মার্গারেট মিচেলের ধারাবাহিক উপন্যাস : যেদিন ভেসে গেছে-- পর্ব ২৯



অনুবাদক : উৎপল দাশগুপ্ত 

পরের বছর এপ্রিল মাসে জেনারাল জনস্টন, তাঁর ছারখার হয়ে যাওয়া বাহিনীতে যারা তখনও টিকে ছিল, তাদের নিয়ে উত্তরক্যারোলাইনায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করলেন। যুদ্ধও শেষ হল। টারাতে খবরটা পৌঁছল আরও দু’সপ্তাহ পরে। ওখানে সবাইকেকাজ নিয়ে এতটাই ব্যস্ত থাকতে হত যে কারোরই ভ্রমণ করে বাগুজবে কান পেতে সময় নষ্ট করার মত ফুরসত ছিল না। প্রতিবেশিরাও ঠিক ততটাই ব্যস্ত থাকত, ফলে দেখাসাক্ষাৎ করে খবরাখবর নেওয়ার সময়ও হত না। ফলে নতুন কোনওখবর ছড়িয়ে পড়তে অনেকটাই সময় লেগে যেত। 

চাষের মরশুম চলছিল পুরো দমে। ম্যাকন থেকে পোর্কের তুলোআর বাগানের জন্য নিয়ে আসা বীজ বোনার কাজ চলছে। ফিরে আসার পর থেকে পোর্ককে দিয়ে কাজ করানোটাইমুশকিল হয়ে পড়েছে। ম্যাকন থেকে ওয়াগন ভর্তি করে পোশাকের সরঞ্জাম, বীজ, বনমোরগ, হ্যাম, মাংস আরখাদ্যদ্রব্য নিয়ে নিরাপদে ফিরে আসার গর্বে মাটিতে পা পড়ছেনা। কী ভাবে মরতে মরতে বেঁচে গেছে, কোন অলিগলি আরচোরাপথ বেয়ে টারায় এসে পৌছেছে, এই সব গল্প ঘটা করে সবাইকে শুনিয়ে চলেছে। পাঁচ পাঁচটা সপ্তাহ ও বাড়ির বাইরেছিল, স্কারলেটের দুর্ভাবনার অন্ত ছিল না। তবে ফিরেআসার পর ওকে বকাবকি করেনি। ও যে ভালয় ভালয় ফিরেএসেছে, এতেই স্কারলেট খুশি, আরও খুশি যে যত টাকা ওকেদিয়েছিল, তার অনেকটাই ফেরত নিয়ে এসেছে। মনে মনেঅবশ্য একটা সন্দেহ দানা পাকিয়েছে যে বনমোরগ বাবেশিরভাগ খাদ্যদ্রব্যই টাকা দিয়ে কেনেনি। রাস্তায় এতঅরক্ষিত পোল্ট্রী আর স্মোকহাউস থাকাতে এসব জিনিসকেনার জন্য যদি স্কারলেটের টাকা খরচ করতে হত, তাহলেও লজ্জায় মুখ দেখাতেই পারত না। 

খাদ্য-পানীয়ের মোটামুটি কিছু সংস্থান করে ফেলার পর টারারবাসিন্দারা চেষ্টা করতে লাগল যাতে জীবনযাপনেস্বাভাবিকতার আভাসটা আবার ফিরিয়ে আনা যায়। প্রত্যেকজোড়া হাতের জন্য কাজ আছে, অনেক কাজ, অন্তহীন কাজ। জমি থেকে মাথা তুলে থাকা তুলোর ফসলের নাড়া উপড়েফেলতে হবে যাতে নতুন ফসলের জন্য বীজ বপন করা যায়,তারপর হাল টানায় অনভ্যস্ত অবাধ্য ঘোড়াকে ওর ইচ্ছেরবিরুদ্ধে টেনে নিয়ে গিয়ে জমিতে লাঙল দেওয়াতে হবে। বাগান থেকে আগাছা সাফ করে নতুন বীজ লাগাতে হবে,আগুন জ্বালার কাঠ কাটতে হবে, পশুশালা আর মাইলের পরমাইল জুড়ে থাকা বেড়া, যা ইয়াঙ্কিরা হঠকারিতা করে জ্বালিয়েদিয়েছিল, সেগুলো আবার নতুন করে বানাতে হবে। খরগোশ ধরবার জন্য পোর্ক যে ফাঁদ পেতে এসেছে, সেখানেদিনে দুবার গিয়ে খোঁজ নেওয়া, মাছ ধরার বড়শিতে নতুন করে টোপের মশলা লাগানো। বিছানা পাতা, মেঝে ঝাড়পোঁছ করা, রান্না করা, বাসন মাজা, সময়ে সময়ে শুয়োর আর মুরগিদেরখাবার দেওয়া, ডিম তোলা। তারপর আছে গরু দুধ দোয়ানো, ঘাসজমিতে নিয়ে যাওয়া, সেটার ওপর সারাদিন ধরে নজররাখা, যাতে ইয়াঙ্কিরা কিংবা ফ্র্যাঙ্ক কেনেডির লোকজন এসেওগুলো না নিয়ে যায়। এমনকি ছোট্ট ওয়েডকেও কাজ করতেহয়। প্রত্যেকদিন সকালবেলা একটা ঝুড়ি হাতে খুব গর্বের সঙ্গে বেরিয়ে যায়, আগুন জ্বালানোর জন্য ডাল আর পাতা সংগ্রহকরতে। 

আত্মসমর্পণের খবরটা নিয়ে আসে ফোনটেন ভাইরাই, লড়াই থেকে ওরাই প্রথম কাউন্টিতে ফিরে আসে। অ্যালেক্স, তখনও ওর পায়ে বুটজোড়া টিঁকে আছে, হেঁটে ফিরল, আরওর ভাই টোনি, খালি পা, একটা খচ্চরের অনাবৃত পিঠেচেপে। ওদের পরিবারে টোনিই সর্বদা সেরা জিনিসটা দখলকরে নিত। চার বছর ধরে রোদ, ঝড় আর বৃষ্টির দাপটে গায়েররঙ ওদের বেশ ময়লা, প্যাঁকাটির মত লিকলিকে শরীর, আর মুখভর্তি কালো দাড়িগোঁপে ওদের চিনতে পারাই দায়। 

মিমোজ়ায় বাড়ি ফেরার জন্য অধীর হয়ে থাকলেও কয়েকমুহুর্তের জন্য টারায় থামল, মেয়েদের সঙ্গে একবার দেখা করে আত্মসমর্পণের খবরটা জানানোর জন্য। যুদ্ধ থেমে গেছে, লড়াই খতম, ব্যাস এটুকুই, এর থেকে বেশি কিছু ওদের দিয়েবলানোই গেল না। একটা কথাই ওরা বারবার জানতেচাইছিল, মিমোজ়া কি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। অ্যাটলান্টা থেকে দক্ষিণে আসার সময় ওরা সারি সারিকালো চিমনির পাশ দিয়ে এসেছে যেখানে একসময় ওদেরবন্ধুবান্ধবদের বাড়ি ছিল, তাই ওদের মনে হয়েছিল ওদের বাড়িধ্বংসলীলার তাণ্ডব থেকে রক্ষা পেয়েছে এরকম আশা করাটাহয়ত একটু বেশি হয়ে যাবে। বাড়িটা যে এখনও অক্ষতঅবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে এই সুখবরটা শুনে ওরা একটু স্বস্তিরনিঃশ্বাস ফেলল। তারপর স্কারলেট যখন স্যালির ঘোড়ায় চড়েপাগলের মত ছুটে আসা আর কীভাবে হেজের বেড়া টপকেপালিয়ে গেল সেই গল্প বলল, তখন ওরা খুশিতে ঝলমলিয়েঊরু চাপড়ে হেসে উঠল। 

“খুব তেজী মেয়ে ও,” টোনি বলে উঠল, “জো’র মৃত্যুটা ওরকাছে খুবই দুর্ভাগ্যের। আচ্ছা স্কারলেট, তোমাদের কাছে একটুখৈনির তামাক হবে?” 

“নাহ্‌, ধুমপানের তামাক ছাড়া আর কিছু নেই। ভুট্টার শিষেভরে বাপি ধুমপান করেন।”

“আমার অবশ্য এখনও অতটা দুরবস্থা হয়নি,” টোনি বলল, “তবে মনে হয় খুব শিগগিরই আমারও একই দশা হবে।”

“ডিমিটি মুনরো ভাল আছে তো?” অ্যালেক্স জিগ্যেস করল, বেশ উদগ্রীব হয়েই, তবে একটু লজ্জা পেল মনে হয়। স্কারলেটের মনে পড়ে গেল, স্যালির ছোটবোনের সঙ্গেঅ্যালেক্সের একটা মিষ্টি সম্পর্ক ছিল। 

“হ্যাঁ, ও ভালই আছে। আজকাল ফেয়্যাটভিলে ওর আন্টিরকাছে আছে। জানো তো, লাভজয়ে ওদের বাড়িটা পুড়িয়েদিয়েছে। ওর অন্যান্য আত্মীয়স্বজন ম্যাকনে আছে।”

“আসলে ও জানতে চাইছে – ডিমিটি হোমগার্ডের সেইদুঃসাহসী কর্নেলকে বিয়ে করে নিয়েছে কিনা?” টোনি একটুব্যঙ্গ করে বলল। অ্যালেক্স কটমট করে ওর দিকে তাকাল। 

“আরে না, না, ওর বিয়ে হয়নি,” স্কারলেট মজা পেয়ে বলল।

“বিয়ে করে নিলেই বোধহয় ভাল করত,” বিষণ্ণ গলায়অ্যালেক্স বলল। “এমন একজন হতচ্ছাড়ার সঙ্গে – কিছু মনে কোরো না, স্কারলেট। তুমিই বল, আমার মত একটা লোক, যার সমস্ত ডার্কিই আজ়াদ হয়ে গেছে, যার পকেটে এক কানাকড়িও নেই, সে কেমন করে একটা মেয়েকে বলবে, তুমিআমায় বিয়ে কর?”

“তুমি তো খুব ভাল করেই জান, ডিমিটি ওসবের পরোয়াই করে না,” স্কারলেট বলল। ডিমিটির হয়ে কথাটা বলতে ওর বাধলনা, কারণ, অ্যালেক্স ফোনটেন কোনোদিনই ওর প্রণয়ীরতালিকায় ছিল না। 

“গুলি মারো, ওসব কথায় – ওহ্‌ স্কারলেট, আবার মাফচাইছি। কথায় কথায় এই গালি দেওয়ার অভ্যেসটা ছাড়তেহবে আমায়, নয়ত গ্র্যান্ডমা চাবকে আমার ছাল ছাড়িয়েনেবেন। নাহ্‌, আমি কোনও মেয়েকে একটা ভিখিরিকে বিয়েকরতে বলতে পারব না। ওর হয়ত কিছু এসে যাবে না, কিন্তুআমার যাবে।”

বাড়ির সামনের দালানে বসে স্কারলেট যখন ছেলেদুটোরসঙ্গে কথা বলছিল, মেলানি, স্যুয়েলেন আর ক্যারিন, আত্মসমর্পণের খবরটা শোনামাত্রই, নিঃশব্দে বাড়িরভেতর চলে গেল। বাড়ির পেছনের মাঠ দিয়ে ছেলেদুটো যখনওদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল, স্কারলেট ভেতরে চলে এল, দেখল এলেনের ছোট্ট অফিসঘরের সোফায় বসে তিনজনেই ফোঁপাচ্ছে। যে উজ্জ্বল, সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্নকেওরা ভালবেসেছিল, যে মহান আদর্শ ওদের বন্ধু, প্রেমিক, স্বামীদের কেড়ে নিয়েছে এবং ভিখিরি বানিয়ে দিয়েছে, সেই সবকিছুই নষ্ট হয়ে গেছে। যে আদর্শকে ওরা অপরাজেয় মনে করে নিয়েছিল, সেই আদর্শ আজ চিরতরে পরাজিত।

কিন্তু না, স্কারলেটের চোখ থেকে জল পড়ছে না। খবরটাশুনতে পেয়ে প্রথমেই ওর মনে হয়েছিল – যাক বাবা! আর গরুচুরি করতে কেউ আসবে না। ঘোড়াটাও এখন নিরাপদ। রুপোর বাসনকোসন এবার কুঁয়ো থেকে তুলে নিলেই হয়, অন্তত সবাই ছুরি কাঁটা ব্যবহার করতে পারবে। খাবারদাবারের খোঁজে এখন ও নিশ্চিন্তে ঘোড়ায় চড়েকাউন্টিতে ঘোরাফেরা করতে পারবে। 

আহ্‌, কী শান্তি! ঘোড়ার খুরের আওয়াজ শুনে আর ওকে ভয়পেতে হবে না। আর কোনোদিন, মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠেদমবন্ধ করে বুঝতে হবে না যে উঠোন থেকে যে আওয়াজপাওয়া যাচ্ছে – ঠোকাঠুকি লাগার শব্দ, ঘোড়ার খুরেরআওয়াজ, আর কর্কশ স্বরে ইয়াঙ্কিদের হুঙ্কার – সেটা স্বপ্ন না সত্যি। তার থেকেও বড় কথা হল, টারার আর কোনও বিপদনেই! ভয়াবহ দুঃস্বপ্নটা আর কখনোই সত্যি হয়ে উঠবে না। লনের ওপর দাঁড়িয়ে প্রিয়জনদের বাড়ি থেকে আগুনেরলেলিহান শিখা দেখতে হবে না, আগুনে পুড়ে বাড়ির ছাদভেঙে পড়ার আওয়াজ শুনতে হবে না। 

আদর্শটার অপমৃত্যূ ঘটেছে, কথাটা স্বীকার করতেই হবে, কিন্তুএই যুদ্ধ ব্যাপারটা ওর কাছে সব সময়ই বোকামি মনে হয়েছে। শান্তিই ভাল। ‘স্টার এবং বার’ পতাকা উত্তোলিত হতে দেখেস্কারলেট কখনোই রোমাঞ্চ বোধ করেনি, না ‘ডিক্সি’র সুরেরক্তে শিহরণ তুলতে পেরেছে। অন্যরা যেমন একটা অন্ধবিশ্বাসে ভর করে দুঃখকষ্ট, যুদ্ধে আহত হওয়া মানুষদের সেবাকরার মত বিরক্তিকর কাজ, অবরোধের ভয়ে আর শেষ কয়েকমাসের অনাহারে কষ্ট পাওয়াটাকে হাসি মুখে মেনে নিতেপেরেছে, স্কারলেট কখনোই পারেনি। আদর্শটা বাস্তবায়িতহলেও না হয় কথা ছিল। এখন তো সেসব পাট চুকেবুকেগেছে, তবে তার জন্য স্কারলেট কেঁদে ভাসাতে পারবে না। 

সব শেষ! মনে হচ্ছিল যুদ্ধ আর থামবেই না, এই অবাঞ্ছিতএবং অনাহূত লড়াইটা ওর জীবনকে দ্বিধাবিভক্ত করে ফেলেছে, ভাগটা এতই লক্ষণীয় যে ফেলে আসা নিশ্চিন্তজীবনটার কথা প্রায় ভুলেই যেতে বসেছে। সবুজ রঙেরমরক্কো চামড়ার পলকা স্লিপার পরা সে সুন্দরী স্কারলেটেরকথা ওর মনে পড়ে, বাতাসে ল্যাভেন্ডারের সুরভি ছড়িয়েওর যাওয়া আসা, আর মনে মনে ভাবে সেদিনের সেইমেয়েটাকে কি আর কোনোদিন ফিরে পারে। স্কারলেট ও’হারা – পুরো কাউন্টি যার আঙ্গুলের ইশারায় নেচে উঠত, শতাধিকক্রীতদাস-দাসী ওর ফাইফরমাশ খাটার জন্য হাজির, টারারঅর্থসম্পদের অবলম্বন, আর ওর যে কোনো আবদার শুনতেপ্রস্তুত স্নেহশীল বাবা আর মা। লাই পেতে পেতে বখেযাওয়া, দায়িত্বজ্ঞানহীন স্কারলেটের কোনো একটা ইচ্ছেওঅপূর্ণ থাকেনি, কেবল অ্যাশলের ব্যাপারটা ছাড়া। 

চার বছরের এই লম্বা সফরের কোথাও যেন সেই সুরভিবিলোনো, নাচের স্লিপার পায়ে গলানো কিশোরী মেয়েটাহারিয়ে গেছে, পড়ে আছে তীক্ষ্ণ সবুজ চাউনির এক মহিলা, যার কাজ হল এক এক পয়সার হিসেব রাখা আর যাবতীয়কায়িক পরিশ্রমে হাত লাগানো – পা রাখার মত একখণ্ডলাল জমিটুকু ছাড়া এই ধ্বংসস্তুপে যার আর কিছুই অবশিষ্টনেই। 

হলে দাঁড়িয়ে মেয়েদের ফোঁপানর শব্দ শুনতে শুনতে ওর মনঅন্য ভাবনায় ব্যস্ত হয়ে উঠল।

“এবার বেশি করে তুলোর চাষ করতে হবে, আরও বেশি করে। পোর্ককে কালই ম্যাকনে পাঠাতে হবে তুলোর বীজ নিয়ে আসারজন্য। ইয়াঙ্কিরা তো আর ফসল পুড়িয়ে দেবে না, আরআমাদের ট্রুপকে দেওয়ার জন্যও দরকার হবে না। অপারমহিমা ঈশ্বরের! এবারের শীতে তুলোর দাম আকাশছোঁয়াহবেই!” 

ছোট্ট অফিসঘরে ঢুকে, ফোঁপাতে থাকা সোফায় বসা মেয়েদেরদিকে কোনো রকম নজর না দিয়েই, টেবিলে বসে কলম নিয়েযে টাকা উদ্বৃত্ত আছে সেটা দিয়ে অতিরিক্ত কতটা তুলোর বীজকেনা যায় তার হিসেব-নিকেশ করতে লাগল। 

“লড়াই তাহলে থেমে গেছে,” মনে মনে ভাবল স্কারলেট, খুশির জোয়ারে হাত থেকে কলমটা আচমকাই পড়ে গেল। লড়াই থেমে গেছে আর অ্যাশলে – যদি অ্যাশলে বেঁচেবর্তেথাকে, বাড়ি ফিরে আসবে! কথাটা কি মেলানির মনে এসেছে? আদর্শের মৃত্যুর এই শোকের বিহ্বলতার মধ্যে! 

“শীগগিরই একটা চিঠি পাব আমরা – না না চিঠি নয়। চিঠিপাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু খুব তাড়াতাড়িই – যে কোনোভাবে ও আমাদের জানিয়ে দেবে!” 

কিন্তু দিন চলে যায়, সপ্তাহ ঘুরে আসে, অ্যাশলের কাছ থেকে কোনও খবরই আসে না। দক্ষিণের ডাকব্যবস্থা একটুঅনিয়মিতই, বিশেষ করে গ্রামীন অঞ্চলে তো ব্যবস্থাটাই নেই। মাঝে মধ্যে অ্যাটলান্টা থেকে আসা পরিযায়ী কোনও যাত্রীআন্ট পিটির কাছ থেকে অশ্রুপূর্ণ আবেদনে ভরা এক টুকরোকাগজ নিয়ে আসে, মেয়েদের ফিরে আসার জন্য। কিন্তুঅ্যাশলের কোনও খবর আসে না। 

***

আত্মসমর্পণের খবরটা জানার পর থেকেই স্কারলেটের সঙ্গে ঘোড়া নিয়ে স্যুয়েলেনের একটা খটাখটি লেগেই রইল। ইয়াঙ্কিদের কাছ থেকে আর কোনও বিপদের আশঙ্কা যখননেই, স্যুয়েলেনের ইচ্ছে প্রতিবেশিদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাতকরার। নিঃসঙ্গতা আর পুরোনো দিনের মত সামাজিকমেলামেশা না করতে পারার অভাববোধ থেকে স্যুয়েলেনেরইচ্ছে হল বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার, অন্তত এইটুকে জেনেআশ্বস্ত হবার জন্য যে কাউন্টির অন্যান্যরাও টারার মত একইধরণের দুর্দশার মধ্যে রয়েছে। কিন্তু স্কারলেট নাছোড়বান্দা। ঘোড়া ব্যবহার করা হবে কাজের জন্য, জঙ্গল থেকে কাঠ বয়েআনার জন্য, জমিতে লাঙ্গল দেওয়ার জন্য আর খাবারেরখোঁজে পোর্কের যাওয়া আসার জন্য। প্রতি রবিবারে ওকেচরে বেড়াতে দেওয়ার আর বিশ্রাম দেওয়ারও প্রয়োজন। স্যুয়েলেনের যদি এতই যাওয়ার ইচ্ছে, পায়ে হেঁটে গেলেইপারে। 

আগের আগের বছর পর্যন্ত, স্যুয়েলেন জীবনে একশ গজওপায়ে হেঁটে কোথাও গেছে কিনা সন্দেহ, ফলে কথাটা ওরকানে মোটেই মধু ঢেলে দিল না। তাই ও ঘরে বসেই রাগেফুঁসতে লাগল, কান্নাকাটি করে সবাইকে অতিষ্ঠ করে তুলল, আর কথায় কথায় বলতে লাগল, “ওহো, মা যদি এখানেথাকতেন!” ফলে স্কারলেট ওকে থাপ্পড় মারার যে শাসানি দিত, একদিন সেটা মেরেই বসল, আর সেটা এতই জোরে মারল যেও চেঁচিয়ে বিছানার ওপর পড়ে গেল, আর বাড়ির সকলেরীতিমত হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল। এরপর থেকে স্যুয়েলেনঘ্যানঘ্যান করা কমিয়ে দিল, অন্তুত স্কারলেটের সামনে। 

ঘোড়াটাকে সপ্তাহে একবার বিশ্রাম দেওয়া দরকার এই কথাটাসত্যিই স্কারলেটের মনে হয়েছিল, তবে সেটাই পুরো সত্যি নয়। বাকি সত্যিটা হল, স্কারলেট একবার পুরো কাউন্টিতে চক্করলাগিয়েছিল, আত্মসমর্পণের পরের মাসেই, কিন্তু পুরোনোবন্ধুদের আর ওদের প্ল্যান্টেশনের দূরবস্থা দেখে ওর ভেতরপর্যন্ত কেঁপে গেছিল, আর সেটা ও নিজের কাছেও পুরোপুরিস্বীকার করে নিতে ভয় হয়েছে। 

ফোনটেনদের অবস্থা তবু মন্দের ভাল, স্যালির ঊর্ধশ্বাসেঘোড়া ছোটানোটা বৃথা যায়নি, তুলনামূলকভাবেঅন্যান্যদের দুর্দশা চোখে দেখা যায় না । হার্ট অ্যাটাকের পরগ্র্যান্ডমা ফোনটেন আর পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেননি, আগুননিবিয়ে বসতবাড়িটা বাঁচাতে সবার সঙ্গে হাত লাগানোরধকলটা শরীর নিতে পারেননি। বৃদ্ধ ডঃ ফোনটেনের একটিবাহু ছেদনের পরে সুস্থ হয়ে উঠতে অনেক সময় লাগছে। অ্যালেক্স আর টোনি অপটু হাতে জমিতে লাঙ্গল আরকোদাল চালাচ্ছে। বেড়ার ওধার থেকে ঝুঁকে পড়ে দুজনে হাতবাড়িয়ে স্কারলেটের সঙ্গে করমর্দন করল, স্কারলেটেরভাঙাচোরা ওয়াগন নিয়ে খানিক হাসাহাসি করল, তিক্ততারহাসি, কারণ ওরা নিজেদের দুরবস্থা নিয়েও টিপ্পনী কাটতে ছাড়ল না। স্কারলেট জানাল ও ভুট্টার বীজ কিনতে চায়, ওরা জানাল দেবে, তারপরেই চাষবাসের নানান সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করল। বলল, ওদের বারোটা মুরগি রয়েছে, দুটো গরু আর পাঁচটা শুয়োর আর লড়াই থেকে নিয়ে আসা একটা খচ্চর। একটা শুয়োর এর মধ্যেই মরে গেছে, ভয় যে বাকিগুলোরও না একই দশা হয়। যে ফুলবাবুরা আগে কখনও টাইয়ের কেতদূরস্ততার বাইরে কোনো বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায়নি তাদের মুখে শুয়োর নিয়ে গুরুগম্ভীর কথাবার্তা শুনে স্কারলেট হেসেই কুল পায় না। তবে স্কারলেটের হাসিতেও সেই তিক্ততারই ছোঁয়া। 

খুব হইচই করে সবাই মিলে স্কারলেটকে মিমোজ়াতে অভ্যর্থনাজানাল, বলতে লাগল বীজ এমনিই দেবে, দাম কিছুতেই নিতেপারবে না। স্কারলেট যখন টেবিলের ওপর ডলারের একটানোট রাখল, ফোনটেন পরিবারের রগচটা মেজাজটা বেরিয়েপড়ল, সোজাসুজি বলে দিল দাম নিতে পারবে না। স্কারলেট বীজ নিয়ে নিল আর চুপি চুপি স্যালির হাতে ডলারের একটানোট ধরিয়ে দিল। আট মাস আগে টারায় ফেরার পর যেস্যালি স্কারলেটকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল, সেই স্যালি এখনঅনেক বদলে গেছে। তখনও ওকে ফ্যাকাসে লেগেছিল ঠিকই, কিন্তু প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর ছিল। সেই প্রাণচাঞ্চল্যএকেবারেই উধাও হয়ে গেছে, আত্মসমর্পণ ওর সমস্ত স্বপ্ন যেনভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে।

“স্কারলেট,” টাকাটা হাতের মুঠোয় নিয়ে ফিসফিস করে বলল, “এই সব করে কী উপকারটা হল বলত? কেন মিছে আমরালড়াই করতে গেলাম? বেচারা জো! আমার হতভাগাবাচ্চাটা!”

“জানি না, কেন আমরা লড়াই করলাম, আমার কিছুই এসেযায় না,” স্কারলেট বলল। “আর আমি জানতে চাইও না। কোনোদিনই জানার আগ্রহ হয়নি। এই সব লড়াই-টড়াইছেলেদের ব্যাপার, মেয়েদের নয়। তুলোর ভাল একটা ফসলউঠুক, এটাই এখন আমার একমাত্র কাম্য। এই ডলারটা নাও, আর ছোট্ট জো’কে একটা জামা কিনে দিও। আমি জানি, ওরলাগবে। অ্যালেক্স আর টোনি যাই বলুক না কেন, আমিকিছুতেই তোমাদের লোকসান করাতে পারব না।”

ছেলে দুজন স্কারলেটকে সাহায্য করবার জন্য ওয়াগন পর্যন্তগেল, ছেঁড়াখোঁড়া পোশাকে থাকলেও ওদের সৌজন্য আররসবোধে কোনও ঘাটতি ছিল না, তবু মিমোজ়া থেকে ফেরারপথে ওদের রিক্ততা স্কারলেটকে ভেতর থেকে কাপিয়ে দিল। দারিদ্র আর অভাবের তাড়নায় একেবারে নাজেহাল হয়ে গেছে ও। এমন একটা পরিবারও যদি পাওয়া যেত যাদেরএখনও যথেষ্ট টাকাকড়ি আছে, দুবেলা অন্ন জোটা নিয়েভাবনা করতে হয় না, কী ভালই না লাগত! 

কেড কালভার্ট পাইন ব্লুমে বাড়িতেই ছিল, যখন স্কারলেট পুরোনো বাড়িটার সিঁড়ির সামনে এসে পৌঁছল, সুখেরদিনগুলোতে এখানে এসে কতরার নেচেছে, আজ কেডের মুখেমৃত্যুর করাল ছায়া। শীর্ণকায় হয়ে গেছে, রোদ্দুরে একটাইজ়িচেয়ার পেতে বসে খুক খুক করে কেশে উঠছে, হাঁটুর কাছেএকটা শাল ছড়ানো, স্কারলেটকে দেখামাত্রই চোখমুখ খুশিতেভরে উঠল। সামান্য সর্দি বসে গেছে বুকে, স্কারলেটকেঅভ্যর্থনা জানানোর জন্য উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতে করতেবলে উঠল। বৃষ্টিতে ভিজে হয়েছে, তবে খুব তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে উঠে সবার সাথে কাজে হাত লাগাবে। 

বাড়ির ভেতর থেকে কথাবার্তার আওয়াজ শুনে ক্যাথলীনক্যালভার্টের ওর ভাইয়ের মাথার ওপর দিয়ে স্কারলেটের সঙ্গে চোখাচোখি হল। স্কারলেটের মনে হল ক্যাথলীন সবই জানে, আর ওর চোখে তীব্র হতাশা। কেড নাও জানতে পারে, কিন্তুক্যাথলীন জানে। পাইন ব্লুমে তদারকির অভাব, ফলেআগাছায় চারপাশ ভরে উঠেছে, পাইনের চারারা মাথা চাড়াদিয়ে উঠেছে অবিন্যস্তভাবে, বাড়িটা ভেঙে পড়ছে, অপরিচ্ছন্ন। রোগা টানটান চেহারা ক্যাথলীনের। ওরা দুই ভাইবোন, ওদের ইয়াঙ্কি সৎ মা, ছোট চারজন সৎ ভাইবোন, আর ওদেরইয়াঙ্কি ওভারসিয়ার হিলটন, এরা সবাই এই নিষ্প্রাণ বাড়িরনীরব বাসিন্দা। হিলটন কোনোদিনই স্কারলেটের পছন্দেরতালিকায় ছিল না, যেমন নিজেদের ওভারসিয়ার জোনাসউইল্কারসনকেও ও পছন্দ করত না। এখন যখন হিলটনঅলসভাবে স্কারলেটকে সম্ভাষণ জানাতে এল, যেন সমানেসমানে দেখা, লোকটার প্রতি স্কারলেটের বিতৃষ্ণা আরও বেড়েগেল। আগে ওর চেহারায় বেহায়াপনার সঙ্গে সঙ্গে একটাবশংবদ ভাব ফুটে উঠত, কিন্তু এখন, যুদ্ধে মিস্টার ক্যালভার্টআর রাইফোর্ডের মৃত্যু হয়ে যাওয়ায় আর কেড অসুস্থ হয়ে পড়ায়, বশংবদ ভাবটা পুরোপুরি উবে গেছে। দ্বিতীয় মিসেজ়ক্যালভার্ট নিগ্রোদের কাছ থেকেই সম্মান আদায় করতেপারেননি কোনোদিন, একজন সাদা মানুষের কাছ থেকে আদায় করা তো আশাই করা যায় না। 

“এই কঠিন সময়ে আমাদের পাশে থেকে মিস্টার হিলটন যে কীউপকার করেছেন, সে বলার নয়,” মিসেজ় ক্যালভার্ট একটুঘাবড়ে যাওয়া গলায় বললেন, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা সৎ মেয়ের দিকে একবার দৃষ্টিপাত করে। “খুবই উপকার করেছেন। তুমি নিশচয়ই শুনেছ, দু’দুবার কী ভাবে আমাদের বাড়িটাশেরম্যানের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। উনি না থাকলে, কী করে যে আমি সব দিক সামলে উঠতে পারতাম – টাকাকড়িও কিছু নেই আর কেড – ”

কেডের ফর্সা মুখটা লাল হয়ে উঠল, চোখের লম্বা পালকেরতলায় ক্যাথলীনের চাউনি আড়াল হয়ে গেলেও, ওর চোয়ালশক্ত হয়ে উঠল। একজন ইয়াঙ্কি ওভারসিয়ারের গলগ্রহ হয়ে থাকতে হচ্ছে বলে ভেতরে ভেতর দুজনেই যে নিষ্ফল আক্রোশেজ্বলছে, সেটা স্কারলেট বুঝতে পারে। মনে হচ্ছিল মিসেজ়ক্যালভার্ট বুঝিবা কেঁদেই ফেলবেন। সাঙ্ঘাতিক একটাগোল যে বাঁধিয়ে বসেছেন, সেটা বুঝতে পারছিলেন। প্রায়ইউনি এই ধরণের গোল বাঁধিয়ে বসেন। দক্ষিণের মানুষদেরউনি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেন না, অথচ জর্জিয়াতে কুড়িটাবছর কাটিয়ে দিয়েছেন। সৎ ছেলেমেয়েদের কী বলা উচিতনয়, সেটা উনি ভেবেই পান না, উনি যাই বলুন বা করুন না কেন, ওরা সব সময়েই মাত্রাতিরিক্ত ভদ্রতা দেখাবে। মনে মনেউনি ঠিকই করে নিয়েছেন যে উনি উত্তরে নিজেদেরলোকজনদের কাছেই ফিরে যাবেন, বাচ্চাদেরও নিয়ে যাবেন, আর এই সব একগুঁয়ে ঘাড় শক্ত মানসিকতার মানুষদের থেকে দূরে চলে যাবেন। 

এই সব দেখা সাক্ষাতের পর স্কারলেটের আর টার্লটনদেরবাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছেই হচ্ছিল না। চারজন ভাইই চলে গেছে, বাড়িটাও পুড়ে ছাই, পরিবারটা ওভারসিয়ারের কুঁড়েতে কোনও রকমে মাথা গুঁজে আছে। যাওয়ার ইচ্ছেটাই মরে গেল ওর। কিন্তু স্যুয়েলেন আর মেলানি আকুতি করতে লাগল, মেলানিও বলল ওদের কাছ থেকে একবার ঘুরে না আসাটাখারাপ দেখাবে, বিশেষ করে মিস্টার টার্লটনের লড়াইয়ের পরেবাড়ি ফিরে আসাটা উদযাপন না করা হলে।

এই যাওয়াটাই হল সব চেয়ে বেশি হৃদয়বিদারক। 

বাড়িটার ধ্বংসাবশেষের পাশ দিয়ে যেতে যেতে বিয়াট্রিসটার্লটনের দেখা পেল, ছিন্নভিন্ন একটা ঘোড়ায় চড়ার পোশাকপরে, চাবুক হাতে নিয়ে ঘোড়াশালের পাঁচিলের ওপরফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। ওদের ঘোড়াদের তালিমদিত যে বেঁটে মত নিগ্রোটা, যা দুই পা ধনুকের মত বাঁকা, পাশে দাঁড়িয়ে। ওর চোখেমুখেও ওর মালকিনের মতই মলিনএকটা ভাব। ঘোড়াশালাটা, এক সময় ভাল জাতের ঘোড়ায়ভরা থাকত, এখন শূন্য। একটা শুধু খচ্চর রয়েছে ওখানে, যেটাতে চড়ে মিস্টার টার্লটন ফিরেছেন, আত্মসমর্পণের পরে। 

আমার সোনার টুকরোগুলো না থাকায়, আমি যে কী করবভেবেই পাচ্ছি না,” মিসেজ় টার্লটন পাঁচিল থেকে নামতেনামতে বললেন। অপরিচিত লোকেরা ভাববে হয়ত ওঁর মৃতচার পুত্রের কথা বলছেন, কিন্তু টারা থেকে আসা মেয়েরাজানে যে উনি ঘোড়াদের কথাই বলছেন। আমার সুন্দর সুন্দরঘোড়াগুলো সব মরে গেছে। আহা, বেচারি নেলী! অন্ততনেলীটাও যদি থাকত! সেই জায়গায় কী আছে? না মুখপোড়াএকটা খচ্চর!” কথাটা আবার করে বললেন। রাগ রাগ চোখে জানোয়ারটার দিকে একবার তাকালেন। “ওটা তো আমার সোনার টুকরোগুলোর স্মৃতিকে অপমান! ওই হতচ্ছাড়া ওদেরজায়গাটা দখল করে বসে আছে! বেজন্মা প্রাণী এইখচ্চরগুলো – ওদের চাষ করাটাই বেআইনি!"

জিম টার্লটন, দাড়ির জঙ্গলে চেহারাটা আড়াল হয়ে গেছে, ওদের স্বাগত জানানোর জন্য ওভারসিয়ারের কুটির থেকে বেরিয়ে এসে ওদের গালে চুমু খেলেন, ওঁর চার লাল-চুলোমেয়েরা, পরনে রিফু করা পোশাক, ওরাও পেছন পেছন বেরিয়েএল, পায়ের কাছ থেকে এক ডজন কালো আর বাদামিশিকারি কুকুরদের সরাতে সরাতে। অপরিচিত গলারআওয়াজ পেয়ে ওরা ঘেউ ঘেউ করতে করতে ছুটে এসেছিল। পরিবারের সকলেই যে আনন্দে আছে, উচ্ছ্বল পরিবেশ তৈরি করে সেটা তুলে ধরার সযত্ন প্রয়াস। মিমোজ়ার তিক্ততাকিংবা পাইন ব্লুমের মৃত্যু-সদৃশ নীরবতা – তার চেয়েওএখানকার পরিবেশ স্কারলেটকে ভেতরে ভেতরে কাঁপিয়েদিল। 

মেয়েরা যাতে ওঁদের সঙ্গেই ডিনার করে যায় সেই নিয়ে টার্লটনরা জোর করতে লাগলেন। বললেন যে অতিথিঅভ্যাগতদের আসা যাওয়া আজকাল বড় কমে গেছে, ওঁরাসবার খবরাখবর শুনতে চান। স্কারলেটের একদম থাকারইচ্ছে ছিল না, পরিবেশটায় ওর দমবন্ধ হয়ে আসছিল, কিন্তুমেলানি আর ওর দুই বোন আরও অনেকক্ষণ থেকে যেতেচাইছিল। ফলে চারজনই থেকে গেল, আর পরিবেশন করামাংস আর শুকনো মটরশুঁটির মত অতি সাধারণ খাবার দিয়েডিনার সারল।

খাবারদাবারের দৈন্যদশা নিয়ে খুব হাসাহাসি করল ওরা, টার্লটন বোনেরা নিজেদের গোঁজামিল দেওয়া পোশাক নিয়ে কথা বলতে বলতে খুব হেসে উঠল, যেন তামাশা করার মতকিছু বলে ফেলেছে। মেলানিও ব্যাপারটা হালকা করারজন্য হাসিতে ওদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে টারার দৈন্যদশা নিয়েওরসিকতা করতে লাগল, এই রকম প্রগলভতা এতটাইমেলানির স্বভাববিরুদ্ধ যে স্কারলেট খুব আশ্চর্য হয়ে গেল।স্কারলেট প্রায় চুপচাপই রইল। চার টার্লটন ভাইদের অলসমেজাজে বসে ধূমপান করা, খুনসুটি করা, এসব না থাকায়ঘরটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। ওর নিজেরই যখনএতটা ফাঁকা লাগছে, তাহলে টার্লটনরা, যাঁরা হাসিমুখেঅতিথিদের আপ্যায়ন করে চলেছেন, তাঁদের মনে কী চলছে, সেটা তো সহজেই অনুমান করা যায়। 

খাওয়ার সময় ক্যারীন খুবই কম কথা বলছিল, কিন্তুখাওয়াদাওয়া শেষ হয়ে যাবার পরে মিসেজ় টার্লটনের পাশেচলে গিয়ে ওঁর কানে কানে কিছু বলল। মিসেজ় টার্লটনেরমুখের ভাব বদলে গেল, মুখ থেকে লোকদেখানো হাসিটামিলিয়ে গেল, ক্যারীনের সরু কোমরটা হাত বাড়িয়ে জড়িয়েধরলেন। তারপর ওঁরা দুজনে বেরিয়ে গেলেন। স্কারলেটের মনে হচ্ছিল, আর এক মিনিটও ওখানে বসে থাকা সম্ভব নয়, তাই উঠে ওদের পেছন পেছন গেল। বাগানের ভেতর দিয়েপথটা ধরে ওঁরা যাচ্ছিলেন, স্কারলেট দেখল ওঁরা সমাধিভূমিরদিকে চলেছেন। কিন্তু এখন আর ভেতরে ফিরে যাওয়া সম্ভবনয়, খুবই খারাপ দেখাবে। কিন্তু ক্যারীনের মিসেজ় টার্লটনকেওঁর ছেলেদের সমাধির দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার কোনও মানেহয়, বিয়াট্রিস যখন নিজেকে এতটা অবিচলিত রাখার চেষ্টাকরছেন?

সেডার গাছের বিষাদমাখা চায়ায়, ইটে ঘেরা জায়গায়শ্বেতপাথরের দুটো নতুন ফলক – এতই নতুন যে এখনও বৃষ্টিপড়ে সেগুলোতে লাল মাটির কাদার ছিঁটে লাগাতে পারেনি। 

“গেল হপ্তায় আনালাম ওদুটো,” মিসেজ় টার্লটন খুব গর্বেরসঙ্গে জানালেন। “মিস্টার টার্লটন ম্যাকনে গেছিলেন – ওয়াগনে করে বাড়ি নিয়ে এলেন।”

সমাধিফলক! খুবই দামি নিশ্চয়ই! সহসা স্কারলেটের আরটার্লটনেদের জন্য কষ্ট পাওয়াটা চলে গেল। খাবারদাবারেরযখন এত দাম, এত দুষ্প্রাপ্য, তখন কেউ যদি টাকা সামান্যসমাধিফলকের পেছনে অপচয় করে, তবে সহানুভূতি তারমোটেই প্রাপ্য নয়। তাছাড়া দুটো ফলকেই অনেক কিছু লেখা। যত বেশি লেখা, তত বেশি টাকা! পরিবারের সকলেরই নির্ঘাতমাথা খারাপ হয়ে গেছে! এছাড়া তিন ছেলের দেহ নিয়ে আসারজন্যও তো টাকা খরচ হয়েছে! ব্যয়েডের দেহ তো পাওয়াই গেলনা, কোনও খোঁজও পাওয়া যায়নি। 

ব্রেন্ট আর স্টুয়ার্টের সমাধির মাঝখানে লাগানো ফলকটাতেলেখা আছে – “যখন বেঁচে ছিল, ওরা খুব হাসিখুশি আরপরস্পরের ঘনিষ্ঠ ছিল, মৃত্যুর পরেও ওদের আলাদা করা হলনা।”

অন্য ফলকটাতে বয়েড আর টমের নাম আর ল্যাটিনে কিছু লেখা, যেটা শুরু হয়েছে “Dulce et – ” কিন্তু তার অর্থস্কারলেটের বোধগম্য হল না, ফেয়্যাটভিল অ্যাকাডেমিতেল্যাটিন ক্লাসগুলো কোনোক্রমে পালিয়ে বেঁচেছে। 

সামান্য দুটো সমাধি ফলকের জন্য এত টাকা খরচ! পাগলনাকি ওরা! যেন ওর নিজের টাকা গচ্চা গেছে, স্কারলেট মনে মনে খুব রেগে গেল। 

ক্যারীনের চোখ অদ্ভুতভাবে জ্বলজ্বল করছে।

“অসাধারণ লাগছে,” প্রথম ফলকটা দেখিয়ে ফিসফিস করে বলল।

ক্যারীনের অসাধারণ লাগতেই পারে। আবেগময় যে কোনও ব্যাপারেই ও নাড়া খেয়ে যায়। 

“ঠিক বলেছ,” মিসেজ় টার্লটন বললেন, স্বরটা খুবই কোমল, “আমাদের মনে হয়েছিল, এরকমই হওয়া উচিত – প্রায়একসাথেই দুজনে মারা গিয়েছিল, প্রথমে স্টুয়ার্ট, আর ব্রেন্টতারপরে, ওর হাত থেকে খসে যাওয়া পতাকাটা তুলতে গিয়ে।”

টারায় ফেরার পথে, স্কারলেট খানিক নিজের মনেই রইল, এইবাড়িগুলোতে গিয়ে কী কী দেখল সেটা নিয়েই ভাবছিল। ইচ্ছেনা থাকা সত্ত্বেও মনে এসে যাচ্ছিল কাউন্টির গরিমারদিনগুলোর কথা, বড় বড় বাড়ি, টাকাকড়ির অভাব নেই, কোয়ার্টারগুলো নিগ্রো ক্রীতদাসে ভরা, তুলোর ফসলে ক্ষেতসবুজ হয়ে আছে। 

“আর এক বছরের মধ্যে এই সব ক্ষেত পাইনের চারায় ভরেযাবে,” চারপাশে ঘেরা বনভূমির দিকে তাকিয়ে, শিউরে উঠেস্কারলেট ভাবল। “ডার্কিদের ছাড়া, নিজেদের কোনোক্রমেবাঁচিয়ে রাখা ছাড়া আর কিছুই আমরা করে উঠতে পারব না। একটা বিশাল প্ল্যান্টেশন, ডার্কিদের ছাড়া চালানো অসম্ভব। অনেক জমি চাষ না করা অবস্থাতেই পড়ে থাকবে। আগাছায়ক্ষেত ভরে যাবে। বেশি করে তুলোর চাষ কেউ করতেপারবে না। তাহলে আমরা করব কী? গাঁয়ের মানুষদের কীহাল হবে? শহরের লোকেরা তো কোনওভাবে চালিয়ে নেবে! ওরা সর্বদাই চালিয়ে নিয়েছে। কিন্তু আমরা, গাঁএর লোকেরা, একশ বছর পিছিয়ে যাব আবার, যাঁরা এর পত্তন করেছিলেন, তাঁদের মত, ছোট ছোট ক্যাবিনে থেকে, অল্প কয়েক বিঘাজমি চাষ করে। কোনও রকমে অস্তিত্ব রক্ষা।”

“উহুঁ – ” স্কারলেট ক্ষমাহীন মন নিয়ে চিন্তা করল, “টারাকেকিছুতেই এরকম হতে দেওয়া যাবে না। তার জন্য যদি নিজেকেলাঙ্গল চালাতে হয়, তাও সই। এই পুরো অঞ্চল, পুরো রাজ্য, জাহান্নামে যেতে চায় যাক, টারাকে আমি কিছুতেই যেতে দেবনা। তাছাড়া আমার টাকা আমি সমাধিফলক কিনে বাআমার সময় যুদ্ধ নিয়ে অযথা বিলাপ করে নষ্ট হতে দেব না। কোনো উপায় আমরা বের করতেই পারি। আমি জানি যে এতমৃত্যু না হলে আমরা সামলে নিতে পারতাম। । ডার্কিদের চলে যাওয়াটা তত বড় কোনও ব্যাপার নয়, যতটা না এত মানুষেরমৃত্যু, বিশেষ করে তরুণদের মৃত্যু।” টার্লটনদের চার ভাই, জো ফোনটেন, রেফোর্ড ক্যালভার্ট, মুনরো ভাইরা আরফেয়াটভিল আর জোনসবোরোর ছেলেদের কথা – যাদের নামনিহতদের তালিকায় ও দেখেছিল – এদের সবার কথা আবারকরে ভাবল। “যথেষ্ট লোক বেঁচে থাকলে, কোনোক্রমে অবশ্যইসামলে নিতে পারতাম, কিন্তু – ”

সহসা অন্য একটা ভাবনা মাথায় এল – ধর যদি আবার ওরবিয়ে করার ইচ্ছে হয়। বিয়ে করবার ইচ্ছে ওর মনে আদৌ নেইঅবশ্য। একবারই যথেষ্ট। তাছাড়া একজনও পুরুষমানুষকেইও বিয়ে করতে চেয়েছে, আর সে হল অ্যাশলে, কিন্তু ওর তোবিয়ে হয়েই গেছে, অবশ্য যদি এখনও ও বেঁচে থাকে। তবুকথার কথা ধরে নেওয়া যাক, ওর আবার বিয়ে করতে ইচ্ছেহল। কে থাকবে যে ওকে বিয়ে করতে পারবে? ভাবনাটা মনকেভারাক্রান্ত করে তুলল।

“মেলি,” ও বলে ফেলল, “দক্ষিণের মেয়েদের কি হবে গো?”

“কী বলতে চাইছ?”

“ঠিক যা বলেছি। ওদের কী হবে? ওদের বিয়ে করার মত কেউইতো রইল না। একবার ভাব মেলি, জোয়ান ছেলেরা সব মরেগেল, দক্ষিণের হাজার হাজার মেয়ে আইবুড়ো থেকেই মরেযাবে!”

“আর ওদের কোনও সন্তানও থাকবে না,” মেলানি যোগ করল, ওর কাছে ওটাই সব চাইতে জরুরি ব্যাপার। 

বোঝা গেল ভাবনাটা স্যুয়েলেনকেও ভাবাচ্ছে, ওয়াগনেরপেছনে বসে হঠাৎ ও কাঁদতে শুরু করল। বড়দিনের পর থেকে ফ্র্যাঙ্ক কেনেডির কোনও খবর ও পায়নি। কারণটা ঠিক কী, সেটা ও জানে না – ডাক চলাচলের অব্যবস্থাই এর জন্যদায়ী, না এতদিন উনি কেবল ওর আবেগ নিয়ে ছেলেখেলাকরে এখন ওকে বিলকুল ভুলে গেছেন। কিংবা কে জানে, লড়াইয়ের শেষের দিকে উনি হয়ত মারাই পড়েছেন! ওকেবেমালুম ভুলে যাওয়ার থেকে, এটা হলেই ভাল, কারণপ্রেমিকের মৃত্যু হয়ে যাওয়ার মধ্যে গৌরবের একটা ব্যাপার আছে, যেমন ক্যারীন আর ইন্ডিয়া উইল্কসের ক্ষেত্রে হয়েছে, কিন্তু প্রেমিকের ছেড়ে চলে যাওয়া খুব অপমানের। 

“ভগবানের দোহাই, চুপ কর তুই,” স্কারলেট বলল।

“বাহ, তুই যা খুশি তাই বলতে পারিস,” ফোঁপাতে ফোঁপাতেস্যুয়েলেন বলল, “কারণ তোর তো বিয়ে হয়ে গেছে, একটাবাচ্চাও আছে, তাই সবাই জানে তোকে একজন ছেলেও অন্ততচেয়েছে। একবার আমার দিকে তাকিয়ে দেখ! তুই এত নীচেনেমে বোঝাতে চাইলি যে আমি একজন আইবুড়ো মেয়ে, আমার কোনও রাস্তাই খোলা নেই! আমি তোকে মন থেকে ঘেন্না করি!”

“চুপ করবে তুই! জানিসই তো যারা সারাক্ষণ কানের কাছেচেঁচামেচি করে তাদের আমি দেখতে পারি না। ভালমতইজানিস তুই ওই পাকা ঝুলো গোঁপওয়ালা বুড়োটা বহালতবিয়তেই আছেন, আর ফিরে এসে তোকে বিয়েও করবেন। তবে নিজের কথা যদি বলি, ওই ভদ্রলোককে বিয়ে করারচাইতে আমি আইবুড়ো হয়ে থাকাটাই বেশি পছন্দ করব!”

ওয়াগনের পেছনদিকে খানিকক্ষণ সব চুপচাপ, ক্যারীনঅন্যমনস্কভাবে দিদির গায়ে হাত বুলিয়ে ওকে শান্ত করতেলাগল, কারণ ওর মন তিন বছর আগে ফিরে গেছে, যখনব্রেন্ট টার্লটনের পাশে পাশে ঘোড়ায় করে যেত। ওর চোখেমুখেপ্রগাঢ় শান্তির আভা। 

“ওহ্‌,” মেলানি দুঃখিতস্বরে বলল, “আমাদের ভাল ভাল সবছেলেরা ছাড়া কেমন লাগবে দক্ষিণকে? ওরা বেঁচে থাকলেকেমন হত এই দক্ষিণ দেশটা? ওদের সাহস, কর্মশক্তি আরবুদ্ধিমত্তাকে আমরা কাজে লাগাতে পারতাম। স্কারলেট, আমাদের যাদের যাদের ছোট ছোট ছেলে আছে, ওদেরএমনভাবে মানুষ করতে হবে যাতে যারা চলে গেছে, তাদেরজায়গাটা ওরা নিতে পারে, ওদের মত সাহসী হতে পারে।”

“ওদের মত মানুষ আর হবে না,” ক্যারীন আস্তে আস্তে বলল। “কেউ ওদের জায়গা নিতে পারবে না।”

বাকি পথটা ওরা আর কোনও কথা বলল না। 



***

এই ঘটনার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই, সূর্যাস্তের সময়ে, একদিনক্যাথলীন ক্যালভার্ট টারাতে এল। কান ঝোলা, খোঁড়া যেজানোয়ারের গায়ে জিনটা লাগানো, স্কারলেট কোনও খচ্চরেরএমন করুণ দশা আগে কখনও দেখেনি। ক্যাথলীনেরও ওরবাহনের মতই করুণ অবস্থা। গৃহভৃত্যরা সাধারণত যেরকমপরে থাকে, সেই রকম ডোরাকাটা মলিন পোশাক, মাথারওপরের বনেটটা সুতো দিয়ে থুতনির সঙ্গে বাঁধা। বাড়িরসামনের উঠোনের সামনে এসে দাঁড়াল, কিন্তু নামল না। স্কারলেট আর মেলানি সূর্যাস্তের শোভা উপভোগ করছিল, ওরা সিঁড়ি বেয়ে নেমে ওর সঙ্গে দেখা করতে গেল। যেদিনস্কারলেটরা গেছিল সেদিন কেডকে যেমন দেখাচ্ছিল,ক্যাথলীনকেও সেরকমই পাণ্ডুর দেখাচ্ছে, ফ্যাকাসে, কঠোরএবং ভঙ্গুর, যেন কথা বলতে গেলেই ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে যাবে। তবেশিরদাঁড়া ঋজু, আর মাথাটাও একদম সোজা করে রাখা। ওদের দেখে ঘাড় নাড়ল। 

উইল্কসদের বারবেকিউয়ের দিনটার কথা সহসা স্কারলেটেরমনে পড়ে গেল, যেদিন ও আর ক্যাথলীন একসঙ্গে বসে রেটবাটলারকে নিয়ে গুজগুজ ফুসফুস করেছিল। অরগ্যান্ডিরনীল রঙের পোশাকে, আর গোলাপ ফুলের সুগন্ধে ভরাওড়নাতে আর ছোট ছোট সুন্দর গোড়ালি পর্যন্ত ঢাকা কালোরঙের স্লিপারে ওকে সেদিন কী সুন্দর আর তাজা লাগছিল।আজ খচ্চরের পিঠে বসে থাকা আড়ষ্ট মেয়েটার সঙ্গে সেদিনেরমেয়েটার কোনও মিলই নেই। 

“আমি আর নামছি না, ধন্যবাদ,” ও বলল। “এলাম শুধুতোমাদের জানাতে যে আমি বিয়ে করতে চলেছি।”

“বল কী!”

“কার সঙ্গে?”

“কী ভাল খবর, ক্যাথি!”

“কবে?”

“আগামীকাল,” ক্যাথলীন খুব শান্তভাবে বলল, কিন্তু ওরগলার স্বরে এমন কিছু একটা ছিল, যে ওদের মুখ থেকে হাসিমিলিয়ে গেল। “বলতে এলাম যে কাল আমার বিয়ে হবে, জোনসবোরোতে – আর আমি তোমাদের কাউকে আসতেবলছি না।”

কথাটা ওরা চুপচাপ হজম করে হতভম্ব চোখে ওর দিকে তাকালদুজনে। তারপর মেলানি কথা বলল –

“আমরা চিনি, এমন কারোর সাথে, সোনা?”

“হুঁ,” ক্যাথলিন এক নিঃশ্বাসে কথাটা বলল। “মিস্টারহিলটনের সঙ্গে।”

“মিস্টার হিলটন?”

“হ্যাঁ, মিস্টার হিলটন, আমাদের ওভারসিয়ার।”

স্কারলেটের মুখে কেবল “ওহ্‌!” কথাটাও সরল না, তবেক্যাথলীন মেলানির দিকে তাকিয়ে হিংস্রস্বরে বলে উঠল, “তুমিযদি কাঁদ, মেলি, আমি সহ্য করতে পারব না। আমি মরেইযাব!” 

মেলানি কিছু বলল না, শুধু মাথা নীচু করে পাদানি থেকে ঝুলতে থাকা ওর বাড়িতে বানানো বেঢপ জুতোতে হাতবোলাতে লাগল। 

“আর আমার গায়ে হাত বুলিয়ে দিও না। সেটাও সহ্য করতেপারব না।”

মেলানি হাত সরিয়ে নিল, কিন্তু মাথা তুলল না। 

“ঠিক আছে, এবার যেতে হবে, তোমাদের জানাতেইএসেছিলাম।” কঠোর আর ভঙ্গুর মুখোশটা আবার ফিরেএল, লাগামটা হাতে তুলে নিল। 

“কেড কেমন আছে?” স্কারলেট জানতে চাইল। অস্বস্তিকরনীরবতাটা ভাঙ্গতে কিছু একটা বলার জন্য এতক্ষণ মনে মনে তোলপাড় করছিল।

“ও মরে যাবে,” ক্যাথলীন রূঢ়স্বরে বলল। অদ্ভুত গলার স্বরওর। “তবে কিছুটা স্বস্তি আর শান্তি নিয়ে চোখ বুজতে পারবে, যদি বিয়েটা করে ফেলতে পারি, ও চোখ বুজলে আমার দেখাশোনা কে করবে সেই দুশ্চিন্তা থেকে রেহাই পাবে। আরতাছাড়া আমার সৎ মা তাঁর বাচ্চাদের নিয়ে উত্তরে চলে যাচ্ছেন, কালই, চিরদিনের জন্য। আচ্ছা এবার আমাকেযেতেই হবে।”

মেলানি মাথা তুলে ক্যাথলীনের কঠিন দৃষ্টির সঙ্গে দৃষ্টিমেলাল। মেলানির চোখে জল চিকচিক করছে, সহমর্মিতায়ভরা দৃষ্টি। সে দৃষ্টির সামনে ক্যাথলীনের ঠোঁটে বাঁকা একটাহাসি ফুটে উঠল, ঠিক যেন সাহসী এক শিশু প্রাণপণে কান্নারোধ করার চেষ্টা করে চলেছে। স্কারলেট তখনও ক্যাথলীনক্যালভার্টের ওভারসিয়ারকে বিয়ে করার ব্যাপারটা মনে মনেমেলানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে – ক্যাথলীন, যে কিনাএকজন সমৃদ্ধ প্ল্যান্টারের মেয়ে, সেই ক্যাথলীন, স্কারলেটেরপরেই এই কাউন্টিতে যার প্রণয়ীর সংখ্যা গুনে গুনে হিসাবরাখতে হত!

ক্যাথলীন সামান্য ঝুঁকে পড়ল, মেলানি পায়ে পায়ে এগিয়েগেল। তারপর পরষ্পরকে চুম্বন করল। লাগাম ধরে হেঁচকাটান লাগাতেই বুড়ো খচ্চরটা এগিয়ে চলল।

মেলানি ওর যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রইল, ওর চোখথেকে অজস্রধারে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। 

“মেয়েটা কি পাগল হয়ে গেল, মেলানি? ও কখনোই লোকটারপ্রেমে পড়ে থাকতে পারে না!”

“প্রেমে পড়েছে? না, না স্কারলেট, এমন ভয়ঙ্কর কথা মুখেওএনো না! বেচারি ক্যাথলীন, বেচারা কেড!”

“দুত্তোরি!” চেঁচিয়ে উঠল স্কারলেট। মনে মনে ও রেগে যাচ্ছে। মেলানি যে ওর থেকে আগেই হালচালগুলো বুঝে ফেলে, এইব্যাপারটা খুবই জ্বালাতনের। ক্যাথলীনের এই বিপত্তিটা শুনেও খুবই হতবাক হয়ে গেছিল, এটা যে আসলে একটাবিপর্যয়, সেটাই ধরতে পারেনি। সাদা চামড়ার একজনইয়াঙ্কিকে বিয়ে করাটা মোটেই কিছু আহ্লাদের ব্যাপার নয়, কিন্তুএকটা মেয়ের একার পক্ষে প্ল্যান্টেশনে থাকাটা মুশকিলের, অন্তত একজন স্বামী পাশে থাকা দরকার সেটা চালাতে সাহায্যকরার জন্য। 

“এই কথাটাই সেদিন আমি বলতে চেয়েছিলাম, মেলি। মেয়েদের বিয়ে করার জন্য কেউ যদি নাও থাকে, তবুও কাউকেনা কাউকে বিয়ে করতেই হবে।”

“বিয়ে করতেই হবে এমন নয়। আইবুড়ো হয়ে থাকাটা মোটেইঅসম্মানের নয়। আন্ট পিটিকেই দেখ না। এর চেয়েক্যাথলীনের মরে যাওয়াই ভাল ছিল! কেডও হয়ত সেটাইচাইত। ক্যালভার্ট বংশের এখানেই ইতি। ওদের ছেলেমেয়েরাকেমন হবে ! না স্কারলেট, তুমি পোর্ককে এখুনি ঘোড়ায় লাগামজুততে বল, ওর পেছন পেছন গিয়ে বল, ও যেন আমাদের সঙ্গে এসে থাকে!”

“হে ভগবান!” স্কারলেট চেঁচিয়ে উঠল। যেরকম সহজভাবেমেলানি ওকে টারায় আশ্রয় দিতে চাইল, তাতে স্কারলেট খুবইবিস্মিত হল। আরু একটা মুখে খাবার জোগানোর ইচ্ছেস্কারলেটের মোটেই নেই। কথাটা মুখ থেকে বেরিয়েই গেছিল, কিন্তু মেলানির দুঃখপীড়িত মুখের দিকে তাকিয়েই নিজেকেসামলে নিল। 

“ও আসবে না, মেলি,” শুধরে নিয়ে বলল। “তুম জান, ও আসতে চাইবে না। ওর আত্মমর্যাদাবোধ থেকে ও মনে করবেসেটা হবে পরের দয়ার ওপর ভরসা করা।”

“ভুল বলনি কথাটা, খুব ঠিক কথা!” মেলানি অন্যমনস্কভাবেলাল ধুলো উড়িয়ে ক্যাথলীনের দূরে মিলিয়ে যাওয়া দেখতেদেখতে বলল।

“তুমিও তো অনেক কটা মাস ধরে আমার কাছে রয়েছ,” মমতাহীনভাবে নিজের ননদের পানে তাকিয়ে স্কারলেট চিন্তাকরল, “তোমার কি কখনও মনে হয় না যে তুমিও অন্যেরদয়াতেই আছ? মনে হয় সেই কথা কখনোই তোমার মনে আসবে না। তুমি হলে সেই সব মানুষদের একজন, যুদ্ধ যাদেরবদলাতে পারেনি, তোমরা এখনও মনে কর আমার কাছেকুবেরের সম্পত্তি আছে আর খাবারদাবার এত আছে যেভেবেই পাই না কী করবে, তাই কয়েকজন অতিথি থাকলেওআমার কিছু এসে যায় না। তুমি তো আমার ঘাড়ে সারাজীবনের জন্য চেপেই বসেছ। ক্যাথলীনকে আর চাপাতে পারবনা!”








একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ