বেথ এবং তার গ্রুপ চলে যাবার পর সুদীপের দিনগুলো জাহান্নাম হয়ে
যায়। অফিস করে কিন্তু মন বসাতে পারে না। প্রায় প্রতিদিনই কল করে সিঙ্গাপুরের পার্টনার
লী’কে একাউন্টে টাকা এসেছে কিনা জানার জন্য।
রাশিয়া তখনও এল সি’র ব্যবসার
জগতে প্রবেশ করেনি। সরাসরি অর্থের লেনদেন হয়। চুক্তিমত এতদিনে টাকা পৌঁছানোর কথা, কিন্তু
দেরি হচ্ছে।
লী সুদীপদের পার্টনার, কারণ সিঙ্গাপুরে স্থানীয় কোনো পার্টনার
ছাড়া কোম্পানি খোলা যায় না। লী’ র সাথে
ব্যবসায়িক লেনদেন খুব একটা হয়নি, ওর কাছ থেকে কিছু কম্পিউটার কেনা ছাড়া। সবেমাত্র ডাক্তারী
পড়া শেষ করা, জীবন সম্পর্কে অপরিপক্ক সুদীপ ব্যবসায়ি জগতের প্রতারণার বিষয়টি মাথায়
রাখেনি । মোশতাকও নয়।এতগুলো টাকা কোম্পানির একাউন্টে এলে লী সেই টাকার কোনো অপব্যবহার
করতে পারে কিনা, বা টাকাগুলো আটকে দিতে পারে কিনা, সে কথাটি ওরা গুরুত্ব দিয়ে ভাবেনি।
রাশিয়ায় আইন নাই কিন্তু সিঙ্গাপুরে আছে। তারা সেটাকে গুরুত্ব দিয়ে ভেবেছে তারা নিরাপদ
কিন্তু সেই আইন তাদের, যারা বিদেশের নাগরিক, না সিঙ্গাপুরের নাগরিক লী’র স্বার্থ রক্ষা করবে সেটা তারা জানে
না।
খুবই বিপদজনক লেনদেন কিন্তু ওরা নগদ অর্থের দিকটাই দেখেছে, বিপদের
দিকটা নয়।
প্রায় ৩ সপ্তাহ কেটে গেছে, টাকা আসেনি।
এক শুক্রবার নিকোলাই সের্গেইভিচ ছুটে আসে, “সুদীপ, খবর খারাপ। পোলিশ ডিফেন্স মিনিস্ট্রিতে
বড় রকমের দুর্নীতি ধরা পড়েছে, মিনিস্টারকে দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেয়া হয়েছে এবং বেশ
কিছু লোক গ্রেফতার হয়েছে!”
ওর বাসায় যখন কথা চলছিল, তখনই টিভিতে সর্বশেষ খবরে পোলিশ মিনিস্টার
এবং আরো কয়েকজনের ছবি দেখানো হয়, তাদের মধ্যে সেই সন্ধ্যার উর্বশী বেথও রয়েছে।
সুদীপের স্বপ্নের বেলুন ছিদ্র হয়ে যায়।
অনেক অনেক ডলার হাতে আসার কৃষ্ণচূড়া লাল কল্পনাগুলো ফ্যাকাশে হয়ে
আসে।
নিকোলাই সের্গেইভিচ আশাহত কিন্তু সে অভিজ্ঞ মানুষ, স্বপ্ন মৃত্যুর
কষ্টের চেয়ে বাস্তব বিপদগুলো তাকে বেশি ভাবায়। সে ভেতর থেকে যতদূর খবর পেয়েছে তাতে
পোল্যান্ডে যে দুর্নীতি ধরা পড়েছে তা তাদের চুক্তি নয়। কিন্তু ভয় পাচ্ছে ওরা খোঁজাখুজি
করলে তাদেরটাও বের হয়ে আসতে পারে। সেক্ষেত্রে কেজিবি পিছনে লাগবে এবং এখানেও ধরপাকড়
শুরু হবে।
সুদীপর কিছুদিন শহরের বাইরে থাকা দরকার এবং বাসায় বা অফিসে ফোন
না করাই নিরাপদ।
নিজেও সে আত্মগোপনে যাবে। যেসব বন্ধু-বান্ধবের কাছে তার নিয়মিত যাতায়াত রয়েছে, সেখানে বা দাচায় না যাওয়াই ভালো, কেজিবির চোখ সর্বত্র। যদি তার খোঁজ পড়ে তারা ওসব জায়গাগুলোতে আগে হানা দেবে। রোববার সকালেই সুদীপ কিছু বই নিয়ে বাসা ছেড়ে যায়।
টেলিফোন বুথ থেকে কল করে রুস্কো ব্যংকের কালো চোখের ল্যুবাকে যে বহুবার ডেকেছে
তার সাথে দাচায় যাবার জন্য।
“যাবো
সময় করে, ব্যস্ততাটা কমুক।”
“আপনার ব্যস্ততা কি কমবে কোনোদিন? ব্যবসা ছাড়া অন্য
কিছু কি আপনার চোখে পড়ে?”
“পড়বে
না কেন? অবশ্যই পড়ে।”
“কী চোখে
পড়ে?” সে
জেরা করে।
“তোমার চোখ, চুল, ঠোঁট, বুক ও বন্ধুত্ব”- সে ফিসফিস করে। ল্যুবার মুখে রং ছড়িয়ে পড়ে।
“কী করছো?”
“দাচায়
যাবো, তৈরি হচ্ছি।”
“আর কে যাচ্ছে?”
“কেউ
না, আমি একা।”
“আমাকে নেবে?”
সুইডিসদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য পিটারের আমলে প্রতিষ্ঠিত একটি
ছোট শহর। লেনিনগ্রাদ থেকে ফিনল্যান্ডের দিকে ট্রেনে যেতে হয় ঘণ্টাখানেক। ১৯১৭ সালের
জুলাই বিদ্রোহের পরে কমরেড লেনিন আত্মগোপন করতে বাধ্য হয়েছিলেন সিস্ত্রারিয়েৎস্কের
রাজলিভ গ্রামে। খড়ের গাদার নীচে বাস করেছেন কয়েক সপ্তাহ ফিনল্যান্ডের একজন ঘাসির ছদ্মবেশে।
সাথে ছিলেন কমরেড জিনোভিয়েভ। কিন্তু পরে যখন লেনিনকে দেবতা এবং জিনোভিয়েভকে অসুর ঘোষণা
করা হয়, রাজলিভে লেনিনের সাথে তার একসাথে আত্মগোপন করে থাকার ব্যাপারটা সমীকরণ বহির্ভূত
হয়ে পড়ে এবং তার নামটি রাজলিভের ইতিহাস থেকে সম্পূর্ণ উধাও করে দেয়া হয়। সেখানে জারের
পুলিশবাহিনীর চেয়েও বড় অত্যাচার ছিল মশার উৎপাত। কোনোভাবেই এই রক্তপিপাসুদের থাকে মুক্তি
পাওয়া যায় না।
শুধু বৃষ্টি হলে মশা কমে কিন্তু খড়ের চাল চুঁয়ে বৃষ্টি নেমে এসে সবকিছু ভিজিয়ে দেয়। লেনিনের লেখালেখি, কাগজ পত্র, ঘুমানোর স্থান নষ্ট হয়ে যায়। এই দু:সহ অবস্থার মধ্যেই লেনিন তার “রাষ্ট্র ও বিপ্লব“ বইটি লেখেন। কিভাবে সমাজতন্ত্র গড়বেন তার তাত্ত্বিক নির্দেশনা রয়েছে এই বইতে। কিন্তু বিপ্লবের পরের বাস্তবতায় তাঁর দৃষ্টি উন্মুক্ত হয় এবং বহু ধারণা থেকে সরে এসে ন্যাপের ধারণায় পৌঁছান। আস্তে আস্তে একদিন রাষ্ট্র বিলুপ্ত হয়ে যাবার স্বপ্ন মঙ্গলের বোধিও এখানেই উন্মোচিত হয়েছিল। সময় শুধু তা মিথ্যাই প্রমাণিত করেনি, রাষ্ট্র (পুঁজিবাদী এবং সমাজবাদী) বিলুপ্ত হবার বদলে ফুলে ফেপে ইতিহাসের সবচাইতে সফিস্টিকেটেড নিপীড়ন যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। নাগরিকদের দিয়েছে চিড়িয়াখানার স্বাধীন প্রাণীর অধিকারের মত অধিকার সংরক্ষণের নিশ্চয়তা।
একদিন বৃষ্টির তাড়া খেয়ে এক কসাক এসে হর হর করে ঢুকে যায় লেনিনের
ছোট্ট কুড়ে ঘরে।
লেনিন বলেন, “হে হে হে, তুমি কে, এখানে কী করছো?”
“আমি
লেনিন নামে একজন অপরাধীকে খুঁজছি, সে নাকি জার্মান চর ও দেশের শত্রু। সে এই এলাকায়
লুকিয়ে আছে।”
সাময়িক সরকারের কর্মকর্তা, আন্দ্রেই ভিশিনস্কি, লেনিনকে গ্রেফতারের
আদেশ দিয়েছিলেন।
অক্টোবর বিপ্লবের পর পরই কমরেড স্ট্যালিনের হাত ধরে ভিশিনস্কি
পক্ষ পরিবর্তন করেন এবং বিচারবিভাগের একজন শক্তিশালী সদস্য হিসাবে পার্টিতে শুদ্ধি
অভিযানে কমরেড স্ট্যালিনকে সহায়তা করেন। ১৯৩৫ সালে তাকে বিচারবিভাগীয় প্রধান করে শুরু
করা হয় বিখ্যাত মস্কো সিরিজের বিচারসমূহ, যার মাধ্যমে, ভিশিনস্কির স্বাক্ষরে জিনোভিয়েভ,
কামেনেভ, বুখারিন ইত্যাদিসহ বহু বড় নেতাকে ফায়ারিং স্কোয়াডে পাঠানো হয়। লেনিনকে ধরতে
পারেননি বলেই অক্টোবর বিপ্লব ও মানবজাতির ইতিহাসে অন্যতম বিশাল নিরীক্ষা সম্ভব হয়েছিল।
কিন্তু
শোধটা তিনি নিয়েছিলেন লেনিনের সহচরদের হত্যা করে।
এবং যিনি এই প্রতিশোধের
মূল নিয়ন্তা, তার কথা বার বার বলা যায় না।
পরিচ্ছন্ন ছোট্ট গাছের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি ল্যুবাদের ঘর। ছোট ছোট
গোছানো কক্ষ, বিছানা। জানালার বাইরে সব্জির বাগান, গুচ্ছ গুচ্ছ বেরির ঝোঁপ, ফুল আর
ফুল। ল্যুবা যেন অন্তর্নিহিত আনন্দে চিক চিক করছে। সে দ্রুত আলু ছিলে চুলোয় চড়িয়ে দেয়।
বাগান থেকে শশা, টমেটো, পেঁয়াজের পাতা ও ধনেপাতা জাতীয় কিন্জা পাতা কেটে আনে। সসেজ
সিদ্ধ করে, ফ্রেশ সালাদ ও সিদ্ধ গরম আলু ও রেড ওয়াইন দিয়ে চমৎকার ডিনার করে।
“বহুবার
ডেকেছি যদিও, আপনি আসবেন, আশাই করিনি। গান শুনবেন?”
অন্যরুম থেকে গিটার নিয়ে আসে। অদ্ভুত গায় সে! কোনো জড়তা নেই। মিষ্টি
ভালোবাসার গান।
সুদীপ জানতো না, ও এত সুন্দর গায়। একটু একটু করে রেড ওয়াইনে চুমুক
দেয়, তাই যেন ওর কণ্ঠে সুর হয়ে ফিরে আসে। রেড ওয়াইন, না গান তাকে তন্ময়তায় গলিয়ে দেয়,
সে প্রশংসা করার ভাষা হারিয়ে ওর প্রতি একটা অদ্ভুত আকর্ষণ বোধ করে। বাইরে অন্ধকার রাত।
আকাশে তারা নেই। কয়েকটি বার্চগাছ দাঁড়িয়ে আছে ভূতের মত। লেনিনের স্মৃতিধন্য শহর। কেজিবির
ভয়ে সুদীপ সেখানে লুকিয়ে আছে। দুই জগতের দুই মানুষের সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মের আত্মগোপন।
একজন রাশিয়াকে জারের শোষণ থেকে স্বাধীন করে শ্রমিকশ্রেণির মুক্তির উদ্দেশ্যে লড়াই করে
গেছেন, অন্যজন দ্রৌপদী রাশিয়ার বস্ত্রহরণে লিপ্ত শকুনি সম্প্রদায়ের সামান্য একজন। অথচ
সে রাশিয়ায় গিয়েছিল লেনিনের মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েই। যে কোনো জিনিসই দূর থেকে দেখলে
সৌন্দর্যটুকু চোখে পড়ে, কাছ গেলে দেখা যায় সুন্দর ও অসুন্দরের সংমিশ্রণ। কাছে গেলেই
বোঝা
যায় সবচেয়ে সুন্দরী নারীরও অন্ত্রভরা পুরীষ এবং সবচেয়ে সৎ মানুষটিও
অসৎ হতে দূরে নয়।
সে শুয়ে আছে, ঘুম আসছে না। মাথায় চিন্তা ঘুর ঘুর করছে, কত চিন্তা।
ল্যুবা কি ঘুমিয়ে পড়েছে রাতের গাউনে বিস্রস্ত? বালিশ ঢেকে দিয়েছে বাদামি চুলগুলো?
কেমন ওর দেহের গন্ধ? সন্ধ্যার সুস্বাদু রেড ওয়াইন ওর মগজে বিভ্রমের
ইন্দ্রজাল ছড়ায়, চেতনে নিশিপাখি ডানা ঝাঁপটায় এবং আমু দরিয়ার মত অথৈ এক তৃষ্ণায় সে
ছটফট করে। নিজের সাথে লড়াই করতে হয় তার এবং সে পরাজয় স্বীকার করে বিছানা ছেড়ে উঠে
দাঁড়ায় এবং বাইরে তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম কাঁধে টুক টুক করে হাঁটে আদিম ও অকৃত্রিম রাত।
পেরেস্ত্রোইকা, মস্কো
ও মধু
৫২ তম পর্ব
পৃথিবী যতদিন আছে, ততদিন ধরেই আছে আদিম ও অকৃত্রিম রাত-দিন। বছর
দুয়েক আগে একটা দুপুরের কথা মনে পড়ে সুদীপের, যেদিন সে বিবেকের পরিখা অতিক্রম করেছিল।
“নভি
রুস্কি” বা
“নতুন রাশিয়ান”
নামে সদ্য গজানো ব্যবসায়ি গোষ্ঠি প্রবল দাপটে ব্যবসা করছে এবং রুবল ডিগবাজি খাচ্ছে
দিনে রাতে, ছোটরা নিঃস্ব হচ্ছে এবং বড়রা হচ্ছে আরো বড়। সোভিয়েত ইউনিয়ন মৃত্যু শয্যায়
ধুঁকছে। সুদীপ “নভি
রুস্কি” ছিল
না কিন্তু বিদেশি হিসাবে তখনও বাইরে যাওয়া আসা করার সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল।
পেত্রোভস্কি ব্যাংকে কাজ ছিল ওর।
১৫ লাখ রুবল ছিল একাউন্টে, বের করতে সক্ষম হয়নি। তখনও ক্যাশ বৈধভাবে
তোলা যায় না। একরাতেই ৬ রুবলের ডলার, ৩০ রুবল হয়ে গেছে। ব্যাংকের একাউন্টে এখন যা আছে,
কাগজ। কিছুটা বিষণ্ণ সুদীপ। অদূরেই এক হোটেলে বন্ধুর অফিস। পাশ দিয়ে যাবার সময় ড্রাইভারকে
বলে গাড়ি থামাতে। কাজ একটা ছিল, তবে বন্ধু ছাড়াও সেই অফিসে আরও একটা আকর্ষণও ছিল।
কলিং বেল টিপতেই দরজা খুলে দেয় মেয়েটি।
আঙুর বাগানের কৃষাণীর মত সুন্দর ও নম্র। শণ পাতার মত চোখ এবং শণের
মত চুল।
বস্ কই?
মস্কো গেছে।
তাই নাকি? আসবে কবে?
আগামীকাল।
কাজ ছিল, ঠিক আছে অন্যদিন আসবো।
কাজ শুধু বসের সাথেই, আমি কি কিছুই করতে পারি না?
ওর হাসিটি সবসময়ই সুন্দর, আজও ব্যতিক্রম নয়। ওকে দেখলে সব বিষণ্ণতা
কেটে যায়। এমন কি ১৫ লাখ রুবলের পানি হয়ে যাবার দুঃখও। রাশিয়ার জায়মান ব্যবসার জগতে
অফিসের সাফল্যে যৌবতি, সুন্দর ও তীক্ষ্ণ সেক্রেটারির বিকল্প নেই।
চা খাবে?
ডিস্টার্ব হবে না?
কিছুটা তো হবেই, তবে তোমার জন্য সেটা না হয় হলোই।
বাহ্! তুমি কত সুন্দর করে কথা বলো।
শুধু কথাই সুন্দর মনে হলো?
না, তোমার সমস্তটাই সুন্দর।
সমস্তটা? মুখে সকালের রৌদ্রের মত হাসি ছড়িয়ে পড়ে।
না দেখে কী করে জানলে? আবার হাসে। হাসি নয় যেন প্রাচীন মদ। সে
খেলে খেলে, মস্তিস্কে ক্ষার ঢেলে কথা বলে।
অনেকদিন আগেই সুদীপের দৃষ্টিতে কিছু একটা দেখতে পেয়েছিল লিজা এবং
তা তার চোখের মণির ছিদ্র অতিক্রম করে রেটিনায় গেথে গিয়েছিল। মানুষের কখনও কখনও হঠাৎ
করেই, কোনো পূর্বসংকেত ছাড়া, এমন হয়। যে বিদ্যুৎটা তার মধ্যে জন্মায় এবং তা চমকিয়ে
আলো ছড়িয়ে, বিলুপ্ত হয়ে যায় না সাথে সাথেই। সুদীপ যখন আসে সে সেটা অনুভব করে। বয়ফ্রেন্ডের
সাথে থেকে যে অনুভূতির আগুনটা একটু স্তিমিত হয়ে এসেছে, তা যেন দপ করে জ্বলে ওঠে আবার
এবং ওর মোমের মত গলতে ইচ্ছে করে।
সুদীপের অভিজ্ঞ বন্ধু কোলিয়া নিচের প্রবাদটি বলেছিলঃ
গিদিয়ে ঝিবিওস তাম নি ইবি
গিদিয়ে ইবিওস তাম নি ঝিবি।*
এবং সে তা মেনে চলেছে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে, প্রকৃতপক্ষে সে কোনো
কিছুতেই জড়ায়নি। আলিওনার ঘ্রাণটা তখনও মাদকের মতই ছিল। কিন্তু আজ ওর মাথায় “সমস্তটা? কী করে জানলে?” প্রশ্নটা ওলট পালট ঘুরতে থাকে।
মেয়েটি কি চায় সে ওর সমস্তটা দেখুক? নির্জন কক্ষে কেমন একটা নেশা
নেশা লাগে।
লিজা জল ঢেলে কেটলিতে বসায়।
এবং অনেকটা মন্ত্রমুগ্ধের মতই সে পিছু পিছু যায়। লিজা কেটলি বসিয়ে
ফিরে দেখে সুদীপ খুব বেশি নিকটে। ওর শ্বাস-নিশ্বাস গায়ে এসে লাগে, পারফিউমের ম্যাসকুলিন
ঘ্রাণটা নাকের শ্লেষ্মা ঝিল্লি দিয়ে ঢুকে মগজের কোথায় যেন কুয়াশার সৃষ্টি করে।
একটা চুমু খাওয়া যায় না?
ও হেসে ফেলে, চা না চুমু।
দুটোই।
শুধু একটা চুমুই তো?
হ্যাঁ।
আচ্ছা। একটাই কিন্তু।
দুজোড়া ঠোঁট আটকে যায় চোরাবালিতে এবং প্রলম্বিত হয়, এত দীর্ঘ যে
একের বুক অন্যজনের বুকে মিশতে বাকি থাকে না। শুধু তাই নয়, ওই যে বিদ্যুতটা লিজার শরীরে,
তা চমকাতে শুরু করে।এবং সুদীপ অনুভব করে মেয়েটার বুকের বামকক্ষে অসংখ্য মাল্লা দাঁড়
ফেলছে হেইও, হেইও তীব্র গতিতে। এবং তার প্রতিটি দাঁড়ের ঝপ্পাস ঝম্পন ওর বুকে এসে আঘাত
করছে। ওর হাত চলে যায় যেখানে অসংখ্য বুম বুম হৈ হৈ রৈ রৈ, কিন্ত একটি কোমল পদ্ম ওর
মুঠো ভরে দেয়। একটি নয়, দুটো। তাদের পাপড়িতে পাপড়িতে আফিমের রেনু।
লিজার চোখ বুজে আসে, শ্বাস দ্রুত হয় এবং সে তার দুই কাঁধ গলিয়ে
বাঁধার বাঁধনগুলো উন্মুক্ত করে দেয়। ১৯ র চোখ জ্বালা-করা ভরাটত্ব, কোথাও কোনো শিথিলতা
নেই। রঁদার ভাস্কর্যের
সুদৃঢ় ও টানটান স্থলপদ্মের যুগল। ওর ঠোঁটের স্পর্শ পেয়ে কখনও টান
টান ঋজু কখনও রাজহংসীর মত বাঁকা হয় মেয়েটি। বান-জলের তীব্র তীরভাঙা ঢেউয়ে ভেসে যেতে
যেতে সে কিছু একটা ধরতে চায়। ওর বুক খোঁজে, পিঠ খোঁজে এবং ত্বকের সবগুলো সুইচ অন করে
দেয়।
প্রচণ্ড, দৃঢ় ও উষ্ণ সুন্দর এক দুপুর।
ঘন, নরম ও বাদামি নল-খাগড়া-উপত্যকার দক্ষিণে অপূর্ব উন্মুক্ত গিরিখাত অতিক্রম করা গ্রামের এঁটেল মাটির রাস্তার মত সিক্ত ও পিছল পথ ধরে হাঁটছে সে। একজন ও অন্যজন ছাড়া এত কাছে আর কিছু নেই। পৃথিবী নেই, আকাশ নেই, নক্ষত্র নেই। এক অনিন্দ্য ছন্দময় আন্দোলনে কাঁপছে পুষ্পিত নল-খাগড়ার ঝাঁড়। চেতনার প্রতিটি দেরাজ ভরে উঠেছে কোটি কোটি আনন্দকণায়!
বহুতল দালানের উঁচু তলা। বিশাল জানালার বাইরে নীল আকাশ, পারাবত
মেঘ উড়ছে নির্জন। মেঘেদের কাছে ভালো কী মন্দ, বাস্তব কী অবাস্তব, উচিত কী অনুচিত এইসব
প্রশ্ন অবান্তর। একজন মানব সুন্দর ও একজন মানবী সুন্দর ছুটছে এক অপূর্ব প্রজাপতির ডানার
ঝাপটের পিছু পিছু।
কেটলিতে শব্দ করছে ফুটন্ত জল।
——
পাদটিকা
*যেখানে বাস কর, সেখানে পরকীয়ায় ডেকো না
যেখানে পরকীয়া কর, সেখানে থেকো না।
পেরেস্ত্রোইকা, মস্কো
ও মধু
৫৩ তম পর্ব
ল্যুবার বাসায় ভোরটা পাখাওয়ালা ফুরফুরে। ওর মুখে মৃদু একটি হাসির
রেনু ছড়িয়ে আছে। সুন্দ উপসুন্দকে হত্যা করার জন্য ব্রহ্মার নির্দেশে বিশ্বকর্মা পৃথিবীর
যেখানে যা কিছু সুন্দর, নান্দনিক ও মনোহরণকারী, তা-ই বিন্দু বিন্দু সংগ্রহ করে তারই
অণু-পরমাণু দিয়ে তৈরি করেছিলেন যাকে, ল্যুবা যেন সে-ই, প্রভাতের সুস্মিত নিষ্ককণা।
লেনিনগ্রাদে কাজে যাবার ব্যাতিব্যস্ত প্রস্তুতি নিচ্ছে।
“তোমার এই জায়গাটা খুব ভালো লেগেছে আমার, কয়েকটা দিন
থেকে যাই?”
বিস্মিত গভীর চোখে ফিরে তাকায় ল্যুবা, “বাড়িতে কোনো
সমস্যা?”
“না।”
“কিন্তু কিছু একটা হয়েছে, তাই না?”
“মাফিয়া!
কিছুদিন শহরের বাইরে থাকা দরকার।”
সে কেজিবির সমস্যার কথাটা মাফিয়ার কাঁধে চাপিয়ে দেয়, যদিও সে জানেই
না, জাপানি দুই মাথার পূর্বদর্শী পাখির মত সে তার নিজেরই ভবিষ্যত বলছে।
“যতদিন
ইচ্ছা থাকো।”
সুদীপের বিপদে বা ওর এখানে থেকে যাবার ইচ্ছায় ল্যুবাকে বিষণ্ণ
হবার বদলে খুশিই মনে হয়।
কোথায় কী রয়েছে, তা বুঝিয়ে সে চলে যায়।
শুয়ে বসে দিন কাটায় সুদীপ, ভদকার নদীতে সাঁতরায়। আলিওনার মুখটি
চোখে ভাসে। ভাবে মানুষ-আদিতম পণ্য, কেনা যায়, বেচাও যায়, শুধু দামেই রকমফের, আলিওনা
কি তা জানে?
জানার কী দরকার? জ্ঞানই কি জ্ঞানহীনতার সবচেয়ে বড় আধার নয়?
বসনের নীচে প্রতিটি মানুষই নগ্ন।
সে নিজেকে নিজের কাছে জাস্টিফাই করে।
সারাদিন শুয়ে বসে বই পড়ে সে, ড্রিংক করে প্রচুর। সন্ধ্যার দিকে
ঝিম ঝিম মাথা ঘাড়ে নিয়ে হাঁটতে বের হয়। দীর্ঘ পাইনের ছায়াগুলো ঘাসে শুয়ে আছে লম্বা
লম্বা সাপের মত। হাঁটতে হাঁটতে গোধুলির দিন-রাত্রির মায়াবী সন্ধিক্ষণ ঘনিয়ে আসে। পাইনের
বন, নিঝুম নির্জন, ছায়া আর ছায়া। পাইনের গন্ধে কেমন কেমন লাগে। পাখাওয়ালা দেবদূতের
মত হাওয়া। ডালে ডালে শব্দ করে মাঝে মধ্যে কোনো পাখির পাখা ঝাপটানোর মত। সে একটি বেঞ্চ
দেখতে পায়। একজন লম্বা মানুষ কালো কোট পরে বসে আছে টানটান, ঋজু পিঠ, মাথা উঁচু।
বসে চিন্তা করছে। সুদীপ পাশে গিয়ে বসে।
“দব্রি ভিয়েচের” (শুভ সন্ধ্যা!)
“দব্রি,
দব্রি” (শুভ,
শুভ)! উত্তর দেয় লম্বা রাশিয়ান।
“আজ বিকেলটা
বড়ই সুন্দর, তাই না!” সুদীপ
বলে।
“আমিও
ঠিক এ কথাই ভাবছিলাম, অপূর্ব সন্ধ্যা।”
“জায়গাটাও বেশ সুন্দর, নিরিবিলি; আপনি আশেপাশেই কোথাও
থাকেন বুঝি?”
“হ্যাঁ,
এখানেই, অনেক দিন ধরেই আছি। যে বছর প্যাস্টারনাককে নোবেল প্রাইজ অস্বীকার করতে বাধ্য
করা হলো, সে বছর থেকেই আমি এখানে, স্বেচ্ছায় নয়। অবশ্য এখন আর কিছু যায় আসে না।”
ততক্ষণে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে, গাছগুলোকে বিশাল বিশাল ছায়ায় ভুডুড়ে
মনে হয়।
সুদীপ বলে, “চলুন
যেতে যেতে কথা বলি।”
“তুমি
যাও, আমি যাবো না।”
“আচ্ছা আপনি থাকুন, আমি যাই, কথা বলে ভালো লাগলো, আপনার
নাম কী?”
“মিশা, মিশা জস্সেন্কো!”
রাশিয়ায় মিশা বা মিখাইল প্রচুর এবং জস্সেনকোও কম নয়। নামটা সুদীপের
এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কানে বের হয়ে যায়। সে হাঁটতে শুরু করে।
এখানে অন্ধকার নেমে আসে গুপ্তচরের মত দ্রুত পায়ে। একটু এগিয়ে লাইটপোস্টের
ওপর থেকে গলে আসা মৃদু আলোয় সে ছোট একটা সাইনবোর্ড দেখতে পায়, “সেস্ত্রারিয়েৎস্ক কবরস্থান”!
সুদীপের গা কেঁপে ওঠে। নামটা হঠাৎ মনে পড়ে, মিখাইল জস্সেন্কো!
একসময়ের প্যাস্টারনাক ও আখমাতভার চেয়েও পাঠক নন্দিত লেখক।
সে ফিরে তাকায়। অবিকল আগের মতই বসে আছে লম্বা মানুষটা, উঠে চলে
যায়নি।
সুদীপের মাথা ঘুরতে থাকে, সে অতিরিক্ত পান করে ফেলেছে।
জস্সেন্কো এতকাল নির্বাসিত, নির্বাপিত ছিলেন, কিন্তু এখন রাশিয়ায়
খুব আলোচনা হচ্ছে তাকে নিয়ে। লেখালেখি হচ্ছে প্রচুর। এবং তার জীবনে ঘটে যাওয়া একটি
দুঃখময় প্রেমের গল্প পড়েছিল সে কিছুদিন আগেই।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধফ্রন্টে আহত হবার পরে যখন পেত্রোগ্রাদ
বিপ্লবের জ্বরে কাঁপছিল, মিখাইল ছিলেন আর্খাঙ্গেল্সক শহরে। চিরশীতের নির্জন এই দেশে
কয়েক বছর পরে লাদা নামে এক অসামান্যা নারী তার হৃদয় হরণ করে। তার স্বামী সমুদ্রে মাছ
ধরতে গিয়ে নিঁখোজ হয়ে গেলেও
লাদা তার মৃত্যুর কথা বিশ্বাস করে না। মাসের পরে মাস যায়, অপেক্ষা
করে থাকে স্বামীর জন্য। মিখাইল প্রেম নিবেদন করেন, প্রস্তাব করেন তার নৈঃসঙ্গের সাথী
হবার। কিন্তু লাদা প্রত্যাখ্যান করে। “তারপরে?
তারপরে কী? যখন প্রথম রাত্রিগুলোর আবেগ ও অনুভূতির তীব্রতা শেষ হয়ে যাবে, আসবে দৈনন্দিনতার
ঢিমে তেতালা দিন, একঘেয়েমি জেঁকে বসবে আপনার মনে এবং আপনি মস্কো বা পেত্রোগ্রাদ ফিরে
যাবার জন্য হাঁসফাঁস করবেন।”
কিন্তু মিখাইল তার থেকে দৃষ্টি সরাতে পারেন না। তার হাঁটার ছন্দ
তার বুকে কাঁপন তোলে। সে যখন গৃহ পরিস্কার করে, কাপড় ধোয়, রান্না করে আর গুন গুন করে
গান গায়, তার গানের কণ্ঠ আফিম-তন্ময় করে রাখে। লাদা জীবনকে অতি সহজভাবে গ্রহণ করতে
শিখেছে। নিজের ভাগ্যের বিরুদ্ধে তার কোনো অভিযোগ নেই। তার পিতা ছিলেন “পসকভ”
শহরে গির্জার পাদ্রী। প্রতিক্রিয়াশীল ও বিপ্লবের শত্রু আখ্যা দিয়ে তার পিতা-মাতা দু’জনকেই ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করা হয়েছে।
শত্রুকন্যা হিসাবে স্বামী ও তিন সন্তানসহ তাকে নির্বাসিত করা হয়েছে আর্খাঙ্গেল্সক শহরে।
সেই স্বামী এখন নিঁখোজ।
তারপরেও সারাদিনের পরিশ্রমের ক্লান্তি শেষে সে শিশুদের ঘুম পাড়িয়ে হাতে তুলে নেয় পুরোনো গিটার। ধীর কণ্ঠে গায় হারানো দিনের গান, রাতের নৈঃশব্দ ফুপিয়ে কাঁদে বিস্মৃত রোমান্সের সুরের যাতনায়। দুর্ভেদ্য দুর্গের মত নারী। হয়তো সে ছিল ভবিষ্যতদ্রষ্টা, হয়তো সে চায়নি “দুইজন দেশ-শত্রুর” মেয়ের জীবনের সাথে উষ্ণহৃদয়ের আবেগপ্রবণ এই মানুষটিকে জড়িয়ে ফেলতে। অথবা হয়তো তার অনুভূতি পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল।
শেষপর্যন্ত মিখাইল ফিরে আসেন পেত্রোগ্রাদে। লাল ফৌজে যোগ দিয়ে
লড়াই করেন বলশেভিক বিপ্লবের পক্ষে। পরিচিত হন ভেরার সাথে। প্রেমে পড়েন আবার, জ্বলে
উঠে অনুভূতির দিদোনা-দাহ।
“আপনার
জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস কী?”
ভেরা প্রশ্ন করেন।
হৃদয়ে তার একটিই উত্তর শোনার উদগ্র কামনা, “আপনি।”
“অবশ্যই
সাহিত্য”- উত্তর
আসে।
এভাবেই সারা জীবন। বিয়ের পরেও সাহিত্যের চেয়ে বড় তার জীবনে আর
কিছু ছিলো না।
কিন্তু লাদা রয়ে যায় তার হৃদয়ের গহীনে লেখার অনুপ্রেরণা হয়ে। রয়ে
যায় জীবনের এক বড় ট্রাজিডি দেখার জন্য। শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র সবচাইতে শক্ততম মানুষটিকেও
যে ভেঙে ফেলতে পারে, তাই দেখার জন্য। অনেক বছর পরে যখন সন্ত্রাসের রোলার চলছিল সারা
দেশে এবং কোটি কোটি নিরীহ মানুষ হয়েছিল বন্দী ও নিগৃহীত, জস্সেন্কোকে কর্মসূত্রে যেতে
হয়েছিল দূরবর্তী কোনো শহরের গুলাগ বা শ্রমশিবিরে।
সেখানে নোংরা, ছেড়া ন্যাকড়া পরিহিতা, ক্ষুধার্ত, পাগলিনীপ্রায়,
অমানবিকতার প্রেতপ্রতিবিম্ব, লাদাকে চিনতে পারেন তিনি। বজ্রাহতের মত জিজ্ঞেস করেন তার
তিন সন্তানের কথা।
লাদা কিচ্ছু জানে না। কোথায় আছে ওরা, কী খবর, বেঁচে আছে কিনা।
সে কোনো অপরাধ করেনি, দেশের শত্রু বলে চিহ্নিত ও নিহত পিতা-মাতার সন্তান হওয়া ছাড়া।
কিন্তু সেই অতীত তার পিছু ছাড়েনি। অপরাধি সবসময়ই অপরাধি, ভালোমানুষ সবসময় ভালোমানুষ
নয়।
“একজন
গুলাগের নারীর গল্প” লিখতে
চেয়েছিলেন তিনি কিন্তু লেখেননি, ফায়ারিং স্কোয়াড নয়, জীবনকে বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু
ত্রিশের দশকের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক হয়েও শেষরক্ষা হয়নি। তার লেখা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে,
লেখক সংঘ ও সমস্ত প্রচারমাধ্যম থেকে বহিস্কৃত করে তাকে অনাহারে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া
হয়েছে। জীবনের শেষ দিনগুলো কেটেছে জুতো সেলাই করে। ১৯৫৮ সালের ২২ জুলাই স্ত্রী ভেরার
কাঁধে মাথা রেখে তিনি বলেছিলেন, “কী অস্বাভাবিক
ঘটনা ভেরা! সত্যিই অস্বাভাবিক, কীই না অর্থহীন একটা জীবন কাটিয়ে গেলাম।”
এই ছিল তার শেষ কথা।
লেনিনগ্রাদে যার জন্ম এবং জীবনের বেশিরভাগ সময় যার সেখানে কেটেছে,
পার্টির নেতারা তাঁকে সেই শহরে একটুকরো মাটি দিতে অস্বীকার করে লোকচক্ষুর অন্তরালে
দূরবর্তী সেস্ত্রারিয়েৎস্ক কবরস্থানে নির্বাসিত করেন। মহৎ লেখক ও মহৎ সমাজ, কী অনাতিক্রম্য
দূরত্ব তাদের মধ্যে!
——
তথ্যসূত্রঃ
আন্দ্রেই গনচারভ: জস্সেন্কো মিখাইল মিখাইলোভিচ- গদ্যকার, নাট্যকার ও অনুবাদক
পেরেস্ত্রোইকা, মস্কো
ও মধু
৫৪তম পর্ব
অভ্রের সাথে ১ সপ্তাহ সিঙ্গাপুরে কাটিয়ে নাস্তিয়া তার শহর রিজানে এসেছে গ্রীষ্ম কাটাতে। সে ওদের শপিংমলে হাঁটতে পছন্দ করে। বাল্যকালের স্মৃতিজড়িত শহর, আগের জৌলুশ আর নেই। মলের ভেতরে, করেডোরে বহু ছোট ছোট কিয়স্ক গড়ে উঠেছে, ফলে করিডোরগুলো আগের মত আর প্রশস্ত নয়। আগের মত শেলফগুলো এখন আর শূন্য নয়, নীচুমানের চাইনিজ পণ্যে ভরা। সে হাঁটছে বান্ধবি মাশাকে নিয়ে। আগে এখানে উৎসব উৎসব লাগতো কিন্তু এখন সর্বত্রই দৈন্য ও ধুসরতা।
একেবারে গায়ের ওপর এসে পড়ে এক যুবক। বিদেশি স্যুট কোট পড়া, চোখে
দামি ফ্রেমের কালো রোদ চশমা। রোদ এখানে নেই, কিন্তু চশমা অভিজাত্য দেয়।
পিওতর! পেতিয়া!
পেতিয়া ওদের লক্ষ্য করেনি। চেনামাত্রই উচ্ছ্বসিত হয়ে দুজনকেই জড়িয়ে
ধরে একসাথে, “স্তো
লিয়েত, স্তো জিম্!” (শতবর্ষ
ও শতশীত অতিক্রম করে আবার দেখা হলো।)
ওদেরই পাড়ার ছেলে, বছর দুয়েকের বড়, এক সাথেই বেড়ে উঠেছে, খেলা-ধুলা
করেছে।
দেখা হয়নি চার বছর।
পেতিয়াকে ওর ভালো লাগতো, ডিসকো নাচতো একসাথে। ধীরে ধীরে শুধু ভালোলাগা নয়, ভালোবাসতে শুরু করে। বয়স ছিল অল্প, মাত্র ক্লাস নাইনে পড়তো নাস্তিয়া। অনেক সময় কাটাতো একসাথে, হাঁটতো, ঘুরতো, গল্প করতো। কৈশোর ও যৌবনের সন্ধিস্থলের বয়েসটা এমন যখন মানুষ কথা বলে শব্দ করে, চিন্তা করে শব্দ করে, আর হাসে খল্ খল্ করে। ১৮ বছর বয়সে পেতিয়া বাধ্যতামূলক আর্মিতে চলে যায়, সেখান থেকে আফগানিস্তানে। তারপরে হারিয়ে যায়। নাস্তিয়া ওকে মিস করে। শেষপর্যন্ত চলে যায় মস্কোতে, ক্লাশ, পড়াশুনা ইত্যাদির ভিড়ে পেতিয়ার মুখটি অস্বচ্ছ হতে হতেও মুছে যায় না।
পেতিয়া ওদের ধরে নিয়ে যায়। বিশাল, সুন্দর এবং নতুন একটা বিদেশি
পাজেরো গাড়ি। নব্য রুশীদের ভিজিটিং কার্ড। ড্রাইভার দরজা খুলে দাঁড়ায়। একটা দামি রেস্টুরেন্টে
গিয়ে বসে। নাস্তিয়া লক্ষ্য করে রেস্টুরেন্টের সবাই পেতিয়াকে চেনে এবং সমীহ করে। অত্যন্ত
ভালো সার্ভিস দেয়। দামি ফরাসি শ্যাম্পেন সার্ভ করা হয়। নাস্তিয়া এলকোহলের বিশেষ সমঝদার
না হলেও বান্ধবি মাশা খুব উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে। নাস্তিয়ার জানতে ইচ্ছা করে পেতিয়া
এখন কোথায় কী করে?
পেতিয়া হাসে, “বলবো, আস্তে আস্তে বলবো, এত তাড়াহুড়া কী ?”
বলে, ব্যবসা করে।
“কী ব্যবসা?”
“নানান
ধরনের, কেনা -বেচা, ইম্পোর্ট-এক্সপোর্ট।”
পেতিয়া ওদের বাসায় পৌঁছে দেয়, নাস্তিয়া নেমে যায় আগে। মাশা নাস্তিয়ার
থেকে একটু বেশি চটপটে। সে এক অফিসে হিসাবরক্ষকের কাজ করে। ব্যবসায়ি জগতের সাথে তার
যোগাযোগ আছে। এই জগতে প্রচুর অর্থ, ক্রাইম, মদ ও সেক্স। সঠিক পুরুষ ধরতে পারলে তর তর
করে উপরে উঠে যাওয়া যায়। পেতিয়া সুপুরুষ, বোঝা যায় অর্থ প্রচুর, সম্ভবত ক্ষমতাও। নাস্তিয়া
যখন নস্টালজির ঘাস-ফুল মাঠে বিচরণ করে, মাশা চোখ দিয়ে চেটে পুটে খায় পেতিয়াকে।
“শাবাশ
পেতিয়া, তুমি আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সফল।”
পেতিয়া হাসে।
বাসার কাছে পৌঁছে সে পেতিয়াকে ডাকে, “চলো
চা খাবে আমার বাসায়।”
পেতিয়া রাজি হয় না, “আজ
নয়, আসবো একসময়।”
মাশা বিয়ে করে ঘর বাধার মত বন্ধু এখনও জোগাড় করতে পারেনি। ওর বস্ আসে মাঝে মাঝে চা খেতে, ফুল-পানীয় নিয়ে। মাশা আপ্যায়ন করে উদারভাবে, বস্ চলে যাবার পরে স্নান করে নেয় ।
রিজান শহরের ছায়ার জগতে মূলত: চারটি গ্রুপ রয়েছে। ব্লিনভ, খ্রেনভ, নাসিমভ ও মাগিলনিকভ গ্রুপ। এই গ্রুপগুলোর নিয়মিত "স্ত্রেলকা” বা মিটিং হয়। শহরের কোন্ এলাকা কোন্ গ্রুপের আওতায় থাকবে, তা নির্ধারিত হয়। এই "স্ত্রেলকা”র মাধ্যমেই সমস্ত বিতর্ক, বিরোধ ও বিচ্যুতিগুলোর সমাধান হয়। এই চলে এসেছে বহুদিন ধরে। কিন্তু সময় বদলায়, লোভের উত্তর-দক্ষিণ হয়, ভালো-মন্দের সংজ্ঞায় নতুন নর্ম আসে। ইদানিং মাগিলনিকভের লোকজন বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। তারা অন্যদের এলাকায় বখরা বসাচ্ছে। ফলে অন্ধকার জগতের ভ্রাতৃত্বে ফাটল ধরছে। সবাই, কেবল মাগিলনিকভ ছাড়া, জানে যে এটা খুবই বিপজ্জনক খেলা এবং দীর্ঘস্থায়ী রক্তারক্তির বন্দোবস্ত। আজকের মিটিংয়ে এ নিয়ে এস্পার ওস্পার হবার কথা ।
পেতিয়ার বস্ স্তুকানভ, নাদুস নুদুস কিন্তু গায়ে অসম শক্তির একজন মানুষ। সে নাসিমভের গ্রুপের দ্বিতীয় ব্যক্তি। শেভ করা কুমড়ার মত মাথা। দীর্ঘদিন শহরের মূখ্য বিচারকের ড্রাইভার হিসেবে কাজ করেছে পার্টির শাসনামলে। ক্ষমতার সামনের ও পেছনের প্রায় সবাইকেই সে চেনে ব্যক্তিগতভাবে।
মাগিলনিকভ প্রসিদ্ধ স্পোর্টস মাস্টার, তারও গায়ে শক্তি থৈ থৈ করে এবং সে প্রয়োজনের অতিরিক্ত রাগী।সে অপরাধ জগতের প্রতিষ্ঠিত পবিত্র আইন লংঘন করে সারা শহরের ওপর নিজস্ব কর্তৃত্ব স্থাপন করার দু:সাহস দেখাতে শুরু করেছে। কিন্তু তার এই ‘গা মানে না, আপনি মোড়ল’ মানসিকতার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী নাসিমভের সাথে মিটিং শুরু হবার কিছুক্ষণের মধ্যেই তর্ক বিতর্ক ও মারপিট শুরু হয়ে যায়। মাগিলনিকভ তার শরীরের অসম্ভব শক্তি ব্যবহার করে নাসিমভকে যথেচ্ছ পিটুনি দেয়। দুইগ্রুপের কর্মিদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে মারপিট। পেতিয়া ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর্মিতে উপযুক্ত ট্রেনিং সে পেয়েছে, শক্তি, সাহস এবং ক্ষিপ্রতায় সেও কম যায় না। অন্য দুই গ্রুপের কর্মিরা এদের থামাতে সক্ষম হলেও এই হয় রিজান শহরের সর্বশেষ স্ত্রেলকা এবং ক্ষমতার ভারসাম্যের অবসান। পেতিয়াদের জরুরি মিটিং হয়। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় রিজানে যুদ্ধ শুরু করার। ক্ষমতা কুক্ষিগত এবং সংহত করার যুদ্ধ।
যুদ্ধ চিরকালই ধরেই অতি প্রয়োজনীয়, কিন্তু নারী ও অপ্রয়োজনীয় নয়
কোনোকালে। সন্ধ্যায় সে ৯৯ টি লাল গোলাপের এক বিশাল বাস্কেট হাতে উপস্থিত হয় নাস্তিয়ার
দরজায়। রাশিয়ায় জীবিতকে ফুল দিতে হয় বেজোর সংখ্যায় আর মৃতকে জোর। ৯টি গোলাপ হলেই যেখানে
চলতো, ৯৯ টি গোলাপ সেখানে ওর সদ্যার্জিত আভিজাত্যেকে আরও উজ্জ্বল ও দৃষ্টিগোচর করে
তোলে।
নাস্তিয়ার মুখে ক্ষণিকের একটি আনন্দ অভিব্যক্তি অতিক্রম করে গেলেও সে নিজের
স্থৈর্য ধরে রাখে:
“তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে, পেতিয়া, এতগুলো ফুল দিয়ে
আমি কী করবো?”
“এতদিন
পরে তোমার সাথে দেখা, আমি তোমাকে খুব মিস্ করেছি নাস্তিয়া।”
“তাই বুঝি?”
“আমি
নিচে গাড়িতে অপেক্ষা করছি, চল কোথাও ঘুরে আসি।”
নাস্তিয়া তৈরি হয়ে নেমে আসে। ওরা গাড়ি করে শহর ঘুরে বেড়ায়। রিজান
ক্রেমলিনের পাশ দিয়ে গাড়ি চলে। পেতিয়া সংক্ষেপে তার আফগান নরক পার হয়ে আসার গল্প করে।
ওর সাথে যাওয়া বেশিরভাগ যুবকই ফিরে আসেনি। যারা এসেছে তাদেরও বেশিরভাগই জীবন্মৃত ও
পঙ্গু। সে সৌভাগ্যবান যে অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসতে পেরেছে। আসার পরে দীর্ঘদিন ছিল কর্মহীন।
কিছুদিন কাজ করেছে কিছু কমার্শিয়াল কোম্পানির সিকিউরিটি গার্ড
হিসাবে। তারপরে আস্তে আস্তে ব্যবসায় ঢোকে। সেই ব্যবসাই তাকে নিয়ে এসেছে যেখানে সে আজ।
সে নাস্তিয়াকে খুঁজেছে কিন্তু কোনো হদিশ করতে পারে নাই। নাস্তিয়ার
ইতিহাস সংক্ষিপ্ত কিন্তু সে-ও পেতিয়াকে মিস করেছে। শহর ঘুরে গতদিনের দামি রেস্টুরেন্টে
ডিনার করে ওরা। দুজনে শ্যাম্পেন শেষ করে এক বোতল, মূলত পেতিয়াই খায়, তবে নাস্তিয়াও
গ্লাস দুই পান করে। সে ফুর্তির ভাব অনুভব করে গায়ে। বাতাসে লেবু ফুলের ঘ্রাণে যে মাদকতা
থাকে তেমনি একটি বোধ।
একজন শিল্পী গান গাইছে। ডিম লাইটে নাচের ফ্লোরে নাচছে লোকজন। সবাই সুন্দর পোষাকপরা, দরিদ্র কেউ নাই। নব্যরুশী ব্যবসায়ি ও তাদের বন্ধু বান্ধবীরা। পেতিয়া ওকে নাচে আহ্বান করে। গান ও মিউজিকের ছন্দে ছন্দ মিলিয়ে ওর সারাটা সত্তা নাচে। প্রায় চল্লিশ মিনিট পাশাপাশি বা নিবিড় দ্বৈত নাচে পেতিয়ার সাথে কাটায়। ওর গায়ের গন্ধটা সে টের পায়। এখনও আগের মতই। সম্ভবত প্রতিটা মানুষেরই নিজস্ব যে গন্ধ আছে তা বদলায় না বা চলে যায় না। যদিও খুব নিবিড়তায় সে গন্ধ নিজ গায়ে মেখে নেয়ার আগেই পেতিয়া চলে গিয়েছিল।
তারপরে মস্কো। অভ্রের সাথে সিঙ্গাপুর। সে এখনও কোনো পুরুষের সাথে নিবিড়ভাবে মেশেনি। আজকের দিনে যা প্রায় অসম্ভব এবং অস্বাভাবিকও। ওর বান্ধবি মাশা স্কুলে থাকতেই ….,তবে কার সাথে, কখন, সে তা কোনোদিন বলেনি। ওটা ছিলো ব্যতিক্রম, পুরোনো মূল্যবোধে অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু ইচ্ছা যে তাকে পোড়াতো না, তা নয়, কিন্তু সে নিজেকে অতিক্রম করতে পারেনি। মা ও পুরানো কমিউনিস্ট এবং নীতিবোধ ঝরঝরে।
সিঙ্গাপুরে অভ্রের সাথে সে এক বিছানায় ঘুমিয়েছে কাকতালীয়ভাবে
কিন্তু কিছু ঘটেনি। সে-ই প্রয়োজনের তুলনায় বেশি অনমনীয়তা দেখিয়েছে। কিন্তু যখন সে
মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়েছে অভ্র তার ‘না’কে প্রয়োজনেরও চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে
আর কোনো উৎসাহ দেখায়নি। দেহ পায়নি, কিন্তু সে নাস্তিয়ার মন জয় করেছে। প্রায় ১ মাস হল
সে রিজানে, এমন কোনো দিন যায়নি, যেদিন সে অভ্রের কথা ভাবেনি। শুধু ভাবেনি, রক্ত মাংসের
সমস্ত শরীর দিয়ে সে অভ্রের স্পর্শ কামনা করেছে। মনে মনে সে সিদ্ধান্তও নিয়েছে মস্কো
পৌঁছেই সে অভ্রের কাছে যাবে এবং সিঙ্গাপুরের অপূর্ণতাকে পরিপূর্ণ করবে। অথচ পেতিয়া
এসে উপস্থিত ৯৯টি লাল গোলাপ নিয়ে।
ও যখন আর্মিতে চলে যায়, নাস্তিয়ার মনে হয়েছিল ওর মনে যে ডানা গজিয়েছিল
তা পেতিয়া কেটে নিয়ে গেছে সাথে করে। ওর খুব কষ্ট হয়েছে ভালোবাসার মানুষটিকে বিদায় দিতে।
ওর প্রথম যৌবনের স্বপ্নপুরুষ। সে এখন বড় ব্যবসায়ি। অবশ্য এখনও সে জানে না কত বড় এবং
ব্যবসাটা কী। কিন্তু সে জানে আজকের দিনে মানুষ কত ধরনের ব্যবসা যে করে তার কোনো ইয়ত্তা
নেই।
বিক্রেতা অসংখ্য, ক্রেতাও।
ওর পরিবার আজও অস্বচ্ছল। অবশ্য এ নিয়ে যে ওর কোনো দু:খ আছে, তা
নয়।
পেতিয়ার সাথে নাচতে ভালো লাগছে, এই যা। বেশ রাতে ওকে পেতিয়া বাসার
সামনে নামিয়ে দিয়ে যায়। সে জানতে পায় পেতিয়া এখনও বিয়ে করেনি। একাই থাকে তিন রুমের
এক ফ্লাটে, শহরের কেন্দ্রে। মাত্র কিছুদিন আগেই কিনেছে। পরেরদিন আবার অনেক ফুল, ডিনার
ড্রিন্ক ড্যান্স।
এই চলে প্রায় ১ সপ্তাহ।
নাস্তিয়ার মাথা ঘুরতে থাকে, সে বুঝেই উঠতে পারে না যে পেতিয়া তাকে
কিনে ফেলছে।
ঈশ্বরের ৬ দিন লেগেছিল পৃথিবী ও বিশ্ব সৃষ্টি করতে। পেতিয়ার ১দিন
বেশি লাগে নাস্তিয়াকে কিনতে। অথচ নাস্তিয়া সেটা বুঝতে পারে না। সে ভালোবাসা সত্ত্বেও
পেতিয়ার নিবিড়তার আহ্বানগুলোকে ‘না’
‘না’ করে ফিরিয়ে দিয়েছিল। তার ভেতরে নিভে
যাওয়া প্রেম উজ্জীবিত হয় নতুন করে। সে পেতিয়াকে আর না বলে না, এতদিন যা সযত্নে রক্ষা
করেছে তাই দিয়ে দেয়।
সব মানুষই বিক্রি হয়, কেউ কেউ বুঝতেই পারে না যে, সে বিক্রি হয়েছে।
বিশ্বব্যাপি বিপ্লবী নেতা-কর্মিরাও নাস্তিয়ার মত বিক্রিত হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা টেরই
পায়নি বরং কমরেডের প্রতি কমরেডের ভালোবাসা মনে করে ফ্রি টিকেটে মস্কোতে এসে ফ্রি চিকিৎসা
করে গেছে।
পেরেস্ত্রোইকা, মস্কো
ও মধু
৫৫ তম পর্ব
নাস্তিয়ার ইন্সটিটিউট খোলার সময় সময় ঘনিয়ে অসে, কয়েকদিনের মধ্যেই
সে মস্কোর ট্রেন ধরে।
পেতিয়া মাঝে মাঝে চলে আসে মস্কোতে ওর হোস্টেলে। রাত থেকে চলে যায়। ডিন অফিসে গিয়ে নাস্তিয়ার জন্য একক রুমের বন্দোবস্ত করে দেয়। পেতিয়া নাস্তিয়াকে অনেক দামি ডায়মন্ডের একটি আংটি উপহার দেয়। এ বছর ব্যবসা নিয়ে পেতিয়া খুব ব্যস্ত, কথা হয় পরের বছর তারা বিয়ে করবে। নাস্তিয়া খুব খুশি।
ফিরে আসার পর অভ্রের কাছে সে আর যায়নি। ইচ্ছা যে হয়নি তা নয়। কিন্তু
সে নিজেকে সংবরণ করেছে, জটিলতা বাড়াতে চায়নি। কিন্তু একদিন ওদের দেখা হয়ে যায়।
“নাস্তিয়া তুমি? কবে এসেছো?”
নাস্তিয়া উত্তর দেয়। অভ্র চট করে ওর কণ্ঠের পরিবর্তন ধরে ফেলে।
বলে "বাহ, সুন্দর আংটি তো, এনগেজমেনটের বুঝি?"
নাস্তিয়া হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ায়।
"অভিনন্দন, আমাকে জানাওনি কেন?"
অভ্র ওর জন্য যে অপেক্ষা করেছিল এবং ওর প্রতি খুব কোমল কিছু অনুভূতি
লালন করছিল তা চেপে যায় একটা নিঃশব্দ দীর্ঘনিঃশ্বাসের সাথে।
“তুমি
সুখী হও এই কামনা করি, দেখা হবে" বলে অভ্র হাঁটা ধরে।
নাস্তিয়ার বুকের ভেতরে একটা ঝড় ওঠে। ও নিয়ন্ত্রণ হারায়, কেমন কান্নার
মত মুখ থেকে বের হয়ে যায়, “অভ্র!”
অভ্র ঘুরে দাঁড়ায়, ফিরে আসে, “কিছু বলবে?”
“প্রাস্তি!” (তুমি আমাকে
ক্ষমা করো)
“কিসের ক্ষমা? কেন?”
নাস্তিয়া বেখেয়াল হয়ে যায়। তাদের মধ্যে মৌখিক হৃদয়ের আদান প্রদান
হয়নি, কিন্তু সে অভ্রকে ভালোবেসে ফেলেছিল। যদিও অভ্র মুখে কিছু বলেনি, ওরও মনে হয়েছে
অভ্র ওর প্রতি উদাসীন নয়। ওর সিঙ্গাপুরের একসাথে কাটানোর মুহূর্তগুলো মনে পড়ে। শপিংমলে
জোর করে বিকিনি ও অন্তর্বাস কিনে দেয়া, একই বিছানায় আধশোয়া পাশাপাশি গল্প করা, হাত
ধরে অর্কিড দেখা, সেন্টোসা দ্বীপের রৌদ্র-স্নান।
মাত্র ১ মাস আগের কথা। কী অসম্ভব যত্ন ও মনোযোগ দিয়েছে ওর প্রতি।
নাস্তিয়া চুপ করে তাকিয়ে থাকে অভ্রের দিকে। ইচ্ছে করে ওর বুকের সাথে মিশে যেতে। গত
একমাসে রিজানে বসে এই আকাংখাটাই অসম্ভব তীব্র ছিল ওর মধ্যে। কিন্তু সব কেমন ওলট পালট
হয়ে গেল। পেতিয়া ওর জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। সে আফগানিস্তানে মারা যেতে পারতো, কিন্তু
ফিরে এসেছে, সে তাকে না বলতে পারেনি। না বলতে পারেনি কারণ সে পেতিয়াকে ভালোবাসতো। অভ্রের
দীর্ঘনিঃশ্বাস চেপে যাওয়া এবং দৃঢ় আত্মসংবরণ ওর চোখ এড়ায়নি। সেটা ওর মধ্যে জন্ম দিয়েছে
আরও অস্থিরতার। সে জানে, অভ্র নিজেকে কখনো সস্তায় বিক্রি করে না। সে তার নিজস্ব সীমানা
সম্পর্কে ভীষণ সচেতন। কারো অধিকারে হস্তক্ষেপ করবে না, পিড়াপীড়ি করে আদায় করবে না।
রিজানে চলে যাবার সময় সেই বলে গিয়েছিলো এবার কষ্ট হবে অভ্রকে ছাড়া, অথচ
......
নাস্তিয়ার চোখ ভিজে আসে।
ও আসলেই জানে না কাকে চায়, পেতিয়াকে, না অভ্রকে। একজন মানুষ কি
একই সাথে দুজনকে ভালোবাসতে পারে? ওর নিজেকে গহীন জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া মানুষের মত হয়।
ইচ্ছে হয় প্রশ্নটির উত্তর জানতে।
অভ্র বলে, “শোনো মন খারাপ করো না, আমি সত্যই খুশি তোমার জন্য, তুমি অসম্ভব ভালো, তুমি সুখি হবে, আমি জানি।”
রিজানে নাস্তিয়ার প্রিয় বান্ধবি মাশা পেতিয়াকে জয় করার জন্য উঠে
পড়ে লাগে। কিন্তু খুব পরিশ্রম করতে হয় না, পেতিয়া গির্জার পাদ্রি নয়। তার কাজে প্রাপ্তি
যেমন, টেনশন এবং জীবনের ঝুঁকিও তেমন। নারীসঙ্গ হচ্ছে সবচেয়ে কার্যকর টেনশনমুক্তির উপায়।
সে মাশাকে নিয়ে মাঝে মধ্যে সময় কাটায় নিজের বাসায়। মাশাকে বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয় না।
সে নিজেই মাছির মত ডাক ছাড়াই আসে। একদিন মাশার সাথে সময় কাটানোর সময়ই ফোন বেজে ওঠে।
তড়িঘড়ি এক অপারেশনে যাওয়ার ডাক আসে। পথে মাশাকে বাসস্টপে নামিয়ে দিয়ে ওর গাড়ি ছোটে
তীরের বেগে চাপায়েভ স্ট্রিটের দিকে। দলবল নিয়ে হানা দেয় মাগিলনিকভের "বানিয়া"য়
যেখানে তার গ্রুপের কর্মিরা স্নান করার ফাঁকে ফাঁকে আনন্দ ফুর্তি করছিল ভদকা, ক্যাভিয়ার
ও নারীর শুশ্রষায়। মাগিলনিকভ সেখানে ছিল না অথবা থাকলেও পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ওরা
অপ্রস্তুত, পূর্ণ ও অর্ধ দিগম্বর মাগিলনিকভ-ছানাদের আচ্ছা করে উত্তম মাধ্যম করে।
বিষয়টির মিটমাট এখানেই হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু কেউটের বিষ দংশনের
আগে ধন্য হয় না।
একরাতে বড় এক ফ্যাকটরির ‘বার'
এবং ডিসকো হলে মাগিলনিকভের লোকজন ফুর্তি করছিল।
সেখানে ৫ জন কিলার পাঠানো হয়, পেতিয়া বাইরে থেকে অপারেশনের তদারকি করে। হঠাৎ বৈশাখের শিলা বৃষ্টির মত গুলি চলতে শুরু করে ভেতরে, ১১ জন সাথে সাথে মারা যায়, ১৩ জন আহত হয়। মাগিলনিকভের বিড়ালের প্রাণ, বড় একটা স্তম্ভের আড়ালে লুকিয়ে এবারও রক্ষা পায়।
সে কঠিন প্রত্যুত্তর নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। স্তুকানভের বস্ ও গ্রুপের
প্রতিষ্ঠাতা নাসিমভকে হত্যা করে।
স্তুকানভ নাসিমভের মৃত্যুকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে শহরে তার শক্তি
প্রদর্শনের বন্দোবস্ত করে।
ঢাক-ঢোল পিটিয়ে শহরের সবচেয়ে বড় গির্জায় নাসিমভের সৎকার প্রক্রিয়ার
বিশাল আয়োজন করে। মাগিলনিকভ সিদ্ধান্ত নেয় স্তুকানভের মূল লোকজন যখন গির্জার ভেতরে
থাকবে, শক্তিশালি বোমা মেরে পুরো গির্জাটিই উড়িয়ে দেবে ভেতরের লোকজনসহ।
গির্জা উড়ানো নতুন কোনো ঘটনা নয় রাশিয়ায়। বলশেভিকরা বহু গির্জা
উড়িয়েছে একসময়। এখন বলশেভিকদের উৎখাত করা হয়েছে কিন্তু ট্রেডিশন কি সহজে মরে? স্পার্তাক
ফুটবল টিমের একজন শ্রেষ্ঠ ফুটবলার পার্টটাইম মৃত্যু-ফেরির চাকরি করে। ব্রিফকেসের ভেতরে
শক্তিশালি বোমা নিয়ে চার্চে ঢোকার কথা তার। কিন্তু যে ঈশ্বর নাই, তার চোখ আছে। হোক
ঠগ, বদমাস, ডাকাত ও মাফিয়ার বাসা, সে চায় না গির্জাটি ধ্বংস হোক। বরং ফেরেশতাদের পাঠিয়ে
দেয়। গির্জায় ঢোকার ১৫০ মি. দূরে থাকতেই বোমাটির বিস্ফোরণ হয়। এবং সে যাতে আর ফুটবল
খেলতে না পারে, সেই উদ্দেশ্য নিয়ে ফেরেশতারা ওর দুটো পা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। পেতিয়াসহ
স্তুকানভের শিষ্যরা গির্জা থেকে ছুটে আসে।
মুমুর্ষ খুনী গোঙিয়ে গোঙিয়ে সাহায্য চায়।
পেতিয়া বলে, “তোকে
কে পাঠিয়েছে বল, এম্বুলেন্স ডাকবো।”
কিন্তু খুনী পেতিয়ার কথা অমান্য করে মারা যায়, কিছু না বলেই।
স্তুকানভ মাগিলনিকভকে হত্যার নীল নক্সা এঁকে ওর নিরীহ, অপরাধ জগতের
বাইরের অতি ছা-পোষা সোভিয়েত নাগরিক ছোটভাইকে হত্যা করার দায়িত্ব দেয় পেতিয়াকে। আফগান
বীর পেতিয়া কাজটি সম্পন্ন করে সুচারু রূপে। প্ল্যান ছিল মাগিলনিকভ যখন ভাইয়ের সৎকারে
আসবে এবং তখনই তাকে কতল করা হবে। কিন্তু মাগিলনিকভ অনুপস্থিত থাকে। সে ভ্রাতৃহত্যার
প্রতিশোধ নেয় অন্যভাবে। স্তুকানভের এক ডান হাতকে দিনে দুপুরে তার অফিসে হত্যা করে।
এরপরে তারা স্তুকানভকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে লঞ্চ স্টেশনের রেস্টুরেন্ট উড়িয়ে দেয়ার
পরিকল্পনা করে, কিন্তু ব্যর্থ হয়। রিজান শহর আফগানিস্তানে পরিণত হয়। সাময়িকভাবে মাগিলনিকভের
পাগলা কুকুরের ক্ষিপ্ততার কারণে স্তুকানভ গ্রুপের সবাইকে আত্মগোপনে যেতে হয়। তা সত্ত্বেও
পেতিয়ার ব্যস্ততার শেষ নেই। এরই মাঝে সময় বের করে বলশেভিক বিপ্লবীদের মত এ পথ ও পথ
ঘুরে চলে আসে মস্কোতে। পাজেরো রেখে আসে অন্যত্র। সচরাচরের মত অনেক ফুল নিয়ে এসে রাতে
নাস্তিয়ার হোস্টেলে থেকে যায়।
নাস্তিয়া ওর প্রথম ভালোবাসা।
সে আফগানিস্তানের পাহাড়েদের মাঝে, বুলেট ও বারুদের নরকে কল্পনা
করেছে নাস্তিয়ার কচি মুখ।
মৃত্যু হাঁটতো মাইল নয়, মাত্র কয়েক গজ দূরে। সামনে, পেছনে, ওপরে,
নীচে, পাশে যে কোনো দিক থেকে কামড় দিতো দাঁতালো কুমিরের মত। এক যুদ্ধে মুজাহিদিনদের
আক্রমণ ওরা শুধু প্রতিহত করতেই সক্ষম হয়নি বরং ধ্বংস করে দেয় সম্পূর্ণরূপে। কিন্তু
মাত্র দুজন ছাড়া ওদের গ্রুপের সবাই নিহত হয়। সে গুরুতরভাবে আহত হয়, সুস্থ হয়ে বীরের
পদক পায়।
ও জানতো যে সে মারা যাবে। কোনো দুর্গম পাহাড়ে নিভে যাবে ওর জীবন
প্রদীপ। আফগানিস্তান তার দেশ নয় এবং কেন তাকে সেখানে জীবন দিতে হবে, সেই প্রশ্ন করা
যেতো না। অথচ স্কুলে থাকতে যখন সে গৃহযুদ্ধ ও মহান পিতৃভূমির যুদ্ধের বীরদের সম্পর্কে
পড়তো, সে ভাবতো বড় হয়ে দেশের প্রয়োজনে সেও প্রাণ দেবে। পাহাড়ে বসে তারকাখচিত আকাশ মনে
হতো খুব কাছে। সেই আকাশে কত শান্তির হাতছানি রিজানের আকাশের মতই। দ্রুত উড়ে যাওয়া তুলো
পেজা মেঘ, ছোট ছোট খণ্ডে।
সেই মেঘেদের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিত চাঁদ আর একটি মুখ, নাস্তিয়ার,
মাত্র ১৬ বছর বয়সের কচি, রিজানের মাঠের ফুলেদের মত সুন্দর ও পবিত্র। সে মাতৃভূমির মুখ
দেখতে চাইতো কিন্তু দেখতে পেতো না, মাতৃভূমির মুখ তখন ক্ষয়রোগে ফ্যাকাশে। নাস্তিয়ার
জন্যই সে মরে নাই।ফিরে এসেছে নিজ পায়ে হেঁটে। সাথে ছিলো যারা তাদের বেশিরভাগই এসেছে
কফিনবন্দী হয়ে। এসে দেখে এখানে সব কিছু উবে গেছে কর্পূরের মত । আগের দেশ নেই। আগের
ডিসিপ্লিন নেই।
নেতারা ব্যবসায়ি …. যে ব্যবসা, সে চলে যাবার আগে ছিল অবৈধ ও অপরাধ। জীবন আফগান মুজাহেদিনদের চেয়েও হিংস্র। কী কষ্টটাই না করতে হয়েছে তাকে সেই নতুন, অপরিচিত দেশে, পায়ের নীচে মাটি অনুভব করার জন্য। নাস্তিয়াকে খুঁজেছে, নাস্তিয়া যেন মাটি ফুঁড়ে নিঁখোজ হয়ে গেছে।
মাগিলনিকভের কিলারেরা চোখ রেখেছিলো ওর ওপর। নাস্তিয়ার দুর্ভাগ্য,
সে দুজন পুরুষকে ভালোবেসেছে। ভালোবাসা একটা বোধ, দেখা যায় না, মাপা যায় না, কিন্তু
সমাজ দেখে শুধু দুইজন পুরুষ। দু’জনকে
ভালোবাসে যে, সে নষ্ট নারী। শুধু দ্রৌপদী ব্যতিক্রম। ৫ জনকে ভালোবাসা ২ জনকে নয়। এই
বিষয়টিও মিটমাট বা প্রতিষ্ঠিত করার সময় হয়ে ওঠে না, পরেরদিন প্রত্যুষে বুলেট ঝাঁঝরা
অবস্থায় পাওয়া যায় ওদের দুজনকেঃ নাস্তিয়া এবং পেতিয়া। একজনের প্রোদ্ভিন্ন প্রসূন প্রেমিকের
হৃদয়, অন্যজন প্রাক্তন আফগান বীর এবং বর্তমান রিজানের ডাকাত ও কিলার। কিন্তু নাস্তিয়া
তা জানতো না। সে পেতিয়াকে ভালোবেসেছিল, সেই কৈশোরে, স্বপ্ন দেখেছিল ওর সাথে ঘর বাঁধার।
তাই অভ্রের প্রতি অনুভুতির পাপড়ি মেলা সত্ত্বেও সে তা অবদমিত করেছিল স্বেচ্ছায়। তার
মন দ্বিচারী হয়েছিল, কিন্তু সে ছিল একজন সোভিয়েত, সরল, স্বপ্নচারী দিভা। যদি সে অভ্রের
কাছে যেতো, হয়তো বেঁচে থাকতো এবং একগুচ্ছ সুন্দর সন্ততির মা হতো।
ওরা রিজানের মাঠে ছুটে বেড়াতো, কে জানে, হয়তো এক এক জন সুন্দর
সের্গেই ইয়েসিনিন হয়ে।
কে চেনে রিজান শহরকে? অথচ সারাবিশ্ব চেনে এই রিজানের মাঠ ও তার
অতিমানব শিশু সের্গেই ইয়েসিনিনকে।
ইয়েসিনিন-প্রকৃতির সংগীত। ইয়েসিনিন-প্রেম ও মানবতার জয়গান। ইয়েসিনিন-অনুভূতির
অশ্রু ও হাহাকার!
চলবে
0 মন্তব্যসমূহ