মারিয়া এউখেনিয়া রামোস'এর গল্প : লাল রিবন

মূল স্প্যানিশ থেকে বঙ্গানুবাদ: জয়া চৌধুরী

দিম্মা সোফায় গড়াগড়ি করছিল। অনেকক্ষণ থেকে সোফায় বসে ঢুলছিল। আমি জানি ওখানে ওভাবে বসে ঝিমোনো আর কবরের মধ্যে থাকার মধ্যে কোন তফাৎ নেই। বহুদিন হল খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। কানে শোনে না, চোখে দেখতে পায় না, ভয় আর ব্যাথাবেদনা ছাড়া কিচ্ছু টের পায় না। ক্বচিৎ কখনও নিজের পুরনো কথা মনে পড়ে যায়, তখন চারপাশে চেনা মানুষদের খোঁজে। আর্তুরো নাকী? প্রায় অশ্রুত গলায় ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে। হ্যাঁ দিম্মা এই তো। কিছু চাও? কিছু না। উত্তর দেয়। ভাবলাম ওরা আমাকে একলা রেখে গেল নাকী।

যবে থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছে তখন থেকে একলা থাকতে ভীষণ ভয় পায়। ওই জন্যই বসবার ঘরে সবকিছু নিয়ে বসত করছে। ঘরের যে কোনটায় দিম্মা থাকে সেখানে কড়িকাঠের ওপর একটা কাঠপোকা কটকট কটকট করতে থাকে। ব্যাটা সারা বাড়ি দখল করেছে। জিনিষপত্র খেতে খেতে এমন অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে যে কয়েকটার তো কাঠামোটা কেবল আছে। যে কোনদিন ছুঁড়ে ফেললেই হয়। ওদের কাছে বলেছিল দিম্মা যাতে সোফাটাকে সারিয়ে দেয়। ওখানেই তো রোজ সকালে দিম্মার ঘর থেকে লেপ কম্বল গুলো আর বালিশের স্তূপ নিয়ে এসে রাখে। ওগুলোর মধ্যেই ফ্যাকাশে ত্বক নিয়ে দিম্মা পড়ে থাকে রোগা হাড়গুলো সুদ্ধ, ওরা ঝুরঝুর করে ঝরে পড়বার অপেক্ষায় আছে। খুব কম, এক আধবারই আমি মিস্ত্রীর কাজ করেছি। সামান্য যে কটা টাকা রোজগার করতে পেরেছি বলেছিলাম দিম্মাকে চাকাওয়ালা চেয়ার কিনে দিই। কিন্তু শোনে নি। বলে আমি আর কটা দিনই বা আছি। খরচ করবি কেন? সোফা থেকে যখন কলঘরে যায় চেয়েছিলাম দেয়ালে রেলিং বসিয়ে দিই যাতে ধরে ধরে যেতে পারে। অন্য কারো ওপর নির্ভর করতে হয় না তাহলে। বলে- না। তাহলে বাড়ির অন্যদের অসুবিধা হবে চলাফেরা করতে। চিরকাল ঘাড় তেড়া মানুষ। আর এই অবস্থায় এত জেদ আমাকে মরীয়া করে তোলে। বারকয়েক চেষ্টা করেছি। তবে তারপর থেমে গেছি। এখন দিম্মা যদি চায়ও আমার আর টাকা নেই। যে সামান্য কটা টাকা পড়ে আছে সেটাও দিম্মার কটা ওষুধের জন্য। মামারা ভাবে এটা আমার বাধ্যবাধকতা। আমার চাকরিবাকরি থাকুক বা না থাকুক, শুধু এই কারণে প্রয়োজনীয় থাকতে আমার ভাল লাগে। যদিও এটা খুব মনগড়া এক প্রয়োজনীয়তা, তবুও। কেননা মনে মনে জানি ওষুধপত্র কিছুই এটা সারায় না, এমনকি একটু উপশমও করে না ব্যাথার।

এ বাড়িটায় যেখানে আমি বড় হয়েছি, সেটার পিছন দিকে থাকি আমি। একটা ছোট ঘর যেটায় আসলে সেলার থাকার কথা সেখানে। এদিককার দীর্ঘ গ্রীষ্মে যেটার অ্যালুমিনিয়ামের ছাদ এত গরম হয়ে ওঠে যে সহ্য করা যায় না। আমি রাজমিস্ত্রি। বাড়ি বানানোর কিছু কাজ আমি জানি। ওই ছাদটাকে ভালভাবেই বদলাতে পারি। অন্তত একটা ফাঁপা ছাদ ওটার তলায় বানিয়ে নিতে পারি যে সময়ে হাতে কিছু টাকাপয়সা পড়ে থাকে। কিন্তু তাও নিজেকে জিজ্ঞেস করি কীসের জন্য খরচ করব। আমার তো এখানে চিরকাল থাকার কোন ইচ্ছে নেই। কোথাও না কোথাও নিশ্চিত একটা বাড়ি হবে আমার, একটা জীবন যা আমার নিজস্ব হবে। তুমি নও। যখন মনে হবে না ধারের টাকায় বাঁচছি। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, এই ভাবনা থেকেই জামাকাপড় কেনা ছেড়েছি। সত্যিটা হল একজন রাজমিস্ত্রির নতুন জামাকাপড় লাগে না। দু চারটে রঙ চটা জামা থাকলেই যথেষ্ট। কারণ কাজটা নোংরা। আর যখন কাজ থাকে না তখন একেবারেই টাকাও থাকে না, অতএব বাইরে বেরনোর দরকারও পড়ে না।

আমি এ বাড়িতে রয়ে গেছি কারণ মা আমায় এখানেই ফেলে গিয়েছিল। এভাবেই পিয়ানোটাও ফেলে গিয়েছিল। মনে পড়ে সেসব দারুণ দিন যখন কাঠপোকারা ছিল না। মা পিয়ানো বাজাত আর গান করত। আমার সে গানগুলো শুনতে বড্ড ভাল লাগত। যদিও কথাগুলোর অর্থ কিছুই বুঝতাম না। মা বলত বাণীগুলো ফরাসী। বলত বড় হলে আমাকে শিখিয়ে দেবে। কিন্তু একদিন আমায় বলল- নিজের হৃদয়ের কথা শোনা উচিৎ। তারপর চলে গেল। আমার তখন ছ বছর বয়স। আমি তখন সবসময় ভাবতাম মা আমার বড় দিদি। আমার সুন্দরী দিদি যে আমাকে তার লম্বা চুল আঁচড়ানোর সময় তা দেখতে দিত। মামাদের লুকিয়ে যখন ঠোঁটে রঙ মাখতাম তখন কিচ্ছু বলত না। যখন সে চলে গেল আমার মামারা বলল সে আমার দিদি নয়। কোন প্রেমিকের সঙ্গে মেশবার ফলে পেটে বাচ্চা এসে গিয়েছিল। সে জানত না কার বাচ্চা। ওভাবেই আমি জন্মেছিলাম। অনেক দিন অপেক্ষা করেছিলাম মার জন্য যদি ফিরে আসে সে আশায়। সেসব দিনে পিয়ানো অভ্যাস করতাম মাকে মনে করবার জন্য। যতদিন না দাদু বলল- এই বাচ্চাটা পিয়ানো বাজিয়ে খুব গন্ডগোল করে। ওদের বলল পিয়ানোটাকে সেলারে রেখে আস্তে এখন যেখানে আমি শুই। ও ঘরে অনেককিছু ডাই করে রেখেছে বলে শেষমেশ জিনিষপত্র ভেঙে পড়ে। ভেতরে ভেতরে আমার ধারণা দাদু আসলে এভাবে চেয়েছিল মা যে বুকে দাগা দিয়ে চলে গেছে আমাদের ফেলে সে চিহ্ন সরিয়ে ফেলতে। আমি কখনও বুঝি নি হৃদয়ের কথা শোনা- শব্দগুলোর অর্থ কি। হৃদয় তো আমাদের এখানেই রয়েছে, বুকের খাঁচার ভেতরে। মার জিনিষের মধ্যে শুধু লিপস্টিকটাই রয়ে গেছে আমার কাছে। যাবার সময় নিতে ভুলে গিয়েছিল। মামারা কখনও ধারণাও করতে পারে নি যে আমি অপেক্ষা করতাম কখন তারা বেরিয়ে যাবে আর আমি ঠোঁটে রঙ মাখব। তারপর আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের চোখদুটোর মধ্যে মাকে খুঁজব। কিন্তু কখনও দেখতে পাই নি।

গড়িয়ে গড়িয়ে স্কুলে যেতে থাকলাম, রান্নাঘরে খেতে লাগলাম ঠাম্মার সঙ্গে। মা যখন ছিল মার সঙ্গে যেভাবে খেতাম। ক্লাস সিক্সে উঠতে আমার বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। ক্লাসে মনোযোগ বসাতে পারতাম না। সবসময় বকা খেতাম। দাদু বলত যে পড়াশুনা করতে চায় না তার উপরে আমি খরচ করতে পারব না। মামাদের একজনের কাজে সাহায্য করবার জন্য আমাকে লাগিয়ে দিল। রাজমিস্ত্রীর কাছে সে দারুণ পটু। এভাবেই আমি রাজমিস্ত্রি হয়ে উঠলাম। টাকা রোজগার করতে শুরু করে আমার ভাল লেগেছিল। অন্য মিস্ত্রিরা টাকাগুলো বিয়ারে খরচ করত। কিংবা যাদের তখনই বিয়েশাদি হয়ে গিয়েছিল, তারা তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য খাবার কিনে খরচ করত। কিন্তু আমি বাজারের কোন অচেনা দোকান যেখানে কেউ আমায় চিনবে না সেখান থেকে লিপস্টিক কিনতাম। ওদের এনে সেলারের ঘরে জড়ো করতাম। ততদিনে ওটা আমার ঘর হয়ে গিয়েছিল। যে লিপস্টিক মা ফেলে গিয়েছিল সেটা ততদিনে শেষ হয়ে গিয়েছিল। ছট থাকতে এতবার ঠোঁটে ঘষেছি ওটা। কিন্তু এখনও একটা কৌটোয় ওটা রেখে দিয়েছি। সবসময় আমার সঙ্গে রাখি ওটা। কখনও সখনও ফাঁকা টিউবটা জড়িয়ে ধরি।

দাদু বছর কয়েক আগে মারা গেছে। কবর দেবার সময় থাকতে পারি নি। কারণ তখন একটা বাড়ি তৈরির কাজে শহরের বাইরে গেছিলাম। আমি খুশি। কারণ আমাকে দুঃখের ভান করতে হয় নি। লোকটা আমাকে কখনও কাছে টানে নি, কখনও দূরেও ঠেলে দেয় নি। কখনও সখনও দূর থেকে দেখে আশ্চর্য হতাম। লোকটা যেন অদ্ভুত ধরনের ছিল। হ্যালোউইন দিনে কখনও হয়ত দিম্মার সঙ্গে গিয়ে পূর্ব পুরুষদের কবরে ফুল দিয়ে আসত। তবে সে কেবল যদি আমার মামারা কেউ বাড়ি না থাকত তবেই।

দিম্মার স্বাস্থ্য ভাল ছিল। মুখেও কখনও মার কথা বলত না। কেউ মার কথা বলত না। শুধু মামারা ছাড়া। আমার উপর যখন তারা রেগে যেত তখন এমন অনেক কথা বলত সেগুলো কিছু বুঝতাম না। কিন্তু আমার উপর খুব চটে থাকত ওরা। যেদিন থেকে অসুখে পড়েছে ঠাম্মা সেদিন থেকে আমার কাছে মার কথা বলা শুরু করে। আমরা যখন একলা থাকি তখন বলে। নালিশ করতে থাকে তারা সবাই কীভাবেই না মাকে দেখভাল করেছিল। একমাত্র মেয়ে সন্তান হিসাবে খুবই আদর যত্নে পেয়েছিল মা। কী করে মা পারল আমাকে ফেলে যেতে সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে। মার সম্বন্ধে খারাপ কথা শুনতে ভাল লাগত না। কিন্তু সহ্য করে যেতাম। কারণ মামারা কাজে বেরিয়ে গেলে দিম্মার সঙ্গে একলা থাকতে আমার ভাল লাগত। আসলে দিম্মার পুরনো সব সেলাইগুলো খুঁটিয়ে দেখতে ভাল লাগত। এমনকি কিছু জামা পরে দেখতে ইচ্ছে করত যেগুলো ওই পুরনো কাপড়ের ট্রাঙ্কে ন্যাপথালিন দিয়ে রেখে দিয়েছিল দিম্মা। কোন অজ্ঞাত কারণে সেটা দিম্মাকে অবাকও করত না। এমনকি বলত এটা ভাল করে দেখ। কিংবা ওই রঙটা তোকে বেশি ভাল মানাবে। যাতে চোখে না পড়ে সেভাবে কয়েকটা জামা আমি আমার সেলার কুঠরিতে নিয়ে এসেছিলাম। সেইসব লম্বা সময়ে যখন আমার কিছু করবার থাকে না তখন সেগুলো যাতে পরে থাকা যায় সেজন্য। বাজে ব্যাপারটা হল ও ঘরে বড় আয়না ছিল না যাতে গোটা শরীর দেখতে পাওয়া যায়। বেসিনের উপরে একটা ছোট আয়না। ওটা আমিই লাগিয়েছি ওখানে। শাওয়ার আর টয়েলেটের পাশে। এইসব জিনিষে আমি খরচ করেছি। কেননা রাতে মামারা দরজা বন্ধ করে দিত। বাড়ির কলঘরটা ব্যবহার করতে পারতাম না। বড় একটা আয়না আমি কিনতেই পারতাম। কিন্তু আমার জবাবদিহি করতে আলস্য লাগত কেন একজন পুরুষমানুষের, যে আবার রাজমিস্ত্রি, তার ঘরে একটা বড় আয়না লাগাতে চায়। নানা দিক থেকে দেখা পছন্দ করতাম। আমি এই ভাবনায় পৌঁছেছিলাম যে আমি এরকমই। নানা টুকরো জুড়ে তৈরি। জানি না আমি ওরকমই নাকী একখানা শরীরে অনেকগুলো মানুষ। এই ভাবনাটা সদ্যই মনে উদয় হয়েছে। আর আমি শিউরে উঠে মাছি তাড়ানোর মত করে ভাবনাটা তাড়াই।

আজ ফের আমি দিম্মার কাছে এসেছি। কিন্তু আরো পোশাক খুঁজছি না। স্রেফ একটা লাল রিবন খুঁজছি। কোন কারণে আমি এমন রিবন চাই যেটা লিপস্টিকের রঙের সঙ্গে মানানসই হবে। হয়ত মনের মধ্যে আবছা কোন স্মৃতি রয়ে গেছে যে মা কে দেখেছি চুলে এমন কোন রিবন পরে থাকতে। আমাকে যখন কোলে নিত না মা তখন চুল আঁচড়াত। সেখানে অনেক কিছু আছে যেখানে খোঁজার। শোবার ঘরে যাবার রাস্তাটা ভিড়ে ভিড়াক্কার। একটা তাক গোটা দেয়ালটা ঢেকে দিয়েছে। ধুলোভরা তাক আর একগাদা বই যেগুলো কেউ পড়ে না। একটা ভাঙা আসবাব। কোনরকমে ঠেকনা দিয়ে রাখা হয়েছে যাতে পড়ে না যায়। একগাদা এলোমেলো বাক্স ঠাসা। কয়েকটা আবার প্লাস্টিকের। গোছানো বাড়িতে ভদ্রলোকেরা যেসব জিনিষ সাজায় সেরকম। কটা বাক্স জুতোর। আবার ব্যবহার করার মত। ভেতরে মালপত্র রেখে দেয়া যায়।

যদিও রাজমিস্ত্রির কাজ করি বলে আঙুলগুলো মোটা আর শান্ত আমি কাপড়গুলোর সেলাইয়ের ভাজে হালকা হাতে বুলাতে পারি, পুরনো ফেব্রিকের ভাঁজে সুতো, লেস, বোতামের খোঁজ করতে পারি । অনেক ফিতে আছে। সবুজ, কমলা, গোলাপি, নীল। কিন্তু লাল ফিতে খুঁজে পাচ্ছি না। সোফার কাছে গেলাম দিম্মা ঘুমাচ্ছে যেখানে। মুখটা আধখোলা। জানি পুরোপুরি ঘুমায় নি দিম্মা। কারণ কখনও সখনও নালিশ করতে থাকে। দিম্মা, ডাকলাম। উত্তর দিল না। একটু জোর গলায় ডাকলাম দিম্মা। মুখ বন্ধ করল। চোখটা একটু ফাঁক করে তাকাল। দিম্মা, ফের বললাম। লাল ফিতেটা খুঁজে যাচ্ছি। আছে কি না তোমার মনে আছে? এখন জানি জেগে রয়েছে। কারণ আমার হাত ধরেছে। হাতটা ঠান্ডা টের পেলাম। এত গরম থাকা সত্ত্বেও আমার বমি পাচ্ছিল খুব। কিছু সময় দিলাম দিম্মাকে যাতে ফের আগের অবস্থায় ফিরে যায়। যাতে আমাকে চিনতে পারে, যাতে টের পায় সোফায় বসে আছে, একগাদা বালিশ ঘিরে কম্বল চাপা দিয়ে রয়েছে। কী? – আমায় প্রশ্ন করল। তোমার লাল ফিতে আছে দিম্মা? একটু থমকাল। কয়েক সেকেন্ড চুপ। টের পেলাম স্মৃতির ফুটো দিয়ে খুঁজতে চেষ্টা করছে। অপ্রত্যাশিতভাবে চোখ দুটো বড় করে তাকাল। সাধারণত যে গলায় কথা বলে তার চেয়ে স্পষ্ট স্বরে বলল- হ্যাঁ, খাটের নিচে একটা কাঠের বাক্স রাখা আছে, সেটায় দেখ।

কোন বাক্সের কথা বলছে আমি জানি। একটা বাঁকানো কাঠের বাক্স, ট্রাঙ্কের মত আকার। কিন্তু ছোট্ট। ছোটবেলা থেকে কৌতূহলের চোখে দেখেছি। ভেতরে কী আছে তা জানতে চাই খুব। কিন্তু সবসময় চাবি দেয়া থাকত। কিছু প্রশ্ন করার আগেই ঠাম্মা বলল- চাবিটা আমার টেবিলে মাতা মেরির ছবির পিছনে আছে।

দিম্মা বরাবর একনিষ্ঠ ক্যাথলিক ছিল। ঘরটা দেবদূত আর সন্তদের ছবিতে ভর্তি। কারো কারো বাঁধানো ছবিতের ফ্রেমে, কেউ খোদাই করা মূর্তি রূপে। একজন দুঃখী মুখের মানুষের মুখ আছে সেখানে। ছোট থেকেই ওটা দেখলে ভয় পেতাম। ঠিক যেন আমার দাদুর মুখ। সাদা জামা আর চটি পরা, হাতে একটা দাঁড়িপাল্লা ধরে আছেন, পায়ের কাছে অনেক মানুষ পড়ে আছে যাদের গায়ে আগুনের শিখা। ইনি হলেন স্বয়ং ন্যায়বিচার। দিম্মা বলত। ভয় পাস না। শুধু আদবকায়দা ভাল রাখিস যাদের সেসের দিন এলে তোকে নরকে যেতে না হয়। এসব আমাকে কেন বলছে বুঝতে পারতাম না। যেটা বাজে ব্যাপার ছিল সেটা হল আমি স্কুলে অন্যমনস্ক থাকতাম। যখনই ও ঘরে ঢুকতাম তখনই চাইতাম অন্যদিকের দেয়ালে তাকাতে। কারণ আমার খালি মনে হত দেয়াল থেকে এই ভদ্রলোক আমার দিকেই একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে। রাতে দুঃস্বপ্ন দেখতাম। বদলেও কুমারী দেবীদের ছবি অনেক নরম ছিল। তাদের পোশাকগুলো খুব প্রিয় ছিল আমার। মনে হত নরম কাপড়ে তৈরি সেসব পোশাক। মজবুত সেলাই। দেবী গুয়াদালুপে আর দেবী কারমেন, কিন্তু যখন কুমারী মা বলে বলত দিম্মা, আমি ঠিক টের পেতাম কার কথা বলছে। দেবী সুইয়াপা। দিম্মা এর খুব ভক্ত।

শেষ পর্যন্ত আমি আবেগে উদ্বেল হয়ে উঠতে পারলাম। বহুবছর পরে এমন হল যখন বাক্সটা খুললাম। দেখলাম ভেতরে কী আছে। আমি তাড়াতাড়ি ফিরে এলাম- দিম্মা বলল। এত সময় একলা থাকতে আমার ভাল লাগে না। আমি তাড়াতাড়ি ঘরে পৌঁছলাম। চাবিটা যেখানে রাখা ছিল দিম্মা ঠিক সে জায়গাটার কথাই বলেছে। বাক্সের ধুলো সরালাম। ফুটোয় চাবি ঢোকালাম। বেশ ধ্বস্তাধ্বসি করে খুলতে হল। বহুদিন খোলা হয় নি দেখে এঁটে বসেছিল। আমাকে আশ্চর্য করে সেখানে যা ছিল দেখলাম, তা হল একটা লাল ফিতে। চুলে আটকানোর ফিতে। কোনভাবে মনে পড়ল যখন ছোট ছিলাম এটাই আমি মাকে পরে থাকতে দেখতাম। ভাবতাম আমার দিদি।

হাতে ফিতে নিয়ে আলমারির গায়ে লাগানো বড় আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। দেখলাম আমি কেমন। প্রাপ্তবয়স্ক একজন পুরুষ, ছেঁড়া ফাটা কাপড়ে বানানো ট্রাউজারস আর গেঞ্জি পরে রয়েছি। দুহাত আড়াআড়ি করে রাখা। আমি যেন কাজ করছি না। বহুদিন হল চুল ছাঁটিও না কিংবা কোন কায়দাও করি না। বড় চুল নেই আমার। এটা আমার পছন্দ হল। মনে হল ফিতেটা ভাল্ভাবে মাথায় আটকাতে পারব। দাদুর ব্রাশটা নিলাম। সাবধানে চুল আঁচড়ালাম। আমার হাতদুটো শক্তপোক্ত। কিন্তু চুল নয়। নরম। আশা করি আমার মায়ের মত চুল। মার মত দেখতে হল আমার দারুণ লাগবে। তবে মার মতই কী না জানি না। কারণ মার একটা ফটো নেই আমার কাছে। প্রতিদিন আমার স্মৃতির থেকে আরো একটু দূরে সরে যাচ্ছে।

ভাল করে দাঁত মেজে মাথায় ফিতেটা বাঁধলাম। তারপর আবার দিম্মার ঘরে গেলাম। বেশিক্ষণ একলা থাকুক চাই না। ঘুমোচ্ছে নতুন করে নির্ঘাত। আওয়াজ না করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু জেগে আছে। দেখলাম মনে করার চেষ্টা করছে। কাছে গেলাম। সাহায্য করতে হাঁট দুটো ধরলাম। একলা পারে না দিম্মা। মনে হল ভয় পাচ্ছে, তবে শেষ মেস বসতে পারল। সোফার উপর পাশে বসলাম। যদি কলঘরে যাবার দরকার হয়। তখন দেখলাম কাঁদছে। বসা গালের উপর দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে দরদর করে। নাক মুখের খানা খন্দের ভেতর জল আটকে যাচ্ছিল। তখন যে ভয় পেল সে হল আমি নিজে। কী হয়েছে দিম্মা? কী আছে? ব্যাথা করছে তোমার? মাথা নাড়িয়ে না বলল। হাঁট তুলে আমার মাথায় বাঁধা ফিতেটা ধরল। জানি না ওটা খুলতে চাইল নাকী মাথায় হাত রাখল আশীর্বাদ করার ভঙ্গীতে। তবে আমি এগিয়ে দিলাম যাতে আমাকে ছুঁতে পারে।

এটা ওর। বলতে শুরু করল। চোখের জলের মাঝখান দিয়ে কথাগুলো বুঝতে একটু বেগ পেতে হচ্ছিল। যখন অতসব ঘটেছিল একমাত্র এটাই তার কাছে রয়ে গিয়েছিল। জিজ্ঞেস করলাম না ‘ও’ কে। কারণ আমি তো জানি ও হচ্ছে আমার মা। যে নতুন করে আমার স্মৃতিতে তার লম্বা চুল নিয়ে ভাসতে শুরু করেছিল। কিন্তু চাইছিলাম ঠাম্মা কান্না বন্ধ করুক। ভীষণ অস্থির হয়ে উঠেছিল। দিম্মা, বললাম, কিছু আনব? ছাড়- বলল। আমায় বলতে দে, কারণ এখন আমার সব মনে পড়ছে।

জানি না কী মনে করে এত কাঁদছে। আজ সপ্তাহের কোন দিন সেকথা মনে করছে। কিন্তু খেয়াল করে চুপ করে অপেক্ষা করতে লাগলাম। তখন কথা বলতে শুরু করল। আমি জানি কিছুই থামাতে পারবে না। তোর মা কোন প্রেমিকের সঙ্গে বেরিয়ে গিয়ে পেটে বাচ্চা আনে নি। তোর কাকারা তোকে যেসব কথা বলে, আমি তোকে যা যা বলেছি সেসব মিথ্যে। আমি মনে করতে চাই না। ও খারাপ মেয়ে ছিল না আমার। সুন্দরী বুদ্ধিমতী মেয়ে আমার। স্কুলে ভাল ফল করেছিল। দামী স্কুল ছিল। ওখানে পিয়ানো শেখাত আর ফরাসি শেখাত। তোর দাদু অনুমতি দিয়েছিল। টাকাও দিত সেজন্য।

কান্না থামিয়ে দিয়েছিল। এক মুহূর্ত চুপ করে রইল। ভাবলাম আবার বলি জল দেব নাকী। কিন্তু ভাবলাম থাক। এখন আরো জোরে বলছিল। মুখের ভাব অন্যরকম। মনে হচ্ছে যেন হঠাত করে থেমে গেছে সব যন্ত্রণা, যা এতক্ষণ ধরে হচ্ছিল। আমি তলিয়ে দেখতে চাই নি- বলল, তলিয়ে কিছুই বুঝতে চাই নি। কারণ আমাকেই তো ওর দেখাশোনা করতে হত। তোর দাদু মামাদের সঙ্গে শুত। কারণ তোর মা যখন আমার পেটে ছিল, তখন থেকেই এরকম। ও সবচেয়ে ছোট। বলেছিল- ওকে দেখলে বিরক্তি লাগে। একদিন ভোরবেলা আমি কলঘরে গেছিলাম, দেখলাম তোর মার ঘরের দরজা খোলা। আমি বন্ধ করতে গেলাম। ভাবলাম হাওয়ায় খুলে গেছে বুঝি। তখন দেখলাম। সবকিছু দেখলাম। কারণ রাস্তার আলো জানলা দিয়ে ঘরে এসে পড়েছিল। তোর দাদু বিছানায়। তোর মার ওপরে। ও নড়তে পারে নি। চোখদুটো খোলা ছিল। কিন্তু কিচ্ছু দেখতে পারছিল না। চুলে এই লাল ফিতেটা লাগানো ছিল।

আমার চোখদুটো খোলা রয়ে গেছিল। আমি কোন কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। দিম্মা যেমন বলল আমার মা যেমন করে ছিল। অনেক দূর থেকে দিম্মার গলার স্বর শুনতে পাচ্ছিলাম। দুর্বল বলে নয়। বরং আমি অন্য দিকে সরে গিয়েছিলাম। ওখান থেকে গলার আওয়াজ কম শোনা যাচ্ছিল। নিজের ঘরে ফিরে এলাম। নিজের জীবন কাটাতে লাগলাম। কিছু করি নি, কিছু বলি নি। দিম্মা বলে চলল। কি ঘটেছে সেটা ভুলে যেতে বাধ্য হলাম। তোর মার পেট যখন ফুলতে শুরু করল, জানতাম বাচ্চাটা তোর দাদুর। আমরা তিনজন জানতাম। কিন্তু কখনও বলিনি। তোর দাদু ওকে স্কুল থেকে বের করে আনল। সময় হলে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। তুই জন্মালি। তোকে সামলানোর জন্য ও অনেকদিন রইল। শেষ পর্যন্ত ও চলে গেল। আমি ওকে কখনও খুঁজি নি। শুধু লাল ফিতেটা রেখে দিয়েছিলাম। এটা যাতে কখনও আর না দেখতে হয়। তোর দাদু তোর দাদুও বটে আবার বাবাও। তোর দাদু আর আমি, আমরা দুজন তোর মাত্র জীবনটা শেষ করে দিয়েছি। আমার মেয়ের জীবন।

শেষ পর্যন্ত কথা থামাল। আমি কিছু বললাম না। দিম্মাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টাও করলাম না। সেও চাইল না। আবার শুয়ে পড়ল। জানি এই দফায় ঘুম ভেঙে আর উঠবে না। তার ঢুলুঢুলু তন্দ্রার আশ্রয় থেকে বেরোবে না। খেয়াল করে দেখলাম সে আর মরতে পারবে না, কারণ বহুদিন হল সে মৃত।



লেখক পরিচিতি
মারিয়া এউখেনিয়া রামোস (María Eugenia Ramos ) তর্কসাপেক্ষে হন্ডুরাসের বর্তমান কালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লেখক। বর্ষীয়ান এই সাহিত্যিক ১৯৭৮ সাল থেকে সে দেশ এবং লাতিন দুনিয়ায় বেশ কিছু পুরষ্কারে ভূষিত হয়ে চলেছেন। বাংলা ভাষায় এই প্রথমবার হন্ডুরাসের কোন সাহিত্যিকের কাজ অনুবাদ করা হল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ