কিযী তাহনিনের গল্প : আমি মেশিনঘরের রিসিপশনিস্ট


দিনের বেশির ভাগ সময় মানুষ নিজেকে দেখতে পায়না। অন্যের চোখে তার বুঝে নিতে হয় নিজেকে। ভাগ্গিস সে নিজেকে দেখতে পায়না। দেখতে পেলে বুঝতো, যে নিজের কাছে আমরা কতটা অদেখা। এই যে বিচলিত মানুষ, এই যে অস্থির মানুষ যখন গভীর অপেক্ষারত অবস্থায় পা নাচায়, এদিক ওদিক তাকায়, দাঁত দিয়ে নখ কাটে, সে কি জানে তাকে দেখতে কেমন লাগে? বড় বড় শ্বাস, শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁট, আর অস্থির দৃষ্টিতে কি ভীষণ অসহায় দেখায়, মানুষ যদি নিজের সে চেহারা দেখতে পেতো। দেখতে না পাওয়াই ভালো। নিজেকে পুরোটুকু দেখে ফেললে, জীবনের পেছনে এমন করে ছুটে কি আর ভাল লাগবে? সকালে আয়নায় দেখা, কিংবা লুকিয়ে জানালার কাঁচে কিংবা বাথরুমের আয়নায় এক ঝলক, নিজেকে দেখা আমি যে আমিই নই, এইটা যে আমরা মনে রাখিনা, কিংবা সচেতন ভাবে ভুলে যাই, এটা ভালো। সামনে তাকাতে ইচ্ছা করে। নিজেকে বড় সুন্দর লাগে।

এই যেমন আমি। আমি কিন্তু প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা, মানুষের এমন বিচিত্র চেহারা দেখি। অস্থির মানুষ, অসহায় মানুষ, অপেক্ষায় মানুষ, আশায় মানুষ। কতরকম মানুষ। কিন্তু আমি যখন তাদের দেখি, তখন আমাকে দেখতে কেমন লাগে , আমি তা জানিনা। জানে ওপারে বসে থাকা মানুষগুলো। যারা আমাকে দেখছে।

আমি যে কাজটি করি, তাতে মানুষ দেখা অন্যতম। আমি একটি বড় ঘরের মাঝ বরাবর একটি চেয়ারে বসে মানুষ দেখি। সামনে থাকে ছয়েক কাঠের টেবিল। প্রতিদিন ৮/৯ ঘন্টা। এটিই আমার চাকরি। আমি একজন রেসিপশনিস্ট।

আমি কোনো ডাক্তারখানা কিংবা বিউটিপার্লারের রিসিপশনিস্ট নই। কোনো বড় কর্পোরেট কিংবা জ্যোতিষীর ব্যবসার রিসিপশনিস্ট ও না।

আমি একটি মেশিনঘরের রিসিপশনিস্ট। মেশিনঘর শুনলেই প্রথমে মনে হয় পানির পাম্পের মেশিন। কিন্তু আমি এমন কোনো সহজ সাধারণ মেশিনঘরের রিসিপশনিস্ট না। আমি সেই মেশিনঘরের রিসিপশনিস্ট, যে মেশিনে মানুষের স্বপ্ন তৈরী হয়। স্বপ্ন তৈরির মেশিন।

স্বপ্ন তৈরির মেশিন। যে মানুষেরা কাজ খুঁজে বেড়ায়, যে মানুষেরা কাজে ক্লান্ত, কিছুটা অকাজের কাজ চায় তারা এ মেশিনঘরের ক্লায়েন্ট।

জীবনানন্দ দাস নাকি বলে গেছেন, "পৃথিবীতে নেই কোনো বিশুদ্ধ চাকুরী।" শুদ্ধ আর অশুদ্ধকে নিয়ে ভাববার যুগ বোধয় এটি নয়। মনের মতন চাকরি খোঁজে সবাই। কেউ চায় ক্ষমতা, কেউ অর্থ, কেউ সুনাম, কেউ দুর্নাম কিংবা সাধারণ জীবনের ন্যূনতম খুঁটি।

এদের সবার জন্য মেশিনঘর। যে মেশিনঘরের আমি রিসিপশনিস্ট।

এ মেশিনঘরের খবর সবার জানা নেই। তাহলে তো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আসর এখানেই হতো। সপ্তাহে তিনদিন গুটি কয়েক মানুষ আসে। একই মানুষ কোনোদিন দ্বিতীয়বার আসেনি। কারণ এ মেশিন দ্বিতীয়বার একই মানুষের ইচ্ছাপূরণ করেনা। যারা আসেন, তারা কোথা থেকে খোঁজ পান, আমি জানিনা। আমার সেটি জানবার এক্তিয়ার নেই। যদি জানতে চাই, আমার চাকরি থাকবেনা।

আমার চাকরি দরকার। কৌতুহল মুহূর্তের চাহিদা মাত্র। জীবনের তাগিতে আমি কৌতুহলকে ত্যাগ করি।

মজার ব্যাপার হলো আমার চাকরিও এ মেশিনের মাধ্যমে। মেশিনের কাছে ইচ্ছে প্রকাশ করেই যদি চাকরি পেলাম তো রিসিপশনিস্ট এর চাকরি কেন? রাজা হলেই তো পারতাম? কিন্তু এ মেশিন হুট্ করে কাউকে যেমন তেমন চাকরি দেয়না। বহু প্রশ্নাদি করে, যাচাই বাছাই করে, তবেই চাকরি হয়। তাই যার ভিখারি হবার যোগ্যতা, সে রাজা পদটি পাবেনা। মেশিন বড় নিরপেক্ষ।

আমি বিএ পাশ। কোন রকমে। যে সময় চাকরি খুঁজছি, বা হাঁটুতে সমস্যা ছিল। একটা অপারেশন হয়েছে। বসে থাকবার চাকরি দরকার। অপেরেশনের কারণে আগের চাকরিটি গেছে। একদিন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিলাম। রাস্তার ধার ধরে। মেহেদীর কমলা রং দিয়ে সাদা চুল রঙিন করা এক লোকের সাথে আমার চা-বিড়ির দোকানে পরিচয় হয়েছিল। লিকার চা এবং এক খিলি পানের সাথে অনেক গল্প হয়েছিল। এবং কমলা রঙের চুলের মানুষটি আমাকে নিয়ে এসেছিলো, এ মেশিনঘরে।

বলেছিলো, "যাও, ভেতরে, দেখো, বোঝো।"মে

শিনঘর। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় কারো কোনো নিজস্ব বাড়ি। আধা খোলা কলাপসিবল গেট। ঢোকার মুখে এক চিলতে জায়গায় বাগানবিলাসহ গাছ দুটি, কয়েক পা এগোলে জৌলুসহীন একতালা দালানের সাথে লেপ্টে আছে মানানসই বুড়ো মানিপ্লান্ট গাছ। ডানদিকে দরজা। ঢুকলে ডাকারখানার মতন এক রিসিপশন ঘর। ১০-১৫টা চেয়ার, আর রিসিপশনিস্ট এর বসার জায়গা। আর ভেতরের এক দরজা দিয়ে ঢুকলে মেশিনঘর। অনেকটা এক্স-রে রুমের মতন। আটকানো থাকে। যার সিরিয়াল আসে সে দরজা ঠেলে ঢোকে শুধু।

আর মেশিনঘরের ভেতরের খুব সাধারণ। চারকোনা রুম, হলদে দেয়াল, একটা মেশিন অনেকটা জুয়া খেলার মেশিনের মতন। আর বসবার জন্য একটি চেয়ার। ভীষণ ঠান্ডা ঘর। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ঠান্ডা। আর বাড়তি কোনো সরঞ্জাম নেই এই রুমে। মেশিনের স্টার্ট বোতাম টিপলে বিভিন্ন প্রশ্ন আসে স্ক্রিনে, বোতাম টিপে টিপে হ্যাঁ, না উত্তর দিতে হয়। সব উত্তর মিলিয়ে, মেশিন একটি ছোট্ট চিরকুট বের করে তার মুখের ফাঁকা পকেট থেকে। সেখানে বাংলায় টাইপ করা থাকে , চাকরি জুটলো কিনা, কিংবা কি চাকরি, কোথায় চাকরি।

আমি যেদিন প্রথম গিয়েছিলাম, সেদিন মেশিনঘরের বাইরে একজন রিসিপশনিস্ট ছিল। ষাটোর্ধ একজন মানুষ। সবুজ পাঞ্জাবি পরে আছে। রিসিপশনে পাঞ্জাবি পরে একজন বসে আছে দেখায় হয়তো তার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। তার কাঁচাপাকা জুলফি, চুলগুলো কলপ দেয়া কালো। একটু বেশিই কুচকুচে কালো। তো কলপ যখন চুলে দিলো, জুলফিতে নয় কেন? তাকে দেখে আমার এই কথাটাই প্রথম মনে হয়েছিল। আমি যেয়ে তাকে আমার নাম বলেছিলাম। সে বলেছিলো 'বসেন, তিন নম্বর সিরিয়াল। রুমে আমরা ছিলাম পাঁচ জন। কেউ আমাকে প্রশ্ন করেনি আমি কেমন করে এখানে এলাম। আমিও কাউকে প্রশ্ন করিনি। আমি রিসিপশনিস্ট এর উল্টোদিকের কাঠের চেয়ারে বসে অপেক্ষা করছিলাম। যতবার চোখ পড়েছিল, রিসিপশনিস্ট হেসেছিলেন, পরিমিত কিন্তু আন্তরিক হাসি।

আমি যখন এখন রিসিপশনের চেয়ারে বসে অপেক্ষারাত মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে হাসি, আমিও তার মতন পরিমিত আন্তরিক একটি হাসি হাসার চেষ্টা করি। কে জানে সে হাসি দেখতে কেমন লাগে? কে জানে হয়তো অপেক্ষারত মানুষগুলো, আমার আঁকাবাঁকা দাঁতের হাসি দেখে মনে মনে ভাবে, 'হায়নার হাসি।' কিংবা 'দেঁতো হাসি। অথবা অর্থহীন হাসি, অথবা নিরীহ গরিবী হাসি?

কে জানে। কিন্তু আমি জানি, আমি যখন হাসি তখন সবুজ পাঞ্জাবি পড়া , সেই মানুষের চেহারা মনে পরে। তার কাঁচাপাকা জুলফি। পরিমিত হাসির সেই আগের রিসিপশনিস্ট। মেশিনঘরে আমার চাকরির জোগাড় হয়েছিল সেই দিনই। যখন কাজ শুরু করি, সেই আগের রিসিপশনিস্ট কে দেখিনি। সে কি আগেই জানতো তার জায়গায় নতুন লোক আসবে? অথবা সে অন্য কোথাও চলে গিয়েছে? কিন্তু তার সেদিনের সে হাসি তো বিদায়ের ছিলোনা। ছিল তাড়াহীন এক স্থির হাসি, পরিমিত আর আন্তরিক হাসি। সে যে পরদিন থেকে আসবেনা সে কি জানতো? কে জানে? তার সাথে তো আমার আর কখনো দেখা হয়নি।

এই কাজের সূত্র ধরে আমার যে কত রকম মানুষ দেখা হলো। আসলে দেখা হয় মানুষের চোখ। রিসিপশনে বসে মানুষের চোখ বরাবরই চোখ যায়। কত রকম চোখ, কত তাদের আখ্যান। চকচকে চোখের মানুষ - যেন হীরার টুকরোকুচি মাখা আশার আলোয় ধাঁধানো চোখ। হতাশার খটখটে তাপে শুকিয়ে যাওয়া বৃষ্টিহীন চোখ, হাসির বুদবুদে খেলা করা চোখ, ক্লান্ত চোখ, ভ্রান্ত চোখ। কত রকম চোখ। আমি সেসব চোখ পড়ি, দেখি। চোখের অধিকারে কোন মানুষ, তাকে মনে রাখে হয়না আলাদা করে।

দু'একজনকে মাঝে মাঝে মনে থাকেনা তা তো নয়। এই যেমন বেশ মনে আছে, গোঁফওয়ালা সুখী চেহারার মানুষটিকে। তার মূল বৈশিষ্ট্য ডান নাকের পাশের বড়সড় তিলটি। এই তিলটি তাকে মনে রাখতে সাহায্য করে। তাকে হয়তো ভুলেই যেতাম, যদিনা তাকে দেখার দুদিন পর পত্রিকায় তার ছবিটি না দেখতাম।

পত্রিকার শেষ পাতার বাম দিকের কোণায়, লোকটির ছবি। এক বাড়িতে ডাকাতি করতে যেয়ে ধরা পড়েছে। প্রভাবশালী এক ব্যক্তির বাড়িতে ডাকাতির চেষ্টা। এই জন্য পত্রিকায় ছবি। নাহলে হয়তো ছাপা হতোনা তার ছবিখানা। আমি ভাবলাম অন্যকথা। তবে সে মেশিনঘরে এসেছিলো কেন? মেশিন বুঝি তার খামে ভোরে দিয়েছিলো, চিরকুট, 'তুমি ডাকাত হবে।' নাকি মেশিনঘরের বরাতে কিছু মেলেনি বলে শেষমেশ ডাকাতি? কে জানে? আমি ওতো জানিনা। আমার মাস শেষে টাকা আসে। যা আসে তা নিয়মিত, পর্যাপ্ত, আমার চলে যায়। দেশে পরিবারকে ও পাঠাতে পারি। স্ত্রী আর চার বছরের পুত্র থাকে দেশের বাড়ি। ছেলে আরেকটু বড় হলে, শহরে নিয়ে আসবো ওদের। এখন দাদাবাড়ি, নানাবাড়ি মিলিয়ে ছেলে ভালো আছে। ছেলের মা ও শহরের ব্যাপারে অনাগ্রহী। ফাপর লাগে। যাক আরো কিছুদিন যাক, ওদের নিয়ে আসবো।

মেশিনঘরের সুপারভাইসার লোকমান সাহেব, মাস শেষে খামে করে আমার বেতনের টাকা বুঝিয়ে দেন। ব্যতিক্রম হয়না। এই মেশিনঘরের মালিক ব্যস্ত মানুষ। দিনে কখনো আসেন না। প্রয়োজনে লোকমান সাহেব যেয়ে তার বাসায় কিংবা তার অন্য অফিসে মিটিং করে আসে। আর মালিক আসলেও রাতে অন্য কাজ সেরে ঘুরে যান। তখন আমি তো আর অফিসে থাকিনা। কাজে যোগ দেয়ার পর, এক দু'বার ই মালিকের সাথে দেখা হয়েছে। সে অর্থে ঝেড়ে কেশে কোনো কথা হয়নি। 'ঠিক করে কাজ করো, মন দিয়ে কাজ করো', উত্তরে আমার 'জি স্যার' গোছের কথা হয়েছে মাত্র। বলতে গেলে লোকমান সাহেবই আমার বস। উনি নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ। আর আমার কাজ তো এমন আহামরি কঠিন নয়। শিখিয়ে বুঝিয়ে দেয়ার পর আমি এবং নিজেই সামলাতে পারি। ঈদ পূজা সরকারি ছুটিতে মেশিনঘর বন্ধ থাকে। আগে থেকে নোটিস দিলে ছুটি পাওয়া যায় ৩/৫ দিনের। অমন সময়ে লোকমান সাহেব রিসিপশন সামলে নেন। তো যেমন আরামের কাজ ছেড়ে দেয়ার কোনো সুদূর পরিকল্পনা আমার আপাতত নেই।

এই যে আমার কোনো তাড়া নেই, ছেড়ে যাওয়ার কোনো অস্থিরতা নেই, এই ভাবনা গুলো এলোমেলো ভাবি, আমি যখন প্রতিদিন কাজ থেকে বাড়ি ফিরি তখন। আমার কাজের জায়গা থেকে বের হলেই সরু গলি। দুজন মানুষ পাশাপাশি হাঁটতে পারে, তেমন প্রস্থের গলি। গলি থেকে বের হলে একটি অফিসার্স কলোনির নিজস্ব রাস্তা। সেই রাস্তায় ও ভিড় নেই তেমন, সাথে লাগোয়া পার্ক। সাধাসিধে পার্ক। যেমন হয় আর কি। সকালে মর্নিং ওয়াক পার্টি, দুপুরে অলস আর বেকারের দলের শুয়ে বসে থাকা, দুপরের রোদ পড়তির সময়ে প্রেমিক যুগল, বাদাম ভাজা -ভুট্টা পোড়া , শিশুদের নিজের ছন্দে দাপাদাপি খেলা এবং ইভিনিং ওয়াক পার্টি। আমি সেই তথাকথিত পার্কের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে, বাড়ি ফিরতে ফিরতে, ভুট্টা পোড়ায় কামড় দিতে দিতে এসব তাড়াহীন ভাবনা ভাবি।

আমি সেদিন ও হাঁটছিলাম। থামার কোনো মতলব ছিলোনা। যদিনা পেছন থেকে ডাক না আসতো, হাঁটার ছন্দে বাঁধা পড়লো কেমন। "এই যে শুনেন। এই ভাই এই এই।"

পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, একজন। বয়স বোঝার উপায় নেই , একটা ওড়নায় মাথা থাকা, ওড়নার খুট দিয়ে মুখটা চেপে রেখেছে। তার সাদা-কালো ফুলওয়ালা সালোয়ার কামিজটাই চোখে পড়লো। আমি পিছিয়ে যাই আমার গন্তব্য থেকে। তার দিকে এগিয়ে হাঁটি। চার পা হেঁটে তার সামনে মুখোমখি দাঁড়াই।

বলি, "বলেন।" তাড়াহীন ভাবেই বলি। তাড়াহীন ভাবনারা আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো তখনও।

-"আপনার মোবাইল আছে?"

বাপরে সেধে পরে ছিনতাইকারীর পাল্লায় পড়লাম? চারপাশে তাকাই। দূরে কিছু মানুষ হাঁটছে। তো ছিনতাইকারী ধরলে তো আর কেউ এগিয়ে আসবেনা ভেবে হতাশ কণ্ঠে বললাম, "কেন?"

-"একটা ফোন করবো ভাই। প্লিজ খুব দরকার।"

আমি তাকিয়েই থাকি। মোবাইল দেয়া অনুচিত হবে, খুবই অনুচিত। দৌড় দিবো নাকি?

-"আমার মোবাইলের ব্যালান্স শেষ। ড্রাইভার কই গাড়ি রেখেছে খুঁজে পাচ্ছিনা। এই দেখেন, আমার কাছেও মোবাইল আছে। আমি চোর না।"

"না না আমি তো চোর বলিনি।"

ঢোক গিলি। মোবাইলটা বের করবো? কমদামি মোবাইল আমার, কিন্তু বড় প্রয়োজনীয়। প্রায়ই এই সেই ঝামেলা হয়। পাড়ার দোকানে মেরামত করে সারিয়ে নেই। এইটা হারালে সহসা কেনা হবেনা।

-"আজব আপনি আমারে বিশ্বাস করলেন না? জানেন আমি কে? আমি চোর না। দেখেন আমি কে?" ওড়নার খুট সরে মুখ থেকে।

আমি চমকে উঠি। খুব চেনা চেহারা তো। অরে এঁকে তো আমি চিনি। নামও তো জানি। সুলতানা। ইনি এখানে? কি তাজ্জব ব্যাপার।

এনার নাম সুলতানা আমি জানি। কিন্তু উনাকে কি ভাবে চিনি এবং কই দেখেছি, এই মুহূর্তে কেন আমার মাথায় আসছেনা কে জানে?

-"আপনি আমাকে চিনতে পেরেছেন?" মহিলা নিজেই প্রশ্ন করে।

"সুলতানা?" আমি কাঁপা কাঁপা চোখের পাতা ফেলে এবং তারচেয়েও কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে প্রশ্ন করি।

-"হু সুলতানা, আপনি আমার ছবি দেখেননি কোনো?"

"ছবি? কোন ছবি?:

-"আররে আমার সিনেমা দেখেননি? আপনি তো মনে হচ্ছে আমাকে ঠিক করে চিনেন না। নাম জানেন শুধু।"

এইরে,এত সিনেমার নায়িকা। আমি এর ছবি দেখি পত্রিকায়। মাঝে কি কাহিনী হলো যেন তার নামে সব পত্রিকায় খবর আসলো। পড়ে দেখা হয়নি। আর আমার সিনেমা টেলিভশন দেখা হয়না তেমন। এই মহিলার কোনো সিনেমা দেখিনি। শুধু পত্রিকার কল্যাণে চিনি।

"জ্বী আমার সিনেমা দেখা হয়না তেমন। কিন্তু আমি আপনাকে চিনি। মোবাইল নেন। এইযে।"

মোবাইল সেদিন ঠিকঠাকই ফেরত পেয়েছিলাম। সিনেমার নায়িকা প্রথম সামনাসামনি দেখার মাদকতা নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম। কাউকে বলিনি। বলার মতন আসে পাশে কেউ ছিলও না। আর কিছু ঘটনা ঘটে যায়, যার গল্প বলে ফেললে, ঘটনাকে কম আকর্ষণীয় মনে হওয়া শুরু হয়। তাই এসব ভেবে কিংবা তেমন কিছু না ভেবেই কাউকে আর বলা হয়নি আমার প্রথম নায়িকা দেখার গল্প।

কিন্তু তিনদিন পর যখন ঘটনাটি ঘটলো, না বলে আর উপায় ছিলোনা। বৌকেই জানালাম দেশে ফোন করে। বৌ প্রথম ঘটনা শুনে বিহবল। বিহ্বলতা সামলে সব ঘটনা শুনে বললো, 'সাবধান, এই মহিলার কিন্তু ঝামেলা আছে। টিভি পত্রিকায় খবর আসছে।"

ঘটনা হলো, তিনদিন পর, এক অচেনা নম্বর থেকে ফোন এলো। ছুটির দিন। এক বাড়িতে তিন জন মিলে থাকি আমরা। তিনটি ছোট কামরার এক বাড়ি। সাথে এক চিলতে বারান্দা। আর কমন বাথরুম। রান্না আর ঘর ঝড় পোছ করার জন্য এক লোক আসে সকালে। বাকি কাজ যে যার নিজেরটাই করে। তো সেদিন ছিল ছুটির দিন। আমি আমার সারা সপ্তাহের কাপড় ধোয়া, মশারি ওঠানো ধরণের খুচরো নানা কাজে ব্যস্ত ছিলাম। অচেনা নম্বরের ফোনটা ধরলাম। আমার কাছে কেউ তেমন ফোন করেনা। যারা করে তাদের আমি চিনি, নম্বরও। আর অচেনা নম্বর এর বেশির ভাগই তো কাস্টমার কেয়ার নইলে রং নম্বর।

কিন্তু এই নম্বর অচেনা ছিলোনা মোটেও। বরং আমার জীবনের আরও কত রকমের হুজ্জুতির শুরুও বটে। অচেনা ফোন কল। ওপাশ থেকে নারী কণ্ঠ বললো, "চিনতে পারছেন কি?"

কেমনে চিনি। আমার সস্তা ফোনে কি ক্যামেরা ট্যামেরা ফিট করা আছে যে বুঝবো।

'না। কে আপনি?' কাঠকাঠ গলায় উত্তর দেয়।

আমি সুলতানা।

কোন সুলতানা বলেই মনে হলো এ নিশ্চয়ই নায়িকা সুলতানা। সুলতানার কণ্ঠ মনে রাখার মতন। মিহি গলা নয়। খসখসে।

ফোনের ওইপাশের কণ্ঠ ও খসখসে।

ওই পাশ থেকে সুলতানা বলে, "ওই যে সেদিন পার্কে? আমি নায়িকা ছিলাম"

ও নায়িকা ছিল? এখন নাই নাকি। কিন্তু এইপ্রশ্ন আর করলাম না।

বরং বললাম, "জ্বী বলুন।"

-"খুব বিপদে পরে আপনাকে ফোন দিয়েছি। আপনার কথা মনে হলো। আপনিই পারবেন সাহায্য করতে। প্লিজ প্লিজ।"

এই রে। আমি কি সাহায্য করবো এতো বড় নায়িকা কে। কই গেলো তার নায়ক আর চেলা চামুন্ডারা?

আমি বললাম, "আমি?"

"জ্বী, প্লিজ প্লিজ এতো কথা বলার সময় নাই। আপনি বিকাল ৪ তাই একটু পার্কে আসুন।"

"আপনি আমার নম্বর পেলেন কোথায়।"

"আরে সেদিন আপনার নম্বর থেকে আমার ড্রাইভার কে কল করলাম না। আপনার নম্বর ড্রাইভার এর থেকেই নিয়ে রেখেছিলাম। মনে হয়েছিল আপনাকে কাজে লাগবে।"

"কি কাজ?"

"আহা সেইটা বলবো বলেই তো ডাকছি। আসছেন তো?"

"হ্যাঁ সূচক উত্তর দিয়ে ফোন রেখে আমি ভাবলাম আমি কেন রাজি হলাম?

আচ্ছা যদি আমার কাছে টাকা ধার চায়? আমার কাছে তো এখন দেয়ার মতন কোনো টাকা নাই. ভেবেই হাসি পেলো। চাকায় ঘোড়া জীবনে, টাকা ছাড়া আর যে কোনো প্রয়োজন হতে পারে, এইটা আমার মাথায় ছিলোনা। অতবড় মানুষ, আমার কাছে টাকা চাইবে? কেন? চিন্তা নাকচ করে দিলাম। কিন্তু বুঝলাম বেশ একটা 'কি করি কি করি, সময় কাটেনা গোছের অস্থিরতা আমাকে পেয়ে বসলো।

এমন কেন ভাব হচ্ছে বুঝলাম না। ইতিমধ্যে যেমন তেমন করে হাতের কাজ শেষ করে খেয়ে দিয়ে সাড়ে তিনটা বাজিয়ে, হেঁটে হেঁটে চারটার উদ্যেশে পার্কে রওনা দিলাম।

ঘটনা যা ঘটলো তা আমায় ভাবালো। পার্কে পৌঁছানোর প্রায় ১৫ মিনিট পর সুলতানা আসলো। মাথার হালকা ঘোমটার খুট মুখে চেপে রাখা। পার্কের কোণায় দুটো ঝুমকো জবার গাছ। তার পাশে যে সিমেন্টের বেঞ্চি, তাতে আমরা দুজন বসলাম। কথা বলতে গেলে মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে ফেলতে হলো। চোখে পরে নিলেন নীল রঙের রোদ চশমা। কেউ যাতে না চিনে সেই জন্য হয়তো। অবশ্য আসে পাশে কেউ তাকাচ্ছেও না আমাদের দিকে। কারো ভাবনায় আসবেনা এইখানে বসে আছেন নায়িকা সুলতানা।

সুলতানা অস্থির ভাবে কথা বলেন। তার গলার স্বর খসখসে। তারপর ও শুনতে ভালো লাগে। কিন্তু আমার একটা হালকা অস্বস্তি হচ্ছিলো। তার চোখ দেখতে না পাওয়ার অস্বস্তি। সে যখন চোখ ঢেকে ফেললো, আমি বুঝলাম এই মানুষটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হচ্ছে তার চোখ জোড়া। আমার মেশিনঘরে দেখা প্রতিদিনের চোখগুলো নয়। এ চোখ অন্যরকম, জ্বলজ্বলে, কথা বলে।

সে আমাকে হাত নেড়ে বোঝালো অনেক্ষন আমাকে ডাকার হেতু। একটি খাম আমাকে পৌঁছে দিতে হবে। তার গাড়ি করে, একজনের অফিসে। আমি অবাক। আমি কেন? আপনি বা আপনার ড্রাইভার? কিংবা আরো কোনো লোকজন? মনে মনে বললাম, কোথায় তোমার চেলা চামুন্ডা এবং নায়কেরা?

সুলতানার রাখঢাক নেই। স্বপ্রতিভ। হবেই। সফল মানুষ। হারানোর ভয় তো কিছু নেই। বললো, "আপনি খবর কিছু রাখেন না দেখি। আমার সাথে প্রডিউসার-ডিরেক্টরদের ঝামেলার খবর জানেন না? সবাই জানে। সবখানে বড় বড় করে খবর আসে। টক শো হলো এ নিয়ে। আমার তো কোনো কাজও নেই। আমি বা আমার ড্রাইভার গেলে ঝামেলা আছে। আপনি অপরিচিত মানুষ। কিছু বলবেনা। প্রোডিউসার এর টাকা ফেরত দিয়ে আসেন। প্লিজ। আমার গাড়ি করে যাবেন। আমার ড্রাইভার এর সাথে। সে নিচে অপেক্ষা করবে, আপনি উঠে টাকা দিয়ে আসবেন। কাজ শেষে, গাড়ি বাসায় নামিয়ে দিবে। এ শহরে আসলে কেউ নাইই আমার, থাকলে কি আর আপনাকে .... "

এই সন্ধ্যের মুখে যখন পাখি ঘরে ফিরে, সন্ধ্যা বাতাসে সময় কেমন পাখির মতন হয়ে যায়, ছটফটে, তখন আমার কি সাধ্যি, এই মাদকতাময় অনুরোধ উপেক্ষা করি।

টাকা দিয়ে এসেছিলাম এক বড় অফিসে, এক ছোট কর্মচারীর হাতে, রিসিট সাইন করিয়ে। কোনো ঝামেলা হয়নি। ফেরার সময় গাড়িকে ছেড়ে দিয়েছি। গাড়িতে আমার অনভ্যাস। হেঁটে হেঁটে আর রিকশায় বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভেবেছি। কেন কেন? আমি কেন?

বৌকে আসলে বাড়ি ফিরেই জানালাম। পাশের রুমের শাহেদ ভাই সিনেমার পোকা। সব খবর রাখে। গল্পের ছলে তার থেকে জানলাম ঘটনা, সুলতানার কেচ্ছা। বড় নায়িকা। কিন্তু খামখেয়ালি।কাজ বাদে সব কিছুতে মনোযোগ। কখনো সিডিউল ফাসায় তো কখনো নায়ক কে ফাসায়। টাকা নিয়ে কাজে যায়না। এতসব ঘটনা জমতে জমতে যেদিন প্রোডিউসারের সাথে হাতাহাতি, সবাই মিলে এক প্রকার বয়কটই করলো তাকে। একদম লেজে গোবরে অবস্থা। কাজ নেই। দুর্নাম। ঋণ। ইত্যাদি ইত্যাদি।

এরপরের ফোন আসে দশদিন পর। এরপর আসতেই থাকে। কাজে কিংবা অকাজে। আমি আমার মেশিনঘরের কাজের ফাঁকে ধীরে ধীরে এক অদ্ভুত সময় আবিষ্কার করি, অতীত ও নয় বর্তমান ও নয়, সময়টি অদ্ভুত। যে সময়ে আমি আর অন্য সময়ের মতন না। আমি গুরুত্বপূর্ণ। এ জীবনে আমরা নিজের গুরুত্ব খুঁজে ফিরি। কে না চায় গুরুত্বপূর্ণ হতে? সেই গুরুত্বপূর্ণ হবার লোভে আমি সেই অদ্ভুত সময়কে খুঁজে ফিরি। লুফে নেই।

আমি এমন এক আমি কে খুঁজে পাই, উল্টে পাল্টে দেখি, যেমন অমিকে আগে কখনো দেখিনি। এতো বড় একজন নায়িকা, খসখসে গলায় যখন আমাকে গল্প বলে, অনুরোধ করে বা আদেশ দেয়, তখন সব ভালো লাগা ছাপিয়ে আরেকটি বোধ কাজ করে। নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবার বোধ। কে বিশ্বাস করবে সুলতানা কে আমি চিনি? কে বিশ্বাস করবে সুলতানার সাথে আমার প্রায়শই দেখা সাক্ষাৎ হয়, ফোনে কথা হয়।

বৌ কে মাঝে মাঝে বলি, কিংবা বৌ ও জিজ্ঞেস করে। সরল গলায় প্রশ্ন করে,

"তুমি কি তারে বিয়ে করবা নাকি?

-"আমি?"

"এতো মিলমিশ করো কেন তাইলে?"

_"আমি তো বিয়ে করসিই , তোমারে। এসব কি কও।"

"তুমি পুরুষ মানুষ, চাইলেই তো বিয়ে করে ফেলবা।"

-"কি অদ্ভুত কথা কও রেহানা?"

ভাবি আর হাসি। সুলতানার সাথে বিয়ে? সুলতানাকে যে আমি চিনি কিন্তু তাকে কি আমি বুঝি? আমার পৃথিবীর কোনো অংশে সুলতানার মতন কোনো চরিত্র তো কখনো বিরাজ করেনি। আমি জানিও না তারা কেমন হয়। আমি তাই মনেহয় আগ্রহ নিয়ে বিস্ময়ে তাকে চেনার চেষ্টা করি। কিন্তু আমার পৃথিবীতেই যার বাস নাই, যার ভাবের সূত্র আমি জানিনা, তার সাথে ভালোবাসা তো দূরের কথা। আবার বিয়ে? বৌয়ের কোথায় তাই হাসি।

কিন্তু কাজের ফাঁকে, বাজারের লিস্টি করার ফাঁকে, আমার সুলতানার কথা মনে হয়, সত্যি। সেই মনে হওয়ায় এক কাঁপা কাঁপা ভালো লাগা আছে, গুরুত্ব পাবার লোভ আছে। কিন্তু প্রেম নেই। আমি কখনো প্রেম করিনি। প্রেম করার প্রয়োজন পড়েনি। কিন্তু আমি বুঝি এই অনুভূতি প্রেম নয়। এইটা এক আকর্ষণীয় অনুভূতি - অন্য পৃথিবী আবিষ্কারের মতন আকর্ষণীয় এবং নতুন।

সুলতানা যেদিন আমার বৌয়ের জন্য হলুদ জমিনের সবুজ পাড়ের সিল্ক শাড়ি আর বাচ্চাটার জন্য যে খেলনা প্লেন উপহার দিলো , আমি বিব্রত হলাম। এই শাড়ি আমার অচেনা, সুলতানার মতন। আমার বৌ খুশি হবে নিশ্চয়ই, কিন্তু এই শাড়ির অধিকার পেয়ে স্বস্তি পাবে কি? এই শাড়ি পড়বেই বা কোথায়? কিন্তু সুলতানা কে 'না' বলা অসম্ভব। আমি খেলনা আর শাড়ি গ্রহণ করেছিলাম। আমার পরবর্তীতে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ এক প্যাকেট ডালমুট কিনে তাকে খেতে দিয়েছিলাম। সুলতানা হাসিমুখে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে সেই উপহার নিয়েছিল।

এমনই এই সম্পর্ক - অসম, অপ্রেমের এবং আকর্ষণীয়।

সেদিন সুলতানার মোবাইলের বিলটা মিটিয়ে, পার্কে আসলাম। সুলতানা দেখি আমার আগে এসেই বসে আছে। আজকাল আর মুখ ঢাকেনা। বললো, "আমাকে কি একটা চাকরি দিতে পারবেন?"

আমি চমকে উঠি। "আপনি চাকরি করবেন?"

"হু"

"আপনার এতো টাকা।"

"টাকা নাই, এই যে সবার ধার শোধ করছি, আর তো টাকা নাই।"

"তাও তো আপনার তাও যে টাকা, আমরা তো সারাজীবনে ও ... "

"ফ্ল্যাটটা ও নিয়ে গেছে, গাড়ি বিক্রি করে দিবো।" স্বগোক্তি করে সুলতানা।

সুলতানা এমনই। আমাকে পাশে বসিয়ে বেশিরভাগ সময়ই স্বগোক্তি করে। আমি শুনি। কখনো কখনো বলি।

সুলতানা বলেই যায়, "গাড়ি পোষা তো হাতি পোষা। গাড়ি বিক্রি করতে দিচ্ছি, বাকি টাকা তাতে শোধ হয়ে যাবে। আর এই ড্রাইভার স্পাই। ওদের লোক। একে রাখা যাবেনা।"

এর পর থেকে পরের বেশ কয়দিন, সুলতানার মতন এক বড় মানুষ, আমার কাছে চাকরি খুঁজে। সুলতানা তো জানেও না আমি কি কাজ করি। কোনোদিন জানতেও চায়নি। আমার নাম, বাসার গলি চেনে। আমার বৌ আর এক সন্তান এইটুকুই শুধু জানে বোধহয়। তারপর ও আমার কাছে চাকরি চাওয়ার কোনো কারণ নাই। আমাকে দেখলেই বোঝা যায় আমি ছা-পোষা মানুষ, চাকরি চাওয়া ধরণের মানুষ। চাকরি দেবার মানুষ নই।

তারপর ও সুলতানার অনুরোধ ফেলা অসম্ভব। আমাকে সেদিন যখন আবার বললো, "আমি তো ইন্টারমিডিয়েট পাশ। কোনো একটা অল্প বেতনের চাকরি ও কি হয়না?"

আমি পাল্টা প্রশ্ন করি, "আপনি আর সিনেমা করবেন না?"

-"কিছুদিন যাক, কিছু বছর। তারপর চিন্তা করবো। এখন সময় ঠিক নাই। দাদির বাড়ি আছে, পুরান ঢাকায়, নিচ তলায় যেয়ে উঠবো। একটা কোনো রকম চাকরি পেলে, আর যেটুকু হাতে আছে, আপাতত চলে যায়।"

এর পর আমার আর কি করার থাকে। সেদিন কাজ শেষে, মেশিনঘরের লোকমান সাহেব কে বলি, সুলতানার চাকরির কথা। সে যে নায়িকা সুলতানা তা চেপে যাই। লোকমান সাহেব সব শুনে। আমি বিশ্বস্ত কর্মচারী। আমার অনুরোধ ফেলতে পারেনা। তিন সপ্তাহ পর সময় দেয় সুলতানার জন্য।

সুলতানা কে খবর জানাই। কখন কোথায় যেতে হবে সব বুঝিয়ে দেই। সুলতানার আনন্দ থেকে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। ঠিক করি, সুলতানাকে সাথে নিয়েই ঐদিন মেশিনঘরে যাবো। ভাবি ঠিকই। কিন্তু যা ভাবি তাই কি হয়। দুদিন পর খবর আসে, ছেলেকে কুকুর কামড়েছে। ইনজেকশন শুরু হয়েছে। মায়ের জ্বর - মনে হয় ডেঙ্গু। তৎক্ষনাৎ তৈরী হয়ে বাসের উদ্যেশ্যে রওনা দিতে যেয়ে পকেট থেকে পুরোনো ঝালাই করা মোবাইল মাটিতে পরে যায়। ভেঙে চুরমার।

ছেলের অসুখ, মায়ের ডেঙ্গু, নিজের ডায়ারিয়া, গ্রামের জমি বিষয়ক জটিলতা - সব ঝড় সামলে ফিরে আসতে পাক্কা ২৫ দিন লাগে। এর মাঝে খুব হালকা ভাবে সুলতানার কথা মনে হয়েছে। যোগাযোগের উপায় ছিলোনা, মাধ্যম ও। ভাবি ফিরে এসে খুঁজে নিবো।

এক সাদামাটা সকালে ফিরে আসি। ক্লান্ত শরীর ও মন নিয়ে শহরে। টেবিলের ওপর আমার নাম আসে মুখবন্ধ খয়েরি খামের ভেতর একটি চিরকুট পাই।

"আপনাকে তো খুঁজে পেলামনা। ফোনও বন্ধ। কি করে আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। আমার চাকরি হয়ে গেছে। যে মেশিনঘরে পাঠিয়েছিলেন, সেই মেশিনঘরের রিসিপশনিস্ট। -সুলতানা।"


আমি চিরকুট হাতে অপেক্ষা করি। এক তাড়াহীন বোধ। দুপুর শেষে পথে নামি। হাঁটি। কাজ খুঁজতে হবে। আমি এখন আর মেশিনঘরের রিসিপশনিস্ট নই। আমি এবার কি হবো?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ