুষ, তদেব, পৃ. ১৪৬)
খ. “আমাগো খাল-বিল-নদী-নালার দ্যাশের মানষেরা আপনাগো মনের শান্তির লগে, দ্যাশ ছাইড়া এতদূর পাড়ি দ্যাওনের জ্বালা ভোলাতে নদীর দ্যাশের পালা গাইয়্যা, নদীর ধারের ব্রতকথা আউড়াইয়া কাল কাটাইছি। এহনে সমুদ্রের দ্যাবতা তারই বদলা লয় কিনা হেয়া কে কইথে পারে? চাঁদ সদাগর সাগরে পাড়ি দ্যায় আর মা মনসার অভিসম্পাতে তার সপ্তডিঙা ডুইব্যা যায়, চাঁদ ফকির হয়। সমুদ্রের পারে বইয়া এই কাহিনি কেবলই আউড়াইলে পরে সমুদ্র কি চটে না? সমুদ্র তো এতকাল আমাগো কিছুমাত্র ডোবায় নাই, ভাসায়ও নাই। তাইলে সমুদ্রডারে অকারণ দোষ দিচ্ছি ক্যান। এতগুলান লোক অ্যাদ্দিন ধইর্যা অন্ধের কাজকারবার করলে সমুদ্র এক সকালে অন্ধ অইছে, কী এমন দোষ করছে? আমরা শুধু নিছি আর নিছি সমুদ্রের কাছ থিকা, তারে কিছুমাত্র দিই নাই।” (তদেব, পৃ. ১৪৭)
গ. “যে দর্শন তৈরিই জীবন থেকে, ব্যক্তির জীবন থেকে, প্রান্তিক জীবন থেকে, বঙ্গোপসাগরের সুনীল জলরাশি যেখানে গিয়ে ভূমিপ্রান্ত খুঁজে পায় আছড়ে পড়ার মতো, সেই প্রান্তিক মানুষের দ্বৈপায়ন অস্তিত্ব থেকে। সুবলসখার একণ যে নিজেরই অস্তিত্বে সংশয়, সন্দেহ, অবিশ্বাস। আর সব কিছুর মধ্যে কোনো এক ঢেউয়ের আবিষ্কার। ঢেউ গ্রাস করেছে সুবলসখার চেতনাকে।” (তদেব, পৃ. ১৪৭)
ফরিদপুরের সুবলসখা দেশভাগে উদ্বাস্তু হয়ে শিয়ালদা স্টেশন থেকে আন্দামানে গিয়েছিল। পঞ্চাশ বছর আগে। নানা পরিশ্রমে সেই দ্বীপকে বসবাস যোগ্য করে তুলেছিল। আজ নিজের দেশ বলতে আন্দামানকেই বোঝে। পূর্ব বাংলায় সুবলসখার গ্রামে মুসলিম অত্যাচার ছিল না। তবুও দেশত্যাগ নিয়তিই হয়ে উঠেছিল। হিন্দু হয়েও পূর্ব থেকে পশ্চিমে নির্বাসিত হয়েছিল। পশ্চিম দিক মুসলিমদের আরাধ্য হয়েও ক্রমে তারা পূর্বদিককে দখল করতে অগ্রসর হল। এই নির্বাসনের জন্য সুবলসখার আপাত অভিমান থাকলেও অভিযোগ নেই, আক্ষেপ নেই। নিজের বাসভূমি হিসেবে আন্দামানকে কায়িক পরিশ্রমে উপযুক্ত করে তুলেছিল। অমানুষিক পরিশ্রম, হাড়ভাঙা খাটুনির চিত্র গল্পের বয়ান পড়লেই স্পষ্ট হবে। আজ সমুদ্রের ঢেউয়ে সব তছনছ হয়ে গেছে। জীবনের আক্ষেপ বিলাপে পরিণত হয়েছে। হতাশা নয় আবার নতুন করে শুরু করার জীবনচিন্তা সুবলসখার। নিয়তিকে দোষ না দিয়ে নিজেরই দোষ খুঁজতে অগ্রসর হয়েছে। সাপের হাত থেকে বাঁচতে মনসামঙ্গল ব্রত, পূজা পালন করলেও সমুদ্রের জন্য কিছুই করেনি। সমুদ্রমঙ্গল আয়ত্ত করেনি। তাই বুঝি এই পরিণাম। একবার জীবনের ঢেউয়ে ওপার থেকে আন্দামানে, একবার সমুদ্রের ঢেউয়ে সমস্ত স্বপ্ন হারিয়ে আবার জাগরণে অক্লান্ত সুবলসখা। এই তো জীবন। হা নিয়তি, হা প্রকৃতি, হা রাষ্ট্র। আজ আন্দামান জনবসতি পূর্ণ হলে তামিল পুঁজি নিয়োগ শুরু হয়েছে। অনিশ্চয় চক্রবর্তী শুধু কাহিনি রচনা করেন না, আখ্যানের ভিতর দিয়ে একাধিক সত্য প্রবেশ করিয়ে দেন, যেগুলি যাপনচিত্র থেকে উঠে আসে। তিনি নিবিড় ভাবে দেখেন মানুষের পরাজয় ও সময়ের কাছে মানুষের দাস্যতা স্বীকারের ক্রম পরিণতি। তবে তাঁর নায়ক আদর্শনিষ্ঠ, চাঁদ সদাগরের মতো একক, নিঃসঙ্গ। কেবলই একা হয়ে যায়। সভ্যতার বিবর্তন, ইউটোপিয়া কেবলই একা করে দেয়। একক হয়েও মানুষের বন্ধন মুক্তির, ক্রম পরিণতির স্বপ্ন দেখেন, দেখান। আসলে এসবই অনিশ্চয় চক্রবর্তীর জীবনবোধ, মস্তিষ্ক প্রসূত ভাবনা, আদর্শের প্রতিফলন।
একদিকে মার্কস, লেনিনের গ্রন্থ, রুশ সাহিত্য পাঠ অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের গান—এই তো অনিশ্চয় চক্রবর্তীর যৌবনের স্বপ্নের দিনগুলি। দেবব্রত বিশ্বাসের ক্যাসেট মুগ্ধ হয়ে, তন্ময় হয়ে শুনছেন। পিতা অফিস থেকে ফিরে এসে রবীন্দ্র গান নিয়ে মেতে যাচ্ছেন, মামন (লেখকের বোন) বাড়ি সহ পার্টির নানা সমাবেশেও গান গাইছেন। আর অনিশ্চয় চক্রবর্তী নতুন শতাব্দীতে এসে লিখছেন ‘রবীন্দ্রনাথের গানের জ্যামিতি’। ভাবনা বলয়ে সারাক্ষণ জুড়ে রয়েছে মার্কস, লেনিন, রবীন্দ্রনাথ। প্রেম ,পূজা, রবীন্দ্র ভাবনা, দর্শন, মিলন, শরীর ও অশরীরী চেতনা সব মিলিয়ে অনবদ্য গল্প ‘স্থাপত্য ১’। গল্পের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদেই তিনি জানিয়ে দেন—“আমাদের আখ্যান অবশ্য কোনো সংশয়ের নয়, শুধুই প্রত্যয়ের। কোনো দোলাচলের নয়, শুধুই আত্মবিশ্বাসের। কোনো বিরহবেদনার নয়, শুধুই মিলনের। কোনো জিজ্ঞাসারও নয়, সেকথা অবশ্য নিশ্চিতভাবে বলা যায় না।”(স্থাপত্য ১, তদেব, পৃ. ১৫০)। ‘প্রত্যয়’, ‘আত্মবিশ্বাস’, ‘শ্রদ্ধা’, ‘ভালোবাসা’, ‘সংবেদন’, ‘সংযম’ এসবই অনিশ্চয় চক্রবর্তীর সারাজীবনের সঞ্চয়, বেঁচে থাকার আশ্রয়, অক্সিজেন। ছেলেটির নাম উজ্জ্বল, মেয়েটির নাম পূজা। দুজনে প্রেমের নিমিত্তে মিলিত হয় মেট্রো স্টেশনে। প্রেমেও উজ্জ্বল পূজা পর্যায়ের গান প্রবেশ করিয়ে দেয়। কী অদ্ভুত বাতাবরণ। কী আশ্চর্য জীবনবোধ। গোটা গল্প জুড়েই রাবীন্দ্রিক সুর। তবে মিলনও আছে, শরীরের আকর্ষণও আছে। তবে সেটাই শেষ সত্য নয়। সামান্য স্পর্শ নিয়ে জীবনকে, প্রেমকে অনুভবময় করে তোলার প্রয়াস। যে মিলন কখনোই যৌনতার পর্যায়ে যায় না, যৌনতার দাবি করে না, একটু উষ্ণতার জন্য বা স্বাভাবিক টান। দিন শেষে দুজনেই বাড়ি ফিরে যাবে। এই অনুভবের মধ্যেও লেখক গল্প শেষে যে বাক্যটি লিখলেন সেখানেই মুন্সিয়ানা—“আগামী বাইশ ঘণ্টার জন্য তাদের যে বিচ্ছেদ অচিরেই ঘটে যাবে, তা যে শুধুই শরীরের, মনের নয় কিছুতেই, এই উপলব্ধির জন্য তো কোনো শরীর লাগে না, যতই এই কলকাতার সমস্ত পথের শীর্ষে অজস্র বিজ্ঞাপিত শরীরের হিন্দোল, এই একুশ শতকের চিহ্নবাহী হয়ে থাকুক না কেন।” (তদেব, পৃ. ১৬১) অনিশ্চয় চক্রবর্তীর নায়ক নায়িকাদের প্রেমও একটা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মধ্যে আবদ্ধ। আবহমান কাল ধরে চলে আসা বাঙালির ঐতিহ্যকেই বহন করে যায়। প্রেমের ক্ষেত্রে নষ্টামিতে কেউ বিশ্বাসী নয়। রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দকে সঙ্গী করে প্রেমকেও যেন বৃহৎ মাত্রায় নিয়ে যায়। ‘স্থাপত্য ২’ গল্পের পূজা রবীন্দ্রনাথের গান, জীবনানন্দের কবিতা আয়ত্ত করেছে। প্রেমিকা নিজেকে প্রেমিকের উপযোগী করে তুলেছে। শুধুই কি উপযোগী করে তোলা না অন্য কিছু! নিজের অস্তিত্বের লড়াই। চেতনার বিস্তার। একজন জ্ঞানী কখনোই মূর্খের কাছে আলোচনা করে আনন্দ পেতে পারে না। প্রেমিকা স্বাধীনতা বলতে বোঝায় ‘অধীনতা’। উজ্জ্বলের আমিত্ব কেমন করে যেন আমিহীন হয়ে যাচ্ছে। আসলে এটাই লেখকের দর্শন। আমিহীন বাঁচার যে চেতনা তা খুব সহজ নয়, তবুও যতটুকু চেষ্টা করা যায়। অন্তত লেখক তাঁর সৃষ্ট চরিত্রকে সেই দর্শনে নিয়ে যান। নষ্ট প্রজন্মে, নষ্ট সময়ে নিজেকে সাংস্কৃতিক মনস্ক প্রতিপন্ন করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দেও আমাদের ভুল হয়। রবীন্দ্রনাথকে আয়ত্ত করার চেষ্টা সৎ, কিন্তু সামান্যও যে ভুল করা যাবে না। নায়িকার সেই ভুলও ধরিয়ে দেয় ‘স্থাপত্য ৩’ গল্পের উজ্জ্বল। ‘স্থাপত্য’ চিহ্নিত তিনটি গল্পই যেন ক্রমিক বিন্যাসে রচিত। যার মূল সুর রবীন্দ্রিক চেতনা। ব্যক্তির স্পর্শে রবীন্দ্র ভাবনার বিকাশ, ব্যক্তির অহং, পরাজয়, আমিত্ব, চেতনার বিকাশ সব মিলিয়ে এক সুস্থ সাংস্কৃতিক চেতনার আখ্যান।
এক মগ্ন চেতনার আখ্যান ‘আত্মহননের দিকে’। ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা, অস্তিত্ব-অস্তিত্বহীনতা, জীবন সংগ্রাম, কর্মহীনতা, দায়িত্ব, আবার নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার বাসনা সব মিলয়ে গভীর চেতনার আখ্যান। অনিশ্চয় চক্রবর্তীর আখ্যান পরিকল্পনার কেন্দ্র রয়েছে পাঠকের মস্তিষ্ক। কাহিনির চোরাস্রোতে আখ্যানকে তিনি বোধের কাছে উপনীত করেন। হতাশা, সংশয়, জীবনের দাবির মধ্যে হ্যাঁ-না বোধ, আত্মগ্লানি, সমাজ পরিবেশ সম্পর্কে একরাশ বিতৃষ্ণা, অথচ না প্রকাশ ব্যক্তিকে ক্রমেই একাকিত্ব করে তোলে। ঘটনার ঘনঘটা সামান্যই। আসানসোলের চঞ্চল হাসপাতালে ভর্তিরত পিতাকে নিয়ে যাবে কলকাতা মেডিক্যালে পিতাকে ‘আনফিট’ প্রমাণ করতে। তবে যদি পিতার চাকরিটি সন্তান পায়। এই সামন্য ঘটনাকেই উচ্চসুরে বাজিয়ে দেখিয়েছেন আখ্যানকার। কুড়ি পৃষ্ঠার অধিক গল্পে চঞ্চলের চেতনার মধ্য দিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সমাজ, সময় সম্পর্কে একরাশ অভিজ্ঞতা, কখনো নিজেকেই প্রশ্ন, হীনমন্যতা, আবার নিজের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত করার সদাপ্রচেষ্টা, সংসার চিন্তা কেবলই সংশয়ের জন্ম দেয়। সংশয় থেকে উত্তরণের পথ যে নেই তা নয় কিন্তু সেখানেও দংশন ক্ষত বিবেক বারবার আঘাত করে। জীবনানন্দের নায়কের মতো চঞ্চল কোন পথে যাবে বুঝতে পারে না, কোনটা সঠিক সে জবাবও পায় না, তবুও অস্তিত্বের জন্য লড়াই করে যায়। একদিকে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রাণপণ লড়াই, অন্যদিকে সে লড়াইয়ের জন্য হনন, আত্মহনন, অভিমান, অস্থিরতা কোন চেতনার দিকে নিয়ে যায় নিজেই জানে না। আমরাও কি জানি? শুধুই পাঠ মুগ্ধতা। লেখকের দক্ষতার প্রতি বিশ্বাস, শ্রদ্ধা রেখে পরের গল্পে এগিয়ে যাওয়া।
(৪)
জীবনচেতনা, লিরিক, মিস্টিসিজম, গদ্যের অনবদ্য বিন্যাসে চমৎকার গল্প ‘স্বপ্নেরা, আমার আকাশে’। জীবনচিন্তার সঙ্গে নমনীয়, কোমল গদ্যের চলন বক্তব্যকে একটা উচ্চশিখরে স্থাপন করে। অনিশ্চয় চক্রবর্তীর সমস্ত আখ্যানই নিজস্ব জীবনচিন্তার ফসল। কোনটাই কৃত্তিম নয়। গল্পের জন্য গল্প তিনি লেখেননি। বোধহয় সেজন্যই তাঁর লেখার পরিমাণ স্বল্প। ষাটের কাছাকাছি বয়সে পৌঁছে মাত্র চারটি গল্প সংকলন—‘জন্মের অসুখ’(১৯৯৮), অ-নিয়ন্ত্রণরেখা’(২০০৩), ‘দশটি গল্প’(২০১২), ‘গল্প পঁচিশ’ (১৪২১)। সমস্তটাই আত্মগত চেতনার ফসল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তিনি নিজেই কথক। নিজের যাপনচিত্রের বিন্দুবিশ্ব, আদর্শ, ভাবনার মন্থনজাত অনুভূতিমালা আখ্যানে বিন্যাস্ত হয়। ব্যক্তির বোধ থেকে যখন ‘পাপ’ শব্দটাই উধাও হয়ে গেছে সেখানে লেখক সারাজীবন পাপবোধ থেকে সচেতন থাকতে চেয়েছেন। সামান্য পাপবোধের জন্য লেখকের কী গ্লানি, অপরাধবোধ তা দেখেছি ‘আমার অকিমনিস্ট জীবন’ গ্রন্থে। কোনো ভুল করলে অপরাধবোধ লেখককে এমন পীড়া দিয়েছে সে ভুল আর কোনোদিন করেননি। তেমনি যৌবন থেকেই এক স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকতেন। কী সেই স্বপ্ন ‘আমার অকমিউনিস্ট জীবন’ পড়া থাকলে পাঠককে আর বলার প্রয়োজন নেই। আলোচ্য গল্পের কথক স্বপ্ন নিয়ে জীবন কাটাতে চান। শুধু নিজেই নয় অন্যকেও স্বপ্ন দেখাতে চান। তবে কাউকেই আঘাত করতে চান না। আসলে তিনি জীবন জানতে চান। জীবনই যেন স্বপ্নের জন্ম দেয়, স্থানান্তর ও গোত্রান্তর ঘটিয়ে দেয়। স্বপ্নময় এক আশাবাদের সুর গোটা গল্পের শরীর জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। এ গল্প ‘শারদ আজকাল’ এ ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে লিখলেন। পরের বছর একই পত্রিকায় লিখলেন ‘মিথ্যেরা, আমার বাতাসে’। ভবনা চিন্তায় অনিশ্চয় চক্রবর্তী বিরল গোত্রের গল্পকার তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আখ্যান পরিকল্পনায় তিনি ইউনিক। গল্পের টেকনিক নিয়ে কোনো সচেতন কার্যকলাপ নেই। তাঁর গল্পের মূল অবদান আমাদের চেতনার কাছে। পারিপার্শ্বিক সমাজ বলয় নিয়ে আমাদের যে চেতনা সেখানে তিনি একটু আঘাত করেন, একটু আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে দিতে চান। তবে সে আঘাত একেবারের মায়াময়, স্নেহমাখা। সেজন্য কেউ রাগ করে না। অভিমানের তো প্রশ্নই নেই। এমনই লেখকের জীবনবোধ। ‘মিথ্যেরা, আমার বাতাসে’ আবহমান কালের বাংলা গল্পের ধারায় স্বতন্ত্র চিহ্নিত গল্প। শুধু এগল্প নয় অনিশ্চয় চক্রবর্তীর সমস্ত গল্পই স্বতন্ত্র। গল্প পড়তে গিয়ে পূর্বসূরীদের কোনো গল্পের সঙ্গে মিল আবিষ্কার করা অসম্ভব। এমনই তার আশ্চর্য নির্মাণ, এমনই তার জীবনদর্শন। এক মিথ্যেবাদী নিজের জীবনের মিথ্যের অভিজ্ঞতার কথা মানুষকে শোনাতে এসেছে। গৌরব ও গ্লানি নিয়ে মিথ্যেময় যে জীবনের ইতিহাস তাই উচ্চারণ করতে চেয়েছেন সত্যভাবে, সৎভাবে। আমরা কেন মিথ্যেকথা বলি, মানুষ কেন মিথ্যেকথা বলে, বলে কী সুখ পায়, দুঃখই বা কোথায়, মিথ্যে উচ্চারণের গ্লানি কোথায়, কোন সত্য চাপা দিতে এই উচ্চারণ, ধরা পড়ার ভয় কোথায়, ধরা না পড়লেই বা কী হোত, ধরা না পড়লে মিথ্যে উচ্চারণকারী ব্যক্তির চেতনায় কোনো আঘাতের সৃষ্টি হয় কি না, হলে কোন গ্লানিবোধের জন্ম হয় এমন নানা প্রশ্ন, সংশয়, সন্দেহ, আত্মগ্লানি, আত্মমর্যদার নানা প্রশ্ন ও উত্তর খোঁজার প্রয়াস। প্রাণী জগতে মানুষই একমাত্র মিথ্যেকথা বলে, সমাজে প্রতিষ্ঠা পেতে মিথ্যের দলদাসে পরিণত হয়, কেউ মিথ্যের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রতিষ্ঠায় গৌরববোধ করে, আবার ধরা পড়ার ভয়ে সংকুচিত হয় এমন নানা জিজ্ঞাসা নিয়ে হাজির হন। গল্প থেকে সামান্য তুলে ধরা যাক—
“মিথ্যা রচনা ও উচ্চারণকে তাঁরা এক অনবদ্য শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। নিজেদের অজান্তেই তাঁরা এক একজন শিল্পী। শিল্পের যে সংজ্ঞায় কল্পনায় এক অসাধারণ ভূমিকা মানুষ মেনে নেয়, অভিজ্ঞতার বিপরীতে বা পাশাপাশি, সেই সংজ্ঞা অনুযায়ীই তাঁরা এক একজন শিল্পী। মিথ্যা যে কল্পনারই সবচেয়ে তরল, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, জঘন্য একটা চেহারা, তা আশা করি বলে দিতে হবে না আপনাদের। মিথ্যাকে যাঁরা অপছন্দ করেন, মিথ্যা শুনলে আজও কষ্ট পেয়ে থাকেন, তাঁদের কাছে মিথ্যার এই চরিত্র বিশ্লেষণ নিশ্চয়ই ভাল লাগবে না। হয়তো হতাশ হবেন। কিন্তু আমি অসহায় ও নিরুপায়, মিথ্যা নিয়েই যে কথা বলতে হবে, হচ্ছে আমাকে। আর তা, একজন স্বীকৃত মিথ্যাবাদী হিসেবেই। আপনারা সকলেই হয় আদর্শবাদী, ন্যায়বাদী বা নীতিবাদী। এই সমাবেশে আমিই একমাত্র মিথ্যাবাদী।” (মিথ্যেরা, আমার বাতাসে, তদেব, পৃ. ২০৮)
সমস্ত মিথ্যের মধ্যেও রয়েছে সত্যের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা। মিথ্যেবাদীর সমস্ত উচ্চারণ সৎভাবে, এখানে আর কোনো ভণ্ডামি নেই। একটি শিশু প্রথম মিথ্যে বলে পরিবারের কাছে। মিথ্যে বলে ধরা না পড়ার সাফল্য তাঁকে নিয়ে যায় বৃহত্তর জগতে। একটি মিথ্যে অন্য মানুষের কতখানি সর্বনাশ করতে পারে তা আমরা জানি না। তেমনি ভালোবাসার নামে ক্রমেই চলছে মিথ্যা বর্ষণ। বিপরীত পক্ষ যা সত্য বলে ভাবছে আসলে তা মিথ্যা উচ্চারণ। জীবনের কী সাংঘাতিক পরিণতি, পরিণাম। তবুও মানুষ সত্যের কাছে যায়, যেতে চায়, না গিয়ে উপায় নেই। অয়াদিপাউস তো সত্য জানতে চেয়েছিল, সত্য জেনে নিজের পরিণতিকে গ্রহণ করেছিল। তবুও সত্য জানতেই হবে। নইলে এই চরাচর, এই ভূমণ্ডল ভেসে যাবে, ডুবে যাবে। আখ্যানে কেবল ব্যক্তিগত বয়ান উচ্চারিত হয়েছে, লেখকের বিশ্বাস সেই বয়ান থেকেই রাষ্ট্রিক, সামাজিক ধারণাগুলি স্পষ্ট হবে। মিথ্যার শিল্প চারপাশকে দূষণ করে ফেললেও তবুও বাতাসের কাছে মুক্তির প্রার্থনা জানান। নঞর্থক বোধে লেখক আখ্যান শেষ করেন না। কেবলই সত্য খোঁজা, সত্যের সন্ধানে যাত্রা। মিথ্যের ভিতরেও যে একাধিক সত্য লুকিয়ে থাকে তার অনুসন্ধান বড় হয়ে ওঠে।
সমাজ জীবনের গভীর গভীরতর ক্ষতকে অনিশ্চয় চক্রবর্তী আখ্যানে পরিণত করেছেন। ক্রোধ, হিংসা, ক্ষয়, লোভ কীভাবে মানুষের চেতনবিশ্বে নানা পরিবর্তন ঘটিয়ে দিচ্ছে তা তিনি দেখান। ‘আমিত্ব’ প্রতিষ্ঠা করতে কীভাবে সমস্ত ধ্বংস সাধনে মেতে উঠছে তা তিনি গভীর বোধ থেকে প্রতিষ্ঠা করেন। ব্যক্তির চারপাশে কীভাবে শত্রুরা ঘুরে বেড়ায়, প্রিয়জন যেকোন ঠুনকো মুহূর্তেই স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হলেই বিরোধীপক্ষ হয়ে যেতে পারে এমন আশ্চর্য সামাজিক গ্লানি প্রতিটি মানুষের পক্ষে-বিপক্ষে রয়েছে। নৈঃশব্দ কীভাবে মানুষকে গ্রাস করে, নাশকতার শিল্প কীভাবে বড় হয়ে ওঠে, রাত্রির নিস্তব্ধতা কীভাবে ঘাতকতায় পরিণত হয় সেসব বোধ নিয়ে মনঃসমীক্ষণের আখ্যান ‘ধ্বংসেরা, আমার আকাশে’। জীবনের পাশাপাশি মৃত্যুর যে হাতছানি বয়ে চলেছে ক্রমাগত, যেকোন মুহূর্তেই নেমে আসতে পারে আঘাত, অভিঘাত, প্রতিঘাত। কেন এই প্রয়াস? কোন স্বার্থবুদ্ধি মানুষকে এমনভাবে চালনা করে? ঘাতকতায় মানুষ কোন লাভ পায়? ব্যক্তির নির্জনতা, নৈঃশব্দের কোনো ধ্বনি কি প্রবাহিত হয় না ঘাতকের মনে? আমাদের সময়ের প্রবৃত্তি কেমন? অন্যকে দোষারোপের মধ্যে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করা, নিজেকে সৎ প্রতিপন্ন করার যে রহস্য, তা নির্জনে ব্যক্তির চেতনায় কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে কি না এইসব নানা প্রশ্ন, সংশয়, সন্দেহ, জিজ্ঞাসা নিয়ে লেখক উপনীত হয়েছেন। ধ্বংসের মুখোমুখি হবার জন্য মানুষ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রস্তুতিহীন। মানুষের জীবনে, চেতনায়, স্বপ্নে কখন কীভাবে ধ্বংস সৃষ্টি হয় তা সে নিজেই জানে না। তবে ঘাতকেরও গ্লানি থাকে, অপরাধবোধ থাকে। যা আমরা দেখতে পারি না। ব্যক্তির অস্তিত্ব কীভাবে নাশ হয়ে যায়, সামান্য ঘটনায় মানুষের অভিব্যক্তি কীভাবে তৎপর হয় সেসব নিয়ে এক গভীর চেতনার আখ্যান।
মানবদেহে কীভাবে ক্রোধের জন্ম, বিকাশ হয়, মানুষ কীভাবে ক্রোধ লালন করে সব নিয়ে অসাধারণ আখ্যান ‘ক্রোধগুলি, আমার বাতাসে’। মানব মনের বিন্যাস, সম্পর্কের সমস্ত সম্বন্ধকে লেখক নিখুঁত ভাবে জেনেছেন, জানার চেষ্টা করেছেন। ফলে তাঁর গল্পগুলির পরিসর ভিন্ন। সমাজতত্ত্ব, মানবীবিদ্যা, মানুষের মন-অনুভূতি, হিংসা ,ক্রোধ নিয়ে তিনি গভীর ভাবে ভেবেছেন। এমনকি এই অনুভূতিগুলি চেতনার কোন স্তর থেকে উঠে আসে, এমনকি কেন উঠে আসে তা জানার চেষ্টা করেছেন, আখ্যানে লিপিবদ্ধ করেছেন। চেতনাবান মানুষ হয়েও কোন পরিস্থিতি, দৃশ্য চেতনায় নৈরাজ্য সৃষ্টি করে, সমস্ত শুভবোধকে ক্ষণিকের দৃশ্য, বোধ ডুবিয়ে দেয় গহন অন্ধকারে তা নিপুণ বিন্যাসে লিপিবদ্ধ করেন। গল্পকথক রীনাকে চিঠি লিখছে, চিঠিটিই গল্প। দাম্পত্য জীবনের গভীর সম্পর্ক, শারীরিক মিলনের মতো নিবিড় সম্পর্ক যা মানবজীবনে ক্রমেই আনন্দের মুহূর্ত সৃষ্টি করে, সে সম্পর্কেও একজন পুরুষ কীভাবে একটি নারীকে প্রহার করে, আঘাত করে। ভালোবাসার কি এই পরিণাম? সামান্য সৌজন্যবোধটুকুও নেই। সংযম, সংবদেন শব্দগুলি কি ভীষণ অর্থহীন হয়ে যায় না! গল্পকথককের পিতা মাতাকে প্রহার করেছিল। তেমনি বিশ্বাসে আঘাত এনেছিল। মানুষ কীভাবে ক্রোধকে লালন করে তা লেখক দৃষ্টান্ত সহযোগে পর্বে পর্বে বিশ্লেষণ করেন। সেই উত্তরাধিকার বহন করে চলেছেন লেখক। বারবার নিজেকে সংযত রাখতে চেয়েছেন। ক্রোধ নামক রিপুকে বারবার দমন করতে চেয়েছেন। সমস্ত ক্ষেত্রে সফল হলেও একটি ক্ষেত্রে ব্যর্থ হন। পূর্ব প্রেমিকা অন্যের সঙ্গে শারীরিক মিলনে উদ্যত হলে কথক নিজেই জোর করে প্রেমিকাকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করেন। শারীরিক মিলনের স্বাধীনতা নারী, পুরুষ উভয়েরই আছে। তবুও নিজের অধিকারে এই আক্রোশ। কথকের বয়ান অনুসারে এ যৌন মিলন বা তৃপ্তি নয় শুধুই ক্রোধ। ক্রোধের উত্তেজনা। যিনি সারাজীবন ক্রোধকে বিসর্জন দিতে চেয়েছেন তিনিও পারেননি কোনো এক মুহূর্তে। জীবনের এমনই পরিণাম, পরিণতি।
(৫)
অনিশ্চয় চক্রবর্তীর পাত্রপাত্রীর ভালোবাসাও পবিত্র, বিশুদ্ধ, স্নিগ্ধ আলোময়। সেখানে কোনো গ্লানি নেই, আছে সম্পর্কের স্বাভাবিক বিন্যাস। শারীরিক টান বা অনুভূতি আছে, কিন্তু সেদিকে আখ্যানকে নিয়ে গিয়ে তিনি নতুন কোনো রহস্য আবিষ্কার করেন না। তাঁর পাত্রপাত্রীরা যে ক্রমাগত রবীন্দ্র সংগীত গায়। রবীন্দ্র চেতনা, দর্শন চেতনে মননে সর্বদা বিরজামান। ‘বিনির্মাণ’ গল্পে দুটি বিবাহিত পুরুষ, নারী নতুন সম্পর্কে জড়িয়েছে। সাধারণ দৃষ্টিতে তা মনেই হতে পারে অবৈধ। কিন্তু গল্পপাঠে তা কখনোই মনে হয় না। এমনই আখ্যানের আশ্চর্য নির্মাণ, জীবনবোধ। কেন তারা নতুন সম্পর্কে জড়িয়েছে সে ব্যাখ্যা লেখক গল্পের প্রথম পরিচ্ছেদেই রখেছেন—
“মানুষ তো অবচেতনেই বাঁচে শেষ পর্যন্ত। এই আখ্যান তাই সেই অবচেতনের, যা অন্য কারও চেতনায় আঘাত করতে চায়, এক ভালবাসা দিয়ে আরেক ভালোবাসাকে, ভালবাসার প্রাচীনকে ফিরে পেতে চায়, আর একান্তই না পেলে এই টুকরো ভালবাসাকেই আঁকড়ে ধরতে চায় ভালবাসা দিয়ে, ভালবাসার ভাষা আর ভঙ্গিমা দিয়ে।”(বিনির্মাণ, তদেব, পৃ. ২১৫)
এই বক্তব্যটিই যেন গোটা গল্পের সারবিন্দু। বলা যেতে পারে এই বক্তব্যটিকে কেন্দ্র করেই গল্পের আখ্যান বিস্তার লাভ করেছে অথবা এই সারমর্মের বিশ্লেষণই আখ্যান। গল্পের সময় হেমন্তের এক সকাল। বীজেশ ও প্রমিতা দুজনেই বিবাহিত। তবুও সম্পর্কে জড়িয়েছে। এক সকালে গাড়িতে করে ঘুরছে। এটুকুই গল্পের সময় পরিসর। কিন্তু সেই সময় পরিসরকেই চেতনে-অবচেতনে আশ্চর্য বিন্যাসে লেখক উপনীত করেছেন। সম্পর্কের একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিল দুজনেই। অপরাধবোধ যে নেই তা নয়। হেমন্তের সকালে মেঘ-রোদ্দুরের খেলা, হিমেল বাতাস শরীরে স্পর্শ করলে কে আর অপরাধের কথা মনে রাখে? ‘উড়ানগাথা’ গল্পে দুটি নরনারী ভালোবাসার উড়ান দিয়েছে। পাত্রপাত্রী একই। সারাদিনের অফিসের ক্লান্তি ঘুচাতে এই উড়ান। দুজনেরই বাড়ি ফেরার তাগিদ আছে, দায়বদ্ধতা আছে, তবুও নিজের মতো করে বাঁচতে চেয়েছে। গল্পটি সাধরণ। তবে এই সাধারণত্বকে অসাধারণের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন গল্পের শেষ পরিচ্ছেদে। তাদের এই উড়ানগাথা কোনো অপরাধ নয়। তারা কোনো খুন, ধর্ষণ, হত্যা করেনি। সম্পর্কের ইতিবৃত্ত গড়তে চেয়েছে। ভালবাসার সম্পর্ক যে পবিত্র, যা মানুষকে উদার করে, মহৎ করে তাই লেখক জানিয়ে দেন।
আজন্ম কমিউনিস্ট পরিবারে বড় হওয়া অনিশ্চয় চক্রবর্তী মার্কস, লেনিন যেমন পড়েছেন, গরবাচভকে নিজের নেতা হিসেবে যেমন ভেবেছেন তেমনি নিত্য সঙ্গী রবীন্দ্রনাথ। কমিউনিস্ট মতাদর্শের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বিরোধ ঘটেনি। বরং রবীন্দ্রনাথে পেয়েছেন বাঁচার আশ্রয়, লেনিনে সাহস, সংগ্রামী চেতনা। একই কথা বারবার বলতে হচ্ছে। কেননা এগুলিই অনিশ্চয় চক্রবর্তীর ব্যক্তিগত দর্শন। সে দর্শন নিয়েই বেঁচে আছেন। নিজের অন্তর্বিশ্বে ক্রমাগত রোমন্থন করে সৃষ্টি সুখ অনুভব করেন। যিনি ‘রবীন্দ্রনাথের গানের জ্যামিতি’ লিখেছেন তিনি যে ‘বসন্ত উৎসব’ গল্প লিখবেন এতো স্বাভাবিক। রবীন্দ্রনাথের নোবেল চুরি হয়েছে, তবুও উৎসবে ভাটা পড়েনি। উজ্জ্বল নিজের মতো করে রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে চেয়েছে, পূজার বাধা এসেছে। আবার উৎসব মোবাইলের মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে, ব্যক্তিগত অনুভব সমাগত হয়ে যাচ্ছে। গোটা গল্প জুড়েই রবীন্দ্রিক বাতাবরণ। যিনি অনর্গল রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে পারেন, কোলাহলের মধ্য থেকেও দোকানের ক্যাসেটে বাজা গান যে রমা মণ্ডলেরই, তা নিশ্চিত অনুভব করতে পারেন তাঁর হাতে এমন সুরের গল্প, মিস্টিসিজম, আদর্শের গল্পই তো স্বাভাবিক।
‘স্মৃতির কুহক’ গল্পে স্বপ্ন ও স্মৃতি পাশাপাশি অবস্থান করে আছে। স্মৃতি মানুষকে ক্রমেই আঁকড়ে ধরে, অথচ মানুষ সর্বদা স্বপ্ন নিয়ে বাঁচতে চায়। স্বপ্নেরও স্মৃতি আছে। স্বপ্নভাঙা, সফলের স্মৃতি। তবে স্মৃতি যাপনের জন্য অবসার চাই। রাত্রির নির্জনতার মতো নিস্তব্ধ অবসর। মৌমিতা এক রাতের নির্জনতায় ভাবতে বসেছে প্রায় অর্ধশতাব্দীর জীবনের স্মৃতি। আবাসন থেকে বড় শহরে যাওয়া, আবার আবাসনে ফিরে এই স্মৃতি কাতরতা। স্মৃতির এমনই প্রগলভতা যে সুযোগ পেলেই মানুষকে আঁকড়ে ধরতে চায়। মানুষের সেই স্মৃতিকাতরতা, স্মৃতিময়তা, স্মৃতির জড়তা, আকর্ষণ, ব্যর্থতা নিয়ে এই আখ্যান। লেখক মনস্তত্ত্বের গভীরে প্রবেশ করেছেন সাবলীলভাবে। শুধু এ গল্প নয় অনিশ্চয় চক্রবর্তীর সব গল্প সম্পর্কেই একথা সত্য। ভালোবাসার নানা রূপ-রূপান্তর তিনি আবিষ্কার করেন। দুটি মানুষ জীবনের প্রয়োজনে, বেঁচে থাকার প্রয়োজনে, অনুভবের কারণে মিলিত হয়েছে, এই সত্যে তিনি বিশ্বাস করেন। তাই পরকীয়া নয় তা হয়ে ওঠে স্বকীয়া। নতুন সম্পর্কের জন্য নতুন চেতনা, ভাব, ভাষা, ভালবাসার সেতু গড়ে ওঠে। তাঁর নায়ক জানে ‘শিল্পের চেয়ে জীবন বড়’। গল্পের নাম ‘লগন গান্ধার’। অরিজিৎ ও রূপাই মিলিত হয়েছে এক প্রাচীন উদ্যানে। জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ নিয়ে বাঁচতে চেয়েছে। দাম্পত্য জীবনের ক্ষত থেকে বাঁচতে ক্রমেই নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে যায় অনিশ্চয় চক্রবর্তীর পাত্রপাত্রীরা। কোনো সামাজিক অন্যায়, অপরাধ বোধ নয়, নারী-পুরুষের সম্পর্ককে তিনি দেখেন চরাচরের মহৎ সম্পর্ক হিসেবে। জীবনবোধের পাশাপাশি ভাষাচয়ন, বাক্প্রতিমা, শিল্প-জীবন সম্পর্কে বহু অভিজ্ঞতা, সাহিত্য সম্পর্কিত ধারণা নিয়ে উপস্থিত হয়। সেই সঙ্গে রয়েছে সমাজতাত্ত্বিক বিন্যাস ও মানব মনের সুনিপূণ ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ। চেতনায় কীভাবে অপরাধবোধের জন্ম হয়, ক্ষমতাবানের চেতনায় সে বোধ কীভাবে লুপ্ত হয়, ক্ষমতাবান কীভাবে নিজের দোষ অপরের ওপর চাপিয়ে দিতে পারে, সেইসব বিবিধ প্রবণতা, বিশ্লেষণের অনুসঙ্গ আখ্যানে উঁকি দেয়। অনিশ্চয় চক্রবর্তী কাহিনি বলতে বলতেই জীবন, শিল্প, মানুষ, রাজনীতি সম্পর্কে এমন কিছু ধারণা ও বিশ্লেষণ প্রবেশ করিয়ে দেন যা আখ্যানকে স্বতন্ত্র করে। এমনকি আখ্যান সরলতার পথ অতিক্রম করে বিবিধ ভাবনা দাবি করে। যৌনতা না তা আশ্রয়চেতনা, হিংসার প্রথম উৎপত্তিস্থল কোথায়, হিংসার ভাষা মানবমন থেকে কীভাবে শরীর আঘাত করে, যাপনচিত্রের বিবিধ চিন্তাবলয় নিয়ে অনিশ্চয় চক্রবর্তীর আখ্যান নির্মিত। জীবন, ভালবাসা, সম্পর্ক, অনুভূতি নিয়ে তিনি নানা বিশ্লেষণে অবতীর্ণ হন, যেখানে লুকিয়ে থাকে জীবনেরই নানা রসদ। তেমনি ধর্ষণের কোনো রীতিনীতি নেই, সব বোধ দ্বারা চালিত। সেই বয়াননামা নিয়েই ‘ধর্ষণের রীতিবিধি’ গল্প। মৃত মানুষের মধ্যেও কামানা খোঁজে মুন্না। চোখজ পিপাসা। কামনার কোন আবরণ হয় না, আভরণ হয় না। সে শুধু ধায়।
বোধের যে বহু স্বর সেই স্বরের অভ্রভেদী নির্মাতা অনিশ্চয় চক্রবর্তী। এক সংবেদনশীল বোধ নিয়ে তিনি দেখেছেন জীবনকে, মানুষকে, মানুষের মনকে। একটিও অশ্লীল শব্দ নয়, বরং সে শব্দ মনে জাগার জন্য যে অপরাধ, তা থেকে বহুদূরে আখ্যান ও চরিত্ররা। ব্যক্তির অহং কীভবে পরাজয় চিহ্নিত করে, গ্লানিবোধের জন্ম দেয় সেই ক্ষত চিহ্নিত করে আবার তিনি শুভ চেতনায় ফিরে যান। মানুষের দ্বারাই মানুষের ক্রমমুক্তি ঘটবে। কোথাও দৃঢ় আঘাত নয়, এক ব্যথিত মন নিয়ে রাষ্ট্র, সমাজ সময় সম্পর্কে নিগূঢ় সত্যনামা দিয়ে যান নিজস্ব ভঙ্গিতে। ব্যক্তির যে নিজস্বতা, জীবনচেতনার যে নিজস্বতা তা অনিশ্চয় চক্রবর্তীর আখ্যানের সত্য বহন করে।
পুরুষোত্তম সিংহ
সুভাষগঞ্জ, রায়গঞ্জ, উত্তর দিনাজপুর
চলভাষ-৬২৯৭৪৫৮৫৯১
0 মন্তব্যসমূহ