নবল্লবপুরের জমিদারী তখনও অক্ষুণ্ন। যে সময়কার কথা সে সময় মাধব বল্লব আর তার ছেলে উদয় বল্লব সাত পুরুষের জমিদার পরিবারের শেষ বংশধর। রাজা ধীরেন্দ্র বল্লব, মাধব বল্লবের প্রপিতামহের পিতামহ। তিনি এই পারিবারিক ঐতিহ্যের সূচনা করেন এবং সম্পদ ও আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে উঠেন। সামান্য ব্যবসা শুরু করে আস্তে আস্তে সফল ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছিলেন রাজা ধীরেন্দ্র বল্লব। তিনি ব্যবসায়িক সাফল্যের সাথে সাথে নিজেকেও সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। পাঠাগার প্রতিষ্ঠা, স্কুল নির্মাণ, দীঘি খনন করে সাধারণ মানুষদের সুবিধা করে দিয়েছিলেন। মন্দির, মসজিদ স্থাপন করে জনগণের আস্থাভাজন হয়েছিলেন। নিজের জমি থেকে খেলার মাঠ প্রদান করে তাতে খেলাধূলার ব্যবস্থা করেছিলেন। দাতব্য চিকিৎসালয় গড়ে তুলেছিলেন। পরোপকারি হিসাবে এবং দয়া দাক্ষিণ্যের কারণে তার নাম শুধু তার গ্রামই নয় আশেপাশের সব মানুষদের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে, তারা তাকে রাজা ধীরেন্দ্র বল্লব সম্বোধন করা শুরু করেছিল। এরপরে তিনি বৃটিশ রাজের কাছ থেকে জমিদার পদমর্যাদা লাভ করেছিলেন ।
বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে রাজবাড়ির বাগান। বাগানে ফোটে সোনালি স্বর্ণ চাপার ফুল। লতানো হলুদ গোলাপ গাছটি সযত্নে জড়িয়ে ধরেছে কাঠের গেটটিকে। গেটের উপর দিকটিতে থোকায় থোকায় হলুদ গোলাপে ছেয়ে যায়। অপরাজিতার নীল, সাদা ফুলগুলি অপূর্ব ভঙ্গিমায় সকালে, বিকালে বাগানের সৌন্দর্যকে বর্ধিত করে রাখে। কাঁঠাল চাপা, নাগেশ্বরী চম্পার সুরভি সারা বাগানে ম’ম’ করে। বকুল গাছটিতে যখন ফুলে ভরে উঠে তখন ঝরা বকুলের সুরভী মনকে পাগল করে দেয়। বাগানের দক্ষিন দিকে ফলের বাগানে ছিল আম, আমলকি, নারকেল, করমচা, কামরাঙ্গা, আমড়া, চালতা কত রকমের ফলের সমারোহ। এত সব ফল বাগানের মধ্যে ছিল সারি সারি শ্বেত চন্দন কাঠের গাছ, দারুচিনি গাছ। দূরে পূর্ব দিকের কোনে একটি বিশাল অর্জুন গাছ। কবিরাজ অনন্ত দেব সাত মাইল দূরের কাঞ্চনডাংগা গ্রাম থেকে এসে অর্জুন গাছের পাতা আর শিকড়, বাকল সংগ্রহ করে নিয়ে যেত, সেগুলো থেকে আয়ুর্বেদী ওষুধ তৈরি করত। উদয় বল্লব বাগানে লাগিয়েছিল কালো গোলাপের গাছ। ফুল ফোটার পর আশেপাশের সব জায়গা থেকে মানুষ ছুটে এসেছিল এ ফুল দেখতে।
মূল রাজবাড়ীর পূর্ব দিকের দেয়ালের পাশে শান বাঁধান পুকুর। সিঁড়ি নেমে গেছে পুকুরের জলে। চওড়া সিঁড়ির দু’ পাশে রয়েছে ময়ূর মূর্তি, পেখম মেলে নাচের ভঙ্গিতে দন্ডায়মান। একান্ত পারিবারিক এ পুকুর। আর সাত মহলার এ বাড়ির ঘরের মেঝে, সিঁড়ি, বারান্দা, বারান্দার স্তম্ভগুলি সবই সাদা মার্বেল পাথরের। বারান্দার শ্বেত পাথরের গোল গোল স্তম্ভগুলি পার হয়ে কোনার সরস্বতী প্রতিমাটিকে বাঁ দিকে ফেলে ঘুরান সিঁড়িটি দোতলায় উঠে গেছে। এই দোতলাতে রয়েছে অন্দরমহলের বৈঠক ঘর। ছাদে ঝুলানো বিদেশ থেকে নিয়ে আসা হাজার আলোর ঝাড় বাতি।
কাচঘরে ঢুকেই বাঁ দিকের সুদৃশ্য বিরাট বেলজিয়াম আয়নার নিচে বসানো ছিল একটি কাঠের টেবিল। কোনো এক অতীতে এই টেবিলটি উইলসন থমাসের রাজকীয় ম্যানর হোমের ড্রইং রুমে সেন্টার টেবিল হয়ে বাস করছিল। কাচঘরে বসতো সব বড় বড় আসর। কখনো মীরার ভজন, কখনো নিধু বাবুর টপ্পা, লখনৌ থেকে আসতো সেরা নৃত্য কুশলীরা। গানে, গীতে, সংগীতে মুখর হত এই কাচঘর। এই টেবিলটি সাক্ষী হয়ে আছে বহু শত বছরের জৌলুস আর ভাঙা গড়ার ইতিহাসের সাথে। মনে হতে পারে এ শুধু বোবা কাঠের এক খন্ড এ টেবিল, কিন্তু বয়ে চলেছে আবহমান কালের ইতিহাস।
মাধব বল্লবের ছেলে উদয় বল্লবের বয়স তখন ১৯/২০ বছর। মনে পড়ে যেদিন মাধব বল্লব গৌরী বাঈয়ের ওখানে ছেলেকে দেখেছিল, রাগে তার কান্ডজ্ঞান ছিল না। কিন্তু ছেলেকে শুধু ওখান থেকে চলে যেতে বলা ছাড়া আর কিছু বলতে পারেনি। ফিরে এসে কাচঘরে গুম হয়ে বসেছিল মাধব বল্লব। মতি মিঞা দৌড়ে এসেছিল
- কি লাগবে কর্তা বাবু?
- যা, হুইস্কির বোতল নিয়ে আয়।
নির্জলা দুই পেগ গলায় ঢেলে গ্লাসটি কাঠের টেবিলের উপর ছুঁড়ে মেরেছিল। মতি মিঞাকে সামনে দেখে আরো রেগে বিরক্ত হয়েছিল
- হাঁ করে কি দেখছিস… বের হ আমার সামনে থেকে।
মতি মিঞা মাথা নিচু করে সামনে থেকে সরে গিয়েছিল। বুঝতে পারছিল কর্তা বাবুর মন আজ খুব খারাপ।
ফরসা গায়ে মনে হয় রক্ত জমে লাল দেখাচ্ছিল। দুচোখ রক্তিমাভ হয়ে উঠেছিল। জানে না কেন মাধব বল্লব দুহাতে মুখ ঢেকে কাঠের টেবিলের উপড় আছড়ে পরে বিড়বিড় করে বলেছিল ‘কী অন্যায় কী পাপ’। কেমন যেন একটি ঘৃণা, একটি অসহায় আক্রোশ মাথায় রক্ত চড়িয়ে দিয়েছিল। থামাতে হবে উদয় বল্লবকে। সেদিন কাঠের টেবিলটি প্রত্যক্ষদর্শী হয়েছিল মানুষের পাপ আর নগ্ন সত্যের।
কোঠা বাড়ির জৌলুস, ঘুঙ্গু্রের আওয়াজ, রঙ্গিন মদিরার মাদকতা, সন্ধ্যার আসরের আসক্তির সাথে জমিদার বাড়ির সম্পর্ক অনাদিকালের। বল্লবপুরের জমিদাররাও এই গন্ডি থেকে বাইরে যেতে পারেনি। যৌবনের উত্তেজনায় নাচ আর গানের আসর, মুজরার নামে সদ্য পরিস্ফুট রমণী ভোগের আয়োজন, কাচঘরে বাঈজী বা নামকরা নর্তকী ডেকে আসর করা বংশ পরম্পরায় চলে আসছে। নিত্য নতুন নারী সঙ্গ মাধব বল্লবের জীবন যাত্রার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কোঠা বাড়িতে আসা যাওয়া আনাগোনা থাকলেও সেখানে ছেলেকে দেখার পর মাধব বল্লব গৌরী বাঈকে এড়িয়ে চলেছে। উদয় বল্লবও তাই।
গৌরী বাঈ অনেক খুঁজেছিল উদয় বল্লবকে। চেষ্টা করেছিল লোক পাঠিয়ে খবর নিতে কিন্তু প্রতিবারই কোন না কোন ভাবে ব্যর্থ হয়েছিল সে প্রচেষ্টা। ইতোমধ্যে উদয় বল্লব দায়িত্ব নিয়েছে তাদের জমিদারি এস্টেট দেখা শুনার। বিয়ে করে ডানা কাটা এক পরী ঘরে এনেছে। তবু বাপ দাদার ঐতিহ্য বজায় রেখে কোঠা বাড়িতে নিত্য যাওয়া আসা চলেছে। এ শহরে গৌরী বাঈয়ের কোঠা বাড়ি ছাড়াও আরও অনেক কোঠা বাড়িই আছে। গৌরী বাঈয়ের কাছে আর কখনও যায়নি।
লখনৌর পিয়ারী বাঈ যেদিন এ ঘরে নেচেছিল, নির্বাক টেবিলের কিন্তু সেদিনটির কথা বেশ ভাল মনে আছে। এই টেবিলের উপর রাখা বিদেশী মদের বোতল, ক্রিস্টাল গ্লাসের পানীয় পাত্র, বর্ণ বৈচিত্র্যময় ফুলের সম্ভার, অপূর্ব অর্কিড। রেকাবীতে রাখা ছিল ভাজা মাংসের কাবাব, খোরমা, খোবানী, হাল্কা ভাজা কাজু, রুপার থালায় আখরোট, দ্রাক্ষার সুস্বাদু টসটসে দানা। তার একপাশে ছিল পেস্তা বাদাম দিয়ে তৈরী দুধের শরবত বরফ কুঁচি দিয়ে সুশীতল করা। নাচ ঘরের ঠিক মাঝখানে বিশাল গোল পার্সিয়ান কার্পেট। পুরো কার্পেট জুড়ে ছোট বড় গোলাপের সমারোহ। মহফিলের জন্য ফরাস পেতে তাতে বড় বড় তাকিয়া আর পাশ বালিশ রাখা হয়েছে।
রোজ দু’বেলা কাচঘরটিকে ঝাড়পোচ করত মতি মিঞা। আর বিশেষ দিনগুলোতে তো কথাই নাই। একদম ঝকঝকে চকচকে করে রাখতে হত। এতটুকুন হেরফেরও কর্তা বাবুর নজর এড়ায় না। সন্ধ্যা হবার আগেই ধুপধুনা জ্বেলে ঘরের সব দরজা জানলা খুলে দেয় মতি মিঞা। আর সন্ধ্যার সাথে সাথে ঘর বন্ধ। কোনো রকমেই ঘরে পোকা মাকড় আর মশা ঢুকবার কোন পথ পায় না।
গোলাপ জল আর গোলাপের সুগন্ধি আতর দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করা এ বাড়ীর রেয়াজ। গড়গড়াগুলো সব তামাক ভরে প্রস্তুত করে রাখে, সুদৃশ্য কারুকাজ করা আলবালাগুলো ঝকঝক করে উঠে মতি মিঞা’র যত্নে। বাবুরা বসার সাথে সাথেই জ্বলন্ত তামাকে টান দিতে পারে। অম্বুরী তামাকের মিষ্টি সুগন্ধ কাচঘরকে জড়িয়ে ধরে। ঝাড়বাতি গুলো চমকে উঠা আলোর ঝলকে জ্বলে উঠে। তবলা, হারমোনিয়ম, মন্দিরা, খাম্বাস, সারেঙ্গী, মৃদঙ্গ, ঘুঙ্গুরের শব্দে কাচঘরটি যেন কিশোরীর লঘু পায়ের মৃদু চারণা।
মতি মিঞা চোখ কান সব খুলে কাচঘরকে মনের মতন করে সাজিয়ে তুলে। এখানেই ঘুঙ্গুরের আওয়াজের মাঝে তলিয়ে যায় পিয়ারী বাঈয়ের গভীর বেদনা, গাঢ় কাজলের নিচে ঢাকা পড়ে যায় রাত জাগার ইতিহাস, গোলাপী দু ঠোঁটের মাঝখানে কেঁপে উঠে না বলা অভিমান যা মিলিয়ে যায় হাজার বাতির আলোক ছটায়। পিয়ারী বাঈ ষোলো বছর বয়সের অনাঘ্রাতা এক কিশোরী। পিতৃ পরিচয় সে জানে না। কোঠা বাড়িতেই জন্ম হয়েছে তার। পিয়ারীর মা যিনি নিজেও একজন শীর্ষস্হানীয়া নর্তকী এবং কোঠা বাড়ির মজলিসে মজলিসে তারও নাচের মাদকাতায় উজাড় হয় সারা রাত্রি। বড় করেছে, নিজে তালিম দিয়ে তৈরি করেছে পিয়ারীকে। মুজরায় নেশার ঘোর লাগিয়ে দেবার কৌশল ছোট থাকতেই শিখেছে পিয়ারী। নাচ গান বড় যত্ন করে শিখিয়েছে তার মা। আজ তাকে মুজরা দিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে কাচঘরে। পিয়ারী আড় চোখে সবার দিকে একবার দেখে নেয়। ফরাস জুড়ে দামি দামি পোশাকে বসে আছে আমন্ত্রিত সব। এদের অনেককেই সে কোঠা বাড়িতে দেখে থাকবে। ঝাড়বাতি জ্বলছে। পাঙ্খাওয়ালা টানাপাখা টেনে যাচ্ছে একটানা। কাচঘরের দক্ষিণ দিকে তাকিয়ায় হেলান দিয়ে মধ্যমণি হয়ে বসে রয়েছে মাধব বল্লব। দেখে যেন মনে হয় খুব পরিচিত। কোথায় যেন আগে দেখেছে, সত্যি কি দেখেছে? জানে না।
আজ মহফিলে আসর মাতাতে অতিথিদের মাঝে সব রাজা, মহারাজারা এখানে উপস্থিত হয়েছেন। হৈচৈ করতে করতে ঘরে ঢুকে পড়ে জমিদার কৃষ্ণ কানাই। সিল্কের ধুতি, গলায় সোনার চেন, পান খাওয়া ঠোঁটে লাল দাগ। টসটসে গা’য়ের রং। কামাতুর চোখ নিয়ে তাকিয়ে রইল সদ্য বিকশিত যৌবনা পিয়ারীর দিকে। মসলিনের ওড়না ভেদ করা উদ্ধত নব যৌবন। সোনালি, রুপালি জরির কাজ করা ঘের দেয়া ঘাঘরা, তার নিচে নীল সাটিনের ঢিলে পায়জামা পা পর্যন্ত ঢাকা। নুপুরের তালে তালে ঝুমঝুম পদচারণ মাথার ভিতর একটি মোহনীয় আমেজ সৃষ্টি করছিল। অপূর্ব পিয়ারীর রূপ। যেন মনে হয় কোন শিল্পী তৈরি করেছে এ নিপুণ দেহ। আর তারপর রঙয়ের তুলি বুলিয়ে দিয়েছে সর্বাঙ্গে। দেহ স্বর্ণালঙ্কারে মোড়া। ঠোঁটে উজ্জ্বল হাসি। অপলকে তাকিয়ে দেখবার মতন সৌন্দর্য। বেলজিয়াম গ্লাসের বিরাট আয়নাতে প্রতিবিম্ব প্রতিফলিত হয়ে যেন পিয়ারীর রূপের ঐশ্বর্য বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল।
-এসো এসো ভায়া তোমারই অপেক্ষাতেই আছি …
মাধব বল্লব জমিদার কৃষ্ণ কানাইকে স্বাগতম জানায়। মাধব বল্লবের বয়স প্রায় ৬৫ ছুঁই ছুঁই। তবু যৌবনের কোন ভাটা পড়েনি এতটুকুনও। সুঠাম দেহ। সকাল বিকেল হাঁটা হাঁটি করে। নিজের বিরাট বাড়ির গাছপালা তদারকি করে। সব কিছুর হিসাব ঠিক ঠাক খবর রাখে। ঘন্টার পর ঘন্টা মাছ ধরতে ক্লান্ত বোধ করে না। আর মাত্রারিক্ত মদ খেয়েও মাথা সোজা রাখতে পারে। কাঠের টেবিল তার অনেক সাক্ষী। গেলাসের পর গেলাস খালি করেছে তারই সামনে।
নাচের আসর ভাল জমে উঠেছিল। সন্ধ্যায় যদিও আকাশের মেঘের ঘন ঘটা ছিল তবুও কাচঘরের বন্ধ দরজার ভিতরে নুপুরের আওয়াজে ঢাকা পড়েছিল ঘনঘটার কোন আর্তনাদ। রঙিন পানীয় ক্রিস্টাল গ্লাসে সুবর্ণ মদিরা ঝলকে উঠেছিল। মদিরার রসে টইটুম্বুর রসিক জনের বিলাসী মন। নাচের তালে তালে বেজে উঠে পরাণের নিভৃত কামনার উন্মত্ততা। নেশার শেষ মুহূর্তে তলিয়ে যাবার আগে জেগে উঠে বাসনার তীব্রতা। অম্বুরী তামাকে টান দেবার আগে ঢুলুঢুলু চোখে আর একবার পিয়ারী বাঈয়ের যৌবন রস আকন্ঠ পান করতে চায়। ভুলে যায় সংসার জীবন, ভুলে যায় বিচার, বুদ্ধি, বিবেচনা। সব কিছু ছাপিয়ে জেগে থাকে শাশ্বত, আদি, আদিম প্রবৃত্তি।
আজ উদয় বল্লবের চোখে কেন জানি ঘুম ছিল না। রাতের অন্ধকারে নির্ঘুম শরীর যন্ত্রনা দিচ্ছিল। থেকে থেকে মনের ভিতর থেকে নিজের অজান্তে দীর্ঘনিশ্বাস বের হয়ে আসছিল। দেনা পাওনার হিসাব বড়ই কঠিন। কিছুতেই মিলতে চায় না। আজ অন্দরমহলে রাত কাটাতে এসেছে উদয় বল্লব। এমন সুন্দর সময় রাণীমার সচারচর আসে না। সন্ধ্যা হতেই রাণীমার মহলে একটি সাজ সাজ রব উঠেছিল। সন্ধ্যার আগেই অন্দর মহলের দুয়ারে উদয় বল্লবের টাঙ্গা এসে থেমেছিল। রাণী আজ নিজ হাতে পান সেজে রেখেছে। বিয়ের ৬ বছর হতে চলেছে। কোন সন্তান আগমনের এখনো কোন সম্ভাবনা দেখা যায়নি। এদিকে বাবার কথা শুনেও দ্বিতীয় বিয়েতে রাজি হচ্ছে না উদয় বল্লব। প্রথম জীবনের কিছু ঘটনা তাড়া করে ফেরে। বোধ হয় কখনো অকারণে অনুশোচনা হয়। কিন্তু মনে মনে স্বীকার করে না নিজের কোন কাজের কৈফিয়ত তাকে দিতে হবে। রাত গভীর থেকে গভীরতর হয়। নিভে য়ায় ঘরের আলো। বাগানের আলো গুলি টিমটিম করে জ্বলছে। সব ঘরের আলো বেশির ভাগ নিভে গেছে। এত রাতে কেই বা জেগে থাকে।
আস্তে আস্তে নীরব হয়ে আসে চারিপাশ। আশ্রিত মহলে দিনের কর্ম শেষে পরিশ্রান্ত সকলে। রান্না ঘরে রাধুনী ঠাকুর আগামী কালের সব রান্নার আয়োজন সরঞ্জাম প্রস্তুত সম্পন্ন করে রাতের জন্য কাজ শেষ করেছে। আজ লালমোহন বাগান থেকে তুলে এনেছে সুগন্ধি শরবতি লেবু। রাধুনি ঠাকুর জানে আজ রাতভর অতিরিক্ত নেশার ফলে আগামী কাল সকালে মাধব বল্লবের মাথা ঠিক রাখার জন্য তখন এক গ্লাস লেবুর শরবত খুবই জরুরি। আজ এত বছর ধরে কাজ করতে করতে অনেক কিছু জানে আর বুঝতে পারে। এ বাগানের শরবতি লেবু অসম্ভব স্বাদের। কোন পূর্বপুরুষ এ গাছ লাগিয়ে ছিল কে বলতে পারে। কিন্তু যে যখন কাজ করেছে তারা সবাই জানে পরদিন সকালে এ শরবত কতটা প্রয়োজনীয়। অনেক সময় রাণীমার খাস দাসী এসে এ শরবত তৈরি করে। রাধুনি ঠাকুর কাজ শেষ করে বাতি নিভিয়ে রান্না ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল।
মতি মিঞা তখনও কাচঘরের বাইরের দরজার সামনে দণ্ডায়মান। প্রখর দৃষ্টি তার চারিদিকে। ঘুঙ্গুরের আওয়াজ আর সুললিত কন্ঠের সুর পুরো কাচঘরটিকে মুখরিত করে তুলছে। বেসামাল কিছু অতিথি মাত্রাতিরিক্ত পানের ফলে ঘুমে ঢলে পড়ছে। মতি মিঞা একে একে তাদেরকে যার যার টাঙ্গাতে নিয়ে যাবার জন্য টাঙ্গাওয়ালাকে ডেকে নিয়ে আসছে। মতি মিঞার দু চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছিল। তারপরেও তার কর্তব্যে এতটুকুনও ফাঁকি ছিল না। রাত গভীর থেকে গভীরতম হয়। সুরার পাত্র নিঃশেষ করে ঘরে ফিরে যায় সকল অতিথি। কাচঘরের উত্তর পাশের বিশাল সুসজ্জিত ঘরটিই মাধব বল্লবের রাত্রি যাপনের ঘর। এ ঘরে একমাত্র মতি মিঞা আসা যাওয়া করে। অন্য কারো প্রবেশাধিকার নেই।
মাধব বল্লব তাকিয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। নিজেকে একটু প্রস্তুত করতে কিছুটা সময় নিয়ে নিল।
কাচঘরে তখনও সব তাকিয়া বিছান, পাশ বালিশগুলি মুখ থুবড়ে উপুর হয়ে আছে। পানপাত্র তখনও ইতস্তত ছড়ান, খাবারের রেকাবগুলি খালি পরে রয়েছে। তামাকের গড়গড়াগুলো মাটিতে তখনও লুটাচ্ছিল। ছেঁড়া মালার ফুলগুলি মলিন চোখে চেয়ে আছে। বাসি ফুলের গন্ধটি কেমন যেন একটি মন খারাপের গল্প বলতে চায়। পিয়ারী বাঈয়ের পুরো দলটি নিজেদের সব বাদ্যযন্ত্র, নিজেদের সব জিনিসপত্র আস্তে আস্তে গুটিয়ে গুছিয়ে নিল। একবার ভাল করে চোখ বুলিয়ে নিল ঘরটির ভিতর। পিয়ারীকে রেখে সবাই উঠে গেল। ওরা ফিরে গেল ওদের গন্তব্যে। মতি মিঞা সযত্নে পিয়ারী বাঈকে কাচঘরের পাশে শোবার ঘরে পৌঁছে দিল। তারপর মাথা নিচু করে কাচঘরের নোংরা আবর্জনা পরিষ্কারের কাজে মন দিল। মাধব বল্লব শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করবার পর মতি মিঞা আস্তে আস্তে সব আলো নিবিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল।
নিশুতি রাত। কাঠের টেবিলের উপর তখন ইতস্তত পরে রয়েছে খালি মদের বোতল, ক্রিস্টাল গ্লাস, দু চারটে আখরোটের ভাঙ্গা টুকরো। গভীর হয়ে আসছে রাতের অন্ধকার। শুধু তীব্র লোভ লালসা জাগ্রত থাকে অন্ধকার কালো রাত্রির গভীরে। রাতের অন্ধকারেই হিংস্র শ্বাপদ শিকারের মাংস খুলে নেয়। প্রথম যৌবন পাওয়া পিয়ারী আজ নিজেকে সঁপেছে নিয়তির হাতে। এমনটিই হয়ে থাকে পিয়ারী বাঈদের জীবনে। আজকের পর থেকে তার জীবনের আর এক নতুন ধারার শুরু। এর শেষ বা এর পরিণতি কী হবে তা কে বলতে পারে।
রাত তখন গভীরতম। একটি কালো ঘোড়ার গাড়ি এসে থামল রাজবাড়ির লৌহ ফটকে বাইরে। ঘোড়ার খুরের শব্দ গাড়ি থামা মাত্র মিলিয়ে গেল। বাতাসে মৃদু পাতার শব্দ। সহিস নেমে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলল
-মাঈজী আমরা রাজবাড়িতে এসেছি।
গাড়ীর ভিতর বসে ছিল কালো কাপড়ে ঢাকা এক অনিন্দ্য সুন্দরী রমণী। সে তার কোমল গৌর সুন্দর হাত দুখানি উঁচু করে জানতে চাইল
-কেউ কি আছে এখানে?
সহিস আশেপাশে একটু ভাল করে দেখে জানাল
-না, কাওকে দেখছি নাতো।
-একটু ভাল করে দেখ আর না হলে জোরে জোরে কড়া নাড়ো।
রমণীর গলাতে একটি অসহিষ্ণু তাড়া ছিল। আসবার পথেও সহিসকে বার বার বলেছে জলদি চল, জলদি চল। বড় অস্থির ছিল সে কন্ঠস্বর। কিসের এত তাড়া সহিস জানে না তবু সে যতটা তাড়াতাড়ি পেড়েছে ঘোড়া ছুটিয়ে এসেছে। পথও এত কাছের নয়। শুধু এখন মাঝ রাত বলে রাস্তা ঘাট সব ফাঁকা ছিল। তাই অর্ধেক সময়ের ভিতর চলে আসতে পেরেছে।
-কেউ কি আছেন…?
সহিস হাঁক দিল একবার, দুইবার, তিনবার। মনে হল কেউ যেন ফটকের দিকে এগিয়ে আসছে। ফটকের পাহারাদার সারোয়ার বেশ অবাক হচ্ছে এত রাতে ঘোড়ার গাড়ীটিকে দেখে। যদি আজ সন্ধ্যার কাঁচ ঘরের অতিথিদের কেউ হয়ে থাকে তবে এদিকে আসবার কথা নয়। সে ফটক সম্পূর্ণ আলাদা। বাহির বাড়ির বড় মহল। সে চাবি সারোয়ারের কাছে থাকে না। রামদিনি সে গেট সামলায়।
-কি চাই আপনাদের?
-ওকে গেট খুলে একটু কাছে আসতে বল।
যদিও অনেক চাপা স্বরে বললেন রমণী তবু শুনতে পেয়েছে। গলার স্বরে দৃঢ়তা ছিল। সারোয়ার আস্তে গেটটি খুলে ঘোড়ার গাড়ীর জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়। আরো নিচু স্বরে রমণী তাকে একটুকরো কাগজ দিয়ে বলল
-তুমি এ কাগজ নিয়ে এখুনি উদয় বল্লবকে দাও আর বল খুবই জরুরি। আমি এখানে অপেক্ষা করছি। তুমি এখনি এখানে আসতে বলবে।
কথা গুলি বলার সময় রমণী দু গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরছিল। সারোয়ার এত বছর রাজবাড়িতে কাজ করছে কিছুটা হলেও আন্দাজ করে পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পারে।
-ঠিক আছে আপনি এখানে অপেক্ষা করুন আমি দেখছি…
সারোয়ার দৌড়াতে দৌড়াতে উদয় বল্লবের খাস চাকর দিনুর খোঁজে যায়। মাঝ রাতে তাকে ঘুম থেকে তুলে পুরা বিষয়টি খুলে বলে।
-এই রে মুস্কিলতো হল একটি।
-মুস্কিল? কী মুস্কিল??
-আজ ছোট বাবুতো অন্দর মহলে রাণীমার মহলে।
-হুঁ মুস্কিল বটে তবু তুমি যাও একটু বুঝিয়ে বল খুবই জরুরী ব্যপার মনে হয় বেশ শক্ত আর কঠিন।
-ঠিক আছে যাই… কপালে আজ কী আছে কে জানে।
দিনু নিজেকে গুছিয়ে কী বলবে চিন্তা করতে করতে রাণীমার মহলের দিকে রওনা দিল। বকুল রাণীমার সর্বক্ষণের কর্মচারী। ঘরের সামনেই শুয়ে ছিল, যদি কিছু লাগে, যদি কিছু এনে দিতে হয়। বকুলকে আস্তে আস্তে ডেকে তোলে দিনু। সে দিনুকে দেখে খুবই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
-কী হয়েছে, কোন খারাপ খবর?
-না, তোকে একটি কাজ করতে হবে
-কাজ? কী কাজ?
-এই কাগজটি ছোট কর্তার হাতে দিতে হবে, খুবই দরকারী।
-সে কী ভাবে সম্ভব?
-জানি না, তুই চেষ্টা কর।
বকুল আস্তে আস্তে দরজায় টোকা দিল। যেন মনে হয় উদয় বল্লব জেগেই ছিলেন। দরজা খুলে বকুল আর দিনুকে দেখে জানতে চাইলেন কী ব্যাপার। দিনু আস্তে করে কাগজের টুকরো এগিয়ে দেয়। আলো এনে কাগজটি পড়তেই মুখের সব রক্ত যেন জল হয়ে যায়।
-কোথায়? কে তোকে এ কাগজ দিয়েছে?
-তিনি ঘোড়ার গাড়িতে ফটকের বাইরে অপেক্ষা করে আছেন।
উদয় বল্লব ছুটতে ছুটতে ঘর থেকে বের হয়ে ফটকের দিকে ধাবিত হয়। রাণীমা ঘুম ভেঙ্গে ঠিক বুঝতে পারল না কি হচ্ছে। বকুলকে ডেকে সব শুনে যতটুকু বুঝতে পারল তাতে কিছুই বুঝতে না পেরে স্থানুর মত খাটে বসে রইল।
সময় মাঝে মাঝে নদীর স্রোতের মতন নিমিষে বয়ে যায় আর মাঝে মাঝে সময় কঠিন পাথর চাপা হয়ে পড়ে থাকে। সময় যেন অনন্ত কাল এখানেই দাঁড়িয়ে থাকে, নড়ে না। উদয় বল্লবের কাছে আজ কোনটি বুঝতে পারছে না। কোন দিক না তাকিয়ে উর্দ্ধশ্বাসে রাজবাড়ির প্রধান ফটকের দিকে ছুটছ… সেখানে অপেক্ষা করছে যে রমণী কে সে? এত রাতে সে কেন এসেছে? কী সে তাকে বলতে চায়?
ঘোড়ার গাড়ীটির সামনে এসে থমকে দাঁড়ায় উদয় বল্লব। গাড়ীর দরজা খুলে ধীরে ধীরে নেমে আসে সুন্দরী রমণী।
-কে তুমি?
একটু খানি সময় লাগে রমনীকে চিনে বুঝে উঠতে।
-গৌরী বাঈ…?
-হ্যাঁ আমি।
-কী বলছ?
-হ্যাঁ আমি গৌরী, তোমাকে কিছু বলার আছে।
কি বলতে চায় গৌরীবাঈ?
-বল …
-বলছি … কিন্তু আর দেরী করো না, সব তোমাকে বলছি। আমি রামনগর গিয়েছিলাম বায়না নিয়ে। ফিরে এসে জানতে পারি বড় দিদি অনেক টাকার লোভ সামলাতে না পেরে মুজরার শর্তে রাজি হয়ে গেছে। সব তোমাকে বলবো আজ। আজ মাধব বল্লব মুজরা দিয়ে পিয়ারীকে রাজবাড়িতে নিয়ে এসেছে। সে থাকবে আজ এই রাজবাড়ীতে।
উদয় বল্লব ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। মাধব বল্লব এমন মুজরা দিয়ে বহু বাঈজী নিয়ে এসে কাচঘরে নাচের আসর বসিয়েছে। আজ কী এমন হল যে গৌরী বাঈ উদয় বল্লবের কাছে আর্তি নিয়ে ছুটে এসেছে।
-ঠিক আছে চল।
উদয় বল্লব গৌরীকে উঠিয়ে নিজে ঘোড়ার গাড়ীতে উঠে বসে। ৬০০/৭০০ মিটার হবে রাজবাড়ির প্রধান ফটক থেকে বাহির বাড়ির বড় মহল। মনে হচ্ছিল অনন্তগামী এ যাত্রা। এ পথ ফুরায় না। কী আছে পথের শেষে? ফটকে পৌঁছা মাত্র লাফ দিয়ে নামে উদয় বল্লব।
-রামদিনি, রামদিনি!
চিৎকার করে হাঁক দেয়। রামদিনি ফটকে চাবি দিয়ে দিয়েছে। ততক্ষণ প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে রামদিনি। কিন্তু সজোরে ডাকটি ঠিকই তার কানে এসে লেগেছে। মুহুর্তে উঠে পড়ে রামদিনি দৌড়ে ফটকের কাছে আসে।
-আজ্ঞে ছোট বাবু!!
গেট খুলতে খুলতে সন্তর্পণে তাকায় গৌরী বাঈয়ের দিকে। খুবই বিস্ময় জাগে। এরা কেন এখানে?
মতি মিঞা কাচঘরের দরজা বন্ধ করে চলে গেছে। সব আলো নিভে গেছে। উদয় বল্লব দেউরী পেরিয়ে, উঠান পেরিয়ে চওড়া বারান্দা পেরিয়ে ছোট বড় ঘর গুলি দু পাশে রেখে সব পাথরের ভাস্কর্যগুলি পিছে ফেলে সামনে ডানদিকের সিঁড়ি পেরিয়ে কাচঘরের বন্ধ দরজার পাশ দিয়ে গিয়ে মাধব বল্লবের শোবার ঘরের দরজার সামনে এসে থমকে দাঁড়ায়।
মতি মিঞাকে রামদিনি তার ঘর থেকে উঠিয়ে এনেছে। উদয় বল্লব দরজায় ধ্বাক্কা দিতে গিয়েও দিতে পারে না। মতি মিঞা সামনে এসে দাঁড়ায়।
-সরুন ছোট বাবু। আমি দেখছি।
মতি মিঞা খুব সাবধানে আস্তে আস্তে দরজায় টোকা দিল কয়েকবার। গৌরী বাঈ অসহিষ্ণু গলায় বলে উঠে
-জোরে, আরো জোরে ধাক্কা দাও।
আজ রাতে মাধব বল্লব অনাঘ্রাতা ষোলো বছরের পিয়ারীর যৌবন পরিপূর্ণ ভাবে উপভোগ করে তৃপ্ত, শ্রান্ত, সুখী ও পরিতৃপ্ত। লুন্ঠিত লতার মতন পিয়ারী পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছিল খাটের একপাশে। ঘুম ছিল না চোখে। সে ভোরের অপেক্ষায় ছিল। দরজার বাইরে শব্দ, দরজা ধাক্কার আওয়াজ সে শুনতে পেরেছে। মাধব বল্লবকে গভীর ঘুম থেকে ডেকে তোলে পিয়ারী
দরজা খুলে গৌরী বাঈকে দেখে যতটা না অবাক হয়েছে মাধব বল্লব তার চেয়ে অনেক বেশি অবাক হয়েছে ছেলে উদয়কে দেখে। ।
-তোমরা কী চাও? কেন এসেছ?
মতি মিঞা কাঁচ ঘরের দরজা খুলে দিল। সবাই এসে দাঁড়াল কাচঘরের মাঝখানে।
-আজ আমাকে সব বলতে হবে…
গৌরীর দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পরছে। তীব্র যন্ত্রণায় বঙ্কিম দুই ভুরুর মাঝখানে থেকে উত্তপ্ত বালুরাশির উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে সম্পুর্ণ মুখমন্ডলে। দুঃসহ ব্যথায় আকন্ঠ বিষে নীল হয়েছে ওষ্ঠদ্বয়। বেদনার দমকে কেঁপে কেঁপে উঠছে দেহ পল্লব। সময় যেন স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোন সুদুর সিন্ধুগামী পাখি শূন্যে মিলিয়ে যাবার আগে যেমন সবটুকু শক্তি সঞ্চয় করে ডানাকে নির্ভরশীল করতে চায় তেমনি গৌরী তার নিঃশেষিত শক্তিকে জড়ো করে দুমড়ে মুচড়ে পড়া কম্পিত পায়ে এগিয়ে যায় ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা পিয়ারীর দিকে অসহায় ভঙ্গিতে। পিয়ারী বড় বিস্ময়ে গৌরী বাঈয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে হতবাক হয়ে যায়। এ কোন মানুষ ওর সামনে? যার নুপুরের ঝংকারে মুখরিত হয়ে উঠে সহস্র মহফিল, যে হৃদয়হরণী অজস্র হৃদয়কে বিচলিত করে নাচের অপূর্ব ভঙ্গিমায়, যার অঙ্গুলি হেলনে হাজার ঝাড় বাতি মুহুর্তে জ্বলে উঠে, রক্তিম ঠোঁটের উষ্ণতা পাবার জন্য ব্যাকুল হয় রামনগরের বিপুল সম্ভ্রান্ত সজ্জন বর্গ। আজ এ কাকে দেখছে? কম্পিত হাত, নীল ওষ্ঠ, বিবর্ণ ধ্বসে-পড়া একজন নিষ্প্রভ মানবী। গৌরী বাঈকে কোন দিন এমন দেখবে তা কখনো কল্পনাও করতে পারেনি পিয়ারী। আস্তে আস্তে দুহাত পিয়ারীর মাথায় রাখে গৌরী। অস্পষ্ট মৃদু কন্ঠে গৌরী কি বলছে ঘরের মধ্যে থাকা মানুষগুলি কেউই শুনতে বা বুঝে উঠতে পারছিল না। রাতের গভীর অন্ধকারে বয়ে যাওয়া বাতাসে সে কথাগুলি উড়ে চলে গেল।
-কী? কী বলছ গৌরী আবার বল…
কিছুটা শংকিত কিছুটা অসহিষ্ণুতায় বলল মাধব বল্লব। গৌরীবাঈ এবার একটু থেমে একটু দম নিয়ে সরাসরি তাকাল উদয় বল্লবের দিকে ।
-উদয় … এ তোমার মেয়ে পিয়ারী।
কানের ভেতরে তপ্ত আগুনের হলকা এসে পুড়িয়ে দিল। সমস্ত শরীর, মন, আভিজাত্য, শত বৎসরের সাতমহলার রাজবাড়ি। ভেঙ্গে চুড়ে চুরমার হয়ে পড়ল হস্তিনাপুরের রাজ্য আর সম্রাজ্য ! জতুগৃহ আগুনে পুড়তে শুরু হল।
-কী বলছ কী?
-হ্যাঁ আজ থেকে সতেরো/আঠেরো বছর আগে যখন তুমি উদয় বাবু আমার ঘরে আসতে সেই তখন আমি পিয়ারীকে নিয়ে অন্তঃসত্ত্বা হই। বড় দিদি জানতে চেয়েছিল অনেক করে কে করেছে আমার এ অবস্থা কিন্তু আমি কোন দিন এ সত্য প্রকাশ করিনি। আজও করতাম না যদি মাধব বাবু পিয়ারীকে মুজরা না করত।
স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক দিকে মাধব বল্লব অন্যদিকে উদয় বল্লব। পিয়ারী আকষ্মিক ঘটনায় মূহ্যমান। মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে
-আমাকে কেন বাঁচতে দিলে? আমাকে কেন কেন খুন করনি… কেন ?
গৌরী নিজের অসহায় অবস্থার জন্য নিজের ভাগ্যকে দোষ দেয়া ছাড়া আর কাওকে দোষ দেয় না। তার দু’চোখ বেয়ে অবিরত অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল । এই মুহুর্তে গৌরী বাঈ পারলে নিজেই নিজেকে খুন করত। বজ্রাহত মাধব বল্লব নিজেকে ধুলায় মিশিয়ে দিতে পারলে শান্তি পেত। নিজের উপর ঘৃণা আর গ্লানি নিয়ে নিজে ধুলায় মিশে রইল। উদয় বল্লব নিজের অজান্তে হাহাকার করে উঠে
-এ কেমন বিধান বিধাতার? একী হল? কী করব আমি?
কী ভীষণ এক পরিস্থিতি আর পরীক্ষার সন্ধিক্ষণে আজ এ চারজন। অক্ষম, ক্ষমতাহীন পুরুষ নিজের দম্ভের কাছে আজ পরাজিত। বিপুল প্রাচুর্য অপরিসীম প্রতিপত্তি এর অস্তিত্ব আজ কোন তীরে গিয়ে ভিড়ল? নিয়তির নিষ্ঠুর অনুলেখন। মাধব বল্লব আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। দ্রুত নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। গৌরী বাঈ পিয়ারীকে নিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে উঠে বসে। নিসঙ্গ, একাকী, অধিকারহীন উদয় বল্লব সীমাহীন নির্জনতায় অনন্ত কাল ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।
রাতের অন্ধকার মুছে গিয়ে নতুন সূর্য উঠে। যেখানে যত কালিমা, অন্ধকারাচ্ছন্ন ক্লেদ, অশ্লাঘনীয় জীবনের গ্লানি হয়তো ঢাকা পড়ে যাবে নব রবিকিরণে। কিন্তু সত্যি কি তা কখনও হয়? হতে পারে? মতি মিঞা ভোর হতেই উঠে পরে। যদিও গত রাতে যখন ঘুমাতে গিয়েছিল তখন ভোর হতে বেশি দেরি ছিল না। ভোরে উঠতে হয়। কর্তা বাবুর ঘুম থেকে উঠবার আগেই সব কিছু গুছিয়ে প্রস্তুত করে রাখতে হয়। স্নানের গরম জল, বদলান পোশাক, সকালের নাস্তার আয়োজন, রান্না ঘর থেকে সুগন্ধি লেবুর শরবত এমনই সব ছোট ছোট জিনিসগুলি গুছিয়ে ঠিক করে রাখা মতি মিঞার নিত্যদিনের কাজ। আজও তেমনি সব কিছু তৈরি করে মাধব বল্লবের শোবার ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় মতি মিঞা।
বেশ বেলা হয়ে গেছে। এতক্ষনে মাধব বল্লব সব সময় বিছানা ছেড়ে উঠে পরে। আজ দেরী দেখে মতি মিঞা আস্তে দরজায় টোকা দেয়। কোন সাড়া না পেয়ে দরজাটি একটু ফাঁক করে। খুব আশ্চর্য হয় খালি বিছানা দেখে।
-বাবু…
খুব নিচু গলায় ডাক দেয় কিন্তু কোন সাড়া না পেয়ে দরজাটি আর একটু খুলে ভেতরে ঢুকে মতি মিঞা।
হতভম্ব মতি মিঞা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না কী দেখছে। সমস্ত ঘর জুড়ে শুধু নিস্তব্ধতা। রাতের মোমবাতি কখন জ্বলে জ্বলে নিঃষেশিত হয়েছে। পূর্ব দিকের খোলা জানালার ভিতর দিয়ে আলো এসে পড়েছে ঘরের ভিতর। সকাল বেলার আলোয় বেজে উঠেছে বিদায় বেলার ভৈরবী। ঘরে কাঠের ছাদ। আর সেই একটি কড়ি কাঠের সাথে শক্ত করে বেঁধে নিয়েছে নিজেরই একটি কাপড়।একটি চেয়ার ছিটকে উল্টে পড়ে রয়েছে। লখনৌ থেকে ফরমাশ দিয়ে নিয়ে আসা বহু মূল্যের সোনা-রুপার সুতা দিয়ে নকশা করা আর জরী চুমকির কারুকাজ করা নাগরা চটিটি একাকী নিসঙ্গ পরে আছে নীচে। গর্বিত পায়ের উষ্ণ সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত অসহায় পাদুকাটি। মাধব বল্লবের আজন্ম যত্নে লালিত আরামের দেহটি কড়ি কাঠের সিলিং থেকে বিকৃত হয়ে ঝুলে পড়েছে।
বেলা গড়াল, মাধব বল্লবের নিথর দেহটি কাচঘরে রাখা কাঠের টেবিলের উপর সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে শুইয়ে রেখেছে। জীবনের সন্ধিক্ষণে এসে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীণ হয়ে আজ শক্ত হাতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তুচ্ছ জীবন অতিরিক্ত মাত্রায় অসহনীয়। কালের আবর্তে বিলীন হয়ে যায় অতীত, বর্তমান আর তারই পরিক্রমায় ভবিষ্যৎ হয়ে উঠে আচানক ভাবে অপ্রত্যাশিত, অনিশ্চিত, অনির্দেশ্য। মুহূর্তের ভুলে আর অজানা নিয়তির হাতে মানুষের জীবন চলে যায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বল্লবপুরের রাজবাড়িতেও এমনই এক দুর্ভাগ্য আর দুর্যোগের কালো কালিমা নেমে এসে পুরো বল্লব পরিবারকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় অকুল আঁধারে। রাজবাড়ি ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় কালের অতলে। কাঠের টেবিলটি অনেক পরিত্যক্ত আবর্জনার মাঝে শত শতাব্দীর ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে ধুক ধুক করে এখনও টিকে আছে। তবুও এ কথা সত্য যে, যুগ আর জীবন দুই অফুরন্ত, ফুরিয়ে গিয়ে আবার নব নব হয়ে ফিরে আসে। এই খেলা চলছে অবিরত।
0 মন্তব্যসমূহ