এক
দুই ভাই। একে অপরকে গুলি করেছে। দু’জনেই খুন।দুটো লাশ।একজন চিৎ--অন্যজন উপুর।
তাই তো! বন্দুক এল কোত্থেকে?
গাধা! বন্দুক নয়। পিস্তল।
তাই তো! পিস্তলই বা কোত্থেকে?
গোবেচারা, সাত চড়ে রা না কাড়া, সংসার করা গেরস্ত দু’ভাই পিস্তল পাবে কোথায়?গাবলা গোবলা ছেলেমেয়ে,ফরসা-ফরসা বউ। ঝাঁকরা পাতার বাহারি গাছ টবে।লাল ঝুটি কাকাতুয়া,টিয়া সবুজ চন্দনা,কথা বলা ময়না।লাল কালো হলুদ নীল মাছ। যার শখ নেই, আহ্লাদ নেই, সে আছে বেশ।যার আছে,ঝামেলা তার।গাছে জল দাও,পাতাসার, গোবর,পাখির দানা,মাছের কেঁচো।লোক রাখো।এসব ঝামেলা। যার নেই,
আছে বেশ। শখ শৌখিনতা।দুই ভাই, দুই বউ, ছেলে মেয়ে,কাজের লোক,দেখভাল করার চাকর, চলছিল ভালোই।কিন্তু কোন গূঢ অথবা গভীর ষড়যন্ত্র, হিংসা, ক্রোধ, মনোমালিন্য, বিবাদ, প্রাণ নেওয়ার প্রস্তুতি,মনোভঙ্গি অথবা ঈর্ষা- হয়তো ছিল,-দুই ভাইয়ের মনে।
অনেকদিন ধরে, জ্ঞাতে অথবা অজ্ঞাতে, হয়তো বহন করছিল।দুই বউ দু’জনের মনে এই বিষ ঢূকিয়েছিল- হতেই পারে।বাইরের কেউ?প্রতিবেশী, পাড়া, ক্লাব, প্রভাবশালী ক্লাব সদস্য, ব্যবসার কাজে কাছে আসা মানুষ, খদ্দের, মহাজন, ব্যাংক-ম্যানেজার— কে জারিয়েছিল এই বিষ! বড় কথা, সফল হল কীভাবে!দু’চোখ হারা হত না যারা— দুই ভাই- অমল ও বিমল- জন্মাবধি কাঁধে কাঁধ, হাতে হাত।আলাদা করা যেতনা।
অমলকে মনে হত বিমল। বিমলকে ভুল করে অমল।চুলের ছাঁট, চশমার ফ্রেম,জামার কলার,বোতাম, পকেট, প্যান্টের পেছনের পকেট, সিগারেটের ব্র্যান্ড, জুতোর মাপ- সব এক।তার থেকেও বড় প্রশ্ন পিস্তল এল কোথ্থেকে!যে জীবনে স্বচ্ছলতা আর হাসি, তার মধ্যে পিস্তল কোথা থেকে এবং কেন! ডাল, ভাত, লাউঘন্ট, কাতলা কাটা, উচ্ছের ঝোল খাওয়া সংসারে পিস্তল থাকে না।ছোরা পিস্তলের জীবন অন্যরকম।অন্য কাঠামো। হিসেব মাপজোক আলাদা।সেখানে অন্ধকার, সংঘর্ষ, প্রতিশোধ।
দুই
ঘটনার দিন রাত্রে দুই ভাই দু’জনের গলা জড়িয়ে গান গেয়েছিল।অনেকে শুনেছে সেই গান।ওদের বাড়ি ছাপিয়ে রাত বারোটা নাগাদ বেসুরো ঘুম ভাঙানো, মেঘ ডাকা গান। এই প্রথম।এর আগে কোনদিন ওরা গায়নি।ওরা একসঙ্গে হাসত।সেই হাসি শোনা যেত পাড়ায় পাড়ায়।সমবেত হাসি অনেকক্ষণ একনাগাড়ে।কান্নার মত শোনাত।সেই সব রাতে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি হত।বিদ্যুত আর বাজের শব্দ।কান্নার শব্দ।সব শেষে ব্যাঙের ডাক। বাজ পড়লে শাঁখ বাজত।কান্না ও ব্যাঙের ডাকের মধ্যে শাঁখ।বেজে বেজে মাঝ রাত। অমঙ্গলের আশঙ্কায় রাতে ঘুমোতে পারত না কেউ।পুলিশী তদন্তে তিনমাস পরে এই বিষযগুলো নজরে আসে।
সমবেত গান শেষ হলে যে যার বাথরুমে।স্নান করে নেংটো হয়ে ছাদে।শ্রাবণ পূর্ণিমার সেই রাতে দুই নগ্ন ছায়াশরীর।একসঙ্গে, অনেকক্ষণ ধরে নেচেছিল।কিছু মানুষ তাদের নিজের নিজের ছাদে সন্ধে পার করে রাত বারটা পর্যন্ত মদ খেতে খেতে প্রবল নেশার ঘোরে ভূতের নাচ ভেবে ভয়ে চোখ বন্ধ করে ছাদেই ঘুমিয়ে পড়েছিল।পুলিশী তদন্তে এই ঘটনাও উঠে আসে।
তিন
একটা বাড়ি।ছিল একতলা,হল দু’তলা।বাড়ির মেঝে ছিল লাল সিমেন্ট,হল জয়পুরী মার্বেল। বাড়ির দেযাল—ছিল সাদা চুনকাম, হল প্লাস্টিক পেইন্টস।
এতে কী বোঝা যায়?
কী?
বাসিন্দারা বড়লোক হয়েছে।
দুই ভাই শত শত চক্ষু্র সা্মনে পাড়া প্রতিবেশীর নজর না এড়িয়ে বড়লোক।ব্যবসা। লোহা সিমেন্ট।জমিবাড়ি।কাগজকল।মাছমাংস।হিমঘর-আলু।ব্যবসার আইটেম বাড়ছিল।একটা একটা করে। গেরস্ত ছাপোষা। ছিল চাল বিক্রির দোকান,হয়ে গেল চালকল।দুই ভাই মালিক।আলুর দোকান। সেখান থেকে হিমঘর।কোল্ড স্টোরেজের মালিক অমল ও বিমল।একে একে সব।বাড়ি থেকে বড় বাড়ি, সাইকেল থেকে গাড়ি, বড় গাড়ি--একটা থেকে দু’টো।
দুই ভাইয়ের দুই বউ- অমলা আর বিমলা, হাতে হাত মিলিয়ে ঘরের কাজ সারত।রাঁধাবারা, বাসনমাজা, কাপড়কাচা, জলতোলা, ঘরমোছা।কাজের লোক এল।এক থেকে দুই হয়ে চার।দু’টো গাড়ির দু’জন ড্রাইভার।অফিস।তার কর্মচা্রি।বাগানের মালি।গমগম করতে থাকল দুই ভাইয়ের বাড়ি।হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া, রাজা রাজা ভাব, গরীব দুঃখীদের দান খয়রাতি।জনহিতে জনসেবা। এর মধ্যে পিস্তলের কোন জায়গা ছিল না।
দুই ভাইয়ের বাড়ির বাঁ পাশে উপেনের দু কাঠা জমি।ডানদিকে ভুপেনের দু কাঠা,পেছনে রূপেনের দু কাঠা।সব কিনে দুই ভাইয়ের জমি প্রস্থে ও দৈর্ঘ্যে সমান হল।পুরনো বাড়ি হয়ে গেল অট্টালিকা। দু পাশে ফুলের বাগান, পেছনে ফল। দুই ভাই আরো ফর্সা।লম্বায় কয়েক ইঞ্চি বার বৃদ্ধি।পাতলা হয়ে আহা চুল ঘন কালো হয়ে উঠল। অমলা বিমলা- দুই বউয়ের বয়স দশ বছর কমে টসটসে যুবতী।তাদের শরীরী ভাষায় তীব্র আবেদন।
অমলা বিমলা গাড়ি হাঁকিয়ে মার্কেটিং।শপিং মল।নিভৃতি ও নিরিবিলি।বাইরে কোন রেস্তোরায় লাঞ্চ। ভাত ঘুম অতীত।পার্লারে ফেসিয়াল,ট্যানিং,মাস্ক।মাল্টিপ্লেক্সে নতুন সিনেমা।
এত কিছুর মধ্যে পিস্তল এল কোথা থেকে?
চার
অমলের দেহে নটা গুলি।বিমলের ছটা।পিস্তল দুটো নাইন এম এম,মুঙ্গের মেড।
নটা গুলি খেয়ে বিমলকে ছটা গুলি?
ছটা গুলি খেয়ে অমলকে নটা গুলি?
এ কী সম্ভব!
তদন্ত বলছে, না সম্ভব নয়।অন্য কেউ, অন্য একাধিক।
ওদের দেহরক্ষী?
দেহরক্ষী ছিল ব্যবসায়ী অমল ও বিমলের। এত সম্পত্তি, ব্যবসার অলিগলি রাজপথ ছেড়ে কানাগলি, চোরাগলি।এক আধটা চোরাগোপ্তা, খুচরো, হইচই না ফেলা খুন জখম।ভয় দেখানো।এটুকু তো করতেই হবে।সবাই করে।ছোটখাট ব্যবসাতেই তো কত কিছু।এমন কী ঝুঁকিহীন যে জীবন,চাকরি শিক্ষকতা—ভদ্র সভ্য মানুষ, তারাও অল্প স্বল্প মারামারি ঘুসোঘুসি।বউকে আওয়াজ দিয়েছে, তো ব্যাঙ্কের কেরানি হেভি পিটিয়ে দিল পাড়ার পাঁচু বা জগাকে।মেয়ের দুল ছিনতাইয়ের ব্যর্থ চেষ্টা, হাতেনাতে ধরে মালটার ছাল ছাড়িয়ে দিল সরকারি কর্মচারি।আর এখানে,দুই ভাইয়ের ব্যবসা কোটি ছাড়িয়ে একশ কোটি।কুড়ি পঁচিশ কোটির হরদম লেনদেন।দেহরক্ষী লাগবে না?তিনটে ল্যাব্রাডর, দুটো জার্মান শেফার্ড—পাঁচটা বাঘ রাতে শিকল খোলা।মশা মাছি পর্যন্ত বাড়িতে ঢুকত না।
পাঁচটা কুকুরই ঘুমাচ্ছিল।ঘুমের ওষুধ।মাত্রা বেশি হওয়ায় দুটো ফিনিশ।প্রধান দরজার পাথর সমান তালা খোলা, তালা থেকে চাবি ঝুলছিল, হাওয়ায় দুলছিল। রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজের সব উপাদান পুলিশের হাতে।কিছু একটা না হয়ে যায় না। পাশাপাশি ছাদ থেকে মদ খেতে খেতে ভয় পেয়ে ঘুমিয়ে পড়া মানুষেরা দুই ভাইয়ের উলঙ্গ নাচ দেখেছিল। পুলিশের হিসেবে মৃত্যুর সময় রাত এগারোটা।নাচের সময় ছিল বারোটা।ভূত হতে পারে।যদি ভূত, তবেই না নাচ! কিন্তু পিস্তল?নয় আর ছয় পনেরোটা গুলি। কুকুরের ঘুম।কিছুতেই হিসেব মিলছিল না।
দেহরক্ষীরা গ্রেফতার।দু’জন ড্রাইভার আটক।সন্দেহ, তারাও ছিল ঘটনার সময়।কিন্তু এমন একজন, যাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না—অথচ সে ছিল—ড্রাইভার বা দেহরক্ষীদের কেউ তার নাম বলতে পারছে না— ছিল যে তার প্রমাণ আছে—চেহারার বিবরণ পাওয়া গেছে টুকরো টুকরো।সব বিবরণ একত্র করে যা পাওয়া যাচ্ছে, তার সঙ্গে অমল ও বিমলের অবিকল সাদৃশ্য।পুলিশের তদন্তে সন্দেভাজন ওই ব্যক্তির নাম দেওয়া হয়েছে কমল।
পাঁচ
-প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে খুন।হয়েই চলেছে এই পৃথিবীতে।
কথাটা যিনি বললেন তাকেও দেখতে অমল অথবা বিমলের মত।ইনি একজন সরকারি কর্মচারি। অনেক দিনের চাকরি।টাকাপয়সায় অধুনা বিত্তবান।তার কথার ওজন আছে।আশেপাশে লোকজন মান্যগন্য করে।
-খুনের বদলা খুন হতে পারে না। অথচ তাই হচ্ছে।খুনোখুনিতে ব্যস্ত যারা তারা সমাজের মূল স্রোতে থেকেও বিচ্ছিন্ন।এটা সময়ের সংকট।এর থেকে মুক্তির উপায় ত দেখছি না।
-কিন্তু যে হারে খুন বাড়ছে!খুন, ধর্যণ, প্রতিশোধ, হিংসা—
কথা হচ্ছিল দুই ভাইয়ের খুন হওয়া নিয়ে।কীভাবে হল—সে তো পুলিশের কাজ বের করা। আমরা বিব্রত এবং চিন্তিত খুন হওয়া নিয়ে।মহামারী যেন।সংক্রামক।সুযোগ পেলেই মেরে দিচ্ছে। অসহিষ্ণুতা— বক্তাকে ঘিরে অনেকে।অমল-বিমলের প্রতিবেশী,পাড়ার লোকজন,দূরের পাড়া থেকে আসা কিছু মানুষ। সকলেরই মনে হয় সমাধানযোগ্য খুনের এই সমীকরণ।একটা দুটো চারটে ষোলটা—জ্যামিতিক প্রগতি অনুসারী।পিস্তলের গুলির সংখ্যা আরো আরো।
লক্ষ লক্ষ অনুদঘাটিত হত্যা রহস্যে নতুনতর সংযোজন অমল ও বিমল।আশ্চর্য মানসিক দৃঢ়তা দেখাল অমলা ও বিমলা।একমাসের মধ্যেই হাল ধরেছে।ব্যবসার খুঁটিনাটি আয়ত্তে।তরুণী দুই বিধবা,চোখের জলের দাগ মোছেনি, শোকের সময় নেই, অগাধ সম্পত্তি বারো ভূতে লুটে খাবে, ওত পেতে খুনিরা।ভাড়াটে সুপারি কিলার।দ্রাইভার ছিল ,দেহরক্ষী ছিল— সুযোগ দেয়নি কাউকে, নিপুণ দক্ষতায় পেশাদার খুনি,গুলির পর গুলি শক্তহাতে অমলা ও বিমলা।দাঁতে দাঁত।বুকে সাহস।টাকার হিসেব।কপালে চোখ।এত টাকা! ছাপোষা মানুষ দু’জন—কবে কামালো!কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি।সোজা পথ থেকে কানাগলি,চোরাগলি, এফোঁড় ওফোঁড়—পিস্তলের গুলির মতো।ছারখার হয়ে গেছে সামনে আসা বিরোধ অথবা প্রতিযোগিতা।একে টপকে ওকে মাড়িয়ে, দু-পাঁচটা অবাঞ্ছিত জন্মের মতো হাপিস।খুনোখুনি তো অনেক আগে থেকেই—
-আমার এখানে পৌঁছতে লাগল তিরিশ বছর।এতদিনে এই স্বচ্ছলতা।একটা ছোট গাড়ি, মাথা গোঁজারথেকে সামান্য বড় মাপের একটা ফ্ল্যাট, মেয়ের বিয়ে দিতে পারার মত ব্যাংক ব্যালান্স আর নির্দোয ফুর্তির জন্য অল্প সঞ্চয়। এসব যদি শুরুর পাঁচ বছ্রে এসে যেত, কি বলতেন?
- কী বলতাম?
- দু নম্বরি।ঘুসখোর।চোরাকারবারি।
- এই হয়।স্মরণ করুন আঙুল ফুলে কলাগাছ প্রবাদটা, আর মিলিয়ে নিন।অমল-বিমল, মনে আছেসাইকেল চালিয়ে বাড়ি বাড়ি চাল দিত।আমাকেও। সস্তার চাল। তারপর মুদির দোকান। মাসকাবারি ডাল তেল চিনি আটা— ওদের দোকান থেকেই তো! তারপর? হিসেবে আসছে না।এত তাড়াতাড়ি?
এখানেই পিস্তলের রহস্য। পিস্তলের গুলি। পিস্তল হাতে খুনি। খুনির হাতে খুন।খুনের পর খুনির খোঁজ না পাওয়া।
ছয়
পূর্ণিমার রাত আসে যায়।চাঁদের আলোয় উপর থেকে ছাদে নেমে আসে অমল ও বিমল।নীচ থেকে উপরের
ছাদে উঠে যায় অমলা ও বিমলা।হিসেব নিকেশ চলে।পরামর্শ।টাকা পয়সা কোথায় কোথায়,কীভাবে আরো
টাকা,আরো সম্পত্তি।সোজারাস্তা,আঁকাবাঁকা চোরাগলি, রাস্তার বাঁক, বাঁকে বাঁকে চোরাগোপ্তার ফাঁদ—সব
চেনাজানা হয়ে গেলে চারজন প্লাবিত জ্যোৎস্নায় নাচে।হাততালি, হাসি, ঢ্যাবঢ্যাবে মাদলের বেতাল বেসুরো
গানের কলি আর নাচ।
আশেপাশের ছাদে ছাদে জ্যোৎস্নায় মানুষ।মাতাল চোখে নারী-পুরুষ, ছেলে-মেয়ে, স্বামী-স্ত্রী, পাড়া-প্রতিবেশী
পূর্ণিমার রাতে চারজনের শরীর অশরীর নাচ দেখে।
0 মন্তব্যসমূহ