অনাথনাথ গুছাইতের বড় বাজারে মেডিসিনের হোলসেল ব্যবসা। তারা তিন ভাই, অনাথ, প্রিয়নাথ ও জগন্নাথ। তিন ভাইই ব্যবসায়ী। অনাথনাথ একবার জাল ওষুধের কারবারে গিয়ে ধরা পড়ে। তখন ছাড় পেতে অনেক টাকা ব্যয় হয়েছিল। তারপর জালের কারবার ছেড়ে দিয়েও অল্প অল্প চালিয়ে দেয়। নিষেধে আকর্ষণ থাকে তো বেশি। কেন না লাভের কোনো সীমা নেই। প্রিয়নাথ বইয়ের ব্যবসা করে। রগরগে বই ছেপে, বিনা অনুমতিতে বিখ্যাত লেখকের বই ছেপে সে বেশ গুছিয়ে ব্যবসা করছিল। মাঝে মাঝে পুলিশ হামলা করেছে রগরগে বই ছাপার জন্য, বিনা অনুমতিতে বই ছাপার জন্য। সে সামলে নিয়েছে কোনো রকমে। তবে তিন ভাইয়ের ভিতরে তার ব্যবসা একটু কমজোরি। ভালো চলে জগন্নাথের ব্যবসা। তার পোশাক সারা ভারতে যায় যেমন, বাংলাদেশে বড় এক বাজার। অনাথনাথের যে সময়ের কথা বলছি, সেই সময় পেরিয়ে গেছে বহুদিন। এসব মহামারী আসার বছর চল্লিশ আগের কথা। শোনা যায় তখন পৃথিবীর জল-হাওয়া ভালো ছিল। মানুষ ভালো ছিল। মানুষ ধার করলে ধার শোধ করত। আবার না করলেও লোকে মনে করত, টাকাটা গেল, কিছু করার নেই। এইসব কথা বুড়োদের। তারা বিশ্বাস করে তাদের অতীত ছিল পৃথিবীর সেরা সময়। ভেজাল ছিল তখন। আবার শুদ্ধ জিনিশও ছিল। শুদ্ধ জিনিশের দাম বেশি, ভেজালের দাম কম। আবার এমনও হতো ভেজালকে খাঁটি প্রমাণ করতে তার দামও বাড়িয়ে দেওয়া হতো। সেই সময়ের পৃথিবী ছিল এমনই বর্ণময়। এ থেকে স্পষ্ট ধরা যায়, অতীতই শ্রেষ্ঠ। অতীতের শেষ নেই। যখনই তুমি অতীতে পৌঁছবে, তা বর্তমান হয়ে যাবে। তার চেয়ে বর্তমান নিয়েই কথা হোক। দিন ফুরোলে অতীত দীর্ঘ হয়ে ওঠে। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতম, আষাঢ়ান্ত বেলা। দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়া রেললাইন। দিকহীন প্রান্তর। সাগর।
মেডিসিন বেচে অনাথের টাকা হয়েছিল অনেক অনেক। টাকা হলে লোকে খ্যাতি চায়, সেও চাইছিল। সে লিখতে পারে না যে খরচা করে বই ছেপে খ্যাতিমান হবে। পাড়ায় এক লেখক আছেন। তিনি কত গম্ভীর হয়ে হেঁটে চলে বেড়ান, সকলে তাঁকে কত সম্ভ্রম দেয়। তিনি পুরস্কার পেলে পাড়ায় তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হলো। অনাথের মনে হলো সে লেখক হয়। আগে সে চেষ্টা করেনি এদিকে মন দেওয়ার। এবার ভাই প্রিয়নাথ বলল, ইনভেস্ট করো, এত আয় করলে, অন্য দিকে মন দাও। লেখক হওয়া সহজ কাজ। আমি বইয়ের ব্যবসা করি, আমি জানি। তারপর এক লেখককে ধরে আনল মেজভাই প্রিয়নাথ, অনাথের বই সে লিখে দেবে। ছেলেটার বয়স বেশি না। কোন এক চিটফান্ডের খবরের কাগজে চাকরি করত। চিট ফান্ড উঠে গিয়ে তার চাকরি গেছে। তাকে নিয়ে এসে প্রিয়নাথ, বলল, ’দাদা, এ তোমার বই লিখে দেবে, তার জন্য ব্যয় করতে হবে, রাজি ?
কী বই লিখবে ? অনাথনাথ জিজ্ঞেস করল।
গালে পাতলা দাড়ি, চোখে চশমা, আধ ময়লা পায়জামা, পাঞ্জাবি, এলোমেলো চুলের সেই যুবক যেন অকাল বৃদ্ধ। সে বলল, আপনি যেমন চান।
আমি কেমন চাই তা বুঝবে কী করে? অনাথনাথ তার সাক্ষাৎকার নিতে লাগল। যুবক বলল, আপনার জীবনী লিখে দিতে পারি, আপনার পথের পাঁচালি লিখে দিতে পারি।
সিনেমা ? অনাথনাথ অবাক হল। তার মানে সে তার নামে সিনেমা লিখবে, না সে সিনেমার নায়ক হবে?
আঁজ্ঞে না, উপন্যাস। সে নত্মুখে বলল।
সিনেমার ওই গল্প, দূর আমার ভালো লাগেনি, অন্য রকম লেখ। অনাথনাথ বলল।
কী রকম স্যার ? অরিত্র জিজ্ঞেস করে।
শরচ্চচন্দ্র, দেবদাসের মতো।
লাভ স্টোরি ? অরিত্র জিজ্ঞেস করেছিল।
ইয়েস, একটু ইয়ে থাকে যেন। বলেছিল অনাথনাথ, হাম তুম এক কামরে মে বন্ধ হ্যায় । তাতে সায় দিয়েছিল প্রিয়নাথ। ইয়ে না থাকলে বই চলে না। সঙ্গে ভয়, রক্তপাত, শ্মশান ইত্যাদি। এসব নিয়ে বই যেন ভালো হয়। পুরস্কার পায় যেন। সে খরচাও দাদা করবে। মেডিসিনের ব্যবসায় কত লাভ জানো, দাদা খরচা করতে পিছপা হবে না।
আচ্ছা স্যার। যুবক বলল, আপনার চিন্তা নেই, যেমন চান তেমন পাবেন।
কবিতাও দিয়ো গোটা কয়। অনাথনাথ বলল।
অতঃপর সেই উপন্যাস এবং কবিতা নিয়ে একটি বই বেরোল। অনাথনাথ রচনা সম্ভার। লেখক যুবকের নাম অরিত্র। তার যেন তৈরিই ছিল সব। পাণ্ডুলিপি গেল প্রেসে। লেখকের প্রাপ্য পাঁচ হাজারের অর্ধেক নিল প্রিয়নাথ। আড়াই হাজার পেয়ে ক্ষুব্ধ হলো অরিত্র। কিন্তু সেই অতীতে সব ভালো ছিল। মেনে নিল অরিত্র। সে ছিল অতীত, তাই অনাথনাথ তাকে অতিরিক্ত পাঁচশো দেবে বলল বই প্রকাশ হলে। প্রিয়নাথ তাকে কাজটা দিয়েছে, সেও তো দালালি পাবে অর্ধেক।
অনাথনাথের জীবন কাহিনি বর্ণনা করছি আমি। ক্রমে ক্রমে সব উন্মোচিত হবে। বই বের হলো। কলকাতার দামী মঞ্চে, দামী লেখকের হাতে মোড়ক খোলা হলো। কালো ধুতি, কালো পাঞ্জাবি পরে অনাথনাথ সংবর্ধিত হলেন। অরিত্র বক্তৃতা লিখে দিয়েছিল। ঠোক্কর খেয়ে খেয়ে তা পাঠ করল অনাথনাথ। সকলে ধন্য ধন্য করতে লাগল। অনাথের ব্যবসার কর্মচারীরা সেই বই কিনল। অতীত তো। অনাথ স্বাক্ষর করল সেই বইয়ে। এই সংবাদ সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপিত হলো ছবি সমেত। সেই পত্রিকা কিনে পাড়ায় পঞ্চাশ ঘরে বিলি করলেন অনাথনাথ মেডিসিনের অনাথনাথবাবু। তিনি লেখক হলেন। প্রিয়নাথ সোনার মাথাওয়ালা মানুষ। সে লাভলোকসান ভালো বোঝে। অনাথনাথকে লেখক বানিয়ে সে মুনাফা করল খুব ভালো। অরিত্র তার লেখক। অরিত্রর একটা হিল্লে হলো। অরিত্র যদি অদৃশ্য-বিদেহী লেখক, ঘোস্ট-রাইটার হয়ে থাকতে চায়, তবে প্রিয়নাথের ব্যবসা হবে ভালো। নিয়মিত হলে সে কমিশন নেবে এক তৃতীয়াংশ। অরিত্রর জন্য লেখক জোগাড় করা তার দায়িত্ব। কলকাতা শহরে প্রচুর ধনপতি আছে, তাদের লেখক খ্যাতি পাওয়ার খুব ইচ্ছে। তারা লেখে কিন্তু বাক্য গঠনই শুদ্ধ হয় না। কাহিনির কোনো পারম্পর্য থাকে না। সব ঠিক করতে হবে অরিত্রকে। তার বিনিময়ে সে সম্মান দক্ষিণা পাবে। অরিত্রর জায়গা নেই অন্য কোথাও। চাকরি পায় না, তাই এই কাজ করতে রাজি হলো। অতীতে এমন হতো। সকলে সব কিছু করতে পারত। মেনে নিত।
এখন অমন হয় না। ফেসবুকে প্রকাশক বিজ্ঞাপন দেন, বেতন পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা। দশটা থেকে ছ-টা ডিউটি। কম্পিউটার জানা চাই। সেখানে সেই অতীতে ভূত-লেখক হয়ে থাকা অনেক ভালো ছিল। হ্যাঁ, এখনো ভূত-লেখক হয়ে আছে সেই অরিত্র। তার পশার বেড়েছে। এখন খদ্দের অনেক বেশি। চাকুরেরা অবসর নেয় এক কোটি দু’কোটি নিয়ে। সেই টাকা নিয়ে করবে কী? লেখক হয়। অরিত্র সান্যাল তাদের বই লিখে দেয়। এর ফলে হয়েছে কি। কোন বইটা আসল আর কোন বইটা নকল, তা ধরা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এক অতি পুরস্কৃত বইয়ের লেখক নাকি অরিত্র, এই কথা লেখকের বিপক্ষ লোকজন ছড়িয়ে দিয়েছিল জনে জনে। এমন হতো অতীতে। আসলে আজ যা ঘটছে, তা একদিন অতীত হবেই। অতীতে এমন হতো। অরিত্র সান্যাল কতজনের বই লিখে দিত।
প্রিয়নাথ তার বড়ভাইকে একদিন বলল, এলাকায় যারা মাধ্যমিক উচ্চ-মাধ্যমিক ফারস্ট ডিভিশনে পাশ করেছে, তাদের সংবর্ধনা দেবে এলাকার নাগরিকরা। সেই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবে তার দাদা। এসব না করলে লেখকের খ্যাতি হয় না। তার বই উপহার দেওয়া হবে। সে এক আশ্চর্য অনুষ্ঠান। এলাকায় কত ছেলে-মেয়ে যে প্রথম বিভাগে পাশ করেছে, তার হিশেব নেই। সারাদিন ধরে পুরস্কার দেওয়া চলল। একটি বই এবং একটি ফুলদানি। মীনে করা তার গায়ে। ফুলদানি এলাকার কাউন্সিলর জোগাড় করে দিয়েছিলেন ফ্রি। শুধু বইয়ের দাম দিতে হলো। শতকরা তিরিশ টাকা কমিশন। প্রিয়নাথ খুব লাভ করল। অনাথনাথ সারাদিন বসে থাকল সভাপতির চেয়ারে। বক্তৃতা দিল। সেই বক্তৃতাও লিখে দিয়েছিল অরিত্র, দ্য ঘোস্ট রাইটার। এই ঘটনা পরে অনাথের জন্য বিড়ম্বনাময় হয়েছিল। কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রীর বাবা বই ফেরত দিয়ে গিয়েছিল প্রিয়নাথের কাছে। অশ্লীল সব ঘটনা আছে বইয়ে। দেওয়া ঠিক হয়নি। সকলে কেন ফেরত দিতে আসেনি, সে এক রহস্য বটে। আরো বিড়ম্বনা হলো, যখন লোকে বলাবলি করতে থাকে, বই অনাথনাথের লেখা নয়। তিনি এমন লিখবেন কীভাবে? সব দোষ প্রিয়নাথের। কাকে দিয়ে আগডুম-বাগডুম লিখিয়ে অনাথনাথবাবুর নামে ছাপিয়ে দিয়েছে। কালে কালে অরিত্র আর গোপন থাকল না। তাতে তার দাম বাড়ল দিনে দিনে। সে অনেকের বই লিখে দেয়। প্রিয়নাথের ব্যবসা খুব জমে গেছে। অনাথনাথ বিরূপ হলো মেজ ভাইয়ের প্রতি। বলল, তার বই আর ছাপতে হবে না। লোকে অরিত্রর নাম করে। কত টাকা নেয় অরিত্র তা জিজ্ঞেস করে তাকে ফোন করে। বড় বাজারের ঝাড়াই মশলার ব্যবসায়ী ত্রিভুজ অগ্রবাল তাকে জিজ্ঞেস করেছে, হিন্দি জানে কি না সেই সাহিত্যকার, সে একটি বই লিখবে, তার ফ্যামিলির হিস্ট্রি লিখবে।
তখন প্রিয়নাথ বলল, ঠিক আছে দাদা, তুমি তাহলে মেডিসিন নিয়ে থাকো।
না, অন্য কিছু হয় কি না দ্যাখ। অনাথনাথ বলল।
সে ছিল সুবর্ণ এক অতীত। সম্ভাবনাময় কত কিছু ছিল। সেই অতীতে কলকাতায় দুর্গোৎসব হতো পাঁচ দিনের। উত্তর কলকাতার এই অঞ্চলে একটিই পুজো হতো পার্কের এক অংশ জুড়ে। প্রিয়নাথ সেই পুজোর স্যুভেনির ছেপে কিছু আয় করত। সারাজীবন দু’নম্বরি বই ছেপে বড় কিছু করতে পারেনি। অরিত্রকে দিয়ে শরৎচন্দ্রের নতুন (নবতম!) উপন্যাসও ছেপেছে। ছেপে হুড়কো খেয়েছে হুগলির শরত সমিতির কাছে। তখন লেখকের নাম চট্টোপাধ্যায় থেকে চট্টরাজ করে দিয়েছিল। প্রিয়নাথের এমনি কত অতীত আছে। কিন্তু সেই অতীতে সুখ আছে। চট্টোপাধ্যায় শরৎচন্দ্রের নতুন উপন্যাস ‘উদাসিনী’ এক লপ্তে দশ হাজার বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। লোকে লাইন দিয়ে বই কিনেছিল। মামলা হতে হতেই বিক্রি শেষ। তারপর শরৎচন্দ্র চট্টরাজের বই ধীরে ধীরে চলতে লাগল। মফস্বলের ক্রেতা এসে অনুরোধ করে যেত, ‘পদবী বাদ দিয়ে শুধু শরৎচন্র থাক, আমরা শরচ্চন্দ্রর নতুন নতুন বই চাই।’
যাই হোক, প্রিয়নাথ এলাকার দুর্গোৎসবের স্যুভেনির ছেপে কিছু আয় করত। দাদাকে পরামর্শ দিল, তুমি পুজোর প্রেসিডেন্ট হয়ে যাও।
তাতে হবে কী? অনাথনাথ জিজ্ঞেস করল।
পুজোকে এমন ভাবে করতে হবে যে সারা দেশ যেন ভেঙে পড়ে।
আমার কী হবে তাতে ? অনাথনাথ উদাস গলায় জিজ্ঞেস করল।
তুমি প্রেসিডেন্ট, তুমিই সব, যত হোরডিঙ, যত পোস্টার, সব জায়গায় তোমার ছবি থাকবে, পুজোর প্যাণ্ডেলে তোমার ছবি থাকবে শিব ঠাকুরের উপরে, লোকে বলবে অনাথনাথের পুজো, এমন আলো আর প্যান্ডেল হবে, যা লোকে এ জীবনে দ্যাখেনি।
আহা এ তো সেই দিনের কথা। অনতি অতীতের কথা। আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম। প্রিয়নাথ মনে করতে পারে সব। অরিত্র তার দিন লিপি লিখে রাখে। সেই দিন লিপি থেকে এই কাহিনি। দুর্গোৎসব হলো বটে। চতুর্দিকে সাড়া পড়ে গেল। সারা কলকাতা জুড়ে পোস্টার ছড়িয়ে গেল অনাথনাথের ছবি সমেত। মূল প্যান্ডেলের গায়ে এক মঞ্চ তৈরি হলো। সেই মঞ্চে অনাথনাথ ষষ্টী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী বসে থাকে রঙিন ধুতি পাঞ্জাবি পরে। দর্শনারথীরা তাকে জোড় হাতে নমস্কার করে যায়। ধন্য তুমি এই নরকুলে, তোমার মতো কে আছে এই ভুবনে। এই বাক্য বন্ধ সেই মঞ্চে তার ছবির নিচে শোভা পেতে থাকে। অরিত্রর রচনা। এতদিনে হওয়ার মতো হলো। অনাথনাথ খুব খুশি। এতদিনে তার খ্যাতি হয়েছে। মিনিস্টার এসে তার পাশে বসেন সেই মঞ্চে। মিনিস্টার উদ্বোধন করে কী প্রশস্তিই না করলেন তার। এরপর চিফ মিনিস্টার, তারপর প্রাইম মিনিস্টারকে দিয়ে পুজো উদ্বোধন করা হবে, এমন স্বপ্ন দ্যাখে অনাথনাথ। ব্যবসায়ে খুব লাভ হচ্ছে এখন। ভেজাল ওষুধের আলাদা কারবার করেছে অনাথ। সেসব ওষুধ মফস্বলে পাঠায়। এত টাকা সে করবে কী ? অনাথের বউ আছে, সন্তান নেই। বউ গয়না গড়িয়েই খুশি। পুজোর সন্ধ্যেয় কখনো কখনো মঞ্চে উঠে স্বামীর পাশে বসে থাকে। লোকে বলে, আহা শিব দুগগা। নমঃ নমঃ।
এসব হলো অতীতের কথা। অতীত সর্বদাই সুখের হয়। অতীত সর্বদাই গৌরবোজ্জ্বল হয়। যখন তিনি লেখক ছিলেন, তখন তা আনন্দের ছিল, যখন তিনি পুজোর কর্তা হলেন, পুজোয় ঢাললেন অনেক টাকা, তাও সুন্দর হলো। সুন্দরতর হলো। সুন্দরতম হলো। সেই সময় কত কিছু লেখা হতে লাগল স্যুভেনিরে। খবরের কাগজ, টেলিভিশন সাক্ষাৎকার নিল পুজো কমিটির সভাপতির। স্যুভেনিরে লেখা হলো অনাথের শৈশবকথা। অনাথনাথ যখন শিশু ছিলেন, সেই সময়ে তাঁর ভিতরে কী কী গুণপনা দেখা দিয়েছিল তাও তখন প্রকাশিত হতে থাকে। সেই সব গল-গপ্পো লিখতে লাগল অরিত্র, দ্য ঘোস্ট রাইটার। তা ছাপা হতে লাগল ক্রমান্বয়ে। শিশু অনাথ একবার কাল সর্পকে মাথা নামিয়ে নিষ্ক্রান্ত হতে বাধ্য করেছিল। তখন তার দু’বছর তিন মাস বয়স। শিশু একবার নৌকো থেকে জলে পড়ে গিয়েছিল, তখন তার তিন বছর দুই মাস বয়স। জলে ডুবে যায়নি, খরস্রোতে ভেসেও যায়নি, চিত হয়ে ভাসছিল জলে। খিলখিল করে হাসছিল মহাকাশের দিকে তাকিয়ে। তখন তাকে জল থেকে তুলে আনা হয়। তিনি খেলা করতে মা গঙ্গার জলে ভেসে গিয়েছিলেন।
তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি হলো দুর্গোৎসবকে বাণিজ্যিক রূপ দেওয়া। বড় বড় কোম্পানি এল পুজোর সহায়ক হয়ে। পুজো পাঁচদিন থেকে সাতদিন, সাতদিন থেকে পনের দিন হয়ে গেল। নবরাত্রির সূচনা থেকেই পুজো শুরু হয়ে গেল। সে ছিল আনন্দময় অতীত। ভোলা যায় না। কিন্তু মানুষের সকল সুখ ভগবান সহ্য করেন না। এল মহামারী। অনাথনাথের ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠতে লাগল বটে, কিন্তু মনের শান্তি গেল। পুজো ছোট হয়ে এল মহামারির প্রথম ঢেউয়ে। ব্যবসায়ে টাকা আসছে, মেডিসিনের বিক্রি বাড়ছে, মহামারী রোধে মেডিসিনই ভরসা। কিন্তু এই সফলতায় আনন্দ নেই। টাকা দিয়ে কী হবে, যদি খ্যাতি আরো না বাড়ল। সেবার, হ্যাঁ, সেই অতীতে পুজো হলো, কিন্তু দেব দর্শনে কেউ এল না। মঞ্চ হয়েছিল বটে, কিন্তু মঞ্চের ধারে কাছে কেউ যায়নি। সব নিঝুম হয়ে পার হলো। খুব মনঃকষ্টে কাটল সেই অতীত। তারপর মহামারী স্তিমিত হলো কিছু দিনের জন্য। তিনি আশায় আশায় দিন কাটাতে লাগলেন, সামনের পুজোয় আবার অধিষ্টিত হবেন মহামঞ্চে। সেই সময় মহামারি ঘুরে এল। পটাপট মানুষ মরতে লাগল। তাঁর ওষুধের ব্যবসা হৈহৈ করে চলতে লাগল;। অক্সিজেনের হাহাকার চলতে লাগল। তিনি অক্সিজেন সাপ্লাই করে রোজগার দ্বিগুন করে তুললেন। কিন্তু তাঁর মেজভাই প্রিয়নাথের ব্যবসা একেবারে বসে গেল। মানুষ নিজেকে বাঁচাবে না বই পড়বে? বইয়ের দোকান খোলার আরজি জানালো অরিত্র তার ফেসবুকে। বহুলোক ন তাকে নিন্দা করতে লাগল। খিস্তি করতে লাগল। বই কী হবে, বই দিয়ে কি মানুষ বাঁচবে? এই সময় প্রিয়নাথের রোজগারপাতি শূন্য হয়ে গেল প্রায়। জমা টাকা ভাঙা পড়তে লাগল। অরিত্রর কোনো আয় নেই। ধার করে চলতে লাগল। সে কী করবে ভেবে উঠতে পারে না। ফুল বেচবে, না শব্জি বেচবে? অথচ অনাথের লাভের সীমা নেই। কিন্তু ভগবান কী চান ধরা যায় না। দ্বিতীয় ঢেউয়ে চলে গেল অনাথনাথ। কোনো ওষুধ, সেরা হাসপাতাল, অক্সিজেন, ভিটামিন, কিছুই কাজে লাগল না। তার বডিই দিল না হাসপাতাল। প্লাস্টিক চাদরে মুড়ে পুড়িয়ে দিল সিরিটি শ্মশানে। প্রিয়নাথ শোকে বিহ্বল হয়ে কী করবে ভেবেই পায় না। দাদাকে বুঝিয়ে সে অনেক টাকা নিয়েছে। বিধবাকে কি সেই রকম বোঝাতে পারবে? ইস অনাথনাথ অদৃশ্য হয়ে গেল। দাদা থাকল না। ওহে অরিত্র এখন কী করি ? বইয়ের ব্যবসায় কী আর হতো, আসল আয় তো অনাথনাথকে নিয়ে। অনাথের নাথ ছিলেন তিনি।
অরিত্র বলল, স্যার আমি ভাবি দু’দিন, উপায় একটা হবেই।
তিনদিন নিল অরিত্র ভাবতে। তারপর বলল, মন্দির প্রতিষ্ঠা করুন, উনি সাধু পুরুষ ছিলেন, অবতার, ওঁর মন্দির হোক।
কী বলছ অরিত্র, এ তোমার নকল শরতবাবু না, ভগবান প্রতিষ্ঠা করা যায় ?
যায় স্যার যায়, বাবা অনাথনাথেশ্বর জিউ প্রতিষ্ঠা হবেন, আগামী নবরত্রির মধম লগ্নে। প্রোগ্রাম এমনি ভেবেছি। অধিবাস আগামী ১লা অক্টোবর, মহালয়ার দিনে, অমাবস্যার পুণ্য মুহূর্তে। প্রাণ প্রতিষ্ঠা, শুক্লাষ্টমী, নবরাত্রির অষ্টম দিবসে সকাল ছয় ঘটিকা হইতে রাত্রি নয় ঘটিকা। ভোগ বিতরণ, রাত নয় ঘটিকায়। অনাথের অনাথিনীকে কথাটা বলতে তাঁর দুটি চোখ দিয়ে গঙ্গা যমুনার ধারা বয়ে যেতে লাগল। তাইই তো ছিল লোকটা। অনাথের নাথ। কত দান ধ্যান। কত বড় লেখক। কত টাকা ঢেলেছে সার্বজনীন দুর্গোৎসবে। গরিবকে কত দিত। উদার প্রাণ দেবতা। করো মন্দির করো। মন্দির স্থাপন করা হতে লাগল পুরসভার রাস্তার ধারে। বাবা অনাথের নাথেশ্বর প্রতিষ্ঠিত হবেন। বাবা ঠাকুরের আশ্রয়ে আছি আমরা। ইট এল, সিমেন্ট এল, মারবেল পাথর এল, ধ্বজা উড়ল শিখরে। দিন এগিয়ে আসতে লাগল। অনাথনাথ ঠাকুরের মাহাত্ম্য চতুর্দিকে ছড়িয়ে যেতে লাগল। অনাথের গৃহিনী নারায়ণী টাকা জোগাতে লাগল। জানে এই টাকা নিশ্চিত ফেরত আসবে মন্দির চালু হলেই। অরিত্র এবার অনাথের নাথ, অনাথনাথেশ্বরের পাঁচালি লিখবে পয়ার ছন্দে, সেই বই ছাপবে প্রিয়নাথ। বই বিক্রি হবে মন্দির চত্বরে। বইয়ের প্রচ্ছদে অনাথের ছবি।
অতীতের কথা ইহা অনতি অতীত।
দেবতার কথা না হয় দেবতা ব্যতীত।।
আইলেন ধরা ধামে অনাথ এক শিশু।
বুদ্ধ, নানক যেমন বিলেতের যিশু।।
অনাথের নাথ তিনি, মহা ভগবান।
মন্দিরে আসিও সবে, করি আহ্বান।।
মহামারীর ত্রাতা তিনি, জীবন্ত ঠাকুর।
নদীজলে দিয়াছিলেন একাকী হাঁকুড়।।
এই পথ অনাথের, পুণ্য করো আসিয়া।
বাতাসেতে যায় বুঝি মহাপুণ্য ভাসিয়া।।
প্রণামী বাক্সে দিবেন, ঠাকুরের সেবায়।
ওঁ নমঃ ওঁ নমঃ, নমঃ নমঃ দেবায়।।
প্রণামী তিন ভাগে ভাগ হবে। অরিত্র সমান ভাগ পাবে। স্বনামে এই প্রথম তার বই প্রকাশিত হলো। সে বাবা অনাথনাথেশ্বরের জীবন কাহিনি লিখছে এখন। অতীতের কথা। লিখতে লিখতে মনে হচ্ছে, সত্যিই অমন অলৌকিক কিছু ঘটেছিল তখন। অতীতে এমন ঘটে থাকে। এমন মহাপুরুষের জন্ম হয়ে থাকে। মহাপুরুষ তার সহায় আছেন সর্ব সময়। ওঁ নমঃ নমঃ দেবায়ে। বর্তমান পবিত্র হোক অতীতের ছায়ে।
1 মন্তব্যসমূহ
খুব ভালো লাগলো
উত্তরমুছুন