এক.
এই পার্কটা নদীর ধারে । আজ সন্ধ্যেয় আকাশে মেঘ, পার্কে লোকজন নেই বিশেষ । নদী পর্যন্ত নেমে এসেছে পাথরের সিঁড়ি, সেখানে চুপ করে বসে আছে শুভ । তার চোখ নদীর দিকে নেই, পাশেই ঝোপে জোনাকি জ্বলছে নিভছে, সেইদিকেও নেই। সে তার অন্তরের অতল গুহায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, দেখছে সোনার সিঁড়ির মত ধানের ক্ষেত, টিলার গায়ে ধাপে ধাপে চাষ হয়েছে । গুচ্ছ গুচ্ছ পাকা ধানের উপরে ঝিং ঝিং করে বাজনা বাজিয়ে বয়ে যাচ্ছে পাহাড়ী হাওয়া। কবে সে দেখেছিল অমন? তার প্রথম যৌবনের দিনে, যখন সে বেড়াতে গিয়েছিল উত্তরে পাহাড়ী রাজ্যে । সেইখানেই সে পেয়েছিল তার শঙ্খিনীমালাকে ।
সেই সোনার সিঁড়ির পাশ দিয়ে কতবার সে উঠেছে তার সঙ্গে, কতবার নেমেছে । কোথায় গেল সেইসব দিন? সে পড়ে আছে এই নির্বান্ধব পৃথিবীতে, কোণঠাসা । আর সেই নদীর মতন স্নিগ্ধ নারী কোথায় কতদূরে অন্য কোনো ঘরে লক্ষ্মীর পা, ধানের ছড়া আর ভরাঘটের আল্পনা আঁকছে বুঝি ।
এমনই কি হবার কথা ছিল? তাহলে সন্ধ্যাতারা ফুটতে দেখে তারা কেন সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিল কোনোদিন পরস্পরকে ছেড়ে যাবে না? কেন বলেছিল সেই মেয়ে, "তুমি যেখানেই থাকো, আমারই থাকবে শুভ ।" সেও সেদিন বলেছিল, "তুই যেখানেই থাকিস, আমারই থাকবি শঙ্খী, সখী, চিরদিনের সবচেয়ে প্রিয় । "
নদীর দিক থেকে কর্কশ স্টীমারের ভোঁ শুনে আচ্ছন্নতা ভেঙে গেল শুভর । সময় প্রায় মাঝরাতের কাছাকাছি, ঘরে ফিরতে হবে । কেমন সেই ঘর? সেই সংসার? সেখানে উদ্যত হয়ে আছে সহস্র ক্ষমাহীন তিরস্কার, অভিযোগ, ব্যঙ্গ বিদ্রূপ । তবু ফিরতে কি হবেই?
প্রতিদিন কাজের সন্ধানে ঘোরা, এখানে ওখানে । কোথাও ভরসার কথা শোনা যায়, কোথাও শুধু উপদেশ, কোথাও তিরস্কার । কিন্তু কোথাও কিছু ভালো কাজের ব্যবস্থা হয় না । মঙ্গল আর বৃহস্পতি, সপ্তাহে এই দু'দিন বিকেলে দু'ঘন্টা করে ছাত্র-পড়ানো, এই সামান্য একটা কাজ অবশ্য তার আছে । কিন্তু তার যা আয়, তাতে সংসার চালানো অসম্ভব । গ্রামের বাড়ি থেকে মাঝে মাঝে কিছু টাকা আসে, জমির ফসল বিক্রি বাবদ। আর ব্যাঙ্কে কিছু সঞ্চয় আছে, তার সুদ হিসেবে কিছু আয় হয় । এইসব কুড়িয়ে বাড়িয়ে কোনোক্রমে সংসার চালানো । কিন্তু এইভাবে আর ক'দিন?
স্ত্রী অনুভা দিনরাত খোঁটা দিচ্ছে । হয়তো অকারণে নয় । ছেলেমেয়ে বড় হচ্ছে, দিন দিন খরচ বাড়বে । মেয়ে এখন বছর সাতেকের, ছেলের বয়স তিন । এদের ভালোভাবে মানুষ করতে বহু অর্থের প্রয়োজন ।
কিন্তু কী করবে শুভ? অনুভার কি একটু বোঝা উচিত নয়? সে তো সাধ্যমত চেষ্টা করছে! অথচ এই ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত অবস্থায় মাঝরাতে ঘরে ফিরে জুটবে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা । তারপরে ওই ঢাকা দেওয়া ঠান্ডা ভাত আর তরকারি তার গলা দিয়ে নামতে চায় না ।
ফিরতে তো হবেই । অনিচ্ছুক পা টেনে টেনে শুভ রওনা হল বাড়ির দিকে । পার্কটা বেশ বড়, নদী থেকে পার্কের গেট অবধি বেশ অনেকটা পথ । খুব আস্তে আস্তে হাঁটছিল শুভ । একটুও বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছিল না তার । মনে পড়ছিল প্রথম যৌবনে সে কবিতা লিখত, বেশ কিছু কবিতা প্রকাশিতও হয়েছিল নানা পত্রপত্রিকায় । প্রচলিত ধরণের নয়, একদম অন্যধরণের কবিতা ছিল সেসব । প্রশংসা পেয়েছিল সামান্য, কঠোর সমালোচনা আর ব্যঙ্গ-বিদ্রূপই পেয়েছিল বেশি । তারপর কতকাল আর কবিতা দেওয়া হয় নি কোথাও । লেখে সে এখনও, নিজের খাতায়। রয়ে যায় সব তার কাঠের বাক্সে । হয়তো সবই ওভাবেই থেকে যাবে, একদিন জীর্ণ হয়ে ঝুরঝুরে হয়ে ঝরে যাবে ।
কোথায় গেল সেইসব স্বপ্নের মত দিনগুলো যখন সে নিজের কবিতা সাগ্রহে পাঠাতে পারতো পত্রপত্রিকায়? খুব বেশিদিন আগের কথা তো নয়! এখনও তো যৌবন চলে যায় নি তার, এরই মধ্যে এত ধূসর, বিবর্ণ হয়ে গেল তার জীবন?
সেই সোনার সিঁড়ির পাশ দিয়ে কতবার সে উঠেছে তার সঙ্গে, কতবার নেমেছে । কোথায় গেল সেইসব দিন? সে পড়ে আছে এই নির্বান্ধব পৃথিবীতে, কোণঠাসা । আর সেই নদীর মতন স্নিগ্ধ নারী কোথায় কতদূরে অন্য কোনো ঘরে লক্ষ্মীর পা, ধানের ছড়া আর ভরাঘটের আল্পনা আঁকছে বুঝি ।
এমনই কি হবার কথা ছিল? তাহলে সন্ধ্যাতারা ফুটতে দেখে তারা কেন সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিল কোনোদিন পরস্পরকে ছেড়ে যাবে না? কেন বলেছিল সেই মেয়ে, "তুমি যেখানেই থাকো, আমারই থাকবে শুভ ।" সেও সেদিন বলেছিল, "তুই যেখানেই থাকিস, আমারই থাকবি শঙ্খী, সখী, চিরদিনের সবচেয়ে প্রিয় । "
নদীর দিক থেকে কর্কশ স্টীমারের ভোঁ শুনে আচ্ছন্নতা ভেঙে গেল শুভর । সময় প্রায় মাঝরাতের কাছাকাছি, ঘরে ফিরতে হবে । কেমন সেই ঘর? সেই সংসার? সেখানে উদ্যত হয়ে আছে সহস্র ক্ষমাহীন তিরস্কার, অভিযোগ, ব্যঙ্গ বিদ্রূপ । তবু ফিরতে কি হবেই?
প্রতিদিন কাজের সন্ধানে ঘোরা, এখানে ওখানে । কোথাও ভরসার কথা শোনা যায়, কোথাও শুধু উপদেশ, কোথাও তিরস্কার । কিন্তু কোথাও কিছু ভালো কাজের ব্যবস্থা হয় না । মঙ্গল আর বৃহস্পতি, সপ্তাহে এই দু'দিন বিকেলে দু'ঘন্টা করে ছাত্র-পড়ানো, এই সামান্য একটা কাজ অবশ্য তার আছে । কিন্তু তার যা আয়, তাতে সংসার চালানো অসম্ভব । গ্রামের বাড়ি থেকে মাঝে মাঝে কিছু টাকা আসে, জমির ফসল বিক্রি বাবদ। আর ব্যাঙ্কে কিছু সঞ্চয় আছে, তার সুদ হিসেবে কিছু আয় হয় । এইসব কুড়িয়ে বাড়িয়ে কোনোক্রমে সংসার চালানো । কিন্তু এইভাবে আর ক'দিন?
স্ত্রী অনুভা দিনরাত খোঁটা দিচ্ছে । হয়তো অকারণে নয় । ছেলেমেয়ে বড় হচ্ছে, দিন দিন খরচ বাড়বে । মেয়ে এখন বছর সাতেকের, ছেলের বয়স তিন । এদের ভালোভাবে মানুষ করতে বহু অর্থের প্রয়োজন ।
কিন্তু কী করবে শুভ? অনুভার কি একটু বোঝা উচিত নয়? সে তো সাধ্যমত চেষ্টা করছে! অথচ এই ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত অবস্থায় মাঝরাতে ঘরে ফিরে জুটবে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা । তারপরে ওই ঢাকা দেওয়া ঠান্ডা ভাত আর তরকারি তার গলা দিয়ে নামতে চায় না ।
ফিরতে তো হবেই । অনিচ্ছুক পা টেনে টেনে শুভ রওনা হল বাড়ির দিকে । পার্কটা বেশ বড়, নদী থেকে পার্কের গেট অবধি বেশ অনেকটা পথ । খুব আস্তে আস্তে হাঁটছিল শুভ । একটুও বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছিল না তার । মনে পড়ছিল প্রথম যৌবনে সে কবিতা লিখত, বেশ কিছু কবিতা প্রকাশিতও হয়েছিল নানা পত্রপত্রিকায় । প্রচলিত ধরণের নয়, একদম অন্যধরণের কবিতা ছিল সেসব । প্রশংসা পেয়েছিল সামান্য, কঠোর সমালোচনা আর ব্যঙ্গ-বিদ্রূপই পেয়েছিল বেশি । তারপর কতকাল আর কবিতা দেওয়া হয় নি কোথাও । লেখে সে এখনও, নিজের খাতায়। রয়ে যায় সব তার কাঠের বাক্সে । হয়তো সবই ওভাবেই থেকে যাবে, একদিন জীর্ণ হয়ে ঝুরঝুরে হয়ে ঝরে যাবে ।
কোথায় গেল সেইসব স্বপ্নের মত দিনগুলো যখন সে নিজের কবিতা সাগ্রহে পাঠাতে পারতো পত্রপত্রিকায়? খুব বেশিদিন আগের কথা তো নয়! এখনও তো যৌবন চলে যায় নি তার, এরই মধ্যে এত ধূসর, বিবর্ণ হয়ে গেল তার জীবন?
দুই .
ঠিক তখনই, অনেক দূরে, অন্য এক রাজ্যে, শঙ্খিনীমালা স্বামীর কামোন্মত্ততা সামলাতে সামলাতে প্রাণপণে কান্না চাপছিল । অনেক দাপাদাপির পরে রতিতৃপ্ত স্বামী যখন ঘুমিয়ে পড়ল, তখন সে সন্তর্পণে শয্যা ছেড়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল । আকাশের দিকে চেয়ে তার চোখ জলে ভরে উঠল, মনে পড়ল অনেক অনেকদিন আগের কথা। তার প্রথম যৌবনের কথা ।
কী আশ্চর্য সুন্দর ছিল তখন আকাশ, বাতাস, রোদ্দুর, জ্যোৎস্না, নক্ষত্র, পাহাড়, নদী-সবই । সেই তখনই তার জীবনের প্রথম প্রেমের অনুভূতি । সেই প্রথম, সেই শেষ । শুভর সঙ্গে সেই দিনগুলো যেন অলৌকিক! তারপরই সব ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল যেন । কোথায় হারিয়ে গেল শুভ! বাবামা ও অন্যান্য অভিভাবকদের চাপে অজানা অচেনা এক পুরুষের সঙ্গে সম্বন্ধ করে বিয়ে হয়ে গেল তার ।
এত বছরের বিবাহিত জীবনে সে স্বামীর কাছ থেকে জোরজবরদস্তি ছাড়া আর কিছু পায় নি । যথাসাধ্য কর্তব্যপালন করেছে, তাও মাঝে মাঝেই জুটেছে নির্মম শাস্তি । আর অহরহ মানসিক উৎপীড়ন তো আছেই । আর সে পারছে না ।
তিনতলার ব্যালকনির রেলিং এ ঝুঁকে সে চেয়ে দেখল নিচে, অনেক নিচে মাটি । সুড়কি বিছানো রাস্তা চলে গেছে বাগানের মধ্য দিয়ে । জ্যোৎস্নায় অল্প অল্প দেখা যাচ্ছে থোকা থোকা সাদা গন্ধরাজ । কৃষ্ণা পঞ্চমীর ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদ আকাশে, কেমন একটা রহস্যময় জ্যোৎস্না ঝরে পড়ছে সেই চাঁদ থেকে ।
এমনই জ্যোৎস্না ছিল সেই রাতেও, সেটা অবশ্য শুক্লপক্ষ ছিল । সেই জ্যোৎস্নারাতে ছাদে সে আর শুভ । সারা বাড়ি নির্জন, শুধু একতলায় সাবিত্রীমাসি ছাড়া আর কেউ নেই ।
বাড়ির অন্য সবাই গিয়েছিল তার মাসতুতো দাদার বিয়েতে । ওদের ফেরার কথা ছিল দু'দিন পর, একেবারে বৌভাত পার করে । জ্বর হয়েছিল বলে শঙ্খিনীমালা বাড়িতে একা ছিল, অবশ্য বাড়ির পুরনো কাজের লোক সাবিত্রীবালা ছিলেন সবসময়ের মতন।
সেদিন শুভ ছিল হঠাৎ হাজির হওয়া অতিথি, সে এসেছিল শঙ্খিনীর বাবা-মা-ভাইবোন সবাই বিয়েবাড়ি যাবার জন্য রওনা হয়ে যাবার পর । তখন শেষ বিকেল । শুভ দূরসম্পর্কের আত্মীয় ছিল, ওদের বাড়িতে আসা যাওয়া ছিল আগে থেকেই ।
জ্বর বেশি ছিল না শঙ্খিনীর, সে জ্বর গায়ে উঠেই অতিথির দেখভাল শুরু করল । পথশ্রান্ত অতিথি হাতমুখ ধুয়ে পোশাক পাল্টে আসার পর দেখল তার জন্য চা-জলখাবার রেডি । রান্নাবান্না যা আগে থেকেই তৈরী ছিল শঙ্খিনী আর সাবিত্রীর জন্য, তাই দিয়েই তিনজনের রাতের খাওয়া হয়ে যেত বটে, কিন্তু সাবিত্রী নতুন করে কিছু ভাজা আর ডিমের ঝোল রাঁধলেন । শত হলেও শুভ অতিথি বলে কথা ।
রাতের খাওয়া সকাল সকাল সেরে নিয়ে তারা গিয়ে বসল ছাদে মাদুর পেতে । আশ্চর্য সেই জ্যোৎস্নারাত, একটুও মেঘ ছিল না । হাওয়ায় একটু শীত-শীত ভাব ছিল, তার উপরে জ্বর, শঙ্খিনী একটা শাল জড়িয়ে বসেছিল । একের পর এক গান গাইছিল সে, কেমন পাগল-পাগল লাগছিল তার । পর পর চারখানা গান গাওয়ার পর সে মাদুরে শুয়ে পড়ল । শুভ তখন কবিতা আবৃত্তি করতে লাগল, ওর নিজের রচিত কবিতা ।
তারপর দিগন্তে আকাশ যেমন নত হয়ে পড়ে পৃথিবীর উপরে, তেমনি শুভর মুখ নত হয়ে পড়ল শঙ্খিনীর মুখের উপরে । তারপর তাদের সেই প্রথম চুম্বন । একটি চুম্বনের অসীমতা যে কী সেদিনের আগে জানত না শঙ্খিনী । আজ এত বছর পরেও ভাবতে গেলেই ধকধক করে উঠছে তার হৃৎপিন্ড ।
সেই একটা গোটা রাত, তারা দু'জনেই না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিল ছাদের উপরে । চাঁদ ডুবে গেল, মাথার উপরের তারাগুলো পশ্চিমে হেলল, নতুন তারারা উঠে এল পুবে । একের পর এক কবিতা বলেই চলেছে শুভ, শুনেই চলেছে শঙ্খিনীমালা ।
জ্বর কোথায় পালাল শঙ্খিনীর । পরদিন বিকেলে তারা গেল পাহাড়ের গায়ে ধাপে ধাপে করা ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে, নদীর বাঁকে বিরাট অশ্বত্থের কাছে । আগেও সেখানে কয়েকবার এসেছিল তারা, কিন্তু সেই সন্ধ্যেবেলা তারা ফুটতে থাকা আকাশের নিচে সেই শপথ---আজও ভুলতে পারে না শঙ্খিনী । ওভাবে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে কে সেদিন ভাবতে পেরেছিল?
বাড়ির লোকেরা ফেরার আগেই শুভ বিদায় নিয়েছিল শীগগীর আবার আসবে কথা দিয়ে ।
তারপর---তারপরের সময়ের কথা ভালো করে মনে পড়ে না শঙ্খিনীর । যেন একটা ঝড়ের মধ্যে পড়ল সে, সময়ের বোধ হারিয়ে গেল । এক আত্মীয়ের আনা সম্বন্ধ ধরে তাকে দেখতে এল অচেনা অজানা লোকেরা, সম্বন্ধ পাকা হয়ে গেল । তারপর শুরু হল কেনাকাটা । আরও হাজারো প্রস্তুতি । শঙ্খিনীর নিজের মতামতের যেন কোনো প্রশ্নই ছিল না । তাও সে মায়ের কাছে আপত্তি জানিয়েছিল ওই বিয়েতে । কিন্তু ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিলেন মা । মাত্র উনিশ বছর বয়স তখন তার, কলেজের প্রথম বর্ষে পড়ছিল । ওই অবস্থায় নিজের কোনো শক্তিসামর্থ্যই তো তার ছিল না জোরালো প্রতিবাদ করার ।
মাত্র পাঁচ মাস পরে বিয়ে হয়ে গেল । বিয়ের আগে শুভর সঙ্গে যোগাযোগ সে করতে পারে নি, তার ফোন বা চিঠি সবই তখন কড়াভাবে পরীক্ষা করা হত । শঙ্খিনীমালার সঙ্গে শুভর সম্পর্কটা একেবারেই অনুমোদন পায় নি ওর বাবামায়ের । ওটা যাতে কোনোভাবে জানাজানি না হয় সেইজন্যেই অত দ্রুত বিয়ের ব্যবস্থা করছিলেন ওঁরা । বিয়েতে শুভকে বা শুভদের বাড়ির কারুকে নেমন্তন্ন করা হয় নি ।
বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে দূরের এক রাজ্যে যাওয়া । চেনাজানা আত্মীয়বন্ধু সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কেমন একটা স্তব্ধতার মধ্যে যেন ঢুকে পড়েছিল শঙ্খিনীমালা । এত বছরে মাত্র হাতেগোনা কয়েকবার বাপের বাড়ি যাওয়া হয়েছে তার, তাও কিছু না কিছু উপলক্ষ্যে।
বিয়ের দু'বছর পরে তার একটি কন্যা জন্মায়, প্রিম্যাচিওর বেবি, মাত্র কয়েকঘন্টা বেঁচেছিল সেই মেয়ে । সেও যদি থাকত, তাও বেঁচে থাকার অবলম্বন থাকত তার একটা ।
ক্ষয়াটে চাঁদ ঘুমঘুম চোখে চেয়ে আছে, বিষন্ন জ্যোৎস্না এসে পড়ছে বাগানের গাছে গাছে । ক্ষয়া চাঁদ যেন বলছে, "জানো আমি কেন এত বিষাদ ধরে থাকি এই বুকে? কেউ আমাকে বোঝে নি, কেউ ভালোবাসে নি । প্রিয়বিচ্ছেদ আর অপ্রিয়সঙ্গ-এই দুই দুঃখ আমাকে জাঁতার মতন পিষছে অহরহ । সেইজন্যেই আমি তিলে তিলে ক্ষয়ে ক্ষয়ে অমাবস্যায় একেবারে শেষ হয়ে যাই । "
শঙ্খিনীর মনে হল প্রেমহীন সংসারের অর্থহীন জাঁতাকলে পিষে পিষে সেও একদিন ওই কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের মতই ক্ষয়ে ক্ষয়ে মরে যাবে । তিলে তিলে অনেকদিন ধরে শেষ হবার চেয়ে এখনই যদি-
তিনতলার সেই ব্যালকনির রেলিং টপকে সে নিজেকে ছেড়ে দিল শূন্যে । অনেক নিচের কঠিন মাটি তাকে টেনে নিল নির্মম উদাসীনতায় ।
সেই মুহূর্তেই পার্ক থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় এসে পৌঁছেছিল শুভ । এত রাতে রাস্তায় গাড়ি চলাচল খুব কম, শুধু মাঝে মাঝে দৈত্যাকার ট্রাকগুলো ছুটে যাচ্ছে হেডলাইটের ছটায় রাস্তা ধাঁধিয়ে দিয়ে ।
আলোয় ধাঁধিয়ে দিয়ে একটা ট্রাক চলে যেতেই শুভ হঠাৎ দেখতে পেল রাস্তা নেই, শহর নেই, ক্ষমাহীন ঘর অপেক্ষা করে নেই, সে পৌঁছে গিয়েছে সেই সোনার ধানের সিঁড়ির পাশে । আর সেইখানে তার জন্য অপেক্ষা করে আছে তার শঙ্খিনীমালা । সেই প্রথম যৌবনের শঙ্খিনীমালা । শেষ তাকে যেমন দেখেছিল শুভ, অবিকল সে ।
ধাবমান ট্রাকের সামনে শুভ নিজেকে ছেড়ে দিল ।
তিন.
নশ্বর দেহ দু'টি পৃথিবীতে ফেলে রেখে শুভ আর শঙ্খিনীমালা হাসতে হাসতে নামছিল সোনার ধানের সিঁড়ির ধাপ থেকে ধাপে, আর তাদের কেউ বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না ।
কাছেই বিশাল এক হিজল গাছ, সবুজ পাতায় পাতায় রোদ্দুরের ঝিকিমিকি তুলে যেন তাদের অভ্যর্থনা করছিল । তাদের ঘিরে গান গাইছিল অলৌকিক পাখিরা, তাদের মুখে, চুলে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিল আশ্চর্য স্নিগ্ধ হাওয়া । অলৌকিক নদীর কলধ্বনি ভেসে আসছিল তাদের কানে ।
ফিসফিস করে শুভ বলে উঠল তার কবিতার কয়েকটা লাইন, “স্নিগ্ধ সবুজের পাশে পেয়েছি তো তাহারে আবার, / পৃথিবীর অকরুণ দিনরাত্রি ক্লান্তপায়ে হয়ে পার ।/ একদিন যারে চেয়ে নিভেছিল সব আলো/ ছায়াহাত নেমেছিল মৃত্যুর মত কালো-/ আবার পেয়েছি তারে কলস্বনা নদীটির তীরে,/ পেয়েছি এবারে তারে হৃদয়ের অমেয় গভীরে …..”
শঙ্খিনীমালা এসে হাত ধরল শুভর, ওর কাঁধের উপরে মাথা রেখে শেষ দু'টি লাইন আবৃত্তি করল, "আবার পেয়েছি তারে কলস্বনা নদীটির তীরে,/ পেয়েছি এবারে তারে হৃদয়ের অমেয় গভীরে ..."
কোথায় যেন সুরেলা ডাক ডেকে উঠল একটি পাখি, অন্য আর একটি পাখি সাড়া মিলিয়ে ফিরিয়ে দিল ডাক।
পরস্পরকে নিবিড় জড়িয়ে ধরে অফুরাণ চুম্বনে মিলে গেল শুভ আর শঙ্খিনীমালা । জোরালো পাহাড়ী হাওয়া এসে ছুঁয়ে গেল তাদের যুগলমূর্তি ।
0 মন্তব্যসমূহ