হাসান মাহবুবের গল্প: অন্ধজনা




১.


তার চোখ দুটি বাঁধা। ঘন্টাখানেক ধরে তার চোখে শল্যকার্য চলেছে। কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের। কোন এক মহৎ ব্যক্তির মরণোত্তর চক্ষুদানের বদৌলত সে ফিরে পেতে যাচ্ছে তার দৃষ্টিশক্তি। বহুদিন যাবৎ সে ঘুমিয়ে ছিল উইপোকার স্বপ্নের ভেতরে। সমস্ত উইপোকাই জন্মান্ধ। মানুষের মধ্যেও কেউ কেউ হয় জন্মান্ধ। তবে তারা পূর্বপুরুষের দেখার অভিজ্ঞতা জিনে বহন করে। পরিপার্শ্বের বদৌলতে জানে আকৃতি, শোনে রং, অনুভব করে আলো। উইপোকাদের কেউ কখনও চোখে দেখে নি। তাদের স্বপ্নের মত বিচিত্র বিমূর্ততা কি মানুষের পক্ষে বহন করা সম্ভব? তবুও দৃষ্টি হারানোর বেদনা আর জীবনের বিবিধ যন্ত্রণা হয়তো তাকে নিয়ে গিয়েছিল মনুষ্যজীবনের অর্জিত হাহাকারের উচ্চতম চূড়ায়। সেখান থেকে উইপোকারা তাকে নিয়ে গিয়েছিল এক গাঢ় কালো স্বপ্নের জগতে, যেখানে মনের ভেতর বন, বনের ভেতর পাথর, পাথরের ভেতর শূন্যতা। তার ভেতরে কি সেটা হয়তো জানে কোন শোকার্ত সজারু, যার শরীর থেকে একে একে সবগুলি কাঁটাগুলি তুলে নিয়েছে কোন দুর্দান্ত শিকারী। মানুষ নিজেদের অনুভূতির বোঝা টানতেই এখনও সক্ষম না। তারা কীভাবে উইপোকা, সজারু অথবা চোষক মাছের অনুভূতি ধারণ করবে? অনির্দিষ্টের দিকে চেয়ে থাকার মত ভঙ্গি করে আর অতলে হারিয়ে যাওয়ার ভয়ার্ত অনুভূতি নিয়ে লোকটা বেঁচে থাকতো। তার আশেপাশে ছিল স্বজনেরা, তার জন্যে বরাদ্দ ছিল ভালো খাবার, পোষাক আর সঙ্গীত। তবুও তার মনে হতো নিজেকে সে হারিয়ে ফেলছে উইপোকার স্বপ্নের ভেতরে। অন্ধ মানুষের ইন্দ্রিয়গুলি না কি বাড়তি সুবিধা পায়। বাড়তি ঘ্রাণ, বাড়তি শ্রবণশক্তি। সে এসবের কোন পরোয়া করে নি। সে শুয়ে থাকতো মৃতের মত। তাকে নিতে হতো বিষণ্ণতা নিরোধক বড়ি। তার মরে যেতে ইচ্ছা করতো অক্ষমতা আর বেদনায়। পৃথিবীতে অলৌকিক ঘটনা ঘটে না এই ছিল তার ঐকান্তিক ধারণা। তাই সে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবার আশা কখনও করে নি। তার মনে হতো সে হয়তো ইতোমধ্যেই মৃত, এবং নরকযাপন করছে। তাই আর আলাদা করে মরে যাওয়ার ইচ্ছা হতো না। শুধু জানতো সে, আঁধারের মধ্যে বসবাস শেষে তাকে যাবার চলে যেতে হবে আঁধারগহবরেই। আঁধার থেকে আঁধারের এই ক্রান্তিকালীন যোগাযোগের মধ্যে সে পড়ে থাকতো বড়শিতে গাঁথার জন্যে একথালা কেঁচোর ভেতরের অণুজীব হয়ে। তারপর আজ, চোখ বাঁধা অবস্থায় সে অপেক্ষা করছে এক ঝলক আলোর জন্যে। কর্নিয়া প্রতিস্থাপন সম্পন্ন হয়েছে। 
 
সিনেমায় যেমন দেখায়, অপারেশনের পর চোখের ব্যান্ডেজ ধীরে ধীরে খুলে দেওয়া হয়, কিছুক্ষণ চোখ পিটপিট করার পর অন্ধজনা উচ্ছ্বাসে আপ্লুত হয়ে চিৎকার করে ওঠে, “আমি সব দেখতে পাচ্ছি” ব্যাপারটা ঠিক এমন না। অপারেশন শেষ, এখন তাকে পুরো একদিন চোখে পড়ে থাকতে হবে পট্টি। তার চোখ ব্যথা করবে। চোখ জ্বলবে। এরপর পট্টি খুলে দেওয়ার পর কিছুদিন পরে থাকতে হবে চশমা। এর মধ্যে ধীরে ধীরে সে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবে। চোখের ব্যান্ডেজ খুলে দেওয়ার সাথে সাথেই চারপাশে দৃশ্যরা স্বাগত জানাবে না। পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে লাগতে পারে কয়েক মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত। তা লাগুক। সে অপেক্ষা করতে পারবে। এই অপেক্ষায় সে ক্লান্ত হবে না। আচমকা মোটর দুর্ঘটনায় আহত হয়ে সম্পূর্ণ দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলার পর অন্ধজীবন শুরু হবার অনেকদিনের মধ্যে সে জানতোই না কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে তার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়া সম্ভব। এটা জানার পর যেটা হলো তা হচ্ছে, এই আশাটাকে সত্যি করা আরো বেশি দুঃসাধ্য মনে হতে লাগলো। কারণ খুব কম মানুষই কর্নিয়া দান করে। আর কেউ যদি মরণোত্তর চক্ষুদানের অঙ্গীকার করেও থাকে, মৃতের পরিবার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সমাধিস্থ করার পর চোখ নিতে দেয় না। তাই একটা সুস্থ সবল কর্নিয়া পেলে চোখটা বাঁচানো যাবে এই আশার আলোও ধীরে ধীরে নিভে যেতে লাগলো। 
 
তারপর হঠাৎ! লোকটার কোন এক আত্মীয়ের সাথে অন্ধ কল্যাণ সমিতির কারোর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কসূত্র আবিষ্কৃত হলো, এবং সে কথা দিলো যে একটা কর্নিয়ার ব্যবস্থা করে দেবে। কর্নিয়া তো আর গাছে ধরে থাকা পাকা ফল না যে যাবে আর পেড়ে এনে দেবে! অপেক্ষা করতে হলো দীর্ঘ এক বছর। অবশেষে অপারেশন সম্পন্ন হলো।


২.
প্রত্যাশিত সময়ের চেয়ে দ্রুতগতিতে তার চোখের উন্নতি হতে লাগলো। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও তেমন দেখা দিলো না। সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে লাগলো। চক্ষুদানকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতায় অনেকদিন বিভোর হয়ে থাকলো সে। জীবনকে মনে হতে লাগলো সুবর্ণরেখা ধরে আলোকবৃক্ষের দিকে প্রিয় পদরেখা ছুঁয়ে অবিরাম এগিয়ে যাওয়ার মত সুন্দর। তারপর একসময় সে ফিরে পেতে লাগলো যাপিত জীবনের সাধারণ বেদনা, ক্ষোভ, জিঘাংসা। তাকে আবারও জেঁকে ধরলো বিষণ্ণতা। শরণাপন্ন হতে হলো মনোচিকিৎসকের। কীসের এত দুঃখ লোকটার? কীসের এত বেদনা তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যায় আলো থেকে অন্ধকারে, আবার আলোতে? তার মনে পড়ে বহুদিন আগের এক বিকেলের কথা। বারবার মনে পড়ে। সেদিন একটা লাল ফ্রক পরে চুলে দুই ঝুঁটি করে নাচতে নাচতে বাইরে গিয়েছিল তার কন্যাসন্তান। বয়স তার ছয়। যাবার আগে ঘাড় বাঁকা করে তার কাছে অনুমতি প্রার্থনা করেছিল।

-বাবা, যাই?

-যাও মা। মাগরিবের আজানের আগে ফিরে এসো।

এই ছিল মেয়ের সাথে তার শেষ কথা। পরের দিন তার মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায় নর্দমার মধ্যে। নগ্ন আর রক্তাক্ত। আর সেইদিন থেকে হঠাৎ করে উধাও হয়ে যায় সন্দেহভাজন এক প্রৌঢ়। অনেকেই তাকে বলতো পাগলাটে, অনেকেই বলতো বিকারগ্রস্ত। তাকে কেন প্রায়ই বিকেল বেলা বাচ্চাদের খেলার স্থানে ঘাঁপটি মেরে থাকতে হতো এ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় নি। তার আকস্মিক অন্তর্ধানে তাকে সেই সময় ঘটে যাওয়া দুঃখজনক ঘটনার জন্যে সন্দেহভাজন হিসেবে গণ্য করা হয়, এবং যাবতীয় লক্ষণ বিচার এবং এ্যালিবাই নিরীক্ষণ শেষে এই উপসংহারে সবাই পৌঁছোয় যে সেই জঘন্য কর্মটা ঘটিয়েছে।


৩.

এরপর দীর্ঘ দশটি বছর কেটে যায় পাথুরে বিষণ্ণতায়। লাল ফ্রক পরে লাল কৃষ্ণচূড়ার দেশে চিরকালের জন্যে চলে যাওয়া মেয়েটার বাবা শুধু একটা ইচ্ছা নিয়েই বেঁচে ছিল, প্রতিশোধ। নির্মম, নিষ্ঠুর, জঘন্য প্রতিশোধ। কিন্তু খুনী যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো! অনেক খুঁজেও তাকে আর পাওয়া গেলো না। একটা সময় সে হাল ছেড়ে দিলো। ধরেই নিলো এই বঞ্চনাময় জীবনই তাকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে ভারবাহী পশুর মত। ভেবেছিল এর চেয়ে নিম্নতম প্রকোষ্ঠে মন নামক হিরামন পাখির পক্ষে বন্দি হওয়া আর সম্ভব না। অন্ধত্ব তার ভুল ভাঙিয়ে দিলো। মাঝেমধ্যে তার এই ভেবে অনুশোচনা হতো যে সন্তানের হন্তারকের জীবন সংহারের ইচ্ছার চেয়ে অন্ধত্ব থেকে মুক্তিই তার কাছে বেশি প্রার্থিত হয়ে উঠছে কি না! কিন্তু তা স্থায়ী হতো না। অন্ধত্বের অক্ষমতা আর সন্তানের মৃত্যুর শোক এই দুই অপঅনুভূতির মধ্যে তাকে নিয়ে যেন লোফালুফি করছিল কোন সহিংস দানব। মাঝেমধ্যে নিজেকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করতো এই ভেবে, তার কন্যার হন্তারকের বিভৎস কোন মৃত্যু হয়েছে এ সংবাদ এসে গেছে তার কাছে। সে এও ভাবতো, যদি তাকে একটিবার কেউ সুযোগ দেয় শাস্তি দেওয়ার, তাহলে সে কী করবে! হত্যা তার কাছে লঘু শাস্তি মনে হতো। যদি সম্ভব হতো, সে তার প্রতিটি অঙ্গে বিঁধে দিতো তীক্ষ্ণ বর্শা। যদি তাকে সুযোগ দেওয়া হতো একটি অঙ্গে আক্রমণ করার, সে বেছে নিতো তার চোখ। অন্ধজনার চেয়ে অধিক অভিশপ্ত আর কেউ কি হতে পারে?

সে দেয়ালে ঝুলিয়ে রেখেছিল তার মেয়ের ছবি। ব্যান্ড দিয়ে শক্ত করে বাঁধা চুল। যেন মাথায় শিং গজিয়েছে। বড় বড় দুটি চোখে অতলান্তিক বিস্ময় নিয়ে সে তাকিয়ে আছে শত অনুযোগ নিয়ে।

-কেন আমাকে বাঁচাতে পারলে না তুমি বাবা? কেন আমাকে পাহারা দিয়ে রাখলে না? কেন দুষ্টুলোকটাকে পালিয়ে যেতে দিলে? তুমি কি দেখোনি আমার গলায় বিছুটি পোকার মত সেঁটে ছিল শক্ত আঙ্গুলের করাল দাগ? লোকটা আমাকে অনেক ব্যথা দিয়েছিল বাবা। অনেক কষ্ট দিয়েছিল। আমি ছুটে যেতে চেয়েছিলাম তোমার কাছে। কিন্তু আমার ছোট ছোট পা দিয়ে আর কতদূর দৌড়োনো যায় বাবা? কেন আমাকে তুমি দিলে না পঙ্খীরাজের ডানা? কেন আমাকে তুমি দিলেনা শ্বাপদের নখর? কেন আমাকে তুমি দিলে না মহিষের শিং? আমি দুষ্টুলোকটাকে আঁচড়ে, কামড়ে, গুঁতিয়ে বের হয়ে যেতে পারতাম তাহলে।

লোকটা থরোথরো করে কাঁপে। হাতজোড় করে অনুনয় করে। “থামো মা। প্লিজ থামো। আমি ছিলাম অতি সামান্য এক পিতা। আমি তো ঈশ্বর নই। এই যে তুমি ঈশ্বরের ফুলবাগানে খেলে বেড়াচ্ছো এখন, আমার নামে বিচার দিও তার কাছে। ঠিক আছে? 
 
লোকটার ইচ্ছে করে পালিয়ে যেতে। কিন্তু কোথায় পালাবে? ঢাকা থেকে নরসিংদী? নরসিংদী থেকে জামালপুর? জামালপুর থেকে পঞ্চগড়? সেখান থেকে নেপাল, ভারত, ভুটান, আফগানিস্তান…

ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, মেসিডোনিয়া…

আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, এন্টার্কটিকা…
 
কোথাও গেলে কি এই যন্ত্রণার অবসান ঘটবে? কোন মানচিত্রে আছে কি এই ব্যথার নিদান? যদি সে পেরিয়ে যেতে পারতো সপ্ত আসমান, যদি সে কুঁচকে দিতে পারতো স্থান-কালের পর্দা, যদি সে তলিয়ে যেতে পারতো কৃষ্ণগহবরে, তবে কি এই যন্ত্রণার অবসান ঘটতো?

 
৪.

সময় পেরিয়ে যায়। বয়স বাড়ে। তার জীবনের গভীর ট্র্যাজেডি ফিকে হয়ে আসতে থাকে। সে এখন প্রতিদিন পার্কে গিয়ে দৌড়োয় সকালে। আরো বেশিদিন সুস্থভাবে বাঁচার ইচ্ছা করতে খুব একটু আপত্তি হয় না তার। পেশীগুলিকে জাগিয়ে তুলতে হবে। হৃৎপিন্ডটাকে সচল করতে হবে। বাঁচতে হবে আরো অনেক দিন। বাঁচার ভীষণ লোভ তার। দৌড়ুতে দৌড়ুতে সে দেখে ফিঙে পাখির অবাধ উড়াল, কামরাঙা গাছের শিশিরসিক্ত টসটসে ফল, মেটে লাল রঙের সিমেন্টের চাতাল, সাদাকালো ট্রাউজার আর নীল জার্সি পরে জগিং করা যুবক, ঘাসের সাথে লুকোচুরি খেলা ফড়িং আর ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা বৈদ্যুতিক পিলারকে। দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবার পর তার চোখে রংগুলি যেন নতুনভাবে ধরা দেয়। স্বচ্ছ আর ঝকঝকে। আশেপাশে ঘুরে বেড়ানো প্রাণীসব যেন আরো জীবন্ত, আরো নাটকীয়। আধাঘন্টা দৌড়ে সে একটা বেঞ্চে বসে। সে মানুষ দেখে, পাখি দেখে, গাছপালা দেখে, ইট-পাথর দেখে। শুধু দেখেই তো এক জীবন পার করে দেওয়া যায়! জীবনকে ভালো লাগে তার। ভালো লাগে সময়ের আলপথ ধরে হেঁটে যেতে। গন্তব্য নিয়ে তেমন ভাবে না। গন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। তার সাথে দেখা হয় পুরোনো এক বন্ধুর। অনেক বছর পর দেখা হলো। বন্ধুটি জানতো না যে তার চোখ ঠিক হয়ে গেছে। সে বিস্ময় প্রকাশ করে। অন্ধ হবার পরেও যে দৃষ্টি ফিরে পাওয়া সম্ভব এই তথ্য তার জানা ছিল না। তারপর যখন সে শোনে মহৎজনেরা কর্নিয়া দান করে থাকলে তা দিয়ে অন্ধজনার চোখের দৃষ্টি ফিরে আসা সম্ভব, তখন সে বিগলিত হয়ে তাকে স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে বলে। ধর্মপ্রাণ সেই ব্যক্তিটির মতে, তার নিয়মিত প্রার্থনা করা উচিত চক্ষু দানকারীর জন্যে। কথাটা মনে ধরে তার।

সেদিন দুপুরে, রোদ মরা বিকেলে এবং রাতে সে চক্ষু দানকারী লোকটার জন্যে প্রার্থনা করে। দীর্ঘক্ষণ ধরে প্রার্থনা এবং স্রষ্টার কাছে নিজেকে সমর্পণের ফলে লোকটার মনের মধ্যে প্রশান্তি কাজ করলো। ঈশ্বরের ওপর রাগ করে সে যাবতীয় প্রার্থনাকর্ম থেকে নিজেকে বিরত রেখেছিল। তার মেয়েকে কেড়ে নেয়ার জন্যে সে ঈশ্বরকেই দায়ী করতো। পৃথিবীতে ভয়াবহ অবিচারের সম্মুখীন হওয়া তার কন্যার জন্যে ফের দুঃখ বলক দিয়ে ওঠে। পাথর হৃদয় ফেটে প্রবাহিত হয় কষ্টের বিশুদ্ধ অশ্রূজল। প্রাণভরে কেঁদে সে নিজেকে হালকা করে। সেইদিন রাতে সে অনুধাবন করে যে জীবনে প্রতিশোধের স্পৃহা নিয়ে বেঁচে থাকা কোনকিছুই ফিরিয়ে দেয় না। পৃথিবীতে মন্দের বিপরীতে সমপরিমাণ ভালো কাজ ঘটে। কারো বুকে জমা হয় বেদনার পাথর তার বিপরীতে কেউ ভেসে যায় আনন্দের ফল্গুধারায়। পথ চলতে কারো পায়ে আটকায় পেরেক, কারো পা ধুয়ে দেয় স্বর্ণাভ শিশির।

লোকটা সেদিন অনেকদিন পর সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখলো। তার কন্যা, লাল ফ্রক পরা, রক্তাক্ত এবং মৃত নয়। লাফিয়ে বেড়াচ্ছে স্বর্গের বাগানে। তার হাত ধরে আছে অচেনা একজন। তার মুখের জায়গায় একটা চাঁদ বসানো। তার মেয়েটাকে নিয়ে যাচ্ছে স্বর্গের ছায়াবীথির গহীনে। এই লোকটা নিশ্চয়ই সেই চক্ষু দানকারী মহান ব্যক্তিটি হবে, সে ভাবলো! মেয়েকে হাসিখুশি অবস্থায় স্বপ্নে দেখে ঘুম ভাঙার পর তার চোখ দিয়ে খুব মৃদুগতিতে গড়িয়ে পড়লো আনন্দের অশ্রূ। সে আবারও ধন্যবাদ জানালো ঈশ্বরকে এবং ঐ ব্যক্তিটিকে।

পরিশিষ্ট
 
লোকটা বসে আছে একটা অন্ধকার ঘরে। তার হাতে একটা দীর্ঘ সূচালো ধাতব বস্তু। অন্ধ কল্যাণ তহবিলে কাজ করা তার সেই আত্মীয়ের মাধ্যমে সে জানতে পেরেছে তাকে চোখ দানকারী ব্যক্তির নাম। আরো কিছু অনুসন্ধান করে নিশ্চিত হয়েছে লোকটা সম্পর্কে, যে তার জীবনে এনে দিয়েছিল ভয়াবহ বিষাদের সেই বিকেল। এই লোকটিই তার কন্যাকে নিয়ে গিয়েছিল মহল্লার নির্জনতম কোণে। তারপর ধর্ষণ করেছিল। তারপর ফেলে রেখেছিল নর্দমায়। বিবস্ত্র। রক্তাক্ত। লোকটার মনে পড়ে, তার অন্ধ থাকার সময়ে সে প্রতিজ্ঞা করেছিল, তার মেয়ের হন্তারককে একবার পেলে তার চোখ গেলে দেবে। এখন তার সামনে সুবর্ণ সুযোগ প্রতিশোধ নেবার। সেই চোখের দৃষ্টি এখন সে বয়ে নিয়ে বেরাচ্ছে। অথচ সে এতদিন যাবৎ প্রার্থনা করেছে তার মেয়ের হন্তারকের জন্যে।প্রার্থনা করেছে তার মেয়েকে স্বর্গের উদ্যানে সেই লোকটি পথ দেখাবে।এসব ভাবতে ভাবতে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় সে দীর্ঘ,সূচালো ধাতব বস্তুটিকে নিজের চোখের কাছে নিয়ে আসে।
 
পাশের বাসার বেঁতো রোগী বৃদ্ধ হঠাৎ তীব্র চিৎকার শুনে ঘুম ভাঙার কারণে গালাগাল করতে থাকে শব্দের উৎসের দিক। সেই শব্দ ৩৩০মিটার/সেকেন্ড গতিতে ছুটতে থাকে। সপ্ত আসমান পার হয়ে যাবার প্রতিজ্ঞা তার। কিন্তু গোত্তা খেয়ে পড়ে যায় কংক্রিটে কংক্রিটে ধাক্কা লেগে।

 


লেখক পরিচিতি:

হাসান মাহবুব  

মূলত ছোটগল্প লিখে থাকেন। সপ্তাহে ছয় দিন বাসে করে অফিসে যান, বাসায় ফেরেন।  বাসায় আছে স্ত্রী, পুত্র, কন্যা এবং বিড়াল। আর আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছে এ্যাংজাইটি। তার শহর ছেড়ে গ্রামে খামারবাড়ি করার ইচ্ছে নেই। দূরদেশে গিয়ে পাহাড়, পর্বত, জলপ্রপাত দেখার উৎসাহ নেই। এই অবরুদ্ধ শহরে বসে গল্প লেখাই নিয়তি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ