দীপ শেখর চক্রবর্তীর গল্প : সতেরো বছরের নিঃসঙ্গতা



আমরা আমাদের ভবিষ্যতের স্মৃতি ছাড়া কিছুই নই।

একটা রুক্ষ এবং রঙশূন্য শরীরের ভেতর প্রায় স্পন্দনহীন প্রবাহ। ভোরবেলার কুয়াশাঘেরা গমের মতো ওর দুটো হাত আমার পাশে ছিল। আজ থেকে ঠিক সতেরো বছর আগে। লেপের ভেতরে গরমে আমার সমস্ত শরীরে তীব্র অস্বস্তি সত্ত্বেও, কিছুতেই আমি মাথা বের করে আনছি না। এমন অস্বস্তি আমার ভালো লাগছিল। আমি এই অস্বস্তির মধ্যে থেকে নিজের ভেতরে হলুদ রঙের ঘন এক প্রবাহের কথা বুঝতে চাইছিলাম।

ঠিক এগারো দিন আগে মারা গেছে তিতিরদিদির বাবা, আমার বড় পিসেমশাই।

গোটা বাড়িতেই তাই শাদা রঙ করার আয়োজন চলছিল দশদিন ধরে। এটা এখানকার পৌরসভার নিয়ম। কোনও বাড়িতে মৃত্যু এলে, তারা নিজেদের লোক পাঠিয়ে রঙ করে দিয়ে যায় সমস্ত দেওয়ালগুলো। এমনকী, আসবাবপত্রগুলোকেও বাদ দেয় না। শাদা রঙে ঢাকা পড়ে এমনকী দেওয়ালের টিকটিকিগুলোর শরীরও। তিতিরদিদি সেই শাদা রঙ থেকে বাঁচাতে পারেনি নিজের বাবার আঁকা ছবিগুলো। এত বড় এবং আশ্চর্য রঙের ছবিগুলোর ওপরেও শাদা রঙ করে দিয়ে গেছে মূর্খ লোকগুলো। তারা শুধুমাত্র আদেশ পালন করতে জানে আর যারা আদেশ দেন তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য, যে কোনও উপায়ে শিল্পকে শাদা একটা রঙের প্রলেপে ঢেকে ফেলা।

দেওয়ালে দেওয়ালে নিজের আঁকা ছবিগুলো বাঁচাতে পারেনি তিতিরদিদি। শুধু খাটের তলায় কিছু জায়গা এবং স্নান ঘরের খুব দুর্গম কিছু কোণ ওদের নজর থেকে বেঁচে গেছে।

পিসেমশাইয়ের মৃত্যুটা খুব একটা স্বাভাবিক নয়। নিজের জীবনে ছবি আঁকিয়ে হিসেবে খুব একটা নাম করতে না পারলেও, গোটা জীবন ছবি আঁকা ছাড়া কিছুই করেনি পিসেমশাই। সামাজিক এবং পারিবারিক সমস্ত দায়িত্ব পালনে চূড়ান্ত ব্যর্থ। বড় পিসির সঙ্গে বিয়েটা হয়েছিল বলে কিছুটা বেঁচে গিয়েছিল। বড় পিসি খুবই মেপে চলা মানুষ। নিজের সামাজিক এবং পারিবারিক দায়িত্ব সম্পর্কে খুবই সচেতন। তিতিরদিদিকে ছোট থেকে বড় করা, পড়াশুনো, সমস্ত কিছুই একার হাতে সামলেছে। ছোটবেলা থেকেই এই বাড়িতে আসা নিয়ে একটা আনন্দ ছিল আমার মধ্যে। এমনকী, আমি যখন খুবই ছোট, তখন থেকেই পিসেমশাইয়ের ঘরে গিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে তুলি ধরে রঙ বুলোতাম যে কোনও একটা সাদা কাগজে। গোটা বাড়িটাকে তখন আমার মনে হত একটা রূপকথা। বড় পিসেমশাই এবং পিসি দুজনেই ছিল মিলেমিশে থাকা এক মানুষ। আমরা কখনওই ওদের মধ্যে সামান্যতম ঝগড়া বা বাকবিতণ্ডা দেখিনি। একটি সুখী পরিবারের ছবি সর্বদা ওদের মুখের ওপরে ভেসে থাকত।

যদিও কিছুটা পরে তিতিরদিদির কাছেই জানতে পেরেছিলাম, প্রকৃত ছবিটা আসলে সেরকম ছিল না।
সেই বড় পিসিকেই সেবার খুব ভেঙে পড়তে দেখেছিলাম। পিশেমশাইয়ের মৃত্যুর রাতে। পিসি অনেক রাত অবধি নিজের ছবি আঁকার ঘরে বসে ওঁকে ছবি আঁকতে দেখেছিল। খুবই মগ্ন হয়ে ছবি আঁকছিল পিসেমশাই। রাতেরবেলা ঘুমোতে আসেনি। সকালবেলা উঠে কোথাও আর ওকে খুঁজে পাওয়া গেল না। শুধু ছবি আঁকার চেয়ারের ওপর পড়ে ছিল ওর রাতের পোশাক। টেবিলের ওপর ছিল একটা সেল্ফ পোর্ট্রেট। খুবই যত্ন করে আঁকা। চোখদুটো অসম্ভব বেদনাময়। এই ছবির ঠিক নীচে নিজের নাম, সঙ্গে জন্মের তারিখের পাশাপাশি সেই রাতের একটা তারিখ।

এইভাবে পিশেমশাই নিজের মৃত্যু চিহ্নিত করে গেল।

এগারো দিন হল কিছুতেই নিজেকে সামলে উঠতে পারেনি পিসি। আমার বাবা, মা, ছোট পিসি, জেঠু, জেঠিমা সকলেই তখন ঐ বাড়িতে। বড় দাদা তখন পড়াশুনোর সূত্রে দূরে হোস্টেলে থাকত। আসতে পারেনি। আসেনি ছোট পিসেমশাই। পিসিকে সামলানোর পাশাপাশি তিতিরদিদিকে সকলেই নানারকম ভাবে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু তিতিরদিদি তখন আশ্চর্য নির্লিপ্ত!

শুধু পৌরসভার লোকেরা এসে সমস্ত ছবিতে যখন শাদা রঙ চাপিয়ে দিচ্ছিল, তখন উত্তেজিত হয়ে উঠছিল তিতিরদিদি। তাদের থেকে কীভাবে সমস্তটা বাঁচানো যায়, সেই নিয়ে সারাদিন উত্তেজিত হয়ে থাকত। যুদ্ধ করবার নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করত ও।

কিন্তু যারা নির্লিপ্তভাবে শুধুমাত্র আদেশ পালন করে, তাদের সঙ্গে কি কোনওরকম ভাবেই যুদ্ধ করা যায়?

বিগত দশদিনে অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়েছিল তিতির। বাবার ছবিগুলোর অনেককটা সাধ্যমতো বাঁচিয়েছে। অনেক লড়াই করেছে। তবে এই লড়াই ওর ভেতরে যতটুকু প্রাণশক্তি বাকি ছিল, সবটাই নিংড়ে নিয়েছে। কুয়াশায় আছন্ন একটা গম গাছের মতো শরীর নিয়ে আমার পাশে লেপের ভেতরে মুখ ঢুকিয়ে শুয়েছিল ও। আজ থেকে সতেরো বছর আগে, পিশেমশাইয়ের মৃত্যুর ঠিক এগারো দিন পর।
তোকে একটা কথা বলব, কাউকে বলবি না তো?

কী কথা, বলো?

না, আগে বল কাউকে বলবি না। এমনকী, মামা-মামিকেও না!

বলব না।

ঐ লেপের ভেতরের অন্ধকারেই আমার দিকে ঘুরে ঘন নিঃশ্বাস নিয়ে তিতিরদিদি গলার স্বরকে যথাসম্ভব নামিয়ে রেখে বলেছিল,
বাবা আসে আমার সঙ্গে দেখা করতে।

কথাটা শোনার পর আমার শরীর যেন একটা হিমবাহের গায়ে ধাক্কা খেল। কী বলতে চাইছে তিতির? আমি কোনওভাবে নিজেকে একটু সামলে জিজ্ঞেস করলাম,
কোথায় দেখতে পাস?

নিজের স্বর নিজেই শুনে বুঝেছিলাম, তা অত্যন্ত শীতল এবং শুকনো।

তিতিরদিদি অনেকক্ষণ উত্তর দেয়নি। তারপর সেরকম নীচু গলায় বলল,
মাঝে মাঝেই আমাদের বাগানে, একেকদিন ছবি আঁকার ঘরে। ছাদে জামাকাপড় আনতে গিয়ে দেখি সেদিন, চেয়ারে বসে ছবি আঁকছে। এমনকী...

এমনকী?

ভয় পাস না আমার কথা শুনে।

ভয় না পাওয়ার কথা শুনে মানুষের ভয় যে দ্বিগুণ বেড়ে যায়, সেটা ঐ বয়সে তিতিরদিদি জানত কি না জানি না, তবে আমার জীবনের অভিজ্ঞতায় তা এক চিরস্থায়ী আসন লাভ করল। আমি সরে গেলাম আরও তিতির দিদির দিকে। ওর গা থেকে অদ্ভুত সুন্দর ফুলের গন্ধ আসছে। কোন ফুল?

এমনকী, মাঝে মাঝে রাতের বেলা আমার খাটের তলায় দেখি বাবা বসে বসে ছবি আঁকছে।

খপ করে ধরলাম তিতিরদিদির হাতের ওপরের অংশ। একটা চিৎকার করতে গিয়েও সেটা গলায় আটকে গেল। তিতির মাথার ওপরে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
ভয় পাস না। বাবা লুকিয়ে পড়েছে সবার থেকে। সমস্ত চিন্তা, দুঃখ, যন্ত্রণা, কলঙ্ক, অপমানের বাইরে গিয়ে নিজের মতো করে থাকছে। কোনও ক্ষতি করবে না আমাদের। বাবাকে লুকিয়ে রাখতে হবে। নইলে ঐ লোকগুলো বাবাকে ধরে নিয়ে যাবে একদিন। বাবাকে আমাদের লুকিয়ে রাখতে হবে পুকু।

তবে বাবাকে লুকিয়ে রাখার জন্য যে আসলে বাবাকে খুঁজে পেতে হয়, এই খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা অথবা দুশ্চিন্তায় আমি কাঠ হয়ে রইলাম। দুদিন পর বাবা মা চলে গেল বাড়ি। ছোট পিসি, জেঠুরাও চলে গেল। ফাঁকা বাড়িগুলো আর কতদিন ফেলে রাখা যায়! এছাড়া সমস্ত শোকের একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা আছে। সেটা অতিক্রম করে গেলে শোক পুরোনো হয়। পুরোনো শোক নিয়ে যারা আছন্ন থাকে, এই পৃথিবীতে তাদের স্থান খুব দুর্বল। আমাকে রেখে গেল ওরা তিতিরদিদির কাছে, যেটা আমি একেবারেই চাইনি। তবে তিতির আমাকে রেখে দেওয়ার জন্য বিশেষ আগ্রহ দেখালো। সেই বয়সে নিজের স্বার্থপরতার কথা ভাবলে এখন আশ্চর্য হই! একটি ভয় থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য কীভাবে আমি পালিয়ে আসতে চেয়েছিলাম তিতিরদিদিকে একা ফেলে।

তবে পরিস্থিতি অনেক স্বাভাবিক হয়ে আসছিল। গোটা বাড়িটাকে মৃত্যুর রঙে রাঙিয়ে চলে গেছিল পৌরসভার লোকেরা। বড় পিসি ফিরেছিল রান্নাঘরে। তেল ধোঁয়ায় সেই ফ্যাকাসে শাদা রঙের ওপর জীবনের ছাপ ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছিল। এদিকে বোধহয় আমার কথা ভুলেই গেছিল বাবা মা। দুদিন এসেও বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা কিছুই বলেনি। আমিও সেই প্রথম দিনের মতো আগ্রহ দেখাইনি। শীতের দীর্ঘ ছুটি ছিল আমার স্কুলের, এছাড়া তিতিরদির সঙ্গে থাকার একটা অভ্যেস তৈরি হয়ে গেছিল।

রোজ সকালবেলা উঠে আমরা তুলি রঙ নিয়ে ঘরের দেওয়ালগুলোতে ছবি আঁকতে বসতাম। দুপুরবেলা পিসেমশাইয়ের ছবিগুলো থেকে শাদা রঙ মুছে মুছে তোলার চেষ্টা করতাম, যদিও সেই একটা ক্ষেত্রেও সফল হতাম না। ছবিগুলো নষ্ট করে দিয়ে গেছিল ওরা। বিকেল এবং সন্ধের মাঝের সময়টা ছাদে বসে বসে অদ্ভুত গ্রাম্য সুরে গান গাইত তিতিরদি। সেই গানের একটা কথারও মানে বুঝতাম না। রাতের দিকে পাতা জড়ো করে বাড়ির পেছন দিকের বাগানে আগুন জ্বালাতাম। পিসেমশাইয়ের কথা আর কোনওরকমভাবে উল্লেখ করত না তিতিরদি। ফলে আমার সেই পুরোনো ভয়টা আর হচ্ছিল না। তিতিরদিকে দেখে মনে হয় এই জীবনের সমস্তকিছু থেকে ও ধীরে ধীরে অন্য কোনও এক জীবনে মগ্ন হয়ে পড়েছে। সারাদিন দেওয়ালে ছবি আঁকে এবং আমি আশ্চর্য হয়ে দেখি ওর ছবি আঁকার মধ্যে পিসেমশাইয়ের দক্ষতা কেমন ফুটে উঠছে। অথচ এই কিছুদিন আগে অবধি ছবি আঁকার হাত তেমন ভালো ছিল না ওর। এখন দেওয়ালে দেওয়ালে এমন ছবি ফুটে উঠছে, যেন মনে হয় তিতির নয়, আমার পিসেমশাই আবার ফিরে এসেছে।

পিসেমশাইয়ের যে ছবিগুলো থেকে আমরা শাদা রঙ তুলেছিলাম, সেই ছবির কাঠামোর ওপরে রঙ দিয়ে ঠিক একইরকম ছবি এঁকে দিত তিতির। আমি আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। সন্ধের দিকে ওর বিচিত্র গান আরও বেশি মায়াবী হয়ে আসত। আসলে কি গান? এ যেন সন্ধের আকাশের সঙ্গে একটা কান্নার সুরে আলাপ করত তিতির। একদিন এইসব কাণ্ড দেখে রাতের বেলা অস্থির হয়ে তিতিরকে জিজ্ঞেস করলাম,
তুই এত ভালো ছবি এই কয়েকদিনের মধ্যে শিখলি কীভাবে?

তিতিরের চোখে বিস্ময়। যেন বোকার মতো এই প্রশ্নটা করে ফেলেছি।

কেন? তোকে বলেছিলাম না? বাবা আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে। বাবাই তো হাতে ধরে...

কী বলছিস? সত্যি করে বল না!

তোর আমার কথায় বিশ্বাস হয় না?

না, হয় না।

ঠিক আছে, কালই বাবাকে বলব। তখন বিশ্বাস হবে তোর।

আমি ইতিমধ্যে আরও একটু কাছে সরে এসেছি তিতিরের।

কেন এরকম করছিস আমার সঙ্গে, বল? আমার ভয় লাগে।

কীসের ভয়?

তিতিরদি, তোর বাবা মরে গেছে পনেরো দিনের ওপর হল। তুই কি এটা বিশ্বাস করতে পারছিস না?

তুই জানিস না পুকু, শিল্পীরা কখনও মরে না। তারা লুকিয়ে পড়ে। এই যেমন বাবা পড়েছে। সমস্ত পৃথিবীতে আর কেউ বাবার শিল্প নিয়ে কথা বলতে পারবে না। বাবার ছবির নিন্দে করতে পারবেনা। বাবার ছবিকে সন্দেহের চোখে দেখবে না কোনও সরকার অথবা পৌরসভা। এখন আর কেউ বাবাকে জ্বালাতন করতে পারবেনা, এমনকী মা-ও না!

পিসি!

হ্যাঁ। মা। কম অপমান করেছে বাবাকে? কম জ্বালাতন করেছে? অথচ লোকের সামনে দুজনের সম্পর্ক, যেন প্রিয় বন্ধু! এইটে আমার অসহ্য লাগত। কেন এই ঢেকে রাখা! যা সত্যি, তা সত্যি করেই সামনে আসুক না! একজন শিল্পীর পক্ষে বাইরের জগতের কাছে অভিনয় যে কী অপমানের, তা যদি তুই বুঝতিস পুকু!

বুঝিনি। সেদিন সত্যি বুঝিনি। আজ থেকে সতেরো বছর আগে তিতিরদির পাশে শুয়ে এই কথার মর্মার্থ বোঝা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবে ধীরে ধীরে জীবন এই কথাটি আমাকে বুঝিয়েছে। প্রবলভাবে বুঝিয়েছে।

তিতিরদির জেঠু ও মেয়েরা এল কিছুদিন পর একগুচ্ছ সমবেদনা এবং ফুল নিয়ে। ফুলে ফুলে ভরে গেল বড় পিসির বাড়ি। এমনকী, জায়গা না হওয়াতে কিছু ফুল বাগানে ছড়িয়ে রাখতে হল। ওরা আসাতে বাড়ির শোকের আবহাওয়াটা আবার কিছুটা জমে উঠল। বড় পিসিকে আবারও কিছুটা চোখের জল ফেলতে হল এটি প্রমাণ করতে যে, এখনও ওর চোখের জল শুকিয়ে যায়নি। তবে যে কোনও তীব্র শোকের আবহ পরদিন কেটে গেলে একটা উৎসবের মেজাজ আসে। দ্বিতীয় দিন তিতিরদিকে নিয়ে কানামাছি খেলতে গেল ওর জেঠুর মেয়েরা, আমিও সঙ্গী হলাম।

কানামাছি খেলাটির সঙ্গে আগে আমি যতদূর পরিচিত ছিলাম, এই খেলাটি তার থেকে সম্পূর্ণ অন্য ছিল। তিতিরদির জেঠুর মেয়েরা ছিল সেই বয়সে আমার কাছে একেকজন পরী এবং আমি তাদের প্রতি একটা অলৌকিক টান অনুভব করতাম। মনে হত, তারা একটু দেখলে অথবা ডেকে কথা বললেই আমি ধন্য। এই খেলায় তাদের ছুঁতে পারছি, তাদের নরম শরীরের ওপর হাত চলে যাচ্ছে, এমনকী, বুকের ওপরেও! এসবের ভেতর থেকে নিজেকে নতুন করে চিনতে পারলাম আমি। যদিও এই খেলার মধ্যে আমি বুঝতে পারিনি, আসলে কাকে কাকে ছুঁয়েছি। শুধু একেকবার জেঠুর মেয়েদের কাছে ইচ্ছে করে ধরা দিয়েছি। একবারও ধরা দিইনি তিতিরের কাছে। যাদের ছুঁয়েছি, হতে পারে তার মধ্যে তিতিরদিও ছিল।

একটা হলুদ রঙের আলো জ্বলছিল ঘরটায় আর ভনভন করে পতঙ্গ উড়ছিল সেই আলোটাকে ঘিরে। হয়তো আমার ভেতরেও।

খেলা শেষে খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমোতে এলাম সেই তিতিরদিদির পাশে। একটা খেলা যে এতকিছু বদলে দিতে পারে, জানা ছিল না। আজ সত্যি তিতিরদির পাশে শুতে বেশ অস্বস্তি লাগছিল। তেমন কোনও কথা খুঁজে পেলাম না। তিতিরদি কি ঘুমিয়ে পড়েছে? কোনও সাড়াশব্দ নেই। নিজেও চুপ করে শুয়ে রইলাম। একটা অপরাধবোধ কাজ করছে আমার মধ্যে। অস্বস্তি হচ্ছে।

শান্ত অথচ শক্ত গলায় তিতির বলল,
তুই ওদের বাবার বিষয়ে কিছু বলে দিসনি তো?

কোন বিষয়ে?

এই যে, বাবা আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে, এইসব বিষয়ে কিছু জানতে পারেনি তো ওরা?

না না, এসব কেন বলতে যাব ওদের?

বলিসনা। বুঝতে পারবে না ওরা।

আমিও কি বুঝতে পেরেছিলাম কিছু? আমি শুধু তিতিরদির কথায় বিশ্বাস করে গেছি। বিশ্বাস ঠিক নয়। শুনে গেছি আর চোখের সামনে দেখেছি ছবি আঁকায় ক্রমাগত কেমন দক্ষ হয়ে উঠছে ও। এমনকী, এতদিন এসব বিষয়ে খেয়াল না করা পিসির চোখেও বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

কিছুটা চিন্তিত লাগত পিসিকে।

তবে এতদিন অবধি কেবলমাত্র তিতিরদিদি বাদে, বাকি কিছুই আমার চোখে ধরা দিচ্ছিল না। হয়ত ওর কার্যকলাপের ভেতরে এতটা আছন্ন ছিলাম যে, আশপাশ সম্পর্কে কিছুটা উদাসীন হয়ে পড়েছিলাম। আমাদের মধ্যে সম্পর্কটা অনেক বদলে গেছিল। এই বদলে যাওয়া সম্পর্কটা ঠিক উত্তরের শীতল হাওয়ার মতো। সমস্ত শরীরের ভেতর একটা কাঁপুনি ধরিয়ে দেয়। অথচ আমার যা বয়স, তাতে করে এই কাঁপুনি আমার ভালো লাগছিল। সকাল থেকে সারাদিন শুধু ছবি আঁকা, পুরোনো ছবিগুলো বাঁচিয়ে রাখা এবং সন্ধের মুখে সেই অদ্ভুত গ্রাম্য গান-- এই প্রতিদিনের একঘেয়েমির মধ্যেও, আমার মন ক্লান্ত হয়ে ওঠেনি। তিতিরকে ছবি আঁকতে দেখতে ভালো লাগত আমার। ওর সাদা রঙের টেপ জামার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা রোগা দুটো হাত, এক মাথা ধূসর সমুদ্রের মতো চুল এবং স্বাভাবিকের থেকে লম্বা গলা, যখন একের পর এক রঙ শাদা হয়ে যাওয়া দেওয়ালগুলোর ওপর ছবি আঁকত, আমি বিস্ময়ভরে দেখতাম। জেঠুর মেয়েদের অমন পরীর মতো রূপ, ম্লান হয়ে গেছিল তিতিরদির এই রূপের কাছে। যেন কোনও অলৌকিক জগতের এক প্রাণী, আরও আরও রহস্যময় হয়ে উঠছে আমার সামনে।

তিতিরের মধ্যেই এতটা আছন্ন ছিলাম যে, আশপাশ তেমন দেখতে পাইনি। যেদিন দেখলাম, বুঝলাম এই কুড়ি দিনের মধ্যে গোটা বাড়িটার মধ্যে একটা অদ্ভুত বদল এসেছে। সর্বদা কুয়াশাচ্ছন্ন থাকে যেন বাড়িটা। আলো জ্বলে কম। দৈনন্দিন কাজকর্ম এবং ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তোলার কাজ ছাড়া বড় পিসির কাটে ল্যান্ড ফোনের সামনের চেয়ারে বসে। সারাদিন আত্মীয়দের সঙ্গে গল্প করে কাটে পিসির। যখন কোনও ফোন আসে না, তখন এমনি এমনি রিসিভারটা কানের সামনে ধরে বসে থাকে।

তবে পিসেমশাই যে তিতিরদিদির সঙ্গে দেখা করতে আসে, সেই কথাটির এখনও কোন প্রমাণ পাইনি। একসময় এই প্রমাণ পাওয়ার ভয়ে কেমন গুটিয়ে রেখেছিলাম নিজেকে। এখন আমার মধ্যেও একটা আগ্রহ তৈরি হয়েছে। সারাদিন প্রায় তিতিরদিদির সঙ্গে থাকি। তাহলে কখন ও গিয়ে দেখা করে পিসেমশাইয়ের সঙ্গে। কখন গিয়ে আঁকা শেখে?

শীত সেদিন খুব বেশি। লেপের ভেতর মাথা মুড়ি দিয়েও শরীরের মধ্যে একটা কাঁপুনি দিচ্ছে। তিতিরদিদিকে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলাম,
পিসেমশাই কি এখনও দেখা করতে আসে তোর সঙ্গে?

হ্যাঁ, রোজই তো আসে।

কখন আসে? আমি তো প্রায় সবসময় তোর সঙ্গে থাকি। আমি তো দেখতে পাই না!

এত সহজে দেখা যায়না পুকু। সবকিছুর জন্য দেখার একটা চোখ চাই। তুই বল, ছবি কি সবাই দেখতে পারে? ছবি দেখার চোখ তৈরি করতে হয়। তেমনই যে ছবি আঁকে, তাকে দেখারও চোখ তৈরি করে নিতে হয় পুকু। নইলে এমন একটা মোটা চোখ দিয়ে কিছুই দেখা যায় না।

আমার চোখ যে মোটা এই কথার মানে তখন বুঝিনি। যে মানে বুঝেছিলাম, তাতে দুঃখ পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটাও পাইনি আমি। নিজের মোটা চোখের বিপক্ষে যতরকম যুক্তি হতে পারে, তার একটাও হাতড়ে আমি খুঁজে পাইনি। কারণ, এই কথা সত্যি ছিল যে, একবারও পিসেমশাইকে দেখতে পাইনি আমি। কিন্তু দু-একটি প্রশ্নের উত্তর আমি পাচ্ছিলাম না। প্রথমত, কীভাবে আমি এই মোটা চোখটি সূক্ষ্ম করে তুলব? দ্বিতীয়ত, যদি সেই পথ পাই, তাহলে ঠিক কতদিন লাগে কারও মোটা চোখ সূক্ষ্ম করে তুলতে?

তিতিরদিদি আমাকে আশ্বস্ত করল।

চিন্তা করিস না, কাল তোকে একবার নিয়ে যাব।

কোথায়?

কোনও উত্তর দিল না তিতির। ফলে, পরের দিন অপেক্ষা করা ছাড়া আমার কোনও উপায় রইল না।

খুব কষ্ট করে ঘুম এল রাতে। এতরকম চিন্তা নিয়ে রাতের বেলা কি ঘুমোনো যায়! যা এল, তাকে কি আর ঘুম বলা যায়! যেন নিজের ঘুমকে নিজে ঠকানো। সকালে উঠে অপেক্ষা করে আছি, কখন তিতির আমাকে নিয়ে যাবে সেখানে। সেই সেখানে, যার সম্পর্কে কিছুই জানি না। যেখানে তিতিরদির সঙ্গে দেখা করতে আসে পিসেমশাই।

তিতিরদিদি হাত ধরে নিয়ে গেল আমাকে পিশেমশাইয়ের আঁকার ঘরটায়। যে সমস্ত ছবিগুলো ওরা শাদা রঙ বুলিয়ে দিয়ে গেছিল, তার অনেকগুলো ঠিক হুবহু এঁকে ফেলেছিল তিতির। আরও বেশি জীবন্ত হয়ে উঠেছিল সেগুলো। মনে হচ্ছিল, যেন কাল রাতেই এই সমস্ত ছবি এঁকে ফেলেছে পিসেমশাই!

আমি যা বলছি, মন দিয়ে শোন পুকু। চোখ বন্ধ করবি একবার। মনকে শান্ত করবি। তারপর এই ঘরের মধ্যে যে ছবিগুলো আছে সেগুলো খুব ভালো করে দেখবি। অন্যকিছু মাথায় আনবি না। শুধু মন দিয়ে দেখবি ছবিগুলো। এত ভালো করে দেখবি, যেন মনে হয়, ছবিগুলোর মধ্যে ঢুকে গেছিস। দেখবি শুধুই রঙ আর রেখা। তার ভেতরে এক একটা আবেগ কতটা জীবন্ত। সেই আবেগের ভেতরে একেকটা চরিত্র কেমন ঢুকে বসে আছে। দেখবি, বিশ্বাস করবি এগুলো ছবি নয়। একটা অন্য জগৎ। অন্য এক মাত্রার জগত, যা কেবলমাত্র শিল্পীরাই জানে। তারা মনের ভেতর এটা বহন করে নিয়ে চলে। সেখানে কোনও সময় নেই, অভাব নেই, অভিযোগ নেই, মৃত্যু নেই, বিচ্ছেদ নেই, শুধুই এক দৃশ্যের সুখ। দেখবি তোর আশেপাশে সময় কেমন থমকে গেছে। কেমন নিজের সমস্ত অস্থিরতা কাটিয়ে তুই চলে এসেছিস অন্য এক জগতের ভেতর।

চোখ বন্ধ করে খুললাম। তিতিরদির সমস্ত কথাগুলো অনুভব করে সেইমতো পথে এগোলাম। কিন্তু, আমার মোটা চোখ সেই মোটাই রয়ে গেল! তিতিরদিদি যা দেখার কথা বলেছিল, তার কিছুই আমার সামনে খুলে গেল না। নিজের মোটা চোখকে বারবার করে অভিশাপ দিলাম। তবে কোনওকিছুই কি আর জোর করে হয়! তিতিরদিদি কিছু বলল না সেসব নিয়ে। কীই বা আর বলবে! আমি শুধু বুঝলাম, পাশাপাশি থেকেও ওর জীবনের বড় একটা অংশ থেকে আমি নির্বাসিত। তবে শুধু নির্বাসন দিয়েই জীবন নয়। অভিশাপ পাওয়ার ফলেই হোক বা যে কোনও কারণেই হোক, আমার মোটা চোখ সূক্ষ্মতার দিকে একটা যাত্রা শুরু করেছিল সেইসময় থেকেই। এটা অনেক পরে বুঝেছি। একদিন গভীর রাতে আমাকে ডেকে ডেকে তুলল তিতির। আমি কথা বলতে যেতেই মুখ চেপে ধরে চুপ করিয়ে দিল। খুব সাবধানে ফিসফিস করে বলল,
ওদের অসুবিধে হবে!

আমি চোখের ভাষায় বোঝাতে চাইলাম,
কাদের?

তিতিরদিদি বলল,
আজ বাবার বড় তেলরঙের ছবিটার লোকেরা মিলে একটা রাতের আয়োজন করেছে। সেখানে বাবাও নিমন্ত্রিত। ওরা সকলে মিলে বাবাকে অনেক সম্মান দিয়েছে।

মুখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে নিলে আমি কানে কানে জানতে চাইলাম,
কোথায়?

খাটের তলায়। কান পেতে শোন। কোনও শব্দ করিস না।

নিজের মোটা চোখের সঙ্গে সঙ্গে মোটা মনের কলঙ্ক ঘোচানোর জন্য কি না জানি না, তবে সত্যি সত্যি খাটের তলায় লোকজনের একটা কোলাহল অস্পষ্ট ভেসে এল কানে। বিস্মিত হলাম, আড়ষ্ট হয়ে কাছে ঘেঁষে গেলাম তিতিরদিদির। ওর গায়ের মধ্যে এই নাম না জানা বুনো ফুলের গন্ধটা।

তিতির আমাকে কাছে টেনে নিল আরও কিছুটা। বুকের ভেতর জড়িয়ে নিয়ে বলল,
আমরাও যেতে পারতাম রে পুকু। তবে আমরা তো নিমন্ত্রিত নই, তাই গেলে বিষয়টা খারাপ দেখায়।

তবে যাওয়ার কোনও প্রসঙ্গই আমার মাথার মধ্যে কাজ করছে না। আমি যথাসম্ভব নিজেকে এঁটে রেখেছি তিতিরের সঙ্গে। আমাদের খাটের ঠিক নীচে এরকম একটা আয়োজন হয়েছে, সেই কথা ভেবেই সমস্তটা গুলিয়ে যাচ্ছে আমার। তিতিরদিদির এমন ছেলেমানুষি করার বয়স নয়, তবু যেন ছেলেবেলায় ফিরে গেছে ও। একটা রূপকথার ভেতরে ও রয়েছে এবং আমি কিছু কিছু তার নাগাল পাওয়ার চেষ্টা করছি। অথচ এই পারার সময় ধীরে ধীরে কমে আসছে। বাড়ি ফেরার দিন সামনে আসছে। স্কুল খুলে যাবে। বাবা মা নিতে আসবে শীঘ্র, এমনই জানিয়েছে বড় পিসিকে।

নিজের সমস্তকিছু ধীরে ধীরে গুছিয়ে নিতে হচ্ছে। একটা আসন্ন বিদায়ের সুর বুকের ভেতরে কেমন উথলে উঠছে আমার। মনে হচ্ছে এইবার চলে গেলেই তিতিরদিদির এই অদ্ভুত রূপকথার জগৎটা সমস্ত জীবনের জন্য আমার মুখের ওপরে দরজা বন্ধ করে দেবে। তবে তিতিরদিদির কোনও হেলদোল নেই। আমি চলে যাব শুনে কি একটুও কষ্ট হয়নি তিতিরদিদির? নাকি নিজের জগতে এতটাই আছন্ন ও, আমার দিকে তাকানোর সময়মাত্র নেই!

যেদিন চলে আসব, সেদিন রাত্রিবেলা তিতিরদিদি অদ্ভুত চুপচাপ। তেমন কথা বলছে না আমার সঙ্গে। সারাদিন একমনে কাজ করার পর, চুপ করে পোশাক বদলে সেই সাদা রঙের টেপ জামাটা পরে শুতে এল। শীত তখনও প্রবল। আমি লেপের ভেতর মাথা মুড়ি দিয়ে ভাবছি, কাল ঠিক এই সময়ে নিজের ঘরের বিছানায় একা একা শুয়ে, পাশে তিতিরদিদি নেই, ওর গায়ের অদ্ভুত বুনো ফুলের গন্ধটা নেই! একটা কুয়াশাচ্ছন্ন গমগাছের মতো ওর শরীর আমার পাশে শুয়ে নেই এবং এই সমস্ত রূপকথা আমার থেকে হারিয়ে যাবে! আর কখনও দেখা হয়ে উঠবে না পিসেমশাইকে!

ভোরের আলো তখনও ফোটেনি, ঘুম ভেঙে গেল।

দেখলাম পাশে সত্যিই তিতির দিদি নেই। কোথায় গেল তিতিরদিদি? ভাবলাম বাথরুমে গেছে হয়তো! অনেকক্ষণ শুয়ে রইলাম, ঘুম এল না। তিতির দিদি ফিরছে না। উঠে বসলাম বিছানায়। চারিদিকে অন্ধকার এমন যে, কিছুই প্রায় দেখতে পাওয়া যায় না। মনে হচ্ছে যেন একটা অন্ধকার গহ্বরের ভেতর আমি বসে আছি আর ধীরে ধীরে সেটি গলা টিপে ধরছে আমার। ভয়টা ভীষণভাবে আমাকে চেপে ধরল। ভাবলাম, এখানে এভাবে বসে থাকার থেকে তিতিরদিকে খুঁজে আসি। এতক্ষণ হয়ে গেল, নিশ্চিত বাথরুমে যায়নি ও। বিছানা থেকে উঠে আশপাশ হাতড়ে কোনওক্রমে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। এই ঘর থেকে বেরিয়ে একটা লম্বা করিডর। কিছুটা এগিয়ে গেলে বামদিকের ঘরে বড় পিসি ঘুমায়। আরও কিছুটা এগিয়ে গেলে রান্না ও খাওয়ার ঘর এবং একেবারে শেষে পিসেমশাইয়ের ছবি আঁকার ঘর। এই ঘরের পেছন দিক দিয়েই উঠে গেছে সিঁড়ি। সেই ঘর থেকে দেখলাম, একটা হলুদ রঙের আলো, খুব মৃদু তবে পথের অন্ধকার দূর করার জন্য যথেষ্ট।

এগিয়ে গেলাম। পিসির ঘরের দরজা বন্ধ। নাক ডাকার অভ্যাস পিসির। সেই শব্দ দরজা ভেদ করে এই করিডরে ছড়িয়ে পড়ছে। রান্না ও খাওয়ার ঘরের দরজাটা খোলা। পিসেমশাইয়ের ঘরের দরজাটা আংশিক খোলা। সেখান থেকেই আসছে আলোটা। সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে উঁকি দিলাম।

দেখলাম তিতির দিদিকে একটা হলুদ রঙের আলোয়। গায়ে কোনও পোশাক নেই। কুয়াশাচ্ছন্ন গম গাছের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা কোণে। গলার শিরাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তিতিরের। বয়সের তুলনায় একটু ভারী দুটো বুক। চোখের মধ্যে একটা অদ্ভুত ভয়। ঠিক ভয় নয়। সেই চোখ ঠিক কেমন, তা কিছুতেই ভাষায় আমি প্রকাশ করতে পারব না! খুবই অদ্ভুত দুটি চোখ। সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। তবু নিজেকে কেমন স্থির রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে ও। যেন একজন ছবির চিত্রকরের সামনে উন্মুক্ত করে দিয়েছে নিজেকে।

আলোটা এমন ভাবে ঝোলানো যে, ঘরের সমস্তটা আলোকিত হচ্ছে না। এছাড়া আলোর জোর বেশি নয়। সেই আলোয় একটা ছবির মতো লাগছে তিতিরদিদিকে। ওর চোখ যেদিকে তাকিয়ে আছে, ঘরের সেই অংশটা অন্ধকার। একটা ছায়া, ঠিক মানুষ নয়, সামনে বিরাট একটা ক্যানভাসের ওপর পেন্সিল বুলিয়ে চলেছে। কোনও মানুষ নয়, তবু সেই আদলে কীভাবে যেন ফুটে উঠছে পিসেমশাইয়ের ছায়া। আমি যতই স্পষ্ট করে দেখতে চাইছি তাকে, শুধু মনে হচ্ছে একটা ধোঁয়ার কুণ্ড। অথচ তার আদলের মধ্যে সম্পূর্ণ রয়েছে পিসেমশাই। পিসেমশাইয়ের সেই হাতের টান, সেই ছবি আঁকার ভঙ্গিমা, সেই আশ্চর্য মগ্নতা। যেন কোনও এক নির্বাসন থেকে ফিরে এসেছে পিসেমশাই। এঁকে যাচ্ছে নিরন্তর! বুলিয়ে যাচ্ছে রঙ। তার সামনে সদ্যকিশোরী বয়সের তিতিরদিদি। প্রাচীন কোনও রহস্যময় ছবির মতো সুন্দর। ওর মুখে ভয় এবং আনন্দের এক মিশ্র সৌন্দর্য। অপার্থিব।

ধীরে ধীরে ফিরে এলাম বিছানায়। তিতিরদিদি কখন ফিরেছিল, জানি না! সকালবেলা উঠে চোখ খুলে বিপরীত দিকে তাকিয়ে দেখি, তিতিরদিদি তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ওর চোখে একটা মায়া। খুব গভীর। চোখ খোলার পরে আশ্চর্যভাবে আমাকে কাছে টেনে নিল তিতির, ছোট্ট শিশুর মতো। নেওয়ার পর বুঝলাম, তিতিরদির অবস্থা ঠিক ভোররাতের মতোই, কোনও পোশাক নেই। ওর উন্মুক্ত বুকের ভেতর আমাকে টেনে নিয়ে তিতিরদিদি বলল,
তুই চলে যাবি আজ?

কথা বলার মতো পরিস্থিতি ছিল না। আমার সমস্ত শরীর তখন জেগে আছে। সচেতন এবং আচ্ছন্ন-- দুই অনুভূতি কীভাবে একটা মানুষের মধ্যে হতে পারে, তার খোঁজ ঐ বয়সেই পেয়েছিলাম। তিতিরের এক স্তনবৃন্ত তখন আমার গালের ওপর চেপে বসেছে। কোনওক্রমে হুঁ করে, ওভাবেই রইলাম।

তিতিরদিদি আমার মুখটা তুলে নিয়ে চোখের ওপর একটা চুমু খেল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
পুকু, দেখতে পেলি?

আমি কোনওক্রমে মাথাটা আবার তিতিরদিদির বুকের ভেতর নিয়ে গেছিলাম। অদ্ভুত এক বুনো ফুলের গন্ধের ভেতর হারিয়ে গিয়ে, মাথা নাড়িয়ে সে কথায় সম্মতি প্রদান করলাম।

একটি সম্মতি যেন সতেরো বছরের নিঃসঙ্গতার সমান।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ