একবার হলুদ একবার সাদা একবার গোলাপি ফুলে মুখ ডোবাতে ডোবাতে টুনটুনি বলে গেল, ও জলপিঁপি, মাছরাঙা কোন বই পড়ে উপন্যাস লেখা শুরু করবে ভেবেছো, ‘বাংলা উপন্যাসের কালান্তর’ নাকী?! সেখানে কিন্তু তোমার ওই সুলেখা সান্যাল আর সাবিত্রী রায়দের পাবে না!
ভুবন বেশ মজা পেয়ে বলে—ও বাবা! গাছে না উঠতেই এক কাঁদি। গপ্পো ফাঁদবোনা। এই যে একখান জেবন। যেমন চেয়েছিলাম তেমন না। যেমন চাইনি তেমন না। যেমন চাইতে পারি তেমন না। বা, উল্টোটাও বলা যায়। যেমন চেয়েছিলাম তেমন। যেমন চাইনি তেমন। যেমন চাইব তেমন। তো এসব নিয়ে কথাগুলো লিখে রাখবো ভাবছি। তো ইনি এলেন, পদ্মিনী।’
টুনটুনি বলে—কোন পদ্মিনী গো? পদ্মাবতের পদ্মিনী?
—না। না। ‘সতী নারী পতি তরে হাসিমুখে আগুনে পোড়ে’ এরকম কঠিন কিছু না। এটা আমরা বলতাম জানো। ছোটোবেলায় বলতাম না, আহা এলেন, পদ্মিনী … মানে, মানে কি কে জানে!
—মানে যিনি এলেন তিনি কেউকেটা। সব্বাই তার কথা মানবে। কিন্তু বালিকা তো, মাথার ঘিলুর তো উদাহরণ নেই। তো! ঐ উপ-রূপ-রূপসীর উদাহরণ পদ্মিনী! তাইতো?
—হ্যাঁ। তাই-ই বোধহয়।
—বোধহয় কী, তাই-ই … ভুবন লিখেছো বলে ভেবো না তুমি হরি সিং হয়ে গেলে। যতই ভুবনেশ্বরী লেখো, আসলে তুমি মাছরাঙা বা জলপিঁপি। বা আন্নাকালী।
হরি সিংটাকে জিজ্ঞাসা করা হল না ভুবনের। গাছে গাছে ফুল, ফল, মধু—টুনটুনি বড়ো ব্যস্ত। তার দাঁড়াবার সময় কোথায়!
তবে লক ডাউনের গুমসানো দিনে জলপিঁপি আর মাছরাঙা দুটো নাম পেয়ে ভারি মন ভালো হয়ে গেল ভুবনের। ভুবনঈশ্বরী কী এক জগৎজোড়া নাম দিয়েছিল ঠাকুরমা। সে নাম টুকরো হয়ে ভুবন। ভুবন টুকরো হয়ে এমন মাইক্রো চিপস্। কোথাও নেই কেউ। গোল গোল। দানাদার। মাগো কী এক করোনা ভূত! গোল গোল দানাদার ক্ষীরকদম মতিচুর ঘুরছে বাতাসে বাতাসে। ছুঁলেই মৃত্যু। এমন মৃত্যু কেউ ছোঁবে না তোমাকে। মুখও দেখব না কেউ। ডিপ্রেশন কাটাতে শেষমেশ ছাদ। ছাদের আশ্রয়। সব গিয়ে এটাই এখন বিরাট পাওয়া।
লক ডাউনে একাকিত্বে কাটাতে গান, কবিতা পাঠের লাইভ চালু হয়েছে। ভুবনের এককালে টুকটাক লেখার অভ্যাস ছিল। তো সে পর্ব লিখতে গিয়ে কেমন আওয়াজ খেলো টুনটুনির। টুনটুনি কি কলি-কৃষ্ণকলি? বুদ্ধিমতী, রসিক দুষ্টু মেয়েটি, ভুবনের ইউনিভার্সিটি মেট।
মেয়েদের লেখা নিয়ে সবার নাক সিঁটকানো। মান্যতা না দেওয়া। তাই নিয়ে কী মজাটাই করে গেল। ভুবনও হাসল কুলকুল করে। এই রিটায়ার্ড জীবনে এসে লিখে সে বিখ্যাত হতে চাইবে, পাগল নাকী! সাইকিক না হয়ে। সব সময় মৃত্যুর ভয়ে ভীত না হয়ে একটু বেঁচে থাকার তোড়জোড়। চারিদিকে কত কিছু আছে। আর একটা চাকুরি জীবনের ছোটাছুটিতে কত কিছু ফস্কে যায়। যেমন এই ছাদ। ছাদটা যে এতো কিছু দিতে পারে করোনা না এলে, জানাই তো যেত না!
প্রথম দিকে করোনায় আটক পর্বের প্রথম ধাপে। এক নাগাড়ে তথ্যের বিস্ফোরণ। ভুবনের কলকাতার ডাক্তারবাবু ডঃ বিশ্বাস শুধু নামী—স্পেশালিস্ট নন, সমাজ সচেতন অ্যাকটিভিস্টও! ‘প্লীজ ওয়াচ নিউজ বাংলা অ্যাট ৭ পি.এম বা ডি.ডি. বাংলা অ্যাট ৮ পি.এম’ একনাগাড়ে এইরকম অনেক মেসেজ দেন ডাক্তারবাবু। নতুন রোগ করোনাকে নিয়ে পৃথিবী উত্তাল।
চিন, আমেরিকা, ইউরোপ বিজয় শেষে একটু দেরিতেই সে এ দেশে এসেছে। ইন্ডিয়া সামলে নিচ্ছে মোটামুটি কিন্তু ভারতের কেস জন্ডিস। পিলপিল করে গ্রাম থেকে শহরে পাড়ি দেবার যে ছবিটা রোজ দেখা যায় সেটা উল্টে গেল কেমন! শহর ছেড়ে দলে দলে লোক হাঁটা দিয়েছে গ্রামের দিকে। লক ডাউন কালে যেখানে ঘরে থাকার কথা, সেখানে এতো লোকের হাঁটাহাঁটি। দূরত্ব না মেনে ভিড় করা। এরা নিজেরাও মরবে। মারবে আমাদের সবাইকে।
তো এরা যে আটকে পড়ল শহরে। থাকবে কোথায়। খাবে কী! এরা সবাই তো ভারতববর্ষের নাগরিক। সরকার দায়িত্ব নেবে না, এদের?
সোজা সোজা প্রশ্নের কোনও সোজা সোজা উত্তর নেই। শুধু চারিদিকে অদৃশ্য করোনা। টিভি স্ক্রিনে গোল্লা কাঁটওয়ালা ভাইরাসের ছবি। একটা বড় মার্বেলের মতো ফল ছিল না, গায়ে কাঁটা? খুব শক্ত খোসা। দাঁত দিয়ে কষ্ট করে খেতে হত। খুব যে আহামরি কিছু খেতে তা নয়। কিন্তু ফল তো! কী নাম! কী নাম! কিছুতেই মনে পড়ছে না। বড়দি বঁটি দিয়ে কাটতো। সেই কাটার ভঙ্গিটা মনে আছে। তো বড়দিকে ফোন হল।
—পানি ফলের কথা বলছিস…?
—না। না। পানিফলের গায়ে কী কাঁটা আছে! আর সেটা কি গোল! কাঁটা যে নিশ্চিন্ত আছে সে ব্যাপারেও নিশ্চিন্ত হতে পারছে না ভুবন। কারণ কাঁটা তীক্ষ্ণ নয়। কিন্তু ফলটা দেখতে ওই করোনার মতো। অন্ততঃ চার-পাঁচজনকে জিজ্ঞাসা করে উত্তর না পেয়ে হাল ছেড়ে দিল।
সবাই করোনা নিয়ে যত না চিন্তিত, তার চেয়ে বেশি চিন্তিত ৯ তারিখে প্রবাস থেকে শ্রমিকদের ফেরা নিয়ে।
অনেক ফোনালাপেও ফলটির নাম জানা গেল না। জানা গেল নানা হেঁসেলের নানা পদের কথা। কারো দমে বসানো আছে মাটন বিরিয়ানী। কারো চিংড়ির মালাইকারি। নারকেল নেই—খুব কী জমবে নারকেল ছাড়া! রসগোল্লা তৈরি করেছি জান তো—একদম দোকানের মতো। কিন্তু খুব চিন্তায় আছি আতঙ্কেও! এই ৮, ৯ তারিখ বাইর থেকে আজমেঢ়, হায়দ্রাবাদ থেকে লোক ঢুকবে যে!!
—তো কি!
—না বাইর থেকে আসছে কতজন। করোনা নিয়ে আসছে কীনা তার তো পরীক্ষা হবে না।
—এত দিন ধরে বাইরে আছে। ওদের থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। ওরা বাড়ি ফিরবে না!
কথা আর বেশি এগোয় না। জেলা শহরের উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্তদের নিরাপদ ছাদের নীচে থাকতে থাকতে, এটাই এখন প্রধান দুশ্চিন্তা—ওরা আসছে!!
এর মাঝে করোনার চেহারা পাল্টে গেছে। বড় বড় চ্যানেলে তাকে নিয়ে আলোচনা হয়। সেলিব্রিটিরা করোনাকালে কীভাবে কাটাচ্ছে তার লাইভ দেয়। নানা রূপে কখনো রেনু মাখা কদম, কখন পেতল-পুঁতির অঙ্গ সাজ, কখনো মনিমুক্তো দিয়ে চমৎকার করে সাজানো গোল ভাইরাস—ছোট বড়ো ঘুরছে পুরো স্ক্রিন জুড়ে। কথা বলছেন বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রতিষ্ঠিত সব মানুষ। ডাক্তার, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, মন্ত্রী, পরিষদ, সেলিব্রিটি…
পাশাপাশি মানুষের ছবি। লাঠি স্প্রে। শূন্য থালা। রেল লাইনে ঘুমিয়ে পড়লে, থেঁতলে যাওয়া। নীল প্লাস্টিক ঢাকা সারি সারি মৃতদেহ। গণ কবর। গণ চিতা দাউ দাউ।
এই সব ক্রমাগত দেখলে উন্মাদ হবার দশা। বাঁচো। বাঁচো প্রাণী। টেরেস বাগানের ছবি দাও প্রাণপণ। গান দাও। নাচ দাও। বাণী দাও। হেঁসেল দেখো। কন্টিনেন্টাল হেঁসেল ছেড়ে ঢুকে যাও দিশি বাংলা রান্নাঘরে। পুর্ববঙ্গীয় টানে রান্নার রেসিপি শোনা, কী যে মজা। এক মিনিটেই ব্যঞ্জন রাঁধা শিখে যাবা তা হবে না। দেখো। ছোটো মই। দেখো কাস্তে পেড়ে শাড়ির চওড়া আপা। দেখো গাছে মই লাগিয়ে কাতি দিয়ে কেমন কাটা হল এঁচোড় শরীর। মাটিতে পাটাহীন বঁটি পেতে সবল হাতে কেমন দু-টুকরো নধর ফল। হাতে তেল মাখো। ভুঁতি ফেলো। খুব সূক্ষ্ম হবে না বামুন বাড়ির মতো। প্যাঁজ রসুন চিংড়ি মাছ পড়বে অত সূক্ষ্ম নিরামিষের কী দরকার। তাই বলে তাড়াহুড়োয় হবে না। দায়সারাও হবে না। জাল মাছ ভেজে তোলো। আলু পেঁয়াজ রসুন জিরে ধনের ময়মশলা শরীর দিয়ে জাপটে ধরো কাঁঠালের সাইজ করা শরীর। কাঠ টেনে আঁচ ঢিমা রাখো। দাউ দাউ অরণি পোড়ায়। মজায় না। মজতে দাও মশলার রসে। পানি ঢেলে ফুটতে দাও। এই ফাঁকে মজা করে খেতে পারো কাঁঠালের নরম ভুতি। খুব মিহি করে কাটো। ঝিরি করা পেঁয়াজের সাথে হাত খুলে মরিচ দাও। সর্ষের তেল, লবণ আর খানিক পাকা তেঁতুলের কাঁই। চটকাও রাগ ঝাল আর পিরীত দিয়ে, তবে না মজা!
কী শুনতে শুনতেই জিভে পানি আসে না?
আর এই সব হেঁসেল ঘর। গান বাড়ি। পান বাড়ি। সেলেবদের মাখন ফ্যানা জীবন মহামানবদের রুটি ভাত জীবন নায়কের উঠতি গায়ক হবার ‘কিছু তো চাইনি আমি আজীবন ভালোবাসা ছাড়া’, জীবন দেখতে দেখতে কীভাবে কোন স্ক্রিনে যে চাপ পড়ল—কি যে দেখলে কি দেখলে—এমন হয়—এমন—এমনিই?!!
ছেলেটি ক্যাজুয়াল জামা প্যান্ট। মেয়েটিও জিন্স।
রাস্তার পাশে একটা কাঁচ ঢাকা ঘর। রেস্টোরেন্ট নয়। মনে হয় প্রতীক্ষালয়। কিন্তু কেউ নেই। রোগা সাধারণ। খুব সাধারণ চেহারার দুটি নারী-পুরুষ। নীল জিন্স। লাল জামা। চোখে চোখ। হাতে হাত। স্পর্শ। আবেশ। এসব কিছু নেই। দুটি গরম শরীর। সেক্স করে। ছেলেটির কোলে বসে মেয়েটি। সে সংগমে মেয়েটির ঠোঁটের। স্তনের। যোনীর। কোনও ভূমিকা নেই। ছেলেটি নিপুণ দক্ষতায় পায়ু সঙ্গম করে। মেয়েটি একটু কঁকায়। পিঠু চুলকোলে, খরখরে দেওয়ালে পিঠ ঘষে যেমন নিবৃত্তি। যোনী বা লিঙ্গ তড়পালে যেমন পাশ বালিশে ঘষাঘষি—তেমনি একটি নিস্পৃহ যৌন ক্রিয়া শেষ। এবং চলে যাওয়া। আবাহন ও বিসর্জনের মাঝে নিষ্পৃহ যন্ত্রবৎ কিছু শরীরী ক্রিয়া। দুজন দু’দিকে থেকে এসেছিল। দুজন দুদিকে চলে যাবে। বিদেশ, বিভুঁইয়ে—স্বজনহীন গৃহহীন অভালোবাসো অপ্রেম অযৌন জীবনে এইরকমই হয়তো গাঁ ঘষাঘষি অভ্যাসে রসদ নেওয়া। গা ঘিনঘিন হয়। কষ্টও হয়। এটুকুই কারো মোচন পর্ব, রুটি রুজিও হয় তো! মুঠ্ঠির বোতাম এসব এনে দেয়। দায়িত্বশীল অভিভাবক সতর্ক থেকো। বাচ্চারাও তো নাড়াঘাটা করে যন্ত্র! ভুবনদের বাড়িতে বাচ্চা নেই। ভুবন পাখি দেখে।
ভোর পাঁচটায় হয়ে গেলে আকাশ-বাতাস গাছপালা-পাখিরা কী যে ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরে। মাটির গাছ তো মোটে তিনটি। আম। মাধবীলতা। সুপুরি। কিন্তু গোটা চল্লিশ টব। মেঝে থেকে উঁচুতে সাত ফুটের দুটি স্ল্যাব। ছাদে গেরস্থ ফুল আর পাতার এমন সমারোহে মনে হয় উঠোনের বাগানে বসে আছে ভুবন। স্রেফ যত্নেই মৃদুল উঠোন তুলে এনেছে ছাদে। বোগেনভিলা আর টগরগাছে সাতটা চড়ুইয়ের এমন আড্ডা। রোগা ডালে রোগা শরীরের দোল। চাকা বন্ধ। যন্ত্র বন্ধ। দাপুটে দৈত্য হয়ে যাওয়া মানুষ গৃহবন্দী। প্রকৃতি পরম হরষে এসেছে ফিরিয়া। ভাগ্যি একখান ছাদ ছিল। পাখিদের ডাকে ভোরে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে—সাড়ে চারটায়, পাঁচটায়। দোয়েলের উড়ুক ফুড়ুক চঞ্চলতা। বুলবুলি ঝুঁটি নিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ। ঘুঘু জোড়ায় আসে। একাও আসে কখনও। দোতলার ঘরে দরজা খোলা ছিল। ওমা ছোটো টেবিলের নিচে একটা ঘুঘু। রোগা। ঘরের আলো আঁধারিতে মায়া। যেন রাজমহল পেরিয়ে এসেছে রোজিদা খাতুন।
রিটায়ারমেন্টের পর ভুবন কিছু দিন রাঙামাটি জুনিয়র হাইস্কুলে পড়াতে যেতো। এক দুপুরে রাজাদিঘি কম্যুনিটি সেন্টারের মৃণালিনী সরকার এনেছিল একগুচ্ছ ইঁটভাটা শ্রমিকের বাচ্চাকে। কী এলোমেলো উক্ষীবীক্ষি একপাল বাচ্চা। ভুবন বিরক্ত কারণ, সেভেন এইটের ছাত্রদের সঙ্গে তারাও ক্লাসে বসবে। হাই ইস্কুলে ছাত্রছাত্রীদের সাথে প্রি-প্রাইমারি কেন?
‘ওই একটু পড়াবেন। বাবা-মা ইটভাটায় খাটে। এরা তো হুড়পার করে ঘুরে বেড়ায়। ওরা প্রাইমারিতেই বসবে। নতুন ঘর তৈরি হচ্ছে। ওদের এখানেই বসান এখন।’
সবাই হিন্দীভাষী। কী পড়বে ওরা! ওই হিন্দিতেই বাংলা পড়বে। প্রথম দিন ড্রেস। এক সেট বই। সব দেওয়া হল।
আর পোশাক পরে পরের দিন যখন এলো। আহা কী রূপ ভাবা যায় না। যেন গৃহস্থ সন্তান।
ইউনিফর্ম পরা মেয়েদের ভুবন চিনতে পারেনি। কী ঝলমলে লাগছে সবাইকে। একটা পোশাক এতটাই পাল্টে দিতে পারে তবে! রোজ দুপুরে এক থালা ভাতের প্রতিশ্রুতিও আছে। কিন্তু সে অন্নময় থালার সামনে তারা উদাস ছিল। ঘরে তাদের ব্যঞ্জনের বৈচিত্র্য নাই কিন্তু শাকান্ন ভাতে যত্ন ও পরিপাট্য আছে। ঠিক সময়ে গ্রান্ট না আসা, ধারে চালিয়ে দেওয়া মিড-ডে মিলের মাসীদের পক্ষে, ডাল-ভাতের গুণমান রক্ষা করাও চাপের। শুধু ডিমের দিন থালা চটপট ফাঁকা। তো এই মেয়েদের নিয়ে কী মুস্কিল। কী পড়বে।
গণতন্ত্রের জার্সি সামনে রেখে যেমন হাবিজাবি অসিদ্ধ টকে যাওয়া প্রতিশ্রুতি মাখা নির্বাচনী মোওয়া গিলে নিতে হয়! ডিমের সেই সংবেদী মোহময় উপস্থিতি! খরখরে মোটা চালের ভাত—তীব্র হলুদ বর্ণ তরল প্রায়, বিক্ষিপ্ত, ইতস্তত মুসুর ডালে প্রায় দানাশস্যের লাস্য নেমে আসে। থালা ফাঁকা করে দ্রুত। চেটে সাফ করা থালায় রাঁধুনির শৈলী, দ্রব্যাদির গুণমান। কিন্তু ডিমের খেলা হপ্তায় একদিন। অন্যদিন নর্দমায় ভাত জমে। তো সেদিন হাড় কাঁপানো শীত। VII-এর নিমাখুকি, মামুনি, সবুজ দাস, বিপ্লব মণ্ডল কেউ আসেনি। এসেছে ইট ভাটার ওই এক পাল হিন্দীভাষী বক্ বকম। তো এই মেয়েরা কী পড়বে? বাংলা জানে না। বোঝে না। পড়ুক না পড়ুক এদের বসিয়ে রাখতে হবে। একটু হাঁপালো চেহারার নাগমা খাতুনের বাড়ি ভাগলপুরের তাসপুর। ২ ভাই ২ বোন। নাচ জানো? গান জানো? ছড়া জানো? সে খুব দেমাক নিয়ে গায়—
‘মাম্মী মাম্মী লাল টমেটো খায়েঙ্গে লাল হো জায়েঙ্গে
মাম্মী মেরা নম লিখা দে অঙ্গন বাড়ি জায়েঙ্গে
ছিম ছিম বরষা পানি/ছাতা উপর নিচে হম—
ব্যাস খতম!’
ভাগলুপুরের পিবুপাইতির সাইবুল খাতুন গায় :
‘তেরে আঁখিয়া কে কাজল হম জান লে গয়ী
কুছ করদু না করদু হামারা বিয়া হো গয়ী—’
মহা আনন্দে নাচছে সাইবুল বৈশাখে এদের নিয়ে ফাংশন করলে হয় না! ডিম। না নতুন পোশাক। নাকী লালফুলের ঘাগরা, কে যে বসন্ত এনে দেয় ভাবতেই রাঙামাটির সেই পুকুর পাড়ের আশ্চর্য কৃষ্ণচূড়া গাছ থেকে খুব জোরে শিস্ দিয়ে উঠলো টুনটুনি—এ বাবা। পাগল হয়ে গেলে নাকী ভুবন দিদিমনি। লক ডাউনে—ফাংশন হবে কেমন হবে। করোনা কালে ছাদে আটকে থাকতে থাকতে মাথাটা দেখি গেছে। ইশকুল কোথায়? সব তো বন্ধ। বাড়ি কি এতদিন ওদের ঘরে বসিয়ে রাখবে? দেখো বিয়ে সাদী হয়ে গেল কীনা!
—পালা এখান থেকে। লক ডাউন উঠবে না নাকী? ইশকুল কি বন্ধ হয়ে যাবে?
—না সে দেখো কত দিন। সব তো নাকী ঘরে বসেই ইশকুল হচ্ছে। হবে। আর বৈশাখের ফাংশন মানেই তো তোমাদের রবীন্দ্র জয়ন্তী। তো এরা কোন রবি ঠাকুরে গান গাইবে গো!
—রবি ঠাকুর অন্য গান গাইতে বারণ করেছেন নাকী। যে যা জানে গাইবে… সেদিন ওরা সাদ্রী ভাষায় যীশুর গান শুনিয়েছে জানো ? বনলতা সংকটা গান শেখায় ওদের। এ বছরটা এমনই থাক। সামনের বছর না হয় রবি ঠাকুরের শুদ্ধ গান হবে। মণিদীপা সাদ্রী ভাষায়, প্রেমানন্দ, পীযূষ রাজবংশী ভাষায় রবি ঠাকুরের গান অনুবাদ করেছে জান তো! রবি ঠাকুর আছেন। কিন্তু বৈশাখে শুধু রবি ঠাকুরই কেন? ওরা নিজেদের গান গাইবে। টুনটুনির সাথে তরজায় মাতে ভুবন।
একটা কাল্পনিক ফাংশনের মহড়ায় ভুবনের আর একটি লক ডাউন সকাল কাটে।
কুল কুল করে শব্দ হচ্ছে। যেন ঋষিকোন্ডার ঝোরা।
মাধবীলতা টগর পাতাবাহারদের ভেজাতে ভুবন নেমে পড়ে ঝোরায়।
0 মন্তব্যসমূহ