হামিরউদ্দিন মিদ্যার গল্প: কবর

 

মোষমরার চরে একটা কবর দেখা গেছে।তা নিয়েই সন্ধে থেকে গুঞ্জন।গুঞ্জন হবে না কেন!মানুষ মরলে কবর দেওয়া হয় গ্রামের গোরস্থানে।মোষমরার চরের মতো অমন নির্জন জনমানবহীন এলাকা কবর দেওয়ার উপযুক্ত জায়গা নয়।বিষয়টির সঙ্গে যেহেতু মানুষের মৃত্যু সম্পর্ক জড়িত,সেক্ষেত্রে সবার মনে একটা সংশয় থেকেই যাচ্ছে।সদ্য নির্মিত কবর।অথচ কী আশ্চর্যের বিষয় আশেপাশের গ্রামগুলিতেও কারও মারা যাবার কোনও সংবাদ নেই।মানুষ মরলে খবর কখনও চাপা থাকে না।মানুষের মুখে মুখেই ছড়িয়ে পড়ে।তাহলে কবরটি কার?কারাই বা প্রকাশ্য দিনের আলোয় একটা মৃত মানুষকে ওমন ধূ ধূ প্রান্তরে মাটি খুঁড়ে কবর দিয়ে গেল!

 

তখনও সন্ধ্যা ঘনায়নি।বাগদিপাড়ার পুষ্করের বউ গিয়েছিল চরের খালে মাছ ধরতে।বর্ষাকাল।নদীর এখন ভরা যৌবন।সেই যৌবনেরই ছটা ছড়িয়ে পড়ছে নদীর আশেপাশের খালে-বিলে।মোষমরার চরটা ঠিক আজকালকার চর নয়।শোনা যায়,কোন যুগ আগে নাকি বান এসেছিল নদীতে।মাঠঘাট ডুবিয়ে যখন শান্ত হল নদী,তখন পলি-বালি ফেলে ফেলে নদীটা অনেকদূর সরে পড়েছে।লাগারডাঙার ঘোষদের একটা হালের মোষ চরতে চরতে শক্ত ডাঙা ভেবে বালিতে পা দিয়ে জল খেতে নেমেছিল।আর উঠতে পারেনি মোষটা।ভড়ভড় করে ঢুকে গিয়েছিল নরম দক-মাটিতে।অনেক খোঁজাখুঁজির পর যখন রাখালের চোখে পড়েছিল,তখন শুধু একটা কালো মাথা দেখতে পেয়েছিল সে।চোখ বুজে ওপর দিকে মুখ তুলে যেন গভীর ধ্যানে মগ্ন।কেউ যেন গলাটি কেটে কাদার ওপর নামিয়ে দিয়ে গেছে।মোষটার মাথার ওপর দু-তিনদিন শকুন উড়েছিল।ভাগাড় খেকো কুকুরগুলো দহে নামতে সাহস পায়নি।দূর থেকে বসে বসেই জীভের জল ঝড়িয়েছিল—এ হল মোষমরার চরের বৃত্তান্ত।

চরের আশেপাশে অনেক শাখা নালা আছে।যেগুলো মাঠ থেকে নেমে নদীতে মিশেছে।উজানি জলে নদী থেকে মাছ উঠে আসে।পুষ্করের বউয়ের সঙ্গে তার ন্যালা ছেলেটাও ছিল।কুড়োজালী দিয়ে খালে চুনো মাছ ধরছিল শুকমনি।আর ন্যালা ছেলেটা চরে খেলতে খেলতে কী দেখে মা মা করে ছুটে এসেছিল।হাঁফাচ্ছিল ছেলেটা।

শুকমনি ছেলেকে অমন ভাবে ছুটে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করল,কী হয়েছে তা?ওমন ম্যা ম্যা করিস ক্যানে?

ছেলেটা আঙুল বাড়িয়ে চরের পশ্চিমদিকটা দেখাল।

শুকমনি খাল থেকে উঠে পড়ে।জালটা নামিয়ে ন্যালা ছেলেটার সাথে সাথে এগিয়ে যায় খানিক।ছেলেটা ভয়ে এগোতে চায় না।মায়ের শাড়ির আঁচল ধরে সিঁটিয়ে থাকে।কিছুটা এগিয়েই থম মেরে দাঁড়িয়ে পড়ল শুকমনি।একটা কাঁচা কবর!আজই বানানো হয়েছে।বুকে থুতু দিয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে রাম নাম জপতে লাগল।বুকের ভেতরটা কেমন ধুকপুক করে ওঠে তার।তাদের গাঁয়ের তো কেউ মারা যায়নি!আর এই জায়গাটা কবর দেওয়ার জায়গাও নয়।

সন্ধে হতে আর খুব বেশি দেরি নেই।পশ্চিম আকাশে সূর্য অনেকক্ষণ আগেই ঢলে পড়েছে।খালে নামতে আর সাহসে কুলল না শুকমনির।জালটা কাঁধে ফেলে,ছেলেটাকে নিয়ে এক দমে হেঁটে হেঁটে মাঠ পেরিয়ে গাঁয়ের তে-মাথার মোড়ে এসে থেমেছিল।একবারও পেছন ফিরে তাকায়নি।

।।দুই।।

কার্তিকের চা-চপের দোকানে সন্ধেবেলা পাঁচরকম পাঁচটা মানুষ এসে জড়ো হয়।বাঁশের বেঞ্চিতে পা ঝুলিয়ে চা খেতে খেতে দেশ-দুনিয়ার সাতকাহন তুলে আনে।শুকমনি ভিজে কাপড়ে দাঁড়িয়েই গিয়াসউদ্দিন মোল্লাকে ডাকল,চাচা একবার শুনে যাও এদিকে।

গিয়াসউদ্দিন মোল্লা চায়ের কাপ হাতেই উঠে এল।বলল,একটু আগেই তো পুষ্কর টাকা নিয়ে গেল,তোকে কিছু বলেনি?

শুকমনি বলল,বেতন চাওয়ার জন্য ডাকিনি গো চাচা,অন্য কেস আছে—তারপর গলাটা খাদে নামিয়ে শুকমনি জিজ্ঞেস করে,আজ তুমাদের স্বজাতি কেউ মরেছে চাচা?

—কই না তো!কী হয়েছে একটু খুলে বলদিনি।

—চাচা গো!এখনও বুকটা আমার ধুকপুক করছে।সাঁঝেরবেলা ছেলে নিয়ে মিছে কথা বলবনি।মোষমরার চরে একটা কবর দেখে এলাম।

গিয়াসউদ্দিন মোল্লার চোখ কপালে উঠল।

—বলিস কী!কবর!ঠিক দেখেছিস তো?

—আমাদের ভোলা চরে খেলছিল চাচা।হঠাৎ কবরটা দেখে হাঁফাতে হাঁফাতে ছুটে আসে।তারপর আমিও গিয়ে দেখে এলাম।তুমাদের গোরস্থানে যেমন কবর দেয়,ঠিক তেমন পারা।

ওদের কথাবার্তা শুনে আরও দু'-চারজন এগিয়ে এল।পুষ্করের বউয়ের কথাটি রাষ্ট্র হতে বেশি সময় লাগল না।

মোষমরার চরটাকে যদি মাঝে রাখা হয়,তাহলে নদীর এপারে আরও দুটি গ্রাম পড়ে।ওই গ্রামগুলিতেও যার যত আত্মীয়স্বজন ছিল,সবাইকে ফোন করা হল।কেউ কোনও সংবাদ দিতে পারল না।চারিদিকে হুলুস্থুল পড়ে গেল।রাতের বেলাতেই অনেকে গিয়ে ব্যপারটা চাক্ষুষ দর্শন করে আসতে চায়।এতবড় একটা ঘটনা শুধু মাত্র পুষ্করের বউয়ের জবানের ভিত্তিতেই সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে ছেড়ে দেওয়া যায় না।খবরের সত্যাসত্য বিচারের জন্য মোষমরার চরে একবার রাতারাতি যাওয়া প্রয়োজন।তবে এই অন্ধকার রাত্রে,জল-কাদা,ঝোপ-জঙ্গল মাড়িয়ে কে যাবে?পথটা তো সোজাসাপটা নয়।রাতের বেলা সাপখোপের ভয় আছে।আবার না গেলেও সারারাত চোখে ঘুম আসবে না কারও।

এশার নামাজের পর গ্রামের মসজিদের ইমাম বারাকতুল্লাহ বললেন,শোনেন ভাইসকল।সবার যাওয়ার দরকার নেই।আমার সঙ্গে দু'-একজন গেলেই হবে।

ইমাম সাহেব কত যে মরা মানুষকে ইসলামিক তরিকা অনুযায়ী কবর দিয়েছেন তার কোনও হিসেব নেই।ওনার যাওয়াটা অনেকের কাছে খুব মূল্যবান বলে মনে হল।তবে শুধু ইমাম সাহেবই নয়,সঙ্গে গেল বেশকিছু কৌতুহলী জনতা আর ক্লাবের ছেলে-ছোকরারা।কেউ কেউ পুষ্করের বউকে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার কথা তোলে।তাতে গিয়াসউদ্দিন মোল্লা বলে,ওকে নিয়ে যাওয়ার দরকার নাই।উ যে জায়গার কথা বলেছে,সে জায়গা আমি খুঁজে বার করে নেব।

নদীর কোলঘেঁষা এই গ্রামটির মানুষজন সারাদিন মাঠেঘাটে খেটে এসে রাত ন'টা না বাজতে বাজতেই বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।আবার উঠে পড়ে পুবের আকাশ ফরসা হতে না হতেই।আজ কারও চোখে ঘুম নেই।ইমাম সাহেব যখন দলবল নিয়ে মোষমরার চরে গেছেন,নতুন কোনও সংবাদ না নিয়ে ফিরবেন না।সবাই জেগে আছে সেই অনাগত খবরটুকু শোনার অপেক্ষায়।

গ্রামটিকে নদী থেকে পৃথক করেছে একটি বিশাল মাঠ।আমনধানের কচি চারাগুলি টর্চের আলোয় ঝিলিক দিয়ে উঠছে।একটা মোটা আলপথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা।পলিবেষ্টিত মাঠ।গ্রামকে পেছনে ফেলে দলটি যখন নদীর পাড়ে উঠল,তখন আকাশের সন্ধ্যা তারাটি মেঘ কাটিয়ে বেশ জ্বলজ্বলে হয়ে উঠেছে।

নদীর এপারটায় ছোটছোট লতা-গুল্মের ঝোপ আর কাশবনের রাজত্ব।কোথাও বা প্রহরীর মতো বাবলা,খেঁজুরের গাছ দাঁড়িয়ে।সেসব ডিঙিয়ে ওরা মোষমরার চরে গিয়ে উঠল।টর্চের আলো পড়ছে এদিক-সেদিক।দলের মধ্যে বৃদ্ধ রমজান আলী আছে।বিচার-আচারের সভার মুখ্য ব্যক্তি সে।গিয়াসউদ্দিন মোল্লাকে উদ্দেশ্য করে সে বলে উঠল,গিয়াস ভাই,তুমি খুঁজে বের করো।কোন জায়গার কথা বলেছে পুষ্করের বউ?

গিয়াসউদ্দিন একাই হন হন করে এগিয়ে গেল।পশ্চিমদিকটায় বর্ষার জল পেয়ে প্রচুর ঘাস জন্মেছে।ঘাসের চটানেই নদীর কিনারা ঘেঁষে পড়ে আছে একটা কবর।পলিমাটি দিয়ে গড়া হয়েছে কবরটি।

ইমাম সাহেব কাছে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে পর্যবেক্ষণ করলেন।একে একে সবাই কবরটিকে গোল করে ঘিরে ফেলল।কবরের ভেতর অন্ধকারে শুয়ে থাকা মৃত মানুষটিকে নিয়ে অনেক কল্পনা-জল্পনা চলল।একসময় ইমাম সাহেব বললেন,এটা কোনও বড় মানুষের কবর নয়,আমার মনে হচ্ছে কোনও শিশুর কবর।

—ঠিকই বলেছেন জি।বড় মানুষের কবর হলে আরও লম্বা হত।

—শিশুর কবর হলে এতটা লম্বা করারই বা কী দরকার?

—অন্য কোনও কেস নয় তো?যদি কেউ খুনটুন করে নদীর চরে পুঁতে দিয়ে গেছে!

—তাহলে তো পুঁতে মাটি চাপা দিয়ে দিত।কবর বানানোর কী দরকার ছিল!

—প্রকাশ্য দিনের বেলায় একটা লাসকে বয়ে এনে এখানে কবর দিয়ে যাবে,এমন সাহস কার হবে?চরে কি লোকজন একদমই ছিল না?

—আরে মিঞা লাস বয়ে আনতে হবে কেন?ধরো খুনটা এখানেই করেছে।কোনও নারী সংক্রান্ত কেস।বা টাকাপয়সার ভাগাভাগি।

—আমার মনে হয় ইমাম সাহেবের কথাটাই ঠিক।রমজান আলী সবাইকে থামিয়ে দিয়ে আচমকা নিজের মত প্রকাশ করে,—হয়তো কোনো বাচ্চা মেয়ে শুয়ে আছে কবরের নীচে।চারিদিকে যা আকছার ঘটনা ঘটছে।কিছুদিন আগে শুনোনি তুমরা।জঙ্গলে শালপাতা কুড়োতে গিয়ে এক আদিবাসী মেয়ে একটা বাচ্চা কুড়িয়ে পেল।কারা যেন জঙ্গলে ফেলে দিয়ে গিয়েছিল।সারা গায়ে পিঁপড়ে ধরেছিল বাচ্চাটার,ভাগ্যিস চোখে পড়েছিল,তাই বেঁচে গেল মেয়েটা!

রমজান আলী কী ইঙ্গিত করতে চাইছে,তা কারও বুঝতে বাকি নেই।মালু সেখ কথার খেই ধরে বলল,বাচ্চা মেয়েই হবে এমন কোনও কথা নেই।ছেলেও তো হতে পারে।বিয়ের আগেই এখনকার ছেলে-মেয়েরা যা 'জেনা' করছে!কেউ যদি পেট খসিয়ে গেছে?

দলের মধ্যে বুজুর্গ মানুষরা এতক্ষণ কথা বলছিল বলে ছেলে-ছোকরারা চুপ করেছিল।তাদেরও কিছু বলার আছে।কৌতুহল আছে।কিন্তু তা প্রকাশ করার জন্য সাহসে কুলায়নি।আজফরের মেজো ছেলেটা কলেজের গন্ডী ছাড়িয়ে এবার চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।চোখে চশমা পরা ছেলেটা আর পাঁচজনের থেকে এমনিতেই চুপচাপ থাকে।তার মাথায় যে এমন একটা ভাবনা আসবে,তা কেউ কল্পনাও করেনি।হঠাৎ সে বলল,করোনার মরা নয় তো!ধরো নদীর ওপারের কোনও লাস।করোনায় মৃত বলে,লাসটা কেউ ছোঁয়নি।গ্রামের গোরস্থানে কবর দিতে দেয়নি।তাই নৌকায় এসে এপারে চুপিচুপি পুঁতে দিয়ে গেছে।

আজফরের ছেলের কথা শুনে সবাই কবর থেকে পিছিয়ে গেল কয়েক হাত।

কবরটিকে ঘিরে গভীর নীরবতা নেমে এল।ব্যাপারটার যে এমন একটা দিক ছিল,তা এতক্ষণ কারও মাথায় খেলেনি।কাহিনির একটা অন্য দিগন্ত খুলে গেল।এবার চলল নানাজনের নানারকম কথা।

একজন বলল,করোনায় মরলে তো লাশ দিচ্ছে না।হাসপাতাল থেকেই সৎকার করে দিচ্ছে।তাহলে লাশ পাবে কী করে!

আরও একজন সহমত প্রকাশ করল,হ্যাঁ ভাই,তাও তো বটে।যা ঘটছে এখন!কিছুদিন আগে কী করল বলত?

—তুই কোন কেসটার কথা বলছিস?

—ওই যে রে,হিন্দুর লাস ভুল করে কবর দিল,আর মুসলমানেরটা পোড়ালো।শালার কি কান্ড বলদিনি।

ছেলে-ছোকরাদের আলোচনা শুনে এখন সবার ধারণায় বদ্ধমূল হল,লাশটি কোনও সাধারণ নয়।করোনাতেই মৃত।তবে একটি বিষয় এখনও সবার কাছে অস্পষ্ট।তা হল,করোনার রোগী মরলে তো সহজে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেবে না।তাহলে ঘটনাটা কী?কে শুয়ে আছে কবরের নীচে?কোনও ধর্ষিতা নারী?কোনও অবৈধ শিশু?যেই শুয়ে থাকুক,সে যে ধর্মে মুসলমান এটাই সবাই নিশ্চিত।না হলে কবর দেবে কেন!তাই ইমাম সাহেব আর দেরি করলেন না।ঘোষণা করলেন,ভেতরে যেই শুয়ে থাকুক,আজ রাতের বেলা কিছু করা সম্ভব নয়।সকাল হোক।কাল এর কূলকিনারা হবে।নদীর ওপারেও খবর পাঠাতে হবে।এখন আমরা সবাই মৃত মানুষটির উদ্দেশ্যে দোয়া করব।সবাই চুপ করুন।

।।তিন।।

সকালবেলায় সারা চর জুড়ে মানুষের জটলা।মোষমরার চরে যেন মেলা বসেছে।শুধু এই গ্রামের নয়,আশেপাশের গ্রাম থেকেও অনেকে এসেছে সাইকেল,মোটরবাইক ছুটিয়ে।এমন একটি ঘটনা,এই এলাকায় কক্ষণও ঘটেনি।প্রবীণ বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা মাথা নেড়ে বলে,আজব কান্ডকারখানা বাপু!দ্যাশ-দুনিয়ার হলটা কী!গজব নামতে আর বেশি দেরি নাই।কাল কেয়ামতের দিন ঘনিয়ে এসেছে।

কবরটি দেখার জন্য অনেক মানুষের আনাগোনা।হিন্দুরা মন্দির দর্শনের মতো জুতো খুলে দূর থেকে দাঁড়িয়েই দেখে চলে আসছে।মুসলমানরা কপালে হাত ঠেকিয়ে সালাম করছে।নানাজনের মুখে নানারকম কথা।সেই এক-একজনের কথা নিয়ে চলছে তর্কবিতর্ক।ছেলে-ছোকরাদের ইচ্ছা কবরটি খোঁড়া হোক।মাটির তলে চিরনিদ্রায় শায়িত মানুষটি কে,সে দেখতে কেমন,নারী না পুরুষ, শিশু না বৃদ্ধ—তা জানার জন্য সবার মন উদগ্রীব।কিন্তু কবর খোঁড়ার কথা নিজের মনে এলেও তা কারও কাছে প্রকাশ করা যায় না।না জায়েজ কাজ!এমন কাজ করলে গোটা গ্রামে গজব নেমে আসতে পারে।যে নদীটিকে এত শান্ত দেখছ,তা খ্যাপা মোষের মতো গর্জন করে গ্রামকে গ্রাম গিলে নিতে পারে।ভূমিকম্পে সব উলটপালট হয়ে যেতে পারে।পোকায় মাঠের সমস্ত ফসল কেটে শেষ করে দিতে পারে।

কোথা থেকে খবর পেয়ে সাংবাদিক চলে এসেছেন।মানুষজনের গুঞ্জনটা হঠাৎ থেমে গেল।সবাই পায়ে পায়ে অগ্রসর হল কবরটির দিকে।ক্যামেরা ম্যান ফটাফট ছবি তুলছেন।ইমাম সাহেব দেখলেন ব্যাপারটা বেশ বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে।গ্রামের গোরস্থানের ঘটনা হলে,সাংবাদিক কেন!কোনও বেদাতিকেই না-পাক শরীরে প্রবেশ করতে দিতেন না।আসলে মোষমরার চরটা ঠিক জামবনির মৌজার মধ্যে পড়ে না।নদীর খামখেয়ালিপনায় জন্ম নিয়েছে চরটা।সরকারি ভেস্টের আওতায়।তাই নরম গলাতেই বললেন,এই যে ভাই,ফটো তুলছেন তুলেন।জুতোগুলো খুলে যান।মৃত মানুষের সমাধি।

ক্যামেরা ম্যানের ততক্ষণে ছবি তোলা হয়ে গিয়েছে।ইমাম সাহেবের কথা শুনে বললেন,স্যরি স্যরি!কিছু মনে করবেন না।একদম খেয়াল ছিল না।

এবার ক্যামেরার ফোকাসে নেওয়া হল ইমাম বারাকতুল্লাহকে।শুধু কি তিনি?পেছনে আরও অনেক মুখ।ভিড়টা ক্রমশ যে হারে সকাল থেকে বাড়ছে,মোষমরার চরটাই না বুঝি ধ্বসে নেমে যায় নদীতে!

সাংবাদিক ছেলেটি ইমামের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন,কবরটি কারা দিয়ে যেতে পারে বলে মনে হয় আপনার?

ইমাম সাহেব বললেন,দেখুন সেটা জানলে এত কান্ড হবে কেন!তবে আমাদের জামবনির কেউ নয়,এটাই আমরা নিশ্চিত!

—এতটা নিশ্চিত হচ্ছেন কী করে?

—কবরটা দেখেই বুঝতে পারছেন কাল দিনের বেলা দেওয়া।গ্রামের কেউ হলে সেটা কি দিনের আলোয় সম্ভব?

সাংবাদিক এবার ক্যামেরার দিকে ঘুরলেন,—আপনারা এতক্ষণ শুনছিলেন জামবনির ইমাম সাহেবের কথা।দর্শক,এখানে যা কিছু ঘটছে,আজ আমরা একদম সরাসরি লাইভ দেখাব আপনাদের।আমাদের সঙ্গে থাকুন।

জামবনি ছাড়াও পাশের গ্রাম শিতলপুর ও ঝুঁঝকিডাঙা থেকে এসেছেন বেশকিছু প্রবীণ মানুষ।তিন গ্রামের মাতব্বররা মূলস্থান থেকে সরে এসে একটা গাছের তলায় পরামর্শ করতে বসলেন।

শিতলপুরের এক ব্যক্তি বললেন,ব্যাপারটা আমাদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।সাংবাদিক যখন এসেছে,এটাকে নিয়ে অনেক জলঘাটা হবে।তার আগেই একটা ব্যবস্থা করতে হবে।

—কী ব্যবস্থা করবেন আপনি?কবরটিকে তুলে নিয়ে গিয়ে গ্রামের গোরস্থানে বসাবেন?তার থেকে ছেড়ে দিন না,যা পারে করুক।ঝুঁঝকিডাঙার একজন নেতাগোছের লোক নিজের মত প্রকাশ করেন।

ইমাম সাহেব প্রতিবাদ করে উঠলেন ঝুঁঝকিডাঙার লোকটির কথাতে,—আপনি একদম বত্তামিজের মতো কথা বলছেন মশাই।ছেড়ে দেব মানে!জানেন এর পরিনতি কি হবে?

ইমামকে সাপোর্ট করল শিতলপুরের একজন,—কথাটা ঠিকই বলেছেন আপনি।ব্যপারটা প্রশাসনের আওতায় চলে গেলে কবর থেকে লাশ তুলে বের করবে।পোস্টমর্টেম-এ পাঠাবে।এগুলি করতে দেওয়া কি ঠিক হবে?কবরের নিচে যেই থাকুক,সে তো একজন মুসলমান।মুসলমান হয়ে একজন মুসলমানের লাশ নিয়ে এমন টানাহেঁচড়া করতে দেব কেন?

—হ্যাঁ দেব কেন! আরও একজন উসকে দিল শিতলপুরের লোকটিকে।

—এই চিন্তাভাবনাগুলো এবার ছাড়ুন তো!কোনও খুন খারাপির কেসও তো হতে পারে।আমাদের ভুলে একজন অপরাধী হয়তো বেঁচে যাবে।তাতে আরও পাঁচটা মানুষের প্রাণ যাবে।

ইমাম সাহেব এবার চটে গেলেন,আপনি কি কবর খোঁড়ার পক্ষে মশাই?কী বলতে চাইছেন আপনি?

সবাই হৈ হৈ করে উঠল।নেতাগোছের লোকটিকে মারার জন্য উদ্যত হল।এমন সময় মোষমরার চরকে কাঁপিয়ে একটা গাড়ির গর্জন ভেসে এল।সবাই তাকাল সেদিকে।নেতাগোছের লোকটি বললেন,ওই দেখুন,পুলিশ এল।এবার আটকান।

।।চার।।

পথ ছাড়ুন,পথ ছাড়ুন।কেউ অযথায় ভিড় করবেন না।

থানার বড়বাবু নন্দলাল গূহ রুল দিয়ে দু'-পাশ ফাঁকা করতে করতে এগিয়ে গেলেন কবরটির কাছে।পেছন পেছন আরও দু-জন কনস্টেবল।

বড়বাবু কবরটির চারপাশ ঘুরে ফিরে পর্যবেক্ষণ করলেন।বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে ওনাকে।প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরালেন তিনি।খানিক পায়চারি করার পর কাকে যেন ফোন লাগালেন।

জনতার ভিড় লাগামছাড়া হয়ে উঠছে।এখন শুধু একজন নয়,বেশ কয়েকটি চ্যানেল থেকেই সাংবাদিক এসেছেন।একটু বেলার দিকে মোষমরার চরে এস.পি সাহেবের গাড়ি এসে থামল।

এস.পি সাহেব সব দেখেশুনেও নিজে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন না।ব্যাপারটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ধর্মীয় আবেগ।তাই ডি.এমের সঙ্গে একবার ফোনাফোনি আলোচনা করে নিলেন।তারপর জানালেন,কবরটি খোঁড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।না হলে এর কূলকিনারা হবে না।

ক্যামেরার ফোকাস এখন কবরের দিকে।থানার বড়বাবু কবর খোঁড়ার ব্যবস্থা করলেন।ভিড়টা এখন মূল দৃশ্যে উপচে পড়তে চাইছে।কনস্টেবল দু'জন বার বার চিৎকার করে উঠছেন,এখানে ভিড় করবেন না।সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন।

কনস্টেবলের ধমক খেয়ে ভিড়টা একটু পিছিয়ে যায় কয়েক মিনিটের জন্য।এক-পা দু'-পা করে এগোতে এগোতে আবার যে কে সেই।একজন সাংবাদিক ফলাও করে বলে উঠলেন,আপনারা কেউ নিরাস হবেন না।যারা দেখতে পাচ্ছেন না,বাড়িতে গিয়ে টিভি খুলুন।আমাদের চ্যানেলে সরাসরি লাইভ দেখানো হচ্ছে।

কবরটি ভিজে কাদামাটি দিয়ে তৈরি।তাই মাটি খুঁড়তে বেশি বেগ পেতে হচ্ছে না।কোদালের চোটে খুব সহজেই সরে যাচ্ছে নরম মাটি।যারা ভিড়মিড় ঠেলে কবরের ধারেপাশে আসতে পেরেছে,তাদের চোখ টান টান।কেউ চোখের পলক ফেলছে না।চোখ বুজলেই যদি কোনও মহামূল্যবান দৃশ্য থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ে!তা কেউ হতে দেবে না।এই ঐতিহাসিক ঘটনার সবাই সাক্ষী থাকতে চায়।

কবরের মাটি প্রায় সরানো হয়ে এসেছে।কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনও বাঁশের দেখা মিলল না।মাটিতে খাল কেটে মৃতদেহকে কাফনে মুড়ে শোয়ানো হয়।তারপর খালের ওপর সারি সারি কাঁচা বাঁশ চাপিয়ে আড়াল করে,খড় দিয়ে ছিদ্রগুলো ঢেকে মাটি চাপানো হয়।মাটির নিচে কোনও বাঁশ দেখতে না পেয়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল কবর খোঁড়ার লোকটি।এস.পি সাহেব ধমক দিয়ে উঠলেন,খোঁড়ো খোঁড়ো,আরও তলা অবধি খোঁড়ো।

আরও কিছুটা খুঁড়তেই কোদালটি গাছের ডালে লেগে ঠং শব্দ করে উঠল।বাঁশের বদলে নদীর আশেপাশের গাছের ডালপালা দিয়ে কাজ সেরেছে।এবার একে একে ডালপালাগুলি সরানোর পালা।তাহলেই মূল রহস্য উন্মোচন হবে।সবাই উত্তেজনায় টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে।গাছের ডালগুলি সরাতেই কবর খোঁড়ার লোকটি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।উঁকি মেরে দেখার পর বড়বাবু,এস.পি সাহেব সবাই হতভম্ব।কারও মুখে কোনও কথা নেই।যাদের নজর খালের তলা অবধি যাচ্ছে না,তাদের কৌতূহলের পারদ চড়চড় করে উপরে উঠছে।নীরবতা ভঙ্গ করে জনতার মধ্যে থেকে একজন বলে উঠল,কী আছে খালে?কথা বলছেন না কেন আপনারা?আমাদের দেখতে দিন।

জনতার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতে বসেছে।পেছন থেকে ঠেলাঠেলি আরম্ভ হয়েছে।পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য বড়বাবু এবার ঘোষণা করলেন,কবরের নীচে কোনও মানুষের লাশ নেই।

—লাশ নেই মানে!তবে কী আছে?

—একটা মরা পাখি পড়ে আছে।

—মরা পাখি!

কেউ বিশ্বাস করতে চাইলো না কথাটা।সবাই নিজের চোখে উঁকি মেরে দেখতে চায়।

বড়বাবু চিৎকার করে উঠলেন,আস্তে,আস্তে।কেউ হইহট্টগোল করবেন না।সবাই একে একে দেখে যান।

ভিড় ঠেলে বেড়িয়ে পড়লেন অফিসাররা।

পাখিটিকে দেখার জন্য বেশ ঠেলাঠেলি লেগে গেছে।মৌষমরার চর জুড়ে আবার গুঞ্জন উঠল।কবরের নিচে পাখি কেন বেরল?পাখি কি কবর দেওয়ার জিনিস!কেই বা কবর দিল?যাদের দেখা হয়ে গেছে,তারা এখন নিজেদের মধ্যে তর্কবিতর্ক করতে করতে বাড়ি ফিরছে।কেউ বলল,এটা মনে হচ্ছে কোনও দুষ্টু রাখাল বালকদের কাজ।গরু চরাতে এসে কাজটি করে গেছে।

তর্কবিতর্ক যখন চরম পর্যায়ে পোঁছেছে,তখন একজন বলল—আচ্ছা,এটা সেই পাগলটার কাজ নয় তো!

ছেলেটির কথা শুনে এবার পাগলটির কথা মনে পড়ল অনেকের।সত্যিই তো,এতক্ষণ এই কথা কারও মাথাতেই আসেনি।এটা নির্ঘাত সেই পাগলটারই কাজ।পশুপাখি নিয়েই তো তার কারবার।খোঁজ খোঁজ,শালাকে খোঁজ।পেলে আজ মাথা ফাটিয়ে দেব।সঙ্গে সঙ্গে পাগলটির খোঁজ পড়ে গেল।

বেশকিছুদিন হল এই এলাকায় ঘাঁটি গেড়েছে পাগলটা।মাঝেমধ্যেই তাকে দেখা যাচ্ছে।কোথায় ঘোর-দোর তা কেউ জানে না।এর-তার কাছ থেকে পয়সা চেয়ে চেয়ে পাগলটা দোকান থেকে খাবার কিনে পশুপাখিদের খাওয়ায়।গাছের তলে,দোকানের শেডের নীচে শুয়ে থাকে।একদিন ইলেক্ট্রিক তারে শক খেয়ে মরে যাওয়া একটা কাকের জন্য তাকে কাঁদতেও দেখা গিয়েছিল।

একজন প্রশ্ন করে উঠল,পাগলটা পাখিকে কবর দিতে যাবে কেন!তাহলে কি পাগলটা মুসলমান?

গুঞ্জন থামছে না।তর্কবিতর্ক বেড়েই চলে।

ধীরে ধীরে মানুষের ভিড় কমতে কমতে মোষমরার চর শুনশান হয়ে পড়ল।আবার গুটি গুটি পায়ে নেমে এল সেই আগের নির্জনতা।এমন নির্জন পরিবেশেই আচমকা ঝোপঝাড় মাড়িয়ে একটা লোক চুপিসারে বেরিয়ে এল।উসকোখুসকো চুল,ময়লা তেলচিটে জামাপ্যান্ট।না খেতে পাওয়া কঙ্কালসার চেহারা।লোকটা চারিদিকে চাইতে চাইতে খুব ভয়ে ভয়ে কবরটির কাছে এগিয়ে গেল।ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল লোকটা।ওর কান্না কেউ শুনল না,আওয়াজটা মোষমরার চরের মধ্যেই মিলিয়ে যাচ্ছিল।

 

লেখক পরিচিতি:
হামিরউদ্দিন মিদ্যা
গল্পকার।
পশ্চিমবঙ্গ, বাঁকুড়ায় থাকেন।
প্রকাশিত বই: আজরাইলের ডানা(সৃষ্টিসুখ প্রকাশনী), মাঠরাখা(সোপান প্রকাশনী)

 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ