বারোয়ারিতলায় পা দিতেই আমার মনে হল, ছেলেগুলো মেয়েটার পিছু নিয়েছে। সন্দেহর শুরু ‘রকি’ সিনেমার মোড় থেকে। তখন আমি ছিলাম ওদের পেছনে। ছেলে তিনটে সিগারেট কিনছিল। আর আড়ে আড়ে রাস্তার দিকে নজর রাখছিল। মেয়েটা ওদের ক্রস করতেই তিনজনার চোখে চোখে একটা ইশারা খেলে গেল। কোনরকমে আগুনটা নিয়েই পা চালাল ওরা।
বড় রাস্তা ধরে মিনিট খানেক এগোলেই বাঁ হাতে একটা গলি। আরও হাত দশেক ওই গলি ধরে হাঁটলে বারোয়ারিতলা। তারপর প্রগতি সঙ্ঘের মাঠ। এখন লোডশেডিং। ভটভট করে বাজার কমিটির জেনারেটর চলছে। গলির ভেতর তেমন দোকানপাট না থাকায় সেখানে এক টুকরো অন্ধকার জমে আছে। মেয়েটা সরাসরি সেই অন্ধাকারে মিলিয়ে গেল। ছেলে তিনটে একটু থমকাল। ঠিক তখনই আমি ওদের অতিক্রম করলাম।
আমার হাতে একটা তিন ব্যাটারির টর্চ। ব্যাটারিগুলো একটু পুরন। জ্বাললাম। হলুদ রঙের ম্যাটম্যাটে একটা আলো ছড়িয়ে পড়ল রাস্তা জুড়ে। সামনে হাত দশেক দূরে হাঁটছে মেয়েটা।
বারোয়ারিতলায় রোজ একটা প্রদীপ দিয়ে যায় কেউ। ওটাই আপাতত শেষ আলো। এরপর গাঢ় অন্ধকারে শুয়ে আছে প্রগতি সঙ্ঘের মাঠ। মাঠটা বেশ বড়। লীগ খেলা হয়। সন্ধের পর কিছু ছেলেমেয়ে জোড়ায় জোড়ায় বসে। ঘনিষ্ঠ হয়। এসব আমাদের, মানে, স্থানীয় অধিবাসীদের গা-সওয়া হয়ে গেছে আজকাল।
কিন্তু এখন, এই অগাস্টের মাঝামাঝি, কয়েক পশলা ভারি ধরণের বৃষ্টি হওয়ায় মাঠের প্রায় সবখানেই জলকাদা। ফলে ডায়াগোনালি যে পায়েচলা পথটা ধরে আমরা সারা বছর মাঠ পার হই সেটা এখন পরিত্যক্ত। সাইড লাইন বরাবর ঘুরপথে লোকজনের যাতায়াত চলছে। অথচ, এই অন্ধকারে, মেয়েটা কর্নার পয়েন্ট পার হয়ে জলকাদা ভরা মাঠের মাঝখানেই নামল!
আমি একটু থমকালাম। পেছনে তাকালাম। ছেলে তিনটে গলি বেয়ে এগিয়ে আসছে। সিগারেটের নীলচে ধোঁয়ার মেঘের ওপর পেছন থেকে রাস্তার আলো এসে পড়েছে। নীল সাদা পটভূমিকায় তিনটে সিলুট ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। আমার মন, কেন জানিনা, একটা কূ- ডাক দিল।
টর্চ জ্বাললাম। সামনেই মেয়েটা, শাড়ি মুঠোয় ধরে একটু উঁচু করে নিয়ে এগোচ্ছে। মাঠের গর্ভে নেমে যাচ্ছে ক্রমশ। গতি শ্লথ। কোনও খারাপ মতলব নেই তো?
একটু আনমনা হয়ে পড়লাম। ভাবছি কোন পথে আমি যাব। বয়েস হয়েছে। কাদা কাদা মাঠ। যদিও পায়ে একটা ভাল দামী স্পোর্টস শু আমার। জিনিসটা জব্বর। আমেরিকা থেকে জামাই পাঠিয়েছে। হালকা জলকাদা একদম জব্দ। মেয়েটা ঠিক এই অবস্থায় সামনে না থাকলে আমিও হয়ত ডায়াগনালিই মাঠ পার হতাম। কিন্তু এখন কি তা উচিৎ হবে?
ভাবতে না ভাবতেই পেছন থেকে একটা হেঁড়ে গলা ভেসে এল,
-কী অন্ধকার গুরু। মাল হড়কে গেলে টের পাব কী করে?
মাল? কে মাল? সমানের মেয়েটা? নাকি ওটা মুদ্রাদোষ? হড়কে যাওয়া বলতে কী বোঝাতে চাইল ওরা?
পেছনে তাকালাম। কর্নার পয়েন্টের কাছে তিনটে লাল বিন্দু ভেসে বেড়াচ্ছে। বিন্দু তিনটে কাছাকাছি এল। চাপা স্বরের আদান প্রদান হল। তারপর জলকাদা ভরা মাঠে নেমে এল ওরা। আমাদের পেছন পেছন।
আমি টর্চটা আর জ্বালছি না। কিছুটা আন্দাজে এবং অভ্যাসে এগিয়ে চলেছি। পায়ের নিচে মাটি একটু একটু করে স্লিপ কাটছে। হঠাত পেছন থেকে হেঁড়ে গলা আবার হেঁকে উঠল,
-কী কাদা মাইরি !
সন্তর্পণে ঘাড় ঘোরালাম। আলোর পটভূমি আরও ক্ষীণ এখন। ওদের একজন পড়েই যাচ্ছিল। ওকে ধরতে গিয়ে তিনটে ছায়া জটলা পাকিয়ে গেল। ভেসে এল তীক্ষ্ণ সিটির আওয়াজ।
চমকে গিয়ে টর্চ জ্বালতেই দেখতাম সামনে, মেয়েটা চলার গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। শাড়ি ছেড়ে দিয়ে হনহন করে হাঁটছে। সপসপ শব্দ তুলে ভিজছে নিচটা। ভ্রূক্ষেপ নেই ।
মাঠে নামলেই আমার পা এখনও চুল্কে ওঠে। কেমন সুন্দর মাঠ। একটু পেছল, সেন্টার লাইনের কাছে একটু জল ছলছল করছে। ওই জলটুকু ছিল গোরাদের অভিশাপ আর আমাদের আশীর্বাদ।
তখনও আমরা খালি পা, ওদের বুট। দরকার হলে আঙুল দিয়ে মাটি খামচে তাল রাখতে পারি। বুটে সেই সুযোগ নেই। দমাদ্দম আছাড় খেত ওরা।
ক্ষিতীশদা অবশ্য বলত, সরাসরি কনফ্রন্টেশন এড়িয়ে যাবি সব সময়। ওদের ওজন অনেক বেশি। ডজ করবিনা একদম। শর্ট পাসে খেল। দরকারে সামান্য ড্রিবলিং। বুঝলি?
ক্ষিতীশদার কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতাম আমরা। ভোরবেলা এক ঘণ্টা ফিজিক্যাল ফিটনেস। বিকেলে দু ঘণ্টা প্র্যাকটিস। সঙ্গে ছোলা গুড় কলা । আর একটা জিনিসকে খুব গুরুত্ব দিত ক্ষিতীশদা—চরিত্র। বলত বিবেকানন্দ বলেছেন, গীতা পড়ার চেয়ে ফুটবল খেলা অনেক ভাল। উনিও খেলতেন নিয়মিত, টাউন ক্লাবে। আগে যার নাম ছিল ওরিয়েন্টাল ক্লাব।
জিতলে শিশুর মত আনন্দ পেতেন ক্ষিতীশদা।
কোথায় গেল সেই সব দিন। যুদ্ধের পর এল মন্দা। চাকরি নিলাম পেটের দায়ে, পোর্ট কমিশনারে। পেয়েছিলাম ওই খেলারই সুবাদে। ডীক্সন সাহেব, চেয়ারম্যান, সিলেক্ট করলেন আমাকে। কিন্তু খেলতে আর দিলেন কই। সারাদিন কাজ আর কাজ। ঘাড় গোঁজা মাছি মারা কেরানির জীবন।
তবু টানটা থেকেই গেল। আজও সিটি শুনলে প্রথমেই আনন্দের সঙ্কেত বলে মনে হয়। এখন সিটির মানে সম্পূর্ণ আলাদা। এও খেলা , তবে অন্য রকম।
ছেলে তিনটে আমার অচেনা। তবে এক পলকে যেটুকু দেখেছি , মনে হল, মেয়েটা ওপারের ‘হঠাত কলোনি’র। ওখানকার অনেক মেয়েই আজকাল দুপুরের দিকে সাজগোজ করে বার হয়। ফেরে একটু রাত করে।
আমাদের হাউসিং ‘নন্দন কানন’ থেকে সবই খেয়াল করি আমি। আমার বাড়ি একদম শেষে, তারপর এরোড্রোমের মাঠ। মাঠ পার হলে হঠাত কলোনি।
এলাকাটা পিসফুলই ছিল এতদিন। কিন্তু গতমাসে কলোনির মুখের ঝুপসি বটতলায় রেপ হয়ে গেল একটা।
মেয়েটা কলোনির। জিতেন বাবুর বাড়িতে দু বেলা রান্নার কাজ করত। ফেরার পথে এই কাণ্ড। রাত তখন মাত্র সাড়ে আটটা।
হইচই হল খুব। শতিনেক লোক জড়ো হল। কলোনির, ক্লাবের, পার্টির, টেলিভিশনের মানুষজন এল। বড় রাস্তা অবরোধ করে রাখল সারাদিন। বিকেল বেলায় এস ডি ও , অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে নিয়ে এলেন। জনতা জানাল, ক্রিমিনালরা থানায় বসে বড়বাবুর সঙ্গে রোজ চা খায়। ওদের এখুনি জনগণের হাতে তুলে দিতে হবে।
অনেক বুঝিয়ে অবরোধ তোলা হল। প্রশাসন আশ্বাস দিল, মেয়েটির পরিবার যাতে ক্ষতিপূরণের টাকাটা তাড়াতাড়ি পায় তাও দেখা হবে।
তারপর সব চুপচাপ।
*
আমার চেতনায় প্রথম ধর্ষণ – পাঞ্চালি।
দ্য মোস্ট ইম্পালসিভ রেপ ইন দ্য হিস্ট্রি অফ মাইথলজি।
আচ্ছা? রেপ কী আমাদের রক্তে? সেই মহাকাব্যের আমল থেকেই?
প্রকাশ্য রাজসভা। পঞ্চপাণ্ডব মাথা নিচু করে বসে আছে। আমি মধ্যম পাণ্ডব। পারচেজের রাধামোহনদা মোট আটটা শাড়ি পরে ষ্টেজে। ঘোষবাবু দুঃশাসন। একের পর এক শাড়ি ধরে টানছেন আর ঘাম মুছবার অভিনয় করছেন। উড়ে যাচ্ছে শাড়ির পর শাড়ি। ঘোষবাবুকে পই পই করে বলে দেওয়া হয়েছে সাতখানা শাড়ি খুলবে, হিসেবটা রাখবেন। মুখে ব্লু স্পট আর আঙুলে রাংতার চক্র নিয়ে মেন্টেনান্সের অবিনাশ একটা উঁচু টুলের ওপর দাঁড়িয়ে। নিচটা অন্ধকার। সাত নম্বর শাড়িতে হাত পড়লেই গদা ঘাড়ে লাফিয়ে উঠবে রাঘব। উচ্চারণ করবে সেই ভীষণ রক্তপানের প্রতিজ্ঞার কথা। রাঘবের হাত থেকে আলোর জ্যোতি শাড়ির স্রোতের মত নেমে আসবে রাধামোহনদার কোমরে। মঞ্চ ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে যাবে।
সাত নম্বর শাড়িতে হাত পড়ল, কিন্তু রাঘব লাফ দিয়ে উঠল না। ওর নিচু ঘাড় আরও নিচু হয়ে গেছে। প্রায় বুকে এসে ঠেকছে। বাকি সবাই যদিও অপমানে লজ্জায় ঘাড় নিচু করেই আছি তবু রাঘব যেন অস্বাভাবিক ভাবে নিচু। আমি অর্জুন। ছোটভাই। কী করে বলি দাদা ওঠ। নিজেও উঠতে পারি না। তাহলে কাহিনীর বিকৃতি হবে। রাঘব শেষ অবধি সাত নম্বর শাড়ি শেষ হলেও উঠল না।
দুঃশাসন একটু স্লো দিল। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে। রাধাদা দিশাহারা হয়ে পড়েছে। আট নম্বর, শেষ শাড়িতে টান পড়তেই এক লাফে স্টেজ ছেড়ে ড্রেসিং রুমের দিকে দে দৌড়। পরনে শুধু আন্ডারপ্যান্ট।
ডিক্সন সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। উত্তেজিত ভাবে জিগ্যেস করলেন,
-হোয়াটস রং? বস্ট্রহরণ ইজ স্টিল পেন্ডিং। দেন হোয়াই ডিড রাধাবাবু এস্কেপ?
মঞ্চে ততক্ষণে চটি এসে পড়তে শুরু করেছে। পড়ছে, বাদামের খোসা ভর্তি ঠোঙা।
এতক্ষণে ধড়মড় করে উঠল রাঘব, গদা খুঁজতে লাগল প্রাণপণে।
আসলে, আমরা কেউ জানতাম না যে রাঘব কাল বড়শালীর বিয়েতে জেগেছে হোল নাইট।
*
এতদিন রেপ ছিল মহাকাব্যের পাতায়, যাত্রার মঞ্চে, সিনেমার পর্দায়। তখনও তা পাড়ায় পাড়ায় আসেনি।
পশ্চিম দিগন্তের ওপারে, আকাশের কারখানায় খুব জোর ওয়েল্ডিঙের কাজ শুরু হল। তারই ছটা প্রতিফলিত হচ্ছে সেন্টার লাইনে জমা জলের ওপর। তিনটে লাল বিন্দু রাইট হাফ আর স্টপারের মাঝখান দিয়ে একটু কোণাকুণি ভাবে মাঠ পার হচ্ছে। ঠিক ঐখানে আমি একটা চার্জ নিয়েছিলাম।
ম্যানেজমেন্ট টিমের এক বেটা লালমুখো ওভারসীয়ার ছিল খুব মারকুটে। ইচ্ছে করে ফাউল করে দাঁত বার করে হাসত। হাফ টাইমে আমি ক্ষিতীশদাকে বললাম,
- আমি কিন্তু ওর মালাইচাকি জাস্ট উল্টে দেব।
ক্ষিতীশদা নিষেধ করল, আমি শুনলাম না।
শেষ মুহূর্তে ওকে পেলাম পেনাল্টি বক্সের মাথায়। আমি এগোলাম। ওভারসীয়ার এগিয়ে আসছে ঘোঁত ঘোঁত করতে করতে। আসছে বুল্ডজারের মত। আমি ডিফেন্সে শেষ লোক, তারপরই গোলকিপার। ক্ষিতীশদা প্রাণপণে চেঁচাচ্ছে,
-আটকা, ওকে আটকা।
আমি ডান দিকে একটু ঝুল নিলাম। ও অমনি বাঁ দিক দিয়ে কাটাতে গেল। তখনই শরীরটা ভাসিয়ে দিলাম শূন্যে।
মট্ করে একটা আওয়াজ শুনেছিলাম খালি। ওর বুট সমেত বাঁ পা আমার তলপেটে এসে লাগল। কানে এল ওর চিৎকার,
-ওহ, মাই গড।
তারপর আমি অজ্ঞান।
জ্ঞান ফিরলে দেখি মুখের ওপর অনেক মুখ, সবচেয়ে ঝুঁকে ক্ষিতীশদা। পরে জেনেছিলাম ওভারসীয়ারের ডান হাঁটুর মালাইচাকি পুরো একশ আশি ডিগ্রি ঘুরে গিয়েছিল আমার লাথিতে । অপারেশন করে বাদ দিয়ে হয়েছিল ওই চাকি। ইংল্যান্ড চলে গিয়েছিল ওভারসীয়ার , আর আসেনি।
আর আজ, এই অন্ধকারে, মাঝমাঠে, জলকাদায়, এ এক অন্য খেলা শুরু। এখানে বল নেই, রেফারি নেই, কেবল অন্ধকার পার হওয়া, আরও অন্ধকারের দিকে যাওয়া।
*
ঝপ করে আলো এল। কেঁপে কেঁপে জ্বলে উঠল সার সার টিউবলাইট। মেয়েটাও পায়ের কাদা ঝেড়ে রাস্তায় উঠে এল। সাদা আলো পড়ল সারা গায়ে। এতক্ষণে চেহারাটা স্পষ্ট হল।
বেশ স্বাস্থ্যবতী। কাঁধে সাইড ব্যাগ। পিঠের দিকটায় আব্রুর অভাব। দ্রুত হাঁটার ফলে শরীরে ছন্দ উঠছে, আবার ভেঙেও যাচ্ছে।
আমাদের একটা ক্লাব আছে, চক্রব্যূহ। ফর রিটায়ার্ড পার্সন্স অনলি। সবাই লাইফ মেম্বার। বটতলা এপিসোড নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল খুব। অমিয়দা, প্রাক্তন অধ্যাপক, ক্লাবের সেক্রেটারি, বলেছিলেন,
-দোষ মেয়েদেরই। টু ডে দে আর প্রভকেটীভ এনাফ। পোশাকে, চাউনিতে, কথায় বার্তায় অনবরত সিডিউস করে চলেছে। ছেলেরা কী করবে? বায়োলজিকালি দে আর সো হেল্পলেস।
সুধীনদা, আবগারির দারোগা ছিলেন। বললেন,
-আমিঅ, পুষাকের কথা আর কইও না। অহন মাইয়ারা অঙ্গের চৌদ্দ আনায় খুইল্যা বারায়। চ্যাংড়াগুলানের দুষ কী কও।আমারি তো অহন এই বয়সেও—হ্যাঃ হ্যাঃ হ্যাঃ।
অবিনাশ প্রগতিশীল। ইউনিয়নটা দেখত। বলল,
- কিসসু করবার নেই ব্রাদার। পাতি বুর্জোয়া সমাজে এসব থাকবেই।
আমি একটু স্পেসিফিকালি বলেছিলাম,
-ডিফেন্স পার্টি সন্ধ্যে সাড়ে ছটা থেকে রাউন্ড দিক। আপটু কলোনি। দরকার হলে কলোনির ছেলেদের নিয়ে শিফট বাড়ান যেতে পারে। চুরি ডাকাতির চেয়ে রেপকেস আরও ভয়ংকর।
আর জি পার্টির পরবর্তী মিটিঙে আমার প্রস্তাব ধ্বনি ভোটে খারিজ হয়ে গেল। ফেরার পথে অমিয়দা আমাকে বুঝিয়েছিল,
-কলোনির মেয়েরা রেপ হবেই। ইনফ্যাক্ট দে আর সাম হয়ার এংগেজড ইন প্রসটিটিউশন। ওদের নিয়ে তোমার এত মাথা ব্যথা কেন?
আমি বলেছিলাম,
-অমিয়দা, আমাদের হাউসিংএর হেঁসেল গুলো কিন্তু ওরাই চালু রাখে।
-না মানে,
-ওরা দুদিন না এলে আপনাকে চা করে কে দেবে? আপনার বৌমা তো বিদেশে চলে গেল ছেলের সঙ্গে।
-ওদের আসতেই হবে, বুঝেছ। পেটের দায় বড় দায়। রেপড হলেও পরদিন ঠিক আসবে।
আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। চোখে চোখ রেখে বলেছিলাম,
-অমিয়দা, বুবকা, আমার নাতি, ক্লাস সিক্স, কাল রাতে আমার জিগ্যেস করেছে , দাদু ,হোয়াট ইজ রেপ? পর্ণ সাইটে যেগুলো দেখায় সেগুলো?
-ধমক মারলে না কেন? বড্ড ডেঁপ হয়েছে তোমার নাতিটা, মোবাইল টোবাইল একদম এলাউ করবে না এই বয়েসে।
*
আকাশ জুড়ে ওয়েল্ডিং এখন ঘন ঘন চলছে। গুমোট বাড়ছে, তারাগুলো নিভে যাচ্ছে একে একে। ভারি হয়ে আসছে আকাশ। মনের মধ্যে কেন জানিনা, চাপা অস্বস্তিটা বাড়ছে ক্রমশ।
রাস্তায় উঠেই ছেলেগুলো আরেক রাউন্ড সিগারেট ধরিয়েছে। আপাতত সামনে একশ মিটার পাকা রাস্তা। আলোকিত। মেয়েটাকেও একটু নিশ্চিন্ত মনে হচ্ছে। একবার আকাশটা দেখল। তারপর এগতে থাকল স্বাভাবিক ছন্দে। নাঃ, হাঁটাটা সত্যিই সুন্দর।
টিউবলাইটের আলোয় ছেলেগুলোকে আরেকবার আইডেন্টীফাই করবার চেষ্টা করলাম। এদিককার নয়। রেলের ওপারের নেতাজি কলোনির সঙ্গে এপারের হঠাত কলোনির একটা পুরোন টেনশন আছে। মাঝে মাঝে ওভারব্রিজের নিচে পাতাখোরদের আড্ডায়, বন্ধ সিনেমা হলের পেছনে চুল্লুর ঠেকে ঝাড়পিট হয়। এপারের ছেলে আটকে থাকে ওপারে, ওপারের মেয়ে তুলে নিয়ে আসে এপার। এইসব নিয়ে ষ্টেশন চত্বরে দানা চালাচালিও হয়ে গেছে কয়েকবার। শোনা যাচ্ছে বটতলার কেসটার জেরে নাকি এইসব আবার বেড়েছে। আজকের ব্যাপারটাও তেমন কিছু নাতো?
আবার, সবটা আমার মনের ভুলও হতে পারে। হতে পারে এরা একসঙ্গেই সিনেমা দেখেছে, রেস্টুরেন্টে খেয়েছে। হয়ত এদের ভেতরই কাউকে একটু আস্কারা দিয়ে ফেলেছে মেয়েটা। এখন পিছু ছাড়ছে না।
বটতলার ঘটনা ঘটে যাওয়ার পড়েই হাউজিংএর জানলা দরজা সন্ধ্যে থেকে বন্ধ হয়ে যায় । মেয়েটার চিৎকার নাকি এখান থেকেও শোনা গিয়েছিল। কাল সকালে অমিয়দা এসেছিল। ওর বড় নাতনিকে ভর দুপুরবেলা, ওভারব্রিজের নিচে কিছু ছেলে আটকেছিল। ওরা এক অদ্ভুত ধরণের বাইক চেপে এসেছিল। টিপটিপে বৃষ্টির মধ্যে ছাতা কেড়ে নিয়ে মেয়েটাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল বেশ কিছুক্ষণ। বাড়ি এসে চুমকি ভীষণ কান্নাকাটি করছে। ওরা শাসিয়েছে--- ওদের এক বন্ধুর সঙ্গে প্রেম না করলে ওকেও বটতলা করে ছেড়ে দেবে।
কাল এইসব কথা শুভেন্দুকে বলতে গিয়ে একটু মাথা গরম করে ফেললাম। বললাম,
- তোরা কী ভাবছিস?
- কোনটা?
- এই বটতলার কেসটা? তাছাড়া কাল একদল ছেলে চুমকিকেও টিজ করেছে।
- আমরা কী করব? নাইনটি পারসেন্ট কেসে ভিক্টীমরাই থানা পুলিশ এভয়েড করছে।
- কেন করছে এভয়েড?
- অনেক কারণে, পলিটিকাল কারণ আছে, মিডিয়া আছে, তারপর আনম্যারেড হলে বিয়ে থার প্রবলেম।
- আর আমি যদি বলি, মানুষ তোদের কাছে যেতে ভয় পাচ্ছে?
- হ্যাঁ, সেটাও আছে।
- কেন ভয় পাচ্ছে মানুষ? তোরা থাকতে।
- আমরা কী করব?
এতক্ষণে শুভেন্দুর গলায় ঝাঁজ এল, পুলিসি ঝাঁজ।
-চব্বিশ ঘণ্টা পাহারা দেব নাকি সব মেয়েকে?
-আলবাত দিবি।
-দেখ বাবা।
- তোর পেছনে চব্বিশ ঘণ্টা পাহারা কেন? তুই একজন ডি এস পি। এসেছিস ছুটি কাটাতে। বাবার সঙ্গে ডিনার করছিস। সেখানেও বাইরে টুলে বসে আছে তোর বডিগার্ড। কেন?
-বাবা, আপনাকে আর একটু মাংস দি?
আমার এই পুত্রবধূটি বড় বুদ্ধিমান। বললাম,
-দাও।
খাওয়া দাওয়ার পর বুবকা আমার ঘরে এসেছিল। আমি অন্ধকারে চুপ করে শুয়েছিলাম। ও মৃদু স্বরে ডাকল,
-দাদু
-উঁ।
-রিসাইট করব?
-ইয়েস।
-কোনটা করব? সেই যেটা তুমি আমাকে টেগোরের জন্মদিনে করতে বল?
-হাঁ। কর।
বুবকা শুরু করল,
-তোমার ন্যায়ের দণ্ড প্রত্যেকের করে
অর্পণ করেছ নিজে। প্রত্যেকের পরে
দিয়েছ শাসন ভার। হে রাজাধিরাজ
সে গুরু সম্মান তব, সে দুরূহ কাজ।
কার্শিয়াং মিশনারি স্কুলে কি এসব পড়ান হয়? শুভেন্দু ট্রন্সফার নিয়েছে শুধু ছেলেকে মানুষ করবে বলে। আচ্ছা, ‘মানুষ করা’ কাকে বলে?
-বুকবকাআআআ, শোবে এস, কাল সাতটায় ফ্লাইট তোমার।
-যাও দাদু, শুয়ে পড়।
*
পাকা রাস্তা প্রায় শেষ হয়ে এল। এবার ডানদিকে বাঁক নেবে। একদম শেষ মাথায় সাদা বাড়ীটা আমার। গ্র্যাচুইটী আর প্রভিডেন্ড ফাণ্ড দিয়ে গাঁথা। বাড়িতে এখন আমি ছাড়া আর কেউ নেই। স্ত্রী ফ্লাইটে ওদের সঙ্গে গেছে বুবকাকে রেখে আসতে। ছেলের ওখানকার সংসার একটু গুছিয়ে দেবে। আমাকে নিয়ে কারও কোন সমস্যা নেই। চা থেকে চাওমিন আমি সবই নিজে হাতে এখনও বানিয়ে নিতে পারি। খালি বাসনটা মেজে দেয় সরলা। ‘বটতলা’ কাণ্ডের পর থেকে সেও একবেলার বেশি আসছেনা।
তেমাথার মোড় ওই এসে গেল প্রায়। টিউব লাইট শেষ। এইবার পঞ্চায়েতের এলাকা। এখান থেকে আর একশো গজ এগোলেই কলোনি। রাস্তাটা ভেঙ্গে গেছে। এখান ওখানে জমা জল। মাঝামাঝি জায়গায় বটতলা। অকুস্থল। ওখানে এখনও অন্ধকার বেশ গাঢ়।
এইটুকু পথ মেয়েটা নিশ্চয়ই একা চলে যেতে পারবে। ভয় পাওয়ার মত তেমন তো কিছু ঘটেনি। সবটাই আমার মের ভুল বলেই মনে হচ্ছে। বয়স হলে কতরকম যে মনে হয়। আমি তাহলে এবার ডানদিকে......
-গুরু, সুড্ডাটা সিধা টানবে না হড়কে যাবে ডাইনে?
আমার বুকের ভেতর একটা অতল খাদ দেখা দিয়েই চকিতে মিলিয়ে গেল।কানের পাশে গরম হল্কা টের পেলাম। উত্তরটা এল আরও খারাপ ভাষায়,
- গেলে ভাল, না গেলে সাইডিং-এ নামিয়ে দেব।
কী করব আমি এখন? কী করা উচিৎ আমার? আমি যে একেবারেই ফর্মে নেই ক্ষিতীশদা। আমার দু চোখেই বাইফোকাল। রক্তে চিনি এসে গেছে। সামনের ভেকেশনে বুবকা এসে আমার ডায়মন্ড জুবিলি বার্থডে সেলিব্রেট করবে। এই অবস্থায় ঘুরে দাঁড়িয়ে আমার আর একটা চার্জ নেওয়া কি ঠিক হবে?
ছেলেগুলোর শরীরে যদিও কিছু নেই, কিন্তু পকেটে থাকতেই পারে ক্ষুর, চাকু, চেন।
নাকি বাড়ি চলে যাব? চায়ের কাপ হাতে বসে পড়ব কোন জম্পেশ স্পোর্টস চ্যানেলের সামনে?
আকাশ ফালা করে একটা নীল চাবুক আছড়ে পড়ল কাছেই। তীব্র আলোর ঝলকে দেখলাম মেয়েটার চলার ভঙ্গি নিমেষের জন্য পরিণত হল এক স্থিরচিত্রে। দেখলাম, দৌড়বার জন্য ওর দেহ ঝুঁকে পড়েছে। বাঁ হাতে আঁচল তুলে দিয়েছে মাথায়। আঁকড়ে ধরেছে ব্যাগ। পর মুহূর্তে কানের পর্দা চিরে আকাশ থেকে নেমে এল বুবকার আর্তনাদ,
- দাদুউ , হোয়াট ইজ আ রেপ?
যা হয় হোক, আমি কাঁচায় নামলাম ক্ষিতীশদা। তুমুল ঝড় বৃষ্টি আর হাওয়ার ঝাপটার ভেতর দিয়ে টলতে টলতে এগোতে লাগলাম, মেয়েটা আর ছেলেগুলোর মাঝখানে, চলমান, অসহায়, এক অবরোধের মত।
লেখক পরিচিতি
নির্মাল্যকুমার মুখোপাধ্যায়
নির্মাল্যকুমার মুখোপাধ্যায়
অবসরপ্রাপ্ত বিশেষ ভূমিরাজস্ব আধিকারিক।
কলকাতায় থাকেন।
কবি। গল্পকার। প্রবন্ধকার।
প্রকাশিত বই-
বাংলার ভূমিব্যবস্থা, জরিপ ও রাজস্বের আইনগত বিবর্তন। গাঙচিল প্রকাশনা।
ছোটগল্প প্রকাশিত- সাপ্তাহিক বর্তমান, গল্প সরণি, রব, তীব্র কুঠার, বাংলালাইভ.কম, তথ্যকেন্দ্র।
প্রবন্ধ প্রকাশিত- অন্য প্রমা, গাঙচিল পত্রিকা।
কবিতা - দেশ পত্রিকা ও আরও নানা লি
3 মন্তব্যসমূহ
গল্পটির রচনাকাল ইং ১৯৯৫ সন - লেখক
উত্তরমুছুননির্মম সত্য। অন্য ধারার লেখনী।
উত্তরমুছুনশুভেচ্ছা
মুছুন