মোহাম্মদ কাজী মামুনের গল্প : দুই বাস



সমানে বাড়ি পড়ছিল বাসটার গায়ে, লাঠির নয়, হাতের, মানুষের হাতের। এই বাড়ি ড্রাইভারকে মাঝে মাঝে হতবিহ্বল করে দেয়; সে প্রায়ই বুঝতে পারে না, এই বাড়ি বলতে আসলে কী বোঝায়। যাত্রীরা আসলে কী চায়? থামতে নাকি চলতে? বাড়িগুলো খুব একটা ভিন্ন হয় না, প্রায় একই রকম তাদের চিৎকার, একই তাল ও লয়ে!

‘জুতা দিয়ে পিডান দরকার শুয়োরের বাচ্চাগুলারে’ -এক পর্যায়ে তাদের একজন চেঁচিয়ে উঠলো। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ডানের বাসটির উদ্দেশে ছুঁড়ে দিল আরেকজন, ‘আগে যাইবার চায়, আগে খাইবার চায়।‘

দুই মহিলা পাশাপাশি বসেছিল। তারা পুরো সময়টা ধরে কথা বলছিল, কখনো নিজেদের মধ্যে, কখনো ফোনে, আর তা সবাই শুনতে পাচ্ছিল। সভা-সমিতি-মিছিল করে করে নারীদের ভয়েস অনেকটা যেমন হয়, তেমন ভাঙা ও গরম শোনাচ্ছিল তাদের কণ্ঠ। নারী দুজনের আঁটোসাঁটো সলোয়ার কামিজ, নেতিয়ে পরা ওড়না, মাথার সযত্নে বাঁধা ক্লিপের বেড়ায় সদ্য প্রস্ফুটিত খোঁপা। তারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, আর তারা বাসে ঘুমোতে ভালবাসতো খুব।

মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে থেকে বাস দুটি হাওয়ার তুফান ছুটিয়ে চলছিল। কে জিতছে যাত্রীগণের জানার উপায় ছিল না, ইচ্ছেও ছিল না; তারা তখন চোখ বুঁজে আল্লাহ্‌-খোদা করতে শুরু করে দিয়েছে। বাস দুটোর গন্তব্য ছিল এক, কিন্তু তারা ছিল আলাদা আলাদা পরিবহন সংস্থার অধীনে। ঘুরে সেই পথে আসবে তারা, যেখান থেকে শুরু করেছিল। মিরপুর টু গুলিস্তান, গুলিস্তান টু মিরপুর। তাছাড়া, মাঝে কত স্টেশান ধরবে, তা অগণিত ও অনির্ধারিত। যখন ফার্মগেট ক্রসিং ঘনিয়ে এল, তখন বাঁ দিক থেকে একটি মাইক্রো ঢুকে পড়ায় গতি রুদ্ধ করতে বাধ্য হল বাঁয়ের বাসটি। সেই সুযোগে সোঁ করে এগিয়ে গেল ডানের বাসটি অনেকখানি। কিন্তু যখন সে সিগনালে এসে দাঁড়ালো, বাঁয়ের বাসটি পেছন থেকে উল্কার মত ধেয়ে এল। অন্য দুটো গাড়ির কাটাকাটির মধ্যে পাওয়া জায়গাটি পুরো নিজের করে নিয়েছিল সে। এরপর আরো অনেক যানকে পাশ কাটিয়ে যখন ডানের সেই বাসটিকে এক হাত পেছনে রেখে দাঁড়াল বাঁয়ের বাসটি, ড্রাইভার সাহেব একবার সেদিকে চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে সামনে এক নির্লিপ্ত দৃষ্টি মেলে দিলো, যেন কিছুই হয়নি এতক্ষণ।

সিগন্যালবাতির নিচে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে বাস দুটির দিকে চোখ রেখে চলেছিল একটি অল্প বয়সি ছোক্‌রা। ডানের গাড়িটাকে সে টার্গেট করেছিল, কিন্তু এখন কানায় কানায় পূর্ণ বাঁয়ের গাড়িটির গহবরে সে সুরুত করে ঢুকে পড়ল আর গলা ফাটিয়ে বেচতে শুরু করলো দুই টাকা দামের সস্তা খবর কোন ভণিতা ছাড়াই – ‘কে জিতবে ইউক্রেন যুদ্ধে? পুতিন নাকি জেলেনস্কি?’ সেই খবর যখন ঠাসাঠাসি ভিড়ে ঘুরপাক খেতে থাকে বাসটির মধ্যে, ডানের গাড়িটার কোন এক কোণ থেকে পালটা তীর ছোঁড়া হয় বামের গাড়িটাকে লক্ষ্য করে, ‘তোমাগো ড্রাইভার একটা মাতাল, কি খাইয়া নামছে জিগাও।’

এরপর যখন দুই গাড়ির যাত্রীরা মুখ বাড়িয়ে ঝগড়া করতে করতে সিগন্যাল মুহূর্তটা পার করতো লাগলো, বাঁয়ের গাড়ি থেকে একজন যাত্রীর পাগলের মত চিৎকার শুনতে পাওয়া যায়, ‘ভাইয়েরা থামেন, কি করতাসেন আপনারা? অ্যাক্সিডেন্ট হইলে ওরা আমাগো থুইয়া পলাইব, দয়া কইরা বিপদ বাড়াইয়েন না।‘ এরই মাঝে পেছনের একজন মহিলা যিনি মেয়েসহ উঠেছিলেন, খুব সম্ভবত শখেই, সিটে বসতে বসতে হাত বোলাচ্ছিলেন কন্যার মাথায় আর বলছিলেন, ‘রিকশা তো পাওয়া যায় না, মা, তাছাড়া দেরিও হয়ে …।’ কচি স্কুল ইউনিফর্মের মধ্য থেকে একটা চিকন হাসি উথলে উঠতে দেখা গেল, ‘তুমি তো বাসে চড়তে পছন্দ কর, আর তাই রিকশা তোমার ভাল লাগে না।’ মা অবশ্য কানে তুললেন না, তিনি বরং সেই দেড় মাইল দূরের ঝিম মেরে থাকা বাসাটায় পৌঁছুনোর আগে হাতে থাকা সময়টুকু পুরো উসুল করে নিতে রুদ্ধশ্বাসে ছুটে যাওয়া মানুষের ছবিগুলো দেখতে লাগলেন নিমগ্ন হয়ে।

যাত্রীরা কেউ কেউ ওপরের রড ধরে ড্রাইভারকে সামনে বা পেছনে রেখে দাঁড়িয়ে। কেউ একদিকেই দুই হাত ধরে জানালার মুখোমুখি। কেউ একটি হাত এই সিটে রাখে, আর অন্যটি বিপরীত সিটে আড়াআড়ি করে। কেউ এক হাত দিয়ে সিট, অন্য হাত দিয়ে রড আঁকড়ে ধরে। কারো এক হাত সিটে ও অন্য হাত খালি। এদের মধ্যে নারীও রয়েছে; তাদের কেউ বোরখা, তার উপর ওড়না চাপিয়েছে। এদের মধ্যে কারো কারো ওড়না যেখানে খোঁপা ছুঁয়েছে, সেখানে ফিতা দিয়ে ফুল বেঁধে রেখেছে। কারো গায়ে আবার মাখানো আছে বেঢপ ফুলের কাজ করা সুতি শাড়ি, খোঁপায় বেঁধে রেখেছে বিকট দর্শন ক্লিপ।

বাস দুটি পাল্লা দিয়েছিল, যেন যাত্রী পৌঁছনো বা ভাড়া আদায় বা ট্রান্সপোর্ট ব্যবসা ওদের উদ্দেশ্য নয়, ওরা একটা রেসে নেমেছে। এই ওকে টেক্কা দেয়, তো পরমুহূর্তেই ও আবার একে ছাড়িয়ে যায়, মাঝে মাঝেই গায়ে গায়ে লেগে যায় তারা; ঘেঁষাঘেঁষি, ঘষাঘষির শব্দ চ্যার চ্যার ম্যাড় ম্যাড় করে উঠে। একবার দেখা গেল, বাঁয়ের তরুণ ড্রাইভারটি তার গাড়িটি এগিয়ে নিয়ে গেল শ্বাসরোধী গতিতে চালিয়ে; সবাই ধরে নিল এবার বোধহয় দফারফা হল এই প্রতিযোগিতার। কিন্তু না, কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে পরক্ষণেই গর্জে উঠল ডানের গাড়ির অপেক্ষাকৃত বয়স্ক ড্রাইভারটি, রকেট গতিতে এমনভাবে চালালো যে যাত্রীরা ছিটকে যেতে থাক; অনেক বড় বাস, টেম্পু, সিএনজি সব পেরিয়ে প্রতিযোগী বাসটির পাশে ভিড়িয়ে সে ব্রেক কষল। বাসটা কাওরান বাজারে টার্ন নেয়ার আগে পাশের রাস্তাটায় ঢুকেছিল, যদিও সেই সারিটা ছিল বাঁয়ে যাওয়া যানগুলির জন্য, সে এই শর্টকাট মেরে কিছুটা এগোনোর ধান্দা করে পুরোই সফল হয়েছিল। জ্যামের অবসরে ইচ্ছেমত রসদ মজুদ করে কিছুটা ভার ভার লাগছিল ডানের বাসটির, সেই অবস্থাতেই এক পথচারী বিপজ্জনকভাবে রাস্তা পার হতে থাকলে বাসটির ড্রাইভারের চোখ খুলে গেল। যখন বুঝতে পারল এক চিলতে জায়গা পেয়ে গিয়েছে সে, মুহূর্ত দেরি না করে চাপা দেয়ার হুমকি ছড়াতে ছড়াতে লোকটিকে থামিয়ে দিল সে, আর সিগন‍্যালের জ্যামটাকে ফাঁকি দিয়ে এগিয়ে গেল সবার আগে।

জমে উঠেছে এই রেস ভিডিও গেমসের মত। বিচিত্র ব্যাপার, বাসগুলোতে এই কোন লোক নেই, আবার এই লোকে ভর্তি হয়ে গেছে। যেমন, এই মুহূর্তে বাংলামোটরের মোচড়ে যখন দাঁড়িয়ে, তখন কমে গেছে এদের কারো কারো জনবল আশঙ্কাজনক হারে। সিগনালের জ্যাম অস্বাভাবিক দীর্ঘায়িত হচ্ছিল। পেছনে পড়ে থাকা বাসগুলোকে দেখে মনে হচ্ছিল অনন্তকাল ধরে এই স্থানেই বাস করবে। যখন বাঁয়ের বাসটির ভেতর থেকে গলা বাড়িয়ে ডেকে ডেকে লোক ভরা হচ্ছিল আর এক ফাঁকে হেল্পার নেমে পড়েছিল অদূরে জিহবা বেরিয়ে থাকা ডাস্টবিনটার কোনায়, ঐ মেয়ে দুজনের একজন অগ্নিমূর্তি ধারণ করল, আর নিজেদের বাস ড্রাইভারকেই হুঙ্কার ছাড়ল, 'এই ছ্যামড়া, সিগ্নাল দেখলেই কি তোর দাঁড়াইতে মন চায়”, পেছন থেকে উৎসাহ পেয়ে এক যুবক বয়সি বলে উঠে ‘হেল্পার হালায় একটা মাদারচোদ! থামলেই মুত আহে।’

বাঁয়ের বাসটা ৩৬ ফুট লম্বা হবে, দুই গজ পর পর একটা করে ফ্যান ছাদে, একটা বদসুরুত কাপড় ছাদকে মুড়ে রেখেছে। ৪টি ফ্যানের মধ্যে একটি নষ্ট, একটি ঠিকমত চলছে, একটি তাক করা ড্রাইভারের দিকে, আর একটা খালি, মানে খাঁচা আছে, কিন্তু পাখা নেই, যে বাসের সাথে সাথে দোলে। ডানের বাসটি সে তুলনায় কিছুটা নতুন, আর ঝকঝকে।

বাঁয়ের ড্রাইভারটির বয়স পঁচিশের বেশিঁ হবে না, মুখভর্তি খোঁচা দাড়ি, যে টিশার্টটা গায়ে চাপানো, তাতে ধুলোর গাঢ় আস্তর। চোখটা গর্তে ঢোকানো, কিন্তু তা থেকে ইঞ্জিনের ধোঁয়া ঠিক্‌রে ঠিক্‌রে বেরুচ্ছে। সে একবার জানালায় বসে কি যেন হাতড়ায় ছাদে। যাত্রীদের শোরগোলে সে মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় পেছনে, কিন্তু তা কয়েক সেকেন্ডের জন্যই। তাকে সময় মত পৌঁছাতেই হবে; আর সময় মত মানে হল, প্রতিদ্বন্দ্বীদের আগে পৌঁছানো। তাহলেই শুধু সে ট্রিপ বাড়ানোর স্বপ্ন দেখতে পারে। এমন নয় যে, বোনাসে সয়লাপ হবে সে; কিন্তু তার চাকরিটা ঝুলে আছে রাস্তার তারগুলো যেমন বিশ্রীভাবে ঝুলে থাকে খাম্বা থেকে সরু লাইন ধরে। সে এগিয়ে যেতে থাকে, তার যন্ত্রপাতিতে ত্রুটি দেখা দিয়েছে, অথবা, চালানোর আগে যতটা বলেছিল তার পরামর্শক গাড়ির কন্ডিশান, ততটাও স্বাভাবিক নেই। তবু সে রেইস চালিয়ে যায়। রেইসে নেমে কে কবে থেমেছে!

অন্যদিকে, ডানের ড্রাইভারটির মধ্যে কেমন একটা নির্লিপ্তি, চোখেমুখে বয়সের দুর্ধর্ষ সব বলিরেখা, যারা যেন কথা কয়ে উঠতে চাইছে প্রতিমুহূর্তে। সীমিত গতি ও সীমিত ঝুঁকি – কোনটাকে বাদ দিয়ে চলা সম্ভব? সে জানে কতটুকু গতি ওঠাতে হয় কোন পরিস্থিতিতে। যখন পাব্লিক বলে ‘আস্তে চালাও ওস্তাদ’, তখন তার যে হাসি পায়! আরে গাধার দল, গাড়ি কি ড্রাইভারের গতিতে চলে? গাড়ি চলে রাস্তার গতিতে। যেমন, আজকে যে ছোক্‌রা ড্রাইভার বাহাদুরি করতে লেগেছে, পেছন থেকে ট্যাকল করছে আর ফাউল করছে, তাকে সাইজ করা রাস্তার অঘোষিত নিয়মেই কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি দুর্বল গাড়ি থেকে পিছিয়ে পড়া অপমানকর ও লজ্জাজনক তার কাছে, আর এইজন্যই সে রেসে নেমেছ - এমনটাই হয়তো বলবে লোকে। কিন্তু সে যা করছে বা করতে যাচ্ছে, রাস্তার ডাক এসেছে বলেই। হ্যাঁ, তার আছে বেশি শক্তিশালি যন্ত্র, অধিক আসন, ও চাকা। তবু রাস্তা যদি তাকে পেছাতে বলতো, সে অবশ্যই পেছাতো।

ডানের গাড়িটি হেল্পার ছাড়াই চলছিল। ড্রাইভার একজন যাত্রীকে ভাড়া ফ্রি করে দিয়েছিল ভাড়া তোলার দায়িত্ব পালনের বিনিময়ে। তো সেই রেডিমেড হেল্পার যাত্রীগণের কথা কাটতে যেয়ে ক্ষণিকেই হৈচৈ বাঁধিয়ে ফেললো বাসটির চার দেয়ালে। এরপরও কেউ শুনতে পেল না ডানের ড্রাইভারটির গলার শোর, এমনকি টু শব্দটাও না। শুধু মাঝে মাঝে চোখ গলিয়ে সন্তপর্ণে পাশের তরুণী যাত্রীকে দেখে নেয় সে। তাছাড়া, পথের মাঝখানে পড়া বড় বড় সাইনবোর্ড বা টিভির দিকেও তার মায়াবী নজর লেগে থাকে অনেকটাক্ষণ।

অন্যদিকে বাঁয়ের গাড়িটার বয়স প্রয়োজনের থেকে বাড়িয়ে দিয়েছিল এর বাচ্চা হেল্পার। সে সামনের দিকে ঝুঁকে থাকা চুলটা কিছুক্ষণ পর পরই ঝাঁকায়, মেয়েদের সামনে বেশিক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকে, সে টাকাটা বাম হাতের কায় থেকে আংটি আঙ্গুল পর্যন্ত বাঁধা আঁটির উপর রেখে বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ঠেক দিয়ে ডান হাতের আঙ্গুল দিয়ে তার উপর কয়েকবার পরশ বোলায়, মনে হয় সোজা করছে বা আদর করছে। এটা তার একটা হবিও হতে পারে। সে প্রতিটা সিটেই কসরত করে করে ঢোকে, আর খিটমিটি শুরু হওয়ার আগেই দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। ভাড়া কাটা শেষ হলে সে গেটের বাইরে দেহের অর্ধাংশ বাড়িয়ে দেয়। এরপর বাম হাতটা ভেতরের হ্যাঙ্গারে রেখে ডান হাত নেড়ে নেড়ে প্যাসেঞ্জার আকৃষ্ট করে। এত বড় একটা যুদ্ধের অর্থের যোগান দেয়ার গুরু দায়িত্ব যে তার কাঁধে! অথচ এর মাঝেও প্রাইভেট কার দেখে ‘প্লাস্টিক, এই দেখ প্লাস্টিক’ বেরিয়ে আসে তার মুখ ফস্কে। মাঝে একবার তাকে অনেকটা আচমকাই এক অশীতিপর বৃদ্ধাকে হাত ধরে নামাতে দেখা যায়। কিন্তু উপরে উঠে এলে পড়তে হয় ড্রাইভারের হাত পা ছুঁড়তে থাকা তোপের মুখে, “এই টাকা তুলস না, ক্যান, মাঙ্গীর পুত! সমাজ সেবা মারাও!”

এরই মাঝে চলতি পথের কোন একটি জ্যামকে ধরে জিন্স ও টিশার্ট পরিহিত এক তরুণ হকার একটি পারফিউম হাতে উঠে পরে ডানের বাসটিতে। সে মোড়কটি খুলে ডান হাতে নেয় আর বাম হাতে রাখে প্যাকেটটি। এরপর ডান হাতটা বার কয়েক উঁচু করে স্মার্ট ভঙ্গিতে; যেন ক্রিকেট বল করছে, বা, কখনো দেখা যায় ব্যাটসম্যানের অ্যাকশানে হাতটা নত করে বাসের জমিনে। সে কিছুক্ষণ পরপর হাতের জিনিসটি দিয়ে হাওয়ায় স্প্রে করে। শুধু যখন ঝাঁকুনিটা বেশি হয়, তখন শক্ত করে ধরে হ্যান্ডল উপরের। এক ফাঁকে সে আড়চোখে ড্রাইভারকে দেখে নেয় ক্রোধান্বিত চোখে, তার গলার স্বর কেঁপে ওঠে বাসটির চাকা যখন তীব্র গতিতে কষাঘাত করতে থাকে পিচগুলোকে। সে তার সংলাপটিকে প্রায় অর্ধেকটা ছেটে ফেলে মাঝখান থেকে আবার বলতে শুরু করে, যদিও দর্শকশ্রোতা যারা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল, তাদের পক্ষে তা আর ধরা সম্ভব হয় না। এরপর লোকটি বাম হাত নিচে নামিয়ে ডান হাতটা ওঠায়, আর তার পণ্যের মোড়কে লাগানো আকর্ষণীয় ফিচারগুলি আঙ্গুল রেখে পড়তে শুরু করে। মাত্র দু’- তিনটে হাত উঠেছিল, তারপর যখন সেই হাতগুলো নেড়েচেড়ে দেখছিল পারফিউমগুলো, সে জানালাটা দিয়ে মাথা গলিয়ে দেখতে পায় পরের স্টপের অন্য রুটের একটা বাস পেটভর্তি মানুষ নিয়ে আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে! সে আবার তাকায় ড্রাইভারের দিকে, তার মারমুখি কিন্তু ফুলে ওঠা রগটা একসময় বাসটার থেকেও বেশি শিথিল হয়ে যায়।

হকারটির একটানা, বিরতিহীন চিৎকার সবাইকে তটস্থ করে তুলছে- রাশিয়া সিজ ফায়ার মানেনি, অভিযোগ ইউক্রেনের; জাতিসংঘ বিভক্ত, রাশিয়ার উপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা। পারফিউমের ছেলেটি নেমে যাওয়ার পর থেকেই ডানের বাসটির মাঠ তার দখলে। নিশ্চিত রুটের দৈর্ঘ্য বাড়িয়েছে সে, না হলে এই বাসে তার দেখা পাওয়ার কথা না। এদিকে গন্তব্য থেকে মাত্র এক স্টপেজ দূরে আছে, এমন অবস্থায় সিগন্যাল অতিক্রম করতে গিয়ে ডানের বাসের যাত্রীরা দেখতে পেল ট্রাফিক পুলিশ ব্যস্ত রয়েছে অন্য গাড়িগুলোকে নিয়ে, আর সেই সুযোগে তাদের ড্রাইভার সামনের খালি রাস্তাটা নিমিষেই পাড়ি দিয়েছে। পুরো রাস্তা জুড়েই পুলিশ সামনে পড়লে ড্রাইভারটি দুনিয়ার সব থেকে সুবোধ বালক হয়ে যাচ্ছিল, আর সেই পুলিশ নাগালের বাইরে রয়েছে টের পাওয়া মাত্রই সে সোঁ করে উড়ে যাচ্ছিল, আর মুখ পাখা মেলছিল উচ্ছল হাসির আদিগন্ত ঝলকে।

কাছেই ছিল বাঁয়ের বাসটি। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ট্রাফিক পুলিশ অলস মুহূর্ত পার করছিল তখন। আর তাই কাগজপত্র সব চেয়ে বসল সে। বাঁয়ের বাসটির ছিল ভঙ্গুর দশা, আর সেই অপরাধে গাড়িটিকে যখন বিস্তর জরিমানা করা হল, ছোকরা ড্রাইভার তর্ক করে যাচ্ছিল বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে। ধৈর্য্য টুটে যায় এক সময় পুলিশের খুব স্বাভাবিক কারণেই। আর ভঙ্গুর সেই বাসটির উপর ভাঙতে থাকে পুলিশের লাঠির আগা।

ফিরতি পথে, মানে, গুলিস্তান থেকে মিরপুর রুটে তরুণ ড্রাইভার সতর্ক ছিল, ইতোমধ্যেই গুলিস্তানের হট টাইম ধরতে ব্যর্থ হয়েছিল। তাই সে পুরো রাস্তা জুড়ে ট্রাফিককে খুব সমীহ করে চললো। সে এখন যে গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে, তাকে টেক্কা দেয়া ডানের বাসটিকে অচিরেই ধরে ফেলতে পারবে। তবে এখন প্রহরের পরিবর্তন হয়েছে, আর সে ডানে অবস্থান নিয়েছে, আর অন্য বাসটা বাঁয়ে। এদিকে সেই খবর-বেচা ছোকরাটি আবার উঠেছে, সে নির্ঘাৎ রুট পাল্টেছে, প্রহরের সাথে সাথে, নাহলে কেন সারাটা দিন ধরেই তার দেখা মিলছে? আবারো ইউক্রেনের আপডেট নিউজ তার অপুষ্ট ঠোঁটের আগায়, ‘কিয়েভ দখলে তীব্র লড়াই রুশ ও ইউক্রেন বাহিনীর মধ্যে, লক্ষ লক্ষ মানুষ আটকা পড়েছে।’ মনে হয়, এই মুহূর্তে পৃথিবীতে আর কোন খবর নেই।


বাস দুটোর পাশে আছে আরো অনেক অনেক বাস। তাদের মধ্যেও কিছু চলছিল কিনা তা জানার উপায় নেই এই বাসদুটোর যাত্রীদের; তারা তো শুধু এটুকুই জানে, তাদের বাস দুটি চলছে আর চলছে - আহ্নিক গতি, বার্ষিক গতি পেরিয়ে; বিষুব রেখা, মেরু রেখা সাঁতরে, সৌর জগতের সাথে তাল মিলিয়ে! কখনো কখনো সংঘর্ষ হতে গিয়েও হচ্ছে না। একটা গেমসে, একটা রেসে যেন অংশ নিয়েছে তারা। প্রতিটা সেকেন্ড গুরুত্বপূর্ণ, কাজে লাগাতে হবে; কিন্তু তাদের নিরন্তর একটানা গতির মধ্যে সময় যেন স্থির হয়ে পড়েছে, একটি বিন্দুর মত।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3 মন্তব্যসমূহ

  1. চমৎতকার একটি গল্প, বাস্তবতায় ঘেরা এ যেন গল্প নয়! এখনকার যে অবস্থা তা খুব সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে আপনার হাতে। “এই টাকা তুলস না ক্যান, মাঙ্গীর পুত! সমাজ সেবা মারাও”

    উত্তরমুছুন
  2. অসাধারন । জীবনের অনন্য চলচ্চিত্র । কথিত ভাষার ব্যবহার সতীনাথ ভাদুডী সমতুল!

    উত্তরমুছুন
  3. তোমার লেখা আমার পছন্দ কেন জানো?
    তোমার বৈচিত্র্যময় আয়োজনের জন্য।
    তোমার ভাবনা বিস্তারে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে ভয় না পাওয়ার জন্য।
    রূপককে চমৎকারভাবে ব্যবহার করার জন্য।
    তোমার এই গল্পটিও কোনো ব্যতিক্রম নয়। হয়ত সব শ্রেণির পাঠকের কাছে সমাদৃত হবে না। হয়ত সবাই আজকের এই জীবনের...যাত্রাপথের আতিশয্যকে চিহ্নিত করতে পারবে না তবুও... ইউ হ্যাভ হিট দ্য রাইট কর্ড।
    এটাই তোমার সিগনেচার স্টাইল এবং এই প্রয়াস জারি থাক।

    উত্তরমুছুন