ইন্তিজার হুসেইনের গল্প: দ্য ওয়াল




মূল গল্প: ইন্তিজার হুসেইন
 ভাষান্তর সুদেষ্ণা দাশগুপ্ত




‘ও হাসছে।’

‘কী?’ তক্ষুণি সবাই ঘুরে গিব্রানের মুখের দিকে তাকায়।

আবার, গিব্রান কান উঁচিয়ে কিছু শোনার চেষ্টা করে, তারপর বলে, ‘হ্যাঁ, ইয়ার, হাসির মতোই শোনাচ্ছে, ও হাসছে।’সবাই কান খাড়া করে দূর থেকে আসা কিছু শোনার চেষ্টা করে, চিন্তিত মুখ আর দমচাপা নীরবতা নিয়ে গ্রিব্রানের কথায় সম্মতি দেয়। তবে একজন এই বিষন্নতার অংশীদার ছিল না। সে উদাসিন, তবে হতাশ নয়। মান্দারিস, যে এদের মধ্যে সবচেয়ে বড়, চেষ্টা করছিল এতসব দুশ্চিন্তা যাতে তার বোধবুদ্ধিকে গ্রাস না করে ফেলে। অসীম গাম্ভীর্য অক্ষুন্ন রেখে দুঃখের সঙ্গে বিড়বিড় করেন, ‘সে-ও...’ আর নীরব হয়ে যায়।

হঠাৎ আমীরের সারা শরীরে শিহরণ বয়ে যায় আর ও দাঁড়িয়ে পড়ে। বন্ধুরা সপ্রশ্ন দৃষ্টি নিয়ে ওর দিকে তাকায়।

‘আমি যাব, আর একটা খবর নিয়ে আসব।’ বলে আমির চলে যায়।

অন্যরা চুপ করে বসে থাকে। সন্ধে নামে। সবারই চোখ আমীরের চলে যাওয়ার দিকে, যদিও বেশিক্ষণ তা দৃষ্টিগোচর হয় না। অন্ধকার নেমে এলেও তা পায়ের শব্দকে ঢাকে না, অনেক দূর অবধি আমীরের পায়ের শব্দ সবাই কান পেতে শোনে।

‘আর কিছু শোনা যাচ্ছে না।’ আসাহিল বলে ওঠে।

গ্রিবান কান খাড়া করে আরও গভীরভাবে শুনতে চেষ্টা করে। আসাহিলের কথায় সম্মত হয়ে বলে ‘হ্যাঁ, আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন ও হাসি থামিয়েছে।‘

আবার কারুর পায়ের শব্দ শোনা গেল, আমীর ফিরে আসছে। ওকে কেউই কিছু বলল না, কোনো প্রশ্ন করল না। ঠোঁটে না প্রশ্নটা ছিল সবার চোখে। সকলের জিজ্ঞাসু চোখ আমীরকে ঘিরে ধরে।

‘কিন্তু সে ওখানে নেই’।

‘সে কী!’ ওরা সবাই চমকে ওঠে।

‘হ্যাঁ, আমার বন্ধুরা, ও ওখানে নেই। লম্বা দেওয়ালের একেবারে কাছে গিয়ে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত আমি খুঁটিয়ে দেখেছি। ও সেখানে ছিল না’।

‘তাহলে কি সে-ও?’ গমগমে কিন্তু বিষণ্ণ গলায় বলেই মান্দারিস স্তব্ধ হয়ে যায়।

‘তাহলে ও কোথায় গেল?’ আসাহিলকে উদ্বিগ্ন দেখায়।

‘ওর আগে বাদবাকিরা যেখানে গেছে, ও সেখানেই গেছে।’ জোর দিয়ে বলে মান্দারিস। ওর বলার দৃঢ়তা বন্ধুদের মুখে কুলুপ এঁটে দেয়। বেশ কিছুক্ষণ পর আসাহিল বিড়বিড় করে, ‘আমাদের এতজন বন্ধু এই পথে পা বাড়াল আর হারিয়ে গেল! আশ্চর্যের ব্যাপার প্রতিটি বন্ধু বলেছিল যে একবার ওখানে যাই, কী আছে দেখে সেই খবর নিয়ে আসি, কিন্তু যেই মুহূর্তে সে দেওয়ালে চড়ছে, সেই মুহূর্তেই যেন বোবা হয়ে যাচ্ছে। আর তখন আমাদের দিকে না ফিরে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে, জোরে হাসছে আর ওই দিকেই পা বাড়িয়ে দিচ্ছে’।

‘কী আছে ওই অন্যদিকে?’ আসাহিল জিজ্ঞেস করে।

‘ওই দিকে?’ চমকে উঠে এ ওর দিকে অনেক প্রশ্ন নিয়ে তাকায়, আর সবাই গভীর চিন্তায় ডুবে যায়। তবে অ্যামাসা ছাড়া। আমাসের মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে মান্দারিস ওকে জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা অ্যামাসা, তুমি কি জানো দেয়ালের অন্যদিকে কী আছে?’

‘কিছুই না মানে এমন কিছু না যা জানার মতো।’

‘কিছু না? তাহলে সবাই অন্যদিকে যাচ্ছে কেন আর গিয়েই হাসছে কেন?’ আমীর রেগে ওঠে।

‘ও হাসছে এই কারণে যে ওখানে গিয়েই বুঝেছে যে ওখানে কিছুই দেখার নেই।’ এই কথা শুনে আমীর আরও রেগে খাপ্পা হয়ে ওঠে। উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘আমি ওই দেয়ালে চড়ব, তারপরে ফিরে এসে বলব ওখানে সত্যিই কী লুকিয়ে আছে।’

বন্ধুরা সবাই চিন্তিত মুখে ওর দিকে তাকায়, আমীর তৈরি হয় দেয়ালের দিকে যাওয়ার জন্য।

‘তোমার আগে যারা গেছিল তারাও তোমার মতো ঠিক এই কথাগুলোই বলে এগিয়েছিল।’ ঠোঁটে বিষ হাসি নিয়ে অ্যামাসা বলে।

‘কিন্তু আমি ফিরে আসব।’ ক্রুদ্ধ আমীর জবাব দিয়ে দ্রুত এগিয়ে যায়। দ্রুত হেঁটে যাওয়ায়, মুহূর্তেই সবার চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় আমীর। আর ঝুপ করে নেমে আসে অন্ধকার। ওর চলে যাওয়ার দিকে বন্ধুরা তাকিয়ে থাকল যত দূর পর্যন্ত দৃষ্টি যায়। তারপর কান খাড়া করে রাখে। ভীত, নিস্তব্ধ সবাই বসে থাকে। সেই হাসি শোনার অপেক্ষায় থাকে যা এর আগেও বারবার শুনেছে।

গিব্রান কান পেতে শোনার চেষ্টা করে তারপর বলে, ’এবার, সে-ও...।’

‘কী? শেষ পর্যন্ত আমীরও?’ সবাই চমকে ওঠে।

গ্রিব্রান আবার মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করে দূর থেকে ভেসে আসা কোনো শব্দের তারপরই বলে, ’হ্যাঁ, আমীরও।’

নিজের মতো করে সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে ভেসে আসা আওয়াজের ধ্বনি, ভয়ার্ত স্বরে বলে, ‘হ্যাঁ, সে-ও।’

আর কিছু শোনা যাচ্ছে না। গ্রিব্রান কান খাড়া করে আপ্রাণ চেষ্টা করে শোনার, কিন্তু না আর কোনো আওয়াজ নেই। হতাশ গিব্রান বলে, ‘না, আর কোনো শব্দ আসছে না।’

‘তার মানে ও-ও চলে গেল।’ মান্দারিস বলে ওঠে।

‘এছাড়া আর কী হতে পারে?’

বেশ কিছুক্ষণ সবাই স্তব্ধ হয়ে থাকে। শেষে আসাহিল নড়েচড়ে গা ঝাড়া দিয়ে বলে, ‘যদি আমাদের আজুজ আর মাজুজের মতো জিভ থাকত!’

‘সেটা কীভাবে সাহায্য করত আমাদের?’ বিস্মিত অ্যামাসা জানতে চায়।

‘সেক্ষেত্রে সারারাত জিভ দিয়ে চেটে আমরা দেয়ালটাকে ফেলে দিতে পারতাম।’

‘কিন্তু পরের দিন সকালেই তো ওটা আবার সেই একই জায়গায় খাড়া হয়ে যেত!’

মান্দারিস তার অভিজ্ঞ গলায় মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করে, ‘আরে ভাই, তোমরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া কোরো না। সবাই মিলে মাথা ঘামিয়ে চেষ্টা করো দেয়ালের ব্যাপারে একটা সমাধানে আসার।’

‘এর চেয়ে ভালো চলো আমরা সবাই ফিরে যাই।’ গিব্রান বলে।

আসাহিল কড়া চোখে গিব্রানের দিকে তাকায়, ‘কী বললে? ফিরে যাব?’

‘হ্যাঁ, ফিরে চলো। তাতেই আমাদের সবার বাঁচোয়া, নয়তো এই দেয়াল আমাদের চরম দুর্ভাগ্য বয়ে আনবে।’

‘ফিরে গেলে আমরা চরম দুর্গতির মুখে পড়ব।’।

‘সেসব দুর্গতি থাকলেও এর চাইতে অনেক স্বস্তির, এখানে কী? এক এক করে শুধু প্রার্থনা করছি, নিজের মুখে ফিরে আসার ঘোষণা করছি, অর্থহীন হাসছি। আর তারপরেই একটাও কথা উচ্চারণ না করে দেওয়াল ডিঙিয়ে ওইদিকে চলে যাচ্ছি। এই এক ঘটনার পুনরাবৃত্তি কোন সুরাহাটা আমাদের করছে?’

একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে মান্দারিস বলে, ‘প্রিয়জনেরা, আমি দেখতে পাচ্ছি ওই দেয়াল আমাদের মধ্যে একটা দেয়াল তৈরি করছে। এই দেয়াল আরও বড় হয়ে ওঠার আগে আমাদের এই সমস্যার কোনো সমাধান খুঁজে বার করতে হবে। আর তাই, মাই ডিয়ার বন্ধুরা, আমি এবার ওই দেয়াল ডিঙোতে যাব’।

‘মান্দারিস তুমি?’ সবাই শঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করে।

‘হ্যাঁ, আমি ....আমি দেয়াল ডিঙিয়ে ওদিকে যাব, এবং ওইদিকের খবর তোমাদের কাছে নিয়ে আসব।’

‘সেই এক বিবৃতি।’ গিব্রান বলে, ‘ঠিক যা অন্যেরা যাওয়ার আগে বলেছিল। ওরাও এই বিবৃতি দিয়েই গেছিল, কিন্তু ফিরে আসেনি।’

‘কিন্তু আমি একটা উপায় বার করেছি ফেরার।’

‘সেটা আবার কী?’

‘আমি একটা বড় দড়ি নেব। দড়ির এক প্রান্ত আমার কোমরে জড়িয়ে গিঁট বেঁধে নেব আর দড়ির অপর প্রান্ত থাকবে তোমাদের হাতে। যেই মুহূর্তে আমি ওই হাসির ফাঁদে পা দিয়ে দেওয়ালের অন্যদিকে ঝাঁপাতে উদ্যত হব, তোমরা সেই মুহূর্তে দড়ির অন্যপ্রান্ত থেকে আমাকে টেনে ধরবে। এতে আমি ওইদিকে আর লাফাতে পারব না, কিন্তু তোমাদের জন্য ওইদিকে কী আছে তার খবর আনতে পারব।’ একথা শুনে অ্যামাসা তার সহজাত হাসিটা আবার শুরু করে। মান্দারিস সেই হাসি অগ্রাহ্য করে নিজের পরিকল্পনা মাফিক কাজ শুরু করে। লম্বা দড়ির এক প্রান্ত নিজের কোমরে পেঁচিয়ে শক্ত গিঁট লাগায়, আর অন্য প্রান্ত নিজের বন্ধুদের হাতে ধরিয়ে দেয়ালের দিকে এগিয়ে যায়।

দেয়ালে ওঠার আগে মান্দারিস দেখে নেয় বন্ধু আসাহিল আর গিব্রানের দিকে, যারা ওদের হাতে দেওয়া দড়ির অপরপ্রান্ত আঁকড়ে ধরে আছে। অ্যামাসাকে একটু দূরে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মান্দারিস বলে, ‘ও অ্যামাসা, তুমি কি ওভাবেই দূরে দাঁড়িয়ে থাকবে আর আমাকে দেয়ালের ওদিকে পড়ে যেতে দেখবে?’

অ্যামাসা কিছুক্ষণ থমকে থেকে অলস পায়ে এসে দড়ি ধরে, তারপর বলে –‘আমার নিজের জন্যই খারাপ লাগছে কারণ আমি জানি ব্যর্থ প্রচেষ্টা হতে চলেছে, আর সেই দলে কিনা আমি নিজে সামিল হচ্ছি!’

মান্দারিস দ্রুত দেওয়ালে চড়ে। চোখের পলক ফেলতেই গিব্রান আর আসাহিল দেখে মান্দারিস দেয়ালের মাথায় দাঁড়িয়ে, আর সে দেয়ালের অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। আসাহিল চেঁচিয়ে বলে, ‘ও মান্দারিস, আমাদের বলো, তুমি দেয়ালের ওদিকে কী দেখতে পাচ্ছো?’

আসাহিলের কথা প্রতিধ্বনিত হয়ে ঘন অন্ধকারে আর শূন্যে হারিয়ে যায়। আসাহিল অবাক হয়, সে মান্দারিসকে ডাকছে তবু সে সাড়া দিচ্ছে না। এবার গিব্রান ডাকে মান্দারিসকে, সেও আশ্চর্য হয়। মান্দারিস ওর ডাকেও সাড়া দেয় না।

‘কী অদ্ভুত না? মান্দারিস আমাদের ডাক শুনছে তবু জবাব দিচ্ছে না।’

‘মান্দারিস উত্তর দেবে না। কারণ সে এরপরেও দেখতে পেয়েছে।’ বিড়বিড় করে ওঠে অ্যামাসা।

‘কিন্তু,’ গিব্রান চমকে উঠে বলে, ‘ও হাসছে’।

‘ কী?’ কান খাড়া করে আসাহিল, ‘মান্দারিস কি হাসছে?’

ওরা দু’জন মন দিয়ে শোনে আর আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। মান্দারিস, যার ওপরে এদের এত ভরসা ছিল সে-ও হাসতে শুরু করল!

‘মান্দারিসও?’ উদ্বিগ্ন গিব্রান জানতে চায়।

‘না, যে কোনো মূল্যে মান্দারিসকে ফিরে আসতেই হবে। ওর কোমরে তো দড়ি বাঁধা আছে আর আমাদের হাতে ধরা সেই দড়ির অপর প্রান্ত’

‘কিন্তু আমার কব্জি ভারী হয়ে আসছে।’

‘আরে গিব্রান, দড়িটা শক্ত করে ধর, একমাত্র এভাবেই আমরা মান্দারিসের ওইদিকে ঝাঁপিয়ে পড়া রুখে দিতে পারি।’

অ্যামাসার সাথে আসাহিল আর গিব্রান শক্ত করে দড়ি টেনে ধরে। প্রথমে মান্দারিসের মৃদু হাসির শব্দ শোনা যায়। ধীরে ধীরে তা জোরালো হতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত মান্দারিসের অট্টহাসি শোনা যায়।

ভয়ার্ত আসাহিল, গিব্রান, অ্যামাসা সেই হাসি শুনে যেতে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত নিজেদের হাতের দড়ি শক্ত করে চেপে ধরে রাখতে সক্ষম হয়।

‘শোনো তোমরা, নিজেদের হাতের দড়ি এবার নিজের দিকে সজোরে টানো নয়তো আমরাই ওই দেয়ালের দিকে চলে যাব’। আসাহিল বলে।

প্রাণপনে ওরা তিনজন দড়ি টানতে থাকে। বোঝে, হ্যাঁ, মান্দারিসকে ওরা নিজেদের দিকে টেনে নামাতে পেরেছে। কিন্তু যেই কাছে যায়, তিনজনের চোখ বিস্ফারিত হয়ে ওঠে বিস্ময়ে আর ভয়ে।

গিব্রানের গলা শোনা যায়, -‘বন্ধুরা এটা কী দেখছি –মান্দারিসের রক্তে ভেজা ধড় এখানে পড়ে আছে। শরীরের আর একটা ভাগ কোথায়?’

‘আমার মনে হয় এসব টানাহ্যাঁচড়ার ফল। শরীরের একভাগ আমাদের দিকে আর অন্যভাগ ও পাশে গিয়ে পড়েছে।’

গিব্রান শুনতে পায় আসাহিলের কথা, অস্বস্তি বোধ করে, অ্যামাসার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করে, ‘ও অ্যামাসা, তুমি এ ব্যাপারে কী বলবে?’

অ্যামাসা হাসে। ‘মান্দারিস এক অযৌক্তিক পরিকল্পনা করে নিজেকে হাস্যকর প্রতিপন্ন করল ...দেখো --- ওর দেহের এক অংশ এদিকে পড়ে আছে আরেক অংশ ওদিকে।’

ভেজা আর কোথাও জমাট বাঁধা রক্তে মান্দারিসের বিভক্ত দেহের দিকে তাকিয়ে বেদনার্ত আসাহিল বলে, ‘যদি আমাদের আজুজ আর মাজুজের মতো জিভ থাকত!’

‘কী বা হতো তাতে?’ দুর্বল কণ্ঠে গিব্রান জানতে চায়।

‘তাহলে আমরা সারারাত লেহন করে দেয়াল নামিয়ে দিতে পারতাম।’

‘আর পরের দিন আবার দেয়াল যে কে সেই খাড়া হয়ে যেত।’

‘আমরা আবার জিভ দিয়ে লেহন করে রাত্তিরে দেয়াল ফেলে দিতাম।’

‘আর পরের সকালে তাকে আবার একই জায়গায় একই অবস্থায় দেখতাম।’ অ্যামাসা তেতো মুখে তার বিষাক্ত হাসি মাখিয়ে বলে, আর তারপর হাসতে শুরু করে।

গিব্রান আর আসাহিল অ্যামাসার এই প্রতিক্রিয়ায় আহত বোধ করে।

‘অ্যামাসা-ও? গিব্রানের মুখে আর কোনো কথা আসে না।

‘আর অ্যামাসা তো দেয়ালেও চড়েনি।’ আশ্চর্য হয়ে আসাহিল বলে ওঠে।

ভয়ে, বিস্ময়ে আসাহিল আর গিব্রান দেখে -অ্যামাসার হাসি ধীরে ধীরে ওপরে চড়তে থাকে আর তা অট্টহাস্যে পরিণত হয়।
----------
একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা: ওল্ড টেস্টামেন্ট কথিত সেই প্রাচীন দেয়ালের গল্প। আজকের পৃথিবীর সাপেক্ষে যা বিশেষ বার্তা বহন করে। দেয়ালের অপর পারে রয়েছেন অসীম ক্ষমতাবান কেউ একজন, বা একদল মানুষ, যাদের অস্তিত্বের রূপটি অপেক্ষাকৃত দুর্বল বা বিপন্ন অস্তিত্বের মানুষের চোখে যথাযথ স্পষ্ট নয়। ক্ষমতাবানের ক্ষমতার রহস্য জানতে সাধারণ মানুষ আজও একইরকম আগ্রহী। আদিকালের ইহুদী-দেশে একটি পুরনো দেয়ালের এপারে-ওপারে বাস করা মানুষদের মধ্যে প্রথমে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিভাজন ছিল, তারপর সেটি ক্রমে জাতিগত বিভাজনের আকার নেয়। একপক্ষের অর্থবল, ধনসম্পদ, বেশি। তাই ক্ষমতা বেশি। অপরপক্ষ সব দিক দিয়েই তাদের থেকে দুর্বল। অদৃশ্য নয়, এই দুটি জাতির মাঝে আজও রয়েছে একটি দৃশ্যমান দেয়াল। সেই ঐতিহাসিক দেয়ালের যে ধারে ক্ষমতার রাশ ধরে রাখা রয়েছে, সেই ধারের থেকেই ঘোষিত হচ্ছে একের পর এক ধর্মীয় আর সামাজিক বিধান। বারবার সেগুলোর সংস্কার, পুনঃসংস্কারও ঘটে চলেছে। এমনও ঘোষণাও শোনা গিয়েছে, কেউ যদি এই দেয়াল অতিক্রম করে অন্য পারে চলে যেতে পারে, তবে ‘অন্তিম ক্ষণ’ বা ‘শেষদিন’ উপস্থিত হবে সভ্যতার শিয়রে। যে চার বন্ধু এই কল্পিত রূপকধর্মী কাহিনিতে, তাদের কেউ ইহুদী, কেউ মুসলিম, কেউ বা খ্রিস্টান। সুপ্রাচীন এই দেয়ালের কথা একেশ্বরবাদী তিনটি প্রধান ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে। চার বন্ধু যেন বাইবেল-বর্ণিত চার দেবদূত। কিন্তু আধুনিক পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে তারা ঈশ্বরের অস্তিত্বের সবটুকু জেনে ফেলতে চাইছে। ফ্রানৎস কাফকা’র একটি অনুগল্পেও ক্ষমতার অন্দরমহলে প্রবেশ করতে চাওয়া সাধারণ মানুষের করুণ পরিণতি লিখিত রয়েছে। একটি লোক একবার একটি বন্ধ দরজার সামনে বহুকাল অপেক্ষা করছিল, দরজার ওপারে কী রয়েছে তাকে জানতে হবেই। কিন্তু দ্বাররক্ষী কিছুতেই তাকে প্রবেশ করতে দিল না। লোকটা এভাবেই চিরটাকাল বন্ধ দরজার সামনে হত্যে দিয়ে পড়ে রইল। তার জীবন কেটে গেল প্রায়। বার্ধক্যে প্রবেশের বেশ কিছুকাল পর একদিন সে বুঝল, এবার সে মারা যাবে। প্রহরারত দ্বাররক্ষীকে সে অনুনয় করে বলল, একবার অন্তত আমাকে ভেতরে ঢুকতে দাও। আমাকে জানতেই হবে, দরজার ওপারে কী আছে। রক্ষীটি হেসে বলে, বন্ধু, তোমার অবগতির জন্য বলি, এটি আসলে কোনও দরজা নয়। আসল দরজা রয়েছে অনেক দূরে। তোমাকে দিকভ্রান্ত করতেই এখানে একটা দরজা আঁকা হয়েছে। তোমার মৃত্যুর পর তোমার মত এই দরজাটিও একদিন ধুয়েমুছে যাবে।
 
লেখক পরিচিতি:
প্রখ্যাত পাকিস্তানি সাংবাদিক, ছোট গল্প লেখক এবং ঔপন্যাসিক ইন্তিজার হুসেইন উর্দু সাহিত্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী গল্পকারদের একজন। জন্মে ছিলেন ব্রিটিশ-ভারতের বুলান্দশহরের দিবাইতে। ১৯৪৭ এ দেশভাগের পর পাকিস্তানের লাহোর-এ চলে যান। লিখেছেন ‘বস্তি’, ‘নয়া ঘর’ এবং ‘আগে সমুন্দর হ্যায়’ নামের তিনটি উপন্যাস। ‘লীভ্স’, ‘দি সেভেন্থ ডোর’. ‘এ ক্রনিকল অফ দি পীককস’ এবং ‘অ্যান আনরিটন এপিক’ তাঁর কয়েকটি বিখ্যাত গল্প সংকলন। তাঁর লেখায় দেশভাগ পূর্ব জীবনের স্মৃতি যেমন ঘুরে ফিরে এসেছে তেমনি ধরা রয়েছে তাঁর জীবন-পাঠ যা একই সাথে সমকালীন এবং কালোত্তীর্ণ।
 
নিজের দেশে নানা সম্মানে ভূষিত ইন্তিজার হুসেইনকে ২০০৭ সালে ভারতীয় সাহিত্য আকাদেমি প্রেমচাঁদ ফেলোশিপে সম্মানিত করে। ২০১৩-তে ‘বস্তি’ উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনূদিত হওয়ার পর তাঁর নাম ‘ম্যান বুকার’ পুরস্কারের মনোনয়নের জন্য সর্বোচ্চ বিবেচিত নামের তালিকায় সংযুক্ত হয়। ২০১৪-তে পান ফরাসী সরকার-এর ‘অর্ডে ডেস আর্টস এট ডেস লেটার্স ‘-এর সম্মান।



অনুবাদক পরিচিতি:
সুদেষ্ণা দাশগুপ্ত
কথাসাহিত্যিক। অনুবাদক
কলকাতায় থাকেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ