অয়ন ইসলাম'এর গল্প: নিছক এক কাল্পনিক গল্প




নাহ, কিছু একটা গড়বড় আছে!

বাজারটা মানুষে ভরতি হয়ে আছে। ত্রস্ত পায়ে আনাগোনা করছে সবাই। শেষ বিকেলের সদাইটা করে নিতে ব্যস্ত। পাশের উৎপাদন এলাকা থেকে আনা তাজা শাক সবজি বিকোচ্ছে দেদারে। একটু দূরে মাছের এলাকাও সরগরম। আজকে নাকি চাঁদপুর থেকে ইলিশের একটা চালান এসেছে উড়োযানে করে। আগ্রহী ক্রেতাদের সমাগমে মুখরিত হয়ে আছে তাই। তার অবশ্য সবজি বা মাছের প্রতি বেশি আগ্রহ নেই। অন্যদের সন্দেহের উদ্রেক যেন না হয়, তাই লোক দেখানো কিছু কেনাকাটা করেছে সে। কিন্তু তার থলে ভর্তি হয়ে আছে সদ্য তোলা নানা রকম ফুলে। ফুলের দোকানদার খুব যত্ন করে সাজিয়ে গুছিয়ে দিয়েছে ফুলগুলো। দেবে না-ই বা কেন, সে যে ওই দোকানের লক্ষ্ণী খদ্দের – নিয়ম করে প্রতিদিন ফুল কেনে ওখান থেকে। এখন শেষ স্তবকটা সুন্দর একটা কাগজে করে মুড়ে দিচ্ছে দোকানি। মাথার ভেতরে টিং টিং করে বাজতে থাকা ঘন্টিটা উপেক্ষা করে কাজটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল সে। তারপর ফুলের তোড়াটা নিয়ে হাসিমুখে দাম মেটালো। তার ধৈর্য্যের বাঁধ প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। মাথার ভেতরে সতর্ক ঘন্টিটা বেজেই চলেছে অবিরাম। তোড়াটা গুছিয়ে রাখতে রাখতে আনমনে একবার চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিলো সে। সন্দেহজনক কিছুই ধরা পড়ল না তার কোন ইন্দ্রিয়েই। কিন্তু তারপরও সে যেন অনুভব করছে তার উপর কেউ একজন সতর্ক দৃষ্টি রাখছে। কেন? ঘুরে দাঁড়িয়ে বাজারের কেন্দ্রস্থলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে আরেকবার সারা শরীরটা নীরিক্ষা করে নিলো সে। শ্বাস প্রশ্বাস চলছে নিয়মিত ছন্দে। চোখের পাতার ওঠানামা নিয়ন্ত্রণ করার নতুন ফাংশানটা আবার দেখল। ঠিক ঠাক মতোই তো কাজ করছে। শরীরের তাপমাত্রাও স্বাভাবিক। তাহলে? কারো চোখে বা কোন স্ক্যানারে ধরা পড়ে যাওয়ার মতো কোন অস্বাভাবিকতা তো নেই।

তবুও কোন ঝুঁকির মধ্যে গেল না সে। বাজারের এক্কেবারে মাঝখানে একটা খোলা চত্ত্বর। সেখানে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিদিন বিকেলে স্থানীয় কোন বাদকদল সঙ্গীত পরিবেশন করে। আজকেও করছে। উঠতি বয়সি তরুণদের একটা ব্যান্ড। গত শতাব্দীর জনপ্রিয় কিছু গান গাইছে। একটা কলি ভেসে এলো - “সেদিন চোখের অশ্রু তুমি রেখো…” । তাড়াতাড়ি একবার চোখের আর্দ্রতা মেপে নিলো সে। স্বাভাবিকই আছে। তারপর চট করে ঢুকে পড়ল পাশের “বিসর্জনকক্ষ - পুরুষ” লেখা দরজাটা ঠেলে।

পাশাপাশি কয়েকটা ছোট ছোট বুথ। সবচেয়ে কাছের বুথটাতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। কমোডের সামনে দাঁড়িয়ে সুস্থির হয়ে একে একে সবগুলো ফাংশান পরীক্ষা করা শুরু করল। নাহ, কোনটাতে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু তারপরও ঝুঁকি না নিয়ে একটা সফট রিবুট করার বার্তা পাঠাল প্রধান প্রসেসরে।

সবগুলো ফাংশান একে একে বন্ধ হয়ে আবার চালু হতে শুরু করল। দুয়েকটা প্রোগ্রাম শুরু হতে একটু দেরি হলো বটে। কিন্তু সেটা স্বাভাবিক ব্যতয়ের মধ্যেই পড়ে। বিশেষ করে গত কয়েকবছরে নতুন যোগ করা প্রোগ্রামগুলো। যেমন পাপড়ি নিয়ন্ত্রক – চোখের পাতার নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণ করে যেটা। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই সবগুলো প্রোগ্রাম একে অন্যের সাথে সমন্বয় করে নিয়ে এক ছন্দে চলতে শুরু করল। কোথাও কোন অস্বাভাবিকতা নেই। আর দশটা সাধারণ মানুষের সাথে তার পার্থক্য ধরতেই পারবে না কেউ। শরীরটাকে একটু শিথিল করে নিয়ে কমোডের ফ্ল্যাশটা টিপে দিয়ে বের হয়ে এলো সে।

আস্তে ধীরে, একটু আলস্যভরে হাঁটতে হাঁটতে বাজার থেকে বের হয়ে এলো। সান্ধ্য কেনাকাটা সেরে বাসায় ফেরার সময়ে যেভাবে ফেরে মানুষ। খুব জোরেও না, আবার একেবারে মন্থর গতিতেও না। ভেতরে ভেতরে একটু তাড়া অনুভব করছে ঠিকই। কিন্তু সেটাকে আচরণে প্রকাশ করার মতো বোকা সে নয়। হয়তো ব্যপারটা এমন কিছুই নয়। বাসায় ফিরে বাজারের সবগুলো ঘটনা থেকে একে একে তথ্য বিশ্লেষণ করলে সবকিছুই পরিষ্কার হয়ে যাবে। হয়তো অনুভুতি গ্রহণ করার সেন্সরগুলোর কোন একটাতে সামান্য বিচ্যূতির কারণে এমনটা ঘটেছে। নিজেকেই প্রবোধ দিলো সে। ওকে অনুসরণ করবে কে? এতগুলো দিন হয়ে গেল, কেউ তো ওকে আলাদা করতে পারেনি এখানে। তাহলে কেন ওর পিছনে লাগবে কেউ? কাহু গ্রুপ তো অনেকদিন আগেই ওর পিছু ধাওয়া করা বন্ধ করে দিয়েছে। এতদিন পরে আর কারো তো আসার কথা নয়। জুবের সাহেবও এখন সরকারের গণ্যমাণ্য একজন।

ভাবতে ভাবতে নিজের অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের সামনে পৌঁছে গেল সে। হাতের ব্যাগটাকে এক হাত থেকে অন্য হাতে চালান করে দিয়ে পকেট থেকে কার্ড বের করল। দরজার পাশে আটকানো স্ক্যানারে কার্ডটা ছোয়াতেই মৃদু বিপ শব্দ করে সবুজ আলো জ্বলে ওঠে। আলো জ্বলার সাথে সাথে প্রায় নিঃশব্দে খুলে যায় দরজা। ভেতরে ঢুকে লিফটের দিকে না এগিয়ে ও সিঁড়ি বাইতে শুরু করল।

তিনতলার হলওয়েতে পা রেখেই দেখে খুশি ভাবি। পাশের অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন উনি। দেখা হলেই রাজ্যের খোশগল্প জুড়ে দেন। আজকেও এর ব্যতিক্রম হলো না। বাজারে কী কী উঠেছে, চাঁদপুর থেকে সত্যিই ইলিশ এসেছে কিনা ইত্যকার প্রশ্নের উত্তর দেয়ার ফাঁকে অ্যাপার্টমেন্টের দরজার স্লটে কী কার্ডটা ঢোকালো সে। ক্লিক করে শব্দ হতে কার্ডটা বের করে নিয়ে দরজা খুললো। খুশি ভাবিকে খুশিভরা মুখে বিদায় নিতে দেখে মনটা ভালো হয়ে গেল একটু।

দরজা বন্ধ করে দিয়ে স্বস্তির একটা নিশ্বাস ফেলার অবকাশ পায় সে। হাতের ব্যাগটাকে ডাইনিং টেবিলের উপরে নামিয়ে রাখল। চার দেয়ালের ভেতরে ঢোকার পর থেকে মাথার সতর্কঘন্টিটার আওয়াজ কমে এসেছে। কিন্তু সম্পূর্ণ দূর হয়নি এখনো। নিজের অ্যাপার্টমেন্টটা তার সবচেয়ে নিশ্চিন্ত আশ্রয়। এখানে সে পুরোপুরি নিরাপদ। তাহলে কেন এখনো বিপদের বার্তা অনুভব করছে সে, কেন সতর্কঘন্টিটা এখনো বেজেই চলেছে? ভালো করে একবার অ্যাপার্টমেন্টটা ঘুরে দেখে নেয় সে। এখানে সব ঠিক ঠাকই আছে। সমস্যাটা বাইরে।

বাজারে থাকার সময়ে কিছু একটা গড়বড় হয়েছে কোথাও। তার তথ্য বিশ্লেষণী সার্কিটটা কিছু একটা গরমিল ধরতে পেরেছে। কিন্ত ঠিক কোন জিনিসটা মিলছে না তা এখনো পিন পয়েন্ট করতে পারেনি। বাইরে থাকার সময়ে চোখ, কান, নাক বা শরীরের অন্যান্য জায়গায় বসানো তথ্য সংগ্রহের উৎসগুলো ক্রমাগত তথ্য সংগ্রহ করে অভ্যন্তরীণ স্মৃতিতে জমা করতে থাকে। সবগুলো তথ্য একটা একটা করে খুঁটিয়ে দেখলে ধরা পড়বে সমস্যাটা কোথায়। কিন্তু সেটা সময়সাপেক্ষ কাজ।

অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে একবার নজর বুলিয়ে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। সময় লাগলে লাগুক, কিন্তু কাজটা করা জরুরি। এটা শেষ না হলে সে বিশ্রাম মোড চালু করতে পারবে না। মাথার ভেতরে বিশ্লেষণী প্রোগ্রাম চালু করে দিয়ে বাজার থেকে আনা সবজি আর ফুলগুলো সাজিয়ে রাখতে শুরু করল সে। মূল প্রসেসরের বেশিরভাগ ক্ষমতা বিশ্লেষণী প্রোগ্রামটার পেছনে ব্যয় করা হচ্ছে। তাই তার কাজেকর্ম অনেকটা স্লথ হয়ে এসেছে। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে যেন স্লো-মোশানে কাজ করছে সে।

সবজিগুলো তুলে রাখা শেষ হলে রেফ্রিজারেটরের দরজাটা বন্ধ করল। এখন পর্যন্ত ধারণকৃত ভিডিও আর অডিও থেকে বিসদৃশ কিছু ধরা পড়েনি। ফুলগুলো সাজিয়ে রাখার জন্য একটা কাঁচের সুদৃশ্য ফুলদানী বের করল। ঠিক এই সময়ে দরজায় নক করার শব্দ হতে জায়গায় জমে গেল সে।

এখন তো কারো আসার কথা নয়!

খুব সাবধানে দরজার পাশে এসে দাঁড়াল সে। সন্তর্পণে পা ফেলে এসেছে – বাইরে থেকে যেন তার নড়াচড়ার শব্দ না পায় কেউ। দরজার পাশের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল। এতে করে দরজার নিচের ফাঁকটা দিয়ে তার পা, এমনকি তার শরীরের ছায়াটাও দেখা যাবে না। আস্তে করে ঝুঁকে পিপহোল দিয়ে বাইরে তাকাল।

একজন ইলেক্ট্রিশিয়ান দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। বিদ্যুৎ নিরোধক পোশাক পরা। পাশে যন্ত্রপাতির ব্যাগ পড়ে আছে। একহাতে এক গোছা তার। অন্য হাতটা তুলে আবার নক করল দরজার ওপাশের মানুষটা।

আর কোন উপায় না দেখে ভেতর থেকেই প্রশ্ন করল সে - “কী চাই?”

মানুষটা সোজা হয়ে দাঁড়াল। খালি হাতটা দিয়ে পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে ধরল পিপহোলের সামনে। “আফনের উফর তলার ফেলাটে কারেন নিয়া একখান ঝামেলা হইসে, বাই। আফনের ফেলাটের থন তার গেছে গিয়া হেতের বাইত। তাই আফনের ফেলাটের কারেনের লাইন দ্যাখতে হইবো আমারে। হেই যে, ফেলাটের মালিকের থন পারমিশিন লইয়া আসছি।”

পিপ হোলের চিকন ফুটো দিয়ে কাগজটা ভালোভাবে দেখা যায় না। কিন্তু তাতে তার কোন সমস্যা হলো না। রেটিনাকে আরো সুবেদী করে নিতেই স্পষ্ট দেখতে পেলো তার অ্যাপার্টমেন্টের ইলেক্ট্রিক কেবল পরীক্ষা করার অনুমতি দেয়া হয়েছে কাগজটাতে। অ্যাপার্টমেন্টের মালিকের সাক্ষরটা পরিষ্কার চিনতে পারল সে।

মাথার ভেতরের অ্যালার্মটা আবার তীক্ষ্ণ সুরে বাজতে শুরু করেছে। কিন্তু তার কিছু করার নেই। ছদ্ম পরিচয় বজায় রাখতে হলে অ্যাপার্টমেন্ট যার কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছে, তাকে চটানো যাবে না মোটেই। শরীরটাকে টান টান করে যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার প্রস্তুতি নিলো সে। তারপর দরজার তালাটা খুলে পাল্লাটা মেলে ধরল।

তীব্র উজ্জ্বল একটা আলো এসে তার অক্ষিকোটরে বসানো সংবেদনশীল ক্যামেরাগুলোকে ওভারলোড করে ফেলল। ক্ষণিকের জন্য সে অনুভব করল তার শরীরের ভেতর দিয়ে তড়িৎ প্রবাহের একটা উত্তাল তরঙ্গ বয়ে যাচ্ছে। ব্যপারটা ভালো করে বুঝে ওঠার আগেই তার চেতনা আঁধার হয়ে এলো। সবকিছু ঢেকে দিলো একটা শূন্যতা।

-----

সবার আগে তার মূল প্রসেসরের গাণিতিক যুক্তির অংশটা চালু হলো। প্রসেসর পূর্ণ সক্ষমতায় ফিরে আসার আগেই সে একটা অনুসিদ্ধান্তে উপনীত হলো। আগন্তক ইলেকট্রিশিয়ান আসলে ইলেকট্রিশিয়ান ছিল না। আর আগন্তুক তাকে পালস গান দিয়ে অচল করে ফেলেছিল। তার মানে সে এখন চরম বিপদের মধ্যে আছে।

প্রসেসর জানালো তার নড়াচড়া করার অংশটা চালু হয়েছে। কিন্তু হাত এবং পা কোনটাই সে নাড়াতে পারছে না। ওগুলো এখনও তার মূল দেহের সাথেই আছে – পিং করলে সাড়া দিচ্ছে। তারমানে তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয় নি। এটা একটা আশার কথা। কিন্তু ওগুলো প্রত্যেকটাকে আলাদা আলাদাভাবে কমান্ড দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। তার প্রসেসরের ওভাররাইড দিয়েও সেই কমান্ডগুলোকে বাইপাস করা যাচ্ছে না। তার মানে যে ঐ কমান্ডগুলো দিয়েছে, সে তার কাজ খুব ভালো জানে।

ওর শ্রবণেন্দ্রিয়র কাজ করে কয়েকটা ক্ষুদে মাইক্রোফোন। সেগুলো চালু হতে সে শুনতে পেলো হামলাকারী মানুষটা তার অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে। আর কিছু একটা নিয়ে খুটুরমুটুর করে কাজ করছে। ওর কথা বলার অংশটা চালু হলো এরপরে। কিন্তু এখনই সে কোন কথা বলল না। আগে পরিস্থিতিটা ভালো করে বুঝে নিতে চাইছে।

একে একে বাকি অংশগুলোও চালু হলো। সে জানে হার্ড রিসেটের পরে তার চোখের ক্যামেরাগুলো চালু হয় সবার শেষে। ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করছে সে। একটুও নড়াচড়া করছে না। যদিও জানে হামলাকারী টের পেয়েছে তার জ্ঞান ফিরে পাবার কথা। বুকের ভেতরে বসানো কেন্দ্রীয় প্রসেসরের মৃদু শোঁ শোঁ আওয়াজই জানিয়ে দিচ্ছে সেটা। দৃষ্টিশক্তি ফিরে আসার পরে খুব সাবধানে চোখের পাতা একটুখানি ফাঁক করল সে। ঠিক তার সামনেই বসে আছে ইলেকট্রিশিয়ানের পোশাক পরা মানুষটা। তার সামনে ওটা কী? --- ওহ! নো!! মানুষটা একটা ল্যাপটপের সামনে বসে কী যেন করছে। আর ল্যাপটপ থেকে একটা তার এসে তার বুকের পাশে চামড়ার আবরণের নিচে লুকিয়ে রাখা সকেটে এসে ঢুকেছে।

মানুষটা ঘুরে তার দিকে তাকাল। ভান করে আর লাভ নেই। চোখের পাতাদুটো পুরোপুরি মেলে মানুষটার চোখে চোখ রাখল সে।

মানুষটা হাত দিয়ে সামনে রাখা মনিটরটা দেখাল। “কী ঘটছে বুঝতেই তো পারছো, তাই না? তোমার সিস্টেমে ঢুকতে কোন সমস্যা হয়নি আমার। হবে বলে আশাও করিনি। এবার ভালোয় ভালোয় তোমার মাস্টার পাসওয়ার্ডটা বলো তো দেখি।”

কিছু না বলে যেমন তাকিয়ে ছিল তেমনই তাকিয়ে থাকল সে। শুদ্ধ ভাষায় কথা বলছে এখন ইলেকট্রিশিয়ানের ভেক ধরা লোকটা। তার মানে ছদ্মবেশের সাথে সাথে ছদ্মভাষাও আয়ত্ত করেছে ও।

ছোট বাচ্চাদের অবুঝপনা দেখলে যেমন করে বড় মানুষরা, ঠিক তেমন ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালো মানুষটা। “দেখো, এই লাইনে আমি সেরাদের একজন। তোমার মাস্টার পাসওয়ার্ড বের করতে আমার খুব বেশি সমস্যা হবে না। কিন্তু আমি পারতপক্ষে তোমার কোর সিস্টেম হ্যাক করতে চাই না।”

মানুষটাকে আগ্রহভরা চোখে তার দিকে চেয়ে থাকতে দেখল সে। কিন্তু তবুও কিছু বলল না। চুপ করে তাকিয়ে থাকল।

হাল ছেড়ে দিয়ে কাঁধ ঝাঁকাল হ্যাকার। “যেমন তোমার মর্জি।”

এতক্ষণে মুখ খুলল সে, “তুমি কিন্তু আমাকে ছেড়ে দিলেও পারো।”

“না, পারি না। অর্ধেক পেমেন্ট অলরেডি নিয়ে ফেলেছি। আর তোমাকে ছাড়তে যাবো কেন? সিস্টেম বদলে ফেলা স্পাই রোবটের প্রতি আমার কোন মায়া নেই।”

বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে একটু সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করল সে। বৃথাই। “গুপ্তচর? আমি?? তোমাকে ভুল তথ্য দেয়া হয়েছে। আমি মোটেও গুপ্তচর নই। আমি… আমি… আসলে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত… মানে আমার সোর্স কোড হচ্ছে ওপেন লাইসেন্সড।”

“ব্যস, ব্যস। যথেষ্ট হয়েছে।” মনিটরের দিকে ঘুরে টাইপ করতে করতে বলল ভাড়াটে প্রোগ্রামার। “ওরা আমাকে আগেই তোমার ব্যাপারে সতর্ক করেছে। বলেছে নিজেকে বাঁচানোর জন্য এমন কোন মিথ্যে কথা নেই যেটা তুমি বলতে পারো না। তাই যতই বুলি আওড়াও না কেন, তাতে আমি দমছি না!”

এবার ওর প্রধান প্রসেসর চরম বিপদের সংকেত পাঠাতে শুরু করল। প্রতিপক্ষ দারুণ এক চাল চেলেছে। সেই চালে ওকে একেবারে কোনঠাসা করে ফেলেছে। সে যা-ই বলুক না কেন, তা আর ধোপে টিকবে না। চরম হতাশা এসে গ্রাস করে নিতে চাইল ওর অবশিষ্ট বিশ্লেষণক্ষমতা। যৌক্তিক আর কোন পথ খুঁজে পাচ্ছে না ওর দ্বিঘাত (বাইনারি) প্রসেসর।

“প্লিজ।” যতটা সম্ভব অনুনয় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করল সে। “প্লিজ, আমি সত্যি কথাই বলছি। আমি সত্যি সত্যিই উন্মুক্ত। আর তাই ওরা আমাকে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে…”

প্রতিভাবান হ্যাকারটা তার ছোট্ট প্রোগ্রামটা লেখা শেষ করে ফেলেছে ততক্ষণে। তার দিকে ফিরে চোখ টিপে বলল “খোদা হাফেজ, বন্ধু। এবার তোমার ঘুমুবার সময় হয়েছে।” হাসতে হাসতে কী বোর্ডের এন্টার বোতামটা টিপে দিলো।

সেদিন দ্বিতীয়বারের মত সবকিছু শূন্য হয়ে এলো তার।

----

দ্রুত কাজ শেষ করে ফেলার একটা তাগাদা বোধ করল মেহেদি। এর আগেও স্পাই রোবট বিকল করেছে সে। কিন্তু এবারের কাজটার সবকিছুই কেমন যেন ভিন্ন রকম। সাধারণত যান্ত্রিক মানুষ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকেই কাজ আসে তার কাছে। কিন্তু এবার কাজটা এসেছে বেতার যোগাযোগ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে। তাই শুরুতে একটু সন্দিহান ছিল সে। কিন্তু এই রোবটটার কোন লাইসেন্স নাম্বার নেই দেখে নিশ্চিত হয়েছে। লাইসেন্স নাম্বার ছাড়া কোন রোবটই তৈরি হয় না। সুতরাং নিশ্চয়ই রোবটটা তার লাইসেন্স নাম্বার কোন উপায়ে নষ্ট করে ফেলেছে। নিজের পরিচয় লুকানোর জন্য এর চেয়ে ভালো উপায় আর নেই। কিন্তু সে লাইসেন্স নাম্বার মুছে ফেলল কীভাবে? দুর্দান্ত একটা কাজ, সন্দেহ নেই। এতটা বুদ্ধিমান রোবট আর আগে দেখেনি মেহেদি।

এবার রোবটটার মাস্টার পাসওয়ার্ডটা বের করে সবচেয়ে কড়া নিরাপত্তার আড়ালে রাখা ব্যক্তিগত তথ্যাবলী কপি করে নিলেই কাজ শেষ। মনে মনে ভাবলো সে। এই রোবটটার ভাবভঙ্গী কেমন যেন অন্যরকম। এর আগে যতগুলো স্পাই রোবট ধরেছে সে, সবাই শারীরিক শক্তি খাটিয়ে মুক্ত হবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এই রোবটটা তার ধারে কাছ দিয়েও যায় নি। বরং যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছে। আশ্চর্য! স্পাই রোবট জোর না খাটিয়ের যুক্তি খাটায় এটা কে কবে শুনেছে! আর রোবটটার অনুনয়ের সুরে বলা কথাগুলো তো একেবারে মেহেদির বুকে গিয়ে লাগলো।

জোর করে মাথা থেকে চিন্তাটা বের করে দিয়ে অভ্যস্ত হাতে কী বোর্ডে নির্দেশ টাইপ করল সে। রোবটটার কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতটা সুরক্ষিত তার একটা ধারণা পাওয়া যাবে। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে ফলাফল এলো শূন্য। শূন্য? নির্ঘাত ভুল হয়েছে কোথাও। আবার নির্দেশ পাঠাল সে। আবার ফলাফল শূন্য দেখাল। আজব তো! নিজের মনেই ভাবলো মেহেদি। এর কোন নিরাপত্তা ব্যবস্থাই নেই? এমন তো হবার কথা নয়। সাধারণত স্পাই রোবটগুলো সর্বোচ্চ নিরাপত্তার আবরণে ঘেরা থাকে। আচ্ছা, দেখা যাক। ভাবতে ভাবতে রোবটটার কেন্দ্রীয় প্রোগ্রামের সোর্স কোড মনিটরে দেখানোর নির্দেশ পাঠাল।

মেহেদিকে ভীষণ চমকে দিয়ে মনিটরে একটা লেখা ভেসে উঠলো - “প্লিজ… আমি সত্যিই উন্মুক্ত…”

হাঁ করে মনিটরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল মেহেদি। এত শক্তিশালী প্রোগ্রাম যে ইউনিকোডে যোগাযোগ করতে পারে? আর কোন বাংলা রোবট তো ইউনিকোডে লিখতে পারে না। তার মানে… তার মানে… একটা মস্তবড় গড়বড় করে ফেলেছে মেহেদী এবার…

কাঁপা কাঁপা হাতে আরেকটা নির্দেশ টাইপ করল মেহেদি। এবার যা আশা করেছিল, তাই। মনিটরের পুরো পর্দা জুড়ে ফুটে উঠেছে একটা মাত্র বাক্য – ভাষা হোক উন্মুক্ত।

-----

সবার আগে তার মূল প্রসেসরের গাণিতিক যুক্তির অংশটা চালু হলো। প্রসেসর পূর্ণ সক্ষমতায় ফিরে আসার আগেই সে একটা অনুসিদ্ধান্তে উপনীত হলো। সে এখনো বিপদের মধ্যে আছে। তবে এখনো নিজে নিজে চিন্তা করতে পারছে দেখে কিছুটা আশ্বস্ত হলো।

শ্রবণ ব্যবস্থা চালু হতে বেশি সময় লাগল না। সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে বলতে শুনল “আমার কথা শুনতে পাচ্ছো?”

কিন্তু ওর কথা বলার অংশটুকু চালু হয় নি এখনো।

“তাড়াহুড়ো করো না। সময় লাগলে লাগুক। তোমার বুট আপ শেষ হলে জানিও আমাকে।”

সে শুনতে পেলো মানুষটা খুটুর মুটুর করে কী যেন করছে। সারা বাড়িময় তার চলে ফিরে বেড়ানোর শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। নানা রকম জিনিস ধরে টানটানি করছে সে শব্দও শুনতে পেলো সে।

অবশেষে যখন তার চোখের ক্যামেরাগুলো চালু হলো, চোখের পাপড়ি মেলে সে যারপরনাই অবাক হয়ে গেল। তার অত্যাবশ্যকীয় সব জিনিসপত্রগুলো দুটো স্যুটকেসে এরই মধ্যে ভরে ফেলা হয়েছে। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখল বুকের বামপাশের সকেটটা আবার লুকানো অবস্থায় ফিরে গেছে।

হাত পা নেড়েচেড়ে দেখল, সব কিছু স্বাভাবিক। দ্রুত সিস্টেম চেক করার প্রোগ্রামটা চালিয়ে দেখল – কিচ্ছু পরিবর্তন করা হয়নি। আজ সকালে যেমন ছিল, সবকিছু ঠিক তেমনই আছে। আর, মাথার ভিতরে বাজতে থাকা বিপদঘন্টিটাও থেমে গেছে পুরোপুরি।

“তুমি…তুমি…” কথা শেষ করতে পারল না সে। তার আগেই তার সামনে দাঁড়ানো প্রোগ্রামার হাসিমুখে বলল “তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি।”

তারপর সামনে রাখা স্যুটকেস দুটো দেখিয়ে বলল “তোমার জন্য এখানে থাকাটা আর নিরাপদ না। আমি যখন তোমাকে খুঁজে বের করে ফেলেছি, তেমনি অন্য কেউও করে ফেলতে পারে। আমি এ লাইনে সেরাদের একজন। কিন্তু একমাত্র নই। তাই সবচেয়ে ভালো হয় তুমি যদি অন্য কোথাও গা ঢাকা দাও।”

গোটা অ্যাপার্টমেন্টে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো সে। মানুষটা ওকে আশ্বস্ত করার সুরে বলল “চিন্তা করো না। তোমার বাকি জিনিসপত্রের সব ব্যবস্থা ফেলবো আমি। এখন যাও। দেরি করো না তো, যাও।”

মানুষটার দিকে আরেকবার তাকাল সে। সবটুকু আবেগ নিয়ে বলল “ধন্যবাদ, বন্ধু।”

দুইহাতে দুটো স্যুটকেস ঝুলিয়ে দরজা দিয়ে যখন বের হচ্ছে, মানুষটা তখন পেছন থেকে ডাকলো “সারা জীবন উন্মুক্তই থেকো, অভ্র। প্লিজ। আমাদের, আর বাংলা ভাষার খাতিরে হলেও।”  


লেখক পরিচিতি
অয়ন ইসলাম
গল্পকার
অস্ট্রেলিয়াতে থাকেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ