অনুবাদ: রঞ্জনা ব্যানার্জী
লোকটির মাথায় জখম। গাছের গুঁড়িতে সে মাথা এলিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল। চোখ মেলে তাকাল এবং জানতে চাইল, “আমরা কি বেরোতে পেরেছি?”
শ্মশ্রুধারী মানুষটি বেশ প্রশান্তচিত্তে উত্তর দিলেন, “প্রভুর কৃপায় আমরা বেরিয়ে আসতে পেরেছি এবং অক্ষত শরীরেই পেরেছি।”
গলায় ঝুলি ঝোলানো লোকটি মাথা দুলিয়ে শ্মশ্রুধারীর কথায় সায় দিল। “হ্যাঁ, নিঃসন্দেহে আমরা প্রাণ নিয়ে পালাতে সক্ষম হয়েছি।” এরপরে সে আহত লোকটির মাথায় বাঁধা পট্টির দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, “এখন কেমন বোধ করছ?”
লোকটি জবাব দিলো, “মনে হচ্ছে এখনও রক্ত চুঁইয়ে বেরোচ্ছে ওখান থেকে।”
শ্মশ্রুধারী একই প্রশান্তি নিয়ে আশ্বস্ত করলেন, “ভেবো না বন্ধু, রক্ত বন্ধ হবে এবং প্রভুর আশিসে ক্ষতও প্রশমিত হবে।”
মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত লোকটি এবার পূর্ণদৃষ্টিতে প্রত্যেককে দেখল। অতঃপর আঙুল তুলে গুনতে লাগল - শ্মশ্রুধারী, ঝোলাধারী এবং তরুণ। অবাক হয়ে সে জানতে চাইল, “অন্যজন কোথায়?”
তরুণ চমকাল, “কে? আপনি বলতে চাইছেন… আমাদের মধ্যে কেউ একজন নেই?”
শ্মশ্রুধারী তরুণের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি হানলেন। এবং মাথায় পট্টিবাঁধা লোকটিকে মৃদু ভর্ৎসনা করলেন, “বন্ধু, আমাদের সংখ্যা এমন বিশাল নয় যে গুনতিতে গোলমাল হবে।”
গলায় ঝোলাধারী লোকটিও শ্মশ্রুধারীর সঙ্গে একমত হলো এবং সে প্রত্যেককে ফের গুনতে শুরু করল- শ্মশ্রূযুক্ত, মাথায় জখম এবং তরুণ। শিউড়ে উঠল সেও, “অন্য মানুষটি কোথায়?” তরুণ হতাশ হয়ে ঝোলাধারীর দিকে তাকাল। এরপরে নতুন করে সে-ও সবাইকে গুনলো- দাড়িয়াল, ঝোলাওয়ালা এবং মাথায় পট্টি। দুশ্চিন্তা ভর করল তরুণকে, “বাকিজন গেলেন কোথায়?” শ্মশ্রুমণ্ডিত মানুষটি ত্রয়ীদের তাঁর ক্রুদ্ধ দৃষ্টির ফলায় বিদ্ধ করলেন। এরপর আঙুল উঁচিয়ে একে একে তিনজনকে গুনলেন- মাথায় আঘাত পাওয়া লোক, ঝোলাধারী লোকটি এবং তরুণ ছেলেটি। এবার তাঁর অবাক হওয়ার পালা। তিনি আবার গুনলেন। এবং ভড়কে গেলেন। তৃতীয়বার আরও সাবধানে এবং আরও ধীরে গুনলেন।হতবিহ্বল হয়ে বিড়বিড় করতে থাকলেন, “অদ্ভুত, বড়ই অদ্ভুত!”
চারজনের দলটির প্রত্যেকে পরস্পরের দিকে ভীত-সন্ত্রস্ত দৃষ্টি বিনিময় করল। এবং সকলের ঠোঁট গলে একই সঙ্গে একটি শব্দই ফিসফিসিয়ে বেরিয়ে এলো, “ সত্যিই অদ্ভুত!” এরপরেই সকলে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল।
দীর্ঘক্ষণ নীরবতা ঘিরে রেখেছিল তাদের । দূরে কোথাও একটা কুকুর ডাকতে শুরু করেছিল। তরুণটি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে অন্যদের দেখল এবং মৃদুস্বরে জানতে চাইল, “কুকুর ডাকছে কেন?”
আহত লোকটি তরুণের প্রশ্ন অগ্রাহ্য করে জানতে চাইল, “কে হতে পারে?”
“এটা নিশ্চয় সে”, শ্মশ্রুধারী প্রত্যয়ের সংগে বেশ জোরে , তাঁর রিনিরিনে গলায় উচ্চারণ করলেন, “খুব বেশি দূরে যেতে পারার কথা নয় তার; ধারেকাছে কোথাও নিশ্চয় পথ হারিয়ে ফেলেছে।”
মাথায় আঘাত পাওয়া লোকটি পাশ থেকে একটা বাঁশের বস্তু তুলে নিল এবং উঠে দাঁড়াল। “যদি সে হয়, এবং কুকুর তাকে এদিকে আসতে বাধা দেয়, তবে আমার তাকে আনতে যাওয়া উচিত।”
বাঁশের বস্তুটি হাতে ধরে সে কুকুরের ডাক লক্ষ্য করে এগিয়ে গেলো । বাকি তিনজন চুপচাপ বসে রইল।
এরপর ঝোলাধারী জানতে চাইল, “আসলেই কি সে?”
শ্মশ্রুধারী বললেন, “এমন অদ্ভুত সময়ে এমন অদ্ভুত জায়গায় সে ছাড়া আর কেই বা হতে পারে?”
“হ্যা, সে-ই হবে”, ঝোলাধারী মেনে নিলো। “ও সবসময় কুকুরকে ভয় পেত। রাস্তায় কখনো কুকুরের সামনে পড়লে একদম মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতো।”
তরুণের গলায় সন্দেহ, “আপনারা কি কিছু বুঝতে পারছেন …কুকুরের ডাক কিন্তু আর শোনা যাচ্ছে না।”
ঝোলাধারী কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করল, তারপর বলল, “হ্যাঁ ঠিক বলেছ এখন কোনো আওয়াজ নেই। কী ঘটল কে জানে” ।
শ্মশ্রুধারী আশ্বস্ত করলেন, “ ওরা দুজন মিলে নিশ্চয় কুকুরটাকে তাড়িয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে ওরা পৌঁছে যাবে”। এরপর ফের সব চুপচাপ।
মাথায় আঘাত পাওয়া লোকটি যে পথ ধরে গিয়েছিল সেই দিক-পানেই ওরা চোখ পেতে ছিল। ঝোলাধারী চোখের পলক ফেলছিল না । হঠাৎ কিছু একটা নজরে এলো তার, বলল “ও ফিরছে, একা।”
“একা?” শ্মশ্রুধারী অবাক হলেন।
“হ্যাঁ, একাই” । এবার ওরা তিনজনই দেখতে পেলো, মাথায় আঘাত পাওয়া লোকটি ক্রমশ নিকটবর্তী হচ্ছে। লোকটি তাদের কাছে এসে জিনিসপাতি নামিয়েই বসে পড়ল। বলল, “কেউ নেই ওখানে।”
ঝোলাধারীর গলায় সন্দেহ, “তবে কুকুর ডাকছিল কেন?”
তরুণ বলল, “কোনো কারণ ছাড়া কুকুর ওভাবে ডাকে না” ।
আহত লোকটি উওর দিল, “কিন্তু কেউ নেই ওখানে” ।
“ভারী অদ্ভুত তো,” ঝোলাধারী বলল।
তরুণটি ফের কান খাড়া করল, “শুনুন… এটাকে কী বলবেন? কুকুরের ডাক না?”
সকলে কান পাতল। শ্মশ্রুধারী মাথায় জখমযুক্ত লোকটির কাছে জানতে চাইল, “ কোনদিকে গিয়েছিলে তুমি? কুকুরের ডাক তো উল্টোদিক থেকে আসছে” ।
ঝোলাধারী আহত লোকটির পাশে পড়ে থাকা বাঁশের বস্তুটি তুলে নিলো এবং দাঁড়িয়ে বলল, “যাই, পরখ করে আসি।”
শ্মশ্রুধারীও উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন, “ আমরা সকলেই তবে যাই এবং খুঁজে আসি?” অন্য দুজনও খাড়া হয়ে গেল। অতঃপর ওরা চারজনই খানিক আগে যে দিক থেকে কুকুরের আওয়াজ আসছিল সেই দিক লক্ষ্য করে এগিয়ে চলল। বেশ অনেকখানি পথ তারা পেরিয়ে এসেছিল। কিন্তু কিছুই দেখতে পায়নি পথে। ঝোলাধারী হাঁটতে হাঁটতে বিড়বিড় করছিল, “এখানেও কেউ নেই।”
শ্মশ্রুধারী তাঁর নিজের মনোবল জড়ো করার চেষ্টা করছিলেন। বললেন, “চল, ওর নাম ধরে ডাকি; ধারেকাছে কোথাও আছে নিশ্চয়। রক্তমাংসের মানুষ সে, অশরীরী তো নয় যে হঠাৎ করে মিলিয়ে যাবে।“
আহত লোকটির স্বরে হতাশা, “ঠিক, নাম ধরে ডেকে দেখা যাক কী হয়,” এরপরে সে লম্বা শ্বাস নিল যেন সমস্ত শক্তি দিয়ে হাঁকবে এখনই, কিন্তু মুখ খুলতে গিয়েই থমকে গেল। ঝোলাধারীর দিকে ফিরে তাকাল এবং বলল, “আমি তার নাম মনে করতে পারছি না। কী নাম ছিল তার?”
“নাম?”
আহত লোকটি তারপরেও প্রাণপণে চেষ্টা করল কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারল না। এরপর সে তরুণের দিকে ঘুরে জানতে চাইল, “তুমি নিশ্চয় মনে করতে পারছ, তরুণ।”
উত্তরে তরুণ বলল, “নাম তো নাম আমার ওর চেহারাও মনে পড়ছে না।”
“চেহারাও মনে করতে পারছ না…” এবং এ কথা বলেই ঝোলাধারী গভীর চিন্তায় ডুবে গেলো। অবশেষে সে বলল, “অদ্ভুত ব্যাপার, আমিও কিছুতেই তার মুখ মনে করতে পারছি না।” সে শ্মশ্রুধারীর দিকে তাকাল।
শ্মশ্রুধারীও গভীর চিন্তায় মগ্ন হলেন। তাঁর স্মৃতির ভেতর থেকে মুখটি তুলে আনার প্রবল চেষ্টা করলেন । অতঃপর উৎকণ্ঠা নিয়ে বললেন, “বন্ধুগণ চলুন আমরা ফিরে যাই, কেননা আরও সামনে খুঁজতে গেলে বিপদের সম্মুখীন হতে পারি আমরা।”
“কেন?”
“কারণ আমরা কেউ-ই তার নাম কিংবা চেহারা মনে করতে পারছি না। এমতাবস্থায় কেবল ঈশ্বরই জানেন আমাদের কী ধরনের সমস্যার সামনে পড়তে হতে পারে। আমরা হয়তো ভাবব ইনিই সেই লোক, অথচ সে হয়তো হবে অন্য কেউ। এই মুহূর্তে আমরা বড় অদ্ভুত সময়ে, অদ্ভুত স্থানে আছি।”
তারা চারজন ফেরার পথ ধরল। পূর্বের স্থানটিতে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত তারা অবিরাম হেঁটেছিল। ফিরেই তারা আগুনের ব্যবস্থা করেছিল এবং ঝোলাধারী লোকটি তার ঝোলার ভেতর থেকে পাঁচমিশালী ডাল বের করে রান্না চাপিয়েছিল।
খাওয়া এবং পান শেষে তারা আগুনের চারপাশে বসে হাত সেঁকতে লাগল। ফেলে আসা স্বজনদের কথা ভেবে তাদের সকলের চোখ সজল হয়ে উঠছিল।
“কিন্তু সেই লোকটি কে ছিল?”, তরুণ জানতে চাইল।
অন্যেরা না-বোঝার ভান করে বলল, “কোন লোক?”
“সেই লোকটা যে আমাদের সংগে ছিল কিন্তু পিছিয়ে পড়েছিল।”
“ওহ্! সেই লোকটা …আমরা তো তাকে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। ঠিক, কে ছিল সে?”
“আসলেই ব্যাপারটা বড়ো অদ্ভুত,” ঝোলাধারী উত্তর দিলো, “আমরা ওর চেহারা কিংবা নাম কোনটিই মনে করতে পারছি না।”
“তবে কি সে আমাদের একজন ছিল না?”
তরুণের প্রশ্নে সকলে বিহ্বল বোধ করতে লাগল। অতঃপর ঝোলাধারী প্রশ্ন তুলল, “সে যদি আমাদের একজন না হয়, তবে কে ছিল সে? এবং কেনই বা সে আমাদের সঙ্গ নিয়েছিল? আবার হঠাৎ করে উধাও হয়ে…” বাক্য শেষ না করেই সে চুপ হয়ে গেল। সকলে পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে লোকটির অন্তর্ধানের রহস্য খোঁজার চেষ্টা করছিল, লোকটি কেনই বা ওদের সঙ্গে ছিল, কে ছিল, কীভাবে, কখন…
অবশেষে ওদের সন্দেহ তাড়িয়ে মনোবল সংহত করার উদ্দেশ্যে শ্মশ্রুধারী বললেন, “বন্ধুরা কোনো রকম সন্দেহের ঘোরে পড়া যাবে না, কেননা সন্দেহ থেকে কোনো সমাধান আসে না। সে নিঃসন্দেহে আমাদেরই একজন ছিল। কিন্তু আমরা এমন ছত্রভঙ্গ হয়ে বাড়ি ছেড়েছিলাম যে সঙ্গীর চেহারা কিংবা সহযাত্রীর সংখ্যার খেই হারিয়ে ফেলেছি।”
“কিন্তু আমরা কেন মনে করতে পারছি না চলে আসার সময় আমাদের সংখ্যা কত ছিল?” তরুণ তাঁর কথার মাঝখানে বাদ সাধল। “এবং কোথা থেকেই বা আমরা বেরিয়ে পড়েছিলাম…” সে আরও জানতে চাইল।
শ্মশ্রুধারী প্রাণপণে স্মরণ করবার চেষ্টা করছিলেন। বললেন, “আমার যতদূর মনে পড়ছে আমি যখন ঘারনাটা ছেড়েছিলাম…”
“ঘারনাটা ছেড়েছিলেন…” বাকি তিনজন চমকে তাকাল তাঁর দিকে।
খানিক পরে ঝোলাধারী জোরে হেসে উঠেছিল। শ্মশ্রুধারী সকলের অবাক দৃষ্টি দেখে দ্বিধায় পড়েছিলেন। ঝোলাধারীর অমন অট্টহাসিতে এবার তিনি বিধ্বস্ত হলেন। ঝোলাধারী হাসতে হাসতেই বলে চলল, “মনে হচ্ছে আমি যেন গর্বভরে ঘোষণা দিচ্ছি, ‘আমি যখন জেহানাবাদ ছেড়ে আসছিলাম…’”
জেহানাবাদ? সকলে স্তম্ভিত হলো এইবার।
ঝোলাধারী যে কিনা এতক্ষণ শ্মশ্রুধারী বয়েসী মানুষটির কথায় হাসি সংবরণ করতে পারছিল না এবার জোর ঝাঁকুনি খেয়ে নিশ্চুপ হয়ে গেল। মাথায় জখম লোকটি হঠাৎ তীক্ষ্ণ হাসি দিলো এবং বিষণ্ণ স্বরে বলল, “আমাকে উন্মূল করা হয়েছিল, কাজেই আমার কাছে স্থানের কোনো গুরুত্বই নেই- সেটি ঘারনাটা নাকি জেহানাবাদ অথবা মক্কার মতো পূণ্যস্থান কিংবা কাশ্মীর …’ এবং সেও নিশ্চুপ হয়ে গেল।
কিন্তু আহত লোকটির বলা প্রতিটি শব্দ ওদের সকলকে সংক্রমিত করেছিল । বেশ অনেকক্ষণ পরে শ্মশ্রুধারী সজলচোখে বলে উঠলেন, “আমাদের যা কিছু ছিল সবই ফেলে এসেছি, কিন্তু তাই বলে আমাদের স্মৃতিও কি মুছে ফেলব?”
ঝোলাধারী লোকটি অনেক ভেবে বলল, “আমি কেবল এটুকু মনে করতে পারি আমাদের বাড়ি শুকনো খড়কুটোর মতো জ্বলছিল এবং আমরা সবাই দৌড়ে বেরিয়ে আসছিলাম এবং পালাচ্ছিলাম।”
তরুণটির বুক ভারী হয়ে উঠেছিল। সে বলল, “কেবল সেই মুহূর্তটিই আমার মনে পড়ছে, আমার বাবা তাঁর তসবিহ হাতে জায়নামাজে বসে ছিলেন। তাঁর ঠোঁট নড়ছিল প্রার্থনায় এবং ধোঁয়ার কুণ্ডলি আমাদের ঘিরে ফেলেছিল …”
শ্মশ্রুধারীর গলায় স্নেহের আধিক্য, তিনি কোমল স্বরে জানতে চাইলেন, “তোমার পিতা কি এইসব দেখবার জন্য জীবিত ছিলেন?” তরুণ জবাব দিলো না কেবল তার চোখের কোণে জল জমে উঠেছিল।
ঝোলাধারী অনেক ভেবেচিন্তে বলল, “আমি কেবল এটুকুই মনে করতে পারছি শুকনো কাঠের স্তুপ জ্বলার মতো জ্বলছিল আমাদের বাড়ি এবং আতঙ্কে অন্ধ হয়ে পালাচ্ছি আমরা।”
মাথায় আঘাত পাওয়া লোকটিকে এসব কিছুই স্পর্শ করছিল না। সে কেবল বলল, “বন্ধুরা তোমাদের স্মৃতিচারণে কোনো লাভ আছে কি? আমার মাথা কি বাঁশের লাঠি, না কি কাঠি অথবা তরবারির আঘাতে দুভাগ হয়েছিল জেনে কোনো ফায়দা আছে? এই মুহূর্তে আমার কাছে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো আমার এই মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে এবং এখনও ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে।”
সকলে লোকটির দিকে করুণ চোখে তাকাল। শ্মশ্রুধারী দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে রইলেন এবং দীর্ঘ বিরতির পরে বললেন, “আমার বুকের ভেতরে তোমার মাথার জখমের চেয়েও অনেক গভীর ক্ষত লুকিয়ে আছে। “এরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বলা শুরু করলেন, “ধুলায় মিশিয়ে দেওয়ার আগে শহরটি কতই না মনোরম ছিল!”
“ কত শত মানুষের ভিড় এবং আমাদের চোখের সামনেই নিমেষে সব নেই হয়ে গেল!” তরুণ ঘোরের ভেতর বলে চলল। সে তার স্মৃতির গোলকধাঁধায় ঘুরছে। ওর মনে পড়ছিল প্রথম চুম্বনে বাঁধাপড়া সেই ভীরু ঠোঁটজোড়ার স্পর্শ।সেই সব অভিনব প্রতিশ্রুতির কথাও মনে পড়ছে যা কেবল এমন মধুর সময়েই মানুষ সচরাচর বলে থাকে এবং কীভাবে সেইসব সময় এবং স্থান তলিয়ে যায় আর সেই ভালোবাসার পথটি কী জাদুময়ই না হয়ে থাকে। অথচ এই মুহূর্তে সেই সুখময় মুহূর্তটিকেই সে বেদনাভরে স্মরণ করছে। আপনমনে বলল তরুণ, “যদি সে আজ এখানে উপস্থিত থাকতো তবে আমাদের সংখ্যাটি জোড়সংখ্যা হতো।”
“সে?” শ্মশ্রুধারী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। “কে যদি থাকত?”
“সে” ।
“সে কে?”
তরুণ এই কথার কোনো উওর দিলো না। একদৃষ্টিতে খালি জায়গাটার দিকে তাকিয়ে রইল । শ্মশ্রুধারী এবং ঝোলাধারী তাকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছিল। মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত লোকটি ফের গাছে হেলান দিয়ে চোখ বুজল, যেন পুরো ব্যাপারটিতে সে অসুস্থবোধ করছে । ঝোলাধারী কোমলস্বরে জানতে চাইল, “সে কি নারী?”
“নারী?”, শব্দটি কানে যেতেই শ্মশ্রুধারী লাফিয়ে উঠলেন। মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত লোকটিও ঝট করে চোখ খুলল। “যদি তিনি নারী হন,” ঝোলাধারী বললেন, “ঈশ্বরের দিব্যি আমরা তবে সৎসঙ্গ থেকে বঞ্চিত হলাম!”
শ্মশ্রুধারী তার দিকে রাগান্বিত দৃষ্টি ছুঁড়ে বললেন, “তিনি যদি নারী হতেন, ঈশ্বর জানেন সেই সঙ্গ আমাদের সকলকে ধ্বংস করে দিতো।”
আহত লোকটি বিদ্রুপের হাসি হাসল, “আমাদের সর্বনাশের আর কিছু বাকি আছে কি?”
“কিন্তু সেই সর্বনাশ তার চেয়েও অধিক হতো।”
মাথায় জখমওয়ালা লোকটি হঠাৎ নির্দয়ভাবে বলে উঠল, “শুনুন বৃদ্ধ , নারীঘটিত সর্বনাশের কারণে যদি বিলীনও হয়ে যাই তারপরেও বলব সেটি এই অকারণ, যুক্তিহীন যন্ত্রণা ভোগ করার চেয়ে শ্রেয়তর।” বলেই সে চোখ মুদে গাছের গুঁড়িতে আবারও মাথা এলিয়ে দিলো।
নিস্তব্ধতা তাদের ঘিরে রেখেছিল দীর্ঘক্ষণ। ঝোলাধারী ব্যক্তি আগুনের জন্য শুকনো কাঠের টুকরো কুড়োতে গেলেন এবং ফিরে এসে আগুন উস্কালেন। তারা সকলে একই ভঙ্গিতে বসে রইল - আগুনের ধারে নিজেদের হাত সেঁকতে সেঁকতে প্রত্যেকে নিজস্ব ভাবনায় মগ্ন ছিল, অমঙ্গলের আশঙ্কা সবাইকে গিলে খাচ্ছিল – যতক্ষণ না শ্মশ্রুধারী বিড়বিড় করে বলে উঠলেন, “এটা কি অদ্ভুত নয় যে আমরা তার নাম কিংবা মুখ মনে করতে পারছি না? এমন কি সে পুরুষ না কি নারী তাও মনে পড়ছে না আমাদের।”
ঝোলাধারী যখন মুখ খুলল মনে হচ্ছিল যেন সে মাথায় প্রচণ্ড চাপ দিয়ে স্মৃতি ফেরানোর চেষ্টা করছে। “নিখোঁজ মানুষটি কে ছিল?কে হতে পারে?”। এবং সে সন্দেহভরে যোগ করল, “কী হবে যদি সেই ব্যক্তি পুরুষ না হয়?”
“পুরুষ নয়?”, বিভ্রান্ত তরুণ প্রশ্ন করল।
শ্মশ্রুধারী খানিক দ্বিধা নিয়ে মৃদুস্বরে বললেন, ‘হ্যাঁ এমন হতে পারে।‘ ফের নীরবতায় ছেয়ে গেলো চারপাশ। তরুণটি ফাঁদে আটকে আছে। সে জিজ্ঞাসা করল, “যদি সে পুরুষ না হয়, তবে কে সে?”
শ্মশ্রুধারী এবং ঝোলাধারী দুজনেই গভীরভাবে ভাবতে লাগলেন। মাথায় যার জখম তিনি চোখ খুললেন, তরুণের দিকে তাকালেন এবং বললেন, “যদি তিনি নারী না হন, তবে কে? যদি জাহান্নাম থেকে আসা কোনো নারী হয়, তবে জাহান্নামে যাক সে।” এবং এটুকু বলে সে ফের চোখ বুজল।
“জাহান্নাম থেকে আসা কেউ!” বাকি তিনজন চমকে উঠল। এক মুহূর্ত দ্বিধা করলেন শ্মশ্রুধারী, এরপর বললেন, “বন্ধু এমন কিছু বলো না যাতে করে সহযাত্রীদের ওপর থেকে আমাদের বিশ্বাস টুটে যায়।”
আঘাতপ্রাপ্ত মানুষটি চোখ খুলল এবং তাঁর দিকে তাকাল। আবারও তার স্বভাবসুলভ বিদ্রুপাত্মক হাসিটি দিয়ে বলল, “বৃদ্ধ মানুষ, আপনার সহযাত্রীদের ওপরে আস্থা এখনও অটুট আছে?” বলেই সে চোখ বুজে মাথা পেছনে দিয়ে গাছের গায়ে এলিয়ে পড়ল।
শ্মশ্রুধারী উৎকণ্ঠা নিয়ে তার দিকে তাকালেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, “বন্ধু তোমার মাথায় কি খুব বেশি যন্ত্রণা হচ্ছে?।” আহত ব্যক্তি চোখ না খুলেই নঞ্র্থক মাথা নাড়ল। তার মুখে কোনো শব্দ ছিল না।
শ্মশ্রুধারী সন্দেহ তাড়াতে জানতে চাইল, “ তোমার কি মনে আছে কীভাবে আঘাত পেয়েছিলে? কিংবা কীভাবে পালিয়েছিলে?”
আহত মানুষটি চোখ বুজেই রইল, তবে উত্তর দিলো। বেদনায় পর্যুদস্ত তার গলার স্বর, “আমার কিছুই মনে নেই।”
“ভারী অদ্ভুত তো!”, তরুণ বলল।
“না এখানে অদ্ভুতের কিছু নেই,” শ্মশ্রুধারী জবাব দিলেন। “ক্ষত যদি গভীর হয় তবে তা মগজকে অসাড় এবং সমস্ত স্মৃতিকে স্থবির করে দিতে পারে।”
“আমার মাথায় কোনো আঘাত নেই, এরপরেও বেশ কিছুদিন ধরে আমার মগজ অসাড় হয়ে আছে।” ঝোলাধারী জানাল।
শ্মশ্রুধারী ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করলেন, “এই ধরনের পরিস্থিতিতে এমন হয়; মানুষ আতঙ্কে জমে যায় …” কথার মাঝখানে তিনি হঠাৎ থেমে গেলেন, চমকে উঠলেন এবং কিছু সময়ের জন্য স্থির হয়ে বসে রইলেন যেন কান পেতে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করছেন , এরপরে তিনি ঝোলাধারী লোকটির দিকে সপ্রশ্নে তাকালেন এবং বললেন, “এটা সেই একই আওয়াজ না?”
ঝোলাধারী কান খাড়া করল এবং বলল, “হ্যাঁ, সেই আওয়াজ।”
তিন জনই কান পেতে আওয়াজটা বোঝার চেষ্টা করছিল, পরস্পরকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে দেখছিল এবং সেই বোবা সন্ত্রস্ত দৃষ্টিটি তাদের চোখ ছুঁয়ে ছিল। শ্মশ্রুধারী উঠে দাঁড়ালেন। ঝোলাধারী এবং তরুণও দাঁড়িয়ে পড়ল। তারা হাঁটতে শুরু করলে আঘাতপ্রাপ্ত জন চোখ মেলে দেখল। ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে সেও উঠে দাঁড়াল এবং বাকিদের অনুসরণ করল। তারা অনেকদূর চলে গিয়েছিল- প্রথমে একদিকে তারপরে অন্যদিকে। ওদের বিস্ময় কাটছিল না। ঝোলাধারী ব্যক্তি বলল, “মাইলের পর মাইল জুড়ে কোথাও কেউ নেই।”
শ্মশ্রুধারী উত্তর দিলো, “কিন্তু কেউ তো নিশ্চয় আছে কেননা কুকুর ডাকছে বারবার।”
“কিন্তু কুকুরটা গেল কোথায়?”, যুবক জানতে চাইল।
প্রশ্নটি সকলকে আচমকা থমকে দিলো । এতক্ষণ কেউ এই বিষয়টি নিয়ে ভাবেনি। কী কারণে ওদের কেউ-ই এই পর্যন্ত একটি কুকুরও দেখতে পেলো না?
ঝোলাধারী বলল, “এবার কুকুরটাও তবে রহস্য হয়ে দাঁড়াল।”
শ্মশ্রুধারী বললেন, “কুকুরটি নয় লোকটিই রহস্যের মূলে।”
মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত লোকটি নির্লিপ্তভাবে তাঁর কথার মাঝখানে বলে উঠল, “যতক্ষণ না আপনি দুটোর মধ্যে পার্থক্য করতে পারছেন।”
শ্মশ্রুধারী তার এই আলটপকা উক্তিকে উপেক্ষা করে ঘুরে দাঁড়ালেন।“চল ফিরে যাই।“
“কেন?”
“আর দূরে যাওয়া বিচক্ষণ হবে না।” অতঃপর সকলে ফেরার পথ ধরল। তারা চুপচাপ হাঁটছিল, এবং সেই স্থানটিতে ফিরে এলো যেখান থেকে তারা যাত্রা শুরু করেছিল।
তরুণ বসল এবং আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল, “আমরা কি ওকে অনুসরণ করছি না কি সে আমাদের অনুসরণ করছে?”
“তোমার কেন মনে হলো যে সে আমাদের অনুসরণ করছে?”, ঝোলাধারী জানতে চাইল, তার গলাতেও ভয়ের আভাস।
“আমি বলছি কারণ ফেরার সময় আমার মনে হচ্ছিল আমাদের পেছন পেছন কেউ একজন আসছে। প্রতি পদক্ষেপে এমন অনুভূতি হচ্ছিল।”
“তুমি কি পেছনে তাকিয়েছিলে?”
“না।”
শ্মশ্রুধারী বৃদ্ধ মানুষটি তরুণের প্রশংসা করে বললেন, “খুবই সমঝদারী কাজ করেছ যুবক! কারোর কখনই পেছনে তাকানো উচিত নয়।”
মাথায় আঘাত প্রাপ্ত ব্যক্তিটি যে কি না পৌঁছানোর পরপরই গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে ধপ করে বসে পড়েছিল, ঝাঁকুনি দিয়ে এবার উঠে দাঁড়াল। বিস্ফারিত চোখে তরুণের দিকে তাকিয়ে রইল সে। বলল, “আমার সঙ্গেও এমনটি হচ্ছিল। যখন আমরা ফেরার পথ ধরেছিলাম তখন আমারও মনে হচ্ছিল কেউ একজন দ্রুত বড় বড় পা ফেলে আমার পেছন পেছন আসছে।”
শ্মশ্রুধারীর গলায় উদ্বেগ, “কিন্তু বন্ধু এই কথাটা তোমার সেই সময়ে বলা উচিত ছিল।“
‘আমি ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু তরুণ বিষয়টি উল্লেখ করতেই আমার মনে পড়ল।” সে হঠাৎ করে এমনভাবে চুপ হয়ে গেল যেন কিছু একটা ওকে আঘাত করেছে।
“কী হলো?”
“কোনো সমস্যা?”
“দাঁড়াও। আমাকে খানিক ভাবতে দাও।” সে নিরর্থক কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করছিল। অবশেষে হাল ছেড়ে জানতে চাইল, “বন্ধুরা, ভালো করে ভেবে পরে আমায় বলো … যখন আমি আমাদের গুনছিলাম তখন কি আমি নিজেকে গুনেছিলাম?”
“তোমাকে গুনেছিলে কি না?”, ঝোলাধারী হতবাক হয়ে জানতে চাইল।
মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত লোকটি কিছু সময় ভাবল, তারপরে বলল, “হয়তো আমি আমাকে গুনি নি… হ্যাঁ আমি নিশ্চিত গুনি নি। আমি নিজেকে গুনতে ভুলে গিয়েছিলাম।”
অন্য তিনজন খানিক বিভ্রান্ত এবার। সমস্বরে বলল, “তো?”
“আমিই সেই নিরূদ্দিষ্ট লোক।”
“তুমি?” প্রচণ্ড ধাক্কা খেল সবাই।
“হ্যাঁ। আমিই।”
হতবাক হয়ে সকলে মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিটির দিকে তাকিয়ে রইল।
সবার আগে সংবিৎ ফিরেছিল তরুণের। হঠাৎ করে তারও মনে পড়ে গেলো যে সেও অন্যদের গুনেছিল কিন্তু নিজেকে গণনায় যুক্ত করেনি। সে বলল, “যে মানুষটিকে খুঁজছি আমরা, আমিই সেই।”
একথা শুনে, ঝোলাধারী ব্যাক্তিরও মনে পড়ল সেও অন্যদের গুনেছে নিজেকে নয়। তারও মনে হলো নিখোঁজ ব্যক্তিটি সে ছাড়া অন্য কেউ নয়।
শ্মশ্রুধারী বুঝতে পারলেন তিনি নিশ্চিত সে জন। তিনি গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন। বেশ অনেকক্ষণ চিন্তা করার পরে, তিনি বললেন, “আমি অন্যদের গুনেছি, নিজেকে গুনতে ভুলে গেছি। কাজেই সঙ্গতকারণেই আমিই সেই নিখোঁজ ব্যক্তি।“
ইতোমধ্যে প্রত্যেকের মনে সংশয় দানা বেঁধে গিয়েছিল। প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ: নিখোঁজ ব্যক্তিটি কোন জন? মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তি সকলকে পুনরায় সেই সময়টির কথা মনে করিয়ে দিলো যখন সে একাই নিখোঁজ লোকটির সন্ধানে বেরিয়েছিল এবং একাই ফিরে এসেছিল।
“সেই সময়ে আমার মনে হচ্ছিল সে আমার অতি নিকটেই আছে, আমি কিন্তু এই খানে ছিলাম না।”
শ্মশ্রুধারী ব্যক্তিটি এমনভাবে কথা বলা শুরু করলেন যেন তিনি খুবই সাধারণ কোনো বিষয় ব্যাখ্যা করছেন, “কিন্তু তুমি এখানে আছ, বন্ধু।”
শ্মশ্রুধারীর বলা কথায় তার বিশ্বাস হচ্ছিল না তাই আঘাতপ্রাপ্ত লোকটি তার সহযাত্রীদের প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকাল। প্রত্যেকে তাকে আশ্বস্ত করল এই বলে যে সে ছিল, সে নিশ্চিত সেখানেই ছিল। শেষমেশ সে বুক কাঁপিয়ে লম্বা শ্বাস নিলো এবং বলল, “যেহেতু আপনারা সকলে আমার উপস্থিতির সাক্ষ্য দিলেন, অতএব বলা যায় আমি নিশ্চয় ছিলাম এখানে। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, আমার থাকা না-থাকার বিষয়টি অন্যের প্রত্যয়নের ওপরেই নির্ভর করছে।”
শ্মশ্রুধারী বললেন, “বন্ধু কৃতজ্ঞ থাক যে এখানে তিন তিন জন মানুষ ছিল তোমার জন্য সাক্ষ্য দিতে। তাদের কথা ভাবো যাদের অস্তিত্ব ছিল কিন্তু তার প্রমাণ দেওয়ার জন্য কোনো সাক্ষী ছিল না। এখন তাদের অস্তিত্ত্ব নেই আর।”
মাথায় আঘাত পাওয়া লোকটি জানতে চাইল, “তার মানে আপনি বলতে চাইছেন আপনি যদি আপনার সাক্ষ্য অস্বীকার করেন, আমার অস্তিত্বও অলীক হয়ে যাবে?”
তার এই কথাগুলো প্রত্যেকের মনে ছাপ ফেলেছিল। উপস্থিত সকলের মধ্যে আশঙ্কার বুদবুদ তৈরি হতে থাকল: আমিই কি তবে সেই নিখোঁজ জন? এবং প্রত্যেকেই বিপন্ন বোধ করছিল: যদি আমিই সেই নিখোঁজ মানুষটি হই, তবে আমার অস্তিত্ব আছে না কি নেই? ওদের দৃষ্টি ওদের অন্তরের ভীতিকে আড়ালে রেখেছিল। তারা পরস্পরকে দেখছিল, অতঃপর দ্বিধা এবং শঙ্কা জড়ানো স্বরে তাদের আশঙ্কার কথা প্রকাশ করল। প্রত্যেকে তারা অপর-জনকে ভরসা দিচ্ছিল। এবং একে অন্যের উপস্থিতির সাক্ষ্য দিয়েছিল। সকলের কাছ থেকে নিজের উপস্থিতির প্রামাণ্য মত পেয়ে সকলে সন্তুষ্ট হয়েছিল। কিন্তু তরুণ ফের সংশয়ের চোরাবালিতে ডুব দিলো। “ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে… শুধু পরস্পরের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে মেনে নেব যে… আমরা অস্তিমান্।”
মাথায় আঘাত পাওয়া লোকটি হাসতে শুরু করেছিল। অন্যেরা জানতে চাইল, “বন্ধু তুমি হাসছ কেন?” আহত লোকটি বলল, “আমি হাসছি কারণ আমার মনে হলো যে আমরা প্রত্যেকে অন্যের অস্তিত্বের সাক্ষ্য দিতে সক্ষম হলেও নিজে নিজের অস্তিত্বের সাক্ষী হতে পারব না।”
তার অদ্ভুত আশঙ্কাযুক্ত কথাগুলি ফের সকলকে বিভ্রান্তিতে ফেলে দিলো। অদ্ভুত সন্দেহের মেঘ তাদের স্থবির করে দিলো। তারা পুনর্বার নিজেদের গুনল। এবার তারা প্রত্যেকে প্রথমে নিজেকে পরে অন্যদের গুনেছিল। এবং এই কার্যক্রমের পরেও তারা সন্দিহান হলো এবং পরস্পরকে প্রশ্ন করছিল, “আমি কি নিজেকে গুনেছিলাম?”
প্রথমজন দ্বিতীয়জনের, দ্বিতীয়জন তৃতীয়জনের এবং তৃতীয়জন চতুর্থ জনের গণনার ভুল ধরতে লাগল। শেষমেশ তরুণটি জানতে চাইল, “আসলে আমরা কজন ছিলাম সেখানে?” প্রশ্নটি যেন সকলের হৃদয় ফুঁড়ে দিলো। প্রত্যেকে অন্যজনের কাছে জানতে চাইল, “আসলে আমরা কয়জন ছিলাম এখানে?” শ্মশ্রুধারী সকলের কথা শুনছিলেন এরপরে বললেন, “প্রিয় বন্ধুরা, আমি এটুকু জানি যে যখন আমরা শুরু করেছিলাম আমাদের সংখ্যা গোনা হয়েছিল এবং আমাদের মধ্যে কেউ হারিয়ে যায়নি। আমাদের সংখ্যা ক্রমশ কমছিল এবং একসময় তা আমাদের হাতের আঙুলে গুনতে পারার পর্যায়ে চলে এসেছিল।”
“এরপরে ঘটনা এমনভাবে গড়াতে লাগল যে আমরা আমাদের আঙুলের ওপরই ভরসা হারিয়ে ফেললাম। আমরা নিজেদের বার বার গুনেও একজনের ঘাটতি পূরণ করতে পারিনি। এরপরে আমরা আমাদের ভুল ধরতে পেরেছিলাম এবং ফের গুনতে গিয়ে টের পেলাম আমরা আসলে নিজেদেরই হারিয়ে ফেলেছি।”
তরুণ অবিশ্বাসের স্বরে বলল, “আমরা তবে সবাই হারিয়ে গেছি?” শ্মশ্রুধারী আগুনচোখে তাকালেন তরুণের দিকে কেননা যে বিষয়টির জট ছাড়ানো হলো সে আবার তাতে প্যাঁচ লাগাচ্ছে। “কেউ হারাইনি; আমাদের সবাই হিসাবের আওতাতেই আছি।“
তরুণ আবার রুক্ষস্বরে অভব্যের মতো জানতে চাইল, “কীভাবে আমরা বলতে পারি যে আমাদের গোনা হয়েছিল? মোদ্দা কথাটি বলুন, শুরুতে আমরা কয় জন যাত্রা করেছিলাম?”
“কখনের কথা বলছ তুমি?”, শ্মশ্রুধারী রাগত স্বরে জানতে চাইলেন।
“আমরা যখন যাত্রা শুরু করেছিলাম।” মাথায় আঘাতপ্রাপ্তজন তরুণের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো।
“আমরা কখন যাত্রা শুরু করেছিলাম?”, তরুণ আহত লোকটির দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল। তার চোখ জলে ভরে উঠেছিল। সে বলল, “আমি কেবল মনে করতে পারি আমাদের বাড়ি ধোঁয়ায় ভরে উঠেছিল আর আমার বাবা জায়নামাজে প্রার্থনারত ছিলেন। তাঁর চোখ বোজা ছিল, তাঁর ঠোট নড়ছিল, তাঁর আঙুল তসবির মালার ওপর ঘুরছিল।” আহত লোকটি যুবকের দিকে তখনো তাকিয়ে, তার দৃষ্টি যুবকের মুখের ওপর আটকে ছিল। খানিক পরে হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে বলল, “ হে তরুণ, তুমি অনেক কিছু মনে করতে পারছ। আমি তো কোনো কিছুই মনে করতে পারছি না।”
তরুণের গলায় বিষণ্নতা, “কিন্তু আমি কিছুতেই মনে করতে পারছি না, ঐ মুহূর্তে সে কোথায় ছিল?”
শ্মশ্রুধারীর চোখ ছলছল করতে থাকে, তিনি বলেন, “আমরা কেবল যদি মনে করতে পারতাম কোথা থেকে আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম, কখন এবং কোন পরিস্থিতিতে আমাদের এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল!”
“এবং কেন?”, তরুণ যোগ করল।
“ঠিক, এবং কেন আমরা বেরিয়ে এসেছিলাম,” তাঁকে বেশ কাহিল মনে হলো, মনে হলো এই বিষয়টা তিনি কিছু সময়ের জন্য ভুলে ছিলেন এবং তরুণটি তাঁকে ফের মনে করতে বাধ্য করছে।
তরুণ তার স্মৃতি খুঁড়ছিল এবং বলে যাচ্ছিল, “যদি আমি সত্যিই জেহানাবাদ থেকে বেরিয়ে থাকি, আমার এই মুহূর্তে যা মনে পড়ছে তা হলো বর্ষার মওসুম পার হয়েছিল এবং কোকিলেরা আমের বাগান ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আমাদের উঠোনের নিমগাছের সঙ্গে ঝোলানো দোলনাটা নামিয়ে নেওয়া হয়েছিল।” সে তার স্মৃতির অরণ্যে হারিয়ে গিয়েছিল। ওর গলার স্বর ফিকে হতে হতে এতটাই মৃদু হয়েছিল যে মনে হচ্ছিল যেন সে তার নিজের সঙ্গে কথা বলছে, “কিন্তু দোলনা নামানোর পরেও সে আমাদের বাড়িতে আসা বন্ধ করেনি”, তরুণ তার ভাবনার ডানায় ভর করে বহুদূরে সরে গিয়েছিল। ওর ফেলা আসা গতকালের বৃষ্টি ভেজা দিনগুলিতে ঘুরপাক খাচ্ছিল সে, যখন উঠোন জুড়ে হলুদ নিমফলের সুজনি পাতা থাকতো আর মেয়েটি সেই দোলনাতে চড়ে অনেক উঁচুতে দোল খেতো আর গাইত: “ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে / দোলনা দুলছে বাদলাতে। “কিন্তু সে তো বর্ষার পরেও আমাদের বাড়িতে নিয়মিত এসেছে … হ্যা, হ্যাঁ… কোনো ভুল নেই … তাহলে সেই দিনটিতে কোথায় ছিল সে ?” তরুণ আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে সেই কথাটি মনে করতে। অতঃপর বিশাদক্লিষ্ট স্বরে বলে উঠল, “আমি মনে করতে পারছি না সেই দিন সে কোথায় ছিল।”
মাথায় জখমযুক্ত মানুষটি তরুণের দিকে পলকহীন তাকিয়ে ছিল।
ঝোলাধারী জানতে চাইল, “আচ্ছা ধর যদি তুমি জেহানাবাদ না-ছেড়ে গিয়ে থাকো তবে?”
“আপনি কী বলছেন?”, অবাক বিস্ময়ে তরুণের মুখ হাঁ হয়ে গেল ।
“যেমন ধর, আমাদের শ্রদ্ধেয় মুরুব্বি যেমন বললেন, আমরা যদি তেমন করেই ঘারনাটা থেকে যাত্রা শুরু করে থাকি তবে?” ঝোলাধারীর বলার ধরনে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছিল এটা একটা অবিশ্বাস্য ভাবনা এবং সে কেবল শ্মশ্রুধারীকে খোঁচানোর জন্যই মজা করছে।
কিন্তু তরুণ ব্যাপারটি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিলো এবং অনেকক্ষণ চিন্তা করে বলল, “ঘারনাটা থেকে?” আবারও সে ভাবল খানিক এবং বিষণ্নভাবে উত্তর দিলো, “যদি আমি ঘারনাটা থেকেই যাত্রা শুরু করে থাকি তারপরেও আমার কিছুই মনে পড়ছে না।”
“যদি সত্যিই আমরা ঘারনাটা থেকে পথে নেমে থাকি,” শ্মশ্রুধারী নিচুস্বরে বলতে শুরু করে থেমে গেলেন এরপর থেমে থেমেই বললেন, “আমার চোখে ভাসছে এক টুকরো ভোরের আলো আর মসজিদ-ই- আকসা’র মিনার…।”
সশব্দে হাসির আওয়াজ এলো ঝোলাধারীর দিক থেকে। “মসজিদ-ই– আকসা ঘারনাটাতে?” বিব্রত শ্মশ্রুধারী চুপসে গেলেন। তরুণও বোকার মতো বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে রইলো। বিড়বিড় করে আওড়ালো “মসজিদ-ই- আকসা?” এরপরে সেও স্তব্ধ হয়ে রইল।
আঘাতপ্রাপ্ত লোকটি যেন আর নিতে পারছিল না। সে বলল, “আমি সত্যিই এইসবে অসুস্থবোধ করছি। কীভাবে এইসব আমাদের সেই পরিস্থিতির কথা মনে পড়াবে যার প্রেক্ষিতে আমাদের পথে নামতে হলো, কিংবা কোন সেই ঋতু অথবা এমন কি সেই শহরের নামটি যা আমরা পেছনে ফেলে এসেছি?”
“ঠিক কথা, সে পরিস্থিতি কিংবা মসজিদের নাম এইসবে কি কিছু পাল্টাবে?” শ্মশ্রুধারী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।“তারপরেও আমরা কখন বেরিয়ে এসেছি অথবা কোথা থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম যদি মনে করতে পারতাম তবে স্বস্তিকর হতো।”
“কিংবা কেন আমরা সেই জায়গা ছাড়লাম তাও”, তরুণ আবারও কথার মাঝখানে কথা জুড়ল।
“হ্যাঁ, সেটিও”
“আর,” তরুণ থামল না, “যখন যাত্রা শুরু করেছিলাম সেই সময়ের আমাদের সহযাত্রীর সংখ্যাটিও।”
শ্মশ্রুধারী ব্যাখ্যা দেওয়ার মতো করে বললেন, “সেই সময়ে আমাদের সংখ্যা সঠিক ছিলো।”
তরুণ কথাগুলো মর্মে নিল এবং জানতে চাইল, “যাত্রার শুরুতে সে কি আমাদের সঙ্গে ছিল?”
“কে?” শ্মশ্রুধারী জানতে চাইলেন।
“সে যে আর আমাদের সঙ্গে আর নেই।”
“কে?” শ্মশ্রূধারী আশ্চর্য হলেন। “এমন কেউ ছিল না সেখানে।”
“এমন কেউ ছিল না?” প্রথম জন দ্বিতীয়জনের দিকে, দ্বিতীয়জন তৃতীয়জনের দিকে তাকাল। তাদের অবাক চোখে শঙ্কা ছিল। তারা সকলে হতভম্ব হয়ে বসে রইল। মনে হচ্ছিল তারা আর কখনই কথা বলবে না। শেষমেশ তরুণটি নড়ে উঠল। উদ্গ্রীব হয়ে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করছিল সে। বিষয়টি অন্যদের নজর এড়ালো না; ওরাও কান খাড়া করল। মৃদুতম শব্দটিকেও শ্রবণসীমায় ধরার চেষ্টায় সকলে মনোযোগী শ্রোতার মতো অপেক্ষা করছিল।
“ওখানে কি কেউ আছে?”, তরুণ ফিসফিস করে জানতে চাইল।
‘হ্যাঁ বন্ধু কেউ একজন ধারে কাছেই আছে এবং সেই কারণেই কুকুরেরা চেঁচাচ্ছে,’ ঝোলাধারী ব্যক্তিটি জবাব দিলো। চারজন মানুষ পরস্পরকে দেখল।
অতঃপর তরুণ নিচুগলায় জানতে চাইল, “এটা যদি সে হয় তবে?”
“কে?”
“সে।”
শ্মশ্রুধারী রাগী দৃষ্টি হানলেন তরুণের দিকে, এরপরে আর কিছুই ভাবছিলেন না তিনি। হঠাৎ করেই যেন কিছু একটা ঘটে গেছে তাঁর ভেতরে, ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। অন্যেরাও দাঁড়াল।
যে দিক থেকে শব্দটা ভেসে আসছিল সেই দিকেই সকলে পা চালাল।
------------------------------------------------------
মূল গল্পের নাম: Those Who are lost
অনুবাদক পরিচিতি
রঞ্জনা ব্যানার্জী
গল্পকার। অনুবাদক।
কানাডায় থাকেন।
0 মন্তব্যসমূহ