ফ্রিল্যান্ডের আজ মহান স্বাধীনতা দিবস। দেশটির স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষ্যে সরকার একটি মহান প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। এক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দেশটির রাজধানী ফ্রিডম শহরে প্রতিষ্ঠিত হয় এক উচ্চতর গবেষণা কেন্দ্র। দেশি-বিদেশি বিজ্ঞানীরা সেখানে একসঙ্গে মিলে এক বছর তিন মাস দশ দিন গবেষণা করে একটি চিপ আবিষ্কার করেছেন। মানব সভ্যতার অগ্রগতি ও নাগরিক অধিকারের ইতিহাসে অভূতপূর্ব আবিষ্কার। বিশ্বের বড়ো বড়ো দেশের প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতি এই আবিষ্কারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
নবজাতকের টিকা প্রদান কাযক্রমের মতোই জন্ম হওয়ার পর চিপটি শিশুদের পেছনে মাথার নিচে ডানপাশে খুব সামান্য একটা অপারেশনের মাধ্যমে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হবে। এরপর আমৃত্যু থাকবে শরীরে। তবে চিপের উৎপাদনে সংকট থাকার কারণে প্রথম পর্যায়ে কেবল প্রাপ্তবয়স্কদের দেওয়া হবে বলে সংসদে ঠিক করা হয়। কিন্তু মাসকতক পর দেখা গেল নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পর্যাপ্ত চিপ উৎপাদন করা সম্ভব হয়নি। তাই নতুন করে ঠিক করা হলো কাজটি কয়েক ধাপে সম্পন্ন হবে। প্রথম ধাপে সরকারি বেসরকারি দলের রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের দেওয়া হবে। অগ্রাধিকারভিত্তিকে সরকারের কয়েকজন সিনিয়র সচিবও পাবেন। সরকার এই ঘোষণা দেওয়ার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা তাদের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন। কয়েকজন সিনিয়র অধ্যাপক চাকরি হারানোর তোয়াক্কা না করে একটি জাতীয় দৈনিকে সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়ে বসলেন। আমলাদের চেয়ে অধিক গুরুত্ব দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কথা সরকারের ভাবা উচিত ছিল। কারণ পনেরো বছরের স্বৈরশাসক হটিয়ে এই গণতান্ত্রিক সরকারকে ক্ষমতায় আনার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান শিক্ষকদের।
এই বিবৃতির ফলে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সংসদের পরবর্তী অধিবেশনে বিলে সংশোধনী আনা হলো। প্রথম পর্যায়ে যারা এই বিশেষ চিপসেট পাবেন তাদের সঙ্গে যুক্ত হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের নাম। কিন্তুঅধ্যাপকদের এই সুবিধা দেওয়া হবে শুনে দেশের লেখক-শিল্পীদের সম্মিলিত জোটও আরেকটি বিবৃতি প্রকাশ করে বসলেন। স্বৈরশাসক ক্ষমতায় থাকার সময় সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হয়েছেন দেশের লেখকশিল্পীরা। ফলে এই উদার গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে তাদের প্রত্যাশা অনেক বেশি। রাষ্ট্রীয় যে কোনো ক্ষেত্রে অধ্যাপক-আমলাদের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নন লেখকশিল্পীরা। লেখক-শিল্পীদের কদর যে জাতি করে না, সে জাতির ধ্বংস অনিবার্য।
এইরকম কথার পর আর কোনো কথা থাকে না। ফলে সরকার তৃতীয়বারের মতো সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে প্রাথমিক পর্যায়ে লেখকশিল্পীদের প্রতিনিধি হিসেবে একশোজনকে এই চিপ দেওয়া হবে বলে জানাল। এরপর অগ্রাধিকারভিত্তিকে আরও পাঁচশো লেখকশিল্পীকে দেওয়া হবে পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে। সেই সঙ্গে দেশের অন্যান্য শিক্ষিত মানুষদের দেওয়ার কার্যক্রম শুরু হবে প্রথমে সরকারি কর্মকর্তাদের। এরপর পাবেন যারা ন্যূনতম উচ্চমাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। ক্রমেই দেশের অন্যান্য প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক এই সুবিধা পাবেন। যারা চিপসেট পাবে, তারাই কেবল যে-কোনো বিষয়ে মত-প্রকাশের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা পাবে। চিপসেটের বিষয়টি একধরনের জাতীয় অনুমোদন-সনদের মতো কাজ করবে। এক্ষেত্রে অনুমোদনপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সরকারি কোনো সিদ্ধান্ত কিংবা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সমালোচনা করলে তিরস্কৃত তো হবেনই না বরঞ্চ পুরস্কৃত হবেন। প্রধানমন্ত্রী নিজ হাতে বছরের শ্রেষ্ঠ সমালোচকের হাতে এই পুরস্কার তুলে দেবেন। এছাড়াও বছরের অন্যান্য সময়ও নানাভাবে প্রণোদনা দেওয়া হবে।
আজ ১লা জানুয়ারি, স্বাধীনতা দিবসে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী, একজন জাতীয় অধ্যাপক এবং একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রপরিচালকের মাথায় চিপ সেট করার মধ্য দিয়ে এই মহান কার্যক্রমের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করা হবে।
দেশের মিডিয়াগুলো ফ্রন্ট পেইজ এই আনন্দ সংবাদে ভরে ফেলেছে। ব্রেকিংনিউজ ঝুলে আছে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে। স্বাধীনতার মাত্র পঁচিশ বছরে ফ্রিল্যান্ড এমন একটা কাজ করতে যাচ্ছে যা পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোনো রাষ্ট্র করতে পারেনি। দেশটির সংগ্রামী ইতিহাসে দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পরাধীন জাতি হিসেবে থাকতে হয়েছে। জনসাধারণ স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করল সামনে থেকে অথচ যুদ্ধজয়ের পরপরই ক্ষমতা চলে গেল সেনাবাহিনীর হাতে। নামেই স্বাধীনতা। দশ বছর আরেক ধরনের পরাধীনতার ভেতর দিয়ে যায় ফ্রিল্যান্ড। নিজেদের গড়া সেনাবাহিনীর সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধ করে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা নেয় দেশটির ফ্রি মুভমেন্ট পার্টি। কিন্তু কিসের কী! কিছুদিন পরই দলটি একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে বসে। নির্বাচন উঠিয়ে দিয়ে টানা পনের বছর ক্ষমতায় ছিল। শেষ দিকে এসে তো মানুষ মতপ্রকাশ করার বিষয়টিই ভুলে যেতে বসেছিল। একজন কৃষক খুব সরলভাবে গাঁয়ের মোড়ে শুধু বলেছিল, দেশের কৃষকরা ভালো নেই। অমনি কৃষি মন্ত্রীর বিরুদ্ধে চলে গেল তার কথা। পরদিনই কৃষক জেলে। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক পড়াচ্ছিলেন ‘শ্রেণিব্যবস্থা’, তার বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ কেইস হয়ে গেল। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে দেশদ্রোহী ‘খেতাব’ পেল দেশটির স্বাধীনতাযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার। ভালোবাসার কোনো জাতধর্ম নেই, এই কথা বলে ধর্মানুভূতিতে আঘাতহানার কারণে জেলে গেল কলেজের ধর্মশিক্ষার শিক্ষক। শুধু রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে না, এর একটা প্রভাব সামাজিক ও পারিবারিক ক্ষেত্রেও পড়েছিল। হবু শ্বশুর হয়ত পাত্রকে জিজ্ঞেস করল, তোমার মত কি বাবা? পাত্রের বাবা তখন বলে উঠলেন, ওর আবার কিসের মত! কিংবা ডাক্তারের কাছে হয়ত রোগী জানতে চাইল, অপারেশনের বিষয়ে আপনার কি মত ডাক্তার সাহেব? ডাক্তার তখন ভূত দেখার মতো চমকে বলে উঠলেন, না, না, আমার কোনো মত নেই। আমি লিখে দিচ্ছি, আপনার যা করার করবেন।
এসব কারণেও মানুষের ভেতর ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। একটা পর্যায়ে রক্তক্ষয়ী গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শাসনক্ষমতা থেকে ফ্রি মুভমেন্ট পার্টির পতন ঘটে। এই গণ-আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল জাতীয় ডেমোক্রেট পার্টি।
সরকার ঘোষণা দিয়েছে এখন থেকে জনগণ সত্যিকারের স্বাধীনতা উপভোগ করবে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা শতভাগ নিশ্চিত করা হবে। লেখকরাও যা ইচ্ছা লিখতে পারবেন। স্বাধীনভাবে নাটক সিনেমা বানাতে পারবেন পরিচালকরা। কারো স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবে না সরকার। অনলাইনে মুক্তমতবিরোধী যে আইন আগের সরকার প্রণয়ন করেছিল সেটা বাতিল করা হবে মানুষের মস্তিষ্কে এই চিপসেট প্রতিস্থাপন কার্যক্রম উদ্বোধন করার মঞ্চে। যেদিন দেশের শতভাগ চিপসেট প্রতিস্থাপন সম্পন্ন হবে সেদিন থেকে দেশের শতভাগ মানুষ মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে শতভাগ স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারবে।
এই স্বাধীনতার পেছনে সরকারের সদিচ্ছাই প্রধান। প্রধানমন্ত্রী এই সেদিনও বললেন ভলতেয়ারের সেই অসামান্য কথা, “তোমার মতের সঙ্গে আমি হয়তা একমত নাও হতে পারি; কিন্তু তোমার মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য আমি আমার জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করে যাবো।” এই চিন্তা থেকেই তিনি হয়তো চিপসেটের মহাপ্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেন।
সরকারের এই উদার বৈপ্লবিক চিন্তার পেছনে চিপসেটের একটা ভূমিকা অবশ্যই আছে। মানুষের মস্তিষ্কে সরকার ও জাতীয়ধর্ম বিরোধী কোনো চিন্তা মাথায় এলেই একটা মৃদু ভাইব্রেশন হবে। তবে কতটা মৃদু এখনই বলা যাচ্ছে না। চিপসেটে কিছু সেট প্রোগ্রাম আছে, সেখানে মানুষ কতটুকু ভাবতে পারবে না-পারবে সে বিষয়ে নীতিমালা দেওয়া আছে। নীতিমালার বাইরে গেলেই ভাইব্রেশনটা হবে। নীতিমালাগুলো তৈরি করেছেন দেশের ক্ষমতাসীন দলের বিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতা, দলীয় বুদ্ধিজীবী, জ্যেষ্ঠ আমলা ও ধর্মীয় নেতারা বসে।
শাস্তি হিসেবে কমিটির প্রস্তাব ছিল, প্রথম ভাইব্রেশনে বিশ হাজার টাকা জরিমানা অথবা এক বছরের জেল। দ্বিতীয় ভাইব্রেশনে পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা অথবা পাঁচ বছরের জেল। তৃতীয় ভাইব্রেশনে এক লক্ষ টাকার জরিমানা অথবা অনাদায়ী হলে দশ বছরের জেল। জেলে থাকা অবস্থায় যদি ভাইব্রেশন হয় তাহলে শাস্তির প্রথম মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু হবে। দশম ভাইব্রেশনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
কিন্তু শাস্তির এই প্রস্তাবে সরকারের উপদেষ্টা কমিটি ভেটো দেয়। প্রথমত, দেশের বাহাত্তর ভাগ মানুষ যেহেতু দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে তাই অধিকাংশ মানুষের পক্ষে অর্থদ- দেওয়া সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, দেশে অপরাধ এমনিতেই এত বেশি যে জেলে এরিমধ্যে স্থানের সংকট দেখা দিয়েছে। এই সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় শাস্তি হিসেবে তাদের বিকল্প প্রস্তাব হলো, ভাইব্রেশনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মস্তিষ্কের ক্ষয় হবে। প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ভাইব্রেশনে স্মৃতির কতটা ক্ষয় হবে এ বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা না থাকলেও জানানো হয়েছে যে, চতুর্থ থেকে পঞ্চম ভাইব্রেশনে মানুষের বুদ্ধিমত্তা সম্পূর্ণ লোপ পেতে পারে। পঞ্চম থেকে সপ্তম ভাইব্রেশনে গিয়ে স্মৃতিশক্তি সম্পূর্ণ নষ্ট হবে অথবা পাগল হয়ে যেতে পারে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে যদি দশম ভাইব্রেশন পর্যন্ত ওঠে, তাহলে নিশ্চিত মৃত্যু। কিন্তু অল্প সময় বলতে মধ্যবর্তী ব্যবধানটা ঠিক কত সেটি নির্দিষ্ট করে বলে দেওয়া হয়নি।
উপদেষ্টা কমিটির বিকল্প প্রস্তাব সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে শাস্তি হিসেবে চূড়ান্তভাবে গৃহীত হলে দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো আপত্তি তোলে। কিন্তু যেহেতু দেশের মানুষ মতপ্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা পাচ্ছে এবং যেহেতু দেশের দুর্বৃত্ত ও বিশৃঙ্খল সৃষ্টিকারীরা দেশটির বহুল প্রতীক্ষিত ও কাঙ্ক্ষিত গণতান্ত্রিক সরকার এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে এমন কথা মুখে আনা বা লেখা তো দূরের কথা চিন্তাও করতে পারবে না, তাই সংগঠনগুলোর আপত্তি সাধারণ জনগণ এবং বুদ্ধিজীবীদের সন্তুষ্টির মুখে টেকেনি। মতপ্রকাশের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা পেয়ে সাংবাদিক থেকে শুরু করে লেখক ও শিল্পীসমাজও যারপরনাই আপ্লুত ও আনন্দিত।
আইসিটি অ্যাক্ট রদ এবং মানুষের মস্তিষ্কে সেলফ সেনসর্ড চিপসেট প্রতিস্থাপনের মধ্য দিয়ে ফ্রিল্যান্ডের পঁচিশতম মহান স্বাধীনতা দিবস উদযাপন মানুষের বাক-স্বাধীনতার একটি অনন্য অসাধারণ দৃষ্টান্ত হয়ে রইল।
0 মন্তব্যসমূহ