নুসরাত সুলতানা'র গল্প: সাতটি পিতলের ড্যাগ






ভীষণ ভয় আর উৎকণ্ঠায় সেদিন রাতে ছেলেকে নিয়ে ঘুমাতে আসে মজিদ খান ও তার স্ত্রী সায়রা বানু।

মজিদ খান হাঁক দিয়ে স্ত্রী সায়রা বানুকে মশারির চারিপাশ ভালো করে গুঁজে দিতে বলে। সাথে সাথে উঁচু করে বিছানার চারপ্রান্তে বালিশও দিয়ে রাখে সায়রা বানু । ঘরের মাঝখানের রুমে আজ ঘুমাতে আসে তারা। রুমে প্রবেশ করার দরোজার খিল ভালো করে এঁটে দেয় মজিদ। সৈয়দকে তারা ঘুমাতে নেয় দুজনের মাঝখানে। সৈয়দের বয়স একুশ বছর, গায়ের রঙ হলুদাভ, বেশ চওড়া কপাল, খাড়া নাক, ডাগর কালো চোখ। যেই একবার তাকায়, মায়া পড়ে যায়। আর ব্যবহার ও খুব অমায়িক। সায়রা বানু ছেলেকে বলে, বাজান তুমি ঘুমাও আমি হারা রাইত পাহারা দিই। স্বামী মজিদকে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে , আপনে কি সর্বনাশ কল্লেন? আমার বাজানের যদি কিছু অয়, আমি আপনেরে ছাড়মু না মনে রাইখখেন। মজিদ শ্লেষে উত্তর দেয়, চুপ কর চুতমারানি খানকি মাগী। আমি গরু কাইট্টা দিমু চরমোনাই পীরের মাজারে। তুই এহন ঘুমা। আর মশারির চারপাশে কোনো ছেদা নাই। কোনহান দিয়া কী আইবে? তুই বাজে চিন্তা বাদ দিয়া আল্লাহর নাম নিয়া ঘুমা।
সায়রা বানু সারাটা রাত প্রায় জেগেই কাটিয়ে দেয়। সারাক্ষণ নিঃশব্দে আয়াতুল কুরসি পড়ে ছেলের গায়ে ফু দিতে থাকে। আর দুহাত তুলে, প্রার্থনায় বলে, "হে মাবুদে এলাহী, হে পরোয়ারদিগার,

আমার বাজানরে আমি আপনের জিম্মায় রাখলাম। অই লোভী মানুষটার শাস্তি আপনে আমারে আর আমার বাজানরে দিয়েন না।" এসব চিন্তা আর দোয়া-দরুদ পড়তে পড়তে কখন যে সায়রা ঘুমিয়ে পড়ে সেটা নিজেও টের পায় না। তখন রাত সম্ভবত তিনটা বাজে।

রাত তিনটার দিকে সৈয়দ ও মাহ! বলে চিৎকার করে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে সিথানে রাখা হারিকেন এর আলো বাড়ায় মজিদ। ডাক দেয় সায়রা বানুকে। সায়রা তখন গভীর ঘুমে। মজিদের ডাক শুনে পড়িমরি করে উঠে বসে সৈয়দের মা। ক্ষতস্থানে হারিকেন ধরে দেখে দুইটা বড় দাগ। কামড় দেয়ার স্থানে দুইপাশে দুইটা দাঁতের চিহ্ন।

মজিদ বলে, শিগগিরই পায়ে বান দে। বিষ জানি উফরে ওটতে না পারে। সায়রা বানু পরার শাড়ি ছিড়ে এনে পায়ের মধ্যিখানে শক্ত করে বেধে দিতে নেয়।

মজিদ খান বলে, এই মাগী তুই আমার পোলা ধরিস না কারণ তুই অর মা। আর উনারা কামড় দিলে মায়ের পুত ছুঁইতে অয় না। তুই হুগনা মরিচ টাইল্লা আন শিগগিরই। আর আমি অই ঘরের পোলাগো ডাক পাড়ি। ইতিমধ্যে সৈয়দ শুরু করেছে চিৎকার। ওহ! মাহ খুব ব্যথা করছে! শুরু হয়েছে প্রচুর রক্তপাত, ঝাপসা হয়ে আসছে সৈয়দের চোখ। সায়রা বানু ভেজে নিয়ে এসেছে পাঁচটা শুকনো মরিচ। সৈয়দ মুখে নিয়ে চিবাতে শুরু করতেই চোখ বন্ধ হয়ে আসে তার।

সায়রা বানু চিৎকার শুরু করে, স্বামীকে মিনতি করে বলে, আমনের পায় ধরি মুই। অই ঘরের পোলাগো ডাকেন, ওঝা ডাকতে পাডান, আমার বাজানরে বাঁচান।

ও নজরুল, ও আবুয়াল, ও হাবি তোগো মেভাইরে বাঁচা।

রাত তখন চারটার কিছু কম। ফাল্গুন মাসের হালকা বৃষ্টি শেষে আকাশ পরিস্কার হয়ে চাঁদ উঠেছে।

রাতকে মনে হচ্ছে সদ্য প্রসূত যুবতী মায়ের মতো কমনীয় আর মোহনীয়।

মজিদ খানের ডাকে ঘুম ভেঙে আসে তার ভাইয়ের ছেলে আবুয়াল আর হাবিব। এসেই উৎকন্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করে , দুদু কি অইছে? মজিদ কপাল চাপড়ে বলে, কপাল পোড়ছে! আমার সৈয়দরে সাপে কামড়াইছে। শিগগিরই কাশেম ওঝারে ডাইক্কা লইয়ায়।

কশেম ওঝারে ডাকতে যায় আবুয়াল আর হাবিব। কাশেম ওঝা আবুয়াল এর ডাকে ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে বলে, কি অইছে? চার ফিট আট ইঞ্চি উচ্চতার কাশেম ওঝার পেট অব্দি দাড়ি, কিন্তু মাথায় টাক, চোখগুলো অসম্ভব রকমের ছোট আর ভেতরে ঢোকানো। কাশেম ওঝা সব শুনে বলে, রোগীর অবস্থা ভালো না। এইরকম রোগী চিকিৎসা করতে ওস্তাদজীর মানা আছে। আমি যাইতে পারমু না। আবুয়াল আর হাবিব খুব অনুরোধ করে বলে, কাশেম চাচা চল, সৈয়দ ভাইরে বাঁচাও। দুদু তোমারে অনেক টাহা দেবে। কাশেম ওঝা অনড় হয়ে বসে রইলো। হাবিব আর আবুয়াল হন্যে হয়ে ছোটে পাশের গ্রাম লামচরী। অইখানে আছে বিখ্যাত ওঝা সুবিনয় কর্মকার। আবুয়াল আর হাবিব গিয়ে সুবিনয়ের বাড়িতে পৌঁছায় তখন সকাল সাড়ে ছয়টা বাজে। সুবিনয় তখন যোগাসনে ধ্যানে ব্যস্ত। সুবিনয়ের বয়স মাত্র পঁয়তাল্লিশ। কিন্তু কণ্ঠ বেশ রাশভারী, আর চাহনি খুব গভীর। সুবিনয়ের স্ত্রী সুরবালা এসে ওদেরকে ঘরের বাইরে বসার পিড়া দেয়। একটা লাল প্লাষ্টিকের বাটিতে নিয়ে আসে নারকেল এর নাড়ু ও চিড়া ভাজা। আবুয়াল আর হাবিব দুজনেই সুরবালা কে খুব অনুরোধ করে বলে, বৌদি সৈয়দ দাদাকে সাপে কাটছে, দুদুর একমাত্র পোলা। তুমি সুবিনয় দাদারে কও না আমাগো লগে যাইতে। টাকা-পয়সা যা চায় দুদু দেবে। সাতটার সময় সুবিনয়ের ধ্যান শেষ হয়। সুবিনয় যখন কথা বলা শুরু করে মনে হয় যেন সমুদ্রের গর্জন শুরু হয়েছে। গমগমে গলায় সুবিনয় শুধায়, কি রে সুরবালা কারা আইছে সকাল সকাল? সুরবালা বলে, বড় বিপদে পড়ে আইছে গো। তুমি এট্টু দেহ না কি করতে পারো! সুবিনয় আগন্তুকদের তার কাছে পাঠাতে বলে।

অইদিকে দুইঘন্টা পর্যন্ত সৈয়দের চোখ বিভিন্ন ভাবে খোলা রাখা সম্ভব হয়েছিল। তারপর আর কোনোভাবেই চোখ খোলা রাখতে পারছে না সৈয়দ। ক্ষতস্থানে ফুলে উঠেছে। ধীরে ধীরে ফুলতে আরম্ভ করেছে সমস্ত ডান পা। সায়রা বানু মূর্ছা যাচ্ছে বারবার আর বিলাপ করছে, আমার বাজানরে অই হারামি ব্যাটা মাইরা ফালাইলো। গ্রামের সমস্ত মহিলারা চোখের জলে বলে, আল্লাহরে ডাকো বুজি। আল্লাহই সবকিছুর মালিক।

সুবিনয় আবুয়ালকে জিজ্ঞেস করে রোগীর বয়স কত?

আর কখন কামড়েছে? আবুয়াল যখন জানায় সৈয়দ এর বয়স একুশ বছর আর সাপে কামড়েছে আনুমানিক রাত তিনটায়। কিন্তু মশারি চারিদিক দিয়ে খুব ভালো করে গোঁজা ছিল। সুবিনয় বলে, তোমরা একটু অইদিকে গিয়া বস আমি দশ মিনিট পরে তোমাগো জানাইতেছি যামু কিনা। দশ মিনিট পরে সুবিনয় জানায়, সাপ ডান পায়ে কামড় দিছে। এই সাপ কোনো সাধারণ সাপ না। সাপের গায়ের রঙ কমলা এবং মাথায় সবুজ মুকুট আছে। এই রোগীকে সারিয়ে তোলা সম্ভব না। আর ধ্যানে আমার গুরু আইনুদ্দিন ওঝা আমারে মানা করছে এই রোগী দ্যাকতে।

ততক্ষণে সৈয়দ গভীর ঘুমে। শ্বাস- প্রশ্বাস হয়তো বা আছে, কিন্তু কোনো চেতন নাই। অবশেষে প্রতিবশী রব হাওলাদার রওয়ানা দেয় ফরিদপুরের দিকে বিখ্যাত ওঝা মাইনুদ্দিনের খোঁজে। এলাকার মানুষ বলাবলি করতে লাগলো, মাইনুদ্দিন ওঝা মরণের মুখ দিয়া রুগী ফেরত আনতে পারে। আর সাপে কাটলে তিনদিন ধরে পরাণ থাহে। আউক মাইনুদ্দিন ওঝা। মাইনুদ্দিন ওঝা এসে পৌঁছালো আছর নামাযের ওয়াক্তে। মাইনুদ্দিন এসে দেখেই বলে, চেহারা তো কালা অইয়া গ্যাছে! রুগী তো নাই! দাফন করে দেন। মজিদ খান মাইনুদ্দিন ওঝাকে লাঠি নিয়া মারতে আসে। কুতকুতে কালো মাইনুদ্দিন হাসতে হাসতে বলে ঘটনা তাইলে এই! উনি কি অন এই রুগীর?

সমবেত জনতা বলে বাপ। মাইনুদ্দিন বলে, ও আল্লার মাইর আলমের বাইর। এই বলে মাইনুদ্দিন বের হয়ে যায়। তাকে খাওয়া দাওয়া করতে বললে, মাইনুদ্দিন জানায় এই বাড়িতে সে একটা দানাও স্পর্শ করবে না।

চরবাড়িয়া গ্রামের খুব কম মানুষই বাকি আছে মজিদ খানের গালি খেতে। মজিদ বাড়ি বাড়ি দুধ ফেরী করে বেশ উপার্জন করে। এলাকার কোনো বিধবা নারীর বাড়িতে দুধ ফেরী করতে গিয়ে তাকায় তার ভরাট বুকের দিকে আর বিড়বিড় করে বলে, এহ রাঢ়ী মাগি দুধ খাইয়া আরও দুধওয়ালী অইবে! তারপর ও এলাকার মানুষ রান্না করে দিয়ে যাচ্ছে ডাল-ভাত, মাছ- তরকারি। আজ আর উনুনে আগুন ধরানো হয়নি। সায়রা বানুর চোখ কোটরে ঢুকে গেছে। মুখে দিচ্ছে না কুটোটিও। তার মন শুধু একই কথা জপ করে বারবার ; হাজেরা আর আমেনা এই দুই মেয়ের পরে আল্লাহ তাকে দিয়েছিল অমন সোনার বরণের রাজপুত্র। তার লোভী, দুষ্ট স্বামীর জন্যই তাকে হারাতে হল।

এরপর লোকমুখে শোনা গেল ঝালকাঠির দেবকান্তি ওঝা নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রোগীকে বাঁচাতে পারে। দুইদিন পরেও চিকিৎসা করে সে মানুষ বাঁচিয়েছে। ঝালকাঠি রওয়ানা দেয় আবুয়াল আর হাবীব। স্বল্পভাষী, বিনয়ী সৈয়দ মিয়া ভাই তাদের খুবই প্রিয়। সে যেন বেঁচে ওঠে সেটা তারা মনে-প্রাণে চায়। দেব কান্তি ওঝা পৌঁছালো রাত এগারোটায়। এসেই জানালো, আগে মনসা দেবীর পুজার ব্যবস্থা করতে হবে। তার জন্য পাঁচ রকমের পাতা, সাত রকমের ফুল, খই ভাজা, চিরা ভাজা, সন্দেশ আর লাগবে মোমবাতি। আগামীকাল সকাল সকাল আমি যোজ্ঞি শুরু করতে চাই। রাতটা রোগীর ডান হাতের কনুই আঙুলে একটা আংটি পরিয়ে দিচ্ছি। অই আংটিই তার রক্ষাকবচ। আগামীকাল বেলা আছরের ভেতর রোগী চোখ মেলবে ভগবান যদি চায়।

সকালে দই, চিড়া, পাঁচটা রসগোল্লা খেয়ে দেবকান্তি ওঝা আরম্ভ করল পুজা। মনসা দেবীর নামে পুজা দিয়ে শুরু করল তিন ওঝা বীন বাজানো আর বিষ নামানোর ঝাড়ফুক ও তন্ত্রমন্ত্র। আছর তো ভালো মাগরিব ও এসে গেল সৈয়দ আর চোখ খুল্ল না। অবশেষে দেবকান্তি ওঝা বল্ল, কি ঘটনা! আমার ধ্যান করতে অইবে। আধাঘন্টা ধ্যান শেষে বল্ল, মা মনসার খুব কাছের কারো স্বার্থে আঘাত লাগছে। তাই অই সাপকে মা মনসা নিষেধ করে দিছে আইতে। এই রোগীকে বাঁচানো সম্ভব না। কথা ছিলো দশ হাজার টাকা দেয়ার।

পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে দেবকান্তি ওঝা বেরিয়ে যায়।

শোকের মাতম ওঠে সমস্ত চরবাড়িয়া জুড়ে। প্রায় হাজার পাঁচেক লোক হয় সৈয়দের জানাযায়। লোকমুখে ফেরে সৈয়দের সল্পভাষীতা আর ভদ্রতা। বলে, মজিদ খানের পোলা এমন কেমনে অইছিল! তাই বুঝি আল্লাহ রাখলো না। বড় ভালো ছেলে ছিল!

তিনদিনের দিন দাফন করা হয় সৈয়দকে। সৈয়দকে দাফন করে ঘরের দরোজায় বসে কবরের দিকে তাকিয়ে আপন মনে ভাবতে থাকে মজিদ খান। কেমন স্বপ্নের মতো সব ঘটে গেল। তার মনে ভেসে উঠতে থাকে সব দৃশ্যপট। প্রথম একদিন স্বপ্নে দেখল, সাতটা পিতলের ড্যাগ দেখিয়ে বলছে "টাকা নে, ডাব-নাহইল দে"। তারপর আবার দ্বিতীয় রাতে একই স্বপ্ন, " টাকা নে ডাব-নাহইল দে।" এরপর একদিন স্বপ্নে ফিসফিস করে বল্ল," আইজ চান্নি-পসর রাইত। পুকুর পারে আয়। পুকুর পারে আইয়া টাকা নিয়া যা।" সেই স্বপ্নের সাথে সাথে ঘুম ভেঙে ওঠে মজিদ খান । রাত তখন দুটা বাজে। জোছনা ধোয়া রাতে নারকেল গাছগুলোকে মনে হয় কোনো দীর্ঘদেহী পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদের কিরণ পড়ে পুকুরটাকে মনে হচ্ছে রুপার খনি।

মজিদ খান সোৎসাহে চলে যায় পুকুর পাড়ে। প্রকৃতির সব মাধূর্য ছাপিয়ে মজিদের ভেতরের লোভী রাক্ষসটার জিহবা তখন লকলক করে উঠেছিল। কিছুক্ষণ চরম উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করে মজিদ। আজই সে কোটি টাকার মালিক হয়ে যাবে! কিন্তু কিছুই দেখতে পায় না।কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে হতাশ হয়ে চলে আসতে নেয় মজিদ। আর সেই মুহূর্তেই ঘটে সেই পরম আশ্চর্যের অপার্থিব ঘটনাটি। পুকুরের পূব কিনারা থেকে একে একে উঠতে থাকে সাতটি পিতলের ড্যাগ। মজিদ খানের ইচ্ছা সবগুলো ড্যাগই সে আটকে রাখবে। কিন্তু ড্যাগগুলো ধরতে গেলেই পিছিয়ে যাচ্ছে। অবশেষে প্রথম ড্যাগটিতে মজিদ খান প্রস্রাব করে দেয়। স্থির হয়ে যায় ড্যাগটি। তারপর ড্যাগটির ঢাকনা খুলে টাকা ঢেলে নেয় সবগুলো মুদ্রা। রৌপ্যমুদ্রার সাথে ড্যাগের ঢাকনার সাথে লেগেছিল একটা স্বর্ণমুদ্রা। যার গায়ে খোদিত আছে একজন সর্পরানীর মাথায় হীরার মুকুট। এরপর মজিদ খান অই স্বর্ণমুদ্রাটিও নিয়ে ড্যাগে ঢাকনা লাগিয়ে পুকুরে ফেলে দেয়। কিন্তু অই ড্যাগ আর ডোবে না। ড্যাগ পুকুরে ঘুরতে থাকে সাতদিন ধরে। পুকুরের এমাথা থেকে ওমাথা ড্যাগ শুধু ঘুরতে থাকে উদ্ভ্রান্ত পাগলের মতো । কিন্তু দেখে শুধু মজিদ খান আর সায়রা বানু। অন্য কোনো মানুষ ড্যাগ দেখতে পায় না। সায়রা বানু বলে, দেহেন ড্যাগ তো যায় না। কিছু একটা করেন। মজিদ খান বলে, আলো অকম্মা মাগী তোর চিন্তা কিজন্য? আমি কি কি মইরা গেছি!

এরপর সৈয়দকে নিয়ে পাট কাটতে গেলে দেখে পাটের আঁটির ওপর সাপ, ধান কাটতে গেলে দেখে ধানের গোলার ওপর সাপ! সীমিত হতে থাকে সৈয়দ এর চলাফেরা। সৈয়দ আর ফুটবল খেলতে যায় না, চায়ের দোকানে বন্ধুদের আড্ডায় যায় না। একা টয়লেটে যেতেও সাহস পায় না সৈয়দ । এর ভেতর পাঁচদিন অতিবাহিত হয় টাকা পাওয়ার। একদিকে সাপের উৎপাত অন্যদিকে সমস্ত পুকুর ধরে ড্যাগ এর ঘুরপাক খাওয়া। এইসব বিষয় আমলে নিয়ে মজিদ খান যায় লতিফ কেরানীর সাথে বুদ্ধি পরামর্শ করতে।

কেরানীদের বুদ্ধি, ধন, সম্পত্তি চরবাড়িয়ায় বিখ্যাত।

লতিফ কেরানী বল্ল, তুমি বটের টাকাটা পুকুরে ফেলে দাও তাইলে ড্যাগ ডুবে যাবে। সেদিন ভর দুপুরে সেই স্বর্ণমুদ্রাটা ফেলে দিল পুকুরে। অমনি ঝুপ করে ডুব দিল ড্যাগ কিন্তু সমস্ত পুকুর জুড়ে উথাল-পাতাল ঢেউ উঠল। মজিদ খান মনে মনে প্রমাদ গুনল। অইদিন সন্ধ্যায় এক প্রকান্ড কমলা রঙের সাপ সায়রা বানুর ছাগলের ছানা মুখে নিয়ে চলে যেতে নেয়। মজিদ খানকে চিৎকার করে ডাক দেয় সায়রা বানু। মজিদ খান সাপের মাথায় লাঠি ছুড়ে মারে। ছাগল ছানা সাপের মুখ থেকে ছিটকে পড়ে। সাপ মজিদ খানের দিকে একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে চলে যায়। হো হো করে হেসে ওঠে ড্যামকেয়ার মজিদ।

সেদিন রাতে মজিদ খান এবং সায়রা বানু দুজনেই স্বপ্নে দেখে, কে যেন পালকিতে করে নিতে এসেছে সৈয়দকে। ঘুম ভেঙে পানি খেয়ে ঘুমালে আবার মজিদ স্বপ্ন দেখে, এক নর্তকী নেচে চলেছে সাপের সাজে আর তার কানে ফিসফিস করে বলে, "ডাব -নারকেল দিতে হবে।"

মজিদ খান চিৎকার করে ওঠে সৈয়দ! বলে। ঘুম ভেঙে দেখে সৈয়দ অঘোরে ঘুমাচ্ছে।

এরপর দিন রাতেই তারা বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করে ঘুমাতে যায়। কিন্তু সেই নিশছিদ্র মশারির ভেতর থেকে দুজনের মাঝখান হতে সাপ সৈয়দকেই কামড় দেয়। সব স্মৃতিচারণ শেষে মজিদ খান চিৎকার করে ওঠে আহা সৈয়দ! আহা আমার বাবা! সবচেয়ে খারাপ বাবার হৃদয়ও বুঝি ধর্মগ্রন্থের মতোই পবিত্র।

সেই বিমূর্ত রাত্রিতে কবরের দিকে তাকিয়ে মজিদ ভাবে, সব সম্পত্তি নিয়াও কেউ যদি আমার সৈয়দরে ফিরাইয়া দিত!

ছোট ভাই জব্বার খানের সাথে সারাবছর ঝগড়া বিবাদ লাগিয়েই রাখে মজিদ । ছেলের মৃত্যুর পর সায়রা বানু একটু কথা কাটাকাটি হলেই জব্বার খান ও সাহারা খাতুনের পাঁচ ছেলের মৃত্যু কামনা করে। পা দিয়ে মাটি টিপে দাঁত কাটতে কাটতে সায়রা বানু বলে, এই তোর পাঁচ পোলা কবর দেই। সাহারা খাতুন খালি জায়নামাযে চোখের জলে পুত্রদের নেক হায়াত ভিক্ষা চেয়ে স্রষ্টাকে বলে,

"হে পরোয়ারদিগার, হে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আপনি আমার মানিকদের নিজের রহমতে রক্ষা কইরেন। আমি কারো ক্ষতি চাই না। অন্যকারো অসৎ প্রতিহিংসার কবল থেকে আমার পুত্রদের আপনি বাঁচান।

সৈয়দ মারা যাবার পর সায়রা বানুকে অনিশ্চয়তা আর হতাশা আচ্ছন্ন করে ফেলে। দুই মেয়ে আমেনা আর হাজেরার বিয়ে হয়েছে পাশের দুই গ্রামে। বড় মেয়ে আমেনার বিয়ে হয়েছে লামচরী গ্রামে। সন্তান-সন্ততি

আর কিছুট অভাব অনটন নিয়ে বেশ আছে আমেনা।

হাজেরার বিয়ে হয়েছে পাশের গ্রাম কাকাশুরায়। হাজেরার অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ স্বচ্ছল। বেশ সুখে আছে হাজেরা। সায়রা বানুর কেবলই মনে হয় মজিদ খান উত্তরাধিকার পাওয়ার জন্য, বংশ রক্ষার জন্য আবার বিয়ে করে ফেলবে। তখন সায়রা বানু কোথায় যাবে! তাই সে স্বামীর কাছে পাঁচ জৈষ্ঠ ধানি জমি চায়।

সায়রা বলে, আমার তো পোলা নাই অই জমির আয় দিয়া আমি বাঁচমু। কিন্তু বেঁকে বসে মজিদ, বলে আমি যদি আরেকটা নিকাও করি তুই সংসারে থাকপি। তোরে জমি লেইখা দিমু ক্যা? এই নিয়ে বিরোধ বাঁধে মজিদ খান আর সায়রা বানুর। সায়রা বানু শাপ -শাপান্ত দিয়ে বলে, আমার পোলা খাইছে, এহন আমারে জমিও দেবে না। মজিদ খান বেদম প্রহার করে সায়রা বানুকে। মেয়ে-জামাই, দেবর ও দেবর পুত্ররা সবাই সায়রা বানুর পক্ষে দাঁড়ায়। সায়রা বানু নারী নির্যাতন ও অবহেলার নালিশ এনে মামলা ঠুকে দেয় বরিশাল জেলা আদালতে।

যে দেবরের পুত্রদের প্রতিনিয়ত অভিশাপ দিত সেই দেবরের ঘরে গিয়েই ওঠে সায়রা বানু। আমেনা হাজেরা স্বামী-সন্তান নিয়ে জব্বার খানের ঘরেই বেড়াতে আসে।মজিদ খান তিন জৈষ্ঠ জমি দিয়ে সায়রা বানুর সাথে বিরোধ মিটিয়ে নেয়। এরপর মেয়ে-জামাই এসে মজিদ খান আর সায়রা বানুর ঝগড়া বিবাদ মিটিয়ে দেয়। মামলা উঠিয়ে নেয় সায়রা বানু কিন্তু স্বামীর সাথে সম্পর্ক আর আগের মতো ভালো হয় না।

যতকিছুই হোক মজিদ খানের মনে শান্তি নেই। তার বংশের বাতি নেই। মজিদ খান দৃঢ় সংকল্প হয় দ্বিতীয় বিয়ের জন্য যদিও বয়স তখন পঞ্চাশের ঘরে কিন্তু তার ভাবনা হল, পুরুষের আবার বয়স কি?

মজিদ খান এখানে -সেখানে নিজের মনের ইচ্ছা প্রকাশ করতে থাকে। খুঁজতে থাকে চল্লিশের নীচের পোক্ত শরীরের কোনো নারী। যাকে সে রতি ক্রিয়ায় চরম উপভোগ করতে পারবে এবং সে নারীর গর্ভ থেকে পাবে নিজের পরম আকাঙ্ক্ষিত বংশধর।

পাশের গ্রাম লামচরীতে বসবাস করে মোবাশ্বের হোসেন হাওলাদার। একসময় প্রচুর জমি-জমা থাকলেও কীর্তন খোলার ভাঙনে প্রায় সর্বশান্ত। গরু পুষে আর বর্গাচাষ করে কোনোরকম দিনাতিপাত করে মোবাশ্বের হোসেন, তার স্ত্রী আর দুই মেয়ে। বড় মেয়ে সকিনার বিয়ে হয়েছিল ধনী পরিবারে। কিন্তু যৌতুক দিতে ব্যর্থ হওয়া সকিনাকে স্বামীর বাড়ি থেকে ফিরে আসতে হয়েছে বিয়ের দুই বছর পর।

একদিন ঘটক এসে সকিনার কথা বলে মজিদ খানকে।

মজিদ খান বলে, তুমি মাইয়া দেহার ব্যবস্থা কর। এক কেজি গরম জিলাপি আর কমলা রঙের আমৃতি মিষ্টি নিয়ে মজিদ খান যায় সকিনা বিবিরে দেখতে। সকিনা বিবির গায়ের রঙ শ্যামলা, মাথায় চুল আছে বেশ ঘন এবং কোমর অব্দি। নিতম্ব বেশ ভারী বুক যা আছে চলনসই। মজিদ খান , মোবাশ্বের হাওলাদারকে বলে আগামী শুক্কুরবার নিকাহের ব্যবস্থা করেন।

দশ হাজার টাকা দেনমোহর ধরে, মজিদ খান আর সকিনা বিবির নিকাহ কার্য সম্পন্ন হল। লাল মালা শাড়ি আর চার আনা স্বর্ণের চেইন পরে সকিনা বিবি আসল স্বামীর সংসারে। প্রথম রাতে পাঁচবার সঙ্গম হল দুজনের। মজিদ খান শেষবার সঙ্গম শেষ করে নতুন বিবিকে বুকে টেনে নিয়ে বলে, খুব সুখ পাইছি তোরে খেইলা। আমারে একটা পোলা দিতে পারবি না? সকিনা চুপ করে মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়।

সাপানিয়া গ্রামে কিছু জমি পছন্দ হইছে খান সাহেবের।

উঁচু ভিটা চার জৈষ্ঠ। এক জৈষ্ঠতে হয় একুশ শতাংশ।

জমিটায় যেমন ধান হবে তেমন হবে রবিশস্য । টাকা দরকার। যে টাকার জন্য একমাত্র পুত্র হারিয়েছে সেই টাকা রাখতে দিয়েছে লতিফ কেরানির কাছে। লতিফ কেরানি জানিয়েছে সে শহরের এক আত্মীয়ের কাছে রাখতে দিয়েছে টাকা। একদিন সকালে গিয়ে মজিদ খান লতিফ কেরানির কাছে টাকা চায়। লতিফ কেরানি দুইদিন পর দেখা করতে বলে। দুইদিন পর গেলে লতিফ কেরানি বলে, তার আত্মীয় জানিয়েছে যে সিন্দুকে টাকা রেখেছিল সেই সিন্দুকের সব টাকা গায়েব হয়ে গেছে। মজিদ খান তখন যেন বোবা, কালা আর বধির হয়ে গেছে। মজিদ শুধু এক অসহায় ডানা ভাঙা পাখির মতো, ল্যাংড়া নেকড়ের মতো বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে লতিফ কেরানির দিকে। লতিফ কেরানি পরিস্থিতি বুঝে তার স্ত্রীকে ডাক দিয়ে বলেন, খান সাহেবকে চা-নাস্তা দাও। বাটি ভরা রসগোল্লা, পরোটা,

খাসির গোশত আর পায়েস পাঠিয়ে দেয় কেরানি গিন্নী। মজিদ খান সুতীব্র আক্রোশে সব ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে আসে। কেরানি সাহেব তখন মুচকি হেসে বলে মূর্খ কোথাকার! টকটকে লাল ফর্সা কেরানি সাহেবের মুখ ভর্তি কাঁচাপাকা দাড়ি। দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে কেরানি সাহেব বলে, অল্লাহু আকবার! এবার দোতলা দালান বাড়ির কাজে

আত(হাত) লাগামু।

কেরানী সাহেবের বাড়ি থেকে ফিরতে প্রায় সাড়ে বারোটা বেজে যায় মজিদ খানের। এসেই দেখে সকিনা মোবাশ্বের হাওলাদারকে থালা ভরা ভাত দিয়েছে আর লাউ দিয়ে রান্না করা শোল মাছ। সাথে বাটিতে দেয়া হয়েছে ঘন মশুর ডাল ভুনা। জীবনের চরমভাবে ঠকে

গিয়ে মজিদ খানের তখন এমন অবস্থা যে, মাথায় ধান দিলে পটাশ পটাশ করে খই ফুটবে। তার ওপর বিয়ের প্রায় ছয় মাস হয়ে গেছে সকিনার গর্ভধারণের কোনো লক্ষ্মণ না থাকায় খান সাহেব সকিনার ওপর বেশ ক্ষ্যাপা। আর তার অনুপস্থিতিতে বাপকে অমন আহ্লাদ করে খাওয়াতে দেখে মেজাজ আরও বিগড়ে গিয়েছে। মজিদ মোবাশ্বের হাওলাদারের ভাতের থালা লাথি দিয়ে উলটে দেয়। আর মুখে বলে অই হালার পো হালা

আমার বাড়িতে গিলতে আইছিস? হালার খয়রাতি খয়রাত কইরা খাইতে পারো না? সকিনা কেবল বলে ওঠে, যে আপনে মানুষ! বুড়া মানুষটা কেবল মুখে খাওন দিছিল! আপনের চেয়ে নমরুদ এর দিলেও মায়া আছে! অমনি মজিদ সকিনার চুল ধরে বলে, ওরে

চুতমারানি খানকি মাগী, আমার খাবি আমার পরবি আর বাপের জন্য দরদ চোদাবি! যা মাগী বাপের বাড়ি গিয়ে থাকন চোদা। মোবাশ্বের হোসেন একরকম পায়ে ধরে বলে, বাবা মুই আর কোনোদিন তোমাগো বাড়ি আমু না। মোর মাইয়াডারে পোতে নামাইও না। এই বলে সকিনার পিতা হনহনিয়ে বেরিয়ে যায়।

বিয়ের দুই বছর অতিক্রান্ত হলেও বংশধরের মুখ না দেখে সকিনার ওপর ত্যক্তবিরক্ত মজিদ। এরপর বিভিন্ন সময়ই বাপের বাড়ি চাল-ডাল টাকা-পয়সা দেয়ার সন্দেহ উদ্রেক হয় সকিনার ওপর। মজিদ মনে

মনে বলে, ধুউর! খালি রাইতের বেলার ধোনের সুখের লাইগা এইরহম হাতি পোষার দরকার নাই। যেই চিন্তা সেই কাজ। দ্বিতীয় বারও স্বামীর সংসার থেকে বাপের বাড়ি ফিরতে হয় সকিনাকে।

মামলা উঠিয়ে নিলেও মজিদের সাথে ভাব- ভালোবাসা নেই সায়রা বানু ও তার মেয়ে জামাইদের সাথে। আমেনা আর হাজেরা জব্বার খানের ঘরে এসেই বেড়িয়ে যায়। একরকম একা একাই নিজের রান্না নিজে করে খায় মজিদ। আর মনে মনে আরও যুবতী কাউকে কামনা করে সর্বক্ষণ।

একদিন কাজকর্ম কিছুই ভালো লাগে না মজিদের। কী এক চিন্তা সারাক্ষণ তাড়া করে ফেরে, এত জমিজমা আমি মরে গেলে কে খাবে! অই হালার পো হালার জামাইরা! নাহ! কিছু একটা করতে অইবে! এমন সময়

খুব সুন্দর একটা ছোট বাচ্চা নিয়ে এক যুবতী ভিক্ষা করতে আসে। বেশ ফর্সা আর খাড়া নাক, কোঁকড়া চুল মাথায়, চোখগুলো ছোট হলেও ভাসা ভাসা। মজিদ প্রায় আধা কেজি চাল ভিক্ষা দিয়ে ভিক্ষুক যুবতীকে কাছে ডাকে। কাছে আসতেই বলে তোমার পোলাডা এত সুন্দর! ওর বাপ কই? আর তোমার নাম কী?

যুবতী উত্তর দেয়, মোর নাম হালিমা আর অর বাপ মইররা গেছে। নাইলে কী আর খয়রাত করতে নামি!

মজিদ বলে, যদি তোমার আর ভিক্ষা করন না লাগে?

তুমি রাজি! হালিমা বলে, ঠিক বুজি না, বুজাইয়া কন।

মজিদ সরাসরি বলে আমি তোমারে এই পোলা সহ নিকা করতে চাই। হালিমা বলে, রাজি আছি, তয় একখান কতা আছে। মজিদ বলে, পোলা সহই তো কইছি। আর কতা কী? হালিমা বলে, হ কইছেন ঠিকই, কিন্তু বিষয়ডা আরও পোক্ত অওন দরকার।। মজিদ জিজ্ঞেস করে, কীরকম? হালিমা বলে রহিমরে দত্তক নেবেন আর বাপের পরিচয় দেবেন। আর বড় অইলে ঘর বানাইতে আর এট্টু গাছ-গাছালি লাগাইতে দুই জৈষ্ট জমি দেবেন। হালিমার বয়স আর নিজের একাকীত্বের বিবেচনায় রাজি হয়ে যায় মজিদ।

হালিমা চায় রহিম স্কুলে যাক, লেখাপড়া শিখে ছোট হলেও চাকরি করুক। কিন্তু মজিদ চায় রহিম তাকে ক্ষেত-ক্ষামারে কাজে সহযোগিতা করুক। রহিম যথাসম্ভব মজিদের কথামতো চলে। নিকাহের ছয় মাসের মাথায়ই হালিমা গর্ভধারণ করে। যথাসময়ে জন্ম দেয় কালো কুচকুচে এক পুত্র সন্তান। বুকের পাথর নেমে যায় মজিদের। এবার রহিমের ওপর চলে অত্যাচারের খড়গহস্ত। আর নিজের ছেলেকে কোলে নিয়ে সোনা, রাজপুত্র, মানিক বলে চুমুতে ভরাতে থাকে মজিদ। ছেলের নাম দেয় আরশাদ আলী খান।

গালি, বকা আর মার খেয়েও রহিম অষ্টম শ্রেণি অব্দি লেখাপড়া করে। আরশাদ কে স্কুলে ভর্তি করে দেয় মজিদ। কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেনিতে তিনটাতে ফেল করে আরশাদ। ধীরে ধীরে বয়স বাড়তে থাকে মজিদের।

আজকাল শরীর ও বেশ খারাপ থাকে। মারধর করে হালিমাকে। হালিমা কান্নাকাটি করলে শ্লেষে বলে, মাগী তোরে মারলে কান্দস, টেকা দেলে খুশি অস ক্যা!

পাড়ায় পাড়ায় সারাদিন ঘুরে বেড়ায় কালো, মাথায় খাড়া চুল আর তীক্ষ্ণ চোখের আরশাদ।

প্রখর সূর্য ও একসময় পশ্চিম দিকে ঢলে পড়তে থাকে। দুরন্ত অশ্বটিরও পা ভাজ হয়ে বসে পরতে ইচ্ছে করে একসময়। তেজী, বদমেজাজি আর দুর্মর লোভী মজিদের শরীর খুব ক্লান্ত লাগে এখন। সায়রা বানু মারা গেছে কেবল মাস ছয়েক হল। দেবরের ঘরে বসে মৃত্যু অব্দি মজিদ কে অভিশাপ দিয়ে গেছে। আর দিনে যে কত কতবার বলেছে, আহারে আমার সৈয়দ! মজিদ ভাবে, মাগী মরতে মরতেও আমারে অভিশাপ দিয়া গেছে! অর অভিশাপই মোর লাগছে!

বরিশাল মেডিকেল কলেজে ওয়ার্ড বয় এর চাকরি হয়েছে রহিম এর। মজিদের পা কেটে গেছে শামুকে।

কোনোভাবে ই পায়ের ঘা শুকায় না। পচন ধরলে রহিম নিয়ে যায় বরিশাল হাসপাতালে। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখে রক্তের চিনির পরিমাণ অনেক বেশি। কিডনি দুইটাই ধরে গেছে আর পায়ে গ্যাংরিন হয়ে গেছে।

তিনমাস হাসপাতালে চিকিৎসা চলে মজিদের। কেটে ফেলা হয়েছে মজিদের ডান পা। আমেনা, হাজেরা এবং তাদের স্বামী সন্তান কেউ দেখতেও যায় না। যে একদিন পুরো চরবাড়িয়া দাপিয়ে বেড়াতো,সেই মজিদ আজ হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে কাঙালের মতো।

রহিম খোঁজ খবর নেয়। আর জব্বার খান সবসময়ই ছেলেদের পাঠায় ভাইয়ের খোঁজ খবর নেয়ার জন্য। মজিদ শুয়ে শুয়ে স্মৃতি রোমন্থন করে তার সোনালী দিনের। ফসল ভরা জমি, সায়রা-সকিনা-হালিমা তিন বিবির কথাই মনে পড়ে। সায়রা বড় মুখোরা বিবি তার, সকিনার শরীর তাকে ভালো সুখ দিয়েছে আর হালিমাকে মারলে তার মুখে চমৎকার বেদনা ফুটে উঠত। অই বেদনা দেখার জন্যই মারের সময় পরবর্তী কিলটি আরও জোরে দিত মজিদ। তিনমাস পাঁচ দিনের মাথায় মজিদ মারা যায়।

আরশাদের বয়স তখন নয় বছর। সমস্ত গ্রাম ঘুরে বেড়ানো, ডাংগুলি খেলা, ঘুড়ি ওড়ানো আর রহিমের কাছ থেকে টাকা নিয়ে দোকানে দোকানে চা-বিস্কুট আর বিভিন্ন বাজে খাবারে পেট ভরানো আরশাদের প্রতিদিনের রুটিন হয়ে যায়। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই শুরু করে কারিগর বিড়ি টানা। এরপর শুরু হয় বাড়ির ছোট ছোট মেয়ে শিশুদের প্যান্ট খুলে যোনীতে হাত দেয়া। একটু বড় মেয়েদের আড়ালে আবডালে পেলেই

সদ্য গজিয়ে ওঠা স্তন টিপে দেয়া। বাড়ন্ত ছেলেগুলোর মাথায় যৌন অনুভূতি গেঁথে দেয়া। হেন অপকর্ম নেই যা আরশাদ চর্চা করে না। এলাকায় রটে যায় মজিদের যোগ্য বংশধর হয়েছে।

রহিমের সহকর্মী বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে ভাসানচর গ্রামের মায়ার সাথে। মায়া খুব বড়লোক চৌধুরী বাড়িতে ফুটফরমাশ খাটতো। মায়ার গায়ের রঙ আপেলের মতো। চুলগুলো ঘনকালো কোমর অব্দি, খাড়া নাক, চিকন ঘনকালো ভ্রু। রহিম বউকে নিয়ে খুউব গর্ববোধ করে। মনে মনে ভাবে, আমার বউটা শাবানার মতো সুন্দর। দেবরের সাথে মায়ার খুব খাতির। ছোট্ট ভাইকে যা আবদার করে তাই ছোট্ট ভাই এনে দেয়। এরই মধ্যে রহিমের ছোট শালী লিলি বেড়াতে আসে রহিমের বাড়ি। আরশাদ বেশ উপহার সামগ্রী কিনে দেয় লিলিকে। যৌন সুখ আরশাদ এর মধ্যে অনেক পেয়েছে। কিন্তু লিলির মতো অমন লাজুক, ফর্সা আর লম্বা ঘনকালো চুলের একটা বউ যদি আরশাদের হত! তাইলে ভাইজানের বউ মানে মায়া যেমন সুন্দরী অন্তত তার কাছাকাছি হত! আরশাদ মনে মনে ভাবে, ভাবী কী আমারে ফিরাইয়া দেবে!

মায়া কিছুতেই এই উড়নচণ্ডী দেবরের সাথে বোনের বিয়ে দেবে না। এই নিয়ে বিরোধ চরমে পৌঁছে যায় দুই ভাইয়ের। আরশাদ তখন বিভিন্ন জায়গায় রাজমিস্ত্রির কাজ করে বেড়ায়। বাড়ি ফেরে না বহুদিন। আরশাদের মা হালিমাও বিরক্ত হয় মায়ার ওপর। কেন বোনকে বিয়ে দিল না তার ছেলের কাছে! জমিজমা কী কম আছে আরশাদের? মায়ার মা ও ভাই দ্রুত বিয়ে দিয়ে দেয় লিলিকে।

খুব ক্ষেপে যায় আরশাদ। বাড়ি আসে না মাসের পর মাস।বিভিন্ন জেলায় রাজমিস্ত্রির কাজ করতে করতেই পরিচয় হয় মীরা বাড়ির ছেলে হক মীরার সঙ্গে। প্রায় সময় দিনে রাতে আরশাদ পড়ে থাকে মীরা বাড়ি। হক এর বোন কোহিনুর সবসময় আরশাদকে ভাত বেড়ে খাওয়ায়। কখন কী প্রয়োজন খেয়াল রাখে। একদিন

রাতে কোহিনুরকে বিয়ে করে নিয়ে আসে আরশাদ আলী। কোহিনুর কালো হলেও চেহারায় একটা মিষ্টি মায়াবী আভা আছে। আর মুখের কথাও অনেক মিষ্টি।

গালি আর মাস্তানির জন্য এলাকায় মীরারা বেশ প্রসিদ্ধ।

এবার দুই কোহিনুর আর মায়ার শুরু হয় খুটিনাটি বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব। আরশাদ রহিমকে বলে দেয়, আপনে আলাদা ঘর তোলেন। রহিম ছেড় দেয় বাপের ঘর।

কিন্তু শুধু ঘর ছাড়া করেই কোহিনুর আর আরশাদ শান্তি পায় না। বাড়ির সব প্রতিবেশী মায়া আর রহিমকে খুব ভালোবাসে। তাদের অমায়িক ব্যবহার আর সবার সাথে মিলেমিশে চলার কারণ সবার সব আয়োজনে তারা উপস্থিত থাকে। এটাই সহ্য হয় না কোহিনুর আর আরশাদের। কোহিনুর জাকে বলে কামের ছেড়ি আর হুমাইন্নার মাঝ খাডাল তুই! এইডা আমার শ্বশুরবাড়ি। তোরে যদি আমি বাড়ি ছাড়া না করি আশেদ মীরার মাইয়া না!

এরপর আরশাদ রহিমকে বলে, আপনে এই বাড়ি ছেড়ে নিজের জমিতে গিয়া বাড়ি বানান। বাড়ির সব প্রতিবেশীরা এক হয়ে এর বিরোধিতা করে। কিন্তু কোহিনুর কিছুতেই রহিম আর মায়াকে এই খান বাড়িতে থাকতে দেবে না। আরশাদ একবাক্যে বলে দেয়, এইডা আমার বাপের বাড়ি। যে হালারপো হালায় রহিমের লইগা দরদ চোদাবে তার মায়রে আমি চুদি। মান-সম্মানের ভয়েও আর কেউ কথা বলে না। রহিম চলে যায় খান বাড়ি ছেড়ে। মজিদের সম্পত্তি থেকে কিছুই পায় না রহিম। মাকে দেখাশোনার ভার রহিমের ওপরই বর্তায়।

সেই বারো বছর বয়স থেকেই আরশাদ সাপ দেখে সবসময় চলার পথে। সন্ধ্যার পরে টর্চ লাইট ছাড়া চলতে ভয় পায় আরশাদ। সামান্য অন্ধকারেও আলো ছাড়া চলাফেরা করে না। পঁচিশ বছর হওয়ার সাথে সাথেই স্বপ্নে দেখা শুরু হয় টাকা ভর্তি পিতলের ড্যাগ। আর সেই একই কথা -টাকা নে , ডাব নাহইল দে। কিন্তু জন্মের আগে ভাই সৈয়দ এর পরিনতির কথা শুনেছে আরশাদ। তাই স্বপ্নেও সে মনে হয় সচেতন থাকে। তিন কন্যার পর এক পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণকরে আরশাদ এর। পুত্রের নাম রাখে কাওসার আহমেদ খান।

কাওসারের জন্মের পর ঘন ঘন শুধু পিতলের ড্যাগ স্বপ্নে আসতে থাকে। এক শুক্লপক্ষ রাতে বেরিয়ে আসে ঘরের বাইরে। ঘুমের ঘোরে দাঁড়িয়ে থাকে সাতটি পিতলের ড্যাগের সামনে আর বিরবির করে কথা বলে।

এমন সময় রব সাহেবের স্ত্রী রিজিয়া বের হয় প্রস্রাব করতে বাইরে। দেখে আরশাদ দাঁড়িয়ে আছে পিতলের ড্যাগের সামনে। রিজিয়া বলে, অ কি আশিদ্দা তোগো ঘরে কি চোর আইছে? অমনি আরশাদ চকিতে ঘরে প্রবেশ করে। আর ড্যাগ অদৃশ্য হয়ে যায়।

কাওসার এর বয়স তখন তিন বছর। একদিন উঠানে বসে খেলছে কাওসার। ভর সন্ধ্যা, ফাগুনের মাতাল বাতাস। পূর্ণ চাঁদ উঠেছে আকাশ জুড়ে। কোহিনুর বারবার ডাকে, কাওসার ঘরে আয়। কিন্তু কাওসার উঠানে বসে ছোট ছোট বল নিয়ে খেলেই যাচ্ছে। এমন সময় কোহিনুর দেখতে পায়;

কমলা কমলা রঙের একটা সাপের বাচ্চা কাওসারের দিকে ফনা তুলে দাঁড়িয়ে আছে আর কাওসার যেই সাপটিকে ধরেতে চায় সাপের বাচ্চাটা আরও ফোস করে ফনা তুলে দাঁড়ায়। কোহিনুর স্থির, অবিচল, কিংকর্তব্যবিমুড় হয়ে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকে।


লেখক পরিচিতি:
নুসরাত সুলতানা
কবি। গল্পকার
ঢাকায় থাকেন












একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ