পার্থ
গাছ আঁকছিল। এক বিশেষ আলোয় সে দেখেছে গাছকে যার তলায় রাতের বেলা হরিণ
ঘুরছিল। রাতের বেলা বলে তখন গাছকে দেখা যায়নি, রান্নাঘরের জানলার পাতলা
জালের ওপাশে দলে দলে হরিণ দেখা গেছে — চিতল হরিণ। ছবি আঁকছে দেখে বাপ্পা
তাকে বলল,“সূর্যের আলোয় তোর মাথা ধরে যাবে। ছাওয়ায় বস।” পার্থ বলল,“ হ্যাঁ
রোদে আমার মাথা ধরে যাবে। সরে যাচ্ছি। ” বাপ্পা বলল,“ সূর্যের আলো পড়লেই
রোদ হয় আর গরম চেপে আসে তখনই তোর মাথা ধরবে। এই জঙ্গলের মধ্যে মাথা ধরে
গেলে রোদ লেগে গেলে বড় মুশকিল।” একটা বিশেষ কোণ থেকে পার্থ গাছটা দেখতে পেল
আর আলো এসে তাতে এমনভাবে পড়ল যে সে থাকতে না পেরে ছবি আঁকছে। সামনের
রাস্তা দিয়ে একটা বাঁদর হেঁটে হেঁটে আসছিল, কুমু মালানি বনবাংলোর চাতালে
বসে বসে দেখছিল বাঁদরের হাঁটা — রাস্তা দিয়ে। সে সার সার বাঁদর আসতে পারে
এই ভয়ে উঠে বাংলোর ডাইনিং হলের জাল লাগানো দরজাটা বন্ধ করে দিল যাতে ওরা
ফায়ারপ্লেসের ওপর রাখা ফল টেনে নিয়ে না যায়। বারান্দার ওপর দিয়ে তাড়াতাড়ি
যেতে গিয়ে কুমু বাবাইয়ের পা মাড়িয়ে দিচ্ছিল আর বলে উঠল,“ সরি বাবাইদা।“
বাবাই সকালবেলা সাফারি করে ফিরে ঝিমোচ্ছিল, সে বলল,“ সরি ? কেন সরি বলছিস
?” কুমু বলল,“ এমনি। ” বাবাই বলল,“ এমনি কেউ কাউকে সরি বলে ?” কুমু চুপ করে
গেল। সে চুপ করে গেলে আসপাশও চুপ করে গেল কারণ এখন আর কোন আওয়াজ হচ্ছে না।
কোন পাখি ডাকাডাকি করেনি, কোন জন্তুর ডাকও শোনা যায়নি। সামনে শুখনো রাস্তা
সোজা চলে গেছে মালানি বনবাংলো ছেড়ে সেটা গেট দিয়ে আলাদা করা আছে। পাতলা
লোহার গেট আর তাতে রাত হলে সৌর বিদ্যুত লাগানো থাকে যাতে কেউ ঢুকতে না পারে
অথবা বেরতে। গেটের গা দিয়ে দিয়ে তার লাগানো থাকে, পাতলা তার অথচ আলো না
জ্বালিয়ে তাতে বিদ্যুত সংযোগ করা হয়। বাবাই প্রথম দিন সকালে ওই গেটের
বাইরে যেতে গিয়েছিল, তাকে বলা হয়েছিল না যেতে, বারণ করা হয়েছে। গেটের ওপারে
জীবজন্তুরা থাকে তাদের সঙ্গে পায়ে হেঁটে দেখাসাক্ষাৎ করা চলবে না। যা কিছু
বাইরে যাবার তা ওই সকালবেলা বা বিকেলবেলা সাফারি করার সময়। বাংলোর ডান পাশ
দিয়ে ওই যে রাস্তা ধারাবাহিক আসতে থাকে সেটা যেন সব সময় চোখে পড়বে সবারই
অথচ তাতে হাঁটা যাবে না। বাপ্পা , বাবাই আর কুমু ছড়িয়েছিটিয়ে বসে দাঁড়িয়ে
ঝিমিয়ে বারবারই ওই রাস্তার দিকে তাকাচ্ছিল। একমাত্র পার্থই মাটিতে বসে।
সে একটা গাছ একমনে তুলে এনে তাতে রঙের আঁচড় দিয়েছে আর আর তাও কাগজের ওপর
সেখানে এখন অনেক ঘাস বানাতে হবে। সেটা রাস্তার মতো নেড়া হলে চলবে না —
এপ্রিলের দুপুরের জঙ্গলের রাস্তার মতো। গরম দুপুরের হাওয়া চারপাশ থেকে
ধুলোও আনছিল। গুঁড়ো গুঁড়ো ধুলো, কখনও দেখা যায় কখনও যায় না। বাবাই কুমুকে
বলল,“ চা করতে বল না ভিকিকে।” কুমু কিছু বলছে না দেখে সে বলল,“ বলবি না ?”
কুমু তার ব্যাগ থেকে একটা বই বার করে পড়ছিল। বাবাই এখনও ঝিমোচ্ছে, তার চোখ
আধবোজা, সেকি একটু একটু করে সব দেখে ফেলছে বলে চুপচাপ ? কুমু বই বন্ধ করে
বলল,“ বলছি। ” বলে সে বন বাংলোর কিচেনে ভিকি বলে যে ছেলেটা রান্না করে
দিচ্ছে তাকে চা বানাতে বলতে গেল। বেতের আরাম কেদারায় তার বইটা পড়ে রইল।
যতক্ষণ না কুমু ফিরে এসে আবার তাকে তুলে নিচ্ছে সে পড়ে থাকতেই পারে আর
হাওয়া এসে তার পাতাকে মাঝমধ্যে তুলে ধরবে তখন তার ফাঁক দিয়ে শব্দরা গড়াতে
থাকবে, গড়িয়ে গড়িয়ে মালানির চারপাশে শব্দরা দেওয়াল তুলতে থাকবে। সে দেওয়াল
দেখা যেতে পারে নাও পারে। সেখানে অনেক কথা লেখা থাকবে। হিজিবিজি সব কথা। বই
থেকে বেরিয়ে শব্দরা গরমের মধ্যে হাল্কা হয় উড়ে উড়ে এঁকেবেঁকে উল্টোপাল্টা
কথা লিখেছে দেওয়ালের ওপর যার ভেতর দিয়ে অনায়াসে পারাপার করা যায় বলে বাবাই
এক বড় হাই তুলে ঝিমুনি থামাল আর তখনই তার পার্থর দিকে চোখ পড়ল। সে দেখল
পার্থ রোদ থেকে সরে এসে বনবাংলোর সামনে বারান্দার এক কোণে বসে , মাটিতে বসে
, একমনে ছবি আঁকছে আর বাপ্পা পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। বাপ্পা কীরকম
করে দেখছে ছবি ? সে তো ওপর থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তার কীরকম করে
ছবি দেখার কথা ? বাবাই বাপ্পাকে বলল,“ তুই কীরকম করে ছবি দেখছিস ?”
—— মানে ?
—— তুই তো ওপর থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে রয়েছিস।
—— পার্থর ছবি দেখছি।
—— পার্থ তো বসে রয়েছে।
—— তাতে কী ?
—— পার্থ বসে বসে ছবি আঁকলে তোরও বসে বসে দেখার কথা।
বাপ্পা কোন উত্তর দিল না, পার্থ বলল,“ আমি গাছের ছবি আঁকছি। ওই গাছটাকে
ওপাশ থেকে দেখেছিলাম। ওখানে আঁকতে শুরু করেছিলাম কিন্তু গরম পড়ে গেল।
ছাওয়ায় চলে এলাম। বারান্দায় ফ্রেমটা তুলে নিয়েছি। আঁকছি। আলোটা কীরকম যেন
পড়েছিল ?” বাপ্পা বলল,“ পড়েছিল বলছিস কেন ? এখন নেই ?” পার্থ বলল,“ না নেই।
আলোটা অন্যরকম হয়ে গেছে। গরমটা বেড়ে গেছে দেখছ না।” বাবাই বলল,“ আর
গাছটা ?” এই সময় কুমু চা নিয়ে এল। সে সবাইকে চা দিতে লাগল। এ এরকম ঠিকই হয়ে
গেছে মেয়েরাই সবাইকে চা দেবে তাই কুমু দিচ্ছিল। বাবাই বলল,“ কুমু ছেলেদের
নামও হতে পারত।” কুমু বলল,“ কিন্তু চা-টা বানিয়েছে ভিকি - সে ছেলে। ”চায়ে
একটা লেবু দেওয়া ছিল। তার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল হাওয়ার মধ্যে। চার দিকে
তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়ার কথা। মালানি বাংলোটা অনেকটা ওপরে। অনেক উঁচুনিচু
পেরিয়ে তাতে যেতে হবে। তখন জঙ্গল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। দেখে আর তার গা থেকে
থেকে সব পাতারা খসে গিয়ে মাটিতে পড়ে আছে , ফলে তারা তাপমাত্রা কমা বাড়া খুব
বুঝতে পারে। রাতে যখন বাঘ তার ছানাকে নিয়ে হাঁটা দেয় তখন হিম পড়ে পড়ে
পাতারা নেতিয়ে থাকায় কোন আওয়াজ দেয় না। সে সময় তাদের রঙও বদলে অনেকটা কালো
মতো হয়ে যায় আর তার ওপর দিয়ে বাঘ তার ছানাদের নিয়ে অনবরত নিরাপদ জায়গায়
নিয়ে যেতে থাকে। সে বাঘকে কি শেরনি বলা ঠিক হবে ? সে কি জেনেশুনে মেয়ে বাঘ
হয়েছে ? তবে তার বোধ তাকে বলছে , অন্য কিছু থেকে, যার মধ্যে বাঘও পড়ে,
ছানাদের বাঁচাতে হবে। না হলে ছানারা মরে যাবে আর সেটা তার সহ্য হবে না।
কুমু কি এইভাবে না জেনে মেয়ে হয়ে জঙ্গলে এসেছে ? তবে বাঘ তার ছানাদের নিয়ে
নিঃশব্দ রাত্রিতে হাঁটতে হাঁটতে কখনও কখনও রাস্তাতেও এসে পড়েছিল। এখন
রাস্তায় পুরু ধুলো আর তাতে জিপসির টায়ারের দাগ কারণ অন্য কোন গাড়ি এখানে
আসা নিষেধ। মাঝে মাঝে বনবিভাগের মাল বওয়া ট্র্যাক্টর আসা যাওয়া করতে পারে
আর সরু সরু মটোর বাইকের চাকা দেখা যেতে পারে নাও পারে যা বনরক্ষীদের
নিজস্ব। টায়ারের দাগের পাশাপাশি বাঘ ও তার ছানাদের তেরছা দাগ দেখতে পেয়ে
কুমু বলেছিল,“ ওই দেখ। ” সবাই দেখল বাঘের ছাপ। আলম নাম করে যে গাইড অথবা
ড্রাইভার ছেলেটি আছে তারই প্রথম দেখার কথা কারণ সে ধিকালাতেই জন্মেছে যা
করবেটের প্রাণ — ওই বনবাংলোর আসপাশের কোন স্টাফ কোয়ার্টারে তার বনরক্ষী
বাবা ও মায়ের ঘরে। জঙ্গলের কথাতে আলমের হক আছে এ নিয়ে কোন প্রশ্ন উঠতে পারে
না। সে হয়ত সামনের দিকে তাকাতে গিয়ে টায়ারের একদম পাশে পাগ মার্ক দেখতে
পায় নি। কুমুর দেখান বাঘের পা ও তার ছাপ দেখতে দেখতে সকালের সাফারির
উদ্দেশ্য ঠিক হয়ে গেল আর তা হল বাঘ ও তার ছানাদের সঙ্গে মোলাকাত। আলম বলল,“
ক্যামেরা রেডি রাখিয়ে।” চারজনের হাতেই ক্যামেরা ছিল আর ছিল ভোরের হিম যা
ক্রমশ কমে আসছিল। তাপমাত্রা আধ ঘন্টা অন্তর অন্তর বাড়ছিল। যতই বাড়ছিল ততো
কি আরো গাছেদের পড়ে থাকা পাতাদের ওপর হাঁটার শব্দ বাড়ছিল, যার ফলে বাঘ ও
তার ছানারা আরো দূরে সরে যাচ্ছিল কিনা কে জানে ?
আলম কান খাড়া করে শব্দ শোনার চেষ্টা করছিল যা সে ছোটবেলা থেকে শুনে আসছে।
যা করবেট সাহেব শুনে আসছিল ছোটবেলা থেকে সেই — ‘কল’য়ের শব্দ , জীবজন্তুর
ডাক। এটা হলে বোঝা যাবে বাঘ হাঁটছে আর বন্ধ হলে তার চলা থেমে গেছে এরকমটা
ধরে নেওয়া যাবে কি ? এটাকে ওরা ইংরিজিতে ‘কল’ বলে কেন ? সেকি সাহেবরা আলাদা
করে জঙ্গল দেখতে শিখিয়েছে বলে ? আগে কি কুমায়ুন গাড়োয়ালের লোক জঙ্গলকে
আলাদা দেখতেই শেখেনি বলে আলাদা করে ডাক শুনতেও শেখেনি। তাই বোধহয় হবে, তবে
আলমই কি করবেটের মতোই একটা কিছু যে জঙ্গলের ভেতরে একটা সভ্য মানুষ বলে
প্রতিটি ‘কল’ই তার মুখস্থ হবে এমন কথা দেওয়া আছে। মুখস্থ এবং অভ্রান্ত
তার লক্ষ্য। সে সব জানে , কোনখানে মহিলা শম্বররা চরে, কোনোখানে পাহাড়ের ওপর
থেকে বুনো শুয়োরেরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে তলায় জিপসি চড়া সাফারির দলকে যেন
ছবির মতো করে দেখছে। বাপ্পা যে রকম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বসে আঁকা পার্থর ছবি
আঁকা দেখছিল, এইভাবে অভ্রান্ত লক্ষ্য হয়ে বাঘ ও ছানাদের খোঁজ করতে করতে
গাড়ি গড়াতে গড়াতে নিয়ে এসে আলম একটা খাদের ওপর দাঁড় করাল । তার তলায় এক
প্রাচীন জলাশয় দেখা যাচ্ছিল। চারজন সাফারির দল ওরা খুঁজতে লাগল এই জলাশয়ে
হরিণ এসেছে কিনা আর বাঘ কোণ কোণ থেকে গুঁড়ি মেরে হরিণকে দেখছে কিনা।
বাপ্পা, বাবাই, পার্থ আর কুমু প্রত্যেকে তাদের স্ব স্ব ক্যামেরা নিয়ে
জিপসির ওপর থেকে অথবা নেমে হেঁটে গুঁড়ি মেরে নানারকম ভাবে ছবি শিকার করছিল।
আলম তখন তার বায়োনোকুলারটা চোখে লাগিয়ে চারপাশে একটা বড় ভাবে প্যান করে
করে দেখার ও দেখানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। তখন খাদের ওপর আর তলা থেকে
আস্তে আস্তে পাতার আওয়াজ বাড়ছে দেখে হাওয়া যেন আর একটু জোরে বইতে আরম্ভ
করে দিয়েছে। বাঁদরেরা ঘুরে ঘুরে আরো বেশি করে লাফালাফি করায় আধ খাওয়া ফলেরা
পাতার পুরু আস্তরণের ওপর পড়ছে। টুপটাপ টুপটাপ টুপটাপ। মনে হচ্ছে কে যেন
পাতার ওপর দিয়ে আসছে। বোঝা গেল জঙ্গলের তাপমাত্রা অনেকখানি বেড়ে বেড়ে এমন
হয়েছে যে গায়ে আর পাতলা সোয়েটার রাখা যাবে না। আলম খাদের ধারে চলে গিয়ে
জলাশয়ের দিকে বায়নোকুলার দিয়ে দেখছে আর বলছে,“ দো মগরমছ হ্যায় তলাও মে।”
সবাই আবার তাপমাত্রার কথা ভুলে জলাশয়ের কুমিরের নড়াচড়া দেখতে গেল। তারা
ঘামছিল ও বোধহয় বাঘের কথা ভুলে গিয়েছিল , শুধু বাপ্পা বলল,“ এ ভাবে হয় না।”
—— কেন ?
—— গাড়িতে হয় না।
—— তবে ?
—— হেঁটে যেতে হবে।
—— কোথায় ?
—— জঙ্গলের ভেতরে ভেতরে চলে যেতে হবে।
—— বাঘেরা আওয়াজ পেলে আগেই পালাবে।
—— তারা গাড়ির আওয়াজে পালাবে না ?
—— না। ওরা ‘ইউজড টু’ হয়ে গেছে।
—— কে বলল ?
—— আলম।
—— কখন ?
—— আমি শুনেছি
—— ও বলছে যে সব বাঘেরা ‘ইউজড টু’ হয়ে গেছে তারা ভয় পায় না। মানুষের কাছাকাছি চলে আসে।
—— আর গাড়ির ?
—— জানি না।
—— ওরা গাড়ির কাছাকাছি চলে আসতে পারে হয় বাঘেরা নয় হরিণেরা অথবা বুনো শুয়োর সবাই চলে আসতে পারে।
—— যদি তারা ‘ইউজড টু’ হয়। আর ভয় পাবে না।
—— কেন ?
—— আলম বলেছে।
—— ও কি করবেট — যে সব জানে ?
—— করবেট সব জানত ?
—— জানি না।
—— ধিকালায় ঢোকার মুখে করবেটের একটা ছবি দেখলাম। জঙ্গল আর তার মধ্যিখানে করবেটের মুখ।
—— আর করবেটের বন্দুক ?
—— সেটা আমি কালাধুঙ্গির মিউজিয়মে দেখিনি।
—— তবে ?
—— বন্দুকের আলমারি দেখেছিলাম — খালি।
—— করবেটের বন্দুক কোথায় ?
—— জানি না।
—— আলমের কি বন্দুক আছে ?
—— ওর বায়নোকুলার আছে।
—— করবেটের বায়নোকুলার ছিল কি ?
কুমু আস্তে আস্তে চা খাচ্ছিল আর গন্ধ পাচ্ছিল লেবুর। এখানে ওরা রেশন নিয়ে
এসেছে। তার মধ্যে লেবু ছিল না। ভিকি রান্না করে দিচ্ছে। সে এই লেবু দিচ্ছে
যাতে গন্ধ আছে আর তা জঙ্গলের মধ্যিখানে, এই বনবাংলোর হাতার মধ্যিখানে,
স্টাফ কোয়ার্টারের আসপাশে বসানো কোন গাছের থেকে সদ্য তোলা। তার বইটা উপুড়
হয়ে পড়ে আছে। সেখানে সে মহামারীর ইতিহাস পড়ে দেখেছে যত লোক পৃথিবীতে মারা
গেছে তার অধিকাংশই এ দেশের। এখানে প্রদেশ ভাগ নেই। আছে একটা সংখ্যা, সেটা
কিছু ধারণার যোগফল যার মানে হল এই সংখ্যক লোক মারা যাবে এমনটাই মনে করা
হচ্ছে। কারা মনে করছে ? কারা মনে করেছে ? কারা মনে করছে না ? একশো বছর,
দুশো বছর গোটাটাই আসলে মহামারীর ইতিহাস এসব এই সন্ধের আলোয় পড়ছিল কুমু।
বাকি তিনজন বারান্দা থেকে বেরিয়ে এসে মালানির বাংলোর চাতালে বসে চা নাস্তা
করছিল। সেই সব চায়ের কাপ পড়ে রয়েছে। নাস্তা শেষ হয়ে গেছে। ভিকি আর একবার
চা আনতে গেছে। আর দুবেলা জঙ্গল সাফারির ধকল সেরে কুমু পড়ছে মহামারীর
ইতিহাস। এটা সে অনেকদিন ধরেই পড়ছে। মহামারী হলেও পড়ছে না হলেও পড়ছে আর পড়ছে
করবেট। এই করবেটের জঙ্গলে এসে সে আবারও করবেট পড়বে যেন ঠিক করা ছিল।
বাঘেদের এরকম মহামারী হয়েই চলবে এটা বুঝে করবেট ক্যামেরা নিয়ে বাঘ পেতে
চাইত। আর করবেট ক্যামেরা নিয়ে বাঘ পেয়েই যেত। সে ওষুধ বিলি করত গ্রামের
লোকেদের। বনবাংলোর মধ্যে গ্রামের লোকেদের চাইলেও পাওয়া যাবে না। এখন সন্ধে
সাতটা, তার মধ্যেও যে আলো আসছে তাতে সবার ছবি তোলা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে
সবাই গেঞ্জি পরে ছড়িয়েছিটিয়ে বসে আছে। চারপাশ থেকে ভেসে আসছে নানান ডাক —
জীবজন্তর সব ‘কল’। এখন কি মালানি বাংলোর তলায় সোঁতার মধ্যে দিয়ে বাঘ তার
সঙ্গিনীকে নিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটছে। মহামারীতে কিন্তু চিতাবাঘের সংখ্যা
বেড়েই চলেছে এমনটা বলেছি করবেট। আধপোড়া, না পোড়া মানুষের মাংসের প্রচুর ভোজ
পেয়ে যায় তারা কুমায়ুন গাড়োয়ালের পাহাড়ের আনাচে কানাচে। এখনও কি পাচ্ছে ?
এবারও ?
অন্ধাকার বনবাংলোর চারপাশ থেকে চিতার ডাক
শোনা যাচ্ছে। ঘর ঘর ঘর ঘর ঘর ঘক্ ঘক্ ঘক্ ঘক্। তার সামনে কি একটা আয়না রাখা
আছে ? সেই আয়নায় চিতাবাঘ নিজেকে দেখছে তো দেখছেই আর সেকি নিজেকে ভালোবাসছে
? আয়নায় নিজেকে আদর করে পিচ্ছিল স্বচ্ছ কাচের মধ্যে দিয়ে হড়কে হড়কে নিজেকে
দেখতে দেখতে কুমু যেভাবে সম্পর্কের লোককে নিজের শরীরে আস্তে আস্তে ঘুরতে
ঘুরতে বিছানায়, নরম বিছানায় পাক খেতে খেতে ঢুকতে দেয় — সেরকম ঢুকতে দিচ্ছে
? চিতাবাঘ কি মেয়ে ? ভাবছিল কুমু আর আলমকে জিজ্ঞেস করাতে সে তাকে শম্বর ,
চিতল , চিতাবাঘ আর নানা পাখির রাতের ডাক চেনাতে ও শোনাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
অন্ধকার ঘনিয়ে এলে জঙ্গলে তাপমাত্রাও আবার কমে এল। সবাই বাংলোর বারান্দায়
ঢুকে পড়ল খোলা চাতাল ছেড়ে। বাইরে গেট আগেই বন্ধ করা হয়েছে আর চারপাশে
তারে সৌর বিদ্যুৎ চালনা করা আছে। বাপ্পা রাতের পাখিদের খোঁজ করতে করতে ঠিক
নাইট জার পেয়ে গেল। পার্থকে সে দেখাল। এরপর ওরা মদ খেল। খাবারদাবার খেয়ে
রাতের শব্দ শুনতে বেরল বারান্দায়। সামনের অন্ধকারে কিছু দেখা গেল না।
সামনের জঙ্গলের তাপমাত্রা আরো নামতে নামতে কোথায় চলে গেল বোঝা গেল না।
তারপর বাংলোর মধ্যে যে ঘর আছে তাতে ওরা চারজন শোয়ার আয়োজন করতে লাগল। দশটার
মধ্যে সব সারা হয়ে গেছে। কে কোথায় শুয়ে পড়বে তার হিসেব করাই ছিল।
কুমু আস্তে আস্তে লাগোয়া রান্নাঘরের জানলায় চোখ রাখল। ঘন অথচ পরিষ্কার
দেখা যায় এমন পাতলা তারে জালির ওপরে স্টাফ কোয়ার্টারের আলো পড়েছে আর সৌর
বিদ্যুতের সরু তারের ফাঁক গলে একটা একটা করে চিতল হরিণ লাফিয়ে নেমে আসছে
বনবাংলোর চাতালে। সেখানে ঘাস আছে। হয়ত পড়ে থাকা খাবারের উচ্ছিষ্ট আছে।
কোথাও হয়ত নির্দিষ্ট জায়গায় প্লাস্টিক বা চিপসের প্যাকেটের টুকরো আছে।
হরিণের দল নামছে তারের ফাঁক গলে গলে। একটা দুটো করে নামতে নামতে তারা একপাল
হয়েছে। তাদের ছেলেদের শিঙ আছে আর মেয়েরা কেবল দেখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে
, তারা বড়সড় হতে পারে কিন্তু তাদের শিঙ হবে না, কিছুতেই না। বড় চেহারা হলে
বাঘ তাদের পছন্দ করবে আর খাবে। কিন্তু শিঙ তাদের হবে না।
আস্তে আস্তে রান্নাঘরের থেকে বাইরে যাবার দরজা খুলল কুমু। আর নিঃশব্দে
এগিয়ে চলল হরিণের পালের দিকে। শুধু চিতল কেন, অন্য হরিণেরা কেন এই চত্বরে
ঢোকে না ? কেন শম্বররা ঢোকে না ? বড়সড় চেহারা বলে ? বার্কিং ডিয়াররা তো ছোট
ছোট , তারা তো ঢুকতে পারে ? নাকি চিতল হরিণদের মতো তারা বিদ্যুতের তার
টপকাতে শেখেনি ? কুমু বুঝতে পারে না স্টাফ কোয়ার্টারের ছিটকে পড়া আলোর
মধ্যেই বা কেন হরিণের দল দাঁড়িয়ে থাকবে — খোলা চত্বরের অনেক অন্ধকার জায়গায়
ওরা চলে যায় না কেন ? তখন রাত হয়ে এসেছিল এ একরকম নিশ্চিত। তাপমাত্রা
কমাতে গাছেদেরও কোন সন্দেহ ছিল না। পাতারাও যথেষ্ট নেতিয়ে মাটির সঙ্গে মাটি
হয়েই ছিল। কুমুর পায়ের শব্দ শোনা যায়নি। একই সময় বাঘ ও তার ছানারাও
নিঃশব্দে জায়গা বদল করছিল কারণ এ তাদের করে যেতেই হবে জঙ্গলের তাপমাত্রা
বাড়াকমার সঙ্গে সঙ্গে।
1 মন্তব্যসমূহ
অসাধারণ গল্প।
উত্তরমুছুন