আমার বুকের ভেতরে যে ঘন্টাধ্বনি বাজে তা কোন এক পুরানো মন্দিরের। আমার শ্বশুরকে একথা বলার পর তিনি তাঁর ঘোলাটে, পাংশুটে চোখ তোলে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন তোমার শাশুড়ি তোমাকে কিছু বলেছে?
এই ঘন্টাধ্বনি আমি প্রথম যখন শুনি, তখনও আমার বিয়ের বছর ঘুরেনি। পুরুষসঙ্গ, নিজস্ব একটা সাম্রাজ্য পাওয়ার ঘোর মেলা থেকে কিনে আনা চরকির মতো আমাকে ঘিরে বিচিত্র রঙে ঘুরছে। আমি কখনো জামানের সোহাগের গোলাপী ঘুর্ণন দেখি, কখনো প্রথম সন্তান ধারণের লাল চক্র দেখি, কোনটা রেখে কোনটা বেশি কাঙ্ক্ষিত সিদ্ধান্ত নিতে পারিনা। গর্ভে গহীন তখন সবে আটাশ সপ্তাহ পার করেছে। প্রতি সপ্তাহে গাইনি ডাক্তারের চেম্বারে যাই, প্রেসার ডায়াবেটিস বাচ্চার পজিশন সব ঠিকঠাক। তবু হঠাৎ একদিন মাঝরাতে কেমন ঢং ঢং ঘন্টাধ্বনিতে ঘুম ভেঙে যায় আমার। আমি ধড়ফড়িয়ে উঠে বসতে চাই, সাত মাসের ভ্রুণ ধারণ করা উদর আমাকে দ্রুত উঠে বসতে দেয়না। দুহাতে ভর দিয়ে বিশেষ কসরতে উঠে বসতে মিনিট কয়েক সময় লেগে যায়। বুকের ধড়ফড়ানি কমে না, মনে হয় খুব কাছে ঘন্টা বাজছে ঢং ঢং...।
ঢাকার অভিজাত পাড়ার সুসজ্জিত ফ্ল্যাটের নিঝুম নিস্তব্ধতায় আমি কান পাতি। এবং আবিষ্কার করি, বাইরে কোথাও নয়, এ ঘন্টাধ্বন বাজছে আমারই বুকে। পরের একমাস আমি টের পাই বুকের ভেতরে এই ঘন্টাধ্বনি যখন তখন বেজে ওঠে। এবং তা মোটেই সুখকর অভিজ্ঞতা নয়। কেমন নদীর পাড় ভাঙার মতো অকল্যাণ আর কালবৈশাখী ঝড়ে টিনের চালে আমগাছের ডাল উড়ে আসার মতো আতঙ্কের আভাস । তারপর বত্রিশ সপ্তাহ পার হতে না হতেই প্রিম্যাচ্যুর গহীনের জন্ম। আমাকে আর গহীনকে নিয়ে যমে মানুষে টানাটানি। ইনকিউবেটর থেকে গহীন আমার কাছে বেঁচে ফিরবে কেউ বলেনি। কিন্তু গহীন এসেছিল, আমার আকুল উৎকণ্ঠা আর অপেক্ষার আকাশ আলো করে গহীন একদিন আমাকে মা ডেকেছিল। সেই থেকে বুকের ভেতরের এই ঘন্টাধ্বনিকে আমার বড়ো ভয়। আমি জানি বুকের ভেতর এই ঘন্টাধ্বনি মানেই কোন না কোন অমঙ্গলের অশনিসংকেত।
আমি যে এলাকায় জন্মেছি বড় হয়েছি তার ত্রিসীমানায় কোন মন্দির ছিল না। ইনফ্যাক্ট আমি বড় হয়েছি আমার বাবার কর্মসূত্রে সরকারি কোয়ার্টারে, প্রতিটি কম্পাউন্ডের ভেতরে মসজিদ থাকলেও কোন মন্দির ছিলনা। আমি কোনদিন মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি শুনিনি। কিন্তু বুকের ভেতরে বেজে ওঠা শব্দটাকে কি করে মন্দিরের সাথে যোগসূত্র তৈরি করলাম আমি জানিনা। তবে শ্বশুরের কথায় মনে হলো বলার মতো আসলেই তবে কিছু রয়েছে যা আমি জানিনা।
বিয়ের পরে শাশুড়িকে আমি পেয়েছি তিনমাস। মৃত্যুর আগে তিনমাস। ক্যান্সারের শেষ স্টেজের রোগী। তিনি আমাকে বিশেষ কিছু বলার সুযোগ পাননি। বাবা মানে শ্বশুরকে কয়েকদফা জিজ্ঞেস করে উত্তর পাইনি। আর জামানকে জিজ্ঞেস করে পেয়েছি ধমক, আমি কি করে জানবো, এতো কৌতূহল কেন তোমার।
চিরকালই আমার কৌতূহলটা একটু বেশি। বড়দের কথা হা করে গিলতাম বলে মায়ের কতো চড় থাপ্পড় খেয়েছি! শুধু গিলতামই না, অবিবাহিত কোন মেয়ের প্রেগন্যান্সির খবর ফিসফিসানির কারণে না বুঝলে পাড়ার মহিলাদের ভরা মজলিসে 'মা মলি আপুর কি হয়েছে', 'মা মলি আপুর কি হয়েছে' জাতীয় অপ্রস্তুত প্রশ্নে সবাইকে বিব্রত করে দিতাম। আহা মলি আপুটা। ইউ এন ও আংকেলের ভাতিজি। কোয়ার্টারের সব মেয়েদের মধ্যমণি। মেয়েদের যে একটা সময়ে পিরিয়ড হয় মলি আপুর কাছ থেকেই আমার প্রথম জানা। কি করে বাচ্চা পেটে আসে, ভাদ্র মাসে কুকুরগুলো কেন একটা আরেকটার উপরে উঠে পড়ে, ইত্যাদি কতো নিষিদ্ধ ঝাঁপি যে মলি আপু আমাদের সামনে খুলে ধরতেন, সেসব ফুঁ দেওয়া বাবলের মতো অজস্র রঙিন বুদবুদে আমাদের কৈশোরকে রাঙিয়ে দিতো। একদিন সেই মলি আপুকে নিয়ে কোয়ার্টারের চারদেয়ালে কি কানাকানি-ফিসফিসানি। তারপর বাবলের বুদবুদের মতোই মলি আপুটা একদিন কোথায় হারিয়ে গেল, আর ফিরে এলোনা। মলি আপু চলে যাবার পরও এসব কানাকানি ফিসফিসানি অব্যাহত ছিল বেশ কদিন৷
ম্যাডাম...ম্যাডাম...লোকটা কি আপনাকে ডাকছে ? কেউ রাস্তার ওপাশ থেকে কাউকে ডাকছে। কাশেম আমাকে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হতে চায়, আমাকেই কিনা। রাস্তায় তখন মধ্যদুপুরের জ্যাম। মাথার উপর অসহ্য চড়া রোদ। আমি আই পি জি এম আরের সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আপেল আর কমলা দরাদরি করছি। কেজিতে মাত্র দশ টাকা কম দেবো বলেছি, তাতেই বিক্রেতা সকল মনোযোগ অন্য ক্রেতার দিকে ফিরিয়ে নিয়েছে, ক্লাসের সবচেয়ে নীরব শান্ত ছাত্রটির মতো আমাকে পাত্তাই দিচ্ছে না।
অথচ এপার্টমেন্টে দজ্জাল মহিলা হিসাবে আমার বিশেষ খ্যাতি আছে। নিজেকে নিজে এভাবে দজ্জাল বলছি বলে পাঠক হাসছেন। বিশ্বাস করেন আমি দজ্জালই। ননদের গায়ে হাত তুলেছিল বলে নিজে পুলিশ নিয়ে গিয়ে ননদের জামাইকে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া দজ্জাল মহিলা। কাজের বুয়া আর ড্রাইভারদের সামান্যতম ফাঁকি ধরে ফেলতে পারার মতো দজ্জাল মহিলা। বুয়া হঠাৎ ফুরিয়ে যাওয়া প্রেসারের ওষুধ আনতে গেলে লিফটে ওঠার আগে যে অন্য বুয়াদের কাছে আমার গোষ্ঠী উদ্ধার করে আসে আমি জানি। আমি এও জানি অবসরের ফাঁকে মিথ্যা অজুহাতে ছুটি না পাওয়া আমার ড্রাইভার আমাকে ডাকে খানে দজ্জাল।
আর এই খানে দজ্জাল মহিলাটিকে তারা কতোটা নির্ভর করে আমি তাও জানি। পোয়াতী মেয়েকে হাসপাতালে ভরতি না নিলে দৌড়ে আমার কাছে আসে, কিংবা কাশেমের রক্ত পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়লে বাড়িতে জানানোর আগে আমাকেই জানায়। আর আমিও খানে দজ্জালের মতো হাসপাতালে ছুটে গিয়ে ঝগড়াঝাটি বাঁধিয়ে মেয়েকে সিট পাইয়ে ডেলিভারি করিয়ে কিংবা জামানের সাথে ঝগড়া করে নিজের ফ্ল্যাটের গেস্টরুম ড্রাইভারকে ছেড়ে দিয়ে ওষুধ পথ্য নিশ্চিত করি।
কারো কোন উপকার করলে তার মুখে অনুচ্চারিত যে কৃতজ্ঞতার হাসিটি ঝুলে থাকে আমার কাছে এ বড়ো আনন্দের উৎস। কিন্তু আমার এই আনন্দের উৎস জামানের কাছে উটকো ঝামেলা। কিন্তু বাঁধা দিতে এলেই আমি খানে দজ্জাল মহিলার রূপ নেই। গৃহশান্তির লক্ষ্যে হোক কিংবা আমার এসব অগুরুত্বপূর্ণ কাজ নিয়ে অশান্তি করার দরকারই নেই , কি ভেবে কিজানি আমার খানে দজ্জাল রূপ দেখেই জামান চুপ করে যায় বরাবর।
রিকশার ক্রমাগত ক্রিং ক্রিং, বাসের হেল্পারের 'প্রেসক্লাব...প্রেসক্লাব...' চিৎকার, সহস্র মানুষের সহস্র কথা, প্রয়োজনীয়, অপ্রয়োজনীয়। সব ছাপিয়ে লোকটির আফা...আফা...ডাক আমার কানে পৌঁছানোর কথা নয়। কাশেম আবার আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিশ্চিত করে, ম্যাডাম আপ্নেরেই ডাকে। আমি সেকেন্ড খানেক কাশেমের দিকে তাকিয়ে, লোকটির দিকে তাকাই। রেলের জানালায় দেখা ইলেক্ট্রিক পিলারের মতো ভীড়ের আড়ালে হারিয়ে যেতে থাকা আবার উদয় হতে থাকা লোকটি কাউকে যে ডাকছে এটা নিশ্চিত। তবে সে আমাকে নয় এও নিশ্চিত। কারণ আমি তাকে চিনিনা।
কয়েক মূহুর্ত স্থির হয়ে আমি আবার আপেলবিক্রেতার দিকে তাকাই, দজ্জাল চেহারা বের করে ধমক দেই, এই মিয়া, কথা কানে ঢোকেনা? আপেল দেবেন কিনা বলেন না কেন? টের পাই কাশেম মনে মনে হাসছে। সে সব জানে বলেই হাসছে৷ ইতোমধ্যে যে দুইবার জামান দুর্নীতি দমন কমিশনে হাজিরা দিতে গেছে, দুবারই কাশেমকে নিয়ে গেছে। ফলে জামানকে নিয়ে যে এখন ব্যাংকপাড়া কতোটা উত্তপ্ত কাশেম জানে, কাগজেপত্রে যেসব অভিযোগ নথিভুক্ত সেগুলোও কাশেম জানে, গাড়িতে বসে ফোনে জামান একে ওকে অনর্গল এসব বলে যায় আর কাশেমের সব জানা হয়ে যায়। তাছাড়া পত্র পত্রিকা, টকশোতে যা আলোচনা হয়,যা সবার মতো আমি জানি এবং শুনি তাও সে জানে। পার্থক্য এই যে এগুলো শুনতে শুনতে জানতে জানতে আমি তাজ্জব হই, কাশেম হয়না বরং প্রসঙ্গ ওঠলে ফ্ল্যাটের অন্য ড্রাইভারদের থোঁতামুখ ঠিক ভোঁতা করে দিয়ে আসে। ওর মনিবভক্তি প্রশ্নাতীত।
আমি বরং ভেবে কুল পাইনা, একি এই জামান? প্রতিদিন যে আমার পাশে শোয়? আমার গায়ে হাত দেয়, ব্লাউজের হুক খুলে...! তার নিউইয়র্কে দুটি বাড়ি কেনা আছে! শতকোটি টাকা আমেরিকায় বন্ধুর সাথে শেয়ার ব্যবসায় ইনভেস্ট! যে ব্যাংকের পরিচালক সে, সেই ব্যাংক দেউলিয়া! টক শোতে সরকারি দলের নেতা আর এক তুখোড় ব্লগার কি নিয়ে যেন তুমুল ঝগড়া করে শেষের দিকে জামানের দুর্নীতির ব্যাপারে একমত হয়ে যায়। আমার কাছে সব রূপকথা মনে হয়। জামান বসে বসে নির্বিকার দেখে আর আমি বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করি, সত্যি তুমি এসব করেছো? কার জন্য? জামান ক্ষেপে উঠে। আমার জন্য, আমার। আমার। তার শেষ আমার টা যেন ফ্ল্যাটের ছাদ ফুঁড়ে সবাইকে জানান দিতে যায়, জামান সত্যি শত কোটি টাকার মালিক।
কাশেম হয়তো মনে মনে ভাবে যার সাহেব এতো টাকার মালিক সে কেজিতে দশ টাকা দাম কমানোর জন্য আপেল কমলা কিনতে এতো দরাদরি করে? কিজানি কেন করি? জামান আমার হাতখরচার টাকা কমতো দেয়না। যা চাই তাই দেয়। আমাকে আত্মনির্ভরশীল নারী হবার জন্য চাকরি বাকরি খুঁজতে হয়নি। জামানের কাছ থেকে টাকা নিতে আমার মর্যাদায়ও লাগে না। ঘরে বৃদ্ধ শ্বশুর,তাঁর দেখভাল, যমজের মতোই প্রায় বছরের এমাথা ওমাথা বাচ্চা। আমার চেয়ে কাজের বুয়ারা ওদের ভালো দেখভাল করবে? প্রয়োজন হলে করতাম নিশ্চয়ই। জামান করতে না দিলে দজ্জাল মহিলার মতো ঝগড়া করে হলেও অধিকার আদায় করতাম।
লোকটি রাস্তা পার হয়ে এবার আমার গাড়ির জানালার বন্ধ কাঁচে চুপি দেয়, আপেল বিক্রেতা তখনো আমাকে পাত্তা দেয়নি। লোকটি এসে আমার জানালায় উপুড় হয়ে দাঁড়ায়। আমি তখনও ক্রুদ্ধ স্বরে আপেলবিক্রেতাকে বলে যাচ্ছি, না পারলে না বলেন না কেন? কাশেম এবার আমাকে নিশ্চিত করে লোকটি আমাকেই ডাকছে। আমি লোকটিকে ইশারা করি ডানপাশে আসার জন্য। ঘুরে আসার মিনিটখানেকের মধ্যে আমি স্মরণের এমাথা ওমাথা উল্টেপাল্টে ফেলি সাপলুডুর পা থেকে মাথা পর্যন্ত, মাথা থেকে পা। স্মৃতির গলি ঘুপচি। না, এই লোকটিকে কখনো কোথাও দেখেছি বলে মনে করতে পারিনা। পোশাকআশাক দেখে প্রথমটায় সন্দেহ হয়, লোকটি কি আমার কাছে কোন সাহায্য চায়? আমার শ্বশুরবাড়ির গ্রামের দিকের কোন আত্মীয়স্বজন? একে কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ছে না তো!
শ্বশুরবাড়িতে আবার আমার অনেক সুনাম। বছরে দুবার ঈদ করতে গেলেই শ্বশুরভিটার এল প্যাটার্নের বিল্ডিংয়ের দরজা খোলা হয়। গায়ের প্রতিবেশীদের বউ ঝিয়েরা আগেই সব ধুয়ে মুছে পরিস্কার করে রাখে। আমার পছন্দের টাকি মাছ ভর্তা আর ধনেপাতায় বাতাসী মাছ রান্না হয়। ঈদ যেদিনই হোক, আমি যেদিন যাই সেদিন থেকেই শুরু হয়ে যায় পাড়া পড়শিদের ঈদ। আমি ব্যাগ থেকে ক্লজেট খালি করা পুরানো কাপড়চোপড় খুলি, আর শুরু হয় তাদের কাড়াকাড়ি। আমি বিব্রত চোখে দেখি। এদের খুশি করা কতো সহজ। আসার সময় বড়জোর হাতে শ দুইশ টাকা ধরিয়ে দেওয়া। আর কালেভদ্রে শহরে আমার অভিজাত ফ্ল্যাটের ম্যাট জুতা দিয়ে মারিয়ে দিলে, আমার নতুন কেনা ওভেনের উপরে ভারি ব্যাগটা রেখে দিলে একটুও বিরক্ত না হওয়া, দুপুরে খাবার টেবিলে আরেকটু নেন আরেকটু নেন বলে টেবিলে যা সাজানো থাকে তাই সাধাসাধি করা। ওরা এতেই কৃতার্থ হয়ে নিজের মেয়েকে অনায়াসে দিয়ে যায় আমার বাসায় গৃ্হস্থালীতে সাহায্য করার জন্য। বাজার সওদা করার জন্য ছেলেকে। ওদেরকে রাখার সময় আমার ব্যবহারে থাকে বিনয়, এতো ওদেরই বাসা। নিজের বাসা মনে করে থাকুক। স্বার্থ আমারও থাকে, ওদেরও। কিন্তু ওরা আমার ভূমিকাকে দেখে গভীর মহানুভবতা হিসাবে৷
সালমাও এভাবেই এসেছিল। অনেকটা হুমায়ুন আহমেদের বহুব্রীহি নাটকের আবুল খায়েরের মতো একদিন দুপুরে গফুর মিয়া মেয়ে নিয়ে এসে হাজির। বউ মারা গেছে চারমাস। গ্রামের মেয়েরা কৈশোরেই যুবতী হয়। কতো হবে তখন সালমার বয়স? তের /চৌদ্দ। অথচ চেহারায় পরিণত যৌবনের জেল্লা। গ্রামের হাইস্কুলে ক্লাস এইটে পড়ে। যুবতী মেয়েকে একা ঘরে রেখে দোকানে যেতে পারেনা মুদি দোকানদার গফুর। আমি সবসময়ই সাতপাঁচ না ভাবা, ভবিষ্যৎ আতঙ্ক সম্ভাবনা না দেখা অদূরদর্শী মানুষ। সহজ মনেই মেয়েটিকে কাছে রেখে দেই আর ভাবি আহারে, গফুর মিয়ার কি কষ্ট। গফুর মিয়ার জন্য আমার উচ্চারণ করা 'আহারে' শব্দটা বুঝি লজ্জা পায়, যখন গ্রামে ফিরে সাতদিন যেতে না যেতেই গফুর মিয়া দ্বিতীয় বিয়ে করে। আর সালমা কেঁদে কেঁদে আমাকে বলে, বিয়ে করার জন্যই আমাকে বিদায় করছে মামী। আমি জানি। আপনেরে বলি নাই। সালমার জন্য আমার স্নেহ আরো গভীর হয়, আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বলি কিচ্ছু ভাবিস না তোর সব দায়িত্ব আমার। ওকে পাশের বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করে দেই, এলাকার কোচিংএ পড়তে পাঠাই। বাসায় মেহমান এলে বলি আমার ভাগ্নি। চেহারা সাজ পোশাকে কেউ অবিশ্বাস করেনা।
লোকটি ঘুরে এলে আমি লোকটিকে ভালো করে দেখি। থুতুনিতে একগোছা দাড়ি। লালকালোয় স্ট্রাইপ শার্ট। ইস্ত্রিহীন অজস্র ভাঁজপড়া প্যান্ট, ক্ষয়ে যাওয়া রেকসিনের জুতো। কোনদিন লোকটিকে কোথাও দেখেছি বলে আমি মোটেই মনে করতে পারিনা।
আপনের সাথে আমার একটু দরকার ছিল। লোকটার ভীরু কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে কেন যেন আমার শ্বশুর বাবার কথা মনে পড়ে। বিয়ের পরপর যে মানুষটার কাছে সবসময় সবাইকে কাঁচুমাচু হতে দেখেছি, সেই একতলা টিনের বাড়িটাতেও, এই সুসজ্জিত ফ্ল্যাটে এসেও। যতই দিন গড়াতে থাকে আমি দেখতাম তিনি নিজেই কেমন কাঁচুমাচু হয়ে যাচ্ছেন। তিনি সবচেয়ে বেশি কাঁচুমাচু হতেন পুত্র জামানের কাছে। আমি তাঁর পুত্রবধূ নাতি নাতনি সবাই তাঁকে ঘিরে থাকতাম, তবু তিনি কান পেতে থাকতেন জামানের পায়ের শব্দ শোনার জন্য। দুপুর রাতের পার্থক্য বুঝতেন না। কলিংবেলটা বাজলেই থরোথরো পায়ে দরজা খুলতে যেতেন, জামান...জামান....। জামান হয়তো তখন লাঞ্চের পর জরুরি কোন মিটিংয়ে। বাসায় ফেরার কোন প্রশ্নই নেই।
শেষ একমাস কোমায় ছিলেন, আমি কাছে গিয়ে ডাকলেও বলতেন,জামান...জামান...। জামান সেবার অফিসিয়াল ট্রেনিংয়ে নেদারল্যান্ডসে, তখন ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপ নেই। আই এস ডি কলে জামানকে ফোন করে বললাম, বাবাকে শেষবারের মতো দেখে যেতে। জামান এলো না। জামানের সময় হলো না। এসময় ছুটি নিলে ক্যারিয়ারে সাংঘাতিক ক্ষতি হয়ে যাবে।
একা দুপুরগুলোতে বহতা আর গহীন তখনও স্কুল থেকে ফিরতো না। বাবা আমার সাথে বসে বসে গল্প করতেন, কতো অফিস ফাঁকি দিয়েছেন তিনি জামানের জন্য। দাঁড়িয়ে থেকেছেন ওর স্কুলের সামনে,কোচিংএর সামনে। রাত জেগে সব পড়া শেষ করাতেন, কোর্স, সিলেবাস, রিভিশন। সব নিঁখুত না হওয়া পর্যন্ত শান্তি নেই। কোন বিষয়ে নাম্বার একটু কম পেলে ঘুম হারাম হয়ে যেত। জামান যখন ফোন করলে মুখের উপর বলে দিতো, এখন আসতে পারবে না, তখন বাবার জন্য ভীষণ মায়া হতো আমার। আহারে, ছেলের জন্য দেওয়া আপনার ফাঁকি আপনাকেই ফিরিয়ে দিলো ছেলে।
কিন্তু এই কাঁচুমাচু লোকটি কে, কি চায় আমার কাছে? আমার অপ্রস্তুত অপ্রকাশ্য প্রশ্নটি বুঝেই হয়তো নিজ থেকেই সে বলে, আপা বাচ্চাটা...। বাচ্চাটা...। কোন বাচ্চাটা? মূহুর্ত মাত্র। আমি সব বুঝে ফেলি। এ নিশ্চয়ই সেই লোক। কিন্তু লোকটি আমাকে চিনলো কি করে! আমিতো একবারও লোকটির সামনে আসিনি। পুরোটা সময় শাহনাজের চেম্বারে এসির তীব্র ঠান্ডায় ঘামছিলাম আর শাহনাজ আমাকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছিল। রাখতো, ভাবিস না, কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে বলে ফোনে যোগাযোগ করছিল নানাদিকে। লেবার রুমে জুনিয়র ডাক্তারকে পরামর্শ দিচ্ছিল, সালমাকে ডোজ বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য। একটার পর একটা ফোন দিচ্ছিলো সরকারি শিশু সদন থেকে এতিমখানা। দত্তক নিতে চাওয়া নিঃসন্তান দম্পতি.... কোথাও একটা ব্যবস্থা হবে। নিশ্চয়ই হবে।
লোকটি আমাকে চিনলো কি করে, প্রথমে এই ভাবনাটা মনে এলেও পরক্ষণেই বহতা এসে ভাবনাটাকে উড়িয়ে নিয়ে গেল। লোকটিকে দেখে বহতাকে মনে পড়ার কোন কারণই ছিল না। বহতার সাথে এই ব্যক্তিলোকটির কোন সম্পর্কই নেই। তবু স্বার্থপরের মতো একটা জটিল সমীকরণ আমার মাথায় দ্রুত হিসাব মিলাতে লাগল। আমি লোকটিকে বললাম, গাড়িতে উঠুন, চলুন। কিন্তু সেই মূহুর্তে আমার ভেতরে আবার মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি বাজতে শুরু করল। যদিও ততোদিনে আমার ঘন্টাধ্বনির রহস্য জানা হয়ে গেছে, কিন্তু কিছুতেই এই আগাম সংকেত, বুকের ভেতরে এর ঢং ঢং থামাতে পারিনি। আমি বুঝতে পারি অনাকাঙ্ক্ষিত কোন পরিস্থিতি আমার জন্য নিয়তির মতো অপেক্ষা করে আছে। এর যে কি দুঃসহ যন্ত্রণা, ভেতরে কেউ আমাকে ঘন্টা পিটিয়ে জানান দেয় কিছু ঘটতে যাচ্ছে, কিচ্ছু ঘটতে যাচ্ছে। অথচ আমি জানিনা কি ঘটবে, আমি সাবধান হতে পারিনা, আমি প্রতিকার করতে পারিনা। দুর্ঘটনায় পতিত হওয়া অসহায় যানের মতো ভবিতব্যের খাদে নিজেকে সমর্পণ করি।
এই ঘন্টাধ্বনি আমার বুকে তৃতীয়বার বেজেছিল সেদিন, যেদিন মীনাবাজার থেকে মাসের বাজার শেষ করে ঠিক দুপুরে সালমার সাথে গহীনকে এক বিছানায় আবিষ্কার করেছিলাম। গফুর আমার শ্বশুরের জুতোজোড়া হাত দিয়ে মুছে তাঁর সামনে রাখে। চেয়ারে বসার আগে গলার গামছা দিয়ে চেয়ার মুছে দেয়। সেই গফুরের মেয়ে সালমা। ঘটনার সাতদিনের মাথায় সালমাকে বাড়িতে আর ছয়মাসের মাথায় গহীনকে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম ইউ এস এ। আমি আর জামান পরামর্শ করেই। ফ্লোরিডার ইউনিভার্সিটিতে ফুল ব্রাইট বৃত্তি নিয়ে এম এস করছিল গহীন। এজন্য খোঁটাও কম শুনতে হয়নি জামানের কাছে। এখন কেন? বউ বানাও সালমাকে ! খুব তো দরদী। বুয়ার মেয়ের ডেলিভারির সময় সারারাত হাসপাতালে কাটিয়েছো, ড্রাইভারকে ফ্ল্যাটে এনে তুলেছো। এখন কেন? কই গেল সব? আমি চুপ করে সহ্য করেছি, আর ভেতরে স্বীকার করেছি আমরা একটা পর্যায় পর্যন্ত উদার হতে পারি, আর সেই উদারতার অহমে নিজেদের সীমাবদ্ধতাগুলোকে অস্বীকার করে চলি। কিন্তু নিজের উপরে এসে পড়লে ঠিক আসল চেহারা বেরিয়ে পড়ে।
এই ঘন্টাধ্বনি আমার বুকে দ্বিতীয়বার বেজেছিল, দুর্নীতির দায়ে জামানের যখন চাকরি যায়। আমি তখন শ্বশুরবাড়িতে। জামান ফিরে গেলেও বাচ্চাদের স্কুল খুলতে কদিন দেরি বলে আমি থেকে গিয়েছিলাম। বাচ্চারা গ্রামের উঠানের এ মাথা ও মাথা দৌড়ায়, আর সন্ধ্যা হতেই ডাল,শাক যা প্লেটে যাই দেই হাপুস হুপুস খেয়ে ঘুমে ঢুলে পরে। আমি মশারি টাঙাতে টাঙাতে ভাবি, ঢাকায় ওদের একবেলা খাওয়াতে এটা ওটা, মুরগি-ডিম, ফ্রায়েড রাইস, চিকেন ক্রিস্পি, কতো সাধ্য সাধনা!
বাচ্চারা ঘুমালেই সেদিন টের পেয়েছিলাম, বুকের ভেতরে আবার ঘন্টা বাজছে। ঢং ঢং। এক অমঙ্গল আশঙ্কায় আমার অন্তরাত্মা শুকিয়ে খাঁ খাঁ করছে। বাবা বারান্দায় পৈতৃক ইজিচেয়ারে বসেছিলেন। সন্ধ্যা মিইয়ে এলেই গ্রামে রাত গভীর হয়ে যায়। পল্লীবিদ্যুতের ইলেকট্রিসিটি থাকে যতক্ষণ, থাকে না তার চেয়েও বেশি। ঘরের খুঁটিতে এখনো হারিকেন দোলে। সন্ধ্যার আগে আগে রেহানা খালা নিয়ম করে চিমনি মুছতে বসে। হারিকেনটা জোনাকির মতো নিবুনিবু ঝুলছে বারান্দার পাল্লায়।
আমি অসহ্য শব্দ সহ্য করতে না পেরে বাবার পাশে জল চৌকি নিয়ে বসি,আকুল হয়ে জিজ্ঞেস করি বাবা আমার বুকের ভেতর কেন এমন শব্দ শুনি, মন্দিরের ঘন্টার মতো। আমার ভয় ভয় লাগে বাবা। উত্তর না দিয়ে শ্বশুর আবার প্রশ্নটা করেন, তোমার শাশুড়ি সত্যি তোমারে কিছু কয় নাই? না বাবা, আমি এ বাড়িতে এসে তো উনাকে পেয়েছি প্রায় মৃতের মতোই। কিছুই বলেন নাই। শ্বশুর মুখ খুলেন না, ঝিম মেরে বসে থাকেন। এবার আর আমি কৌতূহল দমন করতে পারিনা। রেহানা খালা তখন রান্নাঘরে পাটকাঠিতে আগুন দিয়ে খোলা পিঠা ভাজে। আমি নানা কিছুর দিব্যি দিয়ে পড়লাম তার কাছে, আমাকে জানতেই হবে এই ঘন্টাধ্বনির ইতিবৃত্ত। রেহানা খালাও কতো পীর ফকিরের দিব্যি দিয়ে শুরু করলেন কাহিনি।
জমিদার নলিনীকান্ত বাবুর ছেলেরা ৬৫ র দাঙ্গার পর দেশ ছেড়ে চলে গেলে তাদের বাইরবাড়ির নাটমণ্ডপ আর নিত্যপূজার পুরোহিত এখানে ছিলেন অনেকদিন। পূজো আচ্চা করতো আর গাঁয়ের হিন্দুদের পুরোহিতগিরি করে দিব্যি চলে যেত। ৭১ এর যুদ্ধের সময়ও পাঞ্জাবি থানা সদর থেকে আর এদিকে আগায়নি। কিন্তু ৭২ এর এক রাতে নিঁখোজ হয়ে যায় পুরোহিতের পুরো পরিবার। শোনা যায় পুরোহিতের যুবতী মেয়ে পার্বতী পোয়াতি ছিল , আর গাঁয়েরই কোন মুসলমান যুবকের সাথে প্রেম ছিল তার। কিন্তু পোয়াতী পার্বতীকে বিয়ে করেনি যুবকটি। পার্বতীরা নিখোঁজ হবার কদিন পর একটা মরা বাচ্চা ভেসে উঠেছিল মন্দিরের পাশের পুকুরে। এসবই যে তার কেবলই শোনা কথা সত্যমিথ্যা জানেনা, একথাটাও রেহানা খালা দ্বিধার মতো জড়িয়ে দেয় কাহিনির সাথে৷
পরে সেই নাটমণ্ডপ আর মন্দিরের জায়গা ভাস্টেড প্রপার্টি হয়ে গেলে শ্বশুর একশ বছরের লিজ নিয়ে এই বাড়ি বানিয়েছেন। রেহানা খালা কানেকানে বলে, ভাবি সক্কলে কয় পার্বতীর লগে তোমার শ্বশুররেই লাইন আছিল। তোমার শাশুড়িও জানতো ঘটনাটা। নিত্য ঝগড়া লাইগ্যা থাকত। তোমার শ্বশুরের ক্যান বাপের ভিটা থুইয়া এই জায়গাতেই বাড়ি করন লাগবো! তোমার শাশুড়ি তো একবার বিষও খাইছিল।
সেবার আমার কৌতূহল মিটলো বটে। ঘন্টাধ্বনি থামলো না। আমি বুঝলাম কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। আর বেশি আতঙ্কের উত্তাপে দগ্ধ না করে পরদিনই দুপুরে জামান ফোন দিয়ে জানালো, দুর্নীতির অভিযোগে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। সে কোর্টে যাবে।
লোকটি ইশারায় আমাকে তার অটোরিকশাটা দেখালো। তাইতো সে গাড়িতে করে যাবে কি করে? আমি তাকে সমাধান দিলাম, অটোরিকশা নিয়ে আমার সামনে সামনে এগুতে। আর কাশেমকে বললাম তাকে অনুসরণ করতে, পুরোটা রাস্তা আমি উথাল-পাতাল হলাম সামনের পরিস্থিতি বিবেচনায়। কি দেখবো, কি করবো। মাথার ভেতরে যে সমীকরণটি মিলাতে আপ্রাণ চেষ্টা করছি, আদৌ কি আমি তা পারবো?
ভুলে গেলাম আমি বহতাকে একা ঘরে রেখে এসেছি। ডাক্তার বলেছে ওকে একা না রাখতে। অটোরিকশাটি আমার সামনে সামনে যাচ্ছে। আমি কাশেমকে বারবার বলছি ওকে যেন চোখের আড়াল না করে। ওকে অনুসরণ করতে করতে আমি মোহম্মদপুর খালের ঢাল বেয়ে নেমে গেলাম। এদিকটায় কোনদিন আসা হয়নি আমার। নবোদয় হাউজিং,মোহম্মদীয়া হাউজিং কতো বাহারি নামের জনবসতি। হয়তো বছর কয় আগেও জলাভূমি ছিল!
যেতে যেতে বেড়ি বাঁধ পার হয়ে একটা অসমাপ্ত সাঁকোর সামনে থামলো গাড়িটা। সাঁকোর সামনেই নদী নাকি খাল, বেশ প্রশস্ত। এ-যুগেও খোদ ঢাকা শহরে এরকম খরস্রোতা জল আছে কল্পনাই করিনি। সংযোগ সড়ক নেই খালটার উপরে। হয়তো পার হতে পারলে সামনেই মিলতো অসীম আশার দুনিয়া। সম্ভাবনা কিংবা অসম্ভাবনার। কে জানে?
অটোরিকশার পিছনেই আমার গাড়ি থামে। ওপাশে একটা অর্ধনির্মিত বাড়ি। লাল লাল ইটের গায়ে সিমেন্ট দিয়ে জোড়া লাগানোর প্রক্রিয়াগুলো ভেসে আছে। স্বস্তির সিমেন্ট আর স্বপ্নের রঙে মুড়ানো হয়নি। লোকটির সাথে আমাকে দেখে ঘর থেকে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বাইরে এলেন এক উসখুখুসখু মহিলা। বাচ্চাটা তার কাঁধে ঘুমিয়ে আছে। লোকটির কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে আরো নতজানুতা। আফা আজ পনেরোদিন জ্বর কমেনা। অনেক কাশি। ডাক্তার বলেছে নিমোনিয়া, হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। চিকিৎসার তো অনেক খরচ আফা। ঠিকমতো চিকিৎসা করতে পারছিনা। সি এন জি টা নিজের না। মালিককে দিয়ে থুয়ে কোনরকমে নিজেদের দিন চলে, কিন্তু চিকিৎসার যে অনেক খরচ!
অপার কৌতুহলে আমি বাচ্চাটাকে দেখি। কাছে গিয়ে একটু কপালে হাত দেই। তীব্র জ্বর গায়ে। গাল দুটো টকটকে লাল জ্বরের ঘোরে। চোখের কোনে মরা নদীর স্রোতের মতো শুকিয়ে যাওয়া অশ্রুধারা। নাক ভরতি সিকনি।
আমার কোলে ঠিক এভাবেই ঘুমাতো গহীন। ঠিক এভাবে ঠোঁট ফুলিয়ে। আমার চেহারা দেখে মহিলা কি বুঝলো কে জানে! হঠাৎ বাচ্চাটাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে এক দৌড়ে ঘরের ভেতর গিয়ে দরজা আটকে দিলো। উঁচু গলায় শাপ শাপান্ত করতে থাকলো আমাকে। কিন্তু বাচ্চাটিকে এই জড়িয়ে ধরা, দৌড়ে পালানো, আমাকে অভিশাপ দেওয়া সবকিছুর মধ্যে আমি যে অনন্ত জীবন্ত জীবনের গন্ধ পেলাম, আমি স্পষ্ট দেখলাম আমার জীবন থেকে তা হারিয়ে গেছে। এই মহিলার জীবনে আমার কৈশোরে দেখা বাবলের বুদবুদের বিচিত্র রং আছে। অভাবে, অসুখে, দুশ্চিন্তায় তবু কি প্রাণবন্ত এই জীবন, যে জীবনে নিজের সন্তান নয় জেনেও সন্তান আঁকড়ে ধরার প্রাচুর্য আছে।
জামানের বৈভবের জীবনে তার ছিটেফোঁটাও নেই। আমি আঁচলে মুখ চেপে গাড়িতে উঠে পরি। আমার মাথায় জন্ম নেয়া সমীকরণটা এলোমেলো হয়ে যায়। আমি আর মেলানোর চেষ্টাই করিনা। জীবনের অংক পরীক্ষায় এই অকৃতকার্যতা আমাকে খুব বেশি কষ্ট দেয়না। টের পাই বুকের ভেতরে ঘন্টাধ্বনি বাজাও বন্ধ হয়ে গেছে। হয়তো চিরতরেই।
আমার ছেলে গহীন গতবছর আমেরিকায় এক রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে। আর পরপর তিনবার মিসক্যারেজ হয়ে বহতা এখন ডিপ্রেশনের ওষুধ খাচ্ছে। ডাক্তার বলেছিল একটা বাচ্চা কোলে পেলেই সুস্থ হয়ে যেত বহতা।
0 মন্তব্যসমূহ