মেয়েটির প্রসব ব্যথা উঠেছে। সন্ধ্যে কাছাকাছি। ঝিরিঝিরি বাতাসে গ্রামের গাছপালাগুলো হালকা চালে দুলছে। মেয়েটি ব্যথায় এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি দৌড়াচ্ছে। কোনো বাড়িতেই তাকে দাঁড়াতে দিচ্ছে না। কারণ যে বাড়িতে সন্তান জন্ম দিবে সে বাড়িতে তাকে অনেকদিন থাকতে হবে। গ্রামের কেউ সে ঝামেলা নিতে রাজি নয়। সম্ভবত সে কারণেই কোনো বাড়িতে ঠাঁই হচ্ছে না। মেয়েটির কী তবে নিজের কোনো বাড়ি ঘর নেই। মেয়েটি প্রসব ব্যথায় দৌড়ানো তো দূরের কথা আর দাঁড়িয়েই থাকতে পারছে না। কোন্ বাড়িতে সে আশ্রয় নিবে। সবাই ‘ভাগ এখান থেকে’ ‘দূর হ এখান থেকে’ নানা কথা বলে তাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু সন্তান জন্ম দেবার জন্য নিরাপদ একটু ঠাঁই দরকার মেয়েটির। কোথায় যাবে মেয়েটি। অবশেষে সোহরাবের গোয়াল ঘরে তার ঠাঁই হয়।
মেয়েটির নাম সুহানা। বয়স আঠারো কী উনিশ হবে। শ্যামলা বরণ গায়ের রঙে যেন মাতাল করা আবেগ। কালো রঙে একটা অপূর্ব লাবণ্য যেন জড়িয়ে থাকে সারাক্ষণ। এক নজরেই যে কারো চোখে পড়বার মতো। তারুণ্য আর লাবণ্য যেন ছুঁই ছুঁই। কিন্তু সারাক্ষণ গায়ে নোংরা জামা থাকে। সব সময়ই চুলগুলো এলোমেলো। মাঝে মাঝে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলে। সেজন্য কেউ কেউ তাকে অস্বাভাবিক বা পাগলি বলেও তিরস্কার করে। তবে, এসবের কোনো কিছুর প্রতি তার খেয়াল নেই। নিজের মনে নিজেরই কথা বলে চলে। এ গ্রামে সুহানাকে অনেক দিন ধরেই এমনটা দেখা যায়।
সুহানার বাবা—মা কেউ নেই। এ গ্রামে তার নানার বাড়ি। সে মামার কাছে থাকে। মামা অত্যন্ত দরিদ্র। তার ছেলে পুলে নাই। ভাগ্নীকে সে অত্যন্ত স্নেহ করে। মামা শুঁটকি বিক্রি করে জীবীকা নির্বাহ করে। সকাল সন্ধ্যা নানা গ্রামে শুঁটকি বিক্রি করে বাড়িতে এসে প্রথমেই সুহানাকেই খোঁজ করে। সুহানার বাবার বাড়ি গোবিন্দপুর। সুহানার বয়স যখন মাত্র দুই বছর তখন এক দুরারোগ্য ব্যধিতে তার মা মারা যায়। ভালো কোনো চিকিৎসা নিতে পারেনি। এমনকি কী অসুখে মারা গেছে তাও তারা জানে না। কিন্তু সুহানা মায়ের কথা এখন ভুলে গেছে। স্মৃতিতেও ভাসে না। কেন ভাসে না তাও জানে না। সুহানার বাবা আরেকটি বিয়ে করে। সৎ মায়ের ঘরে সে নাকি যত্নেই প্রতিপালিত হচ্ছিল। কিন্তু কয়েক বছর পরেই সুহানার অস্বাভাবিক আচরণ করতে দেখা যায়। তখন বয়স পাঁচ বছর। নানা সময়ই অসংলগ্ন অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে। শোনা যায় তার সৎ মার সন্তান হয়েছে। তারপর থেকেই সুহানার এমন অবস্থা। সংসারের ভেতরে প্রকৃত কী ঘটনা ঘটে তা কেউ জানে না। সবাই দেখতে পায় সুহানার পাগলামো। এমন সময়ে হঠাৎ করেই তার বাবা মারা যায়। সুহানা আতঙ্কিত হয়ে উঠে তার আশ্রয়টুকু থাকবে তো। গ্রামবাসীরা বুঝতে পারে সুহানাকে তার নানাবাড়িতেই পাঠানো ভালো। কিন্তু নানা—নানি মারা গেছে জন্মের আগেই। অবশেষে সুহানার মামা তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে। সেই থেকেই মামা বাড়িতে সুহানা বড় হতে থাকে। কিন্তু দরিদ্র মামা অনেক কষ্টে থাকলেও ভাগ্নীকে নিজের সন্তানের মতোই আগলে রাখতে চায়। নিজেরা যা খায় তাকেও তা খাওয়ায়। খাবার না জুটলে সবাই মিলেই উপোস করে। নিজেদের সামর্থ অনুসারেই সুহানাকে জামা কাপড় পরতে দেয়। স্কুলে ভর্তি করে দিলেও স্কুলে খুব বেশি পড়া তার হয়ে ওঠে না। মামা বাড়িতে কোনো অস্বাভাবিক আচরণ কখনো কারো চোখে পড়ে না। চোখে পড়ে তার যৌবনের আলো।
গ্রামে প্রবাদ আছে‘স্বামীহীন নারী সবার ভাবী’। তেমনি সুহানার বাবা—মা নাই বলে লোকজন নানা রকম কটাক্ষ করে। আজে বাজে নানা টিপ্পনি কাটে। কিন্তু সুহানা কিছু বলে না। এমনকি নিজের মামাকেও কিছু বলতে পারে না। মামা যদি আবার সন্দেহ করে। এরি মধ্যে সুহানার বয়স পনেরো কী ষোল হয়ে উঠেছে। যৌবনের রঙিন আলো যেন তার উপর ভর করেছে। দেহভঙ্গি, অঙ্গ—প্রতঙ্গগুলো যেন চকচক করে উঠে। যেদিকে হেঁটে যায় মানুষের মনোযোগের কেন্দ্র হয়ে উঠে। কী তার শুভ্র মুখভঙ্গি, সরল অভিব্যক্তি, পুষ্ট নিতম্ব, চোখে কটাক্ষ যেন ঠিকরে ঠিকরে পড়ে। শরীরের ছেঁড়া মলিন কাপড়েও যেন লাবণ্য ছুঁয়ে যায়। সুহানা নিজেকে সংযত রাখে। মানুষের কটাক্ষকে পাশ কাটিয়ে চলে। কোনো কোনো ইভটিজিং—এর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে না। মামা সারাদিন গ্রামে গ্রামে ঘুরে শুঁটকি বিক্রি করে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে মামাকে কিছু বলতে পারে না। কিন্তু মনে মনে অসহায়ত্ব গ্রাস করে চলে। অসহায়ত্বের শিকল সে ভাঙতে চায়। কিন্তু কীভাবে ভাঙবে। কখনো মনে মনে ভাবে কেউ যদি বিয়ের প্রস্তাব দিতো। তার পায়ে সে দাসী হয়ে পড়ে থাকতো।
বাড়ি থেকে কিছু দূরে চাররাস্তার মোড়ের পাশে ছিল এক মুদির দোকান। সে দোকানে মাঝে মধ্যে সাবানা কিংবা ছোট খাট জিনিস আনতে যেতে হতো সুহানাকে। আসা যাওয়ার পথে গ্রামের উঠতি বয়সি ছেলেরা কত যেন আজে বাজে মন্তব্য করতো। ইভটিজ করতো তার কোনো শেষ নেই। বাবা—মা না থাকলে এমনই অবস্থা হয় সবার। একবার মামীকে সে জানিয়েছিল। উল্টো সুহানাকেই অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় হতে হয়েছিল। ‘তুই নিশ্চয় এমনকিছু করিস সে জন্য ছেলেরা তোকে দেখে এমন করে।’ তারপর থেকে সুহানা কোনো কিছু বলাই ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু ঘরে আর কেউ ছিল না বিধায় মামী তাকেই দোকানে যেতে বাধ্য করতো। তবে সুহানা সারাক্ষণ মনে এক ধরনের আতঙ্ক বয়ে নিয়ে বেড়াতো।
একদিন ঘটে একটি ছোট্ট দুর্ঘটনা। সেদিন ছিল রবিবার। সুহানা মোড়ের দোকানে জিনিস কিনতে গেলে এলাকার উঠতি বয়সি এক ছেলে তার নাম কাদের, সে টিজকরে বসে। দরিদ্র হলেও সুহানার আত্মসম্মানে আঘাত হানে। সে আর স্থির থাকতে পারে না। ‘পাগলী’ শব্দের প্রতিউত্তরে দীর্ঘক্ষণ মুখ দিয়ে যা আসে তাই বলে বকাঝকা করতে থাকে। দোকানদারের মধ্যস্থতায় বিষয়টি তৎক্ষণাৎ শেষ হলেও ঘটনার রেশ শেষ হয় না। সুহানা বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনুভব করে তার শরীর কাঁপছে। রাগে নাকি ভয়ে তা ঠাহর করতে পারে না। তবে অনুভব করতে থাকে এ জগৎ সংসারে তার আপন বলে কেউ নাই। বিপদে আপদে কোনো স্নেহ ছায়া তাকে আগলে রাখে না। ঝড় বৃষ্টি রোদ থেকে কেউ তাকে রক্ষা করে না। সেদিনই এসে জোহরের নামাজ পড়তে বসে। নামাজে বসে দীর্ঘক্ষণ কান্নাকাটি করে। তারপর ও প্রার্থনা করে আমাকে এমন একজন স্বামী দাও যে কিনা আমাকে এ জগৎ সংসারে রক্ষা করবে। আমাকে আশ্রয় দিবে, খাবার দিবে। আমার কোনো অপরাধও সে অনায়াসে ক্ষমা করে দিবে। মামার ঘরে বোঝা হয়ে আর কতদিন। পরক্ষণেই মনে হয় এমন ছেলে সে কোথায় পাবে। মামার পক্ষেও তো এমন পাত্র জোগাড় করা সম্ভব না। মামার তো আর্থিক কোনো সামর্থ নেই বিয়েতে কয়েকটা টাকা খরচ করার। এমন ভাবেই নোংরা ছেঁড়া কাপড়ে এলোমেলো ভাবনায় দিন কেটে যেতে থাকে। কাটে মাসের পর মাস।
এক হেমন্তের সোনা ঝরা বিকেলে পড়ন্ত রোদের আলোয় দিনের মতো স্বচ্ছ জীবনের আশায় আবিদের প্রস্তাবকে সে ফিরিয়ে দিতে পারে না। আবিদ সুহানাকে ভালোবাসে এর চেয়ে আর বড় সত্য কী হতে পারে। আবিদ অনেক দিন ধরেই তার কাছে প্রস্তাব পাঠাচ্ছে। কখনো কোনো খারাপ ভাবনা মনে আসেনি সুহানার। বরং নিজেকে সর্বদা ছোট ও দরিদ্র বলে গুটিয়ে নিয়েছে। কিন্তু আজ কেন জানি ভিন্ন এক আবেগ ভর করেছে। সুহানা যেন নিজের ভেতরে নিজের আত্মার ছায়া দেখতে পায়। সৎ মার অবজ্ঞা ও মামার দরিদ্রতার চিহ্নগুলো দেখতে পায়। নিজের অসহায়ত্ব যেন সামাজিক জীবন থেকে দূরে ঠেলে দিতে চায়। কিন্তু তারপরও মনের অতলে কীসের এক আনন্দধ্বনি বাজে। অপলক উদাস আনন্দ যেন আন্দোলিত করে তুলতে থাকে তাকে। অসীম দিগন্ত যা দূর নাগালের বাইতে তা যেন হাতের মুঠোয় এসে ধরা দেয়। আনন্দ তখন আকাশে, উদ্দ্যমতা তখন বাতাসে। শরীরের নোংরা মলিন কাপড়গুলো হয়ে উঠতে থাকে স্বর্গীয় সাদা বসনের মতো পবিত্র। চোখের কোনে কাজল জমতে থাকে। অবশেষে বৃক্ষরাজিগুলো যেন প্রকৃতির নিবিড়তায় একীভূত হয়ে উঠেছে। ফুলেরা ফুলেরা যেন ঝুটি বেঁধে অদ্বৈতসূরে অবিচ্ছেদ্য হয়ে উঠে। কোনো এক রাতে দেখা হবার কথাও স্থির হয় সুহানা ও আবিদের। হ্যাঁ, সুহানা যেনঘরে ঘুমায় সে ঘরেই সবাই ঘুমিয়ে গেলে আসবে আবিদ। সুহানা শুনেছে এখনকার প্রেমে নাকি ছেলেদের প্রশ্রয় দিতে হয়। যদিও সুহানা তা কখনো পছন্দ করে না। কিন্তু আবিদের ভালোবাসাকে সে সম্মান দিতে চায়। ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসা দিয়েই বন্ধন করতে চায়। সমাজের সবাই এ ধরনের মানসিকতাকে খারাপ ভাবলেও সুহানা কোনো কিছু ভেবে স্থির সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। একটা ঘোরের মধ্যে সে দুলতে থাকে।
আকাশের পঞ্চমীর চাঁদ সেদিন ডুবে গেছে। সারাদিনের কল্পনা ও প্রতীক্ষা যেন অন্তরে আগুন হয়ে জ্বলছিল। শরীর মনে একধরনের সুখ সুখ লাগছিল। দোচালা ঘরের মাঝে মামা ও মামী ঘুমাতো। সে ঘরের বারান্দার একদিকে মেঝেতে সুহানা ঘুমাতো এবং অন্যদিকে থাকতো তাদের দুটি ছাগল। সেদিন মেঝেতে শুয়ে এপাশ ও পাশ করে কাটছিল সুহানার। কী এক অব্যক্ত আবেগে বারবার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। সময় যেতে থাকে। রাত্রি দ্বিপ্রহর উপস্থিত। চারদিকে ঘণায়মান অন্ধকার। অবশেষে সব অপেক্ষার পালা কাটিয়ে সে সময় সমাগত। বারান্দার খুপড়ি ঘরে তখন সুহানা চির একা ও অসহায়। অবশেষে অন্ধকারে ভেসে এলো আবিদ। আলোর মতো পরিষ্কার তার মুখ। হ্যাঁ ঐ তো আবিদ। চেহারা একই আছে কিন্তু আবেগ কেন স্থির। সুহানা আরও দেখতে পায় আবিদ একা নয়। সাথে দশ বারো জন। সুহানার বলার কোনো সাধ্য ছিল না। রাতের অন্ধার দুমড়ে মোচড়ে নছনছ করে দিলো মা—বাবাহীন সুহানার শরীর। সুহানা অনেক কষ্টে মাটিতে আকাশে নক্ষত্রগুলো খোঁজ করলো বাঁচতে। কিন্তু নক্ষত্র যে দূর আকাশে। নিমিষ কালো অন্ধকার কেঁদে কেঁদে মরলেও সূর্যের আলো তাকে দেখতে পেল না। এ রাতই শুরু করে দিয়ে গেলো অগণিত রাতের যাত্রা পথ। সুহানা মামা—মামীর কাছে আশ্রয়টুকু হারানোর ভয়ে কাউকে কিছু বলতে পারলো না। তারপর থেকে গ্রামের কত ছেলে যে কতবার তার কাছে রাতের অন্ধকার মাড়িয়েছে তার কোনো শেষ নেই। সুহানা ধীরে ধীরে গোপনে গোপনে হয়ে উঠলো গণবধূ। ঘরের কাছে কাঁঠাল গাছটিও যেন সুহানার দুঃখ বোঝে না। এভাবে নিজের ভেতরেই যে কখন কাঁঠালের গুঁটি বাধে তাও সুহানা জানে না। সেই গুঁটি ধীরে ধীরে কাঠালের মতো বড় হতে থাকে। সুহানা টের পায় তার পেটের ভেতর বেড়ে চলেছে ভূখা ক্ষুধার্ত আরেক জীব। সুহানা দাঁড়ায় সমাজ—বাস্তবতার তীব্র প্রশ্নের বিপক্ষে।
সুহানা বেছে নেয় সেই অনাগত সন্তানের জীবনকে। পেটের ভেতরের নড়ে চড়ে ওঠা জীবের সে আশ্রয় দাতা। সে কীভাবে আশ্রয়হীন করবে আরেকটি জীবকে। সে কীভাবে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিবে আরেকটি প্রাণীকে। সে মা। সমাজ—ধর্ম—রাষ্ট্র তুচ্ছ তার কাছে। অনাগত সন্তানই জীবনের মুক্তি। সে সূর্যের আলোয় হাসবে, সে দিগন্তে দিগচিহ্নে খেলবে। যে দাঁড়াবে তার শক্তি হয়ে; তার ভরসা হয়ে। আশ্রয়ের নতুন ভরসায় অনাগতের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু সমাজ—ধর্ম কী মেনে নেবে তার আশ্রয়ের আকাঙ্ক্ষা? সেদিন সন্ধ্যায় অনাগত আশ্রয়দাতার আগমনের ব্যথায় সুহানা অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। দৌড়াতে থাকে সে বাড়ির পর বাড়ি। কোনো বাড়িতেই আশ্রয় হয়ে ওঠে না। সমাজ ধর্ম নীতির কাছে সন্তানটি হয়তো অবৈধ। পাপের সন্তান। কিন্তু মাতৃত্বের কাছে শুধুই সন্তান। আর মা—বাবাহীন সুহানাদের কাছে এ যেন মুক্তিদাতা।
0 মন্তব্যসমূহ