শ্রাবণী দাশগুপ্তর গল্প : বিকেলবেলায়


(এক)

রাতের দিকে প্রশান্ত ফোন করেছিল মধুমিতাকে,
“ভালো আছো?”

ওই ক-টা কথাই। মধুমিতা মোবাইল নম্বর চিনতে পারেনি। অজানা নম্বর সচরাচর সে ধরতে চায় না। অসম্ভব আস্তে, প্রায় অস্ফুট গাম্ভীর্যে বলে,
“কে বলছেন?’

ওপাশ থেকে দ্রুত নিঃশ্বাসের শব্দ। মধুমিতা ফোন কেটে দেয়। তার স্বর মুখে মিলিয়ে যাওয়া অতি সুস্বাদু ক্যারামেল কাস্টার্ডের মতো। জোর করে গাম্ভীর্য ফোটাতে হয়, নাহলে লোকে পেয়ে বসে। দু-একমিনিট পরে সেই নম্বর থেকে আবার ফোন! মধুমিতা যথাসম্ভব দুরমুশ করে গলা ভারী করে,

“কে আপনি? না জানালে ব্লক করছি—,”

বলা শেষ হয়না, ওপাশের মানুষ বলে,
“কেমন আছ মধুমিতা?’

সে রেগে ওঠে, ভেবেছিল কোনো ছাত্রের অভিভাবক। এরকম বহু অভিজ্ঞতা তার আছে। আপাতত ফোন ধরে। ওপ্রান্ত বাজে,

“তেইশ বছর পরে—, দেখা করবে প্লিজ?”

“কে? চিনতে পারছি না!”

গলা সে আরো খাদে নামায়। পাশের ঘরে দীপক লুঙ্গি পরে ফোঁৎ-ফরর নাক ডাকছে। সন্ধেবেলা অফিস থেকে ফিরে চা-মুড়ি, তারপর অধিকাংশ দিন ক্লাবের আড্ডা, বাড়িতে থাকলে দেদার ঘুম। ঘুম ভাঙতে রাত প্রায় এগারোটা। তখন উঠে ঢাকা-দেওয়া ঠাণ্ডা খাবারগুলো গেলে। মধুমিতা দেওয়ালে ঘড়ি দেখে, অজ্ঞাতসারে ভ্রূ কুঁচকায়। দীপকের ঘুম পাতলা হয়ে এসেছে, উঠে পড়বে। ফোনে হেঁয়ালি করতে-থাকা লোকটির প্রতি বিরক্ত হয়। ওপ্রান্ত হালকা হাসে,

“আমি প্রশান্ত, প্রশান্ত ঘোষাল, দুর্গাপুর বি-জোন—অসীমকাকু করুণাকাকিমা—ভুলে গেছো?”

“ও শান্তুদা’!?”

“এ-ই রে! দাদা বলতে নাকি আগেও? খেয়াল করিনি। মাত্র এক-ক্লাস সিনিয়ার, ভুলে গেছো?”

আগে কিছু বলতই না মধুমিতা, কথা হয়নি কখনো। প্রশান্ত উদ্‌গ্রীব,
“একদিন দেখা করা যায়?”

“উঁ? দেখছি!”

ফিশফিশ করে মধুমিতা, বুক ধড়ফড় করে। কিছুদিন ধরে সামান্য উত্তেজনাতেও এরকম প্যালপিটিশন হচ্ছে। প্রশান্ত বলে,

“অফিসের কাজে তিনদিনের জন্য এসেছি। বরকে নিয়েই এসো, অসুবিধে নেই”।

“দেখি!”

ফোন বন্ধ করে ঝুম হয়ে থাকে মধুমিতা। একচিলতে ডাইনিং স্পেস থেকে খুটখাট আওয়াজ ওঠে। সে উঁকি মারে, দেওয়ালের দিকে মুখ করে রুটির টুকরো চিবোচ্ছে তার বর। খাওয়া শেষ করে ছাদে যাবে, ধূমপান করবে, পায়চারি করবে, তারপর নামবে। ততক্ষণে সে অঘোর ঘুমে। শ্বশুরমশাই যতদিন জীবিত ছিলেন, ওই সময়ে তাঁর ঘরে বসে থাকত। মধুমিতা নিঃশ্বাস ফেলে শোওয়ার ঘরে যায়, তাক থেকে চিরুনি নেয়। বন্য আকর্ষের মতো উমনো-ঝুমনো লম্বা চুল—আঁচড়াতে অনেকক্ষণ লাগে। নিজের বিছানায় বসে বিনুনি খোলে, ঝেড়ে ঝেড়ে চুল সোজা করে। তাদের শোওয়ার ঘর এক, খাট আলাদা—দেওয়ালের দু-প্রান্তে দু’টো। চুলের অর্ধেক নিয়ে চোখ বুজে আরামের চিরুনি টানে, ঘুমের আগে মাথা খালি করে দেওয়ার চেষ্টা।

দীপক শুনে সহজভাবে বলে,
“আচ্ছা, যাবো। তোমার বাবার কলীগের ছেলে? বিয়েতে এসেছিল?”

“হ্যাঁ”।

এর চেয়েও সংক্ষেপে বলা গেলে বলত মধুমিতা। সারাদিনে সাকুল্যে চারটে থেকে ছ’টা শব্দ খরচ করে। বেশী বকতে ক্লান্ত লাগে। এমনিতে প্রতিদিন জীবিকার জন্যে একই কথা, একই ব্যাখ্যার অজস্র পুনরাবৃত্তি। “হ্যাঁ” বলে অনুমোদন করে, দীপকের সম্মতিতে আশ্বস্ত হয়। হোয়াটস্যাপে মেসেজ পাঠায়,

“সান্ডে ইভনিং যেতে পারি। ভেন্যু জানিয়ো।”

জলতরঙ্গ বুকের মধ্যে নিয়ে মিটিং-এ বসে। অন্যমনস্ক চোখ লক্ষ করেন সিনিয়ার মিঃ টি কে রাও,
“আর ইউ ও-কে মিস্টার ঘোষাল?”

অকারণ অস্বস্তিতে পড়ে প্রশান্ত,
“শিওর—! ফাইন, ফাইন স্যার।”

হোটেলে ফিরে স্নান করে ফ্রেশ হয়। হাল্কা চা চুমুক দিয়ে বিশাখাকে ফোন করে,
“এই ফিরলাম। ডিনার করে ঘুম দেবো, কী টায়ার্ড ভাবতে পারবে না।”

“ঈস—, রেস্ট নাও, শুয়ে পড়ো। ওষুধ খেয়ো, চোখের ড্রপটা দিয়ে নিয়ো শোবার আগে”।

বউয়ের সঙ্গে খানিক খেজুরগাছি করে রুমে জানালার পাশে বসে। বেশ জায়গা, তত ভীড়ভাট্টা নেই। ফ্লাই-ওভার দিয়ে আলো-জ্বালা গাড়ি দ্রুত যাচ্ছে আসছে। কাচ বন্ধ, বাইরের আওয়াজ ঢোকে না। অদূরে হাইরাইজের মাথা, আলোকিত খুপরিরা। পরশু সকালে ছোট্ট মিটিং শেষে দুপুরের ফ্লাইটে ফিরে যাওয়ার প্রোগ্রাম। কিন্তু দেখা না করে—? আসতে রাজি যখন! এ-সি চলছে, বাতাস ঠাণ্ডা। সে ভেবে যায়, নির্ণয় করতে পারেনা। বিশাখাকে জানানো “আটকে গেছি, সোমবারে ফিরবো” বা মধুমিতাকে “এবারে হলো না আর, নেক্সটবারে—?” প্রশান্ত এ-সি রিমোট বাড়ায়, কমায়। ওয়েটার দরজায় এসে ঠুকঠুক করে,
“স্যার ডিনার লায়া”।

ঘুম এসে কেটে যায়, অস্থিরতার ঘূণপোকা কুরকুর কাটে। বাড়িতে সাড়ে বারোটার পরে ঘুমের অভ্যেস। জেগে থাকে, বইপত্র বা নেট ঘাঁটাঘাঁটি। ন-বছর হল বিয়ে করেছে প্রশান্ত, বিশাখা আট বছরের ছোটো। প্রশান্ত এখন ঊনপঞ্চাশ।

মধুমিতার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছেতে গুরুত্ব দেওয়ার দরকার কতটা—খুঁজতে খুঁজতে চোখ জুড়ে আসে। গভীর ঘুমে রাত ভোর। সকালে উঠে সিদ্ধান্ত নেয় মধুমিতা একবার ফোন না করলে যোগাযোগ সে-ও আগ্রহ দেখাবে না। অফিস থেকে হোটেলে ফিরে ছোট্ট ফোনালাপ হয়েছে বিশাখার সাথে, এত বছরেও মেয়েটার হারাই-হারাই ভাব আর কাটে না। দমবন্ধ লাগে প্রশান্তর। রাত সাড়ে আটটায় তাদের টিমের প্রোগ্রাম ডিনার ক্যাপিটল হিল-এ, রথী-মহারথী দু-তিনজন আসবেন। শৌখিন প্রসাধনপ্রিয় সে, তৈরি হচ্ছিল, হঠাৎ বিছানায় শুয়ে-থাকা মুঠোফোনে ‘মধুমিতা কলিং’। ইতস্তত করে, সময় বাঁধা। অফিসের গাড়ি পোর্টিকোতে অপেক্ষা করছে। মধুমিতা বলে,

“সাণ্ডে যেতে প্রব্লেম আছে?”

পরদিন দুপুরের ফ্লাইটে ফিরে যাওয়ার সংবাদ মুলতুবি রেখে নিস্পৃহভাবে বলে,
“ভীষণ বিজি—জাস্ট বেরোবো—রাতে ফিরে প্ল্যান করছি। অসুবিধে আছে?”

মধ্যরাতে প্রশান্তর বুকের ওপরে নগ্ন ঊর্ধাঙ্গ রেখে বিশাখা জিজ্ঞেস করে,
“আজ তো দুপুর তিনটেয় তোমার ফেরার কথা ছিল, ওয়েট করছিলাম। টিকিট চেঞ্জ কেন করলে?”

প্রশান্ত দায়সারা ভঙ্গিতে বলে,
“মিটিং স্ট্রেচড্‌ হলে ছেড়ে আসব নাকি? সরো, গরম লাগছে।”

সময়ে-সময়ে কর্কশ হয়ে ওঠে সে, খাটের ধারে সরে যায়। অসহ্য লাগে বিশাখার উগ্র রিরংসা, ঘষা-মাজা আইভরি-ত্বক, আদেখলাপনা, অবিরাম বকে-যাওয়া। ভীষণ কথা বলে, বেশ ন্যাকা। এইমুহূর্তে গুম হয়ে যায়, সরিয়ে নেয় শরীর। প্রশান্তর অন্যমনস্কতা বুঝে ফেলে, অনুমান করে কী যেন ঘটেছে! তার বর প্রায়শঃ ঠেস মেরে প্যারানয়েড বলে তাকে, বলুক। বিশাখা বরকে আঁচলে বেঁধে রাখতে জানে।

সল্ট লেকের ফ্ল্যাটের আরামদায়ক ইন্টিরিয়র, সুগন্ধি, ঠাণ্ডা ঘর—দু-জনে দু-পাশ ফিরে শোয়।

বেগুনী নরম হ্যাণ্ডলুম শাড়ির মধুমিতাকে আড়চোখে দেখেছিল প্রশান্ত, আঁচল লুটোচ্ছিল হাতের ভরসায়। আগেকার সুকুমার মুখ বয়সের প্রলেপে ভারিক্কী, গালে ব্রণ ইত্যাদির দাগ, বলিরেখাও কপালে। বাদামের মতো চোখে অল্প কাজল, মেরুণ টিপের পটে অজস্র খোলা চুল, শাড়ির রঙে ফুল গাঁথা।

পাশে সাধারণ চেকশার্ট-পরা ভদ্রলোক বিব্রত, বিষণ্ণ, উদাসীন। অযত্নের ঘন চুলে সাদার আধিক্য। বিয়ের দিনে দেখা ছিপছিপে লাজুক তরুণের চেহারা প্রশান্তর মনে নেই। পরিচয় মিটলে রেস্টুরেন্টের কোণার দিকে তিনজনে বসে কথা বলে। দু-চার কথা, আশপাশ ঘুরে দেখা। চানক্য বি-এন-আর—হেরিটেজ হোটেল, খাওয়া-দাওয়ার চেয়ে বেশী সুন্দর প্রকৃতি-বান্ধব প্রেমিসেস।

সেদিন সন্ধ্যে পেরোলে মা-র কাছে গেল মধুমিতা, তাদের বাড়ির পাশে ছোটো ভাড়াঘর। তার বাড়ির জমিটুকু সে কিনেছিল বাবার রেখে-যাওয়া সামান্য টাকায়। বাবার সঞ্চয়ের অধিকাংশ গেছে তাঁর ক্যান্সারের চিকিৎসায়। মা অল্পটাকার উইডো পেনশন পান। চোঙার মতো সরু তিনতলা বাড়িটা বানাতে সে আর দীপক আধাআধি লোন নিয়েছিল।

মমতা জিজ্ঞেস করেন,
“শান্তু কী বলল রে?”

“উঁ? প্রচুর খাওয়াল।”

“এ বাবা, আমি ভাবলাম তোরাই খাওয়াবি, তোদের গেস্ট--!”

“রাজী হল না।”

“পরের বার এখানে আসতে বলিস, আমি রেঁধে খাওয়াব।”

হেঁটে ফিরতে ফিরতে মধুমিতা ভাবে, মা-র যত বস্তাপচা আদিখ্যেতা।

দীপক রাতে খায়নি, দুপুরের খাওয়াতে নাকি বদহজম হয়েছে। অ্যান্টাসিড খেয়ে শুয়েছে। মধুমিতা চুল-টুল বেঁধে শুয়ে পড়ে। বাড়ি ফাঁকা বছরদুই ধরে, পিঠোপিঠি রিকু-টোটো দুজনেই হস্টেলে।


(দুই)

“ভালো আছো মধু?” মাসচারেক পরে একই প্রশ্ন ছোটোখাট বালির বাতাস হয়ে আসে। মধুমিতা কোয়েশ্চেনেয়ার তৈরি করছিল কোচিং সেন্টারের। চোখ বুজে বালিশ চেপে বুকের দপদপানি সামলায়। নিজের অদ্ভুত প্রতিক্রিয়ায় নিজের ওপরে রেগে ওঠে। বালি-টালি ঝেড়ে স্থির হয়ে লেখে,

“ভালো। তোমরা ভালো তো?”

“আবার ট্যুর তোমার শহরে। প্রায়ই থাকবে এখন—প্রজেক্টের লম্বা কাজ শুরু হয়েছে। বারবার যেতে হবে।”

“ও।”

“দেখা করবে তো?”

উত্তর না লিখে অনলাইন থাকে মধুমিতা। বই ওল্টানোর ফাঁকে মোবাইলে চোখ তার। প্রশান্ত টাইপ করছে অনেকক্ষণ ধরে! রোমান হরফে টেক্সট আসে,
“তিনদিনের ট্যুর—এবারও স্যাটারডে দুপুরে ফেরা। মন্‌ডে রিটার্ন ম্যানেজ করেছি, তোমাকে ছুটি নিতে হবে না। রবিবার হোল-ডে প্ল্যান। রাজী হবে?”

গত মাসগুলো মধুমিতা যেমন থাকে তেমনই ছিল, খুচরো হেলদোল বাদে কিচ্ছু বদলায় নি। এই মুহূর্তে গলার নলিতে রুদ্ধ শ্বাস ‘হুঁক’ শব্দ করে বেরিয়ে আসে, সে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে। যদিও দীপক একতলায়, ড্রইংরুমে টিভি দেখছে। প্রশান্ত টাইপ করে,
“এসো—প্লিজ। একা এসো”।

“পরে জানাবো” দ্রুত লিখে মোবাইল সুইচ অফ করে দেয় সে। কেন কাঁপুনি দেয় শরীরে? দোতলায় ছেলেদের ঘরে বসে কাজ করছিল, বইখাতা গুটিয়ে, মোবাইল ফেলে পাশের ঘরে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। খাওয়া হয়নি, রান্নার মাসী নীচে কিচেনে রান্না করে রেখে গেছে। গুছিয়ে তুলে আনতে হবে, দোতলায় ডাইনিং-এ। ‘থাক পড়ে’ সে ভাবে। কী সম্পর্ক প্রশান্তর সঙ্গে? কোনওদিন কথাই হয়নি, দুর্বলতা দূরের কথা। প্রশান্ত চোখ নামিয়ে পথ হাঁটত, সে-ও তাই। বাড়িতে কড়া শাসন, মেধাবী পরিশ্রমী ছাত্র, পাড়ায় ভালো ছেলে। মধুমিতা মধ্যমেধার। প্রশান্তর বোন পৌলোমীর সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল, একই স্কুল, এক ক্লাস ছোটো।

‘পলি আছে?’ বললে প্রশান্ত দরজা খুলে মাথা নেড়ে সরে যেত।

বেশ ক-বছর হল তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক স্তিমিত, অনেক কিছু জুড়ে আছে বলে হেলাফেলায় গিঁটবাঁধা। উদ্যমহীন, নিস্তেজ, ঘোর মিতব্যয়ী, শৌখিনতাবর্জিত—মধুমিতার ভাষায় ‘নীরস’ দীপক কিছুটা কামশীতলও। মমতাকে কোনোদিন জানায় নি, ছেঁড়াছেঁড়ির উদ্যোগ করে নি। উনি সহ্য করতে পারতেন না। নিজে সম্বন্ধ করেছিলেন, মা-মরা ইন্ট্রোভার্ট ছেলেটির প্রতি অগাধ মায়া। সিলিং-এর দিকে চেয়ে মধুমিতা বলে, “তোমার কপাল ভালো দীপক দত্ত”।

রবিবারে একটাদিন মধুমিতার কোচিং সেন্টারের ছুটি। চুলে শ্যাম্পু, কাচাকাচি, ফুলগাছ, বাজার, কাজ-অকাজে ঘুরে আসা, বন্ধুমিলন বা মা-র কাছে কাটানো। ‘বেরোচ্ছি’ জানিয়ে বের হয়, দীপকও থাকে নিজের মতো—হয়ত ঘরের কোণে বা বাইরে। সপ্তাহের ওই একটা দিন একেবারে নিজের।

সে গেল, নিজস্ব স্কুটিতে। প্রশান্ত এসেছে ড্রাইভার-সহ গাড়ি নিয়ে প্রায় একই সময়ে। বাঁধ-সংলগ্ন পাথুরে টিলায় গাছপালা-ঘেরা সবুজ রক্‌-গার্ডেন। মেরুন টী-শার্ট পরেছে প্রশান্ত, ভারিক্কি শরীরে পাতলা চুলে চশমার ফ্রেমে উচ্চপদাধিকারিকের আভিজাত্য। মধুমিতার বেশ সঙ্কোচ হয়। কাউন্টারে গিয়ে টিকিট কেটে ডাকে,
“আসো ভেতরে যাই?”

শান্ত নিরিবিলি পার্ক, ভারী সুন্দর নির্মান। বাঁধের গা-ঘেঁষে রেইলিং। রোদের আলোয় উজ্জ্বল ঘীরঙ চুড়িদার-কামিজে, ছোটো কপালের মস্ত কালো টিপে, লালকালো ফ্রেমের চশমাতে মধুমিতার শ্যামত্বক কৃষ্ণতর। লিপস্টিকমাখা পাতলা ঠোঁটের পাশে কালো তিল। একঝলক দেখে চোখ সরায় প্রশান্ত, এই মধ্যবয়সী মহিলা অনেক অচেনা। ঘাড় ঘুরিয়ে আশপাশ দেখে, জায়গাটা ভারী পছন্দ হয়, স্বতস্ফূর্ত মন্তব্য করে,
“বাঃ একেবারে ন্যাচারালভাবে সাজানো!”

“হ্যাঁ—।”

“তোমার মতোই—!”

চুপিচুপি বলার মতো জিভ থেকে খসে পড়ে শব্দদুটো। মধুমিতা অস্বস্তিতে গোপনে ব্লাশ করে, পঞ্চাশ ছুঁতে তার আড়াই বছর দেরী। ছোট্ট করে বলে,
“আমি তো দেহাতী।”

প্রশান্তর দিকে তাকায় না, গাইডের মতো আগে-আগে হাঁটে। কোচিং সেন্টারের বড়ো-বড়ো ছেলে-মেয়ে তার ছাত্রছাত্রী, দল বেঁধে বা বিশেষ বন্ধুর সঙ্গে এখানে এসে পড়া খুব স্বাভাবিক। অবশ্য তার এলোপাথাড়ি ঘুরে বেড়ানোর স্বভাব তারা একটু হলেও জানে। দেখা হলে হঠাৎ মুখের সামনে এসে প্রশ্ন করতে পারে,

“ম্যাম, আপকে বয়ফ্রেণ্ড?”

সেই চিন্তা করে মধুমিতা, মনে-মনে বিশ্বাসযোগ্য জবাব গুছোয়।

বাইরে থেকে খাবার আনার অনুমতি নেই। চলনসই একটা কফিশপ আছে, চা-কফি-ঠাণ্ডা আর স্ন্যাক্স পাওয়া যায়। খুলে গেছে দোকানটা। অর্ডার দিয়ে মুখোমুখি চেয়ারে বসে। মধুমিতা অন্য কোনদিকে চোখ ফেলে রাখে। মাথার ঠাসা কালোতে রূপোলি রেখা উঁকি দেয়, সরু লাল সিঁথি। কতক্ষণ শব্দের আকাল, কথার অনটন! কিছু বলতে হবে তাই প্রশান্ত বলে,
“এসেছো যে তোমার হাসব্যাণ্ড জানেন?”

“হুঁ।”

“বাড়িতে আছেন?”

“হুঁ। বেরোবে মনে হল।”

“কোথায়?”

“জিজ্ঞেস করিনি, সে-ও করে না। ছুটির দিন—যে যার মতো, ফ্রি।”

টুকটাক খায় দু-জনে, ওটুকুই শব্দ। ধীরগতির সময়, কত কী ভাবে, মাথায় নড়েচড়ে। প্রশান্ত বলে,
“ভালো!”

“কী?”

“সহজ সুন্দর শহর তোমার, ঝলমল নেই, শো-অফ্‌ নেই। ভালোবেসে ফেলা যায় ফার্স্ট সাইটে—। তোমার মতো!”

পুনরাবৃত্তি হয়ে যায়, মধুমিতার পরিণত বুকের কোটরে হৃদযন্ত্র থরথর, চায়ের চুমুক থেমে যায়। জোর করে হাসে,
“ধ্যাৎ, কী কথা—!”

“ভালো আছো তুমি মধু?”

মধুমিতা রঙিন নখ দিয়ে চটির গোড়ায় খোঁচায়, জবাব খোঁজে। প্রশান্তর জিজ্ঞাসা তার মা, সংসার, দুই ছেলে, ছাত্রছাত্রী, নিজস্ব বাড়ি—এত দরজায় ধাক্কা খায়। সে স্থির গম্ভীর,
“আমি ভালো নেই, কিসে মনে হল?”

থমকে যায় প্রশান্ত। সত্যিই, মধুমিতা অসুখী বাঁচার ইঙ্গিতমাত্র দেয়নি। সহজ হতে কথা ঘোরায়,
“এমনি জানতে চাইলাম। দীপকদা কিসে আছেন?”

“স্টেট গভমেন্টে—এগ্রিকালচার ডিপার্টমেন্ট। সাধারণ পোস্ট, বড়ো কিছু নয়।”

চা শেষ হলে মধুমিতা বলে,
“রোদ নেমে যাচ্ছে, এখানটা ঘুরে দেখবে না?”

ছোট্ট ঝুলন্ত সেতুর ওপরে উঠে ওরা দাঁড়ায়, নামে, পায়ে-পায়ে এদিক-ওদিক করে। মুক্তোরঙ বিকেল নামছে। প্রশান্তর ভেতরটা যেন উথালপাতাল, ঠিক সামনে ছোটো চেহারার ভরন্ত তরঙ্গিনী। নিজেকে জিজ্ঞেস করে, এতবছর কাটিয়ে এসে কেন এই চিত্তদৌর্বল্য? যে সময়ে ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা ছিল, মনের জোর ছিল শূন্য। এবয়সে এসে থিতু সবটুকুকে ঝাঁকিয়ে ওলট-পালট করে দেওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি করা অন্যায়! সে অনুরোধ করে,
“ড্যামের পাশে একবার মধু—যদি!”

“এসো, যাই।” স্কুটিতে বসতে বসতে সম্মতি দেয় মধুমিতা।

রোদের ঢলে যাওয়া বাঁধের জলের প্রতি সেন্টিমিটারে সোনা ছড়িয়েছে। গরম নেই, শুধু বাতাস তপ্ত। অপলক মধুমিতা, বহুবার দেখা দৃশ্যে স্থির চোখ, থমকে আছে আপাত-অভিব্যক্তিহীন মন। দূরত্ব রেখে অনেকক্ষণ বসে প্রশান্ত, ধীরে-ধীরে কাছে সরে আসে। কত কী বলতে ইচ্ছে করে, স্পর্শ করতেও, চেষ্টা করে সংযত থাকে। মধুমিতা সেই ছোট্ট প্রবাহে ঈষৎ হাসে, যেমন বসে আছে সেভাবেই বলে,
“আমার ফোন নম্বর কোথায় পেয়েছ?”

প্রশ্নটা আসতই, উত্তর ভাবা ছিল না। প্রশান্ত ইতস্তত এলোমেলো,


“ওই আর কী, কাঠখড় পোড়াতে হল একটু। শুনলাম পলির দুর্গাপুরের বন্ধুদের গ্রুপের দু’য়েকজনের তোমার সঙ্গে যোগাযোগ আছে—পাপিয়া, শ্রীপর্ণা আর যেন কে-কে। পলিই যোগাড় করে দিল, এখানে আছো জানে—বিয়ের পর থেকে।”

“পলি ভালো আছে?”

বলে মধুমিতা। অন্ধকার পাতলা চাদরের মতো ছাইছে, রোদরশ্মি আকাশের একপ্রান্তে অপেক্ষা করছে, পাখিদের ব্যস্ত ঘরে ফেরা। সে ছোট্ট হাই তোলে,
“ফেরা যাক।”

শব্দদুটো নাড়িয়ে দেয় প্রশান্তকে। ঘেঁষে বসে, মধুমিতার পিঠে হাত ছড়িয়ে আকর্ষণ করে নিজের দিকে। ফ্যাশফ্যাশ করে,
“যখন আসব, আশ্রয় দেবে না মধু?”

মধুমিতা আড়ষ্ট থাকে কিন্তু পিছলে যায় না। একটু পরে আদুরে বেড়ালের মতো শরীর শিথিল করে প্রশ্রয় দেয়। প্রশান্ত আর এগোয় না, অন্যান্য তীব্র ইচ্ছেদের শাসন করে শান্ত রাখে। কতক্ষণ এরকম, যতক্ষণ অন্ধকার না ঢেকে নেয়। তারপর আলগা হয়ে বলে,
“চলো ফিরি।”



(তিন)

নিঝুম রাতে ভীষণ কষাটে গলায় দীপক জানতে চায়,
“কী করছো তুমি?”

“কিসের?”

নিজের বিছানায় দেওয়ালমুখী শুয়ে মধুমিতা। দীপক তিরের মতো সোজা হয়ে বসে,
“কিসের? বাঃ! বুঝতে পারছ না?”

মধুমিতা ভয় পায়, এই মানুষের জমা রাগের ভয়ঙ্কর বহিঃপ্রকাশ এতবছরে চার-পাঁচবার দেখেছে। বিয়ের পরে বরকে নিয়ে মামুলি ক’টা স্বপ্ন ছিল, কিছুই মেলেনি। সেও তাকে কথার আঁচড়ে কম বিক্ষত করেনি। অথচ দু-বছরের মাথায় পিকু এল, আর দু-বছর পরে তোজো। ছেলেদের অসম্ভব ভালোবাসে দীপক। অধীর মারা যাওয়ার পরে মমতাকে এখানে এনে রাখার পরিকল্পনা দীপকেরই, সে মা-ই ভাবে।

দীপক কাঁদে, আক্রোশের, আক্ষেপের কান্না, জ্বালা-জ্বালা গলাতে বলে,
“তোমার কোনো ব্যাপারে কখনো ইন্টারফেয়ার করেছি? ডিড্‌ আই? তবে লাস্ট দু-বছর তুমি কেন—উইদ্‌ দ্যাট—?”

গলা থেকে টকটক ঝাঁঝ ওঠে। মধুমিতা শোনে, দুঃখ হয় না, কিছুটা জমাট কষ্টের শ্বাস বেরিয়ে আসে। নিজের কাছে স্বীকার করে, এতবছরে বরের জন্যে এক খামচা মমতা ছাড়া আর কিছু জমাতে পারেনি।

“তোমার শহরের আশপাশে কত চমৎকার নির্জন জায়গা।”

কতবার যে প্রশান্ত বলে এই কথা! ওরা পরস্পরের শরীরের গোপন তিল চিনেছে, যদিও দু-বছরে তিন-চারবারমাত্র অতটা ঘনিষ্ঠ হয়েছে। বেশীটাই পাশাপাশি বসা, ছুঁয়ে থাকা। প্রাপ্তবয়স্ক মনের একটি চেয়েছে উত্তাপ, অন্যটি চন্দন। মধুমিতা জানতে চেয়েছিল,
“তবে তখন একবারও কেন—?”

“সাহস ছিল না মধু, বাড়ির বিরুদ্ধে যেতে পারতাম না। তোমরা কায়স্থ, তুমি ফর্সা নও! তারপর কত খুঁজেছি, তোমার মতো কাউকে—, তোমাকে!”

“একসাথে পালিয়ে যেতাম নাহয়—চাকরি একটা পেয়েই যেতে তুমি। তা তোমার বউ বুঝি ফর্সা খুব?”

“হ্যাঁ।”

“ফর্সা সুন্দরী স্বজাতি—বাড়ির সকলে খুশী। তবে?”

“কী জানি! অসুস্থ মা খালি আক্ষেপ করতেন। করলাম বিয়ে, অনেক দেরী করে। কিন্তু তোমার মতো—!”

“আঃ!”

“তুমিও তো আমাকে বলতে পারতে!”

“আমি!!”

মধুমিতা হেসে ফেলে। চুপ করে ভাবে, “ওই বয়সে তোমার জন্য কোনো ফিলিংস্‌ ছিলও না আমার। যা গোঁড়া বাড়ি তোমাদের! আর তুমিও এখন সত্যি বলছ বিশ্বাস কী?” শব্দগুলো মুখে আনেনি। একটা বয়সের পরে বিশ্বাসের শিকড়ের ত্বকে মোটা আস্তরণ জন্মায়, সহজে ভেজানো যায় না।

অনেক সময়ে এমন ঘটনা ঘটে যা না ঘটলে জীবনের ছন্দ শেষ পর্যন্ত সমতালে বাজে। ওদের মেলামেশা, দু-বছরের গল্প জানাজানি হয়ে গেছে। স্বভাবত ঝড় উঠেছে। নাগরিক জীবন থেকে খানিক সরে দূরে গিয়ে মুখোমুখি বসে দু’জনে—আত্মবিশ্লেষণ, পরিস্থিতি-সমীক্ষা বা ওরকম কিছু। প্রশান্ত সাধারণ প্রশ্ন করে,
“ভেবেছ কিছু?”

মধুমিতা নীরবে মাথা নাড়ে, চশমার পেছনে জ্বলজ্বল চোখ। নেশালু দুপুরে অদূরে গ্রামের ভেতরে কোথাও আদিবাসী পল্লীতে কীসের উৎসব চলছে। মাদলের আওয়াজ দুলিয়ে দিয়ে যায়, তারস্বরে ডাকে পাখি। সে গলায় চিবুক গুঁজে অদ্ভুত ভঙ্গিতে বসে থাকে। মস্ত হাতখোঁপা উঁচু হয়ে আছে, ফুরফুর করে ওড়ে সুগন্ধ নীল ওড়না। প্রশান্ত আলতো হাত রাখে ওর মাথায়,
“শেষ পর্যন্ত কিছুই বোধহয় ব্যক্তিগত থাকে না, রাখা যায় না”।

“কী জানি?”

তাদের বন্ধুতা, পারস্পরিক বোঝাপড়া, টিউনিং, মুক্ত সম্পর্ক, মানসিক আশ্রয়—সমস্ত গণঅভিযোগের মুখোমুখি। মধুমিতা স্বভাববিরুদ্ধ উঁচু গলায় বলে,
“আমার কিন্তু অপরাধবোধ নেই জানো?”

প্রশান্ত ক্লিষ্ট হাসে, ভাঙা-ভাঙা গলা।

“ভালো! তুমি জানো না, আমি কিসের মধ্যে দিয়ে চলেছি”।

মধুমিতা তার মুখের দিকে তাকায়, যন্ত্রণা ছোঁওয়ার চেষ্টা করে। করুণভাবে বলে,
“প্রচণ্ড অশান্তি হয়েছে, না?”

“বিশাখা শিলিগুড়ি চলে গেছে ওর বাবার বাড়িতে। ডিভোর্সের কেস ফাইল করে চিঠি পাঠাবে”।

ক’রাত শান্তিতে ঘুমোতে পারেনি প্রশান্ত। বিধ্বস্ত দেখায় তাকে, জোরে-জোরে রুমালে ঘষে মুখ মোছে। মাথার পাতলা চুল যেন আরো পাতলা। জুলফির কাছে সাদা বেরিয়ে গেছে। বিশাখার জ্বলন্ত মুখ চোখের সামনে।

“প্যারানয়েড আছি, তাই না? ইউ ডিবচ! পার্ভার্ট! লায়ার! প্রজেক্ট হেড! গত দু-বছর ধরে দিনের পর দিন, দিনের পর দিন বলে গেছ মিটিং স্ট্রেচড্‌! আরো কীযেন সব এক্সকিউজেস্‌ দিয়েছ? অফিস কলীগ অনেকে আমাকে বলেছে, তুই খোঁজ নে বী—কী করছে ওখানে। আমি উড়িয়ে দিয়েছি—ও আমাকে ভালোবাসে, ঠকাবে না।”

প্রশান্তর যুক্তি দুর্বল, গুছিয়ে কথা বলতে পারেনি। জড়িয়ে ধরে শান্ত করতে গেছে, পারেনি। বিশাখা কৈফিয়ৎ চেয়েছে,
“আমাকে কেন বিয়ে করেছিলে? দেখেশুনে, কোর্টশিপে ছ-মাস কাটিয়ে?”

প্রশান্ত এত উদ্‌ভ্রান্ত হয়ে পড়বে পারমিতা ভাবতে পারেনি। আগে প্রায় বলত, “আমার বউ এত টকেটিভ, এমন ভার্বোস, সামটাইমস্‌ ইনটলারেবল্‌, অসহ্য লাগে। জানেই না কেমন করে নিস্তব্ধ সময় কাটাতে হয়।”

মধুমিতা আঘাতের অভিঘাত বোঝার চেষ্টা করে, খুব ক্লান্ত লাগে হঠাৎ, শীত-শীত করে ওঠে। ইচ্ছে করে সবুজ মাঠে শালগাছের গোড়ায় শুয়ে পড়তে। কেউ কিচ্ছু জানতে চাইবে না, উঠতে বলবে না। প্রশান্ত খানিক সুস্থির হয়,
“তোমার বাড়িতে? তত কিছু হয়নি, না?”

মধুমিতা অনেকটা ভেবে অন্যমনস্ক গলায় বলে,
“মা বড্ড কান্নাকাটি করেছে।”

“আর ছেলেরা?”

“কথা হয়নি। পিকুর কলেজে ক্যাম্পাসিং চলছে, তোজোর একজামস্‌। ব্যস্ত দুটিতেই”।

আদিবাসী পল্লীর মাদলের শব্দ মিলিয়ে আসছে, মানুষজনের গলার অস্পষ্ট আওয়াজ ভাসছে। হয়ত বা খাওয়াদাওয়া শুরু হয়েছে। কী যেন মনে পড়ে, তাড়াহুড়োয় হাতব্যাগ খুলে টিফিনকৌটো বের করে মধুমিতা,
“ভুলে গেছিলাম, মোতিচুর লাড্ডু আছে পাঞ্জাব সুইটসের, তুমি ভালোবাসো। খেয়ে নাও, নাহলে শুগার ফল করলে এখানে মুশকিল!”

প্রশান্ত আপত্তি করে না, খায়। অনেক দূরের দিকে তাকিয়ে বলে,
“মধু! এ কী ইনফ্যাচুয়েশন?”

“উঁ? হয়ত তাই!”

“না। দু-জন অ্যাডাল্ট যখন কনসিকোয়েন্স জেনে-বুঝে এগোয়, তাকে ইনফ্যাচুয়েশন বলা যায় না। গোপন রাখা দৈনন্দিন ঝঞ্ঝাট এড়াতে, কিছু পার্সোন্যাল থাকুক, এজন্যেই। মধু--,”

“উঁ?”

“একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারো?”

“কী?”

“চলে এসো আমার কাছে?”

মধুমিতার গলার কাছে মাকড়সার জালের একটা দলা—অনেক কষ্ট, আবেগ, অনুভূতি একসাথে ঠেলাঠেলি করছে বের হওয়ার জন্যে। সে কথা চেপে রেখে জোরে জোরে মাথা নাড়ে, হয়না। প্রশান্ত বলে,
“ছেলেদের কথা ভাবছ? ওরা আমাকে পছন্দ করে!”

মধুমিতা কিছুই বলে না। ছেলেরা দীপকের প্রাণ, দীপকের স্বভাবের দুর্বলতাগুলোতে ওদের কিচ্ছু যায় আসে না। বাবাকে ভীষণ ভালোবাসে, স্নেহ করে। আর মধুমিতা ওদের কাছে মস্ত আকাশ, অটুট আশ্রয়, পায়ের নীচের জমি। মধুমিতা উঠে পড়ে। প্রশান্ত দেখে, পিছু না ডেকে তাকে অনুসরণ করে। বাড়ি অনেক দূর।


(চার)

প্রশান্তর প্রজেক্ট এখন অন্য রাজ্যে, টেম্পোরারি ট্রান্সফার নিয়ে সেখানে চলে গেছে। মধুমিতার শহরে আর আসা হয় না। এক সজীব অপেক্ষা থাকে তবু—হয়ত একদিন তার কাছে আসবে মধুমিতা। ডিভোর্সের মামলা ঝুলছে কোর্টে। প্রশান্ত মিউচ্যুয়াল করার প্রস্তাব দিয়েছিল, বিশাখা সহজে নিষ্কৃতি দেবে না বলে জানিয়েছে। অ্যাডালটরির চার্জ এনেছে।

মধুমিতা নিজের ঘরে একা থাকে, খুব খাটে, সারাদিন ব্যস্ত। কিছুদিন হল মমতাকে তার কাছে নিয়ে এসেছে। মমতা ভালো নেই, শরীর-মন একেবারে ভেঙে গেছে। তিনতলার ঘর থেকে কোচিং-এর প্রাইভেট গ্রুপ মমতার ভাড়াঘরে সরিয়ে নিয়েছে সে। সেঘরে দীপক একা থাকে, স্বপাক আহার।

খাওয়া সেরে, চুল বেঁধে, রাতের প্রসাধন সেরে, ঢলঢলে রাতপোশাকে স্থির হয়ে বসে মধুমিতা। পরদিনের সমস্ত কাজের তালিকা ভাবে। একএকদিন এসময়ে তার বুকের খাঁজ থেকে দামী বিদেশী আফটারশেভ লোশনের গন্ধ আসে, সন্ধ্যেবেলায় কেউ যেন আলগা মুখ ঘষে রেখেছে। শরীর শিরশির করে, চোখ ডবডবে হয়ে ওঠে। সপ্তাহে একটা দিন অনেক রাতে কল্‌ আসে,
“কেমন আছো মধু?”

“ভালো। তুমি ভালো থেকো।”

মৃদুমধুর গলায় সে বলে। প্রশান্ত বলে,

“ভিডিও কল করবো? ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করে।”

মধুমিতা সম্মত হয় না, সে জোর করে না। মধুমিতা উঠে তাকের একেবারে পেছনে রেখে দেয় আফটারশেভ লোশনের শিশি। শেষবার যাওয়ার আগে প্রশান্ত দিয়ে গিয়েছিল—গোপন, একান্ত ব্যক্তিগত।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ