স্মৃতি ভদ্রের গল্প : নিঁখোজ সংবাদ



আজকাল এক অদ্ভুত সমস্যা দেখা দিয়েছে আমার।কতগুলো নিখোঁজ সংবাদ মাথায় বারবার এসে টোকা দিচ্ছে।

প্রতিদিন কত নিঁখোজ সংবাদই তো পড়ি খবরের কাগজে। সেসব নিয়ে আমার কখনই কোনো সমস্যা হয়নি। হবে কেন? খবরের কাগজে পড়া নিঁখোজ সংবাদগুলো তো আমার সাথে সংযোসংযোগহীন।

তবে আমি আজকাল যে নিঁখোজ সংবাদের সমস্যায় ভুগছি তা কিন্তু মোটেও খবরের কাগজে খুঁজে পাওয়া নয়।

সময় অসময়ের বালাই নেই, সুযোগ পেলেই নিঁখোজ সংবাদগুলো হুটহাট আমার সামনে এসে হাজির হচ্ছে। তাতেও আমার খেদ থাকতো না, যদি না ব্যাপারটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে না যেত।

প্রথমদিন নিঁখোজ সংবাদ এলো ঘুমের ভেতর, এক অদ্ভুত স্বপ্নে। সাধারণত আমি খুব একটা স্বপ্নবাজ মানুষ নই। তা সে ঘুমেই হোক বা জেগে থাকা অবস্হায়। তাই বলে ঘুমের ভেতর স্বপ্ন দেখাতে আমার নিয়ন্ত্রণ থাকবে এমন তো হতে পারে না।তবুও কেন যেন স্বপ্ন এসে আমার ঘুমে তেমনভাবে আঘাত হানতো না।

কিন্তু সেদিন এমন হলো না। বহুকাল পর একটি স্বপ্ন এলো। আমার ঘুমের ভেতরেই এলো। স্বপ্ন দেখা কোনো বড় ব্যাপার নয়। তবে আমি যে স্বপ্ন দেখলাম সেটিই আসলে বড়কিছু হয়ে দাঁড়ালো আমার জন্য। স্বপ্নটি এমন:

আমি একটি রাস্তায় হেঁটে চলেছি। যার দু’পাশে অসংখ্য হোল্ডিং বোর্ড। তাতে নিখোঁজ সংবাদের বিজ্ঞপ্তি ঝোলানো। প্রথম হোল্ডিং-এ ঝোলানো একটি বইয়ের নিখোঁজ হয়ে যাবার খবর। তাতে লেখা, আজ থেকে একান্ন বছর আগে্র একটি বই হারিয়ে গিয়েছে। বইটির কভার ছিল চামড়ার। বিশেষ এই বইটি হাতে লেখা, যার সবগুলো হরফ একইমাপের……

ঠিক এই জায়গাতে এসে আমার ঘুম ভেঙে গেলো। শেষরাতের স্বপ্নটি আমার ভাঙে আসলে শেয়ালের ডাকে। অথচ আমার ঘরটির গা ঘেঁষে উঠে যাওয়া আমগাছটায় অসংখ্য চড়ুইয়ের বাস। ভোর হতেই যাদের কিচিরমিচিরে অন্য সবদিন আমার ঘুম ভাঙে। এজন্যই হয়তো স্বপ্ন নয়, শেয়ালের ডাকটাই মাথার ভেতর খোঁচা দিতে লাগলো অনেকটা সময়। আর সে খোঁচাতেই আমি খানিকসময় ভুলে গেলাম সেই স্বপ্নের কথা।

তবে সেদিন দুপুরের পর স্বপ্নটি আবার ফিরে এলো আমার কাছে। আর তা ফিরলো বেশ মহাসমারোহে।সাধারণত তেমনকিছু করার থাকে না আমার দুপুরের পর। কখনো পুরোনো খবরের কাগজের পাতা উল্টাই কিংবা কোনো বইয়ের। কিন্তু সেদিন কোনোটাই করতে ভালো লাগছিলো না বলে চোখ বন্ধ করে কিছু ভাবার চেষ্টা করছিলাম। ঠিক তখনি অন্ধকারের ভেতর জ্বলজ্বল হয়ে উঠলো স্বপ্নের সেই হোল্ডিং। নিখোঁজ সংবাদের খবরটি হুবহু আমার সামনে আবার চলে এলো। যেহেতু ঘুমের ভেতর ছিলাম না আমি তাই ভাবতে অসুবিধা হলো না। ভাবনায় প্রথমেই এলো স্বপ্নটির অভিনবত্ব।এতকিছু থাকতে বই হারানোর বিজ্ঞপ্তি কেন কেউ দেবে? এরকম কোনো নিখোঁজ সংবাদ জ্ঞানত আমার দেখা নেই। এবার মস্তিস্কে জোর দিলাম আমি। পুনরায় স্বপ্নটিকে মনে করার চেষ্টা করলাম। হ্যাঁ, সেটা বই হারানোর বিজ্ঞাপনই ছিল। বেশ অদ্ভুত ব্যাপার। নিজেকে বোঝালাম, আমি বই পড়তে ভালোবাসি তাই স্বপ্নে এমন এলো।

আমি স্বপ্ন নিয়ে ভাবা তখন বন্ধ করে দিলাম।

কিন্তু এখানেই শেষ হলো না বিপত্তি । এবার বিপত্তি স্বপ্ন থেকে এলো না। বরং এলো আমার ঘরের সামনে বেখাপ্পা দাঁড়িয়ে থাকা একটি ইলেকট্রিক তারের খাম্বা থেকে। টু-লেট থেকে শুরু করে সন্ধান চাইসহ নানা ধরণের বিজ্ঞপ্তিতে ঢেকে থাকা খাম্বাটি। স্বভাবতই সেসব আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি আগে। কিন্তু সেদিন নিঁখোজ বিজ্ঞপ্তির নীচে হাতে আঁকা একটি বইয়ের ছবি আমার সব মনোযোগ কেড়ে নিলো। ঠিক যেন স্বপ্নে হোল্ডিং এ ঝুলে থাকা সেই নিখোঁজ সংবাদ। এবার আমি নড়েচড়ে বসলাম। কিছু একটা ঘটছে আমার সাথে।

স্বপ্নে অবাস্তব অনেককিছুই আসে, তা বলে বাস্তবেও বইয়ের নিঁখোজ বিজ্ঞপ্তি এলো। আর ঠিক কি কারণেইবা আমার ঘরের সামনেই বিজ্ঞপ্তিটা সাঁটা হলো? বেশ চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লাম। চোখ বন্ধ করে ভাবতে বসলাম, স্বপ্নের বিক্ষিপ্ত অংশগুলো মিলিয়ে এই ধাঁধার পরিসমাপ্তি ঘটাতে চাইলাম। মনে করার চেষ্টা করলাম বইটির কোনো ছবি স্বপ্নের হোল্ডিংএ ছিল কীনা।

মনে করতে পারলাম,
না কোনো ছবি ছিল না।

আবার স্বপ্নের টুকরোগুলো জড়ো করে চেষ্টা করলাম নতুন কোনো তথ্য খোঁজার বা স্বপ্ন মেলাবার।

মনে পড়লো, বইটির বিশেষত্ব হাতে লেখা হরফ।

সেই প্রথম আবিস্কার করলাম আমি স্বপ্নবাজ হয়ে পড়ছি। অর্ধসমাপ্ত স্বপ্নের জন্য নিজের উপর বিরক্তি এলো। আর মনে মনে প্রার্থনা করলাম স্বপ্নটির ফিরে আসুক। আমি পুরো স্বপ্নটিই এবার দেখতে চাইলাম।

এক রাত, দুই রাত, তিন রাত…..এভাবে বেশ কিছু রাত কেটে গেলো স্বপ্নটি আর ফিরে এলো না। এতদিন অপেক্ষা করার পর স্বপ্নটি আমার মস্তিস্ক থেকে হারিয়ে যাবার কথা। তা না হলেও অন্তত ঝাপসা হয়ে যাবার কথা। আর এদিকে ইলেকট্রিক খাম্বা থেকে নিঁখোজ বইয়ের বিজ্ঞপ্তিও নিঁখোজ হয়ে গেছে। মাথায় টোকা দেবার মতো আরকিছু থাকার কথা না এরপর।

কিন্তু এমন হলো না।

সব হিসেবের গরমিল করে স্বপ্ন আবার হাজির হলো আমার কাছে। তবে রাতের ঘুমে নয়। স্বপ্ন ফিরলো ঝকঝকে এক রোদের দিনে। সেদিন গরম একটু বেশীই পড়েছিলো। সারাদিন দোকানে বসে সামনের খোলা মাঠের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এমনিতেই আমার দোকানে তেমন জিনিষপত্র নেই। তার উপর হল্কা গরমের দুপুরে কেউ খুব প্রয়োজন ছাড়া আসেও না। তাই হেলানো চেয়ারে বসে দেখছিলাম স্কুল মাঠের ছেলেগুলোকে। সদ্য গোঁফ গজানো ছেলেগুলো কলেজ ফাঁকি দিয়ে প্রতিদিনই আসে। ব্যাগ থেকে কিছু একটা বের করে হাতের আড়ালে। এরপর সবাই ভাগাভাগি করে ধোঁয়া টানে অনেকক্ষণ। আগে এই স্কুল মাঠে বাচ্চাদের খেলতে দেখা যেতো। এই সব ধোঁয়াবাজদের কারণে মাঠ এখন ফাঁকাই থাকে বেশীরভাগ সময়।

আর কত দেখবো এদের? প্রতিদিন দুপুর থেকে সন্ধ্যাবধি তো এদেরই দ্রখি। এক দল যায় আরেক দল আসে। সারাদিন এসব দেখতে দেখতে চোখ বড় অভ্যস্ত আমার। তাই চোখে তন্দ্রামতো এলো। আর ঠিক তখনি দপ করে ফিরে এলো স্বপ্ন। স্বপ্নে সেই একইরকম হোল্ডিং, একইরকম নিখোঁজ সংবাদের বিজ্ঞপ্তি। তবে বই নয়, বিজ্ঞপ্তি হলো শব্দের:

আজ থেকে ৪৪ বছর আগে ৫ই জুন রোজ রবিবার কয়েকটি শব্দ হারিয়ে গেছে।শব্দগুলোর বয়স ছিল ১৬ বছর। যে বা যারা শব্দগুলো লিখেছিলো তারা যত্নের সহিত একই হরফে লিখেছিলো শব্দগুলোকে।নিরীহ শব্দগুলোর সাথে জানামতে কারো কোনো বিবাদ ছিল না………

ঠিক এই জায়গাতে এসে আমার তন্দ্রাভাব কেটে গেলো। তবে স্বপ্নের ঘোর কাটলো না। মনে হলো স্বপ্নটি তখনো আমার চারপাশে ঘটে চলেছে।ঠিক তখনি দূর থেকে কিছু শব্দ ভেসে এলো আমার কাছে,

দখলদার এলো…..ভয়ে পালিয়ে গেলো….হারিয়ে গেছে….

এরকম কিছু ভাঙা ভাঙা শব্দ। মনে হলো, এই শব্দগুলোর জন্যই হোল্ডিং এ নিঁখোজ বিজ্ঞাপন ঝুলছে। আমি এদিক ওদিক মাথা ঘুরিয়ে হোল্ডিং খুঁজি। হঠাৎ মধ্যবয়স্ক একজন লোক আমার সামনে চেঁচিয়ে ওঠে,

ও ভাই, কখন থেকে কথা বলছি আপনি শুনতে পারছেন না?

চারপাশের থম ধরা বিকেলের হল্কা বাতাস গায়ে এসে ধাক্কা দিয়ে জানালো আমি আর স্বপ্নের ভেতর নেই। ওদিকে লোকটি বলে চলেছে,

আমার একটা ছাগল হারিয়ে গেছে। কালোর মধ্যে সাদা ছোপ ছোপ। মাঠে ঘাস খেতে খেতে ওদের দেখে ভয়ে পালিয়ে গেলো মাঠ ছেড়ে। কোথায় যে গেলো? আপনি দেখেছেন?

বুঝলাম, শব্দগুলোর সাথে স্বপ্নের কোনো যোগসাজশ নেই। তবে স্বপ্নের নিঁখোজ বিজ্ঞপ্তির সাথে আমার যে একটা যোগসাজশ তৈরী হয়েছে, তা মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে গেলো। নয়তো স্বপ্ন দেখার পর প্রতিবার আমার সামনে এরকম সত্যি সত্যি নিঁখোজ সংবাদ হাজির হবার কথা না।

আমি তো তন্দ্রায় ছিলাম, ছাগল হোক আর মানুষ কোনোকিছুই দেখিনি। তবুও কেন যেন মধ্যবয়স্ক লোকটির সাথে কথা আগাতে ইচ্ছা হলো,

আপনার ছাগল ঘাস খাওয়া ছেড়ে হঠাৎ পালাতে গেলো কেন?

লোকটির কন্ঠ বেশ চিন্তাযুক্ত ছিল,

আগে এমন ভয় পেতো না। যখন বাচ্চারা এই মাঠে খেলতো প্রতিদিন বিকেলে, তখন ছাগলটি একটুও ভয় পেতো না। তবে যেদিন থেকে এদের আনাগোনা বেড়েছে সেদিন থেকেই ছাগলটা ভয়ে থাকে, ঘাসও খায় না ঠিকমতো। আজ আমি একটু অমনোযোগে হতেই ছাগলটা পালিয়ে গেলো…..

লোকটার তর্জনি মাঠের ওসব ছেলেপেলের দিকে তাক করা। লোকটি বলে চলেছেন,
আচ্ছা, এরা কারা? কেন এভাবে মাঠ দখল করে রাখে?

আমি একটু কেশে গলা পরিস্কার করলাম। আদার ব্যাপারি আমি জাহাজের খবর কেন রাখবো?

না, কোনো সাদা ছোপের কালো ছাগল দেখিনি বলে মধ্যবয়স্ক লোকটির সাথে আলোচনার সমাপ্তি ঘটালাম।

খেয়াল করলাম বাস্তবের নিঁখোজ সংবাদে আমি ততটাই নিরাসক্ত যতটা আসক্ত স্বপ্নের নিঁখোজ সংবাদে। আমার এই আসক্তি আরোও বাড়িয়ে দিলো একটি অনাকাঙ্খিত ঘটনা।

রাতে দোকান বন্ধ করার পর আমার তেমনকিছু করার থাকে না। ঘরে ফেরার আগে খানিকসময় ল্যাম্পপোস্টের আলো থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে মাঠের এককোণে বসে থাকি। খোলা বাতাসে শ্বাস নেই খানিকক্ষণ। তেমনই একসময় স্কুলের মাঠে খুন হয়ে গেলো একজন পরিচয়হীন মানুষ। অন্ধকারে থেকেও আমি ল্যাম্পপোস্টের আলোয় খুনী আর নিহত মানুষ দু’জনকেই পরিষ্কার চিনে ফেললাম।

তবে আমি কাউকে কিছু না বলে চুপচাপ অন্ধকারের ভেতর দিয়েই পালিয়ে গেলাম। তবে তাতে কোনো সমস্যা হলো না। অপঘাতে মৃত ব্যক্তির লাশ নিয়ে গেলো আন্জুমান মফিদুলের গাড়ি। আর ক’দিন পর এই ঘটনা নিয়ে কানাঘুষোও বন্ধ হয়ে গেলো সকলের।

এমনকি সময়ের সাথে সাথে আমিও ভুলে গেলাম খুনী ওই মাঠে বসে ধোঁয়া টানা কোনো এক দলেরই সদস্য।

এ আর এমন কী? আমিও সবভুলে বেশ ভালোই থাকলাম কিছুদিন।তবে এই ‘কিছুদিন’ ফুরালো আবার একদিন। না, না, একদিন নয় প্রতিদিন। আমার ঘুমে স্বপ্ন আসতে লাগলো এরপর প্রতিদিন। নিয়ম মেনে খুনের ঘটনাটিই নানাভাবে স্বপ্নে আসার কথা। কিন্তু তা হলো না। বরং নিঁখোজ বিজ্ঞপ্তি স্বপ্নে আসতে লাগলো ভিন্ন ভিন্ন জিনিষের।

তবে তা শুধু ঘুম বা তন্দ্রাবস্হায় হলে না হয় কথা ছিল। তা না হয়ে এরপর একটু আনমনা হলেও আমি স্বপ্ন দেখতে লাগলাম। কী অদ্ভুত শোনাচ্ছে তাই না? কিন্তু আমার সাথে এমন অদ্ভুত ব্যাপারই ঘটতে থাকলো।

এই তো সেদিনের কথা, দোকান খুলেছিলাম একটু দেরী করেই। আসলে আমার দোকানে এমনকিছুই নাই যা মানুষকে খুব আকৃষ্ট করে। বাবার আমলে শেষ মেরামত করা দোকানের কোনাকানচিতে খুঁজলে সেই আমলের জিনিষই খুঁজে পাওয়া যাবে। ভাইবোন দয়া করে দোকানের ভাগ নেয়নি, তাই অন্তত সারাদিন এখানে বসে থাকতে পারি।

বসে বসে মানুষ দেখি। দেখতে দেখতে মুখস্ত হয়ে গেছে সামনে দিয়ে যাওয়া সবার চেহারা আর সবার যাবার সময়। খুব একঘেয়ে ব্যাপার। তাই মাঝে মাঝেই আনমনা হয়ে যাই। এমন এক সময়েই সেদিন কিছু দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলো। তাকে স্বপ্ন বলে ভাবতাম না যদি না তাতে সেই একইরকম নিঁখোজ বিজ্ঞপ্তির হোল্ডিং না থাকতো। আমি দেখলামঃ

আমি দু’পাশে হোল্ডিং-এ ঝোলানো একইরকম দু’টো নিঁখোজ সংবাদ। তাতে লেখা, আজ থেকে ২৬বছর আশুক্রবার ভোররাতে বয়সী একজন লোক হারিয়ে গেছে। পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চির সাহসী লোকটিকে শেষবার দেখা গিয়েছিলো শুক্রবার দিনের বেলায়, যখন তিনি এলাকার কলেজ মাঠে শ্রেণীহীন সমাজের স্বপ্ন দেখাচ্ছিলেন সবাইকে…..

হঠাৎ আমার মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয় আর আনমনে আসা হোল্ডিংগুলো হারিয়ে ফেলি। বয়স হয়েছে, নিউরোলজিক্যাল কোনো সমস্যা হওয়া অস্বাভাবিক নয়। রাতেও স্বপ্নের কারণে ঘুম ঠিকঠাক হয় না। ভাবনাগুলো দিয়ে সাময়িকভাবে ঘটনার পক্ষে যুক্তি সাজালাম।

কিন্তু এখানেই শেষ হলো না। আবার এলো, বারবার আসতে লাগলো একই স্বপ্ন।স্বপ্নটির প্রভাব এমন হলো আশেপাশের সবাইকে সেই হোল্ডিং-এ ঝোলানো নিঁখোজ সংবাদের সেই যুবক বলে মনে হতে লাগলো।

এতে বিড়ম্বনা আরোও বাড়লো। একদিন গলির শেষ বাড়ির পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চিরনেতা টাইপের ছেলেটিকে বাড়ি ফিরে যাবার অনুরোধ করে বসলাম। আমার কান্ডে ছেলেটি অবাক বা বিরক্ত হলো। তবে আমাকে খুব বেশী কিছু বলে সময় নষ্ট করলো না,

শরীর খারাপ আপনার, বিশ্রাম করুন।

শব্দগুলো বিদ্রুপ মনে হলো। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম,

আর ভাবনো না স্বপ্ন বা আনমনে ভেসে আসা দৃশ্যপট নিয়ে। বয়স্ক মস্তিস্ক ভোগাচ্ছে খুব। সেসব ভেবে নিজের প্রতি বিরক্তি এলো।

তবে আমার জন্য আরোও ভোগান্তি তখনও অপেক্ষা করে আছে।

আমি যতই না ভাবি, যতই স্বপ্নকে অর্থহীন বলে দূরে ঠেলি ততই স্বপ্ন আমাকে গিলে খেতে লাগলো। অবস্হা এমন দাঁড়ালো চেহারায় উস্কোখুস্কো ভাব ফুটে উঠলো। দোকান খুলতেও ভুলে যেতে লাগলাম। সারাক্ষণ স্বপ্নে দেখা নিঁখোজ সংবাদের মানুষ কিংবা বই অথবা শব্দগুলো খুঁজি।

এরমধ্যেই সেই স্কুলের মাঠে ওদের আনাগোনা আরোও বেড়েছে। খেলার মাঠে ওদের বাইরে সবার আসা বন্ধ হয়ে গেছে। দোকান থেকে মাঠটিকে কেমন অচেনা লাগে এখন।

আর এসবের মাঝেই আমি স্বপ্নগুলোর টোকা থেকে বাঁচার উপায় খুঁজছিলাম মনে মনে আজ সন্ধ্যায়। কিন্তু সে উপায় না এসে উল্টো এলো স্বপ্ন। বিভৎস স্বপ্ন। দোকানে বসে ঝিমুচ্ছিলাম আমি। তখন এলো স্বপ্নটিঃ

আমার সামনে বড় একটি হোল্ডিং-এ ঝোলানো মেয়ের ছবি। বিভৎস একটি ছবি। রক্তাক্ত অর্ধ উলঙ্গ একটি মেয়ের ক্ষতবিক্ষত ছবি। তাতে লেখা, বায়ান্ন বছর বয়সী একটি মেয়ে হারিয়ে গেছে, যার পরনে সবুজ রঙের একটি কাপড়।

স্বপ্নের ভেতরেই আমি বুঝতে পারলাম মেয়েটিকে আমার খুব চেনা লাগছে, তবে কিছুতেই স্মরণে আনতে পারছি না মেয়েটিকে।

দপ করে আমার ঝিমুনি ভেঙে গেলো। খুব চেষ্টা করেও মেয়েটিকে চিনতে পারছি না বলে বুকের ভেতর ব্যাথা শুরু হলো।

আর এ না চেনাই আমার মাথায় টোকা দিচ্ছে বারবার। এমনিতে কোনো মেয়ের দিকে আমি সেভাবে আগ্রহ নিয়ে তাকাই না। কিন্তু এসময় তাকাতে হচ্ছে। না, কারো সাথেই মিলছে না সেই হোল্ডিং-এর মেয়েটা। অথচ মেয়েটিকে আমি চিনি।

এসব ভাবতে ভাবতেই দোকানের এককোণে জমিয়ে রাখা অনেক পুরোনো সংবাদপত্রে হঠাৎ করেই চোখ পড়লো। এসব একসময় জমাতাম। আজকাল অবশ্য সংবাদপত্র পড়ে জমাই না, ফেলে দেই।

কী ভেবে ধুলো ঝেড়ে সংবাদপত্রগুলো হাতে নিতেই আমার মনে পড়লো মেয়েটিকে।

মেয়েটি সন্তানসম্ভবা ছিল। দেখেছিলাম বর্ডারের খুব কাছে। রক্তাক্ত অবস্হায় পড়ে ছিল মেয়েটি। পোড়া ক্যাম্পের পাশে অর্ধউলঙ্গ মেয়েটির নিম্নাংশে বেরিয়ে আছে একটা শিশুর রক্তাক্ত হাত।

হ্যাঁ, হোল্ডিং-এর মেয়েটিকে আমি চিনতে পেরেছি।

তাহলে স্বপ্নটি আসলে আমার অবচেতন মনের লুকিয়ে থাকা সেই ঘটনা থেকেই এসেছে। কোনো উটকো কিছুও ঘটছে না আমার সাথে।হিসেব মেলানোর আনন্দে আমি লাফ দিয়ে উঠি। আর ওঠার সাথে সাথেই হুড়মুড় করে পড়েও যাই।

মনে পড়লো, একাত্তরের নভেম্বরে বিরলের মুল্লুক দেওয়ানের খুব কাছে পাকিস্তানী আর্মির হেড কোয়াটার আক্রমণ করতে গিয়েছিলাম আমি, সেখানেই গ্রেনেডের আঘাতে বা পা হারিয়ে গেছে আমার।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ