বুলভার ম্যাক্সিম গোর্কিকে এত দীর্ঘ আর কখনও মনে হয়নি; ঠিক যেদিন ‘হাওয়াকলের গান’ গল্পটি পড়লাম, সেদিনই মনে হলো এ বুলভার এত দীর্ঘ… এই বুলভার ধরে হাঁটতে হাঁটতে কবি এইমে সেজায়ারের কাছে চলে যাওয়া যায়, চলে যাওয়া যায় প্রিয় গল্পের বইটিকে হাতে নিয়ে শার্ল বোদলেয়ারের কবরে!
এরকম একটা শব্দকে বুকে নিয়ে আমি বেড়ে উঠেছিলাম- দমকল। একজন বয়স্ক লোক এই গানটি গাইতে গাইতে নিঃশব্দে হেঁটে যেতেন, গ্রামের রাস্তা ধরে- দমকলেতে বাঁশি বাজে… কার বাঁশি কোথায় বাজে- এই রহস্যকথার কিছুই এখনও জানি না কিন্তু দমকল শব্দটি এখনও কানে বাজে, আর এখন, নাহিদা আশরাফী’র ‘ঝুলবারান্দা, তিনটি মাছ আর একটি বিন্দুবর্তী জলাশয়’ গল্পের বইয়ে পাওয়া গেল এমন একটি শব্দ, আমার বুকের ভেতরের দমকলের সঙ্গে এখন তারও নিত্য বসবাস- হাওয়াকল। এই বইয়ের শেষ গল্প (কিংবা মহাকাব্য) ‘হাওয়াকলের গান’। কলের গান শুনেছি অনেকেই, কিন্তু আসুন, আজ একবার হাওয়াকলের গান শুনি। আমার সেইসব প্রাচীন ঠিকানা- সেই উইনচেস্টার স্ট্রিট, হার্লিংটন, ভায়োলেট এভিনিউ কিংবা বুলভার ম্যাক্সিম গোর্কি’র অদৃশ্য ঝুলবারান্দায়, যেদিন এই বইটি এলো, সেদিন বৃষ্টি আর ওয়ালপেপারের অবিরাম সংলাপ চলছিল-
‘যে আমি আমাকে জানি না কিন্তু আমার ছায়া জানে আমার সবটুকু। আমি তাকে প্রশ্ন করি, ছায়া উত্তর দেয়...
- বালিকা কই?
- সে তো তোমারই ছায়া
- জোছনা?
- সেও তাই
- আমি?
- তুমিও তাই
- তুমি
- তোমার ছায়াতেই
- এখন দিন না রাত।
- ছায়াদের পৃথিবী একরকম। দিনরাতের ভেদ নেই।
- ছায়াদের পৃথিবী আছে?
- তোমার ছায়াতেই পুরো পৃথিবী
প্রশ্ন করে করে কতদূর এসেছি মনে নেই হঠাৎই আমার চোখে ভেসে ওঠে এক পরিচিত পৃথিবী। একটা চৌচালা ঘর, দুটি বকুল গাছ, একটা পদ্মপুকুর, শান বাঁধানো ঘাট, ছ’জোড়া কবুতর, একটা বড় হাসনাহেনা আর তিনটে শেফালির চারা। একটা খাটের উপর দু’টি শিশু, পাশেই জুবুথুবু জড়িয়ে শুয়ে থাকা এক বৃদ্ধা। আমি ঘুরে ঘুরে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যাই, আলনায় পরিপাটি ভাঁজ করা দুটো ডুরে ছাপা শাড়ি খুব চেনা চেনা লাগে। শিশু দু’টি নড়েচড়ে ওঠে। ছোটটি মা মা বলে কেঁদে ওঠে। আমি ছুটে যাই। আমার বুকের ভেতরে পাড় ভাঙ্গার শব্দ শুনি। ওর গায়ে হাত বুলিয়ে দেই। সারাগায়ে চুমু খাই পাগলের মত। কী ভেবে ও চুপ হয়ে যায়। আমি শিশু দুটির মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকি। কোথাও কি দেখেছি ওদের? খুব চেনা কেন মনে হয়? খুব আপন...
কখন ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে বৃদ্ধার শান্ত সৌম্য মুখখানির সামনে এসেছি টের পাইনি। একি! এ আমি কাকে দেখছি? এ যে আমারই প্রতিচ্ছবি। আমরই প্রতিবিম্ব। যেন বা সুদূর কোন এক জন্মে সে আমিই ছিলাম বা আমিই সে। আমার সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।
কত সব দৃশ্য, কত সব রঙ, হাসি, কান্না মেঘের মত আমার স্মৃতির দেয়াল ভিজিয়ে দিতে চাইছে। নবান্নের ধানের ক্ষেত, একটা মেঠো পথ, একটা চায়ের দোকান, স্মৃতির সুই খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ক্ষত করছে আমার অনুভব। ঘর ছেড়ে আমি আবার জোছনায় নেমে আসি। আমার মাথার উপর জোছনা, পায়ের তলায় জোছনা। হাতের মুঠোয় জোছনা। অস্পৃশ্য অথচ সুস্পষ্ট। উঠোন পেরুতেই সারি সারি সুপারি গাছ, পেঁপে গাছের রমণীয় বুক ঢেকে আছে রূপালি আঁচল। যে আঁচল আঁকা মিহি জোছনার সুঁতোয়। একটু দূরে কোন হিজলের বনে পেঁচা ডেকে ওঠে। মর্মে বাজে বিষণ্নতার ভায়োলিন। এ বড় চেনা সুর। এ বড় চেনা ডাক। ‘আমি তারে পারিনা এড়াতে।’
- ও ছায়া তোমার কেন ছায়া নেই?
- আছে তো।
- কই? কোথাও যে পাইনা তারে।
- নিজেকে পেলেই তাকে পেতে।
- নিজেকে পাওয়া যায়?
বাতাসের দীর্ঘশ্বাস শুনতে পাই আমি। সেই দীর্ঘশ্বাসে উড়ে যায় কিছু মৃত পাতারা। আমার কেন যেন শিশু দুটির কাছে ফিরতে ইচ্ছে করে। শাড়ি দুটির কাছেও। ক্লান্ত আমার সিথান একটা একটা মোলায়েম বালিশ খোঁজে। যত আমি ঘরের দিকে যেতে চাই কোন এক অদৃশ্য চোরাবালি আমাকে এক অচেনা প্ল্যাটফর্মের দিকে ধাবিত করে।
(‘হাওয়াকলের গান’ গল্পের নির্বাচিত অংশ)
পাঠশেষে, একটা নস্টালজিয়ার মতো, পাঠকের ভেতরে নীরবতার জন্ম হয়, বৃষ্টি আর ওয়ালপেপারের সংলাপ সেই কখন দেখা বার্গম্যানের সেভেন্থ সীল সিনেমার মৃত্যুর সঙ্গে দাবা খেলার মুহূর্তটিকে মনে করিয়ে দেয়। পাঠকের কেবল মনে হয়, এই গল্পটি আমার। এ আমারই যাপিত জীবনের গল্প। একটি গল্প কীভাবে পাঠককে নীরব করে দিতে পারে, ‘হাওয়াকলের গান’ পাঠের অভিজ্ঞতা না থাকলে হয়তো বলা সম্ভব ছিল না! পাঠকের ভেতর নীরবতার জন্ম দেওয়া একজন লেখকের অন্যতম প্রধান কাজ।
নিজেকে ভেঙে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া এই গল্পে আমরা দেখি কীভাবে জীবন জীবনকে টানে, তীব্র আকর্ষণে।
ওরহান পামুকের এই কথাগুলো ঠিক এমন মুহূর্তে মনে পড়ে- ‘এমন কয়েকজন ঔপন্যাসিক আছেন যারা স্মরণীয় দৃশ্যগুলো গড়ে তোলেন আমাদের মনের ভেতরে নানারকমের ছবি তৈরি করে। ফ্লবেয়ার কথিত সেই ‘পারফেক্ট ওয়ার্ল্ড’ গড়ে উঠবার পূর্বে, লেখকের কল্পনায় সম্পূর্ণ নিখুঁত ছবিগুলো থাকতে হয়। একজন পাঠক মাঝে মাঝেই তার পড়তে থাকা উপন্যাসটি বন্ধ করে ওপরে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন, এই তাকানোর মানে হচ্ছে তিনি তখন বাক্যে বাক্যে, অনুচ্ছেদে অনুচ্ছেদে লেখক যে-ছবিগুলো এঁকেছেন, যে-দৃশ্যগুলো তৈরি করেছেন তিনি সেগুলো দেখতে পাচ্ছেন। আমরা এই পাঠকদের জন্যই তো লিখি।’
পামুক-কে কেন মনে পড়লো! এই ‘হাওয়াকলের গান’ গল্পটি পাঠের পর মনে হয়, আমি যেন নিজের মুখোমুখি নিজেই দাঁড়িয়ে আছি; লেখক আমাকে কিছু শব্দ আর বাক্য দিয়ে হিপনোটাইজ করে ফেলেছেন, এক পাঠে এই গল্পের পাঠ-যাপন তাই শেষ হয়ে যায় না; পর পর কয়েক বার পড়তে হয়, শুরু হয় গল্প নিয়ে নিজস্ব যাপন, পাঠক পড়তে পড়তে গল্পের রেশ মাথায় নিয়ে ঘোরগ্রস্থ হয়ে পড়ে। লেখক বাক্যে বাক্যে, অনুচ্ছেদে অনুচ্ছেদে যে ছবিগুলো এঁকেছেন, যে আশ্চর্য জগতটি গড়ে তুলেছেন, সব যেন বুকের ভেতর আলোড়ন তুলে, সব ছবি যেন দেখতে দেখতে ভিড়ের ভেতর একা হয়ে বুলভার ধরে হেঁটে যেতে ইচ্ছে হয়, মনে হয় এ গল্প আমার, একান্তই আমার। এই গল্প বুকে নিয়েই আমার নিজের গল্প-যাপন। পামুক এইখানে, এক ঘোরতরো মুহূর্তে খুব বেশি সত্য হয়ে উঠেন।
‘খুনী’ গল্পটি শুরু হচ্ছে এভাবে-
‘গল্পটা ঠিক কীভাবে শুরু করলে বেশ গোছানো হবে অথবা গল্পটি কীভাবে শুরু করলে আপনারা সহজে ধরতে পারবেন বুঝতে পারছি না।’ লেখক এখানে পাঠকের সঙ্গে এক অদৃশ্য সংলাপ জুড়ে দিচ্ছেন। দ্বিতীয় বাক্যে তিনি বলছেন- ‘পাখি ধরা কঠিন কিন্তু বাগানের ফুলটা? ওর তো ডানা নেই, ওকে ধরা কঠিন কিছু নয় নিশ্চয়ই। তাই না? এ গল্পে ডানা আছে, সত্যি আছে।’ বাগানের ফুল ধরার এই প্রশ্নে পাঠকের আর মুক্তি মিলে না, খুনী গল্পটি তাকে পড়তে হয়…
ফিনান্সিয়াল টাইমস প্রখ্যাত পর্তুগিজ লেখক হোসে সারামাগো’র ছোট একটি সাক্ষাৎকার ছেপেছিল ২০০৯ সালের ৫ ডিসেম্বর, তাদের ‘অল্প কথার আলাপ’ বিভাগে। আনা মেটক্যাফে-র নেওয়া এই সাক্ষাৎকারটির প্রথম প্রশ্নটি ছিল : আপনার প্রকৃত পাঠক কারা?
উত্তরে সারামাগো বলেছিলেন : ‘সেইসব পাঠক, তারা যখন পড়েন তখন বদলে যেতে থাকেন, একটানা পড়ার আগে লেখার ওপর থেকে একটি মুহূর্তের জন্য হলেও চোখ ফিরিয়ে নেন, সেই মুহুর্তে ভাবেন।’
খুনী গল্পটির শুরুর কিছু কথা পড়ে, গল্পের বাকিটুকু পড়বার আগে লেখক যেন এটাই আশা করেন পাঠকের কাছে, লেখার উপর থেকে একটি মুহূর্তের জন্য হলেও চোখ ফিরিয়ে নিয়ে যেন ভাবেন…
না ভাবলে, অখণ্ড মনোযোগে না পড়লে পাঠক কী করে ধরবেন এই গল্পের খুনী আসলে কে?
‘ঝুলবারান্দা, তিনটি মাছ আর একটি বিন্দুবর্তী জলাশয়’ বইয়ের ‘অথচ যেখান থেকে গল্পটা শুরু হতে পারত’, ‘খুনী’, ‘ঝুলবারান্দা, তিনটি মাছ আর একটি বিন্দুবর্তী জলাশয়’, ‘পেনিলোপ, সীতা ও আমি’, ‘মোনঘর’ আর ‘হাওয়াকলের গান’ এই গল্পগুলো আমাদের সমাজে নারীর সাইকোলজিক্যাল অবস্থানকে ধরতে চেয়েছে। এই বইয়ের আরও একটি গল্প, আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল বেশ কিছু দিন। গল্পটির নাম ‘রক্তজবা, বারবারা ও কালো ফুলদানি’। করোনা অতিমারির এক বিষাদময় আখ্যান বলতে বসেছেন লেখক গহন চরিত্রটির মাধ্যমে। মানুষের চিরতরে হারিয়ে যাওয়া তার প্রিয় মানুষটির কাছ থেকে- অতিমারির এই বিষণ্ণতা আমরা কীভাবে কাটিয়ে উঠব, এখনও জানি না- ‘তুমি দেখো বকুল, এলেক্স হেলির কুন্ত একা, টনি মরিসনের পিকালো একা, তুমি একা, আমি একা। একটা ছোট্ট ভাইরাস কী নির্মমভাবে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল আমরা সবাই মিলে কত একা!’
গল্পের গহনের এই একাকীত্ব একটা জোর ধাক্কা খায় হঠাৎ গল্পের যখন জর্জ ফ্লয়েড বলে ওঠে- আই কান্ট ব্রেইদ, আই কান্ট ব্রেইদ… কোনও কোনও গল্পের এক একটি বাক্যই এক একটি গল্প হয়ে উঠে।
লেখকরা নতুন অনুভূতি-অনুভব ও বাস্তবতার আবিষ্কারক। সাহিত্য এক আশ্রয়। অন্তর্জগতের সঙ্গীত। আমরা হয়ত একজন মানুষকে দেখছি- পাঠক। কিন্তু সে মানুষ তো গড়ে ওঠা, অর্থাৎ নির্মিত। তাঁর ভেতরে বহু মানুষের বাস। বহুল স্বরের এক দেবতা সে। লেখালেখি এমন এক শিল্পকর্ম, যা পাঠককে ভাবতে বাধ্য করে। পাঠক তার ভিতরে সেই শিল্পকর্মের রস টেনে নেয় মহাবৃক্ষের মত, তাতে জীবনের অর্থের কাছে মানুষ পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়। এভাবে সাহিত্য এগিয়ে চলে আর লেখক নিজের পথ স্পষ্ট করে দেখতে পান। যেখানে, সব কথা বলা হয়ে গেছে, সেখানে- তিনি কীভাবে নতুন ভঙ্গিতে বলবেন, এবার? কেমন হবে তাঁর লেখার শৈলী? যে শৈলীর কারণেই এক একটি লেখা তা গল্প বা উপন্যাস বা কবিতা, নাটক, যা-ই হোক, নিজেকে সে ভবিষ্যতের পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে পারে! সাহিত্য তখন কুন্ডেরা-বর্ণিত ‘বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির লড়াই’।
নাহিদা আশরাফী’র ‘ঝুলবারান্দা, তিনটি মাছ আর একটি বিন্দুবর্তী জলাশয়’ গল্পের বইটিও বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির লড়াই।
এবং পাঠকের গল্প-যাপনের এমন এক ধরন, যা তাঁকে ক্রমাগত বিদ্ধ করে, ক্রোধিত করে, এবং পুরাণের সীতা ও পেনিলোপের মতো বেদনাহত করে।
লেখক পরিচিতি
এমদাদ রহমান
প্যারিসে থাকেন।
গল্পকার। অনুবাদক। প্রবন্ধকার।
0 মন্তব্যসমূহ