একদা হরপ্রসাদ নামে এক অতিশয় কর্মঠ ও সদাশয় ব্যক্তি দিনে চার বার রেললাইন পারাপার করতেন। শীত, বর্ষা, গ্রীষ্ম— সব ঋতুতে। কেননা, টানা একশো আশি বিঘে উৎপাতহীন একঘেয়ে মসৃণ চাষের জমি আজকাল আর পাওয়া যায় না। হরপ্রসাদের সময় যেত। এবং, হরপ্রসাদের তা ছিল। জমি লাইনের ওপারে, বাড়ি লাইনের এপারে। জমি যেমন
লম্বা-চওড়া, বাড়িও তেমন পেল্লায়। একদম সিগন্যালের গা ঘেঁষে। ভারী মেল ট্রেন কিংবা অনিঃশেষ ওয়াগান গেলে দশ ফুট উঁচু পাঁচিলে ঘেরা বাড়িতে গুমগুম শব্দ হত, চুন-সুরকির ধুলো উড়ত। থরথর করত জানালা-দরজা। লাগোয়া আয়তকার পুকুরের জল নড়ত কলতলার ডেকচির মতো। ঘাটের সিঁড়ি থেকে ছুটে পালাত তেচোকা-খোরসলা। ট্রেন আসুক বা না-আসুক, মাঠভরতি শস্য-আকুল গাছপালায় অহরহ ঢেউ খেলত। হরপ্রসাদ এপার-ওপার হতেন চার বার। ভোরে গিয়ে বারোটায় ফেরা, তারপর একটায় গিয়ে ছ-টায়। এতেই জীবনের বেশিটা কেটে গেছে তাঁর। জমি ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে যথেষ্ট বড়োলোক হয়ে যাওয়ার পর মন বলল, এবার আত্মার জন্য কিছু করো। একটা শুভদিন দেখে নিরামিষ খেয়ে হরপ্রসাদ ডায়েরি লেখা শুরু করলেন। সবচেয়ে বড়ো পিপুল গাছটার নীচে বসে। যার শিকড় ছড়িয়ে গেছে রেললাইনের কাঠের স্লিপার অবধি। মাঝে মাঝে খেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মুনিষদের দেখেন আর ফাঁকফোকরে লেখেন। লেখা শুরু করে তিনি বুঝতে পারলেন দুটি সরল সত্য। এক, মানুষ নিয়ে লেখার কিছু নেই, তারচেয়ে অনেক জ্যান্ত জীবন ব্যস্ত ও ন্যস্ত রয়েছে পোকামাকড় ও পশুপাখিতে। দুই, এক জায়গায় বসে লিখলে হবে না, লিখতে হবে ঘুরে ঘুরে দূরে দূরে। ভ্রমণ মানুষের দৃষ্টি প্রসারিত করে, নিসর্গের পরিবর্তন মানুষকে তাজা রাখে।
হিংসায় অনীহা থাকায় পশু বাদ দিয়ে হরপ্রসাদ মনোনিবেশ করলেন পোকা ও পাখিতে। পাখির গায়ের উকুন, গুবরেপোকা, ধামসাপোকা, গন্ধিপোকা, উচ্চিংড়ে, কুমরে থেকে জোনাকি অবধি শ দেড়েক পোকা বিষয়ে তিনি লিখে ফেললেন অনধিক দেড়শো শব্দ করে। অল্প দেখা আর কিছু শোনায় অর্জিত প্রবল আত্মবিশ্বাসে সৃষ্ট লেখাগুলো বহু ভুলে ভরা থাকলেও আন্তরিকতায় বেশ পাঠযোগ্য হয়ে উঠল।
বোলতা, জোঁক, শুঁয়াপোকা, কেঁচো, কেন্নো, বিছে, পিঁপড়ে, মথ এবং আরশোলাসহ আরও অনেকে স্থান পেল তাঁর অপ্রকাশিত রচনাবলিতে। জ্ঞানের গভীরতা ও বিজ্ঞাননির্ভর বিশ্লেষণের দিকে নজর না থাকলেও পরম ভালোবাসায় লিখে চললেন তিনি। বছরের পর বছর। পোকা ফুরিয়ে এলে ধরলেন পাখি। ডায়েরির পর ডায়েরি ফুরিয়ে গেল। মাঝে মাঝে এল খাতা, হালখাতা, জাবেদা খাতা। অক্ষরের মধ্যে তখন তাঁর বসবাস। অক্ষরবৃত্ত ঘিরে ফেলেছে তাঁর জীবন। অপটু রেখায় প্রাণীদের ড্রয়িংও করলেন। এ জন্য বৈষয়িক ব্যবস্থাপনাকে অবশ্য বিঘ্নিত করলেন না। গোলা ভরে উঠত ফসলে আর অ্যালুমিনিয়ামের ট্রাঙ্ক ভরে উঠত লেখায়। ইতিমধ্যে বাড়ির চওড়া কার্নিশ থেকে উঁকি মারতে শুরু করেছে বট-অশ্বত্থের চারা। এর মাঝে একটা গাড়ি হল, কোথাও যাবার ছিল না, তবু আত্মীয়-পড়শিদের প্ররোচনায় কিনতে হল। দেখতে আদি রোলস রয়েসের মতো, দু-পাশে দুটো চাকা লাগানো ছিল কোমরের সোনার বিছের তুল্য সেক্স-সিম্বল হিসেবে। দূরের আত্মীয়রা যেত কাছের মন্দিরে পিকনিক করতে, আর, পাড়ার লোকের তা কাজে লাগাত রুগিদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে। সবচেয়ে জরুরি দিনেই গাড়িটা বিগড়ে গেল। স্ত্রী মারা গেলেন বিনা চিকিৎসায়। কিন্তু, লেখার নেশা আর জমির বিস্তীর্ণ ল্যান্ডস্কেপ হরপ্রসাদকে দুঃখ পেতে দিল না। লিখতে লিখতে তিনি বুড়ো হয়ে গেলেন। মহৎ কিছু যে লিখলেন, তা নয়, তবু, তাঁর বিশ্বাস ছিল জীবনটা কাজের মতো কাজে কেটেছে। লেখা তো লোকের জন্য নয়, তাই তারা কীভাবে নেবে, তা জরুরি নয়। অগাবগা একটা জীবন না কাটিয়ে ছোটো ছোটো প্রাণের মধ্যে আনন্দ খুঁজে পাওয়া কম আনন্দের নয়। নিজের ধারণা অনুযায়ী হরপ্রসাদের ডায়েরির প্রথম বাক্যটা ছিল— ‘‘একদা আমার জমিতে অনেক প্রকার পোকামাকড় বসবাস করত।’’ এটা লিখে নিজের কানে খটকা লাগায় তিনি তাঁর সেই ‘ওয়ানস আপন এ টাইম’-এর গেরো ছিঁড়ে ফেলেন। হরপ্রসাদের প্রতি সুবিচার করার জন্য দু-একটা উদাহরণ দেওয়া জরুরি। আফটার অল তিনি সুস্মিতার প্রথম বিন্দু, সুস্মিতার ঠাকুর্দা।
আরশোলা: পৃথিবীর প্রাচীনতম এই প্রাণীটির স্থায়িত্ব প্রমাণ করে চেষ্টা করলে মানুষও অমর হতে পারে। কিন্তু, মানুষ আরশোলার মতো সিরিয়াস নয়। নিজের কাজের চেয়ে অন্যের কাজে বেশি মাথা গলায়। কাজ আর অকাজ, এই দুইয়ের সীমারেখায় মানুষ অকাজের দল পাকায়। মানুষের পছন্দ-অপছন্দ তীব্র। এটা মোটেই গুণ নয়। এতে আয়ু কমে। আরশোলার কাছে কোনো খাদ্যই অখাদ্য নয়। তুঁতে মেশানো আঠার গোলা থেকে হার্ডবোর্ড বইয়ের মলাট, এমনকী, ঘুমন্ত মানুষের নরম স্থানের ও সুযোগমতো অস্থানের সুস্বাদু মাংস তারা খেয়ে থাকে। এই বিচারহীনতা তাদের মধ্যে আসক্তি সঞ্চার করেনি। আসক্তি মনকে ক্ষুদ্র করে, জীবনকে ছোটো করে। এইসব হয়তো বুঝে বা না-বুঝে আরশোলা টিঁকে আছে আদি থেকে, অকৃত্রিমভাবে। তাদের দৃষ্টি নেই। শুঁড় ছুঁয়ে ছুঁয়ে পথ খোঁজে। তাদের গা তেলালো, পদ্ম পাতার মতো। বৃষ্টির জল, সকালের শিশির, বাচ্চাদের হিসি পিছলে যায়। তাদের মনে ছাপ ফেলে না। আরশোলাকুলের স্থায়িত্বের অপর বড়ো কারণ হল তাদের সৌন্দর্যচেতনা নেই। মানুষের আছে। সৌন্দর্যবোধ মানুষকে কুরে কুরে খায়, ভেতরে ভেতরে পুড়িয়ে দেয়। এতেও আয়ু কমে। ছোটোবেলায় একবার ঘুমের সময় আমার ডান চোখের পাতার একটু মাংস খেয়েছিল একটা আরশোলা। মা বলেছিলেন অন্তর্দৃষ্টি বাড়ছে। জানি না সেটা হয়েছে কি না।
পিঁপড়ে: একমাত্র ইহাদের দেখেই মনে হয়েছে মানুষ বুদ্ধিমান হলেও এতটা ভদ্রসভ্য নয়, সিনসিয়ার তো নয়ই। মানুষের বুদ্ধি সাধারণত দুর্বুদ্ধির খাতে বয়। পিঁপড়েরাও দল বেঁধে বাস করে, ঘরবাড়ি বানায়, সন্তানদের রক্ষা করে সংঘবদ্ধভাবে। এই ক্ষুদ্র প্রাণীগুলো এতই সংসারী যে, আমরা যেমন গোরু পুষে দুধ খাই, এরা তেমন এক ধরনের ছোটো ছোটো পোকা পুষে তাদের থেকে মিষ্টি খাবার সংগ্রহ করে। গাছের পাতার ওপর পাখির বিষ্ঠার মতো একরকম সাদা ছিটে দেখা যায়। তা মানুষের মনে ভ্রম জাগানোর জন্য। তার নীচে থাকে পিঁপড়েদের ব্যক্তিগত মিষ্টি পোকার ফার্ম। কয়েক প্রকার পিঁপড়ে সুন্দর চাষাবাদ করে। কিন্তু মানুষের মতো নিজস্ব সম্পদ বাড়ায় না। সমষ্টির উন্নতি ভিন্ন চিন্তা নেই। তাদের নেই একক উচ্চাকাঙ্ক্ষা। এমনকী তাদের রানিও আয়েশি নয়, খেটে খেতে হয় তাকেও। খাবার সংগ্রহ করে পিঁপড়েরা যখন বাসার পানে যায়, পথিমধ্যে অন্য পিঁপড়ে শুঁয়ো নেড়ে খিদে জাহির করলে তারা দিয়ে দেয়। আমার জমিতে সচরাচর চার প্রকার পিঁপড়ে দেখা যায়— ডেয়ো, সুড়সুড়ে, কাঠপিঁপড়ে আর লাল পিঁপড়ে। আরও এক ধরনের বিচ্ছিরি গন্ধযুক্ত সূক্ষ্ম পিঁপড়ে আছে, যা কেবল বাড়িতেই দেখেছি। লাল পিঁপড়েরা রাগী আর হিংস্র। সুড়সুড়েরা নিরীহ এবং আধুনিক সময়ের দোষে আক্রান্ত, কারণ, তারা বিচ্ছিন্ন ও অন্যমনস্ক। অন্যরা মহাভারতের রণক্ষেত্রে রচিত ব্যূহ গড়ে চলাফেরা করে। কাঠপিঁপড়ে বিষাক্ত এবং শক্তিশালী। আমার ছেলেবেলার বন্ধু পটলকে জাম গাছের উঁচু ডাল থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল। সমবেত প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে পটল পারেনি। নীচে শুকনো খেজুর পাতা থাকায় সে রক্ষা পায়। মানুষের মায়েরা পিঁপড়েমিশ্রিত দুধ খাইয়ে বলে— ‘সাঁতার শিখবে’। সে আসলে নিজেদের ব্যর্থতার ওপরে পুলটিস। পিঁপড়ে খাওয়া বহু বাচ্চাকে আমি ডুবে যেতে দেখেছি।
এরকম আবোলতাবোল লেখালেখির মধ্যে যুক্তিপরম্পরা ছিল না। জাম গাছতলায় খেজুর পাতা কেন? অথবা, সৌন্দর্যচেতনা না-হয় আরশোলার নেই, তাহলে জলঢোঁড়া সাপের কি আছে, নয়তো তারা স্বল্পজীবী কেন?-— এ-জাতীয় প্রশ্নের উত্তর বা সূত্র তাঁর লেখায় ছিল না।
পোকামাকড়ের বৃত্তান্ত অনেকটা হওয়ার পর সাধের মুনিষদের কিছু জমি দান করে হরপ্রসাদ যাত্রা করলেন পক্ষীকুলের দিকে। শুরুটা নীরপতত্রী, অর্থাৎ, জলচারীদের নিয়ে। পানকৌড়ি, গাংচিল বা গাংতিতি তাঁর প্রিয় পাখি। তারপর শাখারি, মুনিয়া, বসন্তবউরি, ভরত, নরুণচেরা, খঞ্জন, দোয়েল, চিল, বাজ, টুনটুনি, শকুন, শালিখ, বক প্রমুখ দেখা-পাখির সঙ্গে কাজলভ্রমরা, হামিংবার্ড এবং দুর্গাটুনটুনির মতো শোনা-পাখিতে ভরে ওঠে তাঁর লেখকজীবনের সেকেন্ড হাফ। ভুঁড়োচিল, মাছরাঙা, দাঁড়কাক, ম্যাকাও, কাকাতুয়া, ফিঙে, বগা-বগি, আর তিতিরদের মন বুঝতে গিয়ে মা-হারা একমাত্র ছেলেটার দিকে তাকানো হল না। এই পর্বে হরপ্রসাদের কল্পনা পুরুষ্ট হয় অনুশীলনের ফলে। তাই পাখি বিষয়ে ছোটো ছোটো গল্পও লেখেন তাদের বৈশিষ্ট্য বোঝাতে। এর মাঝে আঁকায় অভাবিত উন্নতি হয়, উড়ে যাওয়ার সময় কোনো কোনো পাখি নীচের সবুজের মাঝে সাদা পাতায় আত্মপ্রতিকৃতি দেখে চমকে ওঠে, তাদের ডানায় খিল লেগে যায়। বিশেষত, সিপাহি বুলবুল, হাঁড়িচাঁচা ও বাইল্যার (এ-দেশের বাবুই) ছবিগুলো অপূর্ব। এ থেকেই ফ্রন্ট ও ব্যাক কভার হওয়া উচিত। কিন্তু যে-বই অপ্রকাশিত, তার আবার প্রচ্ছদ!
পাখিদের বিষয়ে সব লেখা শেষ হতে হতে মোটামুটি পড়াশুনা করে বড়ো হয়ে যাওয়া নির্বান্ধব ছেলে দেবপ্রসাদের বিয়ে হয়ে গেল। আত্মীয়স্বজনরাই ধরে-করে দিয়ে দিল। পাঁচ বছরের মাথায় একটা মেয়েও হয়ে গেল। ফুটফুটে মেয়ে। এত আনন্দ হরপ্রসাদ কখনো পাননি। নাতনি কোল থেকে নামতেই চায় না। খাওয়ানো, নাওয়ানো, খেলাধুলা, কথাবার্তা সব নাতনির সঙ্গে। দু-জনে যে যার ভাষায় কথা বলে। এভাবে সুস্মিতা যখন ছুটতে শিখে গেছে এমন এক দিনে হিমাংশু আসেন শহর থেকে। তাঁর হাতে পড়ে আমির শ্যালকের একটা ডায়েরি। উলটেপালটে পড়ে তিনি বলেন, ‘‘ছাইপাঁশ লিখে জীবনটা নষ্ট করলে ভায়া, এসব তো আগেও লেখা হয়ে গেছে।’’
প্রথমে মুষড়ে পড়লেও, এ-পৃথিবীর নানা প্রান্তে কতরকম মানুষ একইরকমভাবে বেঁচে আছে, বেঁচে চলেছে— এই ভেবে হরপ্রসাদ কিছুটা সান্ত্বনা পান।
— ‘‘নতুন কিছুই তুমি জানাওনি’’, হিমাংশু দমেন না।
— তা হোক গে। আমি তো জানাতে চাইনি। জানতে চেয়েছি। কারো সাহায্য ছাড়া নিজে নিজে একলা বসে চাষের ফাঁকে আর সংসারের ফোকরে এইসব দেখলাম, জানলাম, এই-ই-বা কম কী! জানুক-না অন্যে, প্রত্যেককে নিজের আবিষ্কার নিজেকে করতে হয় হিমু।
জানা আসলে পুনর্বার জানা, বহুপ্রচলিত এই উক্তির প্রতিধ্বনি করে হিমাংশু বলেন, ‘‘ঝাড়া আসলে পুনর্বার ঝাড়া।’’ শালাকে ছোটো করতে চান তিনি। নিজের ব্যর্থ জীবনে অন্যকে ছোটো করায় খুশি খুঁজে পেতেন তিনি। কিন্তু ততদিনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণের সান্নিধ্যে হরপ্রসাদের চারপাশে এক স্বর্গীয় বলয় তৈরি হয়েছে, বক্রোক্তি তাঁকে স্পর্শ করে না। ‘‘হিমু রাতের বাবলা গাছে কখনো জোনাকির ঝাঁক দেখেছিস? দেখবি আগের দিনের সঙ্গে মিল নেই। দেখবি কত জানা, তবু কত অচেনা। দেখবি সব জানা নিজের মতো করে বার বার জানতে হয়। এমনকী সামান্য হাঁটাও।’’ স্বপ্নাচ্ছন্ন শোনায় তাঁকে।
সে-রাতে সুস্মিতাকে কোলে করে ছাদে ঘোরার সময় স্বচ্ছ আকাশের তারাদের দিকে তাকিয়ে হরপ্রসাদ ভাবেন এই মুহূর্তে কত পিতামহ কত নাতনি-কোলে ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। কত মানুষ পৃথিবীর নানা প্রান্তে আলাদা ভাষায় একই ভাবনা ভেবে চলেছে। এভাবে খণ্ড খণ্ড মানুষ পূর্ণ ভাবনার দিকে যায়। কেউ হয়তো তার মতো অপ্রকাশিতব্য কিছু-না-কিছু লিখেও ফেলেছে। আঃ, কী সুন্দর একটা গ্রহেই-না জীবনটা কাটল!
এরপর হরপ্রসাদ আর বেশি দিন বাঁচেননি। সত্তরের পর শেষের একটা বছর তার রুটিন ছিল এইরকম— দ্বিতীয় দফায় রেললাইন টপকে নাতনিকে নিয়ে খেতে যাওয়া। স্কুলের
খাতা-বই নিয়ে সে-মেয়ে যেত তার আঙুল ধরে। সে-মেয়ে সারাক্ষণ বকবকম করত। ঠাকুর্দাও। আলাদা ভাষার দুই মানুষ বাড়ি ফিরত সন্ধ্যে বেলা। এর মাঝে হরপ্রসাদ খুলে বসতেন পুরোনো ডায়েরি, এক-একদিন এক-একটা। গভীর মমতায় তাকিয়ে থাকতেন সেগুলোর দিকে, শিল্পী যেমন তার সৃষ্টির দিকে চেয়ে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে, আর, অসমাপ্ত কাজের হিসেব করে। এই শেষ না-হওয়া কাজ আর অতৃপ্তি মানুষকে এগিয়ে নিয়ে চলে। পনেরো-কুড়ি মিটার পরিধির মধ্যে ঘোরাফেরা করত সুস্মিতা, কখনো-বা পাঠ্যবই খুলে বসত। এরকম এক দুপুরে, তিনটে পঞ্চাশের এক্সপ্রেস বেরিয়ে যাওয়ার সময় হরপ্রসাদের ম্যাসিভ কার্ডিয়াক অ্যাটাক হয়। সে-দিন তিনি ছিলেন ঝাঁকড়া একটা নিম গাছের ঠিক নীচে। মাঠের একদম কেন্দ্রে। বিছানো শীতলপাটির ওপর কাত হয়ে পড়েছিলেন। কাকতালীয়ভাবে যার শেষ লাইনটা ছিল মৃত্যু-বিষয়ক— ‘‘পোকার মৃত্যুতে অন্য পোকারা কাঁদে? নাকি, অন্যরা আনন্দের সঙ্গে তাকে খেয়ে নেয়?’’ সবাই টের পায় পরে। সুস্মিতার তারস্বরের কান্নায়। মুনিষরা এসে দেখে রংবেরঙের পোকার দল মালিকের হেলে পড়া শরীরে উঠে পড়েছে। কৃতজ্ঞতায় তারা কামড়াচ্ছিল না, চেষ্টা করছিল বাঁচিয়ে তোলার। পা থেকে ঘাড় অবধি লম্বা মিছিল। ভাঙা খেলনা গাড়ির মতো দেখাচ্ছিল বাবুর শরীরটা। সুস্মিতাকেও ছেঁকে ধরেছিল পিঁপড়ে। বিষের প্রভাবে ফর্সা মেয়ে লাল হয়ে যায়। তার মুখে ঢুকে গিয়েছিল কিছু পিঁপড়ে। দু-জনকে তাড়াতাড়ি তুলে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হলেও ডায়েরিটা পড়ে রইল কেঁচোর কুণ্ডলী-পাকানো একটা গর্তের ওপর। খোলা পাতায় বসেছিল বড়োসড়ো একটা গুবরে পোকা, মৃদুমন্দ বাতাসে পাতাগুলো তার গায়ে পড়ছিল ঝালরের মতো, আর সে চমকে চমকে উঠছিল। গাছের মাথায় হঠাৎ পাখিদের ভিড় লেগে যায়। তখন বিকেল চারটে ছাপ্পান্ন। মৃত্যুর শিঙা বাজিয়ে ডাউন ট্রেনের আর্তনাদ শোনা গেল।
মৃত্যুর কিছু আগে নিজের লেখা থেকে হরপ্রসাদ একটা চিরকালীন সত্য আবিষ্কার করেন। মানুষ নিয়ে তিনি লিখতে চাননি, অথচ, সারাজীবন ছোটো ছোটো প্রাণের মধ্যে মানুষের বৈচিত্র্যই খুঁজে বেড়িয়েছেন। মানুষ যাকে ভুলতে চায়, শেষ পর্যন্ত সে প্রবলভাবে অন্য আকারে তাকে তাড়া করে বেড়ায়।
হার্ট-অ্যাটাকের ঠিক আগে এটা তিনি উপলব্ধি করেন। তখন সময় ফুরিয়ে এসেছে। সে-সময় ছেলের কথা মনে পড়ে— না, ছেলেটার ওপর অবিচার করাই হয়ে গেছে। এরপর একবার সুস্মিতার দিকে তাকান এবং কাত হয়ে পড়েন।
সব ডিটেল সুস্মিতার মনে থাকার কথা নয়। তবু সাত বছরের কিছু কিছু থেকেই যায়। পোকার সারিবদ্ধ মিছিলে চাপা পড়া স্নেহপরায়ণ ঠাকুর্দার নিঃসাড় শরীরের কথা আর পিঁপড়ে-আক্রান্ত নিজের অসহায় জ্বালা-ধরানো অবস্থার অনুভূতি তার মনে রয়ে গেল স্থায়ীভাবে। আর, এসবকে ছাপিয়ে রয়ে গেল একটা রসালো নোনতা স্বাদ, বাঁচার তাগিদে পিঁপড়ে চিবিয়ে ফেলে যা সে পেয়েছিল। ওই স্বাদ কখনো তার পিছু ছাড়েনি। বাকি জীবন স্বাভাবিক যৌনতার প্রধান বাধা হিসেবে সঙ্গে রয়ে গেল। চুম্বন, ফাটা ঠোঁটের রক্ত, লালা, ঘাম, সব ধরনের শারীরিক নিঃসরণে সুস্মিতা পেত পিঁপড়ের নোনতা রসের স্বাদ, আর সেইসঙ্গে তার চোখের ওপর ভেসে উঠত একটা দুঃখের ছবি— নানা শেডের সবুজের মাঝে ছুটে যাওয়া ট্রেনের সঙ্গে মিলিয়ে যাচ্ছে তার জীবনের ফার্স্ট পার্সন, তার প্রথম বিন্দু, শ্রীযুক্ত বাবু হরপ্রসাদ।
২
‘গাইড’ রিলিজ করল পঁয়ষট্টির ছয়ই ফেব্রুয়ারি। তারপর বিপদে পড়ল দেবানন্দ। ‘চিত্রা’ হলে তিন বার দেখার পর অমন হিট হিরো, ভারতীয় গ্রেগরি পেককে পাকড়ে ফেলল সদ্য কৈশোর পেরোনো প্রীতিলতা। বিপদ হল ওয়াহিদা রহমানেরও। তাকে প্রতিদ্বন্দ্বী ধরে নিয়ে মন ঈর্ষায় ভরে গেল প্রীতির। তারপর অসংখ্য সিনেমা এলেও দেবানন্দ মুক্তি পেল না, প্রীতিলতার হৃদয়ে আটকে রইল। সরলতরল হাসিখুশি মেয়েটি ছায়াছবির রোমান্সে এত ডুবে থাকত যে, তার সঙ্গে সবসময় বসবাস করত কোনো-না-কোনো স্টার। অবশ্য, বিছানা অবধি যাবার স্বাধীনতা ছিল একমাত্র দেবানন্দের। ভদ্রলোকের বন্দিদশা চলে উনসত্তরের সাতুই নভেম্বর পর্যন্ত, ওই দিন মুক্তি পায় রাজেশ খান্না আর শর্মিলা ঠাকুরের ‘আরাধনা’, তারপর প্রীতি ধরে ফেলে রাজেশকে। মাঝে ধর্মেন্দ্রর প্রবেশের সম্ভাবনা এসেছিল। বড্ড বলশালী, এই যুক্তিতে সরিয়ে রাখা হয়। সত্তরে প্রীতির বিয়ে। সে-বার চারটে সিনেমা দু-বার করে দেখেছিল— ‘জনি মেরা নাম’, ‘জীবন মৃত্যু’, ‘মেরা নাম জোকার’ আর ‘কাটি পতঙ্গ’। প্রথম তিনটে সে ছেঁটে ফেলে আলাদা আলাদা কারণে। ‘জনি মেরা নাম’— বুড়ো হয়েও দেবসাহেব খালি বাচ্চাদের সঙ্গে লটঘট করে। ‘জীবন মৃত্যু’— বাংলায় উত্তমকুমার অনেক ভালো করেছে। ‘মেরা নাম জোকার’— রাজ কাপুরের গলাটা মেয়েলি, গোঁফটা বাজে। তা ছাড়া একটা সিনেমার দু-দুটো হাফটাইম! ‘কাটি পতঙ্গ’ই ভালো। বেঁচে থাক রাজেশ খান্না। আশা পারেখের পাছা বিসদৃশ, উথলে ওঠা দুধের মতো ফোলা কেন? রাজেশের টেস্ট খারাপ হয়ে যাচ্ছে নাকি, এরকম মৃদু সংশয় অবশ্য ছিল তার মনে। সব মিলিয়ে নিজের জীবনটা কম বয়েস থেকেই ছায়াছবির জগৎ বানিয়ে ফেলেছিল ভালোমানুষ মেয়েটা। নিজস্ব চিত্রনাট্যে ছবিতে দেখা চরিত্র নিয়ে কাটত তার সময়। দিন কাটত গুনগুনিয়ে, রাত স্টার-সংসর্গে। নতুন বর দেবপ্রসাদের সেখানে স্থান ছিল না। বিয়ের পর হানিমুনে গেছিল দার্জিলিং। সেও রাজেশের জন্য। টয়ট্রেন, ঘুম, ম্যাল, ফাইভ পয়েন্ট, টাইগার হিল ঘোরে রাজেশের বুকে মাথা রেখে। ফার্স্ট হাফ জুড়ে গভীর প্রেমে। হাফটাইমের পর আর ভালো লাগেনি, দুঃখী শর্মিলার জায়গায় নিজেকে দেখতে চায়নি প্রীতি। ‘ইন্টারমিশান’ লেখা পড়তে তার হানিমুন শেষ হয়ে যায়।
প্রথম-প্রথম দেবপ্রসাদের কাছে বউয়ের খুকিপনা বেশ মজার লাগছিল, প্রশয়ও দিচ্ছিল খানিকটা। প্রশ্রয়ে যৌনতা বাড়ে। কিন্তু বিবিধ পরিবর্তনশীল স্ক্রিপ্টের সঙ্গে সে তাল মেলাতে পারছিল না। বিয়ের নতুনত্ব কমে আসতে প্রীতির তরল তাজা ভাবটা তার অসহ্য লাগতে থাকে। রোজ পরপুরুষের সঙ্গে কাটায় এমন বউ কোন পুরুষ সহ্য করবে? অবাস্তব এই বউ কখনো গৃহিণী হবে এমন আশা দেবপ্রসাদ ছেড়ে দেয়।
আশা ছেড়ে দিয়েছিল প্রীতিলতাও। মধুচন্দ্রিমায় গিয়েই সে বুঝতে পারে বর তার জগতের কেউ হবে না। নায়ক তো নয়ই, ভিলেন বা ছোটোখাটো সাইডরোলেও ফিট করবে না। পাহাড়ী সান্যাল বা বিকাশ রায় তো দূরস্থ, আগা, মেহমুদ, কিংবা মুকরি হওয়াও সম্ভব না। সে না-হয় মেনে নেওয়া গেল, কিন্তু, ফুরফুরে একটু রোমান্স তো থাকবে। দার্জিলিঙে পূর্ণিমার চাঁদ মাথার ওপর দেখে ঘুমন্ত বরকে সে ডাকে, ‘‘দেখো দেখো, কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে, আলো জলপ্রপাতের মতো গলে পড়ছে।’’ দেবপ্রসাদ পাকা ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলে বাইরের দিকে তাকায়, তারপর বলে, ‘‘চাঁদ এরকমই হয়— পূর্ণিমায় আলো বেশি হয়— পাহাড়ও উঁচু-নীচু হয়— এতে দেখার আছেটা কী?’’ তারপর পাশ ফিরে সে ঘুমিয়ে পড়ে। রাতভোর একা বসে জানালা দিয়ে জ্যোৎস্নার বৃষ্টি দেখে প্রীতি, দেখে ঠান্ডায় কুঁকড়ে যাওয়া গাছপাথর। ভাবে বরফের মধ্যে কাঠের আগুন জ্বেলে সে অপেক্ষায় আছে কারো। সবই ডলবি সাউন্ড এফেক্টসহ। তারপর আর কখনো বরকে ডাকেনি। যা হওয়ার নয়, যে হওয়ার নয়, তার পেছনে ছুটে লাভ কী?
এইভাবে কেটে গেল পাঁচটা বছর। এর মাঝে দুটো মিসক্যারেজ হয়ে গেছে। তৃতীয় বার অতিরিক্ত সতর্কতার মধ্যে ছ-মাস কাটার পর চাঁদু ডাক্তার চেক-আপে আসে। ছোটোবেলার বড়ো হয়ে যাওয়া ডাক্তারবন্ধু। কথাপ্রসঙ্গে গর্ব করে দেবপ্রসাদ তাকে বলে, ‘‘বুঝলে হে, আমাদের বংশের সবার সৃষ্টি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক মুহূর্তে।’’ কথাটা সত্যি। হরপ্রসাদের জন্ম ২৯ জুলাই, ১৯১১। সে-দিন গোরাদের হারায় খালি-পায়ের মোহনবাগান। তার দু-দিন আগে থেকে ঢাকা, অসম, পূর্ণিয়া থেকে বাঙালিরা কলকাতা ও তার আশপাশে ভিড় জমায়। আধচেনা অনেক আত্মীয়ে ভরে গিয়েছিল দেবপ্রসাদের পৈতৃক যৎসামান্য আস্তানা (তখনও তারা সচ্ছলতার মুখ দেখেনি)। সেই প্রথম ভারতে খেলার টিকিট ব্ল্যাক হল। মোহনবাগান শিল্ড হাতে গ্রুপ ফোটো তোলার পর প্রবল হট্টগোলের মধ্যে ফাঁক গলে জন্মে যায় হরপ্রসাদ। জন্মের পাঁচ মাসের মধ্যে ব্রিটিশরা রাজধানী দিল্লিতে সরিয়ে নেয়। এভাবে নিজের, মায়ের, বউয়ের এবং বংশের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দিনক্ষণগুলো বলতে যাচ্ছিল দেবপ্রসাদ। ডাক্তার তাকে থামায়, ‘‘শোনো দেবু, এভাবে দেখলে পৃথিবীর সব ঘটনাই বৃহত্তর ঘটনার সংকেত। সবকিছুর সঙ্গে সব কিছুর যোগসূত্র টানা যায়। খোঁজার নেশা থাকলে খুঁজে পাবেই। ইলেকট্রিক বাল্ব আবিষ্কারের স্বর্ণজয়ন্তী, লেনিনের মৃত্যুর একান্ন বছর, মাওয়ের লং মার্চের স্টার্টিং পয়েন্ট, কলেরার টিকার শতবর্ষ— খুঁজলে কিছু-না-কিছু সবাই পাবে। এগুলো আসলে নিজেদের অযোগ্যতাকে গরিমাযুক্ত করার তৃপ্তি।’’ এরই ফাঁকে পেট নিয়ে হাঁসফাঁস করতে করতে প্রীতি বলে, “ও মা, তাই তো, আমাদের বিয়ে হয়েছিল সাতুই নভেম্বর, এক বছর আগে ওই দিনই তো ‘আরাধনা’ রিলিজ করল, সেই জন্যই তো আমরা টয়ট্রেনে চাপলাম, তাই-না গো।’’ যার উদ্দেশে বলা, সে বলে, ‘‘বোঝো কাণ্ড, আমি কীভাবে বেঁচে আছি বুঝেছ ডাক্তার?’’ চা খেতে খেতে চাঁদু বলে, ‘‘ছেলেমানুষ, বড্ড ছেলেমানুষ।’’
ঐতিহাসিক মুহূর্তে সৃষ্টির পারিবারিক শর্ত মেনে সুস্মিতা হল পঁচাত্তরের বড়োদিনে। এমন সুন্দর বাচ্চা ওই অঞ্চলের কেউ কখনো দেখেনি। দেবপ্রসাদ অবাক হয়ে গেল। আত্মীয়দের সন্দেহ হল। পড়শিরা কানাঘুষো শুরু করল ঈর্ষায়— সাধারণ বাড়িতে এমন সুন্দরী হয় কী করে? দেবপ্রসাদ ভাবার চেষ্টা করে কার সঙ্গে মিল আছে। উত্তমকুমার, দেবানন্দ, ধর্মেন্দ্র না রাজেশ খান্না। অশোককুমার, গুরু দত্ত, মনোজকুমার, দিলীপকুমার, রাজকুমার, রাজেন্দ্রকুমার আর সৌমিত্রকে সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখা হল; তারা প্রীতির কল্পনায় ছিল না। যে যার কথা ভাবে, তার জিন কি স্বপ্নেও সাঁতরে আসে? কার ক্রোমোজোম হানা দিল? দেবপ্রসাদ ভেবে কুলকিনারা করতে পারল না। শুধু এটা বুঝতে পারল, এই বাচ্চা তার বলে কেউ বিশ্বাস করবে না। না-করলেও এ তারই। কিন্তু প্রীতির কল্পনার আকাঙ্ক্ষা তাকে বড়ো ছোটো করে ফেলেছে। প্রীতিলতা অবশ্য একটুও অবাক হল না। তার ভঙ্গিটা ছিল— বলার কী আছে, স্টারদের বাচ্চা তো এরকমই হয়। অন্যরকম হওয়ার তো কথা নয়, কম সাধনা করেছি?
এরপর দেবপ্রসাদের সঙ্গে প্রীতির সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। মা ও মেয়ের থেকে দূরে সরতে গিয়ে আবার স্কুলজীবনের মতো নির্বান্ধব হয়ে পড়ে দেবপ্রসাদ। প্রীতিলতাও মনের মতো মেয়ে পেয়ে বরের পর্বটা শেষ করল নির্বিঘ্নে। একদিনে নয়, ধীরে ধীরে। সুস্মিতা বর্ণপরিচয় ধরার পর স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ইশারানির্ভর হয়ে পড়ে। আর, সুস্মিতা বেড়ে উঠতে থাকে মায়ের বদ্ধ ছায়াছবির জগতের আড়ালে অনেক বেশি-বেশি করে ঠাকুর্দার কল্পনার খোলা জমিতে।
বাবার মৃত্যুর পর দেবপ্রসাদ হিসেব করে দেখল, এতদিন কিছু-না-কিছু করে চলেছে। বাকি জীবনটা আর-কিছু না করলেও চলবে। মাঠে-ঘাটে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সম্পদের প্রতি মোহ দেখিয়ে লাভ নেই। বাবার সাধের মুনিষরা উদ্ধত হয়ে উঠেছে, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক জটিলতায় জমি বেহাত হওয়ার পথে। প্রায় জলের দরে সেগুলো সাল্টে পরিস্থিতি আয়ত্তের মধ্যে এনে ফেলল সে। অকর্মণ্য বর এতকিছু পারবে ভাবেনি প্রীতিলতা। ওই একবারই দেখল আলস্যের অহংকার ভেঙে তাকে কিছু করতে। পুকুরসমেত ভিন্টেজ গাড়িটা কিনে নিল আর্মির এক রিটায়ার্ড লেফটেন্যান্ট, সিভিলিয়ানদের শৃঙ্খলার অভাব নিয়ে কথা বলা ছিল যার একমাত্র অবসর-বিনোদন। নীচের ঘরগুলোয় বসল তিন পরিবার ভাড়াটে। সবমিলিয়ে নিঃসঙ্গতা একটা কমল। চলাফেরার জায়গা বলতে রয়ে গেল দোতলার ঘরগুলো, যার দুটো নানান সময়ের মালপত্র ঠেসে বন্ধ রাখা হত। খোলা আকাশবাতাসে ভ্রমণের জন্য রইল ছোটো চিলেকোঠার ঘরের সামনে ছড়ানো ছাদ আর পেছনের এক-চিলতে বাগান। ততদিনে চারপাশের বাগান কেটে তৈরি হয়েছে বসতি। সবুজের ভারসাম্য রাখতে রেললাইনের সমান্তরাল রাস্তা বরাবর লাগানো হল ইউক্যালিপ্টাসের সারি, ফাঁকে ফাঁকে ফুটে উঠল ফলস টালি বসানো চিত্রবিচিত্র খোঁচা-খোঁচা ঘরবাড়ি। সামনের কাঁচা রাস্তায় যখন পিচ পড়ল, যখন তিরিশ হাজার গ্যালন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন জলের ট্যাঙ্ক হল ষাট ফুট উঁচুতে, দেবপ্রসাদের অর্ধেক চুল পেকে গেছে। প্রীতিলতা সিনেমা দেখা ছেড়ে দিয়েছে অনেক আগেই। সে তখন মেয়ের জন্য ক্রুশে অপূর্ব লেস বানায়, এঁচোড়ের আচার করে। আর, স্মৃতিকাতর আউটডোর সিকোয়েন্সের গান গুনগুন করে। ঘরে যে আটকে যায় তার মনই বেশি দূরে ছোটে। সুস্মিতা তখন পাঁচ দুই লম্বা, ক্লাশ সাড়ে নাইন। বাবার সঙ্গে যোগাযোগ নির্বাক বিদেশির মতো।
স্ত্রী-কন্যা থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও দেবপ্রসাদের বিশেষ হেলদোল হল না। সে পা-ছড়িয়ে বসার একটা ইজিচেয়ার কিনে তাতে থিতু হল। মাসের প্রথম ব্যাঙ্কের মোটা সুদ আর তিন ভাড়াটের টাকা তোলা ছাড়া গোটা মাসটা কাটে শুয়ে-বসে। কাজের লোকদের কাজ ভাগ করে দেওয়া আছে, ওসব নিয়মে চলে। এই অবস্থায় সে একটা দাবা কিনে ফেলল। কাজ করা কাঠের ঘুঁটি আর ভাঁজ করা ল্যামিনেটেড চৌষট্টি খোপের বোর্ড নিয়ে প্রৌঢ়ত্বের গোড়ায় শুরু হল দাবার প্রথম পাঠ। দাবা খেলে আর পুরোনো বাড়ির নানা শব্দ শোনে, শব্দের সঙ্গে পায় অদ্ভুত সব গন্ধ। অবিরাম অবকাশ দেবপ্রসাদের কিছু ইন্দ্রিয় তীক্ষ্ন করে তুলেছে। বাড়ির ছায়ার পরিবর্তন, গতির তারতম্যে ট্রেনের বগি গণনা করে চোখ বুজে। কখনো-বা গল্পের বই, পুরোনো খবরের কাগজ পড়ে। চাঁদু ডাক্তার একদিন বলে, ‘‘এটা কোনো জীবন নয়। সব থাকতেও এভাবে আছ কেন? সামান্য মান-অভিমান এত বড়ো করে তোলে কেউ? টাকার জন্য না হলেও নিজের জন্য কিছু করা দরকার। সংসারও করতে হয় নিজের বাঁচার জন্য। অহেতুক জটিলতায় সব নষ্ট করছ।’’ কিন্তু, আলস্যের বর্ম বড়ো কঠিন, সে আত্মরক্ষা জানে। আলস্যের গর্বে গ্যাসফানুস হয়ে ওঠা দেবপ্রসাদের ধারণা— কাজে ব্যস্তরা আসলে অকাজের লোক, ওতে পৃথিবীর উপকার হয় না। কিছু করছি না মানে, কারো অপকার করছি না। অধিকাংশ কুঁড়ে লোক এক ধরনের লোকাল দার্শনিক হয়ে পড়ে। কথাবার্তায় হয়ে ওঠে ওস্তাদ। আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য গীতা, নীৎশে— সবকিছুর সরল অপব্যাখ্যা করে চতুরভাবে। মোদ্দা কথা একটাই— কিছু না করে জীবনটা চালাব। ডাক্তারকে সে যুক্তি দেয়, ‘‘এক প্রজন্ম উপার্জন করবে, পরের প্রজন্ম ভোগ করবে, এটা পৃথিবীর নিয়ম। বাবা প্রথমটা করেছেন, আমার কাজ আমায় করতে দাও।’’
— ভোগ করার জন্যও শ্রম লাগে, সেটা অন্তত করো।
— পাগল হয়েছ ডাক্তার? বাবাকে দেখেছি উদয়াস্ত খেটে মাঠের মাঝে মরে গেল। কী হবে ওসবে?
— তবু ওটাই জীবন। তুমি কিছুই শিখলে না। না বাবার থেকে, না বই থেকে। মাঠে না মরে খাটে মরলে কী সুবিধা হত?
— শিখেছি। শিখেছি কোনোরকম আবিষ্কার বা উপলব্ধি থেকে দূরে থাকতে হবে। সবই তো পৃথিবীতে হয়ে গেছে। এটুকু জেনেছি। লেখালেখির চক্করে একদম পড়তে নেই। লেখা যত-না বুদ্ধি-বিবেচনা প্রকাশ করে, তারচেয়েও বেশি প্রকাশ করে মূর্খামি। সব লেখালেখির ওপর শেষপর্যন্ত গুবরে পোকা বসে হাসে।
— নাঃ, তুমি একেবারে হোপলেস।
দুই বন্ধুর কথাবার্তা এইভাবে চলে। এভাবে বন্ধুত্ব বাড়ে।
দু-জনে একটু দাবা খেলে। বেসুরো গলায় দেবপ্রসাদ গুনগন করে, ‘যব ছোড় চলে লক্ষ্ণৌ নগরী ...’। ডাক্তার বলে, ‘‘ওয়াজেদ আলি শা-র চেয়ে তোমার অবস্থা করুণ, সবাই একদিন ছেড়ে চলে যাবে তোমায়, তোমারই জটিলতায়।’’
সে-বছর ১১ ডিসেম্বর অকালে চলে গেল প্রীতিলতা। বিনা নোটিশে। মনে মনে সে আগেই মরে গিয়েছিল। শরীর গেল এবার। কারণ বোঝা গেল না, বেশ রহস্যজনক। সুস্মিতা শুত মায়ের সঙ্গে। রাতে খুব আদর করার পর মেয়েকে নিজের হাতে ক্রুশের কাজের সুন্দর জামা পরায় প্রীতি, ‘‘কী সুন্দর দেখাচ্ছে তোকে’’, কাজলদানি থেকে কড়ে আঙুলে কপালের পাশে টিপ লাগিয়ে দেয়। তারপর খাইয়ে-দাইয়ে হালকা চাদর চাপা দিয়ে মেয়ের পাশে শুয়ে পড়ে। সকালে আর সে ওঠেনি। বালিশ সরাতে পাওয়া যায় মোটাসোটা একটা ডায়েরি।
নাভি থেকে গা গুলিয়ে ওঠা দুঃখের মাঝে সেই প্রথম বারের জন্য সুস্মিতা দেখে অপদার্থ বাবার তৎপরতা। মাত্র ৩৯ বছর বয়সে রোগের পূর্বলক্ষণ ছাড়া কীভাবে মা মারা গেল বোঝা যায়নি। রহস্যের বাতাবরণের মধ্যে ডাক্তার লিখল ‘হার্ট ফেলিয়োর’। পরে শোনা যায় প্রীতি নাকি এক বছর ধরে ইসকিমিয়ায় ভুগছিল। সুস্মিতার অবশ্য সন্দেহ থেকে গেল। দেবপ্রসাদ তার এতদিনের চাপা-থাকা স্নেহ উজাড় করে দিলেও তা আর কাটল না। স্ত্রীর প্রতি যে-ভালোবাসা যায়নি, স্ত্রী থাকতে যে-আবেগ দেখা যায়নি, দমবন্ধ করা অধিকারবোধে তা বিপজ্জনক রূপ নিল। সুস্মিতা এই অস্বাভাবিক স্নেহ মেনে নিল না, তার কাছে এসব বাবার অপরাধবোধের অনুতাপময় প্রকাশ। তা ছাড়া, ততদিন অঙ্কের বই থেকে সে জেনে গেছে— দুই বিন্দুর মধ্যে সংক্ষিপ্ততম দূরত্বের পথকে সরলরেখা বলে, এবং হরপ্রসাদ আর প্রীতিলতা নামের দুই বিন্দুর সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল সরলরেখায়। দেবপ্রসাদ নামের বিন্দুটির সঙ্গে দূরতম ঘুরপথের বক্ররেখাতেও সে যোগাযোগের পথ খুঁজে পায় না। তবু, বাবার দিকের আত্মীয়রা মাথায় হাত বুলিয়ে বলে যায়, ‘‘এবার বাবার দায়িত্ব তোর।’’
এসব কথাও সুস্মিতার আবছা হয়ে এল। তাদের প্রতিনিধি হিসেবে রয়ে গেল মায়ের স্মৃতি আর মোটাসোটা ডায়েরিটা। কলেজে ঢোকার পর ডায়েরিটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে সে। তেমন কিছুই ছিল না। ডায়েরি যদি দিনলিপির সমাহার হয়, এটা ডায়েরি নয়। নানান বিষয়ে এলোমেলো লেখা, সময়ের ক্রম অনুসারেও নয়। ছোটোবেলার বন্ধুদের কথা, বড়ো হওয়ার জায়গার বর্ণনা, আর, অন্তত দুই তৃতীয়াংশ জুড়ে সিনেমার কথা। কখনো ছবির সংক্ষিপ্তসার, কী হলে ভালো হত সে-বিষয়ে মতামত। সমালোচকের মতো। কোন সিনেমা হলের সিটে ছারপোকা বেশি, কিংবা, কারা দর্শকদের দাবিতে একই রিল দু-বার চালিয়েছিল, এইসব কথা। স্টাররা তো ছিলই; পাহাড়ী সান্যাল, অভি ভট্টাচার্য, অসিত সেন, টুনটুন, শোভা খোটে, মলিনা দেবী, পদ্মাদেবী, তুলসী চক্রবর্তী নিয়েও টিপ্পনীতে ভরে উঠেছিল পাতাগুলো। সিনেমা দেখা ছাড়ার পর শুরু হয়েছিল লেখা। এভাবেই বোধ হয় ছায়ার মতো ছবির জগতে টিকেছিল প্রীতিলতা। মেয়েকে লেখা অনেক চিঠিও ছিল সেখানে। স্নেহ আর উপদেশে ভরা, সন্তান দূর-হস্টেলে থাকলে মায়েরা যেমন লেখেন। তবে চমকে যাওয়ার মতো ছিল শেষের সতেরো পাতা। হয়তো আরও অনেক লেখার ছিল, সময় পায়নি। তাই কিছু ডট ডট ডট দিয়েই কাজ সেরেছিল। এই অংশটা সাধুগদ্যে লেখা। গভীর কোনো কথা নয়, সমাজচিত্রের বড়োসড়ো প্রতিফলনও ছিল না সেখানে, তবু মায়ের লেখা বলে কথা! প্রীতিলতাকে তেমন সূক্ষ্ম অনুভূতির মানুষ বলা যাবে না, তাহলে স্বাভাবিক চটুলতা ছেড়ে হঠাৎ সাধুগদ্যে আংশিক আত্মচরিত কেন? কে জানে?
প্রথম দুটো পরিচ্ছদ ছিল এইরকম—
ক।। আমার বিবাহের পরবর্তী মাসে ঘোর বর্ষা আসিল। সেই প্রথম দেখিলাম জলের দাপটে রেলগাড়ি খিড়কির পিছনে দাঁড়াইয়া পড়িয়াছে। লাইন ছুঁইয়া জলের স্রোত মাটি নরম করিয়া তোলায় মানুষের বড়ো বিড়ম্বনা হয়। পিতৃগৃহে গমনের কথা ছিল আমার। দিগন্তবিস্তৃত জলরাশি তাহা বাতিল করিল। তবে, যে-অঞ্চলে আমার নতুন সংসার সেটি অত্যন্ত মনোরম স্থান। শুনিয়াছি, এই অঞ্চল ব্রিটিশবর্জিত হওয়ায় ইহার রূপ অন্য প্রকার ছিল। অদৃশ্য এক রেখার ওই পার্শ্বে আসিয়া প্রতাপশালী ইংরেজরা থামিয়া যাইত। কিন্তু, আবহাওয়া দেখিতেছি সে-রেখা মানিতে চাহে না। জলমগ্ন চরাচরে আমরা সামান্য দ্বীপ হইয়া জাগিয়া আছি।
খ।। বন্যার পূর্বাভাস সত্ত্বেও বাবা আসিলেন ছোটোভাইয়ের সহিত। আমি তার আদরের মেয়ে। স্বামী দ্বিতলের বারান্দা হইতে নামিবার সৌজন্যটুকুও দেখাইলেন না। উপর থেকেই বলিলেন, এই দুর্যোগে আসিবার প্রয়োজন কী? মেয়েকে কি জলে ফেলিয়াছেন? এক-হাঁটু জলে দাঁড়াইয়া বাবা বলিলেন, ‘‘বাবাজীবন আমরাই তো জলে পড়িয়াছি।’’ রাতে স্বামী বলিলেন, ‘‘তোমার বাবার কথা ইঙ্গিতপূর্ণ, লক্ষণ ভালো নয়।’’ সে-দিনই আমি টের পাই লক্ষণ ভালো নয়, বিবাহিত জীবন সুখের হইবে না। তবে শ্বশুরমশাই ভালো লোক, তিনি ক্ষুদ্র ভাবনার মানুষ নন। চমৎকার আপ্যায়ন করিয়া আমার সম্মান রাখিলেন।
এইভাবে আলাদা আলাদা প্রসঙ্গে লেখা। দেবানন্দ রাজেশ উত্তমে ডুবে থাকা মানুষ কেন হঠাৎ কৈলাসবাসিনী দেবীর ভাষায় লিখতে শুরু করল শেষ অংশ? সে কি জানত ‘এক্ষণ’ গৃহবধূর ডায়েরি ছাপে? সে কি বুঝতে পারেনি একদিন তা বন্ধ হয়ে যাবে? তা ছাড়া, সেসব গৃহবধূদের সেটাই ছিল স্বাভাবিক ভাষা। প্রীতিলতা অতদূর পেছনে ছুটল কেন? হয়তো সে বুঝেছিল শেষ এগিয়ে আসছে। শেষের শুরুতে মানুষ অদ্ভুত গাম্ভীর্য অর্জন করে, অন্তত চেষ্টা করে। আর, তার সহজতম মুদ্রাদোষ হয়তো এমন ভাষা। প্রীতিলতাও বুঝিবা গম্ভীর কিছু বলার কথা ভেবেছিল, যদিও সে যোগ্যতা তার ছিল না।
সুস্মিতা মায়ের ডায়েরি হরপ্রসাদের সেই ট্রাঙ্কে ঢুকিয়ে রাখে। তার কেমন যেন মনে হয়, ডায়েরি মৃত্যুর পূর্বসংকেত। দু-দু-বার যা সে পেল।
৩
তো, এই হল সুস্মিতার ব্যাকগ্রাউন্ড। কানাঘুষো আর গুজবে সংগৃহীত মিথ জুড়ে একটা বালিকাবেলার কাহিনি। তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের চেষ্টা বৃথা। মিথ্যে হলেই-বা ক্ষতি কী? যে-মিথ্যে বার বার উচ্চারণে প্রতিষ্ঠিত, তা-ই সত্য। আমরা যখন সুস্মিতাকে পাই, আমাদের গল্প সেখান থেকে। পাই বলা ঠিক হল না। পাবার স্বপ্ন বলা যায়। কেননা, সুস্মিতাকে কেউ কখনো পায়নি।
আমাদের ছোট্ট শহরে সে-সময় সুস্মিতা ছিল এক সাড়া জাগানো রমণী। মেয়ে, মহিলা, তরুণী বা যুবতী তার সঙ্গে খাপ খায় না। সুস্মিতাকে দেখে রমণেচ্ছা হয়নি এমন পুরুষ ওই অঞ্চলে ছিল না। আশপাশের মফস্সলেও অমন সুন্দরী ছিল না। সুস্মিতা কারো দিকে তাকিয়ে দেখেনি। দেমাকে নয়, এমনিই। সে বড়ো অন্যমনস্ক। বাবাকে দেখার পর, মায়ের মৃত্যুর পর, পুরুষদের দেখার ইচ্ছেই চলে যায়। বয়সোচিত হরমোনের প্রভাবেও বিপরীত লিঙ্গ সম্পর্কে কৌতূহল জাগল না। সৌন্দর্যের কারণে খেলার সঙ্গী না জোটায় উসকে দেওয়ার মতো কেউ হল না। শরীরের সব কোষ রয়ে গেল অপাপবিদ্ধ। কত কামনাকাতর দৃষ্টি প্রতিমুহূর্তে বিদ্ধ করছে সে-সম্পর্কে সুস্মিতার ধারণা ছিল না। । লক্ষ করলে বুঝতে পারত এই ভক্তকুলের বয়সের লোয়ার লিমিট (১৫-১৬) ছিল, আপারটা ছিল না। ষাটের মানুষদেরও বুক হু-হু করে উঠত। সহপাঠী, ইউনিয়ন লিডার, অধ্যাপক, উঠতি মেরিন এঞ্জিনিয়ার, উচ্চাকাঙ্ক্ষী অ্যান্টিসোস্যাল, কমিউনিস্ট কাউন্সিলার, প্রতিষ্ঠিত প্রোমোটার— অনুচ্চারিত পাণিপ্রার্থীর তালিকা ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ ও দীর্ঘ। এক দল ভাবত সময় ফসকে যাচ্ছে, বয়সের শেষসীমার মানুষরা ভাবত সময় ফুরিয়ে আসছে, জীবনটা বৃথাই গেল। প্রস্তাব দেওয়ার সাহস ছিল না কারোর, না নিষিদ্ধ, না সামাজিক। সুস্মিতার ত্বকের আভা আর নাকের ডগায় জমে থাকা ঘামের বুদ্বুদে তাদের আত্মবিশ্বাস ভেঙে পড়ত। বিলাসবহুল বাংলোর পাশে নিছক সার্ভেন্টস কোয়ার্টার মনে হত নিজেদের। এভাবে চলতে চলতে সুস্মিতা কলেজে পৌঁছে গেল। এই অবস্থায় চুরানব্বইয়ের গ্রীষ্মে বাড়ির সামনে পিচগলা রাস্তার মাঝে সুরঞ্জন তাকে প্রোপোজ করে। তখন লু বইছে, শুনশান রাস্তা সদ্য নিভে যাওয়া জীবন্ত এক আগ্নেয়গিরির সুড়ঙ্গ হয়ে আছে। আঁচে সুস্মিতার গোলাপি গাল লাভা-টুসটুসে হয়ে উঠেছে। সুরঞ্জন বলে, ‘‘জানি এটা ঠিক সময় নয়, তবু মনে যখন এসেছে বলেই ফেলি।’’ গলে যাওয়া পিচে সুস্মিতার চটি আটকে গিয়েছিল। সে জোর দিয়ে পা তোলে, চড়চড় শব্দে ছায়ায় ঝিমোতে থাকা কুকুর ফিরে চায়। রোদ ঠেকাতে সুস্মিতা আঁচল টেনে ঘোমটা দেয়। হাতে ছিল লাইব্রেরি থেকে আজই তোলা দুটো বই— হাস্টিনের ‘ট্রপিকস ইন অ্যালজেব্রা’ আর লোনির
‘কো-অর্ডিনেট জিয়োমেট্রি’। স্কুটার সাইড করে বইদুটো ধরে সুরঞ্জন। রাস্তা পেরিয়ে ফেরত নেয় সুস্মিতা। যেন খুব ব্যস্ত এমনভাবে সুরঞ্জন বলে, ‘‘ও হ্যাঁ, যা বলছিলাম ... যাক, বলে আর কী হবে ... আর যা রোদ ... থাকগে ওসব, এই নাও, এতেই সব লেখা আছে।’’ একটা বড়ো সাদা খাম দেয় সে। ‘‘এটা রাখো, পরে জানিয়ো’’— সুরঞ্জন স্কুটারে বসে। লোহার গেটের ওপর অর্ধচন্দ্রাকারে বেড়ে ওঠা বোগেনভেলিয়ার ঝাড় তাপে চুপসে গেছে, তার ক্লান্ত ছায়ায় দাঁড়িয়ে সুস্মিতা জানতে চায়, কী আছে এতে? এই প্রথম সে কোনো পুরুষের দিকে এত সরাসরি তাকাল। চেহারায় কষ্টেসৃষ্টে পাসমার্ক পাবে, স্ট্রেট-ফরোয়ার্ড বলে কিছুটা গ্রেসমার্ক। সুরঞ্জন বলে, ‘‘প্রোপোজাল। তবে প্রেমপত্র নয়। বায়োডাটা। ফুল-লতা-পাতা-জ্যোৎস্না-পাহাড়-সমুদ্রের মতো সুন্দর তুমি নও। তাজমহলের কথা ক্লিশে হয়ে গেছে। আর চাঁদ
বড়ো এবড়োখেবড়ো, পাথুরে। এতে আমার হাইট, ওয়েট, এডুকেশন, ইনকাম, অ্যাম্বিশান, অ্যাড্রেস, ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড, একস্ট্রাকারিকুলার অ্যাকটিভিটিজ ... এইসব কথা আছে। হ্যাঁ হলে জানাবে, না হলেও দুঃখের কিছু নেই। দূর থেকে ঝাড়ি মারব।’’— স্কুটারে স্টার্ট দেয় পাঁচ-নয়ের শ্যামলা ছেলেটা, ‘‘তাড়া নেই, ভাবো। ডিসিশান পরে নিলেও চলবে।’’ গিয়ার বদলে রওনা দেয় সুরঞ্জন। থতমত সুস্মিতা খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, পেছন ফেরে না। সে বুঝতে পারে দোতলার বারান্দায় মরচে পড়া রেলিঙের ফাঁকে দুটো চোখ বিস্ফারিত হয়ে আছে। নীচের ভাড়াটেদের একটা বুড়িও কি দেখছে না? দেখকুগে। কোনোদিকে না তাকিয়ে সুস্মিতা ওপরে ওঠে।
দশ ফুট চওড়া পঞ্চান্ন ফুট লম্বা বারান্দায় সিঁড়ির মুখে সুস্মিতার ঘর। মায়ের ঘরটাই সে নিয়েছে। বারান্দার ওই প্রান্তে উলটোদিকে দেবপ্রসাদের ঘর। ওই ঘরে শরদিন্দুর গল্পের কুটিল বুড়োদের মতো খুটখাট করে। বার্মাটিকের আলমারি খুলে গোপন কাগজপত্তর নিয়ে সে কীসব যেন করে ডিম লাইট জ্বেলে। রাতভর ব্যস্ত থাকে। দিনের বেলাটা দেবপ্রসাদের বারান্দাতেই কাটে। মাঝে মাঝে পেছনের জানালা দিয়ে রেললাইনের ওপারের জমিজমা দেখে, যে-জমি বহু আগে নিজেই ছেড়ে দিয়েছে। কখনো ডান দিকের পুকুর দেখে, যে-পুকুর তার সহ্য হয়নি। এখন লেফটেন্যান্টের ছেলে সেখানে মাছচাষ করে। সবই চোখের সামনে আছে, শুধু তার নেই। দায়িত্ব আর পরিশ্রমের ভয়ে সে-ই সব থেকে দূরে পালিয়েছে। অনেকটা একই কারণে সে মেয়ের কাছে পৌঁছোতে পারেনি, অল্প চেষ্টার পর হাল ছেড়ে দেয়। মনের গোলকধাঁধা এমনভাবে গ্রাস করেছিল যে, পুনরায় ফেরার চেষ্টা করা যায়নি। তাতে অধিকারবোধ অবশ্য একটুও কমেনি। কেউ না মানলেও না। দিনের বেলা সে শুয়ে-বসে কাটায় বারান্দার ইজিচেয়ারে। এমন একটা জায়গায়, যেখান থেকে পূর্ব দিকের জানালা খুললে সুস্মিতাকে দেখা যায়। ঠিক সুস্মিতাকে নয়, শুয়ে থাকা সুস্মিতার পায়ের দিকটা। যদিও এই কারণে ওই জানালা সুস্মিতা কখনো খোলে না। সে দক্ষিণের দুটো জানালা দিয়ে রাস্তা দেখে, অচেনা লোক দেখে। পশ্চিমের জানালা দিয়ে দেখে রেললাইন, তার ওপারের সেই জমি, যার সুখ ও দুঃখের ছবি এখনও স্মৃতিতে উজ্জ্বল। সুস্মিতার কোন জানালা কখন খোলা মানুষ জানে। তারা ঘুরঘুর করে দর্শনের আশায়। নানা ছুতোয় তারা থমকে যায় জানালার কাছে। অবস্থা বুঝে একটা চায়ের গুমটিও হয়েছে। সাইনবোর্ড নেই, তবু লোকে বলে ‘সুস্মিতা টি স্টল’। কেউ কেউ বলে ‘ভিউ পয়েন্ট’।
ঘরে ঢুকে সুস্মিতা খাম খোলে। পরিষ্কার এ-ফোর সাইজের টাইপ করা কাগজ। চাকরির দরখাস্তে যা-যা থাকে— সব। পরিচ্ছন্ন সিভি। নীচে একটা সইও আছে। সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। মাঝারি মাপের একটা কোম্পানিতে সবে শুরু করেছে। সুস্মিতা হিসেব করে দেখল তার থেকে সাত বছরের বড়ো। এর আগে কখনো প্রেমপত্র পায়নি সে। পেলে, ইনিয়েবিনিয়ে লেখা শব্দসম্ভার নিয়ে সে কী করত? বিরক্তই হত নিশ্চিত। অবধারিতভাবে সেখানে ‘ভালোবাসা’ বা ‘প্রেম’ থাকত, রূপ-গুণের স্তুতি থাকত কালিদাসের জমানার ভাষায়। নিজের বক্তব্যকে বিশ্বাসযোগ্য করানোর জন্য এক গাদা মিথ্যে। ‘লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট’ হয় নাকি? ‘কাম অ্যাট ফার্স্ট সাইট’ হতে পারে। ওই চিরাচরিত ঝামেলা থেকে অন্তত ছেলেটা মুক্তি দিয়েছে। যা জানা যায় না, জানায়নি, যা জানানো সম্ভব সেটুকুই করেছে। নরমসরম কাব্যির চেয়ে এ-স্টাইলটা ভালো। এরকম প্রেমপত্র কাউকে পেতে শোনেনি। তবু চোদ্দো পয়েন্টের পরিচ্ছন্ন হরফগুলোর মধ্যে সে অনুভব করে, ছেলেটা অল্প হলেও রোম্যান্টিক। টাইপমেশিন যা চাপতে পারেনি।
সিভি-তে নেই এমন অনেক কিছু সে দেখতে পায় যেন। আর, ক্রমে শরীরে কেমন যেন হালকা ক্ষরণের অনুভূতি হয়। শরীর থেকে কিছু যেন বেরিয়ে যেতে চাইছে। খাটের ছত্রি ধরে সে দাঁড়িয়ে থাকে। সামান্য একটা সিভি-র প্রতিক্রিয়া এমনও হতে পারে! হয়তো, সামান্য উপলক্ষের অপেক্ষায় ছিল শরীর। অনেক দিন পর সুস্মিতা পুবের জানালা একটু ফাঁক করে, অনুকম্পার দৃষ্টিতে চায় ইজিচেয়ারের দিকে। একটি বার মাত্র। আর, সিভি-টা সে অ্যাকসেপ্ট করে।
পরের ক-টা দিন চমৎকার কাটল সুস্মিতার। সেই ঠাকুর্দার সঙ্গে সময় এত ভালো লাগত। এত ভালো লাগত মা গুনগুন করতে করতে তেল-চুকচুকে চুল বেঁধে দেওয়ার সময়। পরের পনেরো দিন রিকশা, স্কুটারে দেখা হল বেশ কয়েক বার সুরঞ্জন ও সুস্মিতার। সুস্মিতার মন ছেয়ে গেল ভালো লাগায়। ক্লাসের শেষে কলেজ চত্বরের বকুলতলায় সুস্মিতা বসে রইল অকারণ। মাথার ওপর ঝরে পড়া ফুল সরিয়ে দিল না।
এর মাঝে একদিন সুস্মিতাদের বাড়ি যায় সুরঞ্জন। সুস্মিতা বেরিয়েছিল কেনাকাটায়। দেবপ্রসাদ চিরাচরিত দৃশ্যে একভাবে ছিল। সস্তার বাংলা একাঙ্কের মামুলি মঞ্চসজ্জার মধ্যে। সেই তেপায়া টেবিলে দাবাবোর্ড, পুরোনো ইজিচেয়ার আর ক-টা খবরের কাগজ। দু-জনের কুড়ি মিনিটের সাক্ষাৎকারের পনেরো মিনিট চলে যায় ববি ফিশার আর বরিস স্প্যাককি ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপের মতো। দুই গুরুগম্ভীর প্রতিদ্বন্দ্বী বোর্ডে ঝুঁকে, থুতনিতে হাত, নিবিষ্ট চোখ— এমন ক্লোজ-আপ। বাকি পাঁচ মিনিটের ইতস্তত কথোপকথন ছিল এই ধরনের—
— তাহলে তুমি দাবা জান একটুআধটু?
— অল্প। আর, তাতেই বুঝেছি, আপনি তেমন জানেন না।
— সুমির দিকে দেখছি কিছুটা এগিয়েছ।
— আমি একা এগোলেই কি হবে?
— সেটা পরের কথা। তোমার সাহস বলিহারি। এমন চেহারা নিয়ে এগোলে কী করে!
— চেহারা দিয়ে কিছু হয়? চেহারা ক-দিন থাকে?
— ব্যাকগ্রাউন্ড আছে ম্যাচ করার মতো?
— তা দিয়েই-বা কী হয়?
— হবে না। কিছু হবে না। আমার আপত্তি আছে। এ-সম্পর্ক হওয়ার নয়, টেকার নয়।
— সে-কথা না-হয় সুস্মিতাই বলুক।
— সে বলুক। কী বলবে আমি জানি। তবে, তোমায় মানাবে না।
— তা ঠিক। একসঙ্গে বেরোলে লোকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকবে। পরে অভ্যেস হয়ে যাবে, মেনে নেবে।
— নেবে?
— আপনার মেয়ে বলে যখন মানতে পেরেছে, আমারটাও পারবে।
আঁতে লাগে দেবপ্রসাদের। বহু পুরোনো ফোঁড়া ফেটে যায় যেন। সে গুম হয়ে যায়, তারপর কিস্তি দেয়। সুরঞ্জন বলে, ‘‘ওই ঘর থেকে মন্ত্রী সরবে না, রাজা ধরা আছে।’’
প্রথম সাক্ষাৎকারে দেবপ্রসাদের মনে হয় ছেলেটা টেঁটিয়া। সুরঞ্জনের মনে হয় লোকটা আলস্যের চর্চা করতে করতে অ-সুখের সাধনা করছে। তিনটে বোড়ে, একটা ঘোড়া, একটা নৌকো খেয়ে এবং দুটো বোড়ে ও একটা গজ খুইয়ে সুরঞ্জন উঠে পড়ে। ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ অমীমাংসিত থাকে। দেবপ্রসাদ জানতে চায়, ‘‘নেক্সট কবে আসছ?’’ সুরঞ্জন ভাবে ‘বাঞ্চোতটা পাগল’, বলে, ‘‘শিগ্গিরই।’’
দেবপ্রসাদের সঙ্গে কথোপকথনের বর্ণনা সুরঞ্জন দেয়নি। সুস্মিতাও আগ্রহ দেখায়নি। বাড়ি এসেছিল, ফিরে গেছে, ব্যাস। পরের সাত দিনে দু-জনের দেখা হয় চার বার। সুরঞ্জন এগোচ্ছিল রাজধানীর গতিতে। প্রথম বার সুরঞ্জন বলে, ‘‘বলার দরকার নেই, জানি তোমার উত্তর হ্যাঁ।’’ দ্বিতীয় বার হাত ধরে। তৃতীয় বারে ফাঁকা দেখে জড়িয়ে ধরে। চতুর্থ বারে চুমু এবং বিপর্যয়ের শুরু। শরীর কেঁপে উঠল, সব রোমকূপ আবর্জনা সরিয়ে গরান গাছের শ্বাসমূলের মতো জেগে উঠল, কিন্তু, সুরঞ্জনের লালার স্বাদ পেতেই কেমন একটা প্রতিরোধ চাগাড় দিল। তখনই সে পেল পিঁপড়ে চিবিয়ে ফেলার রসালো নোনতা স্বাদ। দাঁতের স্পর্শে পেল সাইট্রিক অ্যাসিডের জ্বালা।
— ‘‘কী হল?’’ নির্লিপ্ত বাধা পেয়ে জানতে চায় সুরঞ্জন।
— কিছু না। অন্য কিছু করো। কথা বলো।
— তা না-হয় বলব, কিন্তু হলটা কী?
— ‘‘কিছু না, কেমন যেন পিঁপড়ের মতো কিছু একটা, কী যেন ...’’ থেমে যায় সুস্মিতা। নিজের কানেই নিজের গলা অচেনা শোনায়।
— ‘‘তোমার ফ্যামিলির কনস্টিটিউশানে গোলমাল আছে মনে হয়’’, দুশ্চিন্তায় পড়ে সুরঞ্জন। সে বলে, ‘‘আজ যাই। একটা প্রোজেক্টের কাজ আছে, অনেক রাত অবধি করতে হবে।’’
সুস্মিতার আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হয় না। দিন সাতেক পর সকাল বেলায় অফিস যাওয়ার পথে সুরঞ্জন একটা খাম ফেলে সুস্মিতাদের লেটারবক্সে। ওপর থেকে দেখে সুস্মিতা। পাশের পুকুরে তখন টানা-জাল দেওয়া হচ্ছে। দেড়-দু কেজি সাইজের রুই-কাতলার সঙ্গে হাইব্রিডরা লাফাচ্ছে। সুরঞ্জন হাসিমুখে টা-টা করে। সুস্মিতা নীচে নেমে চিঠি নেয়। এটা রেজিগনেশন লেটার। ওই ফরম্যাটেই লেখা। এ-বার হাতের লেখায়। বক্তব্য— স্যরি। এটা হবে না। ব্যাঙ্গালোর যাচ্ছি বেটার কাজ নিয়ে। ছ-মাস পর ওরা বিদেশ পাঠাবে। কতদিন থাকতে হবে জানি না। কেরিয়ারের এই পয়েন্টে কিছুতে জড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তা ছাড়া রোজ বিকেলে দাবা খেলাও অসম্ভব। সুস্মিতার মনে হয়। ছেলেটা জেনুইন, হয়তো বিবেচকও। সুস্মিতার সঙ্গে সম্পর্ক টেকার নয়, বুঝতে পেরেছে শুরুতেই। বুঝতে পেরেছে অ্যান্টিক বাড়ি, ভূতুড়ে একাকিত্ব আর কুঁচুটে বাবাকে নিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সুস্মিতা এভাবে এখানেই থেকে যাবে। ধ্বংসের এই মায়া যাওয়ার না।
সুরঞ্জনকে আর দেখা গেল না। দেখার ইচ্ছেও করল না। দুঃখ কিংবা রাগ হল না। সুস্মিতা যে-অবস্থায় ছিল, সেখানে ফিরে গেল। মাস খানেকের একটা সংক্ষিপ্ত ভ্রমণ সেরে। বলা যাবে না, তার মধ্যে প্রেমে চোট খাওয়ার ক্ষত রইল। ভালোবাসাই হল না, বেদনা কীসের! রয়ে গেল একটু অনভিজ্ঞতাজনিত অপমানবোধ। আর মনে হল ছেলেটার অ্যাপ্লিকেশন ও রেজিগনেশনের মধ্যে গ্যাপটা বড়ো কম। এরকম হলে কোনো কোম্পানিতে ওপরে ওঠা মুশকিল।
সুরঞ্জনের দুটো চিঠি শহরের পুরুষদের অনুপ্রাণিত করেছিল। সুরঞ্জন চলে যাওয়ার পর সুস্মিতাদের বাড়িতে চিঠিপত্তরের ধুম লেগে গেল। বড়ো লেটারবাক্স উপচে মাটিতে ডাঁই হয়ে গেল। হড়পা বানের মতো শূন্য থেকে চিঠির ঢল নেমে এল। ক্যুরিয়ার সার্ভিস, পাড়ার ছোটো বাচ্চা, কাজের মহিলা, পায়রার ঠোঁট, সরকারি ডাকপিয়োন, বিমা দপ্তরের এজেন্ট, ব্যাঙ্কের স্টেটমেন্ট— সম্ভাব্য যেকোনো পথে প্রেমপত্র উড়ে চলল সুস্মিতার উদ্দেশে। প্রেরকদের আবেদন একটাই— এবার আমাদের সুযোগ দেওয়া হোক। যথাসাধ্য চেষ্টা করব খুশি রাখার। স্বনামে-বেনামে, ঠিকানাসহ কিংবা ছাড়া— সবরকম বৈচিত্র্যে। ‘হ্যাঁ’ হলে কী করতে হবে তার সিনেমাটিক নিদানও ছিল কিছু আবেদনপত্রে। জানালায় রুমাল বেঁধে রাখা, ছাদে নীল শাড়ি শুকোতে দেওয়া, বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে দোকানে যাওয়া কিংবা লাল টিপ লাগিয়ে কলেজ যাওয়া— এমন হাজারো বায়নাক্কা। স্তুতিতে ভরা কিছু চিঠিতে সংস্কৃত সাহিত্যসম্ভার থেকে রবি ঠাকুর পর্যন্ত শব্দরাশি ঢুকে পরতে থাকে বিপজ্জনক বানানে। প্রথম দিকের কয়েকটা খোলার পর সুস্মিতা আর ফিরেও তাকাল না। কিন্তু ফেলতেও মায়া হল। ঘরের বাইরে সে বানাল একটা বড়োসড়ো বাক্স, ব্যাঙ্কের চেক ড্রপ-বক্সের মতো। না-খোলা চিঠিগুলো জমতে থাকল সেই বাক্সে। মাস খানেক পর চিঠির সংখ্যা কমতে কমতে মিলিয়ে গেল। শহর সব উন্মাদনা ভুলে আবার নিজস্ব একঘেয়েমিতে ফিরে এল। মামা-মাসিদের স্নেহ আর দুশ্চিন্তায় ভরা মাসিক আসা চিঠি অবশ্য বন্ধ হল না। সেগুলোর শেষদিকে অবধারিতভাবে থাকত ক-টা ছোটো বাক্য— ‘‘অনার্সের পর আর পড়তে হবে না। ছেলে দেখেছি। এ-বছরেই বিয়ে। বাবাকে ছেড়ে চলে আয়।’’
সম্পর্ক না থাকলেও বাবাকে ছাড়া সম্ভব ছিল না। মাঝে মাঝে মামার বাড়ির গেলেও তাৎক্ষণিক স্নেহ কুড়িয়ে ফিরে আসত। নিজের শহর, নিজের অন্ধপুরীতেই সে রয়ে গেল। দূরে যেতে হবে বলে এম.এসসি. ক্যানসেল হল। অনার্সটা ভালোভাবে শেষ করে সুস্মিতা একদম বসে গেল। ক্বচিৎ কলেজের কেউ আসত। কখনো-বা বিকেলের দিকে সে রাস্তায় বেরোত অকারণ, নতুন নতুন গড়ে ওঠা দোকান আর অচেনা ঘরবাড়ি দেখতে। এর মাঝে নানান দিক থেকে সম্বন্ধ আসতে লাগল। আর দেবপ্রসাদ অসীম প্রতিভায় সেগুলো ভ্যাংচি দিয়ে চলল। যেটায় একটু পেকে ওঠার আশা থাকে, সুস্মিতা নিজেই কেঁচিয়ে দেয়। এভাবে বাপ-মেয়ের যৌথ প্রতিযোগিতায় সুস্মিতা বিয়ের সেরা সম্ভাব্য দিনগুলো পেরিয়ে যেতে থাকল। শহরের দুটো প্রজন্ম দূর থেকে দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিল। ততদিনে সবাই জেনে গেছে এটা লাস্ট কেস। সৌন্দর্যের কী বিপুল অপচয়!
তিরিশ পূর্ণ হওয়ার পর সুস্মিতা এক সকালে পেপার হাউসে যায়। সে কিনল একটা বড়ো ব্ল্যাকবোর্ড, এক বাক্স চক ও ডাস্টার। দোতলার টানা-বারান্দার মাঝামাঝি বড়ো শতরঞ্চি বিছিয়ে, বাবার ইজিচেয়ার থেকে ঠিক তিরিশ ফুট দূরে একটা কোচিং ক্লাস খুলে বসল। শুধু নাইন-টেনের অঙ্কের ক্লাস। দেবপ্রসাদ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘আমাদের টাকার দরকার নেই।’’ সুস্মিতা চুপ করে ব্ল্যাকবোর্ড টাঙাল, পরিপাটি করে মুছল চারপাশ। তারপর বলল, ‘‘আমাদের কাজের দরকার আছে’’, এটাও আকাশের দিকে তাকিয়ে, যা কিনা বহু বছরের মধ্যে বাবার সঙ্গে বলা তার প্রথম সম্পূর্ণ বাক্য।
৪
পুকুরঘাটের কিনারায় বসেছিল দেবপ্রসাদ। মাথার ওপর রঙিন ছাতা। ইটের উনুনে রান্না হচ্ছিল মাংস। কত বাচ্চা লুকোচুরি খেলছে, উড়ে যাচ্ছে এ-ডাল থেকে ও-ডাল। দূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে, দূরে আকাশের তোরণ বানিয়েছে রামধনু। বাতাসে বরফের গন্ধ। একে শীত, তায় হঠাৎ বৃষ্টি। ডাক্তার আর দেবু ভদকার গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে দেখছিল হাওয়ায় কাঞ্চনের জোড়া পাতা কেমন প্রজাপতির মতো ডানা নাড়ে। প্রীতি একটা বড়ো পদ্ম পাতায় কষা মেটে নিয়ে আসে, ‘‘খালি পেটে মদ খেয়ো না, লিভার যাবে।’’ প্রীতিকে অবাক করে মাংসের ডেকচি থেকে ছিটকে বাইরের পড়ে চারামাছ। তখন পুকুরময় মাছ, কে যে মাংসে জল ঢেলেছিল না দেখে। কত অবাক কাণ্ডই-না ঘটে! লুডো খেলার ফাঁকে প্রীতি উঠে উনুনে শুকনো কাঠ গুঁজে দেয়, ‘‘আর পনেরো মিনিটের মধ্যে খাবার দিয়ে দেব। আগে বাচ্চারা।’’ আজ বড়োদিন, আজ প্রীতির জন্মদিন। কী দেওয়া যায় প্রীতিকে? বড়ো চকোলেট আর রঙিন টিভি দিলে হয়। মেয়েকে কোলে নিয়ে চকোলেট খেতে খেতে সোফায় বসে সিনেমা দেখবে বউ— এরকম কত স্বপ্ন দেবপ্রসাদ আজকাল দেখে। ঠিক স্বপ্ন নয়, চোখ খুলেও দেখে। আধোঘুমে দেখে, আধো-জাগরণে দেখে। সব স্বপ্ন এত মনোরম হয় না, দুঃস্বপ্নই বেশি। ঘুম আর জাগরণের ভেদরেখা আর তার নেই। মদ খাওয়া নিয়ে প্রীতি আপত্তি করেনি ঠিকই, কিন্তু, মেটে চচ্চড়ি কখনো দেয়নি। কেননা, কোনো সিনেমা নায়কের মেটে খাওয়া দেখায়নি। রেল লাইনের পাশের ডোবাগুলোয় শালুক আর পদ্ম ফুটে থাকতে দেখেছে সে, কিন্তু পদ্ম পাতায় সে কখনো খায়নি। তবে দিনরাত দেবপ্রসাদ কিছু-না-কিছু দেখে। প্রীতি বেঁচে থাকতে এসবের অর্ধেক দেখলেও বিজ্ঞাপন করার মতো সুখী পরিবারের কর্তা হতে পারত সে। ডাক্তার বলে, ‘‘এ-বয়সে এসব স্বাভাবিক। পেটভরা উইন্ড, মন-জোড়া ডিপ্রেশন, চোখময় অনিদ্রা আর অ্যাকাউন্টভরতি টাকা নিয়ে মানুষ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। মৃত্যুকে আটকানোর পদ্ধতি হিসেবে না-পাওয়া জিনিসগুলো, না-করা কাজগুলো স্বপ্নে ফিরে আসে। ঘুমটাই শুধু ফেরে না।’’
— ‘‘ডাক্তার, তুমি আর ডাক্তার নেই, দার্শনিক হয়ে উঠেছ, লোকাল বাবাগোছের হয়ে প্রবচনও দিতে পারো।’’ দেবু ফোড়ন কাটে।
— ‘‘হবে হয়তো। কিন্তু মানুষ যত মৃত্যুর দিকে এগোয় তত পুরোনো কথা ফিরে আসে। মূল্যহীন কথাগুলো হঠাৎ আনন্দের একমাত্র উৎস হয়ে পড়ে। আমারও হচ্ছে। হয়তো আমিও মৃত্যুর ...’’, চুপ করে যায় চাঁদু।
সন্ধ্যের পর হুইস্কি খাওয়া দু-জনের অনেক দিনের অভ্যেস। গুনে গুনে তিন পেগ। ঠিক আটটায় শুরু। সাড়ে ন-টায় শেষ। বেশির ভাগ সময় একা একাই খেত দুই বন্ধু। যে যার বাড়িতে। কালেভদ্রে একসঙ্গে। ডাক্তারের চেম্বার শেষ হলে। ইদানীং রোজ একসঙ্গে বসা হচ্ছে। ষাটের পর দু-জনের বন্ধুত্ব বেড়ে গেল। এই সময় রোগীদের থেকে মন চলে গেল ডাক্তারের। অন্য সামাজিক যোগাযোগও কমে এল। তার মধ্যে যে পরিবর্তনটা হল, তা ভৌত, রাসায়নিক এবং সবমিলিয়ে কিছুটা আধ্যাত্মিকও। যদিও তার ধারণা, এখন অবশেষে সুস্থতার দিকে ভ্রমণ শুরু হয়েছে। এদিকে অনেক দিন প্রেশার, কোলেস্টরেল, থাইরয়েড এবং ডিপ্রেশনের ওষুধ বদলাতে বদলাতে দেবপ্রসাদ ততদিনে একজন অর্ধশিক্ষিত ডাক্তারে পরিণত হয়েছে। পুরোনো রোগীরা আকচার যেরকম হয়। ডাক্তারের রোগী হওয়া আর রোগীর ডাক্তার হওয়ার প্রক্রিয়া দু-জনকে মানসিকভাবে এক স্তরে এনে ফেলেছে। এখন, আটটার পর, সুস্মিতার টোল বন্ধ হলে শশা আর টমেটোর কুচি দিয়ে দু-জনে মদ খায়। কোনোদিন কথা হয়, কোনোদিন হয় না। একদিন তিন পেগের পর ডাক্তার বলে, ‘‘স্নেহ-ভালোবাসা না-হয় দিতে পারলে না, বাপ হয়ে মেয়ের সম্বন্ধগুলো কাঠি করলে কেন বলো তো? কোনো ভদ্রলোক এরকম করে?’’
— কী জান ভাই, মেয়েটা চলে যাবে, অন্য পুরুষের কাছ থেকে ভালোবাসা পাবে, ভাবলেই বুকটা ফাঁকা-ফাঁকা লাগত। অত সুন্দর পরির মতো মেয়েটাকে কোথাকার কোন অচেনা ছেলে খুশি করবে ভাবলে নিজেকে অপদার্থ মনে হত। একা একা কীভাবে যে থাকব!
— তুমি মানসিক বিকারগ্রস্ত। ওভাবে একাকিত্ব কাটে? কেটেছে? উলটে মেয়েটার সর্বনাশ হল, একদম হাতের বাইরে চলে গেল। মেয়ে অন্য পুরুষের, অন্য পুরুষও মেয়ের। তার মাঝে তুমি কে হে।
– বটেই তো। আমি একটু অদ্ভুত, মানছি। কিন্তু সব মানুষই কি অদ্ভুত নয়? আচ্ছা, যদি কাল সকাল থেকেই চেষ্টা করি, এখনও তো বিয়ের বয়স চলে যায়নি, হবে না? ওই যে বলে না, যখন জাগবে তখনই সকাল।
— না হে, হবে না। এত রাতে জেগে উঠলে সকাল ফুট করে পালিয়ে যায়। তুমি একবগ্গা মাথাভারী ঘুড়ির মতো, সর্বদা মাটির দিকে গোত্তা মার। কিছু মানুষ ট্রেন চলে যাওয়ার পর স্টেশনে পৌঁছে হাঁকপাঁক করে, তুমি সেরকম। ট্রেনের ক্ষেত্রে তারপরও একটা পার্সেন্ট রিটার্ন পাওয়া যায়, লাইফে হয় না হে।
একমত হওয়ার জন্য দু-জনের মতবিরোধ চলতে থাকে। এটা ওদের মদ্যপানের প্রধান সঙ্গী, তা উসকে দেওয়ার জন্য কিছু-না-কিছু উপকরণ এসে যায়। যেমন, ট্রেনের কথায় এল ট্রেন। জোর হুইসেল বাজিয়ে। গুমগুম করে বাড়ি কাপিয়ে পেছন দিয়ে চলে যাওয়া শোনে দু-জনে। দূরের গাড়ি। মদ খেলে দেবপ্রসাদের অনুতাপ না হলেও রসরোধ বাড়ে। সে বলে, ‘‘আচ্ছা ডাক্তার, ট্রেনের কথায় ট্রেন এল, বিয়ের কথায় পাত্র আসবে না কেন?’’
— হয়তো আসবে, কিংবা, আসবে না। এলেই-বা কী, ট্রেনের মতো সেও তো বাঁশি শুনিয়ে চলে যাবে।
বয়স বাড়লে স্মৃতিচারণের ঝোঁক বাড়ে, এটা বিপজ্জনক রোগ। যে-অসুখে মানুষ মনে করে সে একটা ঘটনাবহুল জীবন কাটাতে পেরেছে। দুই বন্ধুর স্মৃতিকাতরতা নেই, তাই বিশেষ বিষয়ও নেই। না পরনিন্দা, না শেয়ার মার্কেট, না যৌন-অতৃপ্তি, না মার্কেজ-কুন্দেরা-দেরিদা-চমস্কি। নেই জিডিপি, নেই চাইল্ড লেবার, নেই জেনেরিক মেডিসিন, নেই ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড। রিসেশান নেই, পরস্ত্রী নেই, ওবামা-ইরান নেই, এমনকী সংবাদপত্রও নেই। শুধু আছে এই শশা-টমেটো-হুইস্কি। ফুরিয়ে গেলে রিপিটেশান। কোটা ফুরোলে যে যার কোটরে ফিরে যায়। বিষয়হীন বন্ধুত্বে কীভাবে যেন দু-জনের নির্ভরতা বেড়ে গেছে। শব্দে আর কত সম্পর্ক হয়! দুই বন্ধুর আজ নেশা খুব। নিয়ম ভেঙে অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশি খেয়ে ফেলেছে। দেবপ্রসাদ ছোটো হয়ে আসা চোখে বরফজল দেয়। পুরোনো সেই প্রশ্নটা তাকে আবার জ্বালাচ্ছে, কথাটা পেড়েই ফেলে সে— ‘‘কিছু যদি মনে কর তো একটা কথা ...’’
— ন্যাকামো না করে বলো, ভণিতা ভালো লাগে না।
— সুস্মিতা কি সত্যিই আমার মেয়ে? তুমি বিশ্বাস কর?
— সেটা জরুরি? তিরিশ বছর আছ, এটা বেশি জরুরি নয় কি? এত বছর পর এসব কথা কেউ বলে? বরং ভাবো আরও ভালো করে কেন থাকনি, থাকা যায় কি না।
— তা নয়, প্রীতি অন্য কারোর সঙ্গে শুয়েছিল কি না সে-কথা বলিনি। সে নিয়ে কে ভাবে। আমার যেন আজকাল মনে হয়, ভাবলে বোধ হয় অনেক কিছু হয়। সংগমের সময় যদি কেউ অন্যের কথা ভাবে তাহলে জিনের গঠনের পরিবর্তন হতে পারে? কেমন সন্দেহ হয়। মনে হয়, ডাক্তাররা ফালতু কথা বলে।
— সে-সন্দেহ আমারও হয়। এত বছর বিজ্ঞান ছাড়া কিছু ভাবিনি, তবু এখন মনে হয় যুক্তির বাইরে বহু কিছু হয়। মনের যে কী ক্ষমতা আমরা বুঝিনি। এটা একা একা বুঝতে হয়। সে-কারণেই হয়তো এড়িয়ে চলেছি। আমরা দল বেঁধে একা থাকি, একা একা দল হই না। কি জানি কীসে কী হয়!
— তার মানে তুমি বলছ ভাবলেই সন্তান হয়? কল্পনার জিন থেকে পরি হয়?
— ‘‘হয়তো। পুরাণে তো হত। ঠিকভাবে ভাবলে কি না হয়, পৃথিবীটাই মনের মতো হয়ে যায়। আন্তরিকভাবে বৃষ্টির কথা ভাবো, দেখবে বৃষ্টি এসে যাবে।’’ ডাক্তার শশার টুকরোয় নুন লাগায় আনমনে।
— ‘‘তার মানে দেবানন্দ কিংবা রাজেশ সত্যিই সুস্মিতার বাবা হতে পারে?’’ দেবপ্রসাদের ওয়ান পয়েন্ট অ্যাজেন্ডা।
— হলেই-বা কী! চোখের সামনে ফুটফুটে একটা বাচ্চা তিরিশ পেরিয়ে গেল, তাকে নজরে পড়ল না? মনে ধরল না? তুমি বাপ, সুস্মিতা মেয়ে— এই সহজ কথাটা বুঝতে অসুবিধা কোথায়। বাবা হওয়ার মতো সরল কাজটা কি শুধু ওই এগারো মিনিটের শোয়াশুয়িতেই শেষ? কেমন কিসিমের মানুষ তুমি! দমবন্ধ পরিবেশটা তুমি এঞ্জয় করো মনে হয়।
— বোধ হয় করি।
— সংগমের সময় কখনো অন্য মেয়ের কথা ভেবেছ দেবু? সবাই ভাবে। সেই যুক্তিতে প্রীতির অপরাধ কোথায়?
— ভেবেছি। আমার ভাবনায় আশপাশের মেয়ে ছিল। এর মাসি, ওর পিসি, বন্ধুর বোন, কলেজের মেয়ে, স্কুলটিচার ছিল। সে বাচ্চা এরকম হত না। সব এলেবেলে মেয়ে। মধুবালা, নার্গিস, সুচিত্রা বা ওয়াহিদা কখনো আসেনি। তাই আমার দায় নেই।
— ছাড়ো তো ওসব কথা। বাকি ক-টা দিন আর মেয়েটাকে জ্বালিয়ো না। তোমার মন নরকের দিকে, ওকে আর গাড্ডায় টেনো না।
দেবপ্রসাদের বেশ নেশা হয়েছে। তার মাথায় এসব ঢোকে না। ডাক্তার টলোমলো করে ওঠে। সিঁড়ির রেলিং ধরে ধীরে ধীরে নামতে থাকে। দেবু চায় সব সংশয়ের অবসান, ‘‘বি স্পেসিফিক ডাক্তার, দেবানন্দ না রাজেশ।’’ ঘোলাটে চোখে অবাক হয়ে ফিরে তাকায় ডাক্তার— কী মানুষ রে বাবা! সে নামতে থাকে, উত্তর দেয় না। আবার একই প্রশ্ন আসে। ডাক্তার তখন দশ নম্বর ধাপে।
হেলতেদুলতে সে উত্তর দেয়, ‘‘দু-জনের কেউ নয়।’’
— ‘‘তাহলে কে?’’ দেবুর গলা অশ্রুভেজা।
— ‘‘দাদাসাহের ফালকে।’’ চাঁদুর স্বর উইংসের আড়ালে মিলিয়ে যায়।
রাতে ঘুম হয় না দেবপ্রসাদের। এ-বয়সে ঘুম কমে আসে।
সারাদিন যে শুয়ে-বসে কাটায় তার ঘুম আসবেই-বা কেন। দেবপ্রসাদ ঘরে খুটুরখুটুর করে। কীভাবে রাত কাটাবে সে বুঝতে পারে না। পশ্চিমের জানালা খুলে সে স্টেশন দেখে। দেখে ঋতুভেদে তার চরিত্রের বদল। সিগন্যালের আভায় দেখে ধোঁয়া ও ধুলোর পরিবর্তন। আলমারি খুলে পুরোনো অ্যালবাম দেখে। ইন্সিয়োরেন্সের কাগজ ঘাঁটে। ছোটোবেলার জীর্ণ হয়ে যাওয়া ছড়াছবির বই সে ফেলেনি, সেগুলো খোলে। দেখে একটা বইয়ের মাঝে সিন্ডারেলা সেজে সুস্মিতা বসে ললিপপ খাচ্ছে। পাশে বসে নারকোল কুড়োচ্ছেন মা। আর, পেঁজা মেঘের মতো নারকোল-কোরা দিয়ে মুড়ি মেখে খাচ্ছেন বাবা। দেবপ্রসাদের মন খারাপ লাগে। আলমারির নীচের তাকে চায় সে। বিমা কোম্পানি বছর-বছর ডায়েরি পাঠিয়ে গেছে। কোরা কাপড়ের মতো অব্যবহৃত রয়ে গেছে সব। সুস্মিতাকে দিয়ে দিলে হয়। অঙ্কের সাজেশান লিখবে না-হয় ব্যাচ ধরে ধরে। তারপর মনে হয় ডায়েরিগুলো তাকে ডাকছে— লিখেই দেখো না, আমি তো এখনও অপেক্ষায় আছি। কোনোদিন যা ভাবেনি, চিরকাল যা অপছন্দ করেছে, আজ মাঝরাতে, নিশির ডাকের মতো ভূতগ্রস্ত দেবপ্রসাদ সেই কাজ শুরু করে। বালিশ সরিয়ে বিছানায় ডায়েরি খুলে বসে। সেও শেষপর্যন্ত ডায়েরি লেখা শুরু করল পরিবারের ধারা বজায় রেখে। যথারীতি দিনলিপি নয়, আংশিক আত্মকথন। যেখানে সত্য ও মিথ্যা, বাস্তব ও অবাস্তব একাকার। এবং, সবমিলিয়ে ব্যর্থতার এলোমেলো অজুহাতমালা। উৎসর্গপত্রের মতো একটা পাতা ছেড়ে শুরু। সে-পাতার মাঝে মহাপুরুষের বাণীর মতো সে লেখে— জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ আনন্দ খুঁজে পাওয়া। সবচেয়ে সহজ কাজও এটা। তবু মানুষ তা পারে না। কারণ সহজ কাজ করা সবচেয়ে কঠিন। যখন একজন সেটা উপলব্ধি করে তখন তার সময় ফুরিয়ে আসে। বাবা নিজের ঘোরে থাকতেন, আমার দিকে তাকাননি। স্ত্রী নিজের ঘোরে থাকত আমার দিকে তাকায়নি। মেয়ে নিজের ঘোরে আছে, আমার দিকে তাকায় না। আমি আমার ঘোরে থেকেছি, কারো দিকে তাকাইনি। সবচেয়ে দুঃখের হল, কেউ নিজের দিকে আসলে চায় না। যেটুকু সময় আছে চেষ্টা করে দেখি।
চেষ্টা করার মতো সময় তার ছিল না। তবু সম্ভাব্য বিষয়বস্তুর তালিকায় সে ভাবে— আমি, আমার বাবা, আমার মা, স্ত্রী, আমার মেয়ে এবং ছেড়ে আসা জমি— এরকম কটা অধ্যায় লিখবে। আর অবশ্যই বড়োসড়ো করে লিখবে ‘ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাস’। যে-বিষয়টা তার একদম অজানা, যে তাকে আততায়ীর মতো বিপন্ন করেছে, তার যৌবনকে বিভ্রান্ত করেছে।
সিনেমা আমাদের প্রভাবিত করেছে, না কি আমরা সিনেমাকে প্ররোচিত করেছি, জানি না। সবরকম গল্প নিয়ে ছবি হয়। তারপর সবাই গল্পের মতো জীবন কাটায়। আমাদের পরিবারকে নিয়ে সিনেমা বানানো সহজ হবে না। তা সবার জন্য হবে না। কেননা, আমরা আর্ট-ফিল্মের জীবন কাটিয়ে গেলাম। সিনেমার শুরুটা এমন ছিল না, অন্তত দাদাসাহেব ফালকে এভাবে ভাবেননি। নিজেকে ভুলে মানুষ ছবির মায়ায় এতটা জড়িয়ে পড়বে বুঝতে পারেননি।
দেবপ্রসাদ লিখেই চলল। প্রতিরাতে কিছু সময়। টেবিলল্যাম্প জ্বেলে। কখনো জানালার ধারে যায়। কখনো টেবিলে বসে। কখনো বিছানায়। বাবার মতো ঘুরে ঘুরে সে লিখে চলল। কিছুদিন পর সব বিষয় গুলিয়ে গেল। জ্বরের বিকারে, দুঃস্বপ্নে খড়ের গাদায় ডুবতে ডুবতে পাঁকে তলিয়ে যাওয়ার মতো। অধারাবাহিক ও পারম্পর্যহীন টালমাটাল লেখায় ভরে গেল অনেকগুলো ডায়েরি। দেবপ্রসাদ লিখত আর তা লুকিয়ে রাখত বন্ধ আলমারিতে। এই প্রক্রিয়া থামল মাঝারি মাপের সেরিব্রাল অ্যাটাক তাকে পেড়ে ফেলায়। একেবারে থামাল না। জড়ানো জিভে পা টেনে চলা জবুথবু এমন এক বৃদ্ধে পরিণত করল যে, বাকি সময়টা পরবর্তী অ্যাটাকের আশঙ্কা ও অপেক্ষায় কাটাবে। আর, যখন-তখন ছেলেমানুষের মতো কেঁদে ফেলবে যেকোনো ছুতোয়।
৫
সুস্মিতা ভাবেনি শুরুতেই কোচিং ক্লাস ভরে উঠবে। সবাই খোঁজে অভিজ্ঞ স্কুলশিক্ষক। মনে হয়েছিল হাতে গোনা কয়েক জন আসতেও পারে। পড়াতে পড়াতে সে পাকাপোক্ত হবে। একটা বছর ভালো রেজাল্ট হলে কাজটা জমবে। যদিও জমা নিয়ে তার উদ্বেগ ছিল না। রোজগারটা জরুরি নয়, ব্যস্ততা প্রয়োজন। এভাবে অন্য একটা আইডেন্টিটিও হোক। কিন্তু সুস্মিতা অবাক হয়ে দেখল কী দ্রুত তার পড়ানোর ইচ্ছে শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। ছেলে-মেয়েদের বাবা-কাকা-দাদা-পিসে-মেসোদের ভিড়। আশ্চর্য প্রদীপের ঘষায় দুটো ব্যাচ ভরতি হয়ে গেল। সপ্তাহে তিন দিন। সন্ধ্যে বেলা দু-ঘণ্টা। আনকোরা অবস্থায় এই অভাবিত ঘটনার কারণ সে বুঝতে পারল অভিভাবকদের দেখে। এসবই তার কম বয়সের ক্যারিশমার ফসল। সবাই চেয়েছিল সুস্মিতাকে ভুলে যেতে। পারেনি। নিজেদের সময়কে মনে রাখতে গিয়ে দেখা গেল সুস্মিতাকে মনে রাখতেই হচ্ছে। প্রকাশ্যে কে আর ব্যর্থতা খুঁড়ে তোলে। ততদিনে সেইসব পুরুষদের জীবন মাঝনদীতে স্থির নৌকার মতো হয়ে গেছে। কিন্তু ওই যে বলে ‘নিম্নে সংলগ্ন অস্থির স্রোত বয়’— সুস্মিতা তাদের হৃদয়ে বিঁধে ছিল অধরা আলেয়ার মতো, থেকে গেল কঠিন পাথরের নীচে দগ্ধ লাভা হয়ে। স্মৃতিবিদ্ধ অভিভাবকদের গলে পড়া ভাব দেখে সুস্মিতা বুঝতে পারে এদের কেউ কেউ সুরঞ্জন-পরবর্তী পর্বের পত্রপ্রেরক। অনেকে সাইকেলে অনুসরণ করত। চায়ের দোকানের অস্থির পায়চারির, দক্ষিণের জানালার বাইরের দর্শনার্থীদের দেখতে পায় সে। অনেকে পশ্চিমের ট্রেন যাওয়া দেখেছে সুস্মিতার সঙ্গে সুস্মিতার অগোচরে। এবং, প্রত্যেকের কোনো-না-কোনো রাতের সঙ্গিনী ছিল সে। স্বপ্নে, দুঃস্বপ্নে। ছাত্রপ্রাপ্তি পরোক্ষে তার গতরসুষমার ডিভিডেন্ট। সেইসব পুরুষরা শেষপর্যন্ত সুস্মিতার কাছে আসতে পারল। এভাবে এসে কী হয়? কার যে কীসে এবং কীভাবে হয়! সুস্মিতা অভিভাবকদের বলে, ‘‘মাসে একবার প্রগ্রেসের খোঁজ নেবেন।’’
পড়ানো শুরুর প্রথম রাতে ঘরের প্রমাণ সাইজের আয়নায় অনেকক্ষণ নিজেকে দেখে দিদিমণি। শুধু শায়া পরে। অন্যকে দেখার মতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। পুরুষদের মতো কিছুটা উত্তেজিত হয়, একটু লজ্জাও পায়। সে তাহলে নার্সিসাস ও মেগালোম্যানিয়াক। আগে তো বোঝা যায়নি। একইসঙ্গে বুঝতে পারে তার ম্যাজিক এখনও অটুট। যেকোনো হৃদয়ে প্রতিবিম্ব তৈরিতে তার শরীর আরও পারদর্শী হয়েছে। এ-দেশে পুরুষরা চর্বির অল্প পরত পছন্দ করে। তবে, এই অমোঘ টানের কারণ শুধু শরীর নয়, না-পাওয়ার অতৃপ্তি, যে-অতৃপ্তি ঘুরপথে তাকে দিয়েছে টোলভরা ছাত্র। বড়ো চাদিহা তাদের আর নেই। নিজেদের জীবনের একটা চ্যাপ্টার একটু অন্যভাবে রিভাইস করা, এই যা।
আলো নিভিয়ে নাইট ল্যাম্প জ্বালে সুস্মিতা। ভেতরে কিছু পরে না, শাড়ি জড়ায় হালকাভাবে। তারপর পশ্চিমের জানালাদুটো খুলে দেয়। সাড়ে দশটার পর এই সময়টা সুস্মিতাকে কী যেন ভর করে। আধঘণ্টা ঠায় সে দাঁড়িয়ে থাকবে জানালায় ভর দিয়ে। দেখবে দূরের ট্রেনের দূরে চলে যাওয়া। কোনো পুরুষের সঙ্গে তার কখনো প্রেম হয়নি। দশটা পঞ্চাশের মেল ট্রেনের সঙ্গে কীভাবে যেন জড়িয়ে পড়েছে। অন্যগুলো ভালো লাগে। তবে এর কথাই আলাদা। হয়তো আলাদা নয়, মন আর শরীর মেনে নিয়েছে তাই ভিন্ন। দূর থেকে বাঁশি শোনে সুস্মিতা। সে বুক চেপে ধরে জানালার শিকে। পাতলা শাড়ির নীচে কিছু নেই। প্রথম ও তৃতীয় শিক বৃন্ত ভেদ করে তার দুই স্তনে ধারালো দাগ করে দেয়। দুটি সমান্তরাল লাল গাঢ় রেখা। অল্প ব্যথা লাগে। সুস্মিতার ভালো লাগে। ওই দূরে, বাঁ-দিকে রেললাইন বেঁকে গেছে। পাকানো কেন্নোর মতো প্ররোচনাময় অর্ধচন্দ্রাকার বাঁক। ক্যানেলের লোহার ছোটো ব্রিজের ওপর আওয়াজ শোনা যায়। সে এসে গেছে। সে খুব কাছে। আধো-অন্ধকার থেকে হঠাৎ সে ছিটকে বেরোবে। প্রথমে ভারী মুখ, তারপর গাছপালার অদৃশ্য সুড়ঙ্গ থেকে একটু একটু করে প্রস্ফুটিত হবে লাস্যময় শরীর। অনেকটা সময় নিয়ে সে যাবে। এ-সময় গোটা বাড়ি জেগে ওঠে। হরপ্রসাদ, প্রীতিলতা, আরও না-দেখা পূর্বপুরুষরা, বিগত দিনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণ। কেউ তা জানে না। সুস্মিতা বোঝে। তখন হরর সিনেমার মতো এলোমেলো হাওয়া দেয়। দোতলায় তার জানালার কাছে মখমলের কার্পেটে চড়ে কেউ আসে। তার মুখ দেখা যায় না। সুস্মিতা বলে, ‘‘ট্রেন যাক, তারপর এসো।’’ আওয়াজ বাড়িয়ে ট্রেন আসে, শব্দ কমিয়ে সে চলে যায়। আবছা আলোয়। সুস্মিতা দেখে গার্ড সবুজ লন্ঠন দোলাচ্ছে। হয়তো তার জন্য। কখনো সে-গার্ডকে সুস্মিতা দেখেনি। রোজ এক গার্ড থাকে না। তবে লন্ঠন-ধরা ওই হাত যদি আজ রাতে তার শরীরে হাত দিত সে অখুশি হত না। এ-দিন একটু বেশিই হল সব। ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢুকতে গোটা শরীর জুড়ে হঠাৎ ঝাঁকুনি। সম্পূর্ণ অচেনা অনিয়ন্ত্রিত আনন্দ। কাঁপতে থাকা সুস্মিতার কাঁধ থেকে এলোশাড়ি পড়ে গেল। আগে কখনো এরকম হয়নি। কে যে শরীর উলটেপালটে দিল। যতক্ষণ-না ট্রেন প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে হারিয়ে গেল, তত সময় ধরে চলল এই আশ্চর্য কাণ্ড। সুস্মিতার জীবনের প্রথম অর্গাজম। তাহলে এর জন্য পুরুষই একমাত্র উপাদান নয়! ভেতর-বাইরে সম্পূর্ণ সিক্ত অবস্থায় মেঝেতে বসে রইল সুস্মিতা। অনেকক্ষণ, চোখ বুজে। গলা দিয়ে, বুক দিয়ে, নাভি দিয়ে, ঘাড় দিয়ে গোটা শরীরের সব জল নেমে যাচ্ছে পৃথিবীর ভরকেন্দ্রে। কিছু আর আয়ত্তে নেই, অথচ ভালো লাগছে। কেঁপে কেঁপে উঠছে প্রতিটা স্নায়ু। কখনো আত্মরতিতে এরকম হয়নি। এর কাছাকাছিও না। অনেক দূরে সেকেন্ড পজিশনে রাখা যায় সুরঞ্জনের সেই অ্যাপ্লিকেশনের দিনের কথা। কিন্তু, সে তো প্রতারণার পূর্বাভাস। এ-ক্ষেত্রে তৃপ্তি অনেক গভীর, প্রেমিক ততোধিক বিমূর্ত।
ঘুমোনোর সময় সুস্মিতার মনে হল সে বোধ হয় স্বাভাবিক নয়। তার শরীর নির্জীব চিঠি, ট্রেনের হুইসল, গার্ডের লন্ঠনে সাড়া দেয়, কই সামনে থাকা পুরুষে তো কিছু হয় না। ছোটোবেলায়, সেই যৌনকৌতূহলের বয়সে যখন তুতোভাইরা কিংবা তাদের বন্ধুরা গায়ে হাত দিয়েছে কিছু হয়নি। কেউ অন্ধকারে বাড়াবাড়িও করেছে, কিছু তো হয়নি। সে ভাবে বাবার সঙ্গে লড়তে লড়তে সেও বাবার মতো খানিকটা বিদঘুটে হয়ে পড়েছে। যে যার বিরোধিতা করে সে নিজেও কি প্রতিদ্বন্দ্বীর জটিলতার অংশ হয়ে পড়ে?
শুরুর সময় সুস্মিতা বুঝতে পারে স্টুডেন্টদের বাবা-কাকা-দাদাদের গভীর পিরিত ক্ষণস্থায়ী। রেজাল্ট ভালো না হলে সব এক মরসুমে উবে যাবে। এবং, শুরু হবে চরিত্রহনন। ও-মেয়ে আবার টিচার হবে? রূপ দিয়ে কি অঙ্ক হয়? মাথা লাগে। সুস্মিতার মাথার অনেকটা পৈতৃকসূত্রে দুর্বোধ্য গলিঘুঁজিতে যাতায়াত করলেও অঙ্কের মাথা বরাবর ভালো। সে ঠিক করে ইলেভেন-টুয়েলভ নিয়ে পরে ভাবা যাবে। আপাতত মাধ্যমিকে হাত পাকুক। তার জন্য নিজের মতো একটা সহজ ছক বানাল। ভালো আর মাঝারি ছাত্রদের আলাদা আলাদা স্কিম। দুটো বছরকে সে ভরে ফেলল একটা হ্যান্ডি ক্যাপসুলে— অবজেকটিভ থাকবে ১৮ নম্বর। বেছে ৭০-৭৫টা করালে মার নেই, ভালোরা ১৭, অর্ডিনারিরা ১৫ নিশ্চিত। দু-ক্লাসের জ্যামিতির পঁয়ত্রিশটা উপপাদ্যের পনেরোটা করলে ১২ নম্বর ছাঁকা। দুটো কমন পাবেই। সম্পাদ্য মাত্র সাতটা, তার একটা আঁকতে হবে। হয়ে গেল আরও ছয়। ভালোরা ছাড়া একস্ট্রাগুলো পারবে না, তাই চার নম্বরের দুটো বাদ। অ্যালজেব্রায় পাঁচ রকমের উৎপাদক প্র্যাকটিস করাতে হবে, তিরিশটা অঙ্ক ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে। তিনটের মধ্যে যেকোনো দুটো। তিন তিন ছয় সিয়োর। তুলনামূলক, পরিবর্ত, অপনয়ন আর বজ্রগুণন শুনতে যত বিটকেল, করা ততই সহজ। অসমীকরণ সবার মাথায় ঢোকে না, ওটা গ্রাফের সঙ্গে অথবা থাকবে। গ্রাফ ভুল করা যায় না। তাহলে আরও ৬। অনুপাত-সমানুপাত ভালোদের কাছে জলভাত, মাঝারিরা পুরো নম্বর পাবে না। করণী সবাই পারে। অ্যালজেব্রায় প্রশ্নের অঙ্কের ৪ নম্বর নিয়ে সংশয় থাকবে। সেটা ছাড়লে ২১ নিরাপদ। পাটিগণিতে বড়ো অঙ্ক থাকবে। ৬+৬। শতকরা, সরল সুদ আর অংশীদারি কারবার করলে পেরে যাবে। ত্রিকোণমিতির হাইট অ্যান্ড ডিসটেন্সের অঙ্ক শক্ত। ওটা ভালোদের। পরিমিতিও ওদের। একটু বুঝলে ৮ মার্কস। ছক অনুযায়ী মাঝারিদের ৬৫-৭০ এবং ভালো ছাত্রদের ৮৫-৯০ সম্ভব। সুস্মিতার বিশ্বাস সাফল্য একমাত্র অনুশীলনে আসে। তাও তার ছক মেনে। নিজের ধারণাকে রূপ দেওয়ার জন্য সুস্মিতা সাত দফা নিয়মাবলি করল:
১. ছাত্রদের বাড়ি না যাওয়া, বিশেষ নিমন্ত্রণেও না।
২. অভিভাবকদের সঙ্গে রাস্তায় কথা না-বলা।
৩. বেডরুমে সবাই ব্যানড, প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীও না।
৪. মাসিক পরীক্ষায় ফেল করলে পড়ানো হবে না।
৫. উৎসবে আদিখ্যেতা চলবে না। যেমন, দোলের বিকেলে আবির চলতে পারে, কিন্তু পায়ে, তার ওপরে নয়।
৬. টিচার্স ডে-তে সবাইকে আসতে হবে, খাওয়াবে সুস্মিতা। গিফট আনা যাবে না। ফুল বা সস্তার পেন অ্যালাওড।
৭. প্রতিটা ছাত্র মাসে একদিন ক্লাস নেবে। দাঁড়িয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে। সে-দিন সুস্মিতাও স্টুডেন্ট।
এইসব নির্ভুলভাবে করার জন্য সুস্মিতা একটা স্টাইলিশ ও গম্ভীর চশমা কিনল ও.কে. অপটিক্যালস থেকে। সেক্স অ্যাপিল কমে এল সম্ভ্রমের পরশ। প্রথম বছরে সুস্মিতা মায়েদের আস্থা পেয়ে গেলও— না, মেয়েটা ভালো, বেটাছেলেগুলোই মেনিমুখো। দ্বিতীয় বছর সুস্মিতার কাছে লম্বা লাইন। অ্যাডমিশন টেস্ট দিতে হয় ভরতির জন্য। তৃতীয় বছর একটা এডুকেশন ওয়ার্কশপে শিক্ষার পদ্ধতিগত সমস্যা নিয়ে বক্তব্য রাখে দিদিমণি। চতুর্থ বছর রিজার্ভেশনের দীর্ঘ লাইনের পেছনে ম্যাডামকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্টেশনমাস্টার বলে, ‘‘আমার ঘরে বসুন, আমি কেটে দিচ্ছি।’’ সুস্মিতা বলে, ‘‘তা কী করে হয়, এত লোক সামনে, না-হয় একটু দাঁড়ালাম।’’ অভিভূত স্টেশনমাস্টার গলা তুলে ‘এই না হলে টিচার’ বলায় সবাই ঘুরে তাকায়। তখন সুস্মিতার আইডেন্টিটি এস্টাবিলস্ট। পঞ্চম বছরে সুস্মিতার পিরিয়ড ইরেগুলার হয়ে পড়ে অকালে। নদীনালার মতো এটাও কি অব্যবহারের ফলে অকালে বন্ধ হয়, এরকম সন্দেহের মধ্যে আঠারো দিনের মাথায় হয় ঢাকঢোল পিটিয়ে, কোমর-তলপেট ভেঙে পড়ে ব্যথায়, খুলে যায় ঋতু। পাঁচ বছরের মধ্যে সেই প্রথম ক্লাস বাতিল করে সুস্মিতা। সে-সন্ধ্যায় এক ছাত্রের মা আসে দেখা করতে। সাঁচিস্তূপের মতো চেহারা, কী করে যে নড়াচড়া করে! সুস্মিতার ভাবনার মাঝে মহিলা শুরু করে, ‘‘কিছু যদি মনে না কর, একটা কথা বলি।’’
— বলুন। মনে করলেই-বা কী।
— এবার তুমি একটা বিয়ে করো।
— অনেকেই তো করে না।
— সে না করুক, তা-বলে তুমি করবে না কেন? দেরি অনেকের একটু হয় বটে ... তবে, সময় যায়নি ... ওই যে কথায় আছে,
যে-নারীর পুরুষ নাই ...
— ‘‘অনেক মেয়ের থাকে না।’’ কড়া চোখে তাকায় সুস্মিতা।
— ‘‘ও-কথা থাক। এই ফোটোটা দেখো।’’ হ্যান্ডব্যাগ থেকে পোস্টকার্ড সাইজের ছবি বের করে পল্লবের মা।
সুস্মিতা দেখে পুরু গোঁফের এক যুবকের ছবি। স্টুডিয়োয় তোলা, পেছনে ঝুলছে গুলমার্গের বরফ। — ‘‘এ তো বাচ্চাছেলে। এই আমার পাত্র না কি?’’
— হ্যাঁ গো। ও মোটেই বাচ্চা নয়। আমার থেকে কত বড়ো, আমার বড়দা। এ তো এইটটি টু-র ছবি, যখন গ্র্যাজুয়েট হল, এখন টাক পড়ে গেছে। খুব ভালো লোক। তোমার চেয়েও বেশি টিউশনি করে, কলেজে পড়ায় তো। দোজবরে তোমার আপত্তি নেই তো।
সুস্মিতা হাসে। এইটটি টু-তে হরপ্রসাদ মারা যান, তখন সুস্মিতার সাত। সে ভাবতে চেষ্টা করে মানুষটাকে এখন কেমন দেখতে হয়েছে। এক টেকো প্রৌঢ় এক ঘরে পড়াচ্ছে, তার পাশের ঘরে আরও এক-ঘর ছাত্র পড়াচ্ছে সুস্মিতা এমন দৃশ্য মাথায় এল। এবং, বরের ছাত্ররা গোপন প্রেমের সাধু প্রস্তাব দিচ্ছে আর বাতিকগ্রস্ত বর তাতে পাগল হয়ে যাচ্ছে, এরকম পরিণতিও দেখতে পেল। কথা হচ্ছিল খোলা বারান্দায়। ফলস ঝাড়বাতির নীচে। সে বলে, ‘‘ছেলেকে বলবেন পড়ায় মন দিতে, এবার চেপে খাতা দেখা হবে।’’
— আর আমার কথাটা?
— কোন কথা?
— ওই যে দাদার ব্যাপারটা গো।
— ও হ্যাঁ, দাদাকে আমার প্রণাম জানাবেন। আমার হবে না।
সুস্মিতা উচ্চ-মাধ্যমিক শুরু করে পঁয়ত্রিশ পেরিয়ে। মাধ্যমিকের ঠিক পাঁচ বছর পর। শুরুতেই জানিয়ে দেয়, এখানে জয়েন্টের জন্য তৈরি করা হয় না। যারা পিয়োর সায়েন্স পড়তে চায়, বিশেষত, যারা অনার্স ও মাস্টার্স বা পরে রিসার্চ করতে চায়, প্রেফারেন্স দেওয়া হবে তাদের। আর, ভরতি হতে হবে ইলেভেনেই, টুয়েলভে নয়। এ-শর্তেও দুটো ব্যাচ ভরে গেল। ব্যাচে আট জন। নতুন শিক্ষার প্রথম মাসেই বিপর্যয়— বাবার সেরিব্রাল অ্যাটাক। এই অসুখটা সাধারণত বাথরুমে অপেক্ষা করে। ছেলেরা তখন পড়ছিল। কোণের ঘরের লাগোয়া বাথরুমে লোহার বালতির বিকট শব্দে সবাই চমকে ওঠে। দরজা ভেঙে বের করা হয় দেবপ্রসাদকে। ভাগ্যিস ইলেভেনের ছেলেরা একটু ম্যাচিয়োর হয়। দিদিমণির সঙ্গে তারা ছোটে নার্সিংহোমে। আর.এম.ও. বলে, ‘‘ক্রিটিকাল কেস, বড়ো হাসপাতালে যান, এখানে ডেলিভারি কেস হয়।’’ তখন অক্সিজেন আর স্যালাইন লাগিয়ে নামি হাসপাতালে। ডাক্তার বলে, বাহাত্তর ঘণ্টা না কাটলে বলা যাবে না। তার ডান হাতে ছিল সোনালি ঘড়ি। কেন একাত্তর বা তিয়াত্তর নয়? কেউ জানে না। একেই বোধ হয় আগেকার লোক বলত তেরাত্তির না পেরোলে বিশ্বাস নেই। চাঁদু ডাক্তার বিমর্ষ হয়ে গেল। সে তখন বাতের ব্যথায় কাবু। হাঁটু বেঁকে গেছে। সরাসরি এসেছিল গাড়ি নিয়ে। তার ধারণা, শেষ বন্ধুটা বোধ হয় গেল। কিন্তু দেবপ্রসাদ গেল না, ফিরে এল অংশত অসাড় ডান দিক আর জড়িয়ে যাওয়া জিভ নিয়ে। মামারা এসেছিল দেখতে, ‘‘মা তুই একদম একা হয়ে পড়লি, এবার চল।’’ শুনে সুস্মিতা সেবা শুরু করল। কেউ ভাবেনি সুস্মিতা এতকিছু করতে পারবে। ঘড়ি ধরে ওষুধ খাওয়ানো, রুটিনমাফিক চেক-আপ, দিনে দু-বার প্রেসার মাপা, ট্রেন্ড নার্স রেখে বাথরুমের কাজ বিছানায় করানো এবং শরীরের পরিবর্তন অনুসারে ডায়েট ও মেডিসিন নিয়ে ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান চাঁদুর পরামর্শ— দু-মাস চলবে এই শিডিউল। মাঝরাতেও উঠে উঠে দেখে পেশেন্ট ঠিক আছে কি না। দেবপ্রসাদ চেয়ে চেয়ে দেখে আর তার ঠোঁট ফুলে ওঠে, চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে চলে। সুস্মিতা মুখ ঝামটা দেয়, ‘‘বেশি ইমোশনাল হোয়ো না, সব বিগড়ে যাবে।’’ কিছু বিগড়োল না। ফেরার পনেরো দিনের মাথায় খুলে গেল কোচিং সেন্টার। দু-মাসের মাথায় শুরু হল পুরোদস্তুর ফিজিয়োথেরাপি। ছ-মাসের গোড়ায় একটু একটু করে সাড় ফিরে আসল পায়ে। চাঁদু ডাক্তার প্রায়ই আসত, ‘এই পুরোনো সিঁড়ি আর দুম্বো বাড়ি আমায় শেষ করে ফেলবে’ বলতে বলতে উঠত, তারপর ইজিচেয়ারে গ্যাস শেষ হওয়া টিউবলাইটের মতো বসে থাকত। পকেট থেকে পাঁইট বের করলে জল, গ্লাস আর স্যালাড পাঠিয়ে দিত সুস্মিতা। হুইস্কি খেতে খেতে সে স্বগতোক্তি করত— দেবুর কপাল ভালো। ভাগ্যিস থ্রম্বোসিস হয়েছিল, হেমারেজ হলেই কেল্লা ফতে। মেয়ের পুণ্যিতে বেঁচে গেল শালা। টাল খাওয়া জিভে দেবু কষ্টেসৃষ্টে কথা বলতে চাইত। ইজিচেয়ারের ফোল্ডিং হাতগুলোয় পা ছড়িয়ে ডাক্তার বলত, ‘‘এ-বয়সে বলার কিছু থাকে না, শোনারও না। বৃথা বাক্যব্যয়। তবু বেঁচে যে আছি এটা বেশ আনন্দের।’’ মরার বয়স দু-জনের মোটেই হয়নি, কিন্তু একজন কিছু না করে, অন্যজন যুক্তিগ্রাহ্য জগৎ ছেড়ে আধ্যাত্মিক যাত্রার পথের সংশয়ে বয়স বাড়িয়ে ফেলেছে। সার্ভিসিঙের অভাবে কলকবজাগুলোয় ছ্যাতলা পড়ে গেছে। ইজিচেয়ারটা তখন ছিল রোগীর ঘরে। ওয়াকার কেনা হতে সেটা ফিরে গেল পুরোনো জায়গায়। সাড় ফিরতে ওয়াকার ধরে ধরে দেবপ্রসাদও ফিরে গেল ইজিচেয়ারে। নাটকের সেই চেনা সেট– ইজিচেয়ার, আব্দারমাফিক তেপায়া টেবিলে দাবার বোর্ড আর খবরের কাগজ। দিনের আয়া বন্ধ করে রাতের জনকে খালি বহাল রাখা হল। সব যেন নিয়মে চলে। প্রেসার কমিয়ে রাখতে হবে। যেকোনো উত্তেজনা বিপজ্জনক, সেকেন্ড অ্যাটাকে মানুষ ফেরে না। খোলামেলা শান্তির পরিবেশ দরকার।— এই ক্যাসেটটা যে-দিনই আসে ডাক্তার বাজায়। সুস্মিতা বলে, ‘‘অশান্তি তো নেই। মন যদি পাকানো হয়, উৎপাত যদি ভেতরে থাকে, উপায় কী!’’ চাঁদু বলে, ‘‘এতই বোঝো তো বদলে যাও না কেন?’’ পেশেন্ট দু-জনের কথায় ঘাড় নাড়ে।
বাবার নড়বড়ে চলাফেরা শুরু হতেই সুস্মিতা পুরোনো ফর্মে ফিরে গেল। সে আবার কথা বন্ধ করে দিল। অদৃশ্য হল সব ক্ষমা। হাসিখুশি ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের জাগায় ফিরে এল এক কঠোর ব্যক্তিত্বময়ী রূঢ় মহিলা। দেখভালের দায়িত্ব রইল কাজের লোকদের ওপর। দেবপ্রসাদের অবশ্য কিছু বদল বরাবরের মতো হয়ে গেল। মস্তিষ্কের কোনো স্থায়ী পরিবর্তনে সে নরম শিশুর মতো হয়ে পড়ে। ভারসাম্য ছিল না একদম। যে আসত তাকে বলত, ‘‘তাড়াতাড়ি একটা পাত্র দেখো না ভাই।’’ আর, কঁাদত ঠোঁট ফুলিয়ে। কারণ লাগত না তার জন্য। দুধে খই কম কেন, খইয়ে ধানের খোসা কেন, ছেলেরা এখনও পড়তে এল না যে, কেন বৃষ্টি অসময়ে। শব্দ নেই, ট্রেন কোথায়— যেকোনো ছুতোয় তার কান্না পেত। অস্পষ্ট ঝাপসা চোখে চেয়ে থাকত দাবার দিকে। ঘুঁটি নড়ত না, তবু। সুস্মিতা সরকারি হাসপাতালের নিস্পৃহ ডাক্তারের মতো সে-দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিজের পুরোনো রুটিনটা ধরে ফেলল।
পুরোনো রুটিন বলতে ঘরে একা থাকা। ছাত্ররা চলে গেলে দিনরাতের নানা সময়ে দক্ষিণের জানালা দিয়ে রাস্তা দেখা, ভক্তদের দর্শন দেওয়া। রাতে পশ্চিমের খোলা জানালা দিয়ে ট্রেন দেখা, প্রেমিকের অপেক্ষায় থাকা। দুপুর বেলায় ফাঁকা রাস্তা দেখা। রোদ মেঘ পোস্টম্যান দেখা। ভিখারি, রেডিয়ো, পাখিদের শোনা। রোদের তাত, বৃষ্টির ছাট, শীতের আমেজ নেওয়া। আর টুকটাক বই পড়া। কখনো গল্পের, কখনো অঙ্কের। ভোর বেলাটা ইদানীং বদলে ফেলেছে সুস্মিতা। অন্ধকার ফুরোনোর আগে সে উঠে পড়ে। ছাদে চলে যায় প্লাস্টিকের মাদুর নিয়ে। শিশিরভেজা সুরকির ছাদে খালি পায়ে হাঁটে। শীতের সকালটা ওয়াটার কালারে আঁকা, কুয়াশার সমুদ্রে একা হারিয়ে যাওয়া জাহাজের মতো, একটু বিষণ্ণ। কাজ না হলেও বর্ষা পছন্দ করে সে। সাদা-কালো ছাই-ছাই আকাশের মাঝে নীলের ছিটে। ধুলোধোঁয়া কম। গাছপালা ঝুপ্পুস তাজা। ভিজে সব প্রাণী খুশি। ভিজে খুশি সুস্মিতা। বর্ষা শেষের পথে। দূরে ইটভাঁটার চিমনিগুলোর মুখে আটকে আছে আবছা ধোঁয়া, চিলেকোঠার সিঁড়িতে বসে দেখে সুস্মিতা। তাপমাত্রা ভেদাভেদ, হাওয়ার বিভিন্ন স্তর সে দেখে কেকের মতো কেটে কেটে। আগে এ-সময় কয়লার ভারী ইঞ্জিন যেত, উড়ে আসত গুঁড়ো কয়লা। কিছু রোমান্স আর আফ্রিকান লোকগায়কদের ভারী আওয়াজ নিয়ে তারা বিদায় নিয়েছে। তা এক বছর হল। এখন ঘরের জানালা ভোরে বন্ধ রাখতে হয় না। সুস্মিতা আলোর ক্রমশ ফুটে ওঠা দেখে। তারপর উঠে সিঁড়ির আলো নেভায়। পোশাক বদলায় চিলেকোঠার ঘরে ঢুকে। আগে উঁচু বাড়ি ছিল না আশপাশে। জানালা দরজা খুলেই শাড়ি ছাড়ত। ব্লাউজের ওপর চুড়িদার। কিছুদিন হল একশো মিটার দূরে পুকুরের ওই কোণে পাঁচতলা ফ্ল্যাট উঠেছে। নাম দিয়েছে ‘লেক প্যালেস’। তারপর তার নির্জনতা কমে গেছে। মাস খানেক হল সে বেশ অস্বস্তিতে আছে। যোগব্যায়াম করার সময় সে দেখে চারতলার ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে একটা ছেলে ঠায় চেয়ে থাকে। চোখাচুখি হলে জানালা ভেজিয়ে দেয়। তারপরও সুস্মিতা টের পায় ফাঁক দিয়ে ছেলেটা চেয়ে আছে। রোজ এক ঘটনা। অতদূর থেকে কী দেখে? বায়নাকুলার আছে? অথবা নেই। সুস্মিতা কয়েকটা আইটেম বাদ দেয়। যেমন সর্বাঙ্গাসন। কে ও? খোঁজ নিতে হবে, মাদুর গুটিয়ে নামার সময় ভাবে।
প্রায় বছর সাতেক টিউশনি করার পর সময়ের ফারাকটা টের পায় সুস্মিতা। ইন্টারনেট, ফেসবুক, ই-মেল এবং মোবাইলের কানাকানিতে ছেলেমেয়েরা অনেক চৌখস, বাইরের জগৎ জানে। ব্লু-ফিল্মের অভিজ্ঞতায় নগ্ন নারীশরীরের ছোঁকছাকানি কম। তবু, বয়সের কিছু আবেদন বোধ হয় মেলানোর নয়। লাইভ মহিলা দেখার উৎসাহ আর তাকে ঘিরে স্বপ্ন বোনার প্রবণতা একরকম রয়ে গেছে। কাঙ্ক্ষিত মহিলাকে এখনও তারা আড়চোখে দেখে, এখনও উশখুশ করে। নাইন-টেন শেপলেস, তবে রিপুর আলেয়ার ডাক তারা শুনেছে। ইলেভেন-টুয়েলভ কম্পিউটার স্যাভি হলেও তাদের ব্যক্তিগত মিথুনমন্দিরে সুস্মিতা আছে। দিদিমণি খাতায় ঝুঁকলে তারা উঁচু হয়, ক্লিভেজের শেষটুকু চায়। দিদিমণি বোর্ডে গেলে তারা বসে ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে দেখে কোমরের ওপরের খোলা অংশ ছাড়িয়ে স্তনের নীচের আভাস। কেউ কেউ পাছামনস্ক হলেও আধুনিক প্রযুক্তি স্তন্যপায়ীদের স্তনবিমুখ করতে পারেনি। সব দুগ্ধপোষ্য। মেয়েদের কেউ কেউ পূর্ণ যৌনতার স্বাদ পেয়েছে মনে হয়। সুস্মিতার কেমন নিজের ওপর করুণা হয়। সেও তো পারত এমন স্বাভাবিক হতে। মাংসল যৌনতা না পেয়েই কেটে গেল অনেকটা। কম বয়সের ইমেজ তার কাছে কাউকে যেতে দেয়নি। বেশি বয়সের ইমেজ তাকে কারোর কাছে যেতে দেয় না। তবু, মাঝে মাঝে সে বোঝে শরীর ইমেজের ধার ধারে না। সে তৈরি। বাঁশি বাজলেই হল। শুধু কানে শুনলে হবে না। মন চায় চোখে দেখতে, শরীর চায় স্পর্শ।
ইদানীং বিচিত্র সব দিকে মন ছুটছে। সুস্মিতা নিজেই বুঝতে পারে তার মধ্যে অজান্তে এমন রূপান্তর ঘটছে, যা সে আগে ভাবেনি। অন্যের গোপন কথা গোপনে জেনে নিতে ইচ্ছে হয়। ওপর থেকে ভাড়াটেদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। ঝগড়া শুনলে কান বাড়ায়। খাবার চালাচালি দেখে, কী থাকে মেনুতে? দুপুরে মাঝের ঘরের বিবাহযোগ্যা মেয়ে কার সঙ্গে কথা বলে? কে বাইরে থেকে হাত বাড়িয়ে তার ঠোঁট নেড়ে দেয়? এ-ঘরের জামাইয়ের নজর ও-ঘরের বউয়ের দিকে। রাস্তার অচেনা লোকের অপ্রস্তুত আচরণের অপ্রয়োজনীয় বিশ্লেষণ করে। বাবার আয়াকে মোটরসাইকেলে করে যে পৌঁছে দেয় সে তো অনেক ছোটো। নিজেকে দেখে সুস্মিতার বিস্ময় বেড়েই চলেছে। সে দেখে পোস্টম্যান ছাড়াও কত ক্যুরিয়ারের ছেলে চিঠি নিয়ে আসে। বেশ স্মার্ট হয়েছে ছেলেগুলো, সার্ভিসও ফাস্ট। গত কিছুদিন ধরে মৌসুমিদের বেশ চিঠি আসছে। কাজের মেয়ে জানিয়েছে। মৌসুমির ‘লাভ আছে, ছেলেটা ভালো নয় তাই চটপট চেষ্টা চলছে’। কাগজে বিয়ের খবর বেরিয়েছে। সুস্মিতা শোধরায় ‘খবর নয়, বিজ্ঞাপন’।
পরের ক-টা দিন সুস্মিতা খুব পাত্র-পাত্রী সংবাদ পড়ল। পুরোনো কাগজও। কত ধরনের মানুষের কত চাহিদা। বারো বছর আগে হলে নিরানব্বই শতাংশ চাহিদা সে মেটাতে পারত। এখন বড়োজোর দশ শতাংশ, বয়সে মার খাচ্ছে। তবু পড়তে পড়তে তার নেশা ধরে গেল। প্রথমে পড়ল রং দেওয়া বক্সগুলো। তারপর যেগুলোয় ছবি আছে। ছবিতে নিজেকে বসিয়ে দেখল বয়সটা না বললে ফরেনে প্রবাসীদের জন্য পারফেক্ট ম্যাচ। বয়স থাকলে কি সে করত, না কি এখনও সে করবে? সুস্মিতা জানে এ-খেলার মানে নেই, রাজি সে হত না। কক্ষনো না।
লোহার গেট খোলার শব্দে বিছানা থেকে মুখ বাড়ায় সুস্মিতা। দেখে পোস্টম্যান। আজ চিঠি এসেছে, অনেক দিন পর তার একতাড়া চিঠি। লেটারবক্সের গর্ত দিয়ে এক বারে ঢুকল না। ছোটো ছোটো গোছা করে ঢুকিয়ে লোকটা চলে যেতে সুস্মিতা নীচে নামে। ধীরে-সুস্থে চারপাশ দেখে। গেটের ভেতর ঘরোয়া বাগান হওয়ার পক্ষে অনেকটা জমি। লাইন দিয়ে ডুরান্ডার হেজ আর দুটো ঝাউ লাগিয়েছে মৌসুমির মা। অন্য ভাড়াটেরা সামনেটা ঢেকে ফেলেছে টগর, গন্ধরাজ, জবায়। এলোমেলোভাবে। হাওয়াই চটি পরে বাগানে পায়চারি করে সুস্মিতা, পুকুরপাড় অবধি যায়। আড়চোখে ঘরগুলোয় উঁকি মারে। আড়চোখে দেখে লেটারবক্স। অনেক দিন একসঙ্গে এত চিঠি আসেনি। কারা পাঠাল? উত্তেজনা হয় ভেবে। কিছুক্ষণ পরে চাবি ঘুরিয়ে চিঠিগুলো বের করে সে। সিঁড়িতে ওঠার সময় ঘাড় ঘোরাতে সে দেখে রাস্তার ওপারে গোলাপি স্কুটির ওপর থেকে ড্যাবড্যাব করে একটা ছেলে তাকিয়ে। চোখাচোখি হতে চমকে গাড়িতে স্টার্ট দেয় সে। কে এটা, এসব তো আঠারো-কুড়ি বছর আগে হত, আবার শুরু হচ্ছে নাকি, ভাবতে ভাবতে ওঠার সময় সুস্মিতার মনে হয়, হয়তো ভোর বেলার ফ্ল্যাটের সেই ছেলেটা। ব্যাটা বড্ড ছোটো। অতদূর থেকে ঠাওর হয় না, তবু মনে হচ্ছে ও-ই। খোঁজ নিতে হবে।
ঘরে গিয়ে মুষড়ে পড়ল সুস্মিতা। একটা চিঠিও তার নয়। সব কালীপদবাবুর। তার মানে মৌসুমির ম্যাট্রিমোনিয়াল বিজ্ঞাপনের উত্তর। ধ্যুস। মন খারাপ হয়ে যায়। ড্রেসিংটেবিলে তাড়াটা রেখে বিছানায় কাত হয়ে শোয়। কাগজ খুলে আরও পাত্র-পাত্রী সংবাদ পড়ে। দেশে কত মানুষ বিয়ের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে, বাপ রে! বার বার চোখ গেল চিঠিগুলোর দিকে। বিকেলেই দিয়ে আসতে হবে। কী লেখা থাকে চিঠিতে? অন্যের চিঠি দেখা অন্যায়। দুপুর গড়িয়ে বিকেলের কাছে যেতে মনে হল তার বাক্সে এসেছে তারই পড়ার জন্য, এতে অনৈতিক কিছু নেই। দেখলেই হয়। একসময় না-পেরে খুলে ফেলল। একে একে সতেরোটা। সবার ভার্সান মোটামুটি এক— দাবিদাওয়া নেই। সচ্ছল পরিবার। বাবা রিটায়ার্ড। ননদদের বিয়ে হয়ে গেছে। স্বক্ষেত্রে ভাইরা প্রতিষ্ঠিত। কেউ অন্য রাজ্যবাসী, কেউ কাছের। প্রকৃত সুন্দরী ও ইংরেজিতে দক্ষ মেয়ে জেনে তারা ইমপ্রেসড। সংস্কার ও রুচিতে এই পরিবারের সঙ্গে মিলবে বেশ। এগারো জন সঙ্গে ছবি পাঠিয়েছে। প্রাথমিক কথাবার্তার পর অভিভাবকদের অনুমতি নিয়ে মেয়ের সঙ্গে বাইরে আলাদা দেখা করতে চায় উদারপন্থীরা। সুস্মিতা দেখল, ননদের বিয়ে হয়ে যাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। মৌসুমি ফোটোজিনিক, তবে সুন্দরী নয়, তাই সামনাসামনি হলে কেঁচে যাবে। পড়তে পড়তে কৌতূহল উবে গেল। মনে হল, ইস্, মৌসুমির ক্ষতি করে ফেললাম। তারপর সে ভেবে ঠিক করে চিঠিগুলো আবার সে পোস্ট করবে। নতুন খামে ভরে ভিন্ন ভিন্ন শহর থেকে, একটা সময়ের গ্যাপে। দু-তিন দিনে আবার চিঠিগুলো ফিরে আসবে। খামের ওপর লেখাগুলো আঁকাবাঁকা করে দিতে হবে। কালি-কলম বদলে দিলে সন্দেহ হবে না। তা ছাড়া কন্যাদায়গ্রস্ত বাবার সময় কোথায় সন্দেহের। মোটামুটি সম্মানজনক একটা সমাধান জোটায় সুস্মিতার হালকা লাগল। সন্ধ্যে বেলা জানালায় দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে গিয়ে দেখে সেই ছেলেটা সিগারেট-মুখে চা-গুমটির পেছন থেকে উঁকি মারছে। আদলটা চেনা-চেনা লাগে খুব। কে? হোকগে যে খুশি। চিন্তার ব্যাপার একটাই, যেভাবে ছিঁনেজোঁকের মতো লেগে আছে ছোকরা, চিঠি ফেলার সময় না পিছু নেয়। নিলেই-বা কী। সুস্মিতা পড়াতে যায়, ছেলেরা এসে গেছে। তখন ঘর থেকে ওয়াকারে ভর দিয়ে ইজিচেয়ারের দিকে হাঁটে দেবপ্রসাদ। কোচিং ক্লাস শুরু হলেই হয়তো বোঝাতে চায় এখনও আমি আছি, মেয়ে একা নয়।
দু-জনে দু-জনকে পেরোয় নীরবে। দেবপ্রসাদ মুগ্ধ চোখে মেয়ের পড়ানো শুনবে, মেয়েকে দেখবে শশা-মুসুম্বির লো-ক্যালোরি টিফিন খেতে খেতে। সে-সময় লালা, সর্দি, অশ্রু গড়িয়ে পড়ে মুখ-নাক-চোখ দিয়ে। যেকোনো পাঠক্রিয়ায়। সরল সুদ, অপনয়ন, অংশীদারি কারবার কিংবা জ্যামিতির উপপাদ্যে। সবচেয়ে বেশি ইমোশনাল হয় বজ্রগুণনের অঙ্কে। তখন সে ফোঁপায়।
পরের তিন দিন সুস্মিতা চিঠিগুলো পোস্ট করল পরিকল্পনামতো। নিজের ঠিকানায়, কালীপদবাবুর নামে। দু-তিনটে স্টেশন ছেড়ে আলাদা আলাদা শহর থেকে। বাড়ির কাছেই এতগুলো শহর, অথচ সে আগে কখনো যায়নি। অচেনা বিদেশে ত্রস্ত অতিথির মতো ঘুরল। কোনান ডয়েল আর ক্রিস্টির সম্ভ্রান্ত অপরাধী গৃহকর্ত্রীর মতো চোখের কোণ দিয়ে চারপাশ দেখল, সবাইকে মনে হল অনুসরণকারী। বার বার ঘাড় ঘুরিয়ে ফাঁকা দেখে ডাকবাক্সে চিঠি ফেলল। এক বাক্সে নয়, আঞ্চলিক ছোটো কেন্দ্রগুলোয়। এক বাক্সে কেন নয়, তার যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর নেই। নিজের কাণ্ডে অবাক হল সে। তবু ঘোরের মধ্যে সন্দেহজনকভাবে কাজ করে গেল। পুরো সময়টা তার মনে হল অনেকে দেখেছে, এইবার ধরা পড়বে। ধরা সে পড়ল না। পর পর তিন দিন এক স্টেশন থেকে আর-এক স্টেশনে কখনো যায়নি সুস্মিতা। অপরাধবোধ থাকলেও এই সংক্ষিপ্ত অভিসার তার মধ্যে উত্তেজনা জাগাল। চেনা মানুষের মুখোমুখি হওয়ার আতঙ্ক জাগিয়েছিল নিষিদ্ধ উন্মাদনা। যদিও কাউকে জবাব দেওয়ার নেই, কেউ তা চাইবে না, সুস্মিতা ভালোভাবেই জানত। তবু নিষিদ্ধ উত্তেজনার আকর্ষণ মনোরম।
চিঠি পোস্ট করার পরের ক-টা দিন সুস্মিতা পোস্টম্যানের অপেক্ষায় রইল। এক-এক করে চিঠি আসে আর মুখে হাসি ফুটে ওঠে। পোস্টম্যান ঢুকলে সে প্রার্থনা করে— এ-বার যেন ঠিক বাক্সে পড়ে। তবু একটা চিঠি তার কাছে ফিরল। তালা খুলে বুক ফুলিয়ে ফেরত দিল সে, ‘‘মেশোমশাই আপনাদের চিঠি আমার বাক্সে এসেছে, নিন।’’
ছোটোখাটো কৌতূহল যত বাড়ছিল ভেতরে, বাহ্যত সুস্মিতা তত খোলামেলা হয়ে পড়তে থাকে। বুড়ো পাহাড়ের অটুট গাম্ভীর্যের ওপর কোমল ঘাসপালা গজাচ্ছিল। তার ফুরফুরে ভাবটা ছেলেদের মধ্যে সংক্রামিত হয়। সে-দিন পড়াতে গিয়ে দিদিমণি দেখে বোর্ডে খড়ি দিয়ে লেখা— বিন্দু টানলে রেখা হয়। নীচু ক্লাসের জ্যামিতিক সংজ্ঞা হলেও এ আসলে পুরোনো চুটকি, হিন্দি সিনেমার ভ্যাম্প ও নায়িকাকে নিয়ে। রেখা প্রথম দিকে বিন্দুর মতোই ভারী ছিল। পরে রূপ খোলে। দ্বিতীয় চুটকিটা ছিল, রেখা ভাঙলে বিন্দু হয়। এটা শরীর ভাঙার সংকেত। কলেজে খুব চলত এমন ইঙ্গিতপূর্ণ বিকৃতি। সুস্মিতা বোর্ডের দিকে তাকিয়ে ভাবে, কিছু জিনিস কখনো বদলায় না। তার খারাপ লাগে না। কমনীয় মুখে ডাস্টার দিয়ে সে বোর্ড মোছে। তারপর অঙ্কের প্রশ্ন লেখে টেন ইয়ার্স থেকে। লিখতে লিখতে তার মনে পড়ে আরও কাজ বাকি। আঠারো বছর ধরে ঘরের কোণে অস্পৃশ্য পড়ে আছে একবাক্স চিঠি। তার ড্রপবক্স, এবার সেটার ব্যবস্থা করতে হবে।
৬
মেঝেতে ড্রপবক্স উপুড় করে সুস্মিতা বুঝতে পারে বোকামি হয়েছে। জাল ছোড়ায় বহু বৃত্তে জলের ছড়িয়ে যাওয়ার মতো ঘরে ছড়িয়ে গেল আরশোলা আর পোকামাকড়। নানা মাপের। তাদের সক্রিয় আর না-ফোটা ডিমে ভরে গেল মেঝে। চিঠিগুলো বড়ো দুর্ঘটনার পর অনেক শরীরের একটা দলা-পাকানো একটি খামে পক্ব পিণ্ডে পরিণত হয়েছে। সুস্মিতা লক্ষ করে নিষ্প্রাণ বস্তুও কীভাবে সক্রিয় থাকে প্রাণের ছোঁয়ায়, অথবা অদৃশ্যে প্রাণ হয়তো বেড়ে ওঠে জড়ের প্রশ্রয়ে। বদ্ধ জিনিস বন্ধ থাকে না, সেও পৃথিবীর ক্ষয় ও পুনর্নির্মাণের প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকে। ফলে অধিকাংশ চিঠি নষ্ট হয়ে গেছে। আঠা লাগানো খাম কুরে কুরে খেয়েছে পোকারা। বাতাসের আদ্রর্তা এবং ভাঙা ডিমের রস, মৃতদের গলে যাওয়া শরীর আর তাদের মল-মূত্ৰ-ঘাম-বীর্যে চিঠিগুলো করুণভাবে স্যাঁৎসেঁতে হয়ে পড়েছে। হাত না দিলেই হত। এগুলো নিয়ে কী করা যায়। সুস্মিতার মাথায় এল চারটে স্বাদু কল্পনা।
১. ক্ষতবিক্ষত চিঠিগুলোয় অসংখ্য ঘুলঘুলি আর অনন্য জাফরি। জুড়ে কোলাজ বানালে বড়ো শহরের বাউন্ডুলে শিল্পীর কাজ মনে হবে। ফরাসি দেশে খুব হয়।
২. ঢিবির মাঝের অক্ষত চিঠির যা পরিমাণ, বড়োসড়ো একটা পাল বানানো যায় অনায়াসে। এরারুটের আঠায় জুড়ে জুড়ে। রোমাঞ্চকর এক দস্যুজাহাজে সেটা টাঙানো হবে। চাঁদের আলোয়, সূর্যের আলোয় রং বদলাবে তার। কখনো আগুন কখনো বরফ। সিনেমার মতো। মাস্তুলে বড়ো করে থাকবে সুস্মিতার কড়া একটা ছবি। দুটো হাড়ের গুণচিহ্নের ওপরে লেখা থাকবে ‘ডেঞ্জার’ অথবা ‘কাপিতান সুস্মিতা’। পোষা সি-গাল আর উড়ুক্কু মাছেরা লেখা পড়ার চেষ্টা করবে। সামুদ্রিক প্রাণীদের মোবাইল ওয়ার্কশপে, নিজস্ব নোটিশ বোর্ডে।
৩. চিঠিগুলো দিয়ে নানা ধরনের ঘুড়ি বানানো যায়। ছাত্রদের নিয়ে ছাদে বসে। ওয়ার্ক-এডুকেশন ক্লাস। করবে জাপানিদের মতো বিশাল ঘুড়ি। যেটা উড়তে উড়তে প্রেরকদের কাছে যাবে। ফুরফুরে বাতাসে বায়নাকুলার দিয়ে তারা অন্যদের লেখাগুলো পড়বে, কানাকানি করবে খবর। পুরোনো সম্পদ দেখে তারা কি আর একবার একঘেয়েমি ঝেড়ে ফেলতে চাইবে?
৪. ‘হেরিটেজ লেটারস’ নামে একটা ছিন্নপত্রাবলিসংগ্রহ (আক্ষরিক অর্থেই) প্রকাশ করলে লোকালে হিট হয়ে যাবে। যারা লিখেছিল তারা এবং ঝিম-ধরা সংসারে আলোড়ন তোলার জন্য তাদের বউরা নিশ্চয়ই কিনবে। প্রথম সংস্করণ প্রথম মাসে শেষ। দ্বিতীয় সংস্করণ বেরোবে না।
চারটে আনন্দের আজগুবি ভাবনাই বাতিল হল অতি রোমান্টিক ও অবাস্তব বলে। বরং মৌসুমির বিয়ের চিঠির মতো রি-পোস্ট করাটা সম্ভবপর বলে গ্রহণযোগ্য লাগল।
চামড়ার অসুখে তাদের পলেস্তারা-খসা বাড়িটার চতুর্দিক চুলকোয়, ভেতরবাইরে। রঙের মানুষ, পেস্ট কন্ট্রোল ছাড়া অন্তত দুটো খালি ট্রাক লাগবে সামাল দিতে। সুস্মিতা সিদ্ধান্ত নেয় সাফসুতরো করে এবার সব বদলে ফেলবে। আজ বোধ হয় সবারই সিদ্ধান্ত নেওয়ার দিন। নাকে রুমাল বেঁধে চিঠি ঝাড়ার সময় সুস্মিতা শুনতে পায় নীচ থেকে উঠে আসা মৌসুমির মায়ের চিরকালীন উচ্চকিত স্বগতোক্তি। সেও ক-টা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রথমত, কোনো পাত্রপক্ষকে আর বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হবে না। গাণ্ডেপিণ্ডে চপ-কাটলেট-মিষ্টি খেয়ে যায়, খবর দেয় না। শেষেরটা এক কাঠি বাড়া, বলে চা-কফি চলে না, হরলিক্স খায়। দ্বিতীয়ত, বাসন্তীকে আর কাজে রাখা যাবে না। তাকে বলা হয়েছিল ঠাকুরের বাসন-কোসন ধুতে, সে নারায়ণশিলা পর্যন্ত সাবানজলে ভিজিয়ে দিয়েছে। তৃতীয়টা ঠিক সিদ্ধান্ত নয়, অভিশাপ। ফি-বছর বিশ্বকর্মায় বাইরের বারান্দার আর পেছনের বাথরুমের আলো চুরি যায়। মিহি কাচে নাকি ভালো মাঞ্জা হয়। সুতরাং এ-বার সব ঘুড়িতে বাজ পড়ুক, সব লাটাই ভরে যাক উকুনে। দুটো কাজই অসম্ভব— বাজের পক্ষে টিপ করে ঘুড়িতে পড়া আর উকুনের পক্ষে খুসকিভরতি সুন্দর চুল ছেড়ে লাটাই খোঁজা। অবিশ্বাস্য হলেও মহিলা ক্রিয়েটিভ।
অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করে সুস্মিতা বুঝল নব্বই শতাংশ ফেলে দিতে হবে। ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে, অথবা প্রেরকের ঠিকানা নেই। এরা ঝুঁকিহীন খেলায় অংশ নিয়েছিল। বাকি দশ শতাংশের অর্ধেকে প্রেরকের নাম পর্যন্ত নেই। যা আছে তাকে না-থাকাই বলে। গালিভার, অরণ্যদেব, মজনু, ওথেলো, অমিত রে, উত্তমকুমার টাইপের ডামি সব। এমনকী বিদ্যাপতি এবং বড়ু চণ্ডীদাসও পাওয়া গেল। লিখে আর পাঠিয়েই তাদের যৌনতৃপ্তি হয়েছে। ঢিবির মাঝ থেকে বেশ কিছু অক্ষত চিঠি পাওয়া গেল, যার পরিমাণ কম নয়। সেগুলো দেখতে দেখতে সুস্মিতার শরীর ভরে ওঠে খুশিতে, সে ফুলে যায়, ওজনও বেড়ে যায়। ও মা, কত চেনা লোক! কত ছাত্রের বাবা-কাকা-দাদা-পিসে-মেসো এতদিন অবহেলায় কোন কোণে পড়েছিল। এত ডাকসাইটে অফিসার, দুঁদে উকিল, রিটায়ার্ড মস্তান, পুলিশকর্তা, ময়রা, ডাক্তার, গ্যাসের ডিলারের জীবন সে ছেয়ে ছিল! সব চিঠি ফেরত পাঠাবে সে। বিয়ের চিঠির মতো কোণে প্রজাপতি আটকানো থাকে, এমন ফুলতোলা খামে ভরে। সবাইকে পাওয়া যাবে না, অনেকে হয়তো বেঁচে নেই কিংবা ঠিকানা বদলে ফেলেছে। তাহলে তো বেওয়ারিশ চিঠির মতো ‘আনডেলিভার্ড’ বা ‘নট ফাউন্ড’ ছাপ মেরে কোথায় পড়ে থাকবে। চিঠিগুলোর অপেক্ষার দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হবে। তাতে বোঝা যাবে না কত টিকে আছে এখনও। সুস্মিতা ঠিক করে ‘হইতে’ লিখে নিজের ঠিকানা দেবে। পোস্ট করার চিঠিগুলো সরিয়ে রেখে বাতিলগুলো বস্তায় ভরে। আজই সে ডাকটিকিট কিনবে, আজই খামে ভরবে। চিঠিগুলো আজও যেন জীবন্ত হয়ে ওঠার আর্তি নিয়ে অপেক্ষায় শুয়ে আছে। কর্মপরায়ণ লোকগুলোর হৃদয়ে এতদিনে নিশ্চিত মরচে পড়ে গেছে। না কি সময়ের বিপরীতে হাঁটার ইচ্ছে উসকে উঠবে? লজ্জিত হওয়ার অবকাশ নেই, তারা তো জানেই না এতদিন তাদের চিঠি অপঠিত ছিল। বাতিল চিঠির বস্তা দেখে মনে হয় এসব ভিড়বাসে ফাঁকতালে শরীরে হাত দেওয়ার মতো, তার বেশি নয়। কিন্তু কেন সে পাঠাবে চিঠি? যদি কারো কাছে আহ্বান মনে হয়? হোক। সুস্মিতা কিছু চাইছে না, সে শুধু তাদের একটা সময়ের উন্মাদনা, স্বপ্ন, ছেলেমানুষি আর নির্বুদ্ধিতা ফিরিয়ে দিচ্ছে। সে তাদের বয়স ফিরিয়ে দিচ্ছে পত্রমর্মরের ধ্বনিতে। সুরঞ্জনের চিঠিগুলো নিয়ে কী করা যায়? সিভি-তে ঠিকানা ছিল, সে এখন কোথায় কে জানে। থাক তাড়ার মধ্যে, পরে ভাবা যাবে।
গোটা দোতলা ঘুরে সুস্মিতা বুঝতে পারে বাড়ি সাফ করা সোজা নয়। নির্মমভাবে আগে জিনিস বিদেয় করতে হবে। মানুষ যে কত অপ্রয়োজনীয় জিনিসের সঙ্গে জীবন কাটায়! মাঝের তালাবন্ধ দুটো ঘরে ঢুকে সুস্মিতার মনে হয় প্রাচীন ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির পরিত্যক্ত গোডাউনে ঢুকে পড়েছে। এ যেন মিউজিয়ামের স্টোররুম। কাজের মানুষগুলো সাপ্তাহিক ঝাড়পোছের নামে আসলে চেষ্টা করেছে জড়বস্তুকেও বিব্রত না করার। ঘণ্টা দুয়েকের চেষ্টায় সুস্মিতা শুধু দুটো তালিকা বানাতে পারল। স্মৃতিতে ভারাক্রান্ত জিনিসে মায়া দেখিয়ে লাভ নেই। স্মৃতি নিজেই যথেষ্ট ভারী জিনিস, তার অনুষঙ্গ বয়ে চলা আরও কঠিন। সুস্মিতার প্রথম তালিকায় স্থান পেল যেগুলো বিক্রির। যথা— বার্মাটিকের চারটে খাট। সাতটা নানা মাপের দেয়ালঘড়ি।
কাঁসা-পেতলের বাসন (অন্তত ৩০০ কেজি) যজ্ঞিবাড়ির অ্যালুমিনিয়ামের ডেকচি-গামলা-ঘড়া (১৫০ কেজি)। লোহার কড়াই, নৌকো, ড্রাম প্রচুর। তিনটে জামাকাপড় রাখার ডাবল ডোর আলমারি। ভারী লোহার সিন্দুক (৪ বাই ৩ বাই ৩ ফুট) একটা। ছ-জনের ওভাল শেপের ডিনার টেবিল। গদি ফেঁসে স্প্রিং বেরিয়ে যাওয়া সোফা-সেট দু-জোড়া। বারোটা লোহার চেয়ার, স্টাডি টেবিল, অফিস টেবিল। এবং ফুটবলের মাপের দুটো ছাল ছাড়ানো তামার তারের তাল। দ্বিতীয় তালিকাটা দানের, যার মধ্যে পড়ল— পুরোনো গদি-তোশক, কয়েকটা আলনা, গাড়ির ক্ষয়ে যাওয়া টায়ার-টিউব, কাঠের খড়ম, চাকা লাগানো ছিপ, ধানঝাড়াই মেশিন, খ্যাপলা জাল, পারা উঠে যাওয়া রট আয়রন ফ্রেমের আয়না, ডাম্বেল-বার্বেল, শ্যালোর টিউব ও বাঁশের মই। সবগুলোই সংখ্যায় একাধিক। এ ছাড়া ছুরি ও বাগানের কঁচি-বটি-কাস্তে-হেঁসোর জংধরা একটা বড়োসড়ো সম্ভার। মান্তুর মা ফাটা সোফায় বসতে গিয়ে পাছায় জোর গুঁতো খায়। তার যোনি থেকে ব্রহ্মতালু কেঁপে ওঠে। ধুলোর আস্তরণ সরিয়ে স্প্রিঙের সারির মাঝ থেকে বের করা হয় অক্ষত দুটো হুইস্কির বোতল। তার ওপর সাল-তারিখ দিয়ে মালিকের সই। দেবপ্রসাদের হাতের লেখা সুস্মিতা চেনে। দিনক্ষণ দেখে মেয়ে বোঝে কলেজজীবনের শেষসময়ে কেনা। দেবপ্রসাদের ইচ্ছে ছিল ব্যক্তিগত ব্রুয়ারি করার। কুঁড়েমিতে হয়নি। তবে কলেজ থেকে সে ঠিক করে কিছু বোতল প্রতিমাসে কিনে রেখে দেবে। বয়স মদের স্বাদ বাড়ায়। ২৫-৩০ বছর পর এক-এক করে খুলবে ভেবেছিল। তার প্রথম ও একমাত্র লট এটা। সময় যখন এল মনে নেই। এখন মনে পড়েও লাভ নেই। সুস্মিতা বোতলদুটো মুছে বাবার পাশে রাখে। দেবপ্রসাদের ইমোশনাল ফেজ সে-সময় তুঙ্গে। সে বোতলে হাত বোলায় সস্নেহে আর কাঁদে। বাবার দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে সুস্মিতার মনে হয় বাবা খুইয়ে সে একটা সন্তান পেয়েছে। যাক, শূন্য অবস্থার চেয়ে এও ভালো।
বাড়ি সাফাইয়ের প্রোজেক্টটা পিছিয়ে দিতে হল। লেবার পাওয়া সহজ নয়, বিশেষত বিশ্বকর্মার সময়। আপাতত তার মনও আকাশে উড়ে গেছে। ছোটোবেলার মতো ঘুড়ির প্যাঁচ দেখবে, বিপজ্জনক কার্নিশে কোণঠাসা ঘুড়িবাজ ছেলেদের বিশ্বস্ত জোগাড়ে হয়ে থাকবে। রাতে সে ঘুড়ি ওড়াল তারাভরা আকাশে এক-ছায়াপথ সুতো নিয়ে। বাবা লাটাই-কোলে বসে রইল। যদিও সে ঘুড়ি ওড়াতে পারে না, দেবপ্রসাদ সুতো গোটানো বা ছাড়ায় একদম আনাড়ি, তবু ভোর অবধি ঘুড়ি উড়ল দু-জনের।
নিয়মমাফিক অন্ধকার থাকতে ঘুম ভাঙল সুস্মিতার। যত ভোরে সে ওঠে, বিশ্বকর্মা ওঠে তার অনেক পরে। কলকারখানায় তার নাইটডিউটি থাকে। আজ বহু বছর পর ঘুড়ির ওড়াউড়ি, মেঘের লুকোচুরি আর ছেলেদের দিশেহারা ছুট দেখার জন্য মন উন্মুখ হয়ে আছে। বাঁশের লগি নিয়ে ইচ্ছে করছে ছোটোদের সঙ্গে ছুটতে। ছোটোবেলায় যা-যা পায়নি, করেনি— সব করতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু আকাশ আজ অংশত মেঘলা। সেপ্টেম্বরের এই সময় প্রতিবছর যে কেন বৃষ্টি হয়! সুস্মিতা রুটিন অনুযায়ী প্রাণায়াম ও যোগব্যায়াম করল। যথারীতি দূরের জানালা খুলে গেল। ছেলেটা তাকে দেখে চলল। চোখাচুখি হতে লজ্জা পেল, জানালা ভেজিয়ে দিল। আবার ফাঁক দিয়ে দেখা শুরু করল। এই-ই কাজ ছোকরার। সুস্মিতার ঝিঁঝি পোকার মতো অসহ্য লাগে। সে আকাশ দেখে। একটা-দুটো ঘাসফুলের মতো ঘুড়ি ফুটে ওঠে শূন্যের বাগানে। এবার মোমবাতি মার্কাই বেশি। সূর্য খুলল একটু দেরিতে। সূর্যেরও তাহলে মোমবাতি লাগে। ছাদে বসেই সে চা খেল। আর, বাটিচচ্চড়ি দিয়ে লুচি। কেটে আসা কয়েকটা ঘুড়ি ইট চাপা দিয়ে রংবেরঙের ধারালো সুতো গিঁট মেরে গোটাল। তারপর হরির লুঠের বাতাসার মতো ওপর থেকে ভাসিয়ে দিল। তাতেই সকাল কেটে রোদ চড়ে গেল।
দুপুরে ছাদে উঠে সুস্মিতা দেখে আকাশ আশ্চর্যরকম খালি। সূর্যের আঁচ নেই, আকাশের নীল ছেঁড়াফাটা, পরিবর্তে আছে ছাঁইমেঘ ছড়ানো-ছেটানো। ফাঁকে জেটপ্লেনের দীর্ঘ ধোঁয়ার রেখা, ছাড়া-ছাড়া। ধারালো সুতোর ভয়ে এ-সময় পাখিদের ওড়াউড়ি কমে যায়। একটা ছোটো পাখির দল ক্যালাইডোস্কোপে অনন্ত ডিজাইন বানাতে বানাতে ফিরছে। মেঘের অনেক নীচ দিয়ে, স্যাটেলাইট টাওয়ারের অনেক ওপর দিয়ে চলছে অবিরাম পরিবর্তনশীল ব্যূহরচনা। তারপর বড়ো বড়ো ফোঁটায় জল শুরু হল। সুস্মিতা মুখ আকাশের দিকে তুলে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে থাকে। পড়ুক জল। ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টি মুখে পড়ে ছিটকে ছড়িয়ে যায়। স্ফটিকে বিশ্লিষ্ট আলোকরশ্মির মতো। সুস্মিতার ভালো লাগে। ভিজতে ভিজতে সে ঠিক করে একটা সিফনের শাড়ি কিনবে। তাঁতের শাড়ি পরেই সে এতটা বড়ো হয়ে গেল, ফিনফিনে সিফন কখনো পরেনি। কত ছোটো কাজ যে বাকি থেকে যায়! সে আরও ঠিক করে বাবার জন্য একটা মোটা সোনালি পাড়ের ধুতি কিনবে দক্ষিণীদের ধাঁচে। যেটা লুঙ্গির মতো পেঁচিয়ে পরা যায়। খাবার সময় মাছের কাঁটাগুলোও বেছে দেবে এবার থেকে, বাবার আঙুলগুলো এখনও নরমাল হয়নি।
বৃষ্টি এল, বৃষ্টি গেল। সুস্মিতা ভিজল, শুকিয়ে গেল। ঘুড়ি নামল, আবার উঠল। অনেকটা সময় চলল এসব। বিকেল গড়াতে সুস্মিতা নীচে নেমে দেখে অভাবিত দৃশ্য। বাবার সামনে বসে সুরঞ্জন। যদিও আজ দু-জনে দাবা খেলছে না, তবু সেই মনে হয় ফিশার-স্প্যাসকি ক্লোজ-আপ। অবাক কাণ্ড, সুরঞ্জনের সময়ের চিঠির বাক্স খোলামাত্র সুরঞ্জনও ফিরে এল! পৃথিবীর কোন সুইচের কানেকশান যে কীসের সঙ্গে মানুষ জানে না। সুরঞ্জন মিষ্টি হাসে, ‘‘এই এলাম। কথা বলছিলাম মেশোমশাইয়ের সঙ্গে, উনি একইরকম আছেন সেই দাবা নিয়ে। কিছুদিন হল ফিরেছি। আর বাইরে যাব না।’’ সুস্মিতা উত্তর দেয় না। এত অন্তরঙ্গ কথা কেন। যেন অভিযাত্রী শৃঙ্গ জয় করে ঘরে ফিরেছে। আদিখ্যেতার সম্পর্ক তো নয়। সে যদি বাইরে যায় তার কী?
— ‘‘নিজের জায়গা ছেড়ে, বুঝলে, থাকা যায় না। নিজের দেশের কথাই আলাদা। অনেক ঘোরাঘুরি হয়েছে, পাগলের মতো ছোটাছুটির মানে হয় না। তোমরাই ভালো আছ।’’ ফর্মুলামাফিক ডায়ালগ দেয় সুরঞ্জন। ছকবাঁধা নস্টালজিয়া-আক্রান্ত গলায়। বিদেশফেরত দু-একটা লোক দেখেছে সুস্মিতা, সবার এক ধরনের স্ক্রিপ্ট— দেশের মাটি ... সোঁদা গন্ধ ... অলস শান্তি ... কাকিমার হাতের সুক্তো ... প্রবাসে তাঁতের শাড়ি ... বিসর্জনে সিঁদুরখেলা ... ইত্যাদি ইত্যাদি। শিকড়হীন যারা, তারাই বেশি বলে।
— ‘‘একটু বয়স বাড়লেও তুমি আগের মতোই আছ। সলিড, মাথা ঘোরানোর মতো।’’ আংশিক প্যারালিসিসের গার্জেনকে সে পোঁছে না। দেবপ্রসাদ বুঝি স্মৃতি হাতড়ে সুরঞ্জনকে খুঁজে পায় না, সেই কোন যুগে ক-মিনিটের দেখা। কে এটা? হবে কেউ। বেশি ভাবলে তার মাথা ঝিমঝিম করে।
সুস্মিতার কথা বলতে ইচ্ছে করে না। ‘‘বয়স কারো থেমে থাকে না’’, ‘‘বড়োদের সামনে কী বলতে নেই ভুলে গেছ’’, ‘‘চা খেলে পাঠিয়ে দিচ্ছি, আমার কাজ আছে’’— তিনটি সংক্ষিপ্ত বাক্যে পেছন ফিরে ঘরে ঢোকে। এতটা ঠান্ডা সুরঞ্জন আশা করেনি, সে যেন তার বাপের সম্পত্তি জমা রেখে গিয়েছিল। সে নাছোড়বান্দা, পিছু-পিছু ঘরে ঢোকে। সুস্মিতা ভ্রূ কোঁচকায়, অস্বস্তিকর পোকা ব্লাউজে ঢুকলে যেমন হয়। সুরঞ্জন এমন ভাব করে যেন কালই তো পাশে বসে সিনেমা দেখেছে। এ-জিনিস তো আমার, ব্যবহার করিনি এই যা। সুস্মিতার বিরক্তিকে সে পাত্তা দেয় না। অথবা বোঝে না। প্রফেশনাল অভিনেতার মতো সহজাত দক্ষতায় মঞ্চ ব্যবহার করে। জানালার ধারে যায়, সিগারেট ধরিয়ে পর্দা টেনে ‘‘লোকের এখনও তোমাকে নিয়ে খুব আগ্রহ। উঁকিঝুঁকি বন্ধ হয়নি দেখছি’’ বলে ধোঁয়া ছাড়ে। সুস্মিতা দেখতে থাকে কতদূর বাড়তে পারে এই ইজিগোয়িং অনুপ্রবেশকারী। এর চেয়ে সমর্পণকারী ন্যাকা প্রেমিকও ভালো, সে এখন বোঝে। দু-একবার শরীর ছুঁতে পারার দৌলতে যেন স্থায়ী লাইসেন্স পেয়ে যায় পুরুষরা। কেউ যদি চোখভরে খোলা বুক একবার দেখে ফেলে, দশ বছর পরও পাওয়ার দাবি থেকে যায়। আমার কাছে লজ্জার কী, সবই তো জানি, লুকোনোর আছেটা কী— ভাবটা এই ধরনের। দেখলেই সব জানা যায়? জানলেই সব চাওয়া যায়? না কি চাইলেই সব পাওয়া যায়? একবার শুলেই শোয়ার অধিকার জন্মায় না, বলে লাভ নেই, এদের বেসিক কনস্টিটিউশানটাই আলাদা— পুরুষ শরীরের ঊর্ধ্বে উঠতে পারে না। বহু দেশ ঘুরেও সে অশিক্ষিত থাকে গোড়ায়। সুস্মিতা চুপ করে বসে থাকে ড্রেসিং টুলে, সকালে গুছিয়ে রাখা চিঠির তাড়ার দিকে চোখ যায়, ওপরে দেখা যাচ্ছে সুরঞ্জনের অ্যাপ্লিকেশন ও রেজিগনেশন লেটার, দিয়ে দিলে হয়। সুরঞ্জনের হুঁশ নেই, হয়তো কোনোকালেই ছিল না, সামনের মানুষ সে দেখে না, বলে চলে, ‘‘পার্মানেন্টলিই চলে এলাম। এসে দেখি বাবার বাড়ির অবস্থা শোচনীয়। আত্মীয়স্বজন মিলে খিচুড়ি বানিয়ে রেখেছে। মায়া ছেড়ে ফ্ল্যাট কিনতে হল। তোমার বাড়ির কাছে। ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাট, তিন আর চারতলা মিলে, বড়ো শহরের পলিউশানে আর থাকব না ...’’ বলতে বলতে সুরঞ্জন সিগারেট ফুরিয়ে আসা হাত তোলে ফ্ল্যাটের দিকে। কৌতূহল হয় সুস্মিতার, পুরু পর্দার বাধা সত্ত্বেও গত এক মাসের সামান্য প্রহেলিকা স্পষ্ট হয়ে যায় তার কাছে— তর্জনীর দিশায় বোঝে সদা-অনুসরণকারী ছেলেটা তাহলে সুরঞ্জনের! আদল কেন চেনা-চেনা লাগছিল বুঝতে পারে। আর বোঝে এদের বংশ তার দাস হতে জন্মেছে। বাপ ও ছেলের শরীরের ডাক এক ধরনের, এক ধরনের মেয়ে তাদের পছন্দ। দু-জনের অ্যাপ্রোচ খালি আলাদা। প্রবলেমটা তাহলে জেনেটিক। সুরঞ্জন কত কী বলে চলে— কেরিয়ার গ্রাফ, ময়দার তালের মতো বউ, ছেলেকে প্রিন্সটন পাঠানোর স্বপ্ন— আরও কত কী। সুস্মিতা শোনে না। একসময় সুরঞ্জন থামে। শান্ত ঘরে বাইরের শব্দ ঢোকে। সুস্মিতা শোনে। ছুটির সন্ধ্যের আওয়াজ আলাদা। ভিড় পথের রথের মতো কোলাহলপূর্ণ, অভিযানের গল্পে মুখর। এবার সুস্মিতা প্রশ্ন করে, ‘‘ছেলের কোন ক্লাস?’’
— টুয়েলভ। ওর জন্যই তো আসা। অনেক দিন ঘুরঘুর করছে। তুমি নাকি ইলেভেন থেকে না হলে নাও না। নীলাঞ্জন তৈরি আছে, ব্যাচে ফিট করে যাবে।
— ‘‘না, আমার নিয়মে ফিট করবে না।’’ সুস্মিতা থামিয়ে দেয়।
— সবার সঙ্গে আমায় মিলিয়ো না। আমার ব্যাপারটা আলাদা।
— ‘‘কীসে আলাদা? কমবয়সে গায়ে হাত দিয়েছিলে বলে?’’ সুস্মিতা কথাগুলো বলে খুব শান্ত আর স্পষ্টভাবে। সে এত নিস্পৃহ যে, সুরঞ্জনের রেডিমেড স্ক্রিপ্ট পাল্লা দিতে পারে না। তার অসহায় লাগে। ঠোঁটের ডগায় থাকা আত্মবিশ্বাস উলটোপথে গলা বেয়ে সব অর্গান ভেদ করে গুহ্যে পৌঁছে গেছে মনে হয়। সুস্মিতা উপভোগ করে তা। সে ভালোই জানে নীলাঞ্জন পড়ার জন্য ঘুরঘুর করছে না। তার জিন, তার ডেস্টিনি তাকে পাঠিয়েছে। পড়াশুনা হবে না, আত্মরতির রসদ জুটিয়ে ফিরে যাবে খালি। সুরঞ্জন এতটা বোকা সে ভাবেনি।
সুরঞ্জন ছেলের পড়া নিয়ে ভাবিত নয়, সে জিততে চায়, বহু ব্যবহৃত অস্ত্র সে বের করে— ‘‘বুঝলে, জীবনটা বৃথাই নষ্ট হল দৌড়ে। শুধু কেরিয়ার আর উজ্জ্বল জিনিসের পেছনে ছুটে ক্লান্ত হয়ে গেছি।’’
— এ ছাড়া কী করার ছিল তোমার? বেশির ভাগ লোক ছুটেই বেড়ায়, এটাও বাঁচা। ঝামেলা হল, অনেক লোক সব পাওয়ার পর অন্য উপলব্ধি করে। আসলে করে না, মুখস্থ বলে। সব ফুরিয়ে যাবার পর আলতুফালতু কথা গভীরভাবে বলার চেষ্টা করে।
— ‘‘তুমি খুব বদলে গেছ। খুব কঠিন হয়ে গেছ। মানছি তখন তোমার সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছে, কেরিয়ার ফার্স্ট প্রায়োরিটি ছিল তখন ... উপায় কী ছিল বলো।’’ গলা ঘন করে ঘনিষ্ঠ স্বরে কথা বলে সুরঞ্জন। চেনা ফর্মুলা, যার শিরোনাম অনুতাপে সমর্পণ ও সুযোগসন্ধান।
— যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। তোমার সঙ্গে আমার হত না। তোমার স্মার্টনেসে ক-দিনে বিরক্ত হয়ে পড়তাম। ওসব বাইরের চালাকি।
সুরঞ্জন আর পারে না, অপমানবোধ বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে তখন। সে এগিয়ে হাত ধরে সুস্মিতার। সুস্মিতা অনভিজ্ঞতা সত্ত্বেও যেন জানত এটাই হবে। শুয়ে জেতা, করে দখল করার সরল অঙ্ক। কেউ যে কেন অন্যরকম হয় না। সুস্মিতার ঘৃণা হয়, তবু সে অ্যালাও করে— কতদূর আর করবে। ‘‘এখনও তোমায় দেখলে শরীর কেমন করে, রক্ত ছোটাছুটি করে’’ কানের কাছে গাঢ় স্বর শোনে সে, গরম হাওয়া লাগে গালে। সুস্মিতা মুখ তুলে দেখে সুরঞ্জনের চোখ ভারী, মুখ লাল। লোকটাকে অপছন্দ হলেও শরীর বলে, দেখোই-না একবার কী হয়, কখনো তো হয়নি। প্রেমে না হোক, ঘৃণায় হোক। বরখাস্তের চিঠি এখনও স্মৃতিতে উজ্জ্বল। সে দরজার দিকে তাকায়। ভেজানো আছে। থাক। এ-ঘরে তাকে না বলে কেউ আসবে না। ছেলেদেরও আজ ছুটি। সুরঞ্জন ভাবে সে ট্যুরিস্ট ভিসা পেয়ে গেছে। সে সংক্ষিপ্ত কনডাকটেড ট্যুর শুরু করে। কাঁধে হাত দিয়ে সুস্মিতাকে খাটে নিয়ে আসে। দ্বিধাবিভক্ত সুস্মিতা বাধা দেয় না। মন চায় না, শরীর তৈরি। সুস্মিতা চোখ বুজে বিছানায় হেলে পড়ে লম্বালম্বি। চোখ খুলতে ইচ্ছে হয় না। মনে হয় সুরঞ্জনের মুখ দেখলে সব কোষ বন্ধ হয়ে যাবে। তীব্র ভালো লাগা আর প্রবল খারাপ লাগার অদ্ভুত সহাবস্থান। অভিজ্ঞ হাতে শরীর ঘাঁটাঘাঁটি করে সুরঞ্জন। কিছু আগের নিস্পৃহ অবজ্ঞার হিসেব করে সে। চুম্বনের দিকে এগোতে বাধা পেল । সুস্মিতা শরীরের জেগে ওঠা অনুভব করে, সাড়া দেয়, সক্রিয় হয়। কিন্তু চুমুর বিপর্যয়ের কথা সে জানে। ভালোভাবেই জানে ঠোঁটের স্পর্শ সব নষ্ট করে ফেলবে। লালার সঙ্গে দুঃস্বপ্নের মতো ফিরে আসবে সেই পিঁপড়ে আর মৃতদেহ, অ্যাসিডের জ্বালা আর ডায়েরির খোলা পাতা। ছুটন্ত ট্রেন ও ঠাকুরদার মৃতদেহ সে মুখ ফিরিয়ে রাখে পাশে। কয়েক মিনিট পর তার কেমন যেন অস্বস্তি হয়। কিছু একটা চোরাস্রোতের মতো ঘটে চলেছে আড়ালে। স্তনে মুখ গুঁজে রাখা সুরঞ্জনের ঘাড়ের ওপর দিয়ে দেখে সে বাঁ-পা দিয়ে পুবের জানালার একটা কপাট খুলে দিচ্ছে। যে-জানালা কখনো খোলা হয় না। দেবপ্রসাদের জন্য যেন খুলে দিচ্ছে নরকের দরজা। এই অবস্থায়ও ষড়যন্ত্র, এর মাঝেও জেতা-হারা শোধ তোলা! এত অবাক কখনো হয়নি সুস্মিতা। হতবাক হয়ে যায় সে। শরীর সম্পূর্ণ নিভে যায় নিমেষে। ভাগ্যিস বিয়ে হয়নি। ইজিচেয়ারে স্থবির বাবাকে দেখাতে চায় মেয়ের আদুল পায়ে উড়ে আসা এক পুরুষের পা ঘষার দৃশ্য, দিতে চায় পূর্ণ যৌনতার সংকেত। উদাসীন সুস্মিতা লক্ষ করে সুরঞ্জনের শিকারপ্রণালী। সুরঞ্জন মুখ তোলে, ‘‘কী হল?’’ নিরাসক্ত ও নির্মম গলায় সুস্মিতা বলে, ‘‘যাও।’’ কয়েক মুহূর্ত নারীশরীরের ওপর ভুজঙ্গাসনে নির্বিষ ফণা তুলে হিসহিস করে ব্যর্থ পুরুষ। কী ঘটল বুঝতে না পারলেও সে বোঝে এটা চরম আদেশ। এখানেই ফুলস্টপ। সে সরে। সুস্মিতা শাড়ি নামিয়ে নিজেকে গোছগাছ করে। তারপর জানালাটা বন্ধ করে দেয়। সুরঞ্জন এবার মাথা নীচু করে। সে সাফাই দিতে চেষ্টা করে। সুস্মিতা তাকায় না, দরজার দিকে হাত দেখায়।
বাইরে বেরিয়েই সুরঞ্জনের অপরাধবোধ উবে গেল। সে যা করতে চেয়েছিল, কিছুটা করেছে। ধরা পড়বে ভাবেনি। যাক, হয়েছে তা হয়েছে। বুড়োটা খুব বড়ো বড়ো কথা বলেছিল। শালা যখের ধনের মতো এখনও আইবুড়ো মেয়ে আগলে রেখেছে। জুতো পরতে পরতে সে দেবপ্রসাদের দিকে চায়। চোখ বুজে কাত হয়ে শুয়ে আছে। ঠোঁটের কোণ দিয়ে সুতোর মতো গড়িয়ে নামছে চটচটে লালা। চোখের জল কিছুদূর এসে শুকিয়ে গেছে। মরে গেল না তো। নাকের খুব কাছে হাত নিয়ে যায়, শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে কি না বুঝতে চায়। সেকেন্ড অ্যাটাক হয়ে যায়নি তো। বুকের ওঠা-নামা বুঝতে পারল না। আধখোলা বোর্ডের দিকে তাকিয়ে তার মনে হয়, আঠারো বছর আগে হুবহু এই পজিশনেই ছিল ঘুঁটিগুলো। এই ভদ্রলোকের কাছে যেন সময় থমকে গেছে। কালো ঘোড়া তুলে সে চাল দেয়। একসঙ্গে ধরে রাজা ও মন্ত্রী। অন্য সাপোর্টও ঠিকঠাক। এ-গেম তার। দেখার জন্য দেবপ্রসাদ কি চোখ খুলবে? সুরঞ্জনের ভয় হয়। সিঁড়ি দিয়ে আলতো পায়ে নামতে নামতে সে বলে, ‘‘চেকমেট।’’
বিছানায় কতক্ষণ বসেছিল মনে নেই। বাইরে প্রকাশ না পেলেও বেশ দিশেহারা হয়ে পড়েছিল সুস্মিতা। শরীরের কলকবজা নিয়ন্ত্রণে ছিল না। খেলাটা মন্দ লাগছিল না, কিন্তু ছেলেটা এত নীচ, ভাবা যায়নি। পুরুষদের থেকে দূরে থেকে ভালোই ছিল তো। না-কামানো দাড়ির ঘষায় গলা-বুকে হালকা জ্বালা করছিল। তার অনুতাপ হয়। অস্বস্তি হয়, বাবার সামনে সে যাবে কী করে? তুমুল যৌনতা হলেও খারাপ লাগত না। কনসিভ করলেও না। কিন্তু এই ঘটনাটা তাকে খুব ছোটো করে দিয়েছে। অজান্তে সেও ষড়যন্ত্রের অংশীদার। বাবাকে বড্ড খাটো করা হয়ে গিয়েছে। সুরঞ্জনের চিঠিদুটো সে বের করে তাড়া থেকে, এক্সপায়ার্ড লিখে সরিয়ে রাখে। ওগুলো আর পাঠাতে হবে না।
বাথরুমে শাওয়ার খুলে অনেকক্ষণ চান করল সুস্মিতা, তারপর ফুলতোলা নরম ফুরফুরে ছাপার শাড়ি পরল। খোলা রাস্তায় হাঁটলে ভালো লাগতে পারে। শুয়ে থাকা দেবপ্রসাদকে সুস্মিতা পেরোল মাথা নীচু করে, প্রায় চোখ বুজে। সিঁড়ির মাঝের ধাপ থেকে এক লহমায় দেখে নিল বাবা ঘুমের দেশে। ইশারায় কাজের মেয়েটাকে ডেকে বলল, জাগলে খাবার দিয়ো। মশা মারার ধূপ দিয়ে দাও এখনই। নিজের গলা নিজের কানে কেমন কৈফিয়তের মতো অপ্রস্তুত শোনাল।
দফায় দফায় বৃষ্টি হয়ে রাস্তা পরিষ্কার হয়ে গেছে। ছুটির সন্ধ্যেয় জমে ওঠা আড্ডা দানা বাঁধছে পথে পথে। ইলেকট্রিক তার, শহিদস্তম্ভ, কবুতরের লগি, নারকোল গাছ আর সব
খোঁচা-খোঁচা উঁচু স্ট্রাকচার থেকে ঝুলছে ভেজা ছেঁড়া ঘুড়ি। সেসবের নীচ দিয়ে অনেকক্ষণ এলোমেলো ঘুরল সুস্মিতা। বড়ো রাস্তা ছেড়ে অলিগলিতে। সে বুঝতে পারল পেছনে কোথাও আছে নীলাঞ্জন, পিছু তাকে নিতেই হবে। মেয়েরা এসব টের পায়। কত দূরে আছে ভাবার চেষ্টা করল। মনে হল পেছন ফিরলেই ধরা পড়ে যাবে, পালানোর পথ পাবে না। দরকার নেই। দেখুক। ছেলেটাকে নিয়ে খেলা করার ইচ্ছে হয়। আগে সে কখনো খেলেনি, খেলায়নি বটে, তবে পারবে নিশ্চিত। মেয়েদের জন্মগত কিছু গুপ্তবিদ্যা কি তার মধ্যে নেই? আছে, নিশ্চয়ই আছে। এ-ছোকরাকে বিপর্যস্ত করে তোলার পক্ষে যথেষ্ট। যা এর বাবাকে করে তুলবে বিপন্ন। কাঙ্ক্ষিত শাস্তির পথ দেখতে পায় সে, নিজের শান্তির উপায়ও। সে হাঁটে ধীরে ধীরে, ভাবতে ভাবতে হাঁটে। একবার মনে হয়, কখনো না-খেলা এ-খেলার রহস্যময় বাঁকগুলোয় যদি হারিয়ে যায়? না, কিছুই হবে না। মেয়েরা যেকোনো পরিস্থিতির সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করতে পারে, প্রবাদেই প্রতিষ্ঠিত। হাঁটতে হাঁটতে সুস্মিতা মোরাম বিছানো গাছে ছাওয়া রাস্তায় পড়ে, এ-পথে আগে আসেনি, নতুন কোথাও বেড়াতে এসেছে মনে হয়। আর মনে পড়ে যায় ছোটোবেলায় সাপ ধরতে আসা এক বাচ্চা বেদের কথা। বাড়ি ভরে গিয়েছিল আগাছায়, আকন্দ-ফণীমনসার জঙ্গল আর ঘাসফুলের ঝোপে। পাগড়ি-পরা একটা কমবয়সি ছেলে এসেছিল সাপুড়ের বাঁশি আর শুকিয়ে যাওয়া কিছু শিকড়বাকড় নিয়ে। কঁাধের ঝোলা থেকে কয়েকটা ফণা তোলা সাপ বের করে দেখিয়ে বলেছিল, যতক্ষণ এই জড়িবুটি আর বিষহরির মন্ত্র সঙ্গে আছে সাপের সাধ্যি নেই কিছু করে। প্রমাণস্বরূপ সাপের মাথায় সে শিকড় ধরে, ফণা গুটিয়ে সেটা নেতিয়ে যায়। তখন তাকে অনুমতি দেওয়া হয় ধরার। সাপ সে ধরেনি, সাপই তাকে ধরেছিল। চার ফুটের একটা চন্দ্রবোড়া পায়ে কামড়ে ঝোপে মিলিয়ে যায়। অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতাল যাওয়ার পথে গ্যাঁজলা তুলতে তুলতে ছেলেটা জানায় সেটাই তার প্রথম একক আউটডোর প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস। ‘‘— সে কী, আগে কখনো ধরিসনি?’’ ‘‘ধরেছি, বাড়িতে, ওগুলোয় বিষ থাকে না।’’ ‘‘কোন সাহসে এলি? এখন ভালোমন্দ কিছু ঘটলে?’’— ‘‘বেদের ছেলেকে এসব শিখতে হয় নাকি?’’ ছেলেটাকে বাঁচানো যায়নি। সুস্মিতার মনে হয়, বেদের ছেলে হলেই হয় না, বিপদের মধ্যে হাতে-কলমে শিখতে হয়। মেয়ে হলেই হয় না, চর্চা লাগে। গুরুমুখী চর্চা। তা ছাড়া, সে কতদূর মেয়ে, তা নিয়েই সন্দেহ হয়। এই নতুন খেলা বুমেরাং হয়ে যাবে না তো। সুরঞ্জনকে মনে পড়ে তার। সে ঠিক করে, করবে। শেষ অবধি করবে।
বড়ো দোকানে ঢুকে দুপুরের পরিকল্পনামতো কালো শেডের সিফনের শাড়ি আর পুরু সোনালি পাড়ের ধুতি কিনে আবার হাঁটা শুরু করে সুস্মিতা। সরু-মোটা, চ্যাপটা-লম্বা না দেখা গলিরাস্তা দিয়ে। হাতের কাছে কত অনাবিষ্কৃত জায়গা। লাস্যময় রতিক্লান্ত মেজাজে সে হাঁটে। ভালোভাবেই বোঝে নীলাঞ্জন পিছু ছাড়েনি। তার নাকের পাটা ফুলে উঠেছে, রেসের ঘোড়ার মতো গরম হাওয়া বেরোচ্ছে। সে ফুলে গেছে, সব দিকে বেড়ে উঠছে।
অনেকক্ষণ চলে খেলার প্রথম ভাগ। একবার পিছু না ফিরেও সুস্মিতার নিশ্চিত বোধ হয়, যখন মনে হয় ফার্স্ট পেপারে পাশ করেছে বাড়ির দিকে এগোয়। গেটের নীচে পৌঁছে থামে সে। বুড়ো বোগেনভেলিয়াটা শেষজীবনের ফুলগুলো নিয়ে ঝুলে আছে, ঝুঁকে পড়েছে। থোকা থোকা গন্ধহীন ফুল সুস্মিতার মাথায় ঠেকছিল। আঠারো বছর আগে এখানেই সিভি দিয়েছিল সুরঞ্জন, এক গরমে পোড়া বৃহস্পতিবারে। এবার আচমকা ঘুরে দাঁড়ায় সুস্মিতা। রাস্তার ওপারে রেসিং সাইকেলের ওপর চমকায় সুরঞ্জনের ছেলে। সুস্মিতা তাকে সোজা দেখে। বয়সে হাজার মাইল কম, কামনায় বাবার হাজার মাইল এগিয়ে। ঠিক করে, নিয়ম ভেঙে একে কোচিঙে নেবেই। সুস্মিতার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। বিনা অনুশীলনে অনায়াসে বসন্তসেনা হয়ে ওঠে কীভাবে। নীলাঞ্জন নামে স্ট্যাচুকে সে আর দেখে না। সিঁড়ির দিকে ঘোরে, নিতম্বের ওপর থেকে অবহেলায় আঁচল সরিয়ে।
সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় নিজেকে হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালি মনে হয় সুস্মিতার। এতদিন সে বাজায়নি, এই যা। বাঁশি তো শরীরেই আছে। যথাস্থানে বাতাস দরকার। তা হয়তো আজকের পর নিজেই পারবে। এক সন্ধ্যায় সে অনেক শিখেছে। সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছে সুস্মিতার এতক্ষণের অর্জিত আত্মবিশ্বাস ভেঙে পড়ল। তার পা মেঝেতে আটকে গেল। গোটা বাড়ি ধুলো হয়ে মাটিতে মিশে যেতে চাইছে। ইজিচেয়ারে নিশ্চল দেবপ্রসাদকে সে লক্ষ করে না। তার চোখ প্রথমে যায় দাবা বোর্ডের পাশে পড়ে থাকা একটা চওড়া খোলা ডায়েরির দিকে। টেবিল ফ্যানের হাওয়ায় যার পাতাগুলো উড়ে যেতে চাইছিল। ডায়েরি লিখতে বাবাকে সে কখনো দেখেনি। এমনকী, অসুখের সময় বাবার ঘরে গিয়েও কোনো ডায়েরি নজরে আসেনি। ব্যাঙ্ক, ডাকঘর, ভাড়ার রসিদ আর বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া কিছু কোম্পানির শেয়ারের কাগজপত্তর ছাড়া লেখালেখির ধারেকাছে দেখা যায়নি বাবাকে। তাহলে? ডায়েরি কোথা থেকে এল বা কীভাবে এল এগুলো কোনো প্রশ্ন নয়। ঘটনা হল ডায়েরি এসে গেছে। সুস্মিতা জানে এ-অবস্থায় ডায়েরি একা আসে না। মৃত্যুর খুব কাছাকাছি থাকে ডায়েরি। মুহূর্তগুলো তার চেনা। শিরদাঁড়া দিয়ে সব রক্ত নেমে যায় মেঝে ফুঁড়ে পৃথিবীর পেটে। বাবার দিকে তাকাতে তার ভয় করে। ঘটনার অনিবার্যতাকে মেনে নেওয়ার অবকাশ খোঁজে সে। অথবা, যদি এই ফাঁকে নড়েচড়ে ওঠে দেবপ্রসাদ। তিনটে ডায়েরি, তিনটে মৃত্যু— নীরস জীবন এত নাটকীয় হবে কেন? শুকিয়ে যাওয়া লালার ওপর উড়তে থাকা মাছির দিকে না তাকিয়ে সুস্মিতা সোজা হাঁটে বুড়ো কচ্ছপের মতো। পড়ানোর জায়গায় পৌঁছে সে শতরঞ্জির ওপর বসে। হাঁটুতে মুখ গুঁজে থাকে কিছু সময়। কাঁদে না। শূন্য মনে বসে থাকে। বাবাকে ঠেলাঠেলি করে লাভ নেই। বেঁচে থাকলে যখন হোক উঠবে। না-হলে কিছু করার নেই। ডায়েরি পড়ার কৌতূহল হয় না। পরে ঢের সময় পাওয়া যাবে। অনেকক্ষণ পরে সে ওঠে। একে একে বারান্দার সব আলো জ্বালে। তাড়া করে না। রাস্তার দিকের রেলিঙে হেলান দিয়ে ঝিরঝিরে বৃষ্টি দেখে। কাঁদুনে আকাশে সব তারা চাপা পড়ে আছে। সুস্মিতার তাড়া নেই। ধীরে ধীরে একটা খড়ি নিয়ে সে বোর্ডে যায়। তারপর লিখতে শুরু করে— বিন্দু টানলে রেখা হয়। একটা রেখা অনন্ত বিন্দুর যোগফল। কিন্তু, কিছু কিছু অস্থির বিন্দু অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই প্রক্রিয়ার বাইরে থেকে যায়। অন্য বিন্দুদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক হয় না। প্রাণহীন একক নক্ষত্রের মতো তারা থেকে যায় নিঃসঙ্গ ও অব্যবহৃত। বহু আলোকবর্ষ দূর থেকে তারা অন্য নক্ষত্রবিন্দুগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে যোগসূত্রের আশায়। লিখতে লিখতে সুস্মিতা বুঝতে পারে অজান্তে সে-ও অটোবায়োগ্রাফির ভূমিকা লিখতে শুরু করেছে। বাঁ-দিকে ফিরে বাবার দিকে তাকায়। কত দূরে মহাশূন্যে ভাসমান নক্ষত্রের মতো লাগে। যে যত দূরে যায় তাকে তত কাছের মনে হয়। মনে হয় বাবার ডায়েরিটা অ্যালুমিনিয়ামের ট্রাঙ্কে রাখতে হবে অন্য দুই বিন্দুর সঙ্গে। আর মনে হয়, এবার তাকেও একটা ডায়েরি কিনতে হবে। ডাস্টার দিয়ে বোর্ডের লেখা সে মুছে দেয়।
লেখক পরিচিতি
ভিক্টর ভৌমিক
পশ্চিমবঙ্গের চন্দননগরে থাকেন।
কথাসাহিত্যিক।
জন্ম ১৯৬১।
1 মন্তব্যসমূহ