একদিন এক ছোট পত্রিকার পাতায় একটা গল্প পড়লাম, ‘ঘুমন্ত খুনি’। নামটা দেখে কৌতূহল হল, পড়তে শুরু করলাম। আর পড়ার পরে ওই বোমকে যাওয়া যাকে বলে। যেন স্বপ্নের মধ্যে স্বপ্ন। সমাজের বুকে ঘটে যাওয়া খুন-খারাপির ঘটনাগুলো ছোটদের মনে কীধরনের প্রভাব ফেলে, তাকেই হয়তো ধরতে চেয়েছেন লেখক। তখন দাঙ্গার সময় (এই ‘দাঙ্গা’ শব্দটির সঙ্গে আমাদের বাঙালিদের অনেক কষ্টের স্মৃতি, আতঙ্কের অনুভূতি জড়িয়ে আছে)। ছোট ছেলেটি দেখছে একদল ঘুমন্ত মানুষ রাস্তা দিয়ে ছুটছে, খুন করবে বলে। অনেক খুন। আর সে একাই সেটাকে আটকানোর জন্য ছুটছে। আটকাচ্ছে। সব শেষে সেই ঘুমন্ত মানুষের দল রক্তের নেশায় উন্মাদ হয়ে পরস্পরকেই মেরে কেটে শেষ করে ফেলছে। কিন্তু যেহেতু ওরা ঘুমন্ত, তাই অস্ত্রের আঘাত ওরা বোধহয় টের পাচ্ছে না। কারণ ওদের মুখ থেকে কোনও আর্তনাদ ছিটকে আসেনি। আসলে ছোট ছেলেটিও তো স্বপ্নই দেখছিল। প্রবল আতঙ্কের থেকে অবচেতনে যা আসে। সম্পূর্ণ কাল্পনিক একটা গল্প এভাবে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিতে পারে, জানা ছিল না আমার।
পাঠক হিসেবে আমি একেবারেই জাতের নই। গল্প পড়ে আপ্লুত হয়ে পড়লেও, পরে সেই গল্পের নাম, লেখকের নাম, কিছুই আমার মনে থাকে না। স্মৃতির গভীরে রয়ে যায় শুধু গল্পটা। অন্য গল্পের চাপে ঢাকা পড়ে থাকে। হঠাৎ হঠাৎ ডলফিনের মতোই ভুস করে মাথা তোলে কেবল। কিন্তু এই গল্পটা আমি ভুলতে পারলাম না। গল্পটার সঙ্গে বাস চলল বেশ কিছুদিন। লেখকের নামটাও দেখে রাখলাম, কারণ মন বলছে এই লেখককে পড়তে হবে আরও। তারপর থেকে আমি এঁকে খুঁজেছি পত্রিকার পাতায়। যেটুকু যা পেয়েছি, চেটেপুটে পড়েছি। তেমনি একটি গল্প, ‘কুয়োতল’। গল্পের দুটি চরিত্র অমলতা আর বিভু। নদীর ধারে জঙ্গলের ভেতর একটা জায়গায় তারা এসেছে। সেখানে আড়াল থেকে কিছু স্থানীয় মানুষকে লক্ষ করছে, যাদের মুখমণ্ডলে এক অদ্ভুত তৃপ্তির ছাপ। একটি উপমা, ‘প্রত্যেকেরই চোখ ও ঠোঁটে স্থায়ীভাবে লেগে আছে গভীর তৃপ্তি। যেন তৃপ্তি নামক পলায়নপর অনুভবটি পালাবার সময় হঠাৎ আগুনের শিখা হয়ে ওদের মুখগুলোকে স্থায়ীভাবে পুড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে। পোড়া দাগ আর মুছবার নয়।’ এই একটি লাইনের মধ্যে দিয়েই সম্ভবত গল্পটি এবং লেখকের কলমের বিশিষ্টতা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। তৃপ্তি হল পরম সুখের অভিব্যক্তি। যেই সুখের পেছনে আমরা সারাজীবন ছুটি। কখনও মুহূর্তকালের জন্যে তাকে ছোঁয়া যায়, তারপরেই আবার ছুটে চলা, খুঁজে চলা। সেই তৃপ্তি একদঙ্গল মানুষের মুখে স্থায়ীভাবে ফুটে থাকতে দেখলে তাকে স্বাভাবিক ভাবা সত্যিই কঠিন। তাই তাকে পোড়া দাগের সঙ্গে তুলনা করে এক বিপরীত ভাবনায় পাঠককে চালিত করে দিলেন লেখক!
মৃত্যু বারবার এসেছে দেবর্ষি সারগীর লেখায়। ‘মৃত্যুকাল’ গল্পে একটা মানুষ প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে এমন একটা অসুখে আক্রান্ত হয়েছে, যাতে সে অল্পদিনের মধ্যেই মারা যাবে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে যেন মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করে এবং আতঙ্কিত হয়। এতদিন জীবনকে সে সম্পূর্ণভাবে উপভোগ করেছে, সে বিষয়ে তার কোনও আক্ষেপ নেই। এবং এই উপভোগ নৈতিক। সে কখনও কারও ক্ষতি করেনি, বিত্তবান হয়েও দরিদ্রকে ঘৃণা করেনি। হঠাৎই মৃত্যুকে তার বড় অর্থহীন মনে হয়। যা সার্থক জীবনযাপনকেও অর্থহীন করে তোলে, গন্তব্যহীন যাত্রার মতো। মৃত্যুর আতঙ্ক থেকে বাঁচতেই সে একসময় গৃহত্যাগ করে এবং লোকালয় থেকে দূরে এক জঙ্গলের ভেতর পরিত্যক্ত ভাঙা মন্দিরে আশ্রয় নেয়। বর্ষার বৃষ্টি চিরকালের মতো তাকে খুশি করতে পারে না। আসলে আতঙ্কটা তার পিছু ছাড়েনি। শুধু তার ভয় পাওয়া মুখ অন্য কেউ দেখতে পাচ্ছে না ভেবে কিছুটা স্বস্তি পেল সে। তারপরে তার ভাবনার অলিগলিতে লেখক আমাদের ঘোরালেন। বৃষ্টির ফোঁটার প্রিয় শব্দকে মৃত্যুর নৃত্যরত পদসঞ্চার বলেই তার মনে হল। একসময় এই আতঙ্ক আর ক্লান্তি থেকে মুক্তি পেতে সে নিজেই মরতে চাইল। প্রতিটা জীবন্ত মুহূর্তই তখন তার কাছে একেকটা শতাব্দীর মতো দীর্ঘ। একটা সময় সে উপলব্ধি করল, ‘ঈশ্বর ছাড়া মানুষ হয়তো বাঁচতে পারে, কিন্তু মরতে পারে না’। গল্পের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করে এলাম যেন। এই মৃত্যুকেই আবার আরেকরকম ভাবে এনেছেন ‘রাম রায়’ উপন্যাসে। বৃদ্ধ অসুস্থ রাম রায়ের মৃত্যু সম্পর্কে কোনও ভয় নেই। কিন্তু পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার চিন্তা তাঁকে বিষাদগ্রস্ত করে তুলেছে। ‘একজনের মৃত্যু মানে একটা অদ্বিতীয় মুখের মৃত্যু’। এই গল্পে লেখক পুরো বিষয়টাকে উলটে দিলেন। মহিষারোহী ঈশ্বরের হাতেই ধরিয়ে দিলেন দূরবিন। সেই দূরবিনের মধ্যে দিয়েই বর্ণনা করছেন জন্ম-জন্মান্তরের রাম রায়ের। এ এক অপূর্ব সার্থক ইউটোপিয়া।
‘জৈষ্ঠ্যের দুপুর’ গল্পে ফাঁকা বাড়িতে মৃত্যুর প্রহর গুণছে এক বৃদ্ধ। তাঁর স্ত্রী মৃত, পুত্র বিদেশে। ‘প্রিয় মানুষ একদিন চলে যায়, কিন্তু প্রিয় জড়বস্তু কখনও ত্যাগ করে না।’ জাগতিক বিষয়-আশয়ের প্রতি আমাদের যে আসক্তি, তারই উল্লেখ রয়েছে গল্পে। বৃদ্ধ তাঁর বাড়িটির কী গতি হবে তাই নিয়ে চিন্তিত। কিন্তু একটা সময়ের পর ‘চিন্তা করার জন্য, কল্পনা করার জন্য, জীবন নামক বস্তুটিকে একটু বোঝার জন্য যতটুকু শক্তি তাঁর মধ্যে তখনও অবশিষ্ট ছিল, তাতে তাঁর মনে হতে লাগল বাড়িটার দায়িত্ব নিয়ে তাঁর না ভাবলেও চলবে। এই ভার তো নেবে গোটা জগৎই। পৃথিবী নিজে।’ এভাবে তিনি যেন আয়নার মতোই জীবনের সার-সত্য আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। মৃত্যু কখনও ভয়ের, কখনও আনন্দের বা বিষাদের, আবার চরম নির্লিপ্তিও এনে দেয় মৃত্যু। ‘অন্ধকার দেওয়াল’ উপন্যাসের হরিমোহন গুপ্তও যেন রাম রায়েরই আরেকটি রূপ। সাতাশি বছর বয়সে যিনি কোমর ভেঙে বিছানায় শয্যাশায়ী। পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো। তবু অন্যদের অবহেলায় অপমানে ধ্বস্ত হয়ে তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। ভাঙা কোমর বাধা হচ্ছে না। কারণ, ‘চিতার দিকে যাওয়ার জন্য সব মানুষই হাঁটার শক্তি পেয়ে যায়’। তবু ফিরে আসতে হল, ফিরিয়ে আনল নাতি। ‘চোখ বুজে হরিমোহন দাঁড়িয়ে থাকলেন। বৃষ্টির ছাঁট লাগছিল বলে না, তিনি চোখ বুজে ছিলেন কোনও কিছুই আর দেখতে চান না বলে। ফার্ন রোডের আশৈশব চেনা বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, এমনকী নাতি সুমিত্র—কিছুই তিনি দেখতে চাইছিলেন না। নিজেকে তাঁর শুধু মনে হচ্ছিল এমন একজন মানুষ, যে প্রাণের ক্রীতদাস হয়ে গিয়েছে’। গল্পের শেষে কেবলমাত্র মরবেন বলে খাওয়া বন্ধ করে দিচ্ছেন তিনি। কেউ তা টের পায় না। কারণ তাঁর খোঁজই রাখে না কেউ। তাই যেন নিজেই নিজেকে বলছেন, ‘কেমন আছো গো হরিমোহন? কী করে বেরবে নিজেরই খাঁচা থেকে?’ এই রাম রায় তথা হরিমোহন কিন্তু আমাদের খুউব পরিচিত। কিন্তু আমরা ক’জন তাকে সত্যি সত্যি চিনেছি, বুঝেছি?
দেবর্ষির লেখা পড়তে পড়তে মনে হয়, লেখক যেন একটাই লেখা টুকরো টুকরো করে লিখেছেন। ভাবসম্প্রসারণের মতো একেকবার একেকদিক থেকে আলো ফেলেছেন একটাই গল্পের উপর। অথচ ঝিম ধরানো নেশার মতো পড়তে থাকি, পড়তেই থাকি।
যা আমরা চোখে দেখতে পাই না, তাকে আমরা ভয় পাই। যেমন অপারেশনের আগে অজ্ঞান হতে হবে শুনলে রোগী ভয় পায়। কারণ সেটাও অর্ধেক মৃত্যুর শামিল। জ্ঞান ফেরার আগে পর্যন্ত যা কিছু ঘটবে, তার অজানা। আবার জ্ঞান যদি না ফেরে, সেই আতঙ্কও মনে কাজ করে। অন্ধকার গুহায় ঢুকলে আমাদের ভয় লাগে। সেরকমই অজানার প্রতি ভয়ের একটা উদাহরণ হিসেবেই কি মৃত্যুকে তাঁর গল্পে বারবার এনেছেন লেখক? জীবনের খুব স্বাভাবিক এবং অবশ্যম্ভাবী পরিণতি মৃত্যু। যুক্তি দিয়ে বিজ্ঞান দিয়ে ভাবলে এখানে কোনও রহস্য নেই। দুঃখ অবশ্যই আছে, মৃত্যু মানেই চেনা প্রিয় যা কিছু ছেড়ে যেতে হবে। নিজের মৃত্যু কল্পনা করতেও দুঃখ হয়। কিন্তু মৃত্যুর পরে কী? কোথায় যায় আমাদের প্রিয়জনেরা? এই প্রশ্ন মনে আসেই। কোথাও তো থাকে, এই বিশ্বাসও জন্ম নেয় মনের গভীরে। ভূতের গল্পের মধ্যে দিয়ে এই বিশ্বাসেরই চর্চা করি আমরা। তারই অন্য একটা পিঠ, ঈশ্বর। ঈশ্বরকে কল্পনা করে অনায়াসেই নাগালে পেয়ে যেতে পারি, আমাদের না পাওয়াগুলোকে। তাই মৃত্যুর হাত ধরেই এসেছেন ঈশ্বর, আদর্শের হাত ধরে এসেছে ধর্ম। এই ভাবনাগুলোই আমাদের কাছে আরও স্পষ্ট করে মেলে ধরেছেন লেখক দেবর্ষি। সাধারণ মানুষ শাস্ত্রচর্চায় উৎসাহী হয় না। ধর্মগ্রন্থ পাঠ এবং সেই নীতি অনুযায়ী জীবনকে চালনা করার উপদেশ দেন ধর্মগুরুরা। কিন্তু তারপরেও, ‘যারা কথামৃত পড়ে না, পড়তে খারাপ লাগবে বলে নয়, পড়তে ভয় পায় বলে’(রাজার জ্ঞানতৃষ্ণা)। এই ভয়ের কারণই আমাদের মনের অপরাধবোধ। ‘দোষে-গুণে মানুষ’, এই আপ্তবাক্যে নিজেদের সান্ত্বনা প্রশ্রয় দিয়ে থাকি আমরা। দেবর্ষি সারগীর ‘ভ্রমণসঙ্গী ঈশ্বর’ উপন্যাস যেন নতুন আঙ্গিকে গীতাপাঠ।
আমাদের পরিচিত সমাজটাকেও তুলে এনেছেন উলটো দূরবিনের সামনে। ‘চিৎকার’ গল্পে সকলের অলক্ষে ঘটতে চলা একটি ধর্ষণের সম্ভাবনা টের পেয়ে গেছে এক কিশোর ছাত্র। আটকাতেও চাইছে। কিন্তু সে তো একা, তাই সে চিৎকার করে গলিতে ছুটে বেড়াচ্ছে, ডাকছে সবাইকে। কিন্তু ‘একটু দম নিয়ে আমি এক নাগাড়ে চেঁচিয়ে বলে যেতে লাগলাম, উন্মাদের মতো, যেন রেললাইনে আমার পা আটকে গিয়েছে, দূরে ট্রেন আসছে, আর আমি সাহায্যের জন্য প্রার্থনা করে চলেছি’। তারপর ‘দুটো হাত বাইরে বেরিয়ে এসে জানলার পাল্লাদুটো ভেতরের দিকে টেনে নিল, যেন কোনও অতিকায় কালো পাখি নিজের ডানা বন্ধ করে কাউকে শরীরের ভেতর লুকিয়ে ফেলল’। সবশেষে, ‘এখানকার হাওয়া মানুষের ঘুমকে পাহারা দেয়। যতই চেঁচা, তোর চিৎকারকে এই হাওয়া ছুটন্ত নেকড়ের দলের মাংস লুফে নেওয়ার মতো করে গিলে নেয়। কারও কান পর্যন্ত পৌঁছোয় না’। ঘটনার সময়কাল মাঝরাতের দেড় থেকে দু’ঘন্টা। উপমাগুলো দিয়েই লেখক বুঝিয়ে দিলেন সব। ভয়ের পরিবেশ, উৎকণ্ঠা, মরিয়া ভাব, আর হাওয়ার ঘাড়ে সবটুকু দোষ চাপিয়ে সমাজের বধির হয়ে যাওয়া। সমাজ মানে পরিণত বয়সের মানুষেরা। তারাই বধির হয়, অন্ধ হয়। তাই ‘ঘুমন্ত খুনি’র মতো এই গল্পেও একজন কিশোরই সব দেখছে জানছে, আটকাতে চাইছে। সাহস বা নীতিবোধের অবস্থান এখনও যেটুকু টিঁকে আছে, তা শিশুদের মনেই।
অতি যত্নে শ্রুতিমধুর শব্দগুলি পরপর সাজিয়ে বাক্য গঠন করেন দেবর্ষি সারগী। বর্ণনা আর উপমায় ছবি আঁকেন। লেখক কবিতা লেখেন না। কখনও লেখেননি। কিন্তু ‘কবিতা ও গল্পের মধ্যে তফাত শুধু বলার ভঙ্গির, নইলে ওদুটো বলে একই কথা। প্রথমটা যেন ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখার মতো, দ্বিতীয়টা জেগে।’(রাজার জ্ঞানতৃষ্ণা)। তাঁর গল্পের ভাষা যেন কবিতার নদী। মন্থর গতিতে শব্দ আর বর্ণনার মায়াজালে যা আমাদের সম্মোহিত করে ফেলে। ঠাণ্ডা বাতাস যেন আরাম বুলিয়ে যায়। টপ টপ করে ঝরে পড়া বৃষ্টির ফোঁটায় ভেজা অনুভূতি। কখনও পিনের মতো ফুটতে থাকে মরুভূমির রুক্ষ হাওয়া। ‘কলকাতার গোধূলি’ গল্পে ফুটে উঠেছে মানুষের উপর গোধূলির প্রভাব। যখন মানুষের আধ্যাত্মিক চেতনা জাগ্রত হয়। ‘গোধূলিতে ডুবে যাচ্ছে প্রকৃতি। সব যেন এক শিশুর মুখগহ্ববরের মধ্যে ধীরে ধীরে ঢুকে যাচ্ছে...’ অর্থাৎ কিনা শিশুর মুখগহ্ববরের মতোই নরম গোধূলির আলো। আমরা সম্মোহিত হই, প্রকৃতির এই সৃষ্টি ও সৃষ্টিকর্তার প্রতি আবেগে। তাই ওই গোধূলির সময় সে নিজেকে সমর্পণ করল যে, আমায় মেরে ফেলো। খুনিরা ওকে মারতে পারেনি, কারণ গোধূলি ওদের মনের উপরেও প্রভাব ফেলেছে। প্রকৃতি তথা ঈশ্বর তথা আদর্শের প্রতি পাঠকের মনকে এইভাবেই উস্কে দিয়েছেন লেখক। পড়তে পড়তে গল্পের প্রতিটি শব্দ বাক্য ধ্রুব সত্য বলে মনে হতে থাকে। দুনিয়ার বাকি সব তুচ্ছ। সম্মোহনের এই মোহজাল ছিঁড়তে ইচ্ছে করে না, কারণ আমরা সুন্দরকে খুঁজে পাই, ছুঁতে পারি। তুখোর কল্পনাশক্তি দিয়ে সৈনিককে পোষা কুকুর বানিয়েছেন। কালো বড় খরগোশকে টেনে এনেছেন গল্পে। রুক্ষ আধুনিক যাপনে ধানের মতোই বুনে দিয়েছেন সবুজ জলজ প্রকৃতিকে। তার কীত-পতঙ্গ পশু-পাখি সরীসৃপ সবকিছু। আর সমস্যা জর্জর জীবনে দিয়েছেন আধাত্মিক চেতনার পরশ। যা নতুন করে আবার ভালোবাসতে শেখায়। ঈশ্বরকে করেছেন সৌন্দর্যের দূত। মানুষের সান্নিধ্যে যিনি খুশি হন।
দেবর্ষি সারগীর লেখা যখন পড়তে শুরু করি, আমি তখন সবে গল্প লেখা শুরু করেছি। অথচ শুরু থেকেই আমি ওঁর মুগ্ধ পাঠক। কোনও আর্ট এক্সিবিশনে গিয়ে যখন ভালোলাগা ছবিটির সামনে দাঁড়িয়ে থাকি চুপচাপ, মুগ্ধতাটা ব্যাখ্যা করতে পারি না। কিন্তু ওই ভালো লাগাটাই আমাকে টেনে নিয়ে যায় অন্য প্রদর্শনীগুলোতেও। দেবর্ষির লেখা আমার কাছে ঠিক সেরকম। তবে তাঁর লেখা, বিশেষত উপন্যাস পড়ার জন্যে একটু মানসিক প্রস্তুতিরও প্রয়োজন আছে। সোপ-অপেরা দেখার মন নিয়ে বসলে চলবে না। আবার কেজো মনটিকে একপাশে সরিয়ে রেখেই বসতে হবে। সেইরকম মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই পড়তে শুরু করেছিলাম ‘রূপান্তর’ উপন্যাস। ততদিনে ওঁর লেখার সঙ্গে অনেকটাই পরিচিত হয়েছি। বেশ কয়েকটি গল্প-সংকলন পড়ে ফেলেছি। উপন্যাসও। এই উপন্যাসটি পড়লাম বই হওয়ার পরে। একটা অত্যাধুনিক শহরের বর্ণনা দিয়ে গল্প শুরু হচ্ছে। লেখক যেখানে অদৃশ্যভাবে উপস্থিত। তাঁর বর্ণনা থেকেই আমরা সেখানকার ঘটনা জানছি। এমনকি নাগরিকদের ভাবনাও লেখক পড়তে পারছেন। সম্পদ বানানো এবং বাড়ানোর চিন্তায় মগ্ন উন্নত আধুনিক নগর। সকলেই ধনী, তাক লাগানো প্রাসাদ, অঢেল সম্পদ, ভোগের অফুরন্ত জোগান, তাদের রোজকার জীবনকে করে তুলেছে বাসি মড়ার মতোই আকর্ষণহীন। নতুনত্বের খোঁজে তারা এখন পশু হওয়ার সাধনায় মগ্ন। ‘ঠিকমতো পশু হতে পারলেই মানুষ প্রকৃত সুখী হয়ে উঠবে’ এটাই তাদের জপ-মন্ত্র। মৃত্যু নিয়ে প্রবল শূচিবায়ুগ্রস্ত ওরা। শুধুমাত্র মৃত্যু দেখবে না বলেই নিজেদের মধ্যে খুনোখুনিটা বাকি আছে। নইলে সন্দেহ, ঈর্ষা, লোভ, চুরি সবই রয়েছে সেখানে। মানুষ-সমাজের ‘তালাক’ শব্দের মতোই ওদের কাছে ভয়ঙ্কর ‘আত্যহত্যা’ শব্দটি। যে বলে এবং যে শোনে, উভয়েই পরমুহূর্তেই আতঙ্কিত অসহায় হয়ে পড়ে। আর সকলেই চরম বিভ্রান্ত। কী করবে, কী করলে ভালো থাকবে, হন্যে হয়ে খুঁজে চলেছে এটাই। প্রবৃত্তি আর আকাঙ্ক্ষাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মদ মাংস আর মেয়ে সংক্রান্ত বিষয়ে ভুলিয়ে রাখে, ব্যস্ত রাখে নিজেদের। কেবলমাত্র ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেই ওরা কিছুটা নিরুদবেগ নিশ্চিন্ত হতে পারে। নিশুতি রাতে ঝোপঝাড়ে কেবল যৌনতার হাসি উল্লাস।
এই উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপনের প্রতীক হিসেবেই এসেছে মেয়েদের কাঁধে বসিয়ে হাঁটার প্রসঙ্গ। আসলে উচ্ছৃঙ্খলতাকেই কাঁধে চাপিয়ে ঘোরে পুরুষের দল। পশুদের সমাজে মেয়ে-পশুরা একরকম তোয়াজ পায় ঠিকই, এই গল্পে কিন্তু নায়ক হিমা তার মা এবং বউকে কড়া পাহারায় বন্দি করে রেখেছে মানুষ-সমাজের নিয়মেই। তার নিজস্ব হারেমেও তালা ঝোলানো থাকে। রামায়ণের সীতার সোনার হরিণের আব্দারের মতোই এসেছে সোনার বেড়ালের আব্দার। আবার স্বর্ণলঙ্কায় সোনার খাটে অনেক সীতার আলিঙ্গনে ঘুমিয়ে আছে রাবণ। দরিদ্র নিরন্ন মানুষের দেখাও পাওয়া গেল। এবং মানুষ-সমাজের চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী, তাদেরকেই সুখী মনে করে আফশোসে ফেটে পড়ছে ধনীর দল।
গল্পের শুরুতে আমরা সেখানে আধুনিক দুনিয়ার ফ্রি-সেক্স নিয়মের প্রচলন দেখছি। একাধিক নারী বা পুরুষের সঙ্গে মিলনে কোনও বাধা নেই। তবে কেউ কারও ওপর জোর খাটায় না। পরে কিন্তু সেখানেও ঘটে যাচ্ছে ধর্ষণের মতো ঘটনা। আর মানুষ-সমাজের মতোই ধর্ষণের জন্যে শাস্তি নেই, কেবলমাত্র ধর্ষিতার মৃত্যুটাকেই শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে ধরা হচ্ছে। গল্পের ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছে দেখা যাচ্ছে, এতদিন যা ওরা আগলে রাখত, সেই তাল তাল সোনা, অগুণতি মেয়ে, সেইসবই খোয়া যাচ্ছে। কারণ এ ওরটা চুরি করে নিয়ে গেছে। তৈরি হচ্ছে ক্রোধ। অহংকার আর স্বেচ্ছাচারিতার পরিণতি যেমন হয়, বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে জতুগৃহ। গল্পের শুরু থেকে শেষ যৌনতার ছড়াছড়ি। যা প্রেমের বদলে মনে ঘৃণার উদ্রেক করে। মাত্রাছাড়া বীভৎস রসের এই গল্প সার্থক ডিস্টোপিয়া। কাল্পনিক হয়েও যা আমাদের একেবারে চেনা বাস্তব। সভ্যতার আবরণের নীচে ঘাপটি মেরে থাকা নিজেদেরই হীন প্রবৃত্তির প্রকাশ দেখে আমরা শিউরে উঠি। শেকড় নাড়িয়ে দেওয়া এই লজ্জাটাই বোধহয় পাঠককে উপহার দিয়েছেন লেখক। আশা করেছেন লজ্জার অলংকারে ভূষিত হয়েও যদি আমরা এই পতন আটকাতে সক্রিয় হই। ‘এ বোঝা আমার নামাও বন্ধু নামাও/ ঝড়ের গতিতে চলেছি বন্ধু এ যাত্রা মোর থামাও’। সেই বন্ধু হয়েই পাঠকের হাত ধরেছেন লেখক।
ইউটোপিয়া আর ডিস্টোপিয়ার মধ্যে এমনই সাবলীল বিচরণ দেবর্ষির বিশেষ বৈশিষ্ট্য, মুনশিয়ানার পরিচয়। কিন্তু কাল্পনিক গল্পের এমন আকর্ষণ! পাঠক হিসেবে অবাক হয়েছি আবারও।
ঈশ্বরের কথা বলেছেন দেবর্ষি, কিন্তু প্রাধান্য দিয়েছেন কেবলমাত্র মানবিক ধর্মকে। রাজনীতি এসেছে জনতার রাজনীতি হয়ে। পুঁজিবাদী সমাজের কুফল দ্বারা ভুক্তভোগী মানুষ বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে সাম্যবাদের প্রতিষ্ঠা করেছে। সাম্যবাদে কেউ প্রভু নয়, সকলেই সমান। এমন একটি সাম্যবাদী দেশের সন্ধান পেলাম ‘কমিউনিস্ট দেশের নটরাজ’ গল্পে। এই দেশে গুন্ডামি রাহাজানি দাঙ্গা-হাঙ্গামা নেই। আন্দোলন নেই। পাঠ্য বিষয় থেকে সাহিত্য বা দর্শন অনেকটাই ছেঁটে দেওয়া হয়েছে, কারণ প্রশাসন মনে করে, ‘সাহিত্য বা দর্শন বেশি পড়লে জীবন ও জগতের প্রতি বস্তুবাদী ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে অসুবিধে হবে।’ সেই দেশের নাগরিক নটরাজ একজন শিক্ষিত সরকারি চাকুরে। বিবাহিত। ‘ঈশ্বরে বিশ্বাস যে আদপে শ্রেণী অত্যাচারেরই ফলশ্রুতি, শোষকেরা ওটা ব্যবহার করেছে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে আর শোষিতেরা দুর্দশা ভুলবার পথ হিসেবে।’ এই সাম্যবাদী মতবাদে বিশ্বাসী নটরাজও। তাদের দেশে এখন অত্যাচার নেই। মানুষ খেয়ে-পরে তৃপ্তিতে আছে। ‘কিন্তু বড় আশ্চর্য মানুষের মন। প্রাথমিক প্রবৃত্তিগুলোর যথাযথ ও দীর্ঘকালীন তৃপ্তি ঘটে গেলে জেগে ওঠে অন্য প্রবৃত্তি।’ পুঁজিবাদী দেশে কী হয়, তা দেখলাম ‘রূপান্তর’ উপন্যাসে। আর এই গল্পের সাম্যবাদী দেশটিতে ধর্মচর্চা নিষিদ্ধ। শিল্প-সংস্কৃতিকে বেঁধে রাখা হয়েছে নিয়মের বেড়াজালে। তাহলে মানুষের স্বাধীন চিন্তাগুলো যাবে কোথায়? সেগুলো তো আসে। কেজো মনেও আসে কখনও সখনও। যেমন এসেছে নটরাজের। সেই চিন্তার টানে মন উদাস হয়। নটরাজ একা হতে চায়। নিজের মধ্যে প্রকৃতির মধ্যে ডুবে সেঁচে তুলে আনে ঈশ্বর ভাবনা। ফলস্বরূপ কমিউনিস্টদের বিচারে তার ঠাঁই হয় পাগলাগারদে।
অর্থাৎ কিনা কমিউনিস্ট নিয়মে বেঁধে দিলে, সব সুখই বেস্বাদ হয়ে যায়। সুখের খোঁজে মানুষ অন্য পথ খোঁজে। নিয়ম ভাঙে। আর শাস্তি পায়। সাম্যবাদের এই অসারতার পাশেই এসেছে বহুদলীয় শাসনতন্ত্র। ‘আমিও দলে নাম লেখালাম’ গল্পে একটা দেশে অনেক রাজনৈতিক দল। নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠিত হয়। তাই রাজনৈতিক সচেতন হতেই হবে দেশবাসীকে। নাম লেখাতে হবে কোনও একটা দলে। সব দলের মিটিং মিছিল চলবে। কিন্তু রাজনৈতিক ভাষা এতটাই দুর্বোধ্য, যে সাধারণ মানুষ তা বোঝে না। আর মেয়েরা সেখানে বোবা এবং পুরুষের ব্যক্তিগত ‘মাল’ মাত্র। সরকারি সুযোগ সুবিধেগুলো পেতে সরকারি দলে নাম লেখাতেই হবে। আর নাম লেখানোর পরমুহূর্তেই সে হয়ে যাবে হুকুমের চাকর। বিরোধী দলে গেলেও দলদাস হওয়াই ভবিতব্য। অতি সাধারণ ছাপোষা মানুষ তো একটু খেয়ে-পরে শান্তিতে থাকতে চায়। বিপ্লব অশান্তি অনিশ্চয়তার জীবনকে সে ভয় পায়। অতএব বিরোধী দলে সে কেন যাবে? কিন্তু সরকারি দল তার জন্যে যে কাজ নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, তা মোটেই শান্তির নয়। তার হাতে অস্ত্র, অর্থাৎ মানুষ খুন করার ক্ষমতা। বিরোধীরা তাকে ভয় পাবে না, কিন্তু তার হাতের অস্ত্রটিকে ভয় পাবে। ‘নির্ভরযোগ্য কারও দুটো হাতের সাহায্যে একটু মাটির ওপর উঠতে পারার যে সুখকর স্বাদটুকু থাকে সেটা বড় হবার পর কখনও পাইনি।’ এই না পাওয়ার আক্ষেপ ছাপোষা মানুষের মনে রয়েই যায়। একটু শান্তির আশায় কোনও গোষ্ঠী বা দলে আবদ্ধ হতে চায় না সাধারণ জনতা। ‘যেমন কোনও গোষ্ঠীতে নাম না লিখিয়েই আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের আর বউদের আর গরুবাছুরদের ভালোবাসি’(ভোরের দুঃস্বপ্ন)।
সব গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাই যদি ত্রুটিপূর্ণ, আমরা তবে যাব কোথায়? চলে যাব ‘পরমেশ্বর’ উপন্যাসে। শুধুমাত্র রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে নিজের দলের একটা নিরীহ দরিদ্র ছেলেকে খুন করাল নেতা এবং মন্ত্রী পরমেশ্বর। রাজনীতির আঙিনায় হিসেব মিলে গেলেও ছেলেটার ভূত তার ঘাড়ে চাপল। এবং তার ধ্বংস ডেকে নিয়ে এল। অর্থাৎ নেতা মন্ত্রীরা নিজেদের ঈশ্বর পরমেশ্বর ভাববেন, ভাবতে অভ্যস্ত হবেন। এটা বুঝে নিয়ে মেনে নিয়ে নিজেদের বর্ম নিজেদের তৈরি করতে হবে। পরমেশ্বরের মেয়ের প্রেমিককে আমরা খুঁজে পাই ‘অন্ধকার হয়ে গেল বলে’ গল্পে। ঘটনাটা কলকাতার। দেবর্ষির অনেক গল্প উপন্যাসেরই পটভূমি কলকাতা। লীনার বাড়ি দক্ষিণ কলকাতায়। তার প্রেমিক থাকে উত্তরে জোড়াসাঁকো এলাকায়। সেখানেই ভোটে দাঁড়িয়েছে লীনার বাবা। যদি অন্য কোথাও থেকে দাঁড়াত, বিষয়টাকে পাশ কাটিয়ে যেত তার প্রেমিক। যেভাবে আমরা সর্বক্ষণ নানা সামাজিক সমস্যাকে জঞ্জালের মতো পাশ কাটিয়ে চলি। কিন্তু লীনার বাবাকে ভোট দেওয়া সম্ভব নয় তার পক্ষে। নিজের মনের এতটা বিপরীতে যেতে পারবে না বলে, লীনার প্রেমিকটি বুথের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে সারাদিন। পরে লীনাকে বলে, ‘বুথের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। পকেটে ভোটার আইডি-ও ছিল। কিন্তু অন্ধকার হয়ে যায় বলে গেটটা বন্ধ হয়ে গেল।’ এরপর লীনা সম্পর্ক ছিন্ন করে। অর্থাৎ তালে তাল দিতে না পারায় প্রেমটাকেই বলিদান দিতে হল। এবার পাঠক বুঝুন, আপনি নিয়ম মতে চলবেন, নাকি নিয়ম ভাঙবেন?
‘প্রকৃত শাসক প্রেমিক। এবং জ্ঞানী। প্রেম তাকে দেয় মানুষের প্রতি অপরিসীম করুণা, এতটাই যে সে অন্যের জন্য প্রাণত্যাগ করতেও প্রস্তুত। জ্ঞান তাকে দেয় নিরাসক্তি। সে জানে সে চিরকাল শাসন করতে পারে না। রাজমুকুট ছেড়ে, রাজপ্রাসাদ ছেড়ে তাকে একদিন ধুলোমাটি হতেই হবে। এই বোধ তাকে ক্ষমতাগৃধ্ন হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে। প্রকৃত শাসক মানুষকে ভয় দেখিয়ে নিজের অনুরাগী করে না। মানুষ তার অনুরাগী না হয়ে পারে না। তাকে ভয় পায় না কেউই, ভালোবাসে সবাই। অমরতা লাভের জন্য সে নিজেই উন্মাদ হয়ে ওঠে না। অন্যেরাই তাকে অমর করে রাখে। তার রাজত্বে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খায় না ঠিকই। তবে সমস্ত মানুষ এক ঘাটেই জল খায়’(শাসক)। রাজনীতির ব্যাপারে এমনই বলিষ্ঠ স্বর দেবর্ষির। যা সমাজের অসহায় মধ্যবিত্ত্ব চরিত্রগুলোকে মান্যতা দেয়, সম্মান করে। ভয়ের রূপ হল বাঘ। তাঁর লেখায় বাঘ বীরত্বের প্রতীক নয়, ভয়ঙ্করের প্রতীক। খুন করার সময় রাজার নিজেকে বাঘ মনে হয়(শব্দ, নৈঃশব্দ্য)। প্রেমিকার আবদারে বাঘের মূর্তি গড়তে গিয়ে এক প্রেমিক ব্যাঘ্রত্ব নির্মাণ করে, যার ভয়ঙ্কর রূপ সহ্য করতে না পেরে, শিল্পীকেই হত্যা করে প্রেমিকার বাবা গোষ্ঠীপতি(বাঘ)। হেরে যাওয়া রাজনৈতিক নেতা ক্রোধে বাঘ হয়ে খুন করে সুন্দর নিষ্পাপ খরগোশকে(গণতান্ত্রিক ভয়)।
কত তুচ্ছ কারণে ভয় পায় সাধারণ মানুষ। তার নিখুঁত বাস্তব বর্ণনা রয়েছে গল্পগুলির ছত্রে ছত্রে। তারা ভিতু, কিন্তু সৎ সাহসের হঠাৎ ঝলকানিও দেখা যায় তাদের আচরণে। যদিও অত্যন্ত ভিতু সংযত নাগরিক সহসা বেপরোয়া সাহস দেখায় না। তবু সততার একটা জোর মনের গভীরে কোনও অবচেতনেই বাসা বেঁধে থাকে, যাকে তারা নিজেরা দেখতে না পেলেও শাসকের শকুন-চোখ দেখে বা কল্পনা করে নেয়। আর ভয় পেতে থাকে। লেখার মধ্যে দিয়েই এই সত্যিটাকে পাঠকের কাছে প্রমাণ করেছেন দেবর্ষি।
শাসক যখন প্রভু হয়ে ওঠে, মূক জনতা তার দিকে ছুঁড়ে দেয় শ্লেষ, ‘কুড়ি-পঁচিশজন লোক আমাদের ঘিরে দাঁড়াল। টলতে টলতে আমিও উঠে দাঁড়ালাম শাসকের পাশে। আমার পা কাঁপছিল। লোকগুলো হয়তো কাজে যাচ্ছিল, কারণ ওদের হাতে ছিল ঝুড়ি, দড়ি, বালতি ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি। পকেটে হাত দিয়ে আমি একবার পিস্তল ছুঁলাম। কিন্তু বুঝতে পারলাম গুলি চালাবার চেষ্টা করলে ওরা এক্ষুণি আমাদের ছিঁড়ে ফেলবে। ‘স্বাভাবিক মৃত্যু শেষপর্যন্ত খুব কম শাসকের কপালেই জোটে’, ক্রুর দৃষ্টিতে হেসে ওদের একজন বলল। শাসকের প্রতি লোকটার যে দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্রোধ ও ঘৃণা ছিল সেটা ফুটে উঠছিল তার চোখেমুখে। এরপর হঠাৎ একটা ধাক্কা দিয়ে তারা শাসককে মাটিতে ফেলে দিল, তারপর খুব দ্রুত হাতে তাঁর পায়ে একটা লম্বা দড়ি বেঁধে দিয়ে তাঁকে টেনে নিয়ে দৌড়তে লাগল শিশিরে ভেজা মাঠের উপর দিয়ে। আমাকে ওরা ধাক্কা দিয়ে ফেলেনি, আমার পায়ে দড়িও বাঁধেনি, কিন্তু হতভম্ব হয়ে লক্ষ করলাম আমিও একইভাবে শুয়ে কারও অদৃশ্য টানে শাসকের ঠিক পাশাপাশি মাটির উপর দিয়ে চলেছি। তারপর বুঝলাম আমি তো শাসকের একটা অঙ্গের মতো, ফলে তাঁর সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য থাকাই আমার নিয়তি। মাঠের উপর দিয়ে গড়াতে গড়াতে আর্ত, আতঙ্কিত মুখে তিনি আমার মুখের দিকে তাকাচ্ছিলেন, যেন আমি তাঁকে বাঁচাব। আমার কষ্ট হচ্ছিল তাঁর জন্য। কিন্তু অনেক সময় একইসঙ্গে মরে যাওয়া ছাড়া বেচারি দেহরক্ষীর আর কী-ই বা করার থাকে’(দেহরক্ষী)।
কখনও শাসকের দিকে ছুঁড়ে দেয় বিদ্রুপ, ‘তুই যদি বলতে পারিস এখানে মাটির নীচে কোথায় একটা নরকঙ্কাল পাব তবে তোকে একটা জ্যান্ত মুরগি দেব’, নেতা বললেন শেয়ালকে। ‘এ আর শক্ত কী। ওই তো ওখানে খুঁড়লেই একটা পাবেন’। শেয়ালের দেখানো জায়গায় মাটি খুঁড়ে সত্যি একটা নরকঙ্কাল পাওয়া গেল। খুশি হয়ে নেতা ওর দিকে একটা মুরগি ছুঁড়ে দিলেন। মুরগিটা মুখে তোলার আগে শেয়াল হেসে বলল, ‘ওই লোকটা কিন্তু আপনার বিরোধীদলের সমর্থক ছিল। খুন করিয়েছিলেন আপনারাই’(শাসক)।
তারা শাসকের দিকে ছুঁড়ে দেয় করুণা, ‘বলা হয়ে থাকে যে রাজা এরপর হত্যার অনুভব ও অভিজ্ঞতার নিখুঁত বর্ণনা দিতে সত্যি সক্ষম হয়েছিল। ‘কিন্তু আমরা তবু বুঝতে পারছি না, মহারাজ’ ওদের একজন রাজাকে বলল। ‘এবং কখনই বুঝব না যদি না নিজের হাতে কখনও হত্যা করি’। কথাগুলো বলে সাদা কাপড়ে মোড়া মানুষগুলো নিজেদের সরল, মুগ্ধ ও বেদনার্ত চাহনি নিয়ে অস্বচ্ছ ঢেউয়ের মতো ভাসতে ভাসতে অদৃশ্য হয়ে গেল। প্রায়ান্ধকার বনভূমিতে একা দাঁড়িয়ে রাজা চিৎকার করে ওঠে, কোনও দুঃস্বপ্ন ভাঙার ঠিক আগের মুহূর্তে কেউ যেমন চিৎকার করে জেগে ওঠে। রাজার উন্মাদ হয়ে যাবার কথা। কিন্তু হয়নি। কারণ অতল অন্ধকার গহ্বরে পড়ার হাত থেকে ওর চেতনাকে শেষপর্যন্ত ধরে রেখেছিল মানুষটির শেষ শব্দগুলো’(শব্দ, নৈঃশব্দ্য)।
মানুষ মানুষকে হত্যা করে কেন? প্রতিদিন নানা হত্যার খবর আমরা পাই। ব্যক্তিগত আক্রোশ, নিছক ধর্ষণ থেকে খুন, রাজনৈতিক হত্যা, ইতিহাসেও আছে নানা হত্যার কাহিনি। নিজের স্বার্থ পূরণ করতে মানুষ হত্যা করে। ‘দার্শনিক বলল, তাতে অবাক হবার কিছু নেই। কারণ হত্যাকে রোধ করার জন্য হত্যা দরকার। কিছু মানুষ হত্যাকারী হয়ে ওঠে বলেই অধিকাংশ মানুষ মানবিক থাকে। জগতের প্রতিটি হত্যা অন্যদের একটু মানবিক করে দিয়ে যায়। এই নিষ্ঠুর নিয়ম ছাড়া যে মানুষ মানবিক হত না’(আত্মহত্যা)। কী অদ্ভুত বিশ্লেষণ! দার্শনিকের এই কথা কি আমরা মেনে নিতে পারি? লেখকও সম্ভবত পারেননি। তাই ‘আত্মহত্যা’ গল্পে শ্যামকে কেন হত্যা করা হচ্ছে, তার কোনও উল্লেখ নেই। তিনজন চরিত্র পরিকল্পনা করে নিশুতি ভোরে হত্যা করছে শ্যামকে। মারার আগে একটা দীর্ঘ সময় তাকে হাতমুখ বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে। শ্যাম ভাবছে তার বউ মেয়ের কথা। বেঁচে থাকলে সে যা যা উপভোগ করত, ওরা অর্থাৎ ওর পরিচিত তিন হত্যাকারী, সেগুলো উপভোগ করবে। সংসারের সুখ দুঃখ, উৎসবের আনন্দ, প্রকৃতির রূপ, সব ওরা উপভোগ করবে। কিন্তু শ্যাম পারবে না। নাকি ওদের চোখ দিয়ে শ্যাম এখনি সেসবের স্বাদ নিয়ে ফেলল, আর অন্তিম মুহূর্তে ‘শ্যাম গামছা বাঁধা মুখের ভেতর দিয়ে চেঁচিয়ে বলতে চাইল, নারান থামো থামো! নিজেকে হত্যা কেন করছ গো?’ অর্থাৎ কিনা প্রতিটা হত্যাই আসলে আত্মহত্যা। ‘হত্যা করার পর থেকে হত্যাকারীকে আজীবন পেছনদিকে তাকিয়ে হাঁটতে হয়’, কেউ ফলো করছে কিনা, এই দুর্ভাবনায়। এখানে ‘হত্যা’ শব্দটাকে যদি প্রতীক হিসেবে ধরি, যে কোনও অপরাধই পরবর্তী জীবনে মানুষকে স্বস্তি দেয় না। আমি যদি কারও প্রাপ্য ছিনিয়ে নিই, অন্যকে ল্যাং মেরে নিজের আখের গোছাই, তাৎক্ষণিক সুখ হয়তো পাব, কিন্তু মনের অশান্তি থেকে মুক্তি মিলবে না। কিন্তু এ তো নীতিকথা। নীতিকথা আওড়ানোর জন্যে আমরা সাহিত্য পড়ি না। হত্যার মতো ঘৃণ্য বাস্তবও আমাদের কাম্য নয়। তাহলে রাজনীতির অসারতা আর হত্যার মতো অপরাধকে অবশ্যম্ভাবি বাস্তব হিসেবে দেখিয়ে তো আমাদের চরম বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দিলেন লেখক!
কখনও কখনও আলস্য, বিষাদ, অসহায়তার মতো টোটাল নেগেটিভিটির মধ্যেও পাঠককে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছেন দেবর্ষি। ‘একটি মৃতদেহ ও প্রজাপতিরা’ গল্পে একটি শব নিয়ে চলেছে শবযাত্রীরা। আর এক যুবক, যে রাতের কলকাতায় এমনিই বেরিয়ে পড়েছে, সেই শবটির মুখ দেখছে নিবিষ্ট হয়ে। কারণ, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ‘এই মুখটা পৃথিবী থেকে চিরকালের জন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। একজনের মৃত্যু মানে একটা অদ্বিতীয় মুখের মৃত্যু।’(ঠিক এই বাক্যটিই ‘রাম রায়’ উপন্যাসেও পেয়েছি)। কিন্তু রাতের কলকাতা মানেই অপরাধের হাট। এই গল্পে আমরা একটা মেয়েকে দেখছি, যাকে ভোগ করবে বলে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে একদল উন্মত্ত পুরুষ। মেয়েটা ওই যুবককে সামনে দেখে তার হাত ধরছে, পালিয়ে যেতে চাইছে, বাঁচতে চাইছে যুবকটির সাহায্যে নিয়ে। কিন্তু যুবক তৎপর হচ্ছে না। মেয়েটার জন্যে তার খারাপ লাগলেও সে মৃত মানুষটির মুখের দিকেই মনোযোগ দিচ্ছে বেশি। কারণ মুখটা হারিয়ে যাবে। আর মেয়েটাকে বাঁচানোর মতো শক্তি ক্ষমতা সাহস কিছুই তো তার নেই। সে বড় অসহায়। কিছু কিছু সূক্ষ্ম অনুভূতি, উপলব্ধি-সমৃদ্ধ একই বাক্য অত্যন্ত সচেতনভাবেই একাধিক গল্পে বারবার বসিয়েছেন লেখক। ঠিক যেভাবে শিশুকে সু-অভ্যাস রপ্ত করানো হয়, পাঠকের চেতনার দরজায় এভাবে বারবার টোকা দিয়েছেন, যাতে সে ভুলে না যায়।
বাক্যের মতোই আলাদা আলাদা গল্পে ফিরে ফিরে এসেছে একটাই চরিত্র। নাম উহ্য, সে এক যুবক। তার দেখা তার অনুভূতি আত্মমগ্নতা..., বাস্তবের আঘাতে সে কষ্ট পাচ্ছে, কিন্তু প্রতিবাদে সোচ্চার হচ্ছে না। অথচ সে কাপুরুষ নয়, কিন্তু বড় অসহায় সে। অন্যদিকে এই পৃথিবী প্রকৃতি মানুষ সবই তাকে মুগ্ধ করে। এই মুগ্ধতা নিয়েই সে বেঁচে থাকতে চায়। পাঠকের মনেও এই মুগ্ধতার সংক্রমণ ঘটান লেখক। তাঁর ‘জাদুকর গল্পে রয়েছে পৃথিবীর সেরা জাদুকরের কথা। ‘পৃথিবীর সর্বত্রই দর্শকরা অংশ নিতে থাকে তার খেলায়। তার জাদুর এমনই ক্ষমতা আর সে ক্ষমতা এত দূরপ্রসারী যে কারও কারও মতে সে খেলা দেখাচ্ছে হয়তো আফ্রিকার কোনও গ্রামে, আর তাতে অন্তত পরোক্ষভাবে প্রভাবিত হচ্ছে ভারতবর্ষের মানুষরাও। অনেকের মতে আমি যে এই মুহূর্তে জাদুকরটাকে নিয়ে গল্প লিখছি সেটাও হয়তো তারই সম্মোহনবিদ্যার কোনও ফল।’ তাঁর লেখায় যে বিভ্রান্তি আমাদের মনে তৈরি হয়েছিল, তার মীমাংসা রয়েছে এই গল্পে। এভাবেই একটাই ধারাবাহিক গল্পের মতো চলেছে দেবর্ষির কলম। কোথাও প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে, কোথাও রয়েছে উত্তর।
কুয়োর মতো একটা গর্ত খুঁড়ে জাদুকর তার খেলার আয়োজন করে। সন্ধের মুখে অন্ধকার গর্তের ভেতর একটা হীরের আংটি সে ফেলে দেবে। দর্শকের কাজ সেটা তুলে আনা। ‘গর্তে নেমে আংটিটা ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্পর্শকারীর সমস্ত সত্তায় জমাট বাঁধবে এক এমন পরম আনন্দের ঘোর, যা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত সে আর কখনওই হবে না। ...অনেকের মতে যৌনক্রিয়ার আনন্দকে যদি কোনোভাবে সহস্রগুণ বাড়িয়ে দেওয়া যায় তবে যে আনন্দ পাওয়া যাবে, জাদুকরের আংটি থেকে পাওয়া আনন্দ কতকটা সেরকমই।’ খেলা দেখানো জাদুকরের নেশা। নেশায় যেমন সু্খ আনন্দ, খেলা দেখিয়ে জাদুকরেরও সুখ। পৃথিবীতে সবাই আনন্দ পেতে চায়, ‘আনন্দের একটা গোপন শিরা ঘুমিয়ে আছে প্রত্যেকের ভিতরই।’
স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে জাদুকর সবাইকে ডাকে। ঘুম থেকে উঠে স্বপ্নের কথা সবাই ভুলে যায়। কেউ কেউ মনে রাখে, বা রাখতে পারে। তারাই আসে খেলা দেখতে। হুজুকে মেতেও আসে কেউ কেউ। কিন্তু গর্তে নামার সাহস বা উৎসাহ দেখায় না। এইরকম কুয়াশাময় হেঁয়ালির মধ্যে পাঠককে ডেকে নিচ্ছেন, যুক্তির পর যুক্তি সাজিয়ে। লেখক নিজেই সেই জাদুকর। সাহিত্য পাঠের মধ্যেই তো রয়েছে হীরের আংটি ছোঁয়ার সুখ। এখানেই বিনোদনকে অতিক্রম করে গেছে সাহিত্য। দেবর্ষি সারগী-রচিত সাহিত্যের স্বাদ যে পাঠক একবার পাবে, আর ছাড়তে পারবে না। আমি এখানেই থামব, কারণ ‘নতুন অভিজ্ঞতা একজন মানুষকে বোবা করে রাখে, যতদিন না অন্যদেরও অভিজ্ঞতাটা হচ্ছে’(শেষ ধাপ)।
লেখক পরিচিতি
কাবেরী চক্রবর্তী
কলকাতায় থাকেন।
কথাসাহিত্যিক। প্রবন্ধকার।
কথাসাহিত্যিক। প্রবন্ধকার।
0 মন্তব্যসমূহ