নাইয়ার মাসুদকে নিয়ে একটি আলোচনা : ঘরকুনো লোক



বাংলা অনুবাদ : ঋতো আহমেদ


[এই গদ্যটি লিখেছেন দক্ষিণ এশিয়ার বিদ্বান ব্যাক্তিত্ব ডেইজি রকওয়েল, যিনি অ্যামেরিকা থেকে এক কাজেলক্ষ্ণৌ পরিদর্শনে গিয়ে সেখানকার লেখক নাঈর মাসুদের বই খোঁজ করছিলেন; সে’দিন তাঁকে সরাসরি লেখকের বাড়ির দিকেই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল...


এই ঘরের বাইরে বাস্তবিক আমি কিছুই লিখিনি আজ পর্যন্ত। বেশ মোটা আকারের একটা পিএইচডি থিসিস লিখেছিলাম এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য। তবে ওটা কিন্তু এখানে বসে লিখতে পারিনি। কারণ আমার পক্ষে তখন সব উপাত্ত সংগ্রহ করে এখানে বাড়ি ফিরে এসে থিসিসটি লেখা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। মনে করুন আমার মাথায় একটা গল্প আছে লেখার জন্য আর তখন আমি দু/চার দিনের জন্য শহরের বাইরে গিয়েছি : একটা লাইনও লিখতে পারিনি। একজন বলেছিলেন, যখন বাইরে কোথাও যাও তখন তুমি অভিজ্ঞতা আর আইডিয়া সঞ্চয় করো, কিন্তু যদি লক্ষ্ণৌ এর বাইরে যাই আমি, একদম কিছুই লিখতে পারব না। অথবা এইভাবে অন্তত লিখতে পারব না। একটা বাগধারা আছে, ঘর ঘুসনা [অর্থাৎ ঘরকুনো], যেমন বলা হয়ে থাকে, “এ হলো সত্যি এক ঘরকুনো ধরনের লোক,” মানে হচ্ছে, যে লোক কখনও ঘরের বাইরে বেরুতে চায় না। সারাক্ষণ কেবল ঘরের ভেতর আটকে থাকতে চায়। যেটা আমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কয়েকদিনের জন্যও যদি কোথাও যাই, বাড়িটাকে মিস করতে শুরু করি।
সাগরী সেনগুপ্তের নেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলছিলেন গল্পকার নাঈর মাসুদ,

প্রকাশিত হয়উর্দু স্টাডিজের এক বার্ষিকীতে।]


সাহিত্যের শহর

বিদ্যা সাধনার জগত্‌ ছেড়ে আসারঠিক আগেআগে আমাকে একবার একটা কাজে লক্ষ্ণৌ যেতে হয়েছিল। আমি তখন প্রধান একটি গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পদে নিযুক্ত ছিলাম, আর লক্ষ্ণৌ গিয়েছিলাম একটি উর্দু অনুষ্ঠান দেখতে। জানতাম শীঘ্রই ফিরব না, তাই প্রশাসনিক কাজ বাদ দিয়ে স্মরণীয় কিছু একটা করার কথা ভাবছিলাম। দায়িত্বটা অনুষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উর্দু ব্যঙ্গধর্মী রচনার বিদ্বান ব্যাক্তিত্ব আফতাব আহমেদের উপর ন্যাস্ত করে, কিছু উর্দু বই কিনতে বেরিয়ে পড়িলক্ষ্ণৌয়ের রাস্তায়। তবে যে কোনও বই নয়। চাইছিলাম বিশেষভাবে লক্ষ্ণৌয়ের লেখক নাঈর মাসুদের উর্দু গল্প সংকলন কিনতে। কারণ কিছুদিন আগেই তাঁর কিছু গল্পের ইংরেজি অনুবাদ ‘দি এসেন্স অব কমফো’ পড়ে তাঁর সম্পর্কে আগ্রহ জন্মায় আমার।

আমার কাছে, লক্ষ্ণৌ মূলত সাহিত্যের শহর। নোংরা আর আবর্জনায় ভরা, বিস্তীর্ণ,লোকারণ্যের উত্তর ভারতীয় এক শহর। অপরাধপ্রবণ আর দুর্নীতি-নিমজ্জিত। তবেলক্ষ্ণৌ আবার ‘উমরাও জান’ আর ‘পাকিজা’রও শহর। এখানে রয়েছে হিন্দি লেখক যশপালের বাড়ি। আর উর্দু পণ্ডিত সিএম নাঈমের শহর [অবশ্য তিনি এসেছেন বড়বাঙ্কি থেকে, মানান আহমেদ বলেছেন, সেটাও এই শহরের খুব কাছেই]। এখানে হযরত গঞ্জের ব্যাস্ত মোড়ে রাম আদ্ভানির বইয়ের দোকান রয়েছে। এই রাম আদ্ভানি এমনই এক মানুষ যাকে বলা যায় পার্থিব সমস্ত কিছুর আর বহু বহু গুণে সহায়ক এক লোক যার দোকানে মানুষ একবার হলেও তাঁর সাথে আড্ডা দিতে যায়। তিনি বহু বছর ধরে বই-প্রেমীদের জন্য, বিদ্বান ব্যাক্তি আর ছাত্রদের জন্য এক স্বর্গাশ্রয় গড়ে তুলেছেন।সেদিন রাম আদ্ভানির সাথে চায়ের আড্ডা শেষে বেরিয়েই ব্যাস্ত ট্র্যাফিকে যানবাহনের শব্দে মুহূর্তে হারিয়ে যাই আমি। স্মৃতিকাতরের মতো হিন্দি লেখক অশোকের এক গল্পের চরিত্রের কথা মনে পড়ে আমার। যিনি পশমী টুপির পরিবর্তে উজ্জ্বল রঙের পাগড়ী পরে স্কুটারে করে বসন্তের লক্ষ্ণৌ ঘুরে বেড়ান, আর শেষে ভয়ানক সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত হন।


দিল্লি থেকে লক্ষ্ণৌ যাওয়ার ট্রেনে, সবসময়ই আমার মনে হয় যদি তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ি, ঘুমের ঘোরে যদি মাথা নুয়ে আসে, তখন কোনও অপরিচিত রহস্যময় ব্যাক্তি এসে আমার পায়ের আঙুলে সুগন্ধময় ফুলেল উর্দু নোট লিখে রেখে যাবেন। শতাব্দী এক্সপ্রেসের নির্দিষ্ট চেয়ার কারের বিপরীতে সমস্ত সংকেত থাকা সত্ত্বেও, এমনটাই মনে হয় এর নীল ভিনাইল আসন আর ধোঁয়াটে জানালায়।


বই কেনাকাটা

আমি যে অনুরোধ করেছিলাম, আফতাব সে ব্যাপারে বেশ উদ্যমী ছিলেন। তাই ক্লাশ শেষে আমরা আমিনাবাদের আশপাশে বেড়াতে গেলাম। কিন্তু উর্দু বইয়ের দোকানে প্রচুর বই নাড়াচাড়া করে কাটানোর একটি রোম্যান্টিক দিনের ভাবনাটা এক ঘণ্টার ভেতরই উবে গিয়েছিল অবশ্য। আফতাব আমাকে দ্যানিশ মহল নামের একটি বইবিতানে নিয়ে গেছিলেন। বহু পাঠকই যে দোকানের ছবি তুলে পাঠিয়েছিলেন একসময়। বাঁ দিকে রয়েছে ইন্দস্ক্রাইবের তোলা সেইরকমই একটা ছবি। দোকানটি ছোট আকারের, যার তিনটি দেয়াল বই-সাজানো আর তা একেবারে ছাদ পর্যন্ত উঁচু করে বোঝাই। আর চতুর্থ পাশটি রাস্তার দিকে মুখ করে খোলা। একজন খুব, খুব বৃদ্ধ লোকের নিশ্চয়তার অপেক্ষায় ছিলাম আমরা। তার কাছে নাঈর মাসুদের কোনও বই আছে কিনা বোঝা যাচ্ছিল না। বিরক্তিকর লাগছিল, কারণ তিনি খুব বেশি নড়াচড়া না করেই বইয়ের তাকগুলোয় অত্যন্তদুর্বলভাবে খুঁজছিলেন। তার কাছ থেকে জানতে খুব বেগ পেতে হচ্ছিল আফতাবকে সত্যি নায়েরের কোনও বই আছে কিনা। শেষ পর্যন্ত তিনি বললেন, হয়তো নেইতার কাছে। জানতে চাইলাম আর কোথায় খুঁজে দেখতে পারি আমরা। সামান্য কুঁজো হলেন আর কিছুটা ভেবে শেষে বললেন নাঈর মাসুদের বই পাওয়া যাবে নাঈর মাসুদের বাড়িতে স্বয়ং নাঈর মাসুদের কাছে। এ কথা শুনে আমরা দুজনেই অবাক হয়ে গেলাম। জানতে চাইলাম তার বাড়িটা কোথায়। অস্পষ্ট একটা দিকনির্দেশনা দিলেন আমাদের। কষ্ট হলেও আফতাব অবশ্য ঠিকানাটা লিখতে পেরেছিলেন কাগজে। একটা পুরনো টুকরো কাগজে বাড়িটির অস্পষ্টভাবে নির্দেশিত ঠিকানাটা লিখলেন কোনোভাবে।

এরপর আমরা খুরশিদ বুক ডিপোতে গিয়ে আরেকবার ব্যাপক কিন্তু নিষ্ফল খোঁজাখুঁজি করি। টেক্সট বই আর ষ্টেশনারির জন্য সুপরিচিত। ছাত্র আর দোকানের কর্মচারী এই দুই ধরনের মানুষে পরিপূর্ণ ছিল ওটা। আফতাবের প্রশ্নের উত্তরে ওরা বেশ ভদ্রভাবেই জানাল ওই ধরনের কোনও বই তাদের কাছে নেই। মুশকিলে পড়ে গেলাম। আমাদের কি সেই আত্মবিশ্বাস আছে যে একজন বিখ্যাত লেখকের বাড়ি গিয়ে তাঁর কাছেই তাঁর বই কিনতে চাইতে পারি?হ্যাঁ, সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা তা-ই করবো। পরে, ওই দিনটিকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম আর আমার অনুমানের ভিত্তিটিতে সম্মতও হয়েছিলাম যে ওই পদক্ষেপের পরামর্শ দেয়া হয়েছিল কারণ লক্ষ্ণৌতে ঘটনাটি এমনই ঘটেছিল। অন্যদিকে আফতাবের ধারণা ছিল এসব ক্ষেত্রে অ্যামেরিকানরা এমনই করে থাকেন। অর্থাৎ যে পণ্য আমরা খুঁজছি তা পেতে সাহিত্য তারকাদের দ্বারে করাঘাত পর্যন্ত করতে প্রস্তুত থাকা।

কিছুদিন আগেই আমি আফতাবকে জিজ্ঞেস করছিলাম তাঁর এমন বিশেষ কিছু মনে পড়ছে কিনা সেদিনের, যা আমাকে তিনি স্মরণ করিয়ে দিতে চান। তিনি উত্তর দিলেন রাশোমানের মতো, এবং সেই উত্তর ছিল সামাজিক বিবরণের এক জটিল পর্যবেক্ষণ, যা অনায়াসে ৫০০ পৃষ্ঠার একটি উপন্যাস হয়ে যেতে পারে, হয়তো একদিন তিনি লিখে ফেলবেনও ভেবেছিলাম:

আপনার মনে আছে কিনা জানিনা, আমিনাবাদে আমাদের দুটি মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। দ্যানিশ মহলের দিকে যখন যাচ্ছিলাম, এক মেয়ে এসে আমাদের সালাম জানালো। তাকে আপনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম আমার কাজিন। কিন্তু সে আমাকে ‘চাচা’ বলে সম্বোধন করে। ভেবে দেখেছেন কি, কেন সবাই একে অপরকে চাচা বলে সম্বোধন করছিল?আমি তখন কিছুটা বিব্রত হয়েছিলাম কারণ তাকে কাজিন বলে পরিচয় দিয়েছিলাম আপনার কাছে। ভারতে মানুষে মানুষে সম্পর্কের জটিলতা বিষয়ে আপনি হয়তো জেনে থাকবেন। পরে বুঝতে পেরেছিলাম কেন তাকে কাজিন বলে পরিচয় করিয়েছিলাম(যদিও সে আমার দূরের আত্মীয় ছিল না), কারণ আমরা একই বিল্ডিঙে থাকতাম আর তার বড় বোন আমাকে ‘ভাই’ (আমি তাকে ‘ভাবি’ বলতাম) আর তার দুলাভাইকে আমি বলতাম ‘ভাই’। তাই মেয়েটি স্বাভাবিকভাবেই আমার কাজিন হোতো সম্পর্কে। কিন্তু সে আমাকে ‘চাচা’ বলেছিল(যা সেদিনের আগে ওভাবে খেয়াল করিনি) কারণ সে আমাদের বাড়িওয়ালীর মেয়ের বন্ধু ছিল। বাড়িওয়ালীর মেয়ে আমাকে চাচা সম্বোধন করতো আর আমি বাড়িওয়ালীকে ভাবি, আর অবশ্যই তার স্বামীকে ভাই। জানিনা সেদিন এটা আপনি খেয়াল করেছিলেন কিনা।


ঘরকুনো লোক

আজ আমি বুঝতে পারছি, ওই ইংরেজি সংকলন ‘দি এসেন্স অব কমফো’ পড়েই আমরা তাঁর বাড়ির দুয়ার পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলাম। ওই বইয়ের শুরুর দিকেই নাঈর মাসুদের বাড়ির একটা ছবি রয়েছে। তাঁর বাবা এর নাম দিয়েছিলেন ‘আদাবিস্তান’ বা ‘সাহিত্য মহল’। হাভেলির ওই ছবিটিতে রয়েছে দারুণ একটা বিয়ের কেক, অলঙ্কৃত সমস্ত কিছুই, বারান্দা, খিলানপথ সবই সুন্দর সব গাছ দিয়ে ঘেরা। যেন আশ্চর্য ওই বাড়িটাই আমাদের গাড়িটাকে গলিপথে টেনে ভেতরে নিয়ে গেল। আশপাশ উপমহাদেশীয় প্রাচীন শৈলীতে গড়া। একেকটা ঘর কোথায় যে শুরু হয়ে কোথায় শেষ হয়েছিল বলা মুশকিল।

এই পোস্টটির শুরুতেই যেমন বলা হয়েছে, নায়ের মাসুদ তাঁর পুরো জীবনে আদাবিস্তানের বাইরে যাননি কখনও। একই সাক্ষাৎকারের আগের অংশ থেকে উল্লেখ করলে :

সেনগুপ্ত : 
আপনি কখনও লক্ষ্ণৌ ছেড়ে বাইরে যাননি?

মাসুদ : 
সত্যি বলতে-কি, সেইভাবে আসলে যাইনি কখনও। কেবল তিন/চার বছরের জন্য এলাহাবাদ গিয়েছিলাম উর্দুতে পিএইচডি করতে। তখন প্রত্যেক মাসেই লক্ষ্ণৌ ফিরে আসতাম। আমার বোন এলাহাবাদ থাকতেন। আমিও তাঁর সাথেই থাকতাম। তাই ওটাকে লক্ষ্ণৌএর বাইরে থাকা বলা যায় না। এছাড়া, আমি একবার ষোল/সতের দিনের জন্য ইরান গিয়েছিলাম। আরও কিছু শহরে বেড়াতে গিয়েছি আমি, তবে চার/পাঁচ দিনের বেশি থাকিনি। আমার সমগ্র জীবন লক্ষ্ণৌএ কেটেছে, এই একই বাড়িতে।

প্রামাণিকতার ইতিহাসে, সম্প্রতি আমি একটা বিতর্ককে রেড হেরিং(ভাঁওতাবাজি) হিসেবে বাতিল করেছি। কারণ নাঈর মাসুদই হবেন প্রামাণিকভাবে প্রামাণিক লেখক। যদি কেউ সন্দেহাতীতভাবে খাঁটি একজন ভারতীয় লেখকের খোঁজ করেন, তাঁর থেকে ভালো আর কে হতে পারে যে ঘরে তিনি জন্মেছেন তার বাইরে গিয়ে একটি শব্দও লেখেননি? যদিও ব্যাপারটা আকর্ষণীয় আর আপন কাল্পিত ব্যবস্থার যোগ্য, তবু আমি নিশ্চিত মাসুদ নিজেই এমন ধারণার অযৌক্তিকতায় হাসবেন, যে সবসময় একই বাড়িতে থাকাটা তাঁর লেখায় ভারতীয়ত্বের এক বড় মাত্রা যোগ করেছে।


মাসুদের নির্যাস

ইংরেজি সংকলন ‘দি এসেন্স অব কমফো’ বইটির লেখাগুলো নির্বাচন আর সম্পাদনা করেছিলেন মুহাম্মদ উমর মেমন। বইটির ভূমিকায় তিনি বলেছেন, মাসুদের রচনা পড়তে হবে মাসুদের রচনার মতোই, অন্য কিছুর মতো নয়। মাসুদের ওই ভূমিকাটিকে বলা যায় এক নিপুণ ঘনিষ্ঠ পাঠ যা বর্তমান গতানুগতিক সাহিত্য সমালোচনার মতো নয় একেবারেই। মাত্র আট পৃষ্ঠায় মাসুদের ওই রচনাগুলোর ব্যাখ্যা সত্যি অত্যন্ত সমৃদ্ধ পটভূমি ও ভিত্তি প্রদান করতে সক্ষম একজন পাঠককে। মেমনের ভাষায় :

সম্পূর্ণরূপে অ-ব্যুৎপন্ন আর উর্দু কথাসাহিত্যের ইতিহাসে পূর্ববর্তী যেকোনো রচনার বিপরীতে, এই গল্পগুলো নিজেরাই স্বতন্ত্র শ্রেণিতে দাঁড়িয়ে যায়। রচনাগুলো একদিকে যেমন প্রথম দিকের উর্দু রোম্যান্টিক আর শিক্ষামূলক রচনা থেকে ভিন্ন, অন্যদিকে আবার সমাজ-বাস্তবতার লেখক মুন্সি প্রেমচাঁদ [১৮৮০-১৯৩৬] আর প্রগতিশীল লেখক সাজ্জাদ জহির [মৃত্যু ১৯৭৩], কৃষাণ চন্দর [মৃত্যু ১৯৭৭] আর ইসমত চুঘতাই [মৃত্যু ১৯৯১] থেকেও আলাদা।আশ্চর্যজনকভাবে এগুলো আধুনিকতাবাদী বিমূর্ততা কিংবা প্রতীকবাদী রচনার মতোও না, যা ১৯৬০এর সময় থেকে উর্দু কথাসাহিত্যের জগতে নিরলস শক্তিমত্তায় বিরাজমান।

এইভাবেই মেমন বর্ণনা করে গেছেন মাসুদের গল্পগুলোয় কীভাবে উর্দু অন্য লেখকদের থেকেও আলাদা হয়ে ভিন্ন মাত্রায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে :

গল্পের ঝকমকে অধরা গুণ বহু কারণেই উদ্ভূত হতে পারে। যার মধ্যে নূন্যতম নয়, লেখকের তুচ্ছ এবং ছাঁটা গদ্য, যা ফাঁপা অলঙ্করণও এড়িয়ে যায়, যেটি যোগ্যতার চাপে এতোটাই তীব্র যে মনকে অস্থির করে তোলে। সামান্য কিছু বাকধারা অথবা কিছুই নেই, নেই কোনোরকম মৌখিক অত্যাচারও। ভাষা উর্দু, তবে গতানুগতিক উর্দু নয় …অর্থনীতি, এমনকি মাঝেমধ্যে অতিরঞ্জন বা অলঙ্করণের পরিহার তাঁর গদ্যকে অবাস্তব না হলেও অপরিচিতির উপাদান এনে দেয়।

সংকলনের গল্পগুলোর কিছু মেমন নিজেও ইংরেজি অনুবাদ করেছেন। আর করেছেন শান্তনু ফুকাল, আদিত্য বেহাল, ময়াজ্জেম শেখ, এলিজাবেথ বেল এবং সাগরী সেনগুপ্ত। হয়তো এইজন্যই গল্পগুলোর অনুবাদ শৈলী একই ধাঁচের। বেশ মসৃণ। যেন মনে হয় নাঈর মাসুদ নিজেই প্রত্যেক গল্পের অনুবাদকের সাথে প্রতিটি গল্পেই কাজ করেছেন। অনুবাদে মেমন যেমন পরামর্শ দেন, মাসুদ তাঁর লেখায় বেশ চাহিদা সম্পন্ন ছিলেন। মেমন বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর গল্পে “আরও ভালো বিবেচনা আর ধৈর্যকে সর্বোচ্চ সীমায় কর হিসেবে আরোপ করা হয়েছিল।”

গল্পগুলো অধরা প্রকৃতির এবং উপলব্ধি করা কঠিন, যেমন তারা আছে, অন্য কিছুর মতো নয়, আবার নির্দিষ্ট স্থান, সময়, তারিখ, রাজনীতি বা ইতিহাসের কোনও কিছুরই উল্লেখ নেই বলেও। বর্ণনাগুলো বিস্তৃত হতে পারে, তবে সেগুলোর নির্দিষ্ট অবস্থান বা ঐতিহাসিক যুগের পরিপ্রেক্ষিতে কোনও প্রকার ধারণ ছাড়াই পাঠকের দিকে ছুঁড়ে দেন। উদাহরণস্বরূপ, শিরোনাম গল্প ‘দি এসেন্স অব কমফো’র একটা অনুচ্ছেদ নেয়া যায়। যেখানে বর্ণনাকারী কর্পূরের সারাংশ বর্ণনা করছেন যা তিনি নিজেই তৈরি করেছেন :

আমার নির্যাসে অবশ্য কর্পূর বা অন্য কোনও সুগন্ধ নেই। বর্গাকার তলা বিশিষ্ট চীনা সাদা বয়ামের মধ্যে বর্ণহীন একপ্রকার দ্রবণ এটা। গোল ঢাকনাটি সরালেও বয়ামের সরু মুখ দিয়ে কোনও সুগন্ধ ছড়ায় না। এর গন্ধ নেয়ার চেষ্টা করে কেউ কেউ একপ্রকার ফাঁকা অসহায়ত্ব অনুভব করে, আবার দ্বিতীয়বার, আরও গভীরভাবে শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করলে কেউ কেউ এই অসহায়ত্বের ভেতর কিছু হয়তো শনাক্তও করে। অন্তত এইরকমই মনে হয় আমার। অবশ্য অন্যেরা কেমন অনুভব করে তা বলতে পারব না। কারণ আমি ছাড়া আর কেউ এর বিশুদ্ধতম আকার থেকে নির্যাস শোঁকার সৌভাগ্য লাভ করেনি। সত্যি বলতে যখন আমি এই ভিত্তি দিয়ে নির্যাসটুকু তৈরি করি, যারা শ্বাস নেয়, মনে করে প্রত্যাশিত সুগন্ধির নিচে অন্য কিছু রয়েছে। স্পষ্টতই, তারা চিনতে পারে না, কারণ আমার কর্পূরের নির্যাসে কোনও সুগন্ধ নেই।

এইখানে বর্ণনাতীত এমন একটা কিছুর জটিল ব্যবচ্ছেদ রয়েছে যা শেষ দিকে এসে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কর্পূরের এই নির্যাসে কর্পূরের কোনও গন্ধই পাওয়া যায় না। এর কোনও রঙ নেই। অবস্থান করে সমতল সাদা বয়ামে। কোনও ধোঁয়া নির্গত করে না। এর প্রভাব বলতে কেবল কাউকে ‘ফাঁকা অসহায়ত্ব’ দিয়ে পূর্ণ করা। এমনকি, কথক ছাড়া আর কেউ এর গন্ধও পায়নি। এইভাবে কাউকে এক ঘনিষ্ঠ আর জটিলভাবে বর্ণিত জগতে টেনে নেয়া হয় যা একই সঙ্গে কোনও পরিচিত বা জ্ঞাত চিহ্ন বহন করে না। যা বাষ্পহীন বাষ্পের মতোই অবর্ণনীয়।

এই অনির্বচনীয়, বিশদ বিশ্ব মাসুদের কাজকে একই সঙ্গে বোঝার জন্য কঠিন এবং এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় অনুবাদের জন্য অত্যন্ত উপযোগী করে তোলে। কেবলমাত্র কোনও সাংস্কৃতিক উপাদান, নির্দিষ্ট রীতিনীতি কিংবা কোনও পারিবারিক সম্পর্কের উল্লেখের সঙ্গে (কথকের নারী সম্পর্কগুলোকে ‘নারী আত্মীয়’ হিসেবে একই গল্পে উল্লেখ করা হয়েছে)। এর সাথে সেদিনের আমিনাবাদ মার্কেট নিয়ে আফতাবের ওইস্মৃতিচারণকে তুলনা করা যায়। যেখানে সামাজিক এবং পারিবারিক সম্পর্ক সংজ্ঞায়িত করার অত্যন্ত বিস্তৃত অভ্যাসের পরিপ্রেক্ষিতে দুই মহিলার সঙ্গে সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎ বিশ্লেষণ করা হয়। সামাজিক পরিবেশে আফতাবের সেই মুহূর্তটি জীবনের দৈনন্দিন আদর্শকেই তুলে ধরে। তবে গল্পের নারী চরিত্রগুলোকে ‘নারীআত্মীয়’ হিসেবে উল্লেখ করাটাও উদ্ভট আর বিভ্রান্তিকর লাগে। অবশ্য, অনুবাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অসাধারণ কাজ করে। এমন পরিপ্রেক্ষিতে আত্মীয়তার মতো বিষয়গুলো পাঠককে বোঝানো অনুবাদকের জন্য মারমুখো বিভ্রান্তিকর নয়। মাসুদের রচনায় এই ধরনের চ্যালেঞ্জ সম্পূর্ণ অনুপস্থিত বলে মনে হয়।


আদাবিস্তান

দ্যানিশ মহলের বই বিক্রেতার স্পষ্ট আর হাস্যকর পরামর্শে যখন আমরা নাঈর মাসুদের বাড়ির দিকে রওনা হলাম, তখন যে আমরা লেখকের মুখোমুখি হয়ে যেতে পারি এটা আমাদের মাথায় আসেনি। যদিও আফতাব আর আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে এক অপ্রত্যাশিত অভিযানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, তবু আমাদের দুজনেরই অনুমান ছিল এইরকম রহস্যময় রচনাগুলোর সেই বিখ্যাত লেখকের নিশ্চয়ই কোনও গেট কিপার আর একজন মহিলা সহকারী থাকবেন যিনি হয়তো আমাদের আগলে নেবেন, যেন বোকার মতো তাঁর বাড়িতে গিয়ে সরাসরিতাঁর সামনে হাজির না হই।

এমনটা ছিল না মোটেও। একটা প্রাচীরের দরজায় আমাদের ড্রাইভারকে থামতে হলো। সেখান থেকে একটা ছোট আঙ্গিনা ধরে হেঁটে এগিয়ে গেলাম। সামনেই দেখতে পেলাম নাঈর মাসুদ রোদে একটা বেঞ্চ পেতে শুয়ে আছেন। কথা বলছেন কার সঙ্গে যেন। পরে জেনেছি লোকটা লক্ষ্ণৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দুর অধ্যাপক ছিলেন।

সেখানে, হঠাৎ আমি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম। কথাবার্তা চালানোর উপযোগী উর্দু আমি জানতাম না। সাহিত্যালাপের জন্য যথেষ্ট আর পরিমার্জিত উর্দু শব্দের ভাণ্ডার আমার ছিল না। মনে হচ্ছিল কথা বলতে গিয়ে ওর বদলে শুদ্ধ হিন্দি শব্দই বেরিয়ে আসবে আমার মুখ থেকে। আমি তখন সাহিত্যের উর্দু শব্দটাও ঠিক করে মনে করতে পারছিলাম না। আমার ভাবনা তখন ভাষাগত তালিকার ভেতর দিয়ে দৌড়াচ্ছিল। মাথার ভেতর হিন্দির জায়গায় ক্রমাগত উর্দু শব্দের খোঁজ করে যাচ্ছিলাম। উর্দু ব্যাকরণের সাথে যুক্ত ইংরেজি বিশেষ্য ব্যবহার করে আমাকে নাঈর মাসুদের সাথে কথা বলতে হবে ভেবে মর্মাহত হচ্ছিলাম। পূর্ব অভিজ্ঞতা বলছিল, হিন্দি এখানে হাস্যকর শোনাবে। এরপর আমি আশ্বস্ত হলাম। কারণ আমি সেখানে উর্দু অনুষ্ঠানের প্রধান আফতাবের সাথে ছিলাম। উর্দুতে তাঁর পিএইচডি করা আছে!

কিন্তু আমি আফতাবের দিকে অপেক্ষমাণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেই, সে একেবারে চুপ হয়ে গেল। কোনোভাবে ওখানে যাওয়ার আমাদের উদ্দেশ্য তাঁকে বুঝিয়ে দেয়া হলো। কিন্তু আফতাব ছিলেন প্রায় নিশ্চুপ। ভয়ে ভয়ে আমি ইংরেজি মেশানো উর্দুতে কথা বলতে শুরু করেছিলাম। মাসুদ খুব দয়ালু ছিলেন। তিনি আমাদের অবশ্য মুখ ফুটে বলেননি যে তাঁর বই খুঁজতে বাড়িতে চলে আসার আইডিয়াটা উদ্ভট আর হাস্যকর। তবে, ব্যাখ্যা করে বোঝালেন, তাঁর কাছে বইগুলোর অতিরিক্ত কোনও কপি নেই। আর,কিছুটা লজ্জা পেয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে অন্য কথায় চলে যান। খুব বেশি কপি ছিল না ওখানে। সম্ভবত পাকিস্তানে ছিল।

তবে যেহেতু বই খুঁজতে আমি এতদূর চলে এসেছি, তিনি আমাকে অন্য একটা বই দেবেন বললেন। কিছুটা অসুস্থ ছিলেন, কষ্ট করে নিজেকে তুললেন বেঞ্চ থেকে, তারপর বারান্দার কাছে একটা ধাতব আলমারির কাছে গেলেন। কিছুক্ষণ খুঁজলেন ওর ভেতর, এরপর পাতলা একটা সংকলন বের করে আনলেন। গালিবের উপর লেখা তাঁর এক সমালোচনামূলক বই। আমার নাম জিজ্ঞেস করে বইয়ে উৎসর্গ-লিপি লিখে দিলেন। হ্যাঁ, অন্য কারও কাছে দেখতে ওটা উৎসর্গ-লিপিই মনে হবে। আমরা কিছুক্ষণ এটা-ওটা নিয়ে কথা বলি। আর ওদিকে আফতাব তাঁর নিরবতা বজায় রাখছিলেন। আমরা হয়তো চা খেয়েছি তখন।

অবশেষে, যখন মনে হচ্ছিল আমরা হয়তো তাঁর অনেক সময় নষ্ট করে ফেলেছি, বিশেষত যখন তিনি খুব একটা সুস্থ বোধ করছিলেন না, আমরা বিদায় জানিয়ে চালে এলাম। গাড়িতে উঠে আফতাবকে জিজ্ঞেস করলাম, সারাক্ষণ এতো চুপচাপ কেন ছিলেন? এমনকি নিজেকে রক্ষা করার জন্য কিছুটা বিরক্তিও প্রকাশ করেছিলাম তাঁর উপর।

আফবাত বললেন, “হ্যাঁ, আমি কিছু বলতে পারিনি। কারণ আমি লক্ষ্ণৌএর নই।”

“কী বলছেন এসব, আপনি লক্ষ্ণৌএর নন মানে? আপনি তো এখানেই থাকেন?”

“কিন্তু আমি গ্রাম থেকে এসেছি। নাঈর মাসুদের মতো একজন সত্যিকার লক্ষ্ণৌবাসীর সামনে উর্দুতে কথা বলতে খুব বিব্রত বোধ করি। মুহূর্তেই ওনারা ধরে ফেলবেন সত্যিকার লক্ষ্ণৌই উর্দু আমি বলতে পারিনা।”

***

লেখক পরিচিতি
ডেইজি রকওয়েল :দক্ষিণ এশিয়ার সাহিত্যে ডেইজি রকওয়েল একজন লেখক, চিত্রকর ও বিদ্বান ব্যাক্তিত্ব। তিনি গল্পকার উপেন্দ্রনাথ আশোকের উপর বাইওগ্রাফি লিখেছেন [কথা, ২০০৪]। তাঁর অশোকের ছোট গল্পের ইংরেজি অনুবাদ সংকলন প্রকাশিত হয়েছে পেঙ্গুইন ইন্ডিয়াথেকে [২০১৩]। সম্প্রতি তিনি হিন্দি লেখক গীতাঞ্জলি শ্রী’র উপন্যাস ‘রেত সমাধি’র ইংরেজি অনুবাদ ‘টম্ব অবস্যান্ড’ এর জন্য ম্যান বুকার পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

এই গদ্যটি তাঁর ‘লাপাতা’ ছদ্মনামে ‘চাপাতি রহস্য’ নামক ব্লগে প্রথম প্রকাশিত হয়। তাঁর পেইন্টিংগুলো পাওয়া যায়Flickr এ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ