প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের গল্প : ফুলের মূল্য



লন্ডন নগরের স্থানে স্থানে নিরামিষ ভোজনশালা আছে। আমি একদিন ন্যাশনাল গ্যালারিতে ঘুরিয়া ঘুরিয়া ছবি দেখিয়া নিজেকে অত্যন্ত ক্লান্ত করিয়া ফেলিলাম। ক্রমে একটা বাজিল, অত্যন্ত ক্ষুধাও অনুভব করিতে লাগিলাম। সেখান হইতে অনতিদূরে, সেন্ট মার্টিন্স লেনে এইরূপ ভোজনশালা আছে— মৃদুমন্দ পদক্ষেপে তথায় গিয়া প্রবেশ করিলাম।

তখনও লন্ডনের ভোজনশালাগুলোতে লাঞ্চের জন্য বহুলোক সমাগম আরম্ভ হয় নাই। হলে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, দুই-চারিটি মাত্র ক্ষুধাতুর এখানে-ওখানে বিক্ষিপ্তভাবে বসিয়া আছে। আমি গিয়া একটি টেবিলের সম্মুখে বসিয়া, দৈনিক সংবাদপত্রখানি উঠাইয়া লইলাম। নম্রমুখী ওয়েট্রেস আসিয়া দাঁড়াইয়া হুকুমের প্রতীক্ষা করিতে লাগিল।

আমি সংবাদপত্র হইতে চক্ষু উঠাইয়া খাদ্যতালিকা হাতে লইয়া আবশ্যকমতো অর্ডার দিলাম। ‘ধন্যবাদ, মহাশয়’ বলিয়া ক্ষিপ্রগামিনী ওয়েট্রেস নিঃশব্দে অন্তর্হিত হইল।

এক মুহূর্তে, আমার নিকট হইতে অল্পদূরে আর একখানি টেবিলের প্রতি আমার নজর পড়িল। দেখিলাম, সেখানে একটি ইংরাজ বালিকা বসিয়া আছে। তাহার পানে চাহিবামাত্র, সে আমার মুখ হইতে নিজ দৃষ্টি অন্যত্র ফিরাইয়া লইল। অবাক হইয়া সে আমাকে দেখিতেছিল।
 
ইহাতে বিশেষ কোনো নতুনত্ব নাই, কারণ শ্বেতদ্বীপে আমাদের চমৎকার দেহবর্ণটির প্রভাবে জনসাধারণ সর্বত্রই মোহিত হইয়া থাকে এবং মনোযোগের অংশ, প্রাপ্যের কিঞ্চিৎ অধিকমাত্রাতেই আমরা লাভ করি।

বালিকাটির বয়স ত্রয়োদশ কিংবা চতুর্দশ বৎসর হইবে। তাহার পোশাক যেন কিছু দরিদ্রতাব্যঞ্জক। চুলগুলো অজস্রধারায় পিঠের উপর পড়িয়াছে। বালিকার চক্ষুদুইটি বৃহৎ, যেন একটু বিষণ্ণতাযুক্ত।

সে জানিতে না পারে এমনভাবে আমি মাঝে মাঝে তাহার পানে চাহিতে লাগিলাম। আমার খাদ্যদ্রব্যাদি আসিবার কিয়ৎক্ষণ পরেই সে আহার সমাধা করিয়া উঠিল। ওয়েট্রেস আসিয়া তাহার বিলখানি তাহাকে লিখিয়া দিল। বাহির হইবার দরজার নিকট অফিস আছে, সেখানে বিলখানি ও মূল্য দিয়া যাইতে হয় ।

বালিকা উঠিলে, আমার দৃষ্টিও তাহাকে অনুসরণ করিল। স্বস্থানে বসিয়াই আমি দেখিলাম বালিকা তাহার মূল্য প্রদান করিয়া কর্মচারিণীকে চুপি চুপি জিজ্ঞাসা করিতেছে ‘Please Miss, ঐ যে ভদ্রলোকটি, উনি কি ভারতবর্ষীয়?’

‘আমার তাহাই অনুমান হয়।’

‘উনি কি সর্বদাই এখানে আসেন?’

‘বোধ হয় না। আর কখনো দেখিয়াছি বলিয়া তো স্মরণ নাই।’

‘ধন্যবাদ’-- বলিয়া মেয়েটি আমার দিকে ফিরিয়া, আর একবার চকিত দৃষ্টিপাত করিয়া বাহির হইয়া গেল।

এইবার কিন্তু আমি বিস্মিত হইলাম। কেন? ব্যাপার কী? আমার সম্বন্ধে তাহার এই কৌতূহল দেখিয়া, তাহার সম্বন্ধেও আমার অত্যন্ত কৌতূহল উপস্থিত হইল। আহার শেষ হইলে ওয়েট্রেসকে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘ঐ যে মেয়েটি ওখানে বসিয়াছিল, তাহাকে তুমি জানো?’

‘না মহাশয়, আমি তো বিশেষ জানি না, তবে প্রতি শনিবার এখানে লাঞ্চ খাইয়া থাকে, তাহা লক্ষ করিয়াছি।’ ‘শনিবার ছাড়া অন্য কোনো বারে আসে না?’

‘না, আর তো কখনও দেখি না।’

‘ও যে কে তাহা তুমি কিছু অনুমান করিতে পার?’

‘বোধ করি কোনো দোকানে কর্ম করে।'

‘কেন বলো দেখি?’

‘হয়তো সামান্য কিছু উপার্জন করে, অন্যদিন লাঞ্চ খাইবার পয়সা কুলায় না, শনিবার সাপ্তাহিক বেতন পায়, তাই একদিন আসে।’

কথাটা আমার মনে লাগিল।


২.

বালিকাটির সম্বন্ধে কৌতূহল আমার মন হইতে দূর হইল না। এমন করিয়া আমার সংবাদ লইল কেন? ভিতরে এমন কী রহস্য আছে যাহার জন্য আমার সম্বন্ধে উহার এত ঔৎসুক্য? তাহার সেই দারিদ্র্যক্লিষ্ট, চিন্তাপূর্ণ, বিষাদভরা মূর্তি আমার মনে আধিপত্য বিস্তার করিতে লাগিল। আহা, কে বালিকা? আমার দ্বারা তাহার কি কোনো উপকার হওয়ার সম্ভাবনা আছে?

রবিবার দিন লন্ডনের সমস্ত দোকানপাট বন্ধ। সোমবার দিন প্রাতরাশের পর আমি বালিকার অনুসন্ধানে বাহির হইলাম। সেন্ট মার্টিন্স লেনের কাছাকাছি রাস্তাগুলিতে, বিশেষত স্ট্র্যান্ডে অনেক দোকানে অন্বেষণ করিলাম, কিন্তু কোথাও তাহাকে দেখিতে পাইলাম না। কোনো একটা দোকানে প্রবেশ করিলে অন্তত কিছু-না-কিছু ক্রয় করিতে হয়। অনাবশ্যক নেকটাই, রুমাল, কলারের বোতাম, পেনসিল, ছবি-পোস্টকার্ড প্রভৃতি আমার ওভারকোটের পকেটে স্তুপাকার হইয়া উঠিল, কিন্তু কোথাও বালিকার সন্ধান পাইলাম না।

সপ্তাহ কাটিয়া গেল, শনিবার আসিল। আমি আবার সেই নিরামিষ ভোজনাগারে উপস্থিত হইলাম। প্রবেশ করিয়া দেখি, সেই টেবিলে বালিকা ভোজনে বসিয়াছে। আমি সেই টেবিলের নিকটে গিয়া, তাহার সম্মুখে চেয়ারখানি দখল করিয়া বলিলাম— ‘Good Afternoon.’।

বালিকা সঙ্কোচের সহিত বলিল— ‘Good afternoon, Sir.’

একটি-আধটি কথা দিয়া আরম্ভ করিয়া, আমি ক্রমে জমাইয়া তুলিতে লাগিলাম। বালিকা একসময় জিজ্ঞাসা করিল, ‘আপনি কি ভারতবর্ষীয়?’

‘হ্যাঁ।’

‘আমায় ক্ষমা করিবেন—‘আপনি কি নিরামিষভোজী?’

উত্তর না দিয়া বলিলাম, ‘কেন বলো দেখি।’

‘আমি শুনিয়াছি, ভারতবর্ষীয় লোকের অধিকাংশই নিরামিষ ভোজন করে।’

তুমি ভারতবর্ষ সম্বন্ধীয় কথা কেমন করিয়া জানিলে?’

‘আমার জ্যেষ্ঠভ্রাতা ভারতবর্ষে সৈন্য হইয়া গিয়াছিলেন।’

আমি তখন উত্তর করিলাম, ‘আমি প্রকৃত নিরামিষভোজী নহি; তবে মাঝে মাঝে আমি নিরামিষ ভোজন করিতে ভালোবাসি বটে।’

শুনিয়া বালিকা কিঞ্চিৎ নিরাশ হইল।

জানিলাম, এই জ্যেষ্ঠভ্রাতা ছাড়া বালিকার আর কোনো পুরুষ অভিভাবক নাই। ল্যাম্বেথে বৃদ্ধা বিধবা মাতার সহিত সে বাস করে।

জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘তোমার দাদার নিকট হইতে পত্রাদি পাও?’

‘না, অনেকদিন কোনো পত্রাদি পাই নাই। সেইজন্য আমার মা অত্যন্ত চিন্তিত আছেন। তাঁহাকে লোকে বলে ভারতবর্ষ সর্প, ব্যাঘ্র ও জ্বররোগে পরিপূর্ণ। তাই তিনি আশঙ্কা করিতেছেন, আমার ভ্রাতার কোনোরূপ অমঙ্গল ঘটিয়া থাকিবে। সত্যিই কি ভারতবর্ষ সর্প, ব্যাঘ্র ও জ্বররোগে পরিপূর্ণ, মহাশয়?’

আমি একটু হাসিলাম। বলিলাম, ‘না। তাহা হইলে কি মানুষ সেখানে বাস করিতে পারিত?’

--------------------------------------------------------------------------------------------------------
* ইহা কেবলমাত্র চক্ষুলজ্জার খাতিরে নহে, কতকটা দয়াধর্মের অনুরোধেও বটে। লন্ডনের প্রত্যেক বড় বড় দোকানে পুরুষ shop-walker আছে। তাহাদের কর্তব্য খরিদ্দারকে যথাবিভাগে পৌঁছাইয়া দেওয়া এবং সাধারণভাবে কাজকর্ম পর্যবেক্ষণ করা। যদি কোনো খরিদ্দার কোনো বিভাগ হইতে জিনিস দেখিয়া কিছু না কিনিয়া ফিরিয়া যায়, তৎক্ষণাৎ সেই shop-walker দোকানের ম্যানেজারের নিকট রিপোর্ট করিয়া দিয়া থাকে-- ‘Miss অমুকের বিভাগ হইতে একজন ক্রেতা ফিরিয়া গিয়াছে।’ এইরূপ রিপোর্ট হইলে সেই কর্মচারিণীর কৈফিয়ৎ তলব করা হয়। প্রথম প্রথম সাবধান করিয়া দেওয়া হয়, বারবার এইরূপ রিপোর্ট হইলে জরিমানা হয়, কর্মচ্যুতিও হইতে পারে। এইসব Shop-girl অত্যন্ত সামান্য বেতনে কর্ম করিয়া থাকে। জিনিস অপছন্দ হইলেও তাহাদের চক্ষুর মিনতি উপেক্ষা করিয়া ফিরিয়া আসা দুঃসাধ্য।—লেখক।
--------------------------------------------------------------------------------------------------------

বালিকা একটি মৃদুরকম দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। বলিল, মা বলেন, ‘যদি কোনো ভারতবাসীর সাক্ষাৎ পাই, তবে সকল কথা জিজ্ঞাসা করি।’ বলিয়া, অনুনয়পূর্ণ নেত্রে আমার পানে চাহিল।

আমি তাহার মনের ভাব বুঝিতে পারিলাম । বাড়িতে মা’র কাছে লইয়া যাইবার জন্য আমাকে অনুরোধ করিতে তাহার সাহস হইতেছে না; অথচ ইচ্ছা আমি একবার যাই।

এই দীন, বিরহকাতর জননীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে আমার অত্যন্ত আগ্রহ হইল। দরিদ্রের কুটিরের সাক্ষাৎপরিচয়লাভের অবসর আমার কখনো ঘটে নাই। দেখিয়া আসিব এদেশে তাহারা কিরূপভাবে জীবন অতিবাহিত করে, কিরূপভাবে চিন্তা করে।

বালিকাকে বলিলাম, ‘চলো-না— আমাকে তোমাদের বাড়ি লইয়া যাইবে? তোমার মা’র নিকট আমায় পরিচিত করিয়া দিবে?’

এ প্রস্তাবে বালিকার দুইটি চক্ষু দিয়া যেন কৃতজ্ঞতা উছলিয়া উঠিল। বলিল, ‘Thank you so much--it would be so kind of you! এখন আসিতে পারিবেন কি?’ ‘

‘আহ্লাদের সহিত।’

‘আপনার কোনো কার্যের ক্ষতি হইবে না তো?’

‘না— না, মোটেই না। আজ অপরাহ্নে আমার সময় সম্পূর্ণ আমার নিজের!’

শুনিয়া বালিকা পুলকিত হইল। আহার সমাধা করিয়া আমরা দুইজনে উঠিলাম। পথে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘তোমার নামটি কী জানিতে পারি?’

‘আমার নাম অ্যালিস মার্গারেট ক্লিফর্ড।’

রঙ্গ করিয়া বলিলাম, ‘ওহ্ হো—তুমিই Alice in wonderland-এর অ্যালিস বুঝি?’

বিস্ময়ে বালিকা চক্ষুস্থির করিয়া রহিল । জিজ্ঞাসা করিল, ‘সে কী!’

আমিও একটু অপ্রতিভ হইলাম। মনে করিতাম, এমন কোনো ইংরাজ বালিকা নাই Alice in wonderland নামক সেই অদ্বিতীয় শিশুরঞ্জন পুস্তকখানি কণ্ঠস্থ করিয়া রাখে নাই। বলিলাম, ‘সে একখানি চমৎকার বহি আছে। পড় নাই?’

‘না, আমি তো পড়ি নাই!’

বলিলাম, ‘তোমার মাতা যদি আমায় অনুমতি করেন, তবে আমি তোমায় সে বহি একখানি উপহার দিব।’

এইরূপ কথোপকথন করিতে করিতে, সেন্ট মার্টিন্স চার্চের পাশ দিয়া চেয়ারিং ক্রশ স্টেশনের সম্মুখে আসিয়া পৌঁছিলাম। স্ট্র্যান্ড দিয়া হুহু করিয়া বৃহদাকার দ্বিতল অনিবাসগুলো উত্তরদিকে ছুটিয়া যাইতেছে। ক্যাবেরও সংখ্যা নাই। টেলিগ্রাফ অফিসের সম্মুখে ফুটপাথে দাঁড়াইয়া বালিকাকে বলিলাম,‘এসো, আমরা এইখানেই ওয়েস্টমিনস্টার বাসের জন্য অপেক্ষা করি।’

বালিকা বলিল, ‘হাঁটিয়া যাইতে আপনার আপত্তি আছে কি?’

আমি বলিলাম, ‘কিছুমাত্র না! কিন্তু তোমার কষ্ট হইবে না?’

‘না, আমি তো রোজই হাঁটিয়া বাড়ি যাই।’

কোথায় সে কর্ম করে, এইবার তাহাকে জিজ্ঞাসা করিবার সুযোগ পাইলাম। ইংরাজি হিসাবে এরূপ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করাটা নিয়ম নহে, কিন্তু সকল নিয়মেরই ফাঁকি আছে কিনা। যেমন রেলগাড়িতে উঠিয়া সহযাত্রীকে ‘কোথায় যাইতেছেন মহাশয়?’ জিজ্ঞাসা করা ভয়ানক পাপ, তবে ‘অধিকদূর যাইবেন কি?’ জিজ্ঞাসা করিতে দোষ নাই। সহযাত্রী ইচ্ছা করিলে বলিতে পারে, ‘আমি অমুক স্থান অবধি যাইব।’ ইচ্ছা না করিলে বলিতে পারে, ‘না, এমন বেশি দূর নয়।’ আমার প্রশ্নেরও উত্তর দেওয়া হইল, তাহার পর্দাও বজায় রহিল। সেই হিসাবে আমি বালিকাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘এদিকে তুমি প্রায়ই আসো বুঝি?’

বালিকা বলিল, ‘হ্যাঁ, আমি সিভিল সার্ভিস স্টোর্সে টাইপরাইটারের কাজ করি। রোজ সন্ধ্যাবেলা বাড়ি যাই। আজ শনিবার বলিয়া শীঘ্র ছটি পাইয়াছি।’

আমি তাহাকে বলিলাম, ‘চলো, স্ট্রান্ড দিয়া না গিয়া এমব্যাঙ্কমেন্ট দিয়া যাওয়া যাউক। ভিড় কম।’ বলিয়া তাহার বাহুধারণ করিয়া সাবধানতার সহিত রাস্তা পার করিয়া দিলাম।

টেমস নদীর উত্তরকূল দিয়া এমব্যাঙ্কমেন্ট নামক রাস্তা গিয়াছে। চলিতে চলিতে বলিলাম, ‘তুমি কি সচরাচর এই রাস্তা দিয়াই যাও?’

বালিকা বলিল, ‘না, এ রাস্তায় যদিও ভিড় কম, তথাপি ময়লা কাপড়-পরা লোকের সংখ্যা অধিক। আমি তাই স্ট্র্যান্ড এবং হোয়াইট হল দিয়াই বাড়ি যাই।’

আমি মনে মনে এই অশিক্ষিত দরিদ্র বালিকার নিকট পরাজয় স্বীকার করিলাম। ইংরাজ জাতির সৌন্দর্যপ্রিয়তার নিকট আত্মপরাজয় ইহাই প্রথমবার নহে।

কথোপকথনে আমরা ওয়েস্টমিস্টার ব্রিজের নিকটবর্তী হইলাম। আমি বলিলাম, ‘তোমাকে কি অ্যালিস বলিয়া ডাকিব, না মিস ক্লিফর্ড বলিব?’

মৃদু হাসিয়া বালিকা বলিল, ‘আমি তো এখনো যথেষ্ট বড় হই নাই। আমাকে যাহা ইচ্ছা ডাকিতে পারেন। লোকে আমাকে ম্যাগি বলিয়া ডাকে।’

‘তুমি কি বড় হইবার জন্য উৎকণ্ঠিত?’

‘হ্যাঁ।’

‘কেন বলো দেখি।’

‘বড় হইলে আমি কর্ম করিয়া অধিক উপার্জন করিতে সমর্থ হইব। আমার মা বৃদ্ধ হইয়াছেন।’

‘তুমি যে কর্ম করো, তাহা তোমার মনঃপূত?’

‘না। আমার কর্ম বড় যন্ত্রের মতো। আমি এমন কর্ম করিতে চাহি, যাহাতে মস্তিষ্ক চালনা করিতে হয়। যেমন সেক্রেটারির কাজ।’

হাউসেস অব পার্লামেন্টের নিকট পুলিশপ্রহরী পদচারণা করিতেছে। দক্ষিণে রাখিয়া,ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজ পার হইয়া, আমরা ল্যাম্বেথে গিয়া পড়িলাম। ইহা দরিদ্রের পল্লি। ম্যাগি বলিল, ‘আমি যদি কখনো সেক্রেটারি হইতে পারি, তবে মাকে এ-পাড়া হইতে স্থানান্তরিত করিয়া অন্যত্র লইয়া যাইব।’

লোকের ভিড় অতিক্রম করিয়া আমরা চলিতে লাগিলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম,‘তোমার প্রথম নামটি ছাড়িয়ে দ্বিতীয় নামটি তোমার ডাকনাম হইল কেন?’

ম্যাগি বলিল, ‘আমার মা’র প্রথম নামও অ্যালিস, তাই আমার পিতা আমার দ্বিতীয় নামটি সংক্ষিপ্ত করিয়া ডাকিতেন!’

‘তোমার পিতা তোমাকে ম্যাগি বলিতেন, না ম্যাগিস বলিয়া ডাকিতেন?’

‘যখন আদর করিয়া ডাকিতেন, তখন ম্যাগিস বলিয়া ডাকিতেন। আপনি কী করিয়া জানিলেন?’

রহস্য করিয়া বলিলাম, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আমরা ভারতবর্ষীয় কিনা, আমাদের জাদুবিদ্যা ও ভূত-ভবিষ্যৎ অনেক বিষয় জানা আছে।’

বালিকা বলিল, ‘তাহা আমি শুনিয়াছি।’

বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘বটে! কী শুনিয়াছ?’

‘শুনিয়াছি, ভারতবর্ষে অনেক লোক আছে যাহারা অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন। তাহাদিগকে ইয়োগি (yogi) বলে। কিন্তু আপনি তো ইয়োগি নহেন?’

‘কেমন করিয়া জানিলে ম্যাগি, আমি ইয়োগি নহি?’

‘ইয়োগিগণ মাংস ভক্ষণ করে না।’

‘তাই বুঝি তুমি প্রথমে আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, আমি নিরামিষভোজী কিনা?’

বালিকা উত্তর না দিয়া মৃদু মৃদু হাস্য করিতে লাগিল।

ক্রমে আমরা একটি সংকীর্ণ গৃহদ্বারের নিকট পৌঁছিলাম।পকেট হইতে ল্যাচ-কী বাহির করিয়া ম্যাগি দরজা খুলিয়া ফেলিল। ভিতরে প্রবেশ করিয়া আমাকে বলিল, ‘আসুন।’


৩.

আমি প্রবেশ করিলে ম্যাগি দরজা বন্ধ করিয়া দিল। সিঁড়ির নিকট গিয়া একটু উচ্চস্বরে বলিল, ‘মা, তুমি কোথায়?

নিম্ন হইতে শব্দ আসিল, ‘আমি রান্নাঘরে রহিয়াছি বাছা, নামিয়া আইস।’

এখানে বলা আবশ্যক, লন্ডনের রাজপথগুলি ভূমি হইতে উচ্চ হইয়া থাকে। রান্নাঘর প্রায়ই রাস্তার সমতলতা হইতে নিম্ন হয়।

মা’র স্বর শুনিয়া, আমার প্রতি চাহিয়া ম্যাগি বলিল, ‘Do you mind?’

আমি বলিলাম, ‘Not in the least, চলো।’

সিঁড়ি দিয়া বালিকার সঙ্গে আমি তাহাদের রান্নাঘরে নামিয়া গেলাম। দুয়ারের কাছে দাঁড়াইয়া ম্যাগি বলিল, ‘মা, একজন ভারতবর্ষীয় ভদ্রলোক তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছেন।’

বৃদ্ধা আগ্রহ সহকারে বলিলেন, ‘কই তিনি?’

আমি ম্যাগির পশ্চাৎ পশ্চাৎ স্মিত মুখে প্রবেশ করিলাম। বালিকা পরস্পর পরিচয় করাইয়া দিল— ‘ইনি মিস্টার গুপ্ত। ইনি আমার মা। 'How do you do?’— বলিয়া আমি কর প্রসারণ করিয়া দিলাম।

মিসেস ক্লিফর্ড বলিলেন, ‘ক্ষমা করিবেন। আমার হাত ভালো নয়।’ বলিয়া নিজ হস্ত প্রসারণ করিয়া দেখাইলেন, তাহাতে ময়দা লাগিয়া রহিয়াছে। বলিলেন, ‘আজ শনিবার, তাই কেক প্রস্তুত করিতেছি। সন্ধ্যাবেলা লোক আসিয়া ইহা কিনিয়া লইয়া যাইবে, রাত্রে রাজপথে ইহা বিক্রয় হইবে। এরূপ করিয়া কষ্টে আমরা জীবিকা নির্বাহ করি।’

দরিদ্রপল্লিতে শনিবার রাত্রিটা মহোৎসবের ব্যাপার। পথে পথে আলোকময় রেলগাড়িতে করিয়া অসংখ্য লোক পণ্যদ্রব্য বিক্রয় করিয়া বেড়ায়। রাজপথে এই সন্ধ্যায় ভিড় সকল দিন অপেক্ষা অধিক। শনিবারেই দরিদ্রগণের একটু খরচপত্র করিবার দিন, কারণ সেই দিনই তাহারা সাপ্তাহিক বেতন পাইয়া থাকে।

ড্রেসারের উপর ময়দা, চর্বি, কিসমিস, ডিম্ব প্রভৃতি কেক প্রস্তুতের উপকরণগুলি সজ্জিত রহিয়াছে। টিনের আধারে সদ্যপক্ক কয়েকটি কেকও রহিয়াছে।

মিসেস ক্লিফর্ড বলিলেন, ‘গরিব মানুষের পাকশালায় বসা কি আপনার প্রীতিকর হইবে? আমার কার্য প্রায় শেষ হইয়াছে। ম্যাগি, তুই ইহাকে বসিবার ঘরে লইয়া যা। আমি এখনই আসিতেছি।’

আমি বলিলাম, না, না। আমি এখানে বেশ বসিতে পারিব। আপনি বেশ কেক তৈয়ারি করিতেছেন তো!’ মিসেস ক্লিফর্ড স্মিতমুখে আমাকে ধন্যবাদ প্রদান করিলেন। ম্যাগি বলিল, ‘মা বেশ টফি তৈয়ারি করেন। খাইয়া দেখিবেন?’

আমি আহ্লাদের সহিত সম্মতি জানাইলাম। ম্যাগি একটা কাবার্ড খুলিয়া একটি টিনের কৌটাপূর্ণ টফি আনিয়া হাজির করিল। আমি কয়েকটি খাইয়া সুখ্যাতি করিতে লাগিলাম।

কেক তৈয়ারি করিতে করিতে মিসেস ক্লিফর্ড জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘ভারতবর্ষ কিরূপ দেশ, মহাশয়?’

‘সুন্দর দেশ।’

‘বাস করিবার পক্ষে নিরাপদ কি?’

‘নিরাপদ বৈকি। তবে এদেশের মতো ঠাণ্ডা নহে, কিছু গরম দেশ।’

---------------------------------------------
রান্নাঘরের টেবিলের নাম ড্রেসার। --লেখক।
---------------------------------------------

‘সেখানে নাকি সর্প ও ব্যাঘ্র অত্যন্ত অধিক? তাহারা মানুষকে বিনাশ করে না?’

আমি হাসিয়া বলিলাম, ‘ওসব কথা বিশ্বাস করিবেন না। সর্প ও ব্যাঘ্র জঙ্গলে থাকে, তাহারা লোকালয়ে আসে না। দৈবাৎ লোকালয়ে আসিলে তাহারা বিনষ্ট হয়।’

‘আর জ্বর?’

‘জ্বর ভারতবর্ষে কোথাও একটু বেশি বটে— সর্বত্র নহে, এবং সব সময়েও নহে।’

‘আমার পুত্র পাঞ্জাবে আছে। সে সৈনিক-পুরুষ। পাঞ্জাব কেমন স্থান মহাশয়?’

‘পাঞ্জাব উত্তম স্থান। সেখানে জ্বর কম। স্বাস্থ্য খুব ভালো।’

মিসেস ক্লিফর্ড বলিলেন, ‘আমি শুনিয়া সুখী হইলাম।’

তাহার কেক তৈয়ারি শেষ হইল। কন্যাকে বলিলেন, ‘ম্যাগি, তুই মিস্টার গুপ্তকে উপরে লইয়া যা। আমি হাত ধুইয়া চা প্রস্তুত করিয়া আনিতেছি।’

ম্যাগি অগ্রে, আমি পশ্চাৎ পশ্চাৎ তাহাদের বসিবার ঘরটিতে প্রবেশ করিলাম। আসবাবপত্র অতি সামান্য এবং অল্পমূল্য। মেঝের উপর কার্পেটখানি বহু পুরাতন হইয়া গিয়াছে, স্থানে স্থানে ছিন্ন, কিন্তু সমস্তই অত্যন্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।

ম্যাগি কক্ষে আসিয়া পর্দাগুলি সরাইয়া জানালাগুলো খুলিয়া দিল। একটি কাচে আবৃত পুস্তকের কেস ছিল, আমি দাঁড়াইয়া তাহাই দেখিতে লাগিলাম।

কিয়ৎক্ষণ পরে মিসেস ক্লিফর্ড চায়ের ট্রে হাতে করিয়া আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহার অঙ্গ হইতে রন্ধনশালার সমস্ত চিহ্ন অন্তর্হিত। চা পান করিতে করিতে আমি ভারতবর্ষের গল্প করিতে লাগিলাম।

মিসেস ক্লিফর্ড তাঁহার পুত্রের একখানি ফোটোগ্রাফ দেখাইলেন। ইহা ভারতবর্ষ যাত্রার পূর্বে তোলা হইয়াছিল। তাহার পুত্রের নাম ফ্রান্সিস অথবা ফ্রাঙ্ক। ম্যাগি একখানি ছবির বই বাহির করিল। তাহার জন্মদিন উপলক্ষে তাহার দাদা এখানি পাঠাইয়া দিয়াছেন। ইহাতে সিমলা শৈলের অনেকগুলো অট্টালিকা এবং স্বাভাবিক দৃশ্যের ছবি রহিয়াছে। ভিতরের পৃষ্ঠায় লেখা আছে— ‘To Maggie on her birthday from her loving brother Frank.’

মিসেস ক্লিফর্ড বলিলেন, ‘ম্যাগি, সেই আংটিটা মিস্টার গুপ্তকে দেখা না?’

আমি বলিলাম, তোমার দাদা পাঠাইয়াছেন নাকি? কই ম্যাগি, কীরকম আংটি দেখি?’।

ম্যাগি বলিল, ‘সে একটি জাদুযুক্ত অঙ্গুরীয়। একজন ইয়োগী সেটি ফ্রাঙ্ককে দিয়াছিল!’ বলিয়া ম্যাগি আংটি বাহির করিয়া দিল। আমাকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘আপনি ইহা হইতে ভূত-ভবিষ্যৎ বলিতে পারেন?’

Crystal gazing নামক একটা ব্যাপারের কথা অনেকদিন হইতে শুনিয়াছিলাম। দেখিলাম আংটিতে একটি স্ফটিক বসানো রহিয়াছে। হাতে করিয়া সেটি দেখিতে লাগিলাম।

মিসেস ক্লিফর্ড বলিলেন, ‘ফ্রাঙ্ক ওটি পাঠাইবার সময় লিখিয়াছিল, সংযত মনে ঐ স্ফটিকের পানে চাহিয়া দূরবর্তী যে-কোনো মানুষের বিষয়ে চিন্তা করিবে, তাহার সমস্ত কার্যকলাপ দেখিতে পাওয়া যাইবে। ইয়োগী ফ্রাঙ্ককে এই কথা বলিয়াছিল। বহুদিন ফ্রাঙ্কের কোনো সংবাদ না পাইয়া আমি ও ম্যাগি অনেকবার উহার প্রতি দৃষ্টিবদ্ধ করিয়া চিন্তা করিয়াছি, কিন্তু কোনো ফল হয় নাই। আপনি একবার দেখুন না? আপনি হিন্দু, আপনি সফল হইতে পারেন।’

দেখিলাম, কুসংস্কার শুধু ভারতবর্ষেই আবদ্ধ নহে। অথচ ইহা যে কিছুই নয়, একটা পিতলের আংটি এবং একটুকরা সাধারণ কাচমাত্র, তাহা এই জননী ও ভগিনীকে বলিতে মন বসিল না। তাহারা মনে করিয়াছে, তাহাদের ফ্রাঙ্ক সেই বহুদূর স্বপ্নবৎ ভারতবর্ষ হইতে একটি অভিনব অত্যাশ্চর্য দ্রব্য তাহাদিগকে পাঠাইয়া দিয়াছে, সে বিশ্বাসটুকু ভাঙিয়া দিই কী প্রকারে?

মিসেস ক্লিফর্ড ও ম্যাগির আগ্রহ দর্শনে, অঙ্গুরীয়টি হাতে লইয়া স্ফটিকের প্রতি অনেকক্ষণ দুষ্টিবদ্ধ করিয়া রহিলাম। অবশেষে প্রত্যর্পণ করিয়া বলিলাম, ‘কই, আমি তো কিছু দেখিলাম না।’

মাতা, কন্যা উভয়েই একটু দুঃখিত হইল। বিষয়ান্তরের প্রতি তাহাদের মনোযোগ আকৃষ্ট করিবার জন্য বলিলাম, ‘ঐ যে একটি বেহালা রহিয়াছে দেখিতেছি, ওটি তোমার বুঝি ম্যাগি?’

মিসেস ক্লিফর্ড বলিলেন, ‘হ্যাঁ। ম্যাগি বেশ বাজাইতে পারে। একটা কিছু বাজাইয়া শুনাইয়া দে না, ম্যাগি?’

ম্যাগি তাহার মাতার প্রতি রোষ কটাক্ষ করিয়া বলিল— ‘Oh, mother!’

আমি বলিলাম, ‘ম্যাগি, একটা বাজাও না? আমি বেহালা শুনিতে বড় ভালোবাসি। দেশে আমার একটি বোন আছে, সে-ও তোমারই মতো এত বড় হইবে, সে আমায় বেহালা বাজাইয়া শুনাইত।’

ম্যাগি বলিল, ‘আমি যেরূপ বাজাই, তাহা মোটেই শুনিবার উপযুক্ত নহে।’

আমার পীড়াপীড়িতে শেষে ম্যাগি বাজাইতে স্বীকৃত হইল। বলিল, ‘আমার ভাণ্ডারে অধিক কিছুই নাই। কী শুনিবেন?’

‘আমি ফরমাশ করিব? আচ্ছা, তাহা হইলে তোমার music case লইয়া আইস— কী কী আছে দেখি।’ ম্যাগি একটি কালো চামড়ায় নির্মিত পুরাতন মিউজিক কেস বাহির করিল। খুলিয়া দেখিলাম, তাহার মধ্যে অধিকাংশ স্বরলিপিই অকিঞ্চিৎকর, যথা ‘Good-bye Dolly Grey’ ‘Honeysuckle and the Bee’ প্রভৃতি। কয়েকটি রহিয়াছে যাহা যথার্থই ভালো জিনিস, যদিও ফ্যাশান হিসাবে বহু পুরাতন হইয়া গিয়াছে— যথা ‘Annie Laurie,’ ‘Robin Adair’, ‘The Last Rose of Summer’ ইত্যাদি দেখিলাম, কয়েকটি স্কচ-গানও রহিয়াছে! আমি স্কচ-গানের বড়ই পক্ষপাতী। তাই ‘Blue-Bells of Scotland’ নামক স্বরলিপিটি বাছিয়া আমি মাগির হস্তে দিলাম।

ম্যাগি বেহালায় বাজাইতে লাগিল, আমি মনে মনে সুর করিয়া গানটি গাহিতে লাগিলাম—

‘Oh where- and oh where- is my
Highland laddie gone!

বাজনা শেষ হইলে, ম্যাগিকে ধন্যবাদ দিয়া আমি অনেক প্রশংসা করিতে লাগিলাম। মিসেস ক্লিফর্ড বলিলেন, ম্যাগি কখনও উপযুক্ত শিক্ষালাভের সুযোগ পায় নাই। যাহা শিখিয়াছে, তাহা নিজের যত্নে শিখিয়াছে মাত্র। যদি কখনও আমাদের অবস্থার পরিবর্তন হয়, তবে উহাকে lessons লওয়াইবার বন্দোবস্ত করিব। কথাবার্তা শেষ হইলে বলিলাম, ‘ম্যাগি, আর কিছু বাজাও না?’

এখন ম্যাগির সঙ্কোচ তিরোহিত হইয়াছে। বলিল, ‘কী বাজাইব নির্দেশ করুন।’

আমি তাহার স্বরলিপিগুলোর মধ্যে খুঁজিতে লাগিলাম। বর্তমান সময়ে যে-সকল গান শৌখিন সমাজে আদৃত, তাহার কোনোটিই দেখিতে পাইলাম না। বুঝিলাম, সে-সকল গানের প্রতিধ্বনি এখনও এ দরিদ্রপল্লিতে প্রবেশ করে নাই।

খুঁজিতে খুঁজিতে হঠাৎ একটি যথাযথ উচ্চশ্রেণীর স্বরলিপি হাতে পাইলাম। এটি Ground কর্তৃক বিরচিত Faust নামক Opera হইতে Flower song গান--হাত তুলিয়া অনুরোধ করিলাম, এইটি বাজাও।’

ম্যাগি বাজাইল। শেষ হইলে, আমি কিয়ৎক্ষণ বিস্ময়ে মৌন হইয়া রইলাম। Culture নামক জিনিসটা ইউরোপীয় সমাজের কত নিম্নস্তর অবধি প্রবেশ করিয়াছে, ইহাই আমার বিস্ময়ের বিষয়। ম্যাগি এই কঠিন স্বরলিপিটিও সুন্দর বাজাইল, অথচ সে একটি নিম্নশ্রেণীর বালিকা মাত্র। ভাবিলাম, কলিকাতায় কোনো দিগগজ ব্যারিস্টার বা প্রসিদ্ধ সিভিলিয়ানের এই বয়সের কন্যা, গুনোর ফাউস্ট হইতে একটি সঙ্গীত যদি এমন সুন্দরভাবে বাজাইতে পারিত, তবে সমাজে ধন্য ধন্য পড়িয়া যাইত। ম্যাগিকে ধন্যবাদ দিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘এটিও কি তুমি নিজে শিখিয়াছ?’

‘না। এটি আমি নিজে শিখিতে পারি নাই। আমাদের গির্জার মিলস্টারের কন্যার নিকট আমি এটি শিখিয়াছি। আপনি কখনও এ অপেরা শুনিয়াছেন?’

আমি বলিলাম, ‘না, আমি অপেরায় কখনও ফাউস্ট শুনি নাই। তবে গইটের ফাউস্টের ইংরাজি অনুবাদ, লাইসিয়মে অভিনয় দেখিয়াছি বটে।’

‘লাইসিয়মে? যেখানে আর্ভিং অভিনয় করেন?’

‘হ্যাঁ । তুমি কখনও আর্ভিং-এর অভিনয় দেখিয়াছ?’

ম্যাগি দুঃখিতভাবে বলিল, ‘না, আমি কোনো ওয়েস্ট-এন্ড থিয়েটারে কখনও যাই নাই। আর্ভিংকে কখনও দেখি নাই। ছবির দোকানের জানালায় তাঁহার ফটোগ্রাফ দেখিয়াছি মাত্র।’

‘এখন আর্ভিং লাইসিয়মে Merchant of Venice অভিনয় করিতেছেন। মিসেস ক্লিফর্ড আর তুমি যদি একদিন আসো, তবে আমি অত্যন্ত আহ্লাদের সহিত তোমাদিগকে লইয়া যাই।’

মিসেস ক্লিফর্ড ধন্যবাদের সহিত সম্মতি জানাইলেন। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘আপনি সান্ধ্য-অভিনয় দেখিতে ইচ্ছা করেন, না অপরাত্নের অভিনয়?’

এখানে লন্ডনের থিয়েটার সম্বন্ধে একটু টীকা আবশ্যক। কলিকাতার থিয়েটারের মতো, আজ অমুক নাটকের অভিনয়ে ‘হৈ হৈ শব্দ রৈ রৈ কাণ্ড’--কাল নাটকান্তরে ‘হাসির হররা, গানের গররা, আমোদের ফোয়ারা’ উপস্থিত হয় না। প্রথমত সেখানে থিয়েটারে প্রতিরাত্রেই অভিনয় হইয়া থাকে (রবিবার ছাড়া)। ইহা ব্যতীত কোনো থিয়েটারে শনিবারে, কোনোটাতে-বা বুধবারে, কোনোটাতে বা শনি-বুধ উভয়বারেই ‘ম্যাটিনে’ অর্থাৎ অপরাহ্নেও-অভিনয় হইয়া থাকে। একটি নাটক কোনো থিয়েটারে আরম্ভ হইলে, প্রতিদিন তাহারই অভিনয় হয়। যতদিন অবধি দর্শকের অভাব না ঘটে, ততদিন পর্যন্ত এইরূপ চলে। এইরূপে কোনো নাটক দুই মাস বা ছয় মাস বা লোকপ্রিয় Musical comedy হইলে, এমনকি দুই-তিন বৎসর অবধি অবিচ্ছেদে অভিনীত হইতে থাকে।

মিসেস ক্লিফর্ড বলিলেন, ‘আমার শরীর ভালো নহে। অপরাহ্ন-অভিনয়ই সুবিধা। এক শনিবারে, ম্যাগির ছুটির পর একত্র যাওয়া যাইতে পারে।’

আমি বলিলাম, ‘উত্তম! সোমবার দিন গিয়া, সামনে যে শনিবারের জন্য পাই, সেই শনিবারের টিকিট কিনিয়া রাখিয়া আপনাকে তারিখ জানাইব।’

ম্যাগি বলিল, ‘কিন্তু মি, গুপ্ত, আপনি যেন অধিক মূল্যের টিকিট কিনিবেন না। তাহা যদি কেনেন, তবে আমরা অত্যন্ত দুঃখিত হইব।’

আমি বলিলাম, ‘না, অধিক মূল্যের টিকিট কিনিব কেন? আপার সার্কলের টিকিট কিনিব এখন। আমি তো আর একজন ভারতবর্ষীয় রাজা নহি। --ভালো কথা, Merchant of Venice পড়িয়াছ?’

‘মূল নাটক পড়ি নাই। স্কুলে আমাদের পাঠ্যপুস্তকে Lamb’s Tales হইতে গল্পাংশ কতকটা উদ্ধৃত ছিল। তাহাই পড়িয়াছি।’

‘আচ্ছা, আমি তোমায় মূল নাটক একখানি পাঠাইয়া দিব। বেশ করিয়া পড়িয়া রাখিও। তাহা হইলে অভিনয় বুঝিবার সুবিধা হইবে।’

সন্ধ্যা হইয়া আসিয়াছিল। আমি ইহাদিগের নিকট বিদায় গ্রহণ করিলাম।

সোমবার দিন বেলা দশটার সময় লাইসিয়মের বক্স-অফিসে গিয়া কর্মচারীকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘আগামী শনিবার অপরাহ্ন-অভিনয়ের জন্য আমাকে তিনখানা আপার সার্কলের টিকিট দিতে পারেন?’

কর্মচারী বলিল, ‘না মহাশয়, এখন সামনের দুই শনিবার দিতে পারি না। সমস্ত আসন বিক্রয় হইয়া গিয়াছে।’

‘তৃতীয় শনিবার?’

‘সেদিন দিতে পারি।’-- বলিয়া সে ব্যক্তি, সেই তারিখ-অঙ্কিত একটি প্ল্যান বাহির করিল। দেখিলাম, সে তারিখেও আপার সার্কলের অনেক আসন বিক্রয় হইয়া গিয়াছে। সেই সেই আসনের নম্বরগুলো নীল পেন্সিল দিয়া কাটা রহিয়াছে।

প্ল্যানখানি হাতে লইয়া, খালি আসনগুলো হইতে বাছিয়া, পরস্পর সংলগ্ন তিনটি আসন পছন্দ করিয়া, তাহার নম্বর কর্মচারীকে বলিয়া দিলাম। সেই নম্বরযুক্ত তিনখানি টিকিট ক্রয় করিয়া, বারো শিলিং মূল্য দিয়া চলিয়া আসিলাম।



তিনমাস কাটিয়া গিয়াছে। ইতিমধ্যে আরো কয়েকবার ম্যাগির সহিত গিয়া তাহার মাতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া আসিয়াছি। মধ্যে ম্যাগিকে একদিন জুগার্ডেনে লইয়া গিয়াছিলাম। সেখানে Indian Rajah নামক হস্তীর পৃষ্ঠে, অন্যান্য বালক-বালিকার সহিত ম্যাগিও আরোহণ করিয়াছিল। হাতি চড়িয়া তাহার খুশির আর সীমা নাই!

এখনও পর্যন্ত কিন্তু তাহার ভ্রাতার কোনো সংবাদ আসে নাই। একদিন মিসেস ক্লিফর্ডের অনুরোধক্রমে ইন্ডিয়া অফিসে গিয়া সংবাদ লইলাম। শুনিলাম, যে রেজিমেন্টে ফ্রাঙ্ক আছে, তাহা এখন সীমান্ত-সমরে নিযুক্ত। এই কথা শুনিয়া অবধি মিসেস ক্লিফর্ড অত্যন্ত চিন্তান্বিত হইয়া পড়িয়াছেন।

একদিন প্রভাতে ম্যাগির নিকট হইতে একখানি পোস্টকার্ড পাইলাম, সে লিখিয়াছে--

প্রিয় মিস্টার গুপ্ত, আমার মা অত্যন্ত পীড়িত। আমি আজ এক সপ্তাহ কাল কর্মস্থানে যাইতে পারি নাই। আপনি যদি দয়া করিয়া একবার আসেন তবে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ হইব।

--ম্যাগি

আমি যে পরিবারে বাস করিতাম, তাহাদিগের নিকট পূর্বেই ম্যাগি ও তাহার জননী সম্বন্ধে গল্প করিয়াছিলাম। আজ প্রাতরাশের সময় টেবিলে এই সংবাদ উল্লেখ করিলাম।

গৃহিণী আমাকে বলিলেন, ‘তুমি যখন যাইবে, সঙ্গে কিছু অর্থ লইয়া যাইও। মেয়েটি এক সপ্তাহ কর্ম করে নাই, বেতন পায় নাই। তাহারা বোধহয় অত্যন্ত কষ্টে পড়িয়াছে।’

প্রাতরাশের পর, আমি কিছু টাকা সঙ্গে লইয়া ল্যাম্বেথ যাত্রা করিলাম। তাহাদের বাড়িতে পৌঁছিয়া দরজায় ঘা দিলাম। ম্যাগি আসিয়া দুয়ার খুলিয়া দিল।

তাহার চেহারা অত্যন্ত খারাপ হইয়া গিয়াছে। চক্ষু কোটরাগত। আমাকে দেখিয়াই বলিল, ‘Oh, thank you Mr. Gupta, It is so kind--’

জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘ম্যাগি, তোমার মা কেমন আছেন?’

ম্যাগি বলিল, ‘মা এখন নিদ্রিত। তিনি অত্যন্ত পীড়িত। ডাক্তার বলিয়াছে ফ্রাঙ্কের সংবাদ না পাইয়া, দুশ্চিন্তায় পীড়া এরূপ বৃদ্ধি পাইয়াছে। হয়তো তিনি বাঁচিবেন না।’

আমি ম্যাগিকে সান্ত্বনা দিতে লাগিলাম। নিজের রুমাল দিয়া তাহার চক্ষু মুছাইয়া দিলাম।

ম্যাগি একটু সুস্থ হইয়া বলিল, ‘আপনার নিকট আমার একটি ভিক্ষা আছে!’

আমি বলিলাম, ‘কী ম্যাগি?’

‘বসিবার ঘরে আসুন, বলিব।’

পাছে আমাদের পদশব্দে পীড়িত বৃদ্ধা জাগরিত হন, তাই আমরা সাবধানে বসিবার কক্ষে গিয়া প্রবেশ করিলাম। মাঝখানে দাঁড়াইয়া সস্নেহে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কী ম্যাগি?’

ম্যাগি আমার মুখের পানে আকুলনেত্রে কয়েক মুহূর্ত চাহিয়া রইল। আমি প্রতীক্ষা করিলাম। শেষে ম্যাগি কিছু না বলিয়া, দুই হস্তে মুখ ঢাকিয়া নীরবে ক্রন্দন করিতে লাগিল।

আমি বড় বিপদে পড়িলাম। এ বালিকাকে আমি কী বলিয়া সান্ত্বনা দিই? ইহার ভ্রাতা সীমান্ত-সমরে, জীবিত কি মৃত তাহা ভগবানই জানেন। পৃথিবীতে একমাত্র সম্বল মাতা। সেই মাতা চলিয়া গেলে, ইহার দশা কী হইবে? এই যৌবনোমুখী বালিকা, এই লন্ডনে দাঁড়াইবে কোথায়?

আমি জোর করিয়া ম্যাগির মুখ হইতে তাহার হস্তাবরণ খুলিয়া দিলাম। বলিলাম, ‘ম্যাগি, কী বলিবে বলো? আমার দ্বারা যদি তোমার কিছুমাত্র উপকার হয়, তাহা করিতে আমি পরামুখ হইব না।’

ম্যাগি বলিল, ‘মি, গুপ্ত, আমি যাহা প্রস্তাব করিব, তাহা শুনিয়া আপনি কী ভাবিবেন জানি না, তাহা যদি অত্যন্ত গর্হিত হয়, তবে আমাকে ক্ষমা করিবেন।’

‘কী? কী প্রস্তাব?

‘গতকল্য সারাদিন মা খালি বলিয়াছিলেন, মি. গুপ্ত আসিয়া যদি সেই স্ফটিকের প্রতি কিয়ৎক্ষণ দৃষ্টি করেন, তবে হয়তো ফ্রাঙ্কের কোনো সংবাদ বলিতে পারেন। তিনি তো হিন্দু বটে! আমি তাই আপনাকে আসিবার জন্য পত্র লিখিয়াছিলাম।’

‘তুমি যদি ইচ্ছা করো, সে অঙ্গুরীয় লইয়া এসো-- আমি অবশ্যই পুনর্বার চেষ্টা করিয়া দেখিব।’

ম্যাগি আকুলস্বরে বলিল, ‘কিন্তু এবারও যদি নিস্ফল হয়?’

আমি ম্যাগির মনের ভাব বুঝিলাম। বুঝিয়া নিস্তব্ধ হইয়া রহিলাম ।

ম্যাগি বলিল, ‘মিস্টার গুপ্ত, আমি পুস্তকে পড়িয়াছি, হিন্দুজাতি অত্যন্ত সত্যপরায়ণ। আপনি যদি স্ফটিক অবলোকন করিবার পর মাকে কেবলমাত্র বলেন,’ফ্রাঙ্ক ভালো আছে, জীবিত আছে— তাহা হইলে কি নিতান্ত মিথ্যা হইবে? বড় অন্যায় হইবে?’

এই কথা বলিতে বলিতে বালিকার চক্ষু দিয়া দরদর ধারায় জল পড়িতে লাগিল। আমি কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করিলাম। মনে মনে ভাবিলাম, ‘আমি পুণ্যাত্মা নহি--এ জীবনে আমি অনেক পাপ করিয়াছি। আজ এই পাপটিও করিব। এইটিই আমার সর্বাপেক্ষা লঘু পাপ হইবে।

প্রকাশ্যে বলিলাম, ‘ম্যাগি, তুমি চুপ করো, কাঁদিও না। কই সে অঙ্গুরীয়, দাও একবার ভালো করিয়া দেখি। যদি কিছু দেখিতে না পাই, তবে তুমি যেরূপ বলিতেছ সেইরূপ করিব। তাহা যদি অন্যায় হয়, ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা করিবেন।’

ম্যাগি আমাকে অঙ্গুরীয় আনিয়া দিল। আমি সেটি হাতে লইয়া তাহাকে বলিলাম, ‘যাও, তুমি দেখ তোমার মা জাগিয়াছেন কিনা।’

প্রায় পনেরো মিনিট পরে ম্যাগি ফিরিয়া আসিল। বলিল, ‘মা জাগিয়াছেন। আপনার আগমন সংবাদ তাহাকে দিয়াছি।’

‘আমি এখন গিয়া তাহাকে দেখিতে পারি?’

‘আসুন।’

বৃদ্ধার রোগশয্যার নিকট উপস্থিত হইলাম। আমার হস্তে তখনও সেই অঙ্গুরীয়। তাহাকে সুপ্রভাত জানাইয়া বলিলাম-- ‘মিসেস ক্লিফর্ড, আপনার পুত্র ভালো আছে, জীবিত আছে।’

এই কথা শুনিবামাত্র বৃদ্ধা তাঁহার উপাধান হইতে মস্তক কিঞ্চিৎ উত্তোলন করিলেন। বলিলেন, ‘আপনি স্ফটিকে ইহা দেখিলেন কি?’

আমি অসঙ্কোচে বলিলাম, ‘হ্যাঁ, মিসেস ক্লিফর্ড, আমি স্ফটিকেই ইহা দেখিলাম।’

বৃদ্ধার মস্তক আবার উপাধানের সহিত মিলিত হইল। তাহার চক্ষুযুগল হইতে আনন্দাশ্রু বিগলিত হইতে লাগিল। তিনি শুধু অস্ফুটস্বরে বলিতে লাগিলেন- ‘God bless you--God bless you.’


৫.

মিসেস ক্লিফর্ড সে যাত্রা আরোগ্যলাভ করিলেন।

আমার দেশে ফিরিয়া আসিবার সময় ঘনাইয়া আসিল। একবার ইচ্ছা হইল, ল্যাম্বেথে গিয়া ম্যাগি ও তাহার জননীর নিকট বিদায়গ্রহণ করিয়া আসি। কিন্তু সে পরিবার এখন শোকসন্তপ্ত। সীমান্তযুদ্ধে ফ্রাঙ্ক নিহত হইয়াছে। মাসখানেক হইল, কালো-বর্ডার দেওয়া চিঠিতে ম্যাগিই এ সংবাদ আমাকে লিখিয়াছে। হিসাব করিয়া দেখিলাম, যে-সময় আমি মিসেস ক্লিফর্ডকে বলিয়াছিলাম তাহার পুত্র ভালো আছে, জীবিত আছে-- তাহার পূর্বেই ফ্রাঙ্কের মৃত্যু হইয়াছে। এই সকল কারণে মিসেস ক্লিফর্ডের নিকট আমার আর মুখ দেখাইতে লজ্জা করিতে লাগিল।

তাই আমি একখানি পত্র লিখিয়া, ম্যাগি ও তাহার মাতার নিকট বিদায়বার্তা জানাইলাম।

ক্রমে লন্ডনে আমার শেষ রজনী প্রভাত হইল। আমি অন্যদেশ যাত্রা করিব। পরিবারস্থ সকলের সঙ্গে প্রাতরাশে বসিয়াছি, এমন সময় বহির্দ্বরে শব্দ উথিত হইল।

কয়েক মুহূর্ত পরে দাসী আসিয়া বলিল, ‘Please Mr. Gupta, মিস ক্লিফর্ড আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছেন।’

আমার প্রাতরাশ তখনও শেষ হয় নাই। বুঝিলাম মাগি আমার নিকট বিদায়গ্রহণ করিতে আসিয়াছে।পাছে তাহার কর্মস্থানে যাইতে বিলম্ব হইয়া যায়,তাই আমি তখনই গৃহকত্রীর অনুমতি লইয়া টেবিল ছাড়িয়া উঠিলাম। হলে গিয়া দেখিলাম, কৃষ্ণবর্ণ পরিচ্ছদে দেহ আবৃত করিয়া ম্যাগি দাঁড়াইয়া রহিয়াছে।

নিকটেই পারিবারিক লাইব্রেরি ছিল, তাহার মধ্যে ম্যাগিকে লইয়া গিয়া বসাইলাম।

ম্যাগি বলিল, ‘আপনি আজ চলিলেন?’

‘হ্যাঁ ম্যাগি, আজই আমার যাত্রা করিবার দিন।’

‘দেশে পৌঁছিতে আপনার কয়দিন লাগিবে?’

‘দুই সপ্তাহের কিঞ্চিৎ অধিক লাগিবে।’

‘কোন্ স্থানে আপনি থাকবেন?’

‘আমি পাঞ্জাব সিভিল সার্ভিসে প্রবেশ করিয়াছি।কোন্ স্থানে আমাকে থাকিতে হইবে, সেখানে না পৌঁছুলে জানা যাইবে না।’

‘সেখান হইতে সীমান্ত কি অনেক দূর?’

‘না, অধিক দূর নহে।’

‘দেরা-গাজীখাঁর নিকট ফোর্ট মনরোতে ফ্রাঙ্কের সমাধি আছে।’ কথাগুলো বলিতে বলিতে বালিকার চক্ষুদুইটি ছলছল করিল।

বলিলাম, ‘আমি যখন ওদিকে যাইব, তখন অবশ্যই তোমার ভ্রাতার সমাধি দর্শন করিয়া, তোমায় পত্র লিখিব।’

ম্যাগি বলিল, ‘কিন্তু আপনার কষ্ট ও অসুবিধা হইবে না?’

‘কী কষ্ট? কী অসুবিধা? আমি যেখানে থাকিব, সেখান হইতে দেরা-গাজীখা তো অধিক দূর হইবে না। আমি একবার নিশ্চয়ই সুবিধামতো গিয়া তোমায় পরে সব জানাইব।’

ম্যাগির মুখখানি কৃতজ্ঞতায় পূর্ণ হইয়া উঠিল। সে আমাকে ধন্যবাদ দিল-- তাহার কণ্ঠ রুদ্ধপ্রায়। নিজের পকেট হইতে একটি শিলিং বাহির করিয়া আমার সম্মুখে টেবিলের উপর রাখিয়া বলিল, ‘আপনি যখন যাইবেন, তখন অনুগ্রহ করিয়া এক শিলিং দিয়া কিছু ফুল ক্রয় করিয়া, আমার ভ্রাতার সমাধির উপর সাজাইয়া আসিবেন।’

ভাবের আবেগে আমি চক্ষু নত করিয়া রহিলাম। ভাবিলাম, বালিকার এই বহুকষ্টার্জিত শিলিংটি ফিরাইয়া দিই। বলি, আমাদের দেশে ফুল যেখানে-সেখানে অজস্র পরিমাণে পাওয়া যায়, পয়সা দিয়া কিনিতে হয় না।

কিন্তু আবার ভাবিলাম-- এই-যে ত্যাগের সুখটুকু, ইহা হইতে বালিকাকে বঞ্চিত করি কেন? এই-যে বহু শ্রমলব্ধ শিলিংটি, ইহার দ্বারা বালিকা যেটুকু সুখ-স্বচ্ছন্দতা ক্রয় করিতে পারিত, প্রেমের নামে সে তাহা ত্যাগ করিতে উদ্যত হইয়াছে। সে ত্যাগের সুখটুকু মহামূল্য-- সে সুখটুকু লাভ করিলে উহার বিরহতপ্ত হৃদয় কিয়ৎ পরিমাণে শীতল হইবে। তাহা হইতে বালিকাকে বঞ্চিত করিয়া ফল কী?-- এই ভাবিয়া আমি সেই শিলিংটি উঠাইয়া লইলাম।

বলিলাম, ‘ম্যাগি, আমি এই শিলিং দিয়া ফুল কিনিয়া, তোমার ভ্রাতার সমাধির উপর সাজাইয়া দিব।’

ম্যাগি উঠিয়া দাঁড়াইল। বলিল, ‘আমি আর আপনাকে কী বলিয়া ধন্যবাদ দিব? আমার কর্মস্থানে যাইবার বেলা হইল! Good bye,-- পত্রাদি যেন পাই।’

আমি উঠিয়া ম্যাগির হস্তখানি নিজহস্তে লইলাম! বলিলাম-- ‘Good bye Maggie-God bless you’-- বলিয়া তাহার হাতখানি স্বীয় ওষ্ঠের নিকট তুলিয়া তাহাতে একটি চুম্বন করিলাম!

ম্যাগি চলিয়া গেল!

চক্ষের দুইফোঁটা জল রুমালে মুছিয়া, বাক্স-তোরঙ্গ গুছাইতে উপরে উঠিয়া গেলাম।





লেখক পরিচিতি
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় : জন্ম ৩ ফেব্রুয়ারি, ১৮৭৩। মৃত্যু ৫ এপ্রিল, ১৯৩২। ছিলেন বাংলা সাহিত্যের একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী কথাসাহিত্যিক ছোটগল্পকার ও ঔপন্যাসিক।

ছাত্রাবস্থায় 'ভারতী' পত্রিকায় কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে প্রভাতকুমারের সাহিত্য জীবনের শুরু। পরে গদ্য রচনায় হাত দেন। 'শ্রীমতী রাধামণি দেবী' ছদ্মনামে লিখে কুন্তলীনের প্রথম পুরস্কার লাভ করেন। এক বার 'শ্রীজানোয়ারচন্দ্র শর্মা' ছদ্মনামে তাঁর রচিত নাটক 'সূক্ষ্মলোম পরিণয়' মর্মবাণী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রদীপ, প্রবাসী ও ভারতী পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতেন। তাঁর রচিত ১৪ টি উপন্যাস ও মোট ১০৮ টি গল্প নিয়ে ১২ টি গল্প-সংকলনের সম্ভার আছে বাংলা সাহিত্যে। তাঁর প্রথম উপন্যাস 'রমাসুন্দরী' ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে ধারাবাহিক ভাবে 'ভারতী' পত্রিকায় প্রকাশিত হয় । শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত 'রত্নদীপ'। এটি নাট্য ও চলচ্চিত্ররূপে জনপ্রিয় হয়েছে। সরল ও অনাবিল হাস্যরসের গল্পলেখক হিসাবে প্রভাতকুমার সমধিক প্রসিদ্ধ। সাধারণ আটপৌরে জীবনের লঘু ও দুর্বল দিকগুলো হাস্যরসে পরিবেশিত হয়েছে। বাঙালি জীবনের সুখ ও দুঃখের জীবন দোলার ছন্দে ছন্দময় হয়ে সার্থক হয়েছে। তাঁর লেখা গল্প পড়ে রবীন্দ্রনাথ অভিভূত হয়ে এক চিঠিতে তাঁকে লিখেছিলেন -

"তোমার গল্পগুলি ভারি ভালো। হাসির হাওয়ায় কল্পনার ঝোঁকের পালের উপর পাল তুলিয়া একেবারে হু হু করিয়া ছুটিয়া চলিতেছে, কোথাও কিছুমাত্র ভার আছে বা বাধা আছে তাহা অনুভব করিবার জো নাই।"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ