অলোকপর্ণার গল্প : একটি নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা



গতকাল থেকে আমি নিরুদ্দেশ। 

সাদা গেঞ্জি আর নীল লুঙ্গি পরে গতকাল বিকেল চারটের সময় আমায় হাঁটতে হাঁটতে স্কুলমাঠের দিকে যেতে দেখা গেছে শেষবার। পথে টুকাইয়ের সঙ্গে দেখা হলে অফিসের খবর নিয়েছি, দুয়েক কথার পর ওর হোম লোন স্যাংকশন হল কিনা জানতে চেয়েছি, তারপর ইউনুসের দোকান থেকে একটা সিগারেট কিনে আগুন ধরিয়েছি। ছ টাকা খুচরো ছিল না তাই ইউনুসকে- “পরে দেবো” বলে স্কুল মাঠের দিকে ধীরে, ধীরে, হাঁটতে, হাঁটতে, আমি হারিয়েগেছি। 

হারিয়ে যাওয়ার বেলায় আমাকে উদ্ভ্রান্ত দেখিয়েছিল কি না, এখন আর মনে পড়ছে না। আমি জীবন প্রসঙ্গে উদাসীন কিনা, ইউনুস বা টুকাই কেউ বুঝতে পারেনি গতকাল। হোম লোন সম্পর্কে পুছতাছ করার সময় আমার সাদামাটা মাথার ভিতর, হারিয়ে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা জন্মেছিল কিনা ওরা ধরতে পারেনি। এমনকি মুখের কাছে লাইটারটা এনে ফস করে যখন আমি আগুন জ্বাললাম, তখনো আমার কপালে দুশ্চিন্তার কোনো ঢেউ খেলেছিল কি না ইউনুস এখন আর মনে করতে পারছে না। স্কুল মাঠের দিকে আমার হেঁটে যাওয়ায় কোনো নিরুদ্দেশ যাত্রার সংকল্প ওদের দুজনের কেউই টের পায়নি। নিতান্ত সাধারণ পদক্ষেপে আমি একটু একটু করে ঠোঁটে সিগারেট নিয়ে হারিয়ে গিয়েছি গতকাল বিকেল 

চারটে বেজে পঁচিশ মিনিটে। 

হারিয়ে যাওয়ার ইচ্ছেটা কি তবে সিগারেটের ধোঁয়ায় আত্মগোপন করেছিল? গোপন ভাইরাসের মতো, চুপচাপ? ঠোঁট ছুঁতেই, বুকে ধাওয়া দিয়ে সারা শরীরে নিরুদ্দেশ সম্পর্কে একটা আলোড়ন ছড়িয়েছিল কি গতকালের তরতাজা বিকেলে? 

এর আগে আমি কখনো কোথাও হারিয়ে যাইনি। আমার পক্ষে হারিয়ে যাওয়া একপ্রকার অসম্ভব। এবয়সে এসেও আমি বলে দিতে পারি ‘৮৭ র ওয়ার্ল্ড কাপ সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের স্কোর কত ছিল। কলকাতা শহরের সমস্ত অলিগলি আমার নখদর্পনে। কবে, কার বিয়েতে কোন পদ খাওয়ানো হয়েছিল, তা খেতে কেমন ছিল তাও আমি মনে রেখে দিই। সমস্ত তারিখ, সমস্ত সাল, সমস্ত পাপ, সকল অপমান আমার মনের ভিতর খচখচ খচখচ করে সারাটাদিন শুকনো পাতার মতো, আমি কিছুই ভুলি না। রাতে অন্ধকারে নখ ধারালো হয়ে ওঠে, বা, দাঁত তীক্ষ্ণ হয়- এমন সব স্মৃতি মাথার মধ্যে আমি পুষে রেখে দিয়েছি, লালন করেছি এতগুলো বছর। আমি মুখ ভুলিনা, নাম ভুলিনা, সংখ্যা, সময়, গন্ধ, ঠিকানা- সমস্তকিছু মনে রাখি। কবে, কোথায় কোন স্মৃতিখানি আমায় উদ্ধার করতে আসবে, রাতে, ঘুমের আগে,- সেই ভেবে সকল ক্ষত যত্ন করে গোপন রাখি। অনেক সময় এতে অন্য মানুষের উপকার হয়। যেমন, পাঁচ বছর আগে বাইক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত আমার ভাইপো ঋজুকে যখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, রাস্তাতেই আমি তার ব্লাড গ্রুপ বলে দিতে পেরেছিলাম। আবার কামাখ্যায় পুজো দিতে গিয়ে যখন খেয়াল হল, বন্ধু চক্রবর্তীর গোত্র জেনে আসা হয়নি, অথচ পুজো দিতেই হবে, এবং গর্ভগৃহে ফোনের নেটওয়ার্ক নেই, সবাই তখন আমার দিকে ফিরেছিল,- বাতলে দিয়েছিলাম। 

অনেকে ছেলেবেলায়, মেলাতে, রেলস্টেশনে, স্কুলে যাওয়ার পথে, স্কুল থেকে আসার সময়, মনের ভিতর বা বাজারের গলিতে হারিয়ে যায়, পাচার হয়ে যায়, হয়তো মুম্বই বা আরব দেশে গিয়ে পড়ে। কারোর হাত পা কেটে পঙ্গু করে দেওয়া হয়, কাউকে অন্ধ, কাউকে ধর্ষণ করা হয় দিনের পর দিন, শেষমেশ রেড লাইট এলাকায় গিয়ে পড়ে কেউ। এদের মধ্যে অনেকে খুন হয় বীভৎস অত্যাচার সহ্য করে। সেই মৃতদেহের অঙ্গও পাচার হয়ে যায়। আবার অনেকে ফিরে আসে অনেক খোঁজ তালাশের পর, অথবা নিজে থেকেই। হঠাৎ একদিন তাদের হাজির হতে দেখে পাড়াপড়শি চমকে ওঠে। আলোড়ন পড়ে এলাকায়। সবাই চোখের দেখা দেখতে আসে। একেবারে নিম্নবিত্ত না হলে, স্থানীয় কাউন্সিলর আসেন। মেয়ে হলে, মহিলা সমিতিও এসে জোটে। 

অথচ ফিরে আসা মানুষটা আর অংক মেলাতে পারে না। তাদের ফেরাটুকু ফেরা নয়, ছদ্মবেশী আরেকটা নতুন চলে যাওয়া, একটা নতুন দুনিয়ায়, নতুন পাড়ায়, নতুন বাড়িতে, নতুন পরিবারে তারা ফের গুম হয়ে যায়, যেখানে তাদের পুরনো মা নেই, তাদের চিরপরিচিত বাপও যেন অন্যকেউ, তাদের উপর সমস্ত নজর জরিপের, সমস্ত নজর অনুমানের। হাঁ করে তারা বেবাক তাকিয়ে থাকে সমস্ত দিনবদলের দিকে, আর দেখে তাদের নিজেদের হাত পা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে আছে, আঙুল ফ্যাকাশে, আধখাওয়া নখ ফ্যাকাশে, চোখ মুখ সারা দেহ ফ্যাকাশে, ধুসর, রিক্ত, যেন তারা নিজেদের সমস্তটা এখনো ফেরাতে পারেনি নিরুদ্দেশ থেকে। ফ্যাকফ্যাকে চোখে তারা চেয়ে থাকে, আগের চেয়ে একটু বেশি শান্ত আর চুপ হয়ে যায়, আগের চেয়ে আরেকটু বোকা হয়ে পড়ে। 

আবার অনেকে পরিকল্পনা মাফিক নিখোঁজ হন। নেতাজী সুভাষ হয়েছিলেন। আমার অফিসের নিতাই দা হয়েছিল, পাড়ার অঞ্জনাদিও। অফিসের একাউন্ট থেকে আশি লাখ টাকা গায়েব করে নিতাই দা নিজেই একদিন রাতারাতি গায়েব হয়ে গেল। বউ বাচ্চা পর্যন্ত তার হদিস পেল না। আমি কিছুদিন চুপ করে নিতাইদার টেবিল চেয়ারের দিকে চেয়ে স্মৃতি হাতড়ালাম। একমাত্র স্মৃতিতে নিতাই দা তখনো ছিল। তারপর একদিন নতুন একাউন্ট্যান্ট এসে সে টেবিল বাগিয়ে নিতে নিতাই দা অস্ত গেল। 
‘৮৩ সালের বর্ষার এক মাঝরাতে অঞ্জনা দি ঘরের টালির চাল থেকে দুতিনটে টালি সরিয়ে পালালো রাজাদার সঙ্গে। বছর ছয়েক পর রাজা দাকে খুঁজে পাওয়া গেল,- ট্রেন দুর্ঘটনায় দুই পা হারিয়ে হাসপাতালের বেডে, সহৃদয় এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তাকে উদ্ধার করে দেখে সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে, কবে, কেউ জানেনা। অঞ্জনা দির কথা জিজ্ঞেস করলে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। বিড়বিড় করে। মাথা চুলকায়, গলা চুলকায়। অতএব অঞ্জনা দিকে কেউ খুঁজে পায়না, সে কোনোখানে পড়ে নেই। যেন কোনোদিনই ছিল না কোথাও।

মানুষ যে কেন ফেরে না, মানুষ যে কেন মাঝে মধ্যে একে ওকে তাকে ফেলে রেখে চলে যায়, নিরুদ্দেশ কেমন সবপেয়েছির আসর,- আমি হয়তো এখন তা জানতে পেরেছি।

কোনো চিহ্ন রাখিনি আমি ফেলে আসার। তুখোর অপরাধীর মতো সমস্ত নিশান লোপাট করে ঘর ছেড়েছি। তবু জানিনা, আমি স্বেচ্ছায় হারালাম কি না। পরশু রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে একথা কি ভেবেই রেখেছিলাম যে গতকাল চারটের পর আমাকে আর কোথাও পাওয়া যাবে না- এখন আর কিছু মনে পড়ছে না। আমি এটুকু জানি,- কুহেলী রাত সাড়ে দশটায় টিভি বন্ধ হলে আবিষ্কার করবে, আমি তখনো বাড়ি ফিরিনি, এবং আমার ফোন বন্ধ। তার আগে অবধি সে টিভিপর্দায় বনপলাশী সিরিয়ালে পলাশ ও বনানীর সম্পর্কের টানাপোড়েন দেখবে, সৌরভ গাঙ্গুলীর সঞ্চালনায় ক্যুইজশো দেখে উত্তেজিত ও আমোদিত হয়ে থাকবে, গানের অনুষ্ঠানের বিচারকদের তালে তাল মেলাবে। রাতেরবেলা যখন সে আমার খোঁজ করবে এবং খুঁজে পাবেনা, সবার আগে সে ভাইকে ফোন করবে, তারপর কৃষ্ণেন্দুকে। সেখানেও আমায় না পেলে ফোন যাবে লীনাদির কাছে। ধীরে ধীরে ফোনের সংখ্যা বাড়তে থাকবে পিরামিড স্কিমের মতো। ফোন থেকে ফোনে সম্পর্কের সুতো সূক্ষ্ম হতে থাকবে। অবশেষে আজ ভোর অবধি আমায় কোথাও না পেয়ে কুহেলী আর ভাই মিলে ছুটবে থানায়। ততক্ষণে কুহেলী আবিষ্কার করবে ইদানিংকালে আমার কোনো ছবি তোলা হয়নি। সাম্প্রতিক ছবি বলতে বছর সাত আগের তীর্থ- শম্পার বিয়ের পারিবারিক ছবি। সেখানে আমার চুল, দাড়ি, দাঁত, নখ অনেক মার্জিত। দৃষ্টি স্তিমিত। তখনো রক্ত ঠান্ডা। এই আমি কোথাও হারিয়ে যায়নি। সে ছবিতে স্থবির।

পুলিশের কথা মতো আমার বইপত্র, দেরাজ আলমারি তালাশ করা হবে। কোথাও কিছু পড়ে রইল কি না, কোথাও কোনো চিহ্ন, কোথাও আমার একরত্তিও বাকি থেকে গেল কি না, খুঁজে দেখা হবে। 

এরপর খোঁজ করা হবে হাসপাতালে, রেলস্টেশনে, কুহেলী হয়তো কান্নাকাটি করবে প্রবল অনিশ্চয়তায়। তাই ভাইকেই সব করে ফেলতে হবে। ঠিক সেই মুহূর্তে আমি হয়তো হেনরি আইল্যান্ডের নির্জন সমুদ্র সৈকতে দাঁড়িয়ে নিরন্তর ঢেউ দেখছি, অথবা চুপ করে বসে আছি বর্ধমান শহরের কোনো এঁদো পুকুরপাড়ে। আবার এমনও হতে পারে, আমি চাকদা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ধোঁয়া ওঠা কচুরি আলুরদম খাচ্ছি। এও হতে পারে যে, ভাই আমাকে হাসপাতালে খুঁজে পেয়ে গেল,- বাসের ধাক্কায় গুরুতর আহত, অথবা টিটাগড় স্টেশনে, স্মৃতিভ্রংশ অবস্থায়, ফিরে আসার পথ খুঁজে পাচ্ছি না। অথবা বারাসত জেলা হাসপাতালের মর্গে সবাই খুঁজে পেল আমায়। এই পৃথিবী অগাধ সম্ভাবনা। এবং সকলই সম্ভব। আর আমি যেকোনো সম্ভাবনায় রাজী। যেকোনো সম্ভাবনাই আমার কাছে সর্বাঙ্গসুন্দর এখন। কোথাও কোনো কালো নেই। কোথাও নেই কোনো অন্ধকার। সমস্তটা আলো, চোখ ধাঁধান, চোখ ফুঁড়ে মাথার ভিতরে ঢুকে আসা, অন্ধ করে দেওয়া আলো। এই আলোয় সবেতেই রাজী হয়ে যাওয়া যায়। যা খুশি বাজী রাখা চলে।

আমি কোথাও যাওয়ার তাগিদ বোধ করছি না, অথচ আমি সর্বত্র যেতে চাইছি। ছড়িয়ে পড়ছি, আলো হাওয়ার মতো, বাতাসী সুগন্ধের মতো, জনৈক সম্ভাবনায় আমি ফুটে আছি। আর ওরা এখন আমায় খুঁজছে। ওরা এখন আমায় কোথাও পাচ্ছে না।

ছোটোবেলায় দিদিভাইদের সঙ্গে মেয়েলি লুকোচুরি খেলতাম। বালিশ রাখার তাকের পিছনে, ছাদের গুদাম ঘরে, কখনো বাগানে চৌবাচ্চার আড়ালে লুকোন হত। খেলতে খেলতে সবাই চিনে গেছিল আত্মগোপন করার জায়গাগুলো। ধাপ্পা দিতে বেশি বেগ পেতে হত না। তবু একবার খেলাচ্ছলে আমি বড় মাসির খাটের তলায় গিয়ে পড়েছিলাম অনেক কিছুর আবডালে। দম আটকে বসে থাকতে থাকতে একসময় অন্ধকারে দেখতে পেয়েছিলাম, একটা মরা চড়াইপাখি, পেট উল্টে পড়ে আছে, পা দুটো শূন্যে তোলা। হয়তো আটকা পড়েছিল অনেকদিন, হয়তো আহতও ছিল। ধীরে ধীরে পথ্যের অভাবে, উপশমের অভাবে, খোরাকের অভাবে প্রাণটি গেছে চলে। আমি কেবল দেখেইছিলাম। হাত বাড়ানোর সাহস হয়নি সেই ছেলেবেলায়। দেখে ফেলার পর থাকতে পারিনি বেশিক্ষণ, দম আটকে গেছিল, বেরিয়ে এসেছিলাম খাটের তলা থেকে, আর ধরা পড়ে গেছিলাম। ও বাড়ির কাউকে বলতে পারিনি পাখিটার কথা। ভয় পেয়েছিলাম,- যেন আমিই ওকে হত্যা করেছি, কবে কোথায়, তা বুঝি মনে নেই। যেন ওর রক্ত আমার সেই ক্ষুদ্র আঙুলগুলোয় লেগে। যেন আমাকে কেউ বিশ্বাস করবে না, কেউ মানতেই চাইবে না অন্যথা। 

এখন আর সেই আঙুল নেই, হাত নেই। হাতে লেগে থাকা লাগাতার রক্তও কবে যেন শুকিয়ে গেছে। আমিও আর লুকোনোর প্রচেষ্টা করছি না। ধরা দেওয়ার মতো অবস্থাও এখন নয়। এখন সব গোপন উদোম হয়ে আছে।

শুধু ইউনুসের ছ টাকা বাকি রয়ে গেল। আর কারো কিছু বাকি থাকার কথা নয়। কুহেলীকে আমি চিরকাল দুহাত ভরে দিয়েছি। কখনো বলতে পারবে না কিছু চেয়ে, পায়নি। সর্বস্য, এমনকি রক্তের বদলে ওকে আমি তরুণ সূর্য এনে দিয়েছি কখনো কখনো। শাড়ি, গয়না, সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না, কিছুই বাদ রাখিনি। ছোটো ছোটো কষ্ট, ক্ষূদ্রাতিক্ষুদ্র আনন্দ, সবই সে আমার কাছে পেয়েছে। সে আমাকে চেয়েছিল কিনা একথা জানা হয়নি, তবু আমি ছিলাম, যত দিন থাকা যায়, যেমন গতকাল বিকেল চারটে অবধি। 

এখনো পর্যন্ত আমার জানা নেই আমি ফিরবো কি না। ফেরার ধারণা জনবিশেষে পৃথক। আমি অফিস থেকে ফিরেছি, স্কুল কলেজ থেকেও ফিরেছি। মানুষের দিকেও ফিরেছি, অন্তত চেষ্টা করেছি। কাছে হয়তো ফিরতে পারিনি। কাছে ফেরা এই বয়সে, এই পরিবেশ পরিমণ্ডলে একপ্রকার অসম্ভব। ফিরে আসার ধান্ধা এখন অপ্রাসঙ্গিক। আমি তাই হাল ছেড়ে দিচ্ছি। একটু একটু করে। ঘুড়ির সুতো ছাড়ার মতো আমি নিজেকে লেলিয়ে দিচ্ছি নিরুদ্দেশের প্রতি। হারিয়ে যাওয়ার সর্বপ্রথম ধাপটি হল এই। হারিয়ে যাওয়ার থেকেও বলা ভালো আমি পালাচ্ছি। কারণ এটাই পালানোর উপযুক্ত সময়। গতকাল চারটেয় বাড়ি থেকে বেরিয়ে না এলে অনেক দেরি হয়ে যেত। কুহেলী বুঝত সব ঠিকই আছে। পাড়া প্রতিবেশীও ভেবে নিত তাই। আমাকে দেখে কারো মনেই হত না এই লোকটা, এই ছাপোষা মানুষ হারাতে পারে। হারাতে জানে। অথচ আমি আসল সত্য গোপন করেছিলাম। আমি সবাইকে ফাঁকি দিয়েছি। 

রাতের নিস্তব্ধতায় আমায় রক্তের টগবগ আমি ওদের শোনাইনি। বহুবছর যাবৎ একটা ভাইরাস আমার মাথার ভিতর খেলা করছে, আমাকে একটু একটু করে খেয়ে ফেলছে, একথা কাউকে বলাই হলনা, আমি হারিয়ে গেলাম। কুহেলী বা কেউ, অবশ্য শোনার মত অবস্থাতে ছিলও না, হয় তাদের কান ছিল না, নাহয় সময়। অবশেষে গতকাল, কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই আমি আমার রক্তকে সায় দিলাম। লাই দিলাম। অতএব আমাকে হারালো যারা, আমিও তাদের হারালাম। একটা দমকা হাওয়ায়।

আমার হারিয়ে যাওয়ার খবর স্থানীয় খবরের কাগজে ছাপা হতে পারে। সম্পাদক কৃষ্ণেন্দুর বন্ধু। ত্রিশটা শব্দে আমার হারিয়ে যাওয়া ওতে ধরে যাবে আশা করি। সন্ধান চাই। নাম অমুক, বয়স অমুক, উচ্চতা অমুক, থুতনির নিচে কাটা দাগ, সাদা গেঞ্জি, নীল লুঙ্গি এটুকু লিখতে আর কত শব্দ প্রয়োজন, অথবা অমুক পাড়ার, তমুক রাস্তায় আমাকে শেষ দেখা গেছে। সন্ধান পেলে এই নম্বরে যোগাযোগ করুন। সঙ্গে সেই গ্রুপ ফটো থেকে বড় করা ছবি, নখদন্তহীন। অথচ একটাও ফোন আসবে না আমার খবর নিয়ে। বছরখানেক লাগবে আমার সবার মন থেকে মুছে যেতে। কুহেলী শুধু কারণে অকারণে মনে করতে পারে- মায়াবশত।

একটা কথা মনে পড়ে কেবল। একটা স্বপ্ন। একবারই দেখেছিলাম কোনো এক ফেব্রুয়ারি মাসে। একটা সুন্দর বাগান। সবকিছু সবুজ। তার মধ্যে হেঁটে বেড়াচ্ছি। গান বাজছে কোথাও, গান হয়তো নয়, স্তিমিত পিয়ানো। এবং আমি একা নই, একটা অবয়ব পাশাপাশি হাঁটছে। এই প্রথম নিজেকে আধখাওয়া বলে মনে হচ্ছিল না। তাড়া ছিল না কোথাও যাওয়ার বা পালানোর। শুধু হেঁটে বেড়াচ্ছিলাম আমরা, একা নই এটুকু জেনে। যেন এটুকুই কাফি। 

স্বপ্ন ভেঙেছিল। পাশ ফিরে দেখেছিলাম কুহেলী ঘুমোচ্ছে অকাতরে। তার ঘুমন্ত মুখ দেখে সেদিন কোনো মায়া জাগেনি। বরং মনে হয়েছিল আমি ফুরিয়ে আসছি। কুহেলী ধীরে ধীরে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিচ্ছে আমাকে। আমার হাত পা অসাড় হয়ে এসেছিল। বোবা হয়ে পড়ছিলাম।

তীব্র পেচ্ছাপের বেগ সেদিন বিছানা ছেড়ে উঠিয়ে না নিলে হয়তো সেরাতেই আমি শেষ হয়ে যেতাম। কোনো না কোনো প্রকারে, কুহেলীর ফুঁৎকারের হাতে।

আমি চাই কুহেলীরা আমার একটা মৃত্যুসংবাদ পাক, মিথ্যেই হোক, আমার হারিয়ে যাওয়াকে সে খবর একটা পরিণতি দিতে পারে। প্রথমবার মর্গে গিয়ে হয়তো সে আবিষ্কার করবে সে লাশ আমার নয়, এরকম বেশ কয়েকবার মর্গে যাওয়ার পর, বেশ কয়েকটা লাশ দেখে ফেলার পর, কুহেলী মানতে বাধ্য হবে পরবর্তী লাশটি আমি। পাড়াপ্রতিবেশীরাও সে কথা মেনে নেবে। লীনা দি কাঁদবে ফোন করে। কৃষ্ণেন্দু চুপ করে বসে থাকবে বাইরের বারান্দায়। ভাই মুখ লুকোবে আড়ালে। 

এটুকু শান্তি আমি তাদের দিতে চাইতেই পারি।

এইভাবে সমস্ত পিছুটান কেটে গেলে, আমি প্রকৃত হারাবো যখন, তখন আমার একটাই আর্জি থাকবে। এরপরেও যদি আমাকে কোথাও দেখা যায়, জানা যায়- নাম অমুক, বয়স অমুক, উচ্চতা অমুক, থুতনির নিচে কাটা দাগ, পরনে সাদা গেঞ্জি, নীল লুঙ্গি,- যেন কোথাও কোনো নম্বরে ফোন করে কোনো খবর না দেওয়া হয়। যেন কোথাও কোনো থানায় যোগাযোগ করা না হয়। যেন কোনো উড়োচিঠি না পাঠানো হয় কোনো ঠিকানায় যে- অমুক জায়গার তমুক পার্কে, মন্দিরে, বেশ্যালয়ে, বিছানায়, মাছের আড়তে, বিডিও অফিসে বা চিড়িয়াখানায় আমাকে দেখা গেছে। এবং পাওয়া গেছে।

এটুকু অনুরোধ তো রাখা যেতেই পারে।- এটুকু প্রত্যাশা।

নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণাটি আজকের মতো এখানেই শেষ হল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ