উপল মুখোপাধ্যায়ের গল্প: ভ্রমণ কাহিনি



১.
মাদের অসংখ্য জায়গায় থাকতে হবে বলে বাবাইকে ফোন করেছিলাম। বন দেখতে গিয়েছিল বলে বাবাই হতাশ হয়েছে। চারদিকে গোলমাল ও বন দেখতে পায় না। বৃষ্টি হয়, মেঘ ধুয়ে আসে, আকাশ পরিষ্কার হবে। যেই আকাশ পরিষ্কার হল অনেক ওপার থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা গেল। কেন যে ও সব বলে- ইংরিজিতে বলে। কী সব নাম দেয়। “ তার চেয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘাই ভালো। ” বাবাই বলল। কেন বাবাই এ রকম কথা বলে। কেন সে বন দেখতে গিয়ে বিরূপ হয়। কেন সে আরো ভালো ভাবে বন দেখতে চেয়ে লেন্স কিনতে যায়। লেন্সের দাম তিন লক্ষ চার লক্ষ টাকা। ক্যামেরাও দাম দিয়ে তবে কিনতে হবে। বাবাই বেশি বেশি মাইনে পায় না কেন? সে একটি স্কুটি কিনেছে। সেটি নিয়ে সে পাপরখেতি গিয়েছিল। পাপরখেতি পর্যন্ত পাহাড় বলা যায় না। সে পাহাড়ে যাবে না। সে পাপরখেতি যাবে স্কুটি নিয়ে- বাবাই। বাবাই বলল,“তোমরা অনেক জায়গায় থাকতে পার। ”
—— পারি?
—— হ্যাঁ , তিন জায়গায় থাকতে পার , চার বা পাঁচ।
—— ছয়, সাত তাও পার।
—— আর না।
—— তবে থাক। তোমরা তিন জায়গায় থেক।
আসলে আমরা পাঁচ জায়গায় থেকে ছিলাম। সবটা বাবাই জানে না। বাবাইয়ের সঙ্গে কথা বলে গোপালদার সঙ্গে কথা বলেছিলাম। গোপালদার সঙ্গে কথা বলে দেবুদার সঙ্গে কথা বলেছিলাম। গিয়েছিলাম সব জায়গায়। এক দুই তিন চার পাঁচ গুনতে গুনতে ব্যস্ত ছিলাম আর কখন যে সব জায়গায় পৌঁছে গেলাম টেরও পাই নি।
 
২.
বাবাই আমাকে পাহাড়ে গাড়ি চালাতে নিষেধ করেছিল।
—— খবরদার পাহাড়ে চালাবে না।
—— কিন্তু পাহাড়ে তো গাড়ি চলে। চলে না গাড়ি?
—— চলে কিন্তু চালাতে জানতে হয়।
—— চালাতে জানে তো।
—— না জানে না।
—— শিখবে।
—— কী করে শিখবে? শিখবে কী করে?
—— কেন?
—— পাহাড়ের ড্রাইভার আর সমতলের ড্রাইভার আলাদা।
—— কী রকম আলাদা?
—— ওরা চোখে চোখে কথা বলে।
—— কেমন করে?
—— সে জানি না। একমাত্র পাহাড়ের ড্রাইভারই জানে।
বাবাইকে বোঝাতে না পেরে বিনোদকে বুঝিয়ে দিয়েছি। তাকে দেখালাম একটা ভিডিও,“ ওই দেখ বিনোদ গাড়ি চলছে। দেখছ তো?” বিনোদ চুপ থাকে। “ ওই দেখ ওপর থেকে একটা গাড়ি নামছে। একটার পর আর একটা গাড়ি, দেখছ?” বিনোদ চুপ থাকে। “এই দেখ মোট উনিশটা হেয়ার পিন বেন্ড আছে। ওই দেখ হেয়ার পিন বেন্ডে কী রকম করে চালাতে হয়।” বিনোদ চুপ থাকে। ও কী চোখে চোখে কথা বলবে বলে ঠিক করেছে? আমি বললাম,“ বিনোদ চা খাও। ”
পাহাড়ের তলা দিয়ে যখন গাড়ি চলছিল তখনই ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। বিনোদকে বললাম,“ বুঝেছ তো?” বিনোদ এবারও চুপ করে থাকে। আমি বললাম,“ আসলে পাহাড় শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকে।” বিনোদ বলল,“ জানি।” আমি বলেছিলাম,“ অনেক দূর থেকে পাহাড় হতে হতে তবে পাহাড় হয়।” পাহাড়ে উঠতে সত্যি কোন অসুবিধে হয় নি কারণ দেখলাম বিনোদ ঠিক চোখে চোখে কথা বলতে পারছে পাহাড়ের ছেলেদের সঙ্গে, তারা ড্রাইভার। সে কী এই জন্য যে পাহাড় অনেক আগে থেকে শুরু হয় ও বুঝতে পেরে গেছে বলে? পাহাড়ের মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে পারছে কিনা অবশ্য বোঝা যায় নি কারণ কোন মেয়ে ড্রাইভার চোখে পড়ল না। কেন মেয়েরা সে দিন পাহাড়ে গাড়ি চালায় নি বুঝতে পারি নি।
 
৩.
আসলে আলো কোথা থেকে আসে আর কোথায় লুকিয়ে থেকে যাচ্ছে এ সব দেখছিলাম। শোবার ঘরের ছাদটা কৌণিক তাই ওপরে তাকানো যায় না। তাকালে ছাদ ছোট হয়ে পড়তে থাকে তাকে হাত দিয়ে আটকাতে হয়। দুপুরে গরম লাগছিল, তখনই যে আলোরা পালিয়ে লুকিয়ে আছে বুঝতে পারি নি। কার্শিয়াং ট্যুরিস্ট লজের বসার ঘরটাতে ওরা সবাই বসেছিল কুর্সির ওপর। তখন রিসেপশনে কেউ ছিল না। হয় ঘরে চলে গেছে নয় বারে চলে গেছে। আমি দেখলাম আলোরা বসে আছেন সব সারি সারি কুর্সিতে। এখানে ওনারা, আলোরা এই ভাবে লুকিয়ে আছেন দেখে কথা বলি নি। আমি শুধু ছায়া খুঁজছিলাম। অপূর্ব বসার ঘরের ছাদও কৌণিক হয়ে নেমে এসে আমাকে বলল,“ হ্যালো। ” আমি উত্তর দিতে দিতে ছাদ দেখি অন্ধকার হয়ে গেলেন আর চার কোণ পাঁচ কোণে আলোরা ঝলমল করতে লাগলেন। ম্যানেজার কোথায় আছে বোঝা যাচ্ছে না, ম্যানেজার কোথায় আছেন বোঝা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। ওনাকে ফোন করলে উনি কথা বলেন। সে জন্য ফোন করেছি,“ হ্যালো ম্যানেজার সাহেব।”
—— গুড ইভনিং।
—— একটা ঘর কী পাওয়া যাবে বিনোদের জন্য?
—— বিনোদ?
—— মানে যে ছেলেটি গাড়ি চালাচ্ছে।
—— ড্রাইভারের ঘর হবে না স্যার সে তো আগেই বলেছি।
—— নানা ড্রাইভারের ঘর নয়।
—— বলছি তো স্যার ড্রাইভারের ঘর দিতে পারব না। গাড়িতে শুতে বলুন।
—— এই ঠান্ডায় গাড়িতে।
—— ন্যাশনাল হাইওয়ের ওপর গাড়ি রয়েছে স্যার। গাড়িতে শুতে বলুন ব্ল্যাঙ্কেট দিয়ে দিচ্ছি।
—— ঘরে হবে না?
—— না হবে না স্যার।
—— তা হলে আমাদের ঘরেই এক রাত।
—— সেটা এ্যালাউ করতে পারব না স্যার।
—— ঠিক আছে। কম্বল কখন দেবেন।
—— এখনই দিয়ে দিচ্ছি স্যার।
বিনোদকে বললাম,“ তোমার ঠান্ডার ধাত নেই তো?”
ও বলল,“ না।”
 
৪.
সকাল থেকে পাহাড় দেখা ভালো। পাহাড় দেখলে পাহাড়ের ওপর চড়ার মতো মনে হয়। তখন মনে হয় খুব আনন্দ হচ্ছে। তখন মনে হচ্ছে আরো পাহাড় দেখি। আরো পাহাড় দেখার পর আরো পাহাড় দেখতে দেখতে ক্রমশ পাহাড় বড় হতে লাগল। তারপর পাহাড় ছোট হতে লাগল- গাছ বড় বড় হয়ে, ছায়া হয়ে, ফার্নের মতো হয়ে, মসের মতো হয়ে, এ্যালগির মতো হয়ে, কচুরিপানা হয় আর কিছু হয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ল তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়ল অকাতরে। তারপর কিছু মানুষ যে দেখা যায় নি এমনটা নয়। মনে হল বাবাইকে বলি কিন্তু বললাম না। তাতে ওর আরো মন খারাপ হয়ে যাবে। ওদলাবাড়ির দিকে মন খারাপের দিনে ও হাঁটে সারা গায়ে চা বাগান নিয়ে। অনেকটা হাঁটার পর আবার স্কুটি চড়ে চাকরি করতে চলে যায়। সেখানে ওকে জিজ্ঞেস করেছে ,“ স্যার আপনি স্কুটি কিনেছেন?”
—— হ্যাঁ।
—— কত পড়ল?
—— এক লাখ।
—— ক্যাশ?
—— না নব্বুই হাজার লোন নিয়েছি।
—— সেকি স্যার, লোন।
—— হ্যাঁ , ইএমআই দু হাজার মতো।
—— একবার বললেন না স্যার।
—— কী?
—— বললেন না স্যার।
—— কী বলব?
এখানে এসে তার বড় মন খারাপ এ জানি বলে আর কিছু বলিনি তাকে। সবাই তাকে সাহায্য করতে চাইছে এর মানে যে ক্যাশ বা কাউন্ড এ দুটোর বাইরে কিছু হতে পারে এ এখন ভাবতেও পারছে না বাবাই। এ জন্য আর পাহাড়ের সঙ্গে না থেকে, বাবাইয়ের সঙ্গে না থেকে মংপং গিয়ে দেখি বাতাস বইছে। বাতাস কেন বইছে তার কারণ হিসেবে সামনে জঙ্গল আছে আর আছে তিস্তা যার জল একটু ওপর থেকে দেখেছি আর টর্চ অতো বড় কিছু আনি নি যে বালির ওপর ফেলে তার চিকচিক দেখতে পাব। সেই ঝড়ের মধ্যে আড়াল করে আগুন নিয়ে কিছু লোক বসেছিল। তারা উঠতে পারছে না কারণ উঠলেই আগুন নিভে যাবে তখন আর আলো পাবে না। ওই লোকগুলো চাঁদও লক্ষ্য করে নি। সে যে কখন উঠে পূর্ণিমা হয়ে , অমাবস্যা হয়ে চলে যায় সে সব না বুঝে শুধু আগুনকে হাওয়া থেকে আর হাওয়াকে আগুন থেকে আড়াল করতে করতে চলে গেল সব সময়। কিছুক্ষণ পর লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে আর সময় বলে কিছু নেই শুধু হাওয়ার আওয়াজ হচ্ছে, সেখানে জঙ্গলের কিছু কথাবার্তা মিশেমিশে যাচ্ছে পূর্ণিমার অত্যন্ত নিকটে।
 
৫.
রাস্তা আমার একদম ভালো লাগছে না। কারণ তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে অত্যন্ত খারাপ বলে? অধিকাংশ ক্ষেত্রে অত্যন্ত ভালো বলে? কোনটাই ভালো না লাগলে তো ভারী মুশকিল। ভালো রাস্তাও ভালো নয়, খারাপ রাস্তাও ভালো নয়- তবে কী? একটা মাঝ পথই পছন্দ হচ্ছে আজকাল? ভালো আর খারাপের মধ্যে দিয়ে একটা মাঝপথ চলে গেছে, সেই পথের মতো। একে কী মধ্যপন্থা বলে- দেবুদাকে জিজ্ঞেস করেছি। দেবুদা আমার দিকে তাকিয়েছে তারপর চা চুমুকের মতো আওয়াজ করে গেছে দু ঘন্টা, তিন ঘন্টা, চার ঘন্টা। কোথা দিয়ে গুনতে আসা সময় যে কোথা দিয়ে কেটে যাব, কেটে যাব করছে বোঝা যাচ্ছে না। দেবুদা বলেছে,“ বই এনেছো?”
—— না।
—— সে কী!
—— একদম ভুলে গেলাম।
—— ওই কর!
—— সত্যি। সপ্তমীতে দেখা হল। মদ টদ খাওয়া হল। তারপর ভুলে গেলাম যে বই আনতে হবে। এরপরের বার আনব।
—— আর এনেছো। দেখা হচ্ছে প্রায়ই?
—— নিশ্চয়ই। দেখা তো হচ্ছে প্রায়ই। মদ খাচ্ছি-
—— সেটাই তো ভালো পার।
—— নানা, এর পরের বার আনতে পারব।
—— পারবে?
—— নিশ্চয়ই পারব। পারতেই হবে।
—— পারতেই হবে?
—— পারতেই হবে।
এরপর দেবুদা চুপ করে যাচ্ছে। আর মজলিস জমে উঠছে। সেখানে তিনটে চারটে বেঞ্চি আছে, টেবিল আছে আর চা, কফি হচ্ছে, নিজের মতো বানিয়ে খাওয়া হচ্ছে। দুপুরের খাবার সময় এসে গেলে সবাই উঠে পড়ছে। আলমারিতে বই রাখা আছে। সেই সব দেখলাম একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছেন আমাদের দিকে। তারা জল খেতে চায়, চা খেতে চায় অথচ আমাদের সময় হয়ে আসছে। দুপুরে হোটেলে কাঁসার থালায় ভাত দিল তার ওপর কলাপাতার মতো দেখতে কাগজের পাতা চাপানো, কলাপাতার মতো আঁকা কাগজ কাঁসার থালার ওপর রেখে ভাত খেলাম। কতরকমের শাক ও ভাজা সব খেয়ে উঠতে না পেরে, তাদের রেখে চলে এলাম। আর মাছ এসে পড়ল আলাদা কাঁসার থালায়। তারপর রসগোল্লা খেলাম শেষপাতে। কাঁসার বাটিতে ডাল খেয়ে মুখ পরিষ্কার করে দেখি দেবুদা আসছে। দেবুদাকে ভাত দেওয়া হল। একটি মাছ খেলেন। কোন কথা না বলে বলল,“ সিগারেট খাবে? সৌভিককে খাওয়ার কথা বলতে বলল,“ পেটের হাড় কেটে নিয়েছে তো। পেটের পাশের পাঁজরের তাই বাইরে খাচ্ছি না।”
—— বোন গ্রাফটিং?
—— হ্যাঁ । সাড়ে সাত মাস বিছানায় ছিলাম।
—— সপ্তাহ ?
—— না। মাস।
—— এখন?
—— ভালো হয়ে গেছি। স্কুটি চালাচ্ছি।
—— লাগছে?
—— কী?
—— ব্যথা?
—— আছে।
—— তবে?
—— সামান্য।
 
৬.
একটা হর্নবিল উড়ে গিয়েছিল বলে গোপালদা বলেছে। আমি হর্নবিল দেখতে পাই নি। গোপালদাকে দেখলাম। উনি বলেছেন,“ স্যার,একটা হর্নবিল উড়ে গেছে।” যারা ওপরে উঠেছিল তারা দেখেছে ওই হর্নবিল যা এক ধরণের পাখি। কেউ বলেছে সে এক ধরণের পাখি দেখেছে যার ঠোঁট বড় বড় হয়। সে দেখতে গিয়ে ছবি তুলতে ভুলে গেছে। তা হলে সে দেখল কী প্রমাণ দিতে পারছে না। ও জন্য তার মন খারাপ কারণ অন্যরা প্রমাণ দিয়েছে। আজ বড্ড গরম বলে কোথাও চাঁদ ওঠে নি। যারা চাঁদ বলে ছবি তুলেছে সবার চাঁদ হ্যালোজেনের মতো লাগছে। কী হচ্ছে কিছু বুঝতে পারছি না, কী হচ্ছে কিছু বুঝতে পারছি। দেবুদার ফোন এলো আবার চলে গেল। ফোন করলে ফোন ধরছে না কেন বাতাস। এবার বড্ড গরম। জয়ন্তী নদী পাড়ে চাঁদ নেই। হাওয়া নেই। কোন শব্দ করছে না হাওয়া বা নদীরা। কেউ মাল খেতে গিয়ে উঠে পড়ছে না। ভুল করে টি গার্ডেনের দিকে চলে যাচ্ছে। সেখানে চা গাছের খোপে খোপে জল দিতে গিয়ে শাখা নদী হয় আর এক লেপার্ড মা বসে আছেন। তিনি তিনজন ছানাকে নিয়ে এইমাত্র বেরুবেন। বাবাই চিলাপাতার গাছতলায় পাতলা কুয়াশার মধ্যে চিতা ও তার মায়ের ছবি তুলেছে। সেই তুলতে গিয়ে খানিকটা ব্যর্থ হয়ে তিন লক্ষ , চার লক্ষ টাকা দামের লেন্স ও ক্যামেরার কথা অনবরত বলে যাচ্ছে, সে আর ব্যর্থ হতে চায় না। একটা নীল কাঁধওলা পাখির নাম বলেছে বাবাই- ওটা তুলে সে খুব খুশি হয়েছে।
 
দেবুদাকে আজ মাছ খাওয়ালাম। ভাবলাম বলি,“ দেবুদা মাছ খান।” কখনও বললাম,“ দেবুদা মাছ খাও। ” কারণ জেনেছিলাম দেবুদাকে মেরেছিল ও জল দেয় নি, পেচ্ছাপ করিয়েছিল। পেচ্ছাপ খাইয়েছিল খুব। ওই জন্য ফোন ধরে না। চুপচাপ মাছ খাচ্ছিল দেবুদা- পেচ্ছাপ খাচ্ছিল না। ওই জন্য হাওয়া দিচ্ছে না। ওই জন্য চাঁদ আছে। ওই জন্য কথা বলছে না কেউ। পাহাড়ও আড়ালে চলে গেল আর হাতিরাও কাল আসবে বলেছে। সকাল সকাল হাতি দেখব বলে যাব। গোপালদাকে নিতে হবে কারণ নুন দেবে ও হরিণদের দেবেন। তারপর সে সবদের মেরে খেয়ে চলে যাব পরশু। রাস্তা দিয়েও হাতিরা আসবেন। হাতিরা যেমন রাস্তা দিয়ে আসেন- বনবিবিদের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে হ্যালোজেন দেখতে বেরব রাস্তায়।
 
৭.
বাবাই দূর থেকে জলদাপাড়ায় দেখল গণ্ডার ও গাউর পরস্পরকে দেখছে মধ্যিখানে গাছ। আমি বললাম,“ ওটা কী একই ফ্রেমে?” ও বলেছে,“ একই ফ্রেমে।” সে সব সত্যি কথা বলে মনে হচ্ছে কারণ মধ্যিখানে তখনও গাছ আছেন। সেই গাছ দেখলাম। গুঁড়ি ও পাথর দেখলাম। দূর থেকে কী দেখেছি বলছি কিন্তু তাদের ম্যামথ বলে মনে হল। হতে পারে নাকি আমার হচ্ছে আপনার নয়। আপনার জলহস্তী মনে হতে পারে কারণ নভেম্বর মাসেও গরম। যত গরম খাচ্ছি সব মদ বলে মনে হচ্ছে। আর একটুও হাওয়া নেই কেন? ডিসেম্বরেও গরম হবে বলে মনে করছে গোপালদা অবশ্য যদি বৃষ্টি না হয়। একটুও জল নেই বলে বন চটকে গেছে। ম্যামথরা ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আজও দূর থেকে ম্যামথরা কথা বলল আর আমি ভাবলাম ওনারা কাছেই আছেন। শ্রদ্ধেয় বাঘেরা মারা গেছে পঁচানব্বুই সালে। তখন বামফ্রন্ট শাসন করত তাই কেউ জবাব দেবার নেই। এখন আর চাঁদ নেই- বামফ্রন্ট নেই। পলিটিক্যালি খুব ঝুঁকে বামফ্রন্ট দেখতে হচ্ছে - চাঁদকেও। বারন্দায় ভীষণ গরম হচ্ছে বলে উনি পাখা লাগাতে চাইলেন। রাজার বাবা রান্না করেন। একটা ছেলে মাছ বিক্রি করছিল। তাকে পাথরচাটা মাছ বলে। সে মাছ একমাত্র মুন্নার বাবা রান্না করতে পারবেন। কেটে কেটে ফালাফালা করা হবে যখন দেখা যাবে মাছেরা তাকিয়ে আছেন। তখন মশলা দেওয়া হবে, সর্ষে দেওয়া হবে। সে সব রাজার বাবা দেবেন যিনি মুন্নারও বাবা বটে। সামান্য ঠাণ্ডা এলে ম্যামথরা আসবেন মাছ খেতে। কিন্তু মন্দিরের সামনে ছিল হাতিরও পাল। রাজা হঠাৎ বলল সে হাতিদের দেখেছে। চুনিয়া টাওয়ারের কাছে তার ভিডিও করে দিয়েছে বাবাই। গোপালদা বলে সেই হাতিরা ‘সাউথরাজাভাতখাওয়াতেরোনম্বরহোলের’ মধ্যে এলে ম্যামথ হয়েছে। নদী আর নেই। জল নাই। ডলোমাইট নাই। ষ্টেশনের আশ্চর্য চাদোকান আছেন যার ঠাকুর্দা পঞ্চবটি লাগিয়েছিলেন। তবে ষ্টেশন নাই। রেললাইন কদাচ কখনও দেখা দেন কিনা বলতে পারব না। জলহস্তী দেখব বলে জয়ন্তী এসেছি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

7 মন্তব্যসমূহ

  1. উপল মুখো গল্প লেখেন, ছবিও আঁকেন শব্দে শব্দে। পাঠক বোঝার আপ্রাণ চেষ্টা করে, বোঝা না বোঝার মাঝখানে ভ্যাবলা হয়ে দাঁড়িয়ে ভাবে কী পড়লাম, নাকি দেখলাম। সী গালের মতো উপল ঘটনার শীর্ষ ছুঁয়ে ছুঁয়ে একটা অস্পষ্ট কাহিনিসূত্র গেঁথে ফেলেন, তাতে তিমি দেখা যায় না বটে, কিন্তু ছড়িয়ে থাকে প্রবালের রহস্যময় প্রেমযাপন। যেমন এই গল্পের পরে চোখে লেগে থাকে অতিকায় দুই গন্ডার আর গাউরের মাঝখানে শ্রদ্ধেয় এক গাছ !
    অথচ কী নেই এতে, পুলিশি মার, পরিবেশ ধ্বংস, জয়ন্তী নদীর ধারের হারিয়ে যাওয়া প্রাণিকুল, সবার ওপরে আমাদের এই অর্থহীন অসুস্থতা !

    উত্তরমুছুন
  2. উপল মুখোপাধ্যয়ের কয়েকটি গল্প পড়ে, কথোপকথনের বিষয়টি অন্য ধারার বলে মনে লেগেছে। শুভেচ্ছা লেখককে।

    উত্তরমুছুন
  3. বাহ। একদম নতুন ঘরাণার লেখা। খুব ভালো লাগলো।

    উত্তরমুছুন
  4. ঘটমান বর্তমানের চাক্ষুস বিবরণ আর এই নতুন শতকের লেখকদের উপজীব্য নয়। জন প্রিয়তা অর্জন করার যাবতীয় রাস্তাগুলি সযত্নে পরিহার করে উপল এক ব্যতিক্রমী কথাকার হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছেন।। তাঁর গল্পকৃতির উপস্থাপনাতেই মূর্ত হয়ে ওঠে বার্তা।

    উত্তরমুছুন
  5. আহা! নামহীন নই, লিখতে ভুলেছি! আমার একটা নাম আছে -দেবাশিস সরকার।

    উত্তরমুছুন