খুররম মমতাজের উপন্যাস - -এই রাশিয়া, এই রাশিয়া : পাঠপ্রতিক্রিয়া

                                          
রঞ্জনা ব্যানার্জী

সেই রাশিয়া, এই রাশিয়া কভারের পেছনে ব্লার্ব পড়ে এটি একটি নিটোল প্রেমের গল্প এমনটি মনে হলেও পাঠ শেষে বিষণ্ণতা নিয়েও নির্দ্বিধায় বলি, এটি আসলে সময়ের ভ্রমণ।

গল্পের শুরু “সেই রাশিয়া”য়। ইতিহাসের সেই জঘন্য হত্যাকাণ্ডটির ঠিক তিন দিন আগে, ১৯৭৫ সনের আগস্ট মাসের বারো তারিখে, দীপক মাহমুদ ওরফে দীপু নামের উনিশ বছরের তরুণটি আরও ২৭ জন ছাত্রের সঙ্গে মস্কোর শেরেমিয়েতোভো এয়ারপোর্টে নামে। এরা সকলেই সরকারী বৃত্তি নিয়ে এসেছে উচ্চশিক্ষার লক্ষ্যে। অন্য সকলে বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনের সমস্ত কাজসম্পন্ন করে পাসপোর্টে সিল-ছাপ্পড় নিয়ে অনায়াসে বেরিয়ে গেলেও আটকে যায় দীপু। ভাষার অবোধ্যতা এবং অনভিজ্ঞ বয়স- এই দুই নিয়ে ভিনদেশে সদ্য কৈশোর পেরোনো ছাত্রটির জন্য পাঠকের উৎকণ্ঠা প্রথম পাতাতেই উস্কে দেন লেখক। দেশী ছাত্রদের নিতে আসা অপর বাঙালি বড় ভাইটির বদান্যতায় জানা যায় ভিসার নথিতে তারিখের গড়বড়ের কারণেই এই যন্ত্রণা। চিন্তা নেই সুরাহা হলেই ছেড়ে দেবে ওরা। কিন্তু কবে? কখন? দীপুর ভয় লহমায় সংক্রমিত হয় পাঠকের মনেও এবং বইটি তার পূর্ণ মনোযোগ পায়।

সেবার তিন তিনটে দিন নজরবন্দি থাকতে হয়েছিল দীপুকে। আর এই তিনদিনে কত কী ঘটে গেল! সহযাত্রী অন্য ২৭ জনের মস্কো দেখা সারা। পরদিনই দীপুর সঙ্গী হয়ে বাসের জানালা দিয়ে মুগ্ধচোখে আমিও দেখি রেড স্কোয়ার, ক্রেমলিনের দেয়াল, আর তার ওপর “মাথা তোলা রঙিন রসুনের মতো” প্যাঁচানো সেই গম্বুজ। গাইড মেয়ের হাত ছেড়ে মাইক্রোফোন একসময় চলে যায় মস্কোয় বেড়াতে আসা আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে শিক্ষারত শফিক ভাইয়ের হাতে এবং বাসের ওপারের দরদালানের ধারাভাষ চলে বাংলা ভাষায় এবং প্রথমবারের মস্কো দর্শন দ্বিগুণ উপভোগ্য হয়ে ওঠে বাসের ভেতরে থাকা বাংলাভাষী দীপুসহ অন্য সকলের কাছে!

সেই সন্ধ্যাতেই দুঃসংবাদটি এসেছিল। ৩২ নম্বরের তেজী তর্জনী স্থির হয়ে গেছে চিরতরে। বাংলাদেশের ইতিহাসের সেই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডটি ঘটে গেছে রাত পোহানোর আগে। কী হবে এবার? সদ্য বিদেশে আসা ছাত্রের দলকে কি ফিরিয়ে নেবে নতুন সরকার? কেউ একজন তথ্য দেয় আরও ভয়ানক কিছুও ঘটতে পারে, যেমন ঘটেছিল ইন্দোনেশিয়ায়।

নাহ্ ছাত্রদের ফিরতে হয়নি এবং সেই কারণেই দীপুর হাত ধরে সেই রাশিয়ায় ছয় বছরের নানা চড়াই-উৎড়াইয়ের সঙ্গী হলাম- পৃষ্ঠা উল্টে যতোই এগোলাম এবং ক্রমশ ফুলার রোডের দীপু আমার আপন তো হয়ে গেলোই সেই সঙ্গে দীপুর বয়ানে আরও অনেক অপরের জীবনের জানালাও খুলে গেল এই ভ্রমণকালে!

দীপুর চোখে চোখ পেতে আমি দেখেছি রাশিয়ার নগর এবং গ্রামের জীবন। জেনেছি রাষ্ট্রের কূটচালে সব যুদ্ধাহতরা সমান মর্যাদা পায়নি এখানে: জার্মানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা প্রফেসার কিরিল যতটা সম্মানিত ঠিক ততটাই অবহেলিত রাষ্ট্রের হয়ে আফগান-যুদ্ধে যুদ্ধাহত কিংবা নিহত সৈনিকেরা। আবার বাঙালি আলাউদ্দিন কিংবা নিয়াজ খানের অসৎ উপায়ে টাকার জন্যে নিজের এবং দেশের সম্মান বিপন্ন করার স্বার্থপরতা যেমন জেনেছি তেমনই জেনেছি সেই বাংলাদেশের আরেক ছাত্র কান্তি দা’র সংগে মায়ার প্রেম এবং বিয়ে এরপরেও কাটাতারের অলঙ্ঘ্য রাষ্ট্রনীতির বেড়া ডিঙ্গোনোর জন্য কান্তি দা’র দীর্ঘ সংগ্রাম কিংবা উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে পাঁচবছর সেই শিক্ষা কাজে লাগাবার অঙ্গীকারনামার প্রতি দীপুর বিশ্বস্ততা। দমবন্ধ করে অপেক্ষা করেছি ভিউস্কি গ্রামের মিনতি নদীর জলে কুকুরছানা বুবকার ডুবতে ডুবতে উদ্ধার হওয়ার ঘটনা । কে বাঁচাল? আমাদের দিপু! হ্যাঁ পাঠক, এতদূর পড়তে পড়তেই গল্পের দীপু আমার অজান্তেই আমাদের দীপু বনে গেছে !

বুবকার কল্যাণে ভিউস্কি গ্রামে হিরো তো হয়ে গেল সে আর এরই মধ্যে সকলের অলক্ষে আরেকটি গল্পের বীজও বুনে দিলো নিয়তি দীপুর জীবনে আর এই গল্পই দীপুকে ফের টেনে আনে সাতাশ বছর পরের “এই রাশিয়ায়”!

পরের পর্ব ধনতান্ত্রিক রাশিয়ার। এই রাশিয়ায় আসাটা হঠাৎই। এতগুলো বছর মনে যে জেগে ছিল তাকে চাক্ষুষ করবার সুযোগটি যেন ছক বেঁধে ঘটিয়ে দেয় নিয়তি; নতুন চাকরির ছুতোয় । সাইবেরিয়ায় দুই সপ্তাহের কাজ। সাইবেরিয়া সরাসরি নয় মস্কো হয়ে যেতে হয় এবং সেই কারণেই দীপুর মস্কো অবতরণ। চেনা সবই অচেনা এবার। এয়ারপোর্টের ভেতরেই ম্যাকডোনাল্ড থেকে কোকাকোলা সবই পাওয়া যায়। এয়ারপোর্টটিও নতুন। নাম দমোদিয়েদোভো! কী আশ্চর্য এবারও মস্কোতে নেমে সেই একই ঝামেলা! প্যাসেঞ্জার লিস্টে নাম নেই। তবে দীপু এখন দীপক মাহমুদ। জীবন এখন সহজতর। অভিজ্ঞতা এবং ভাষা এই দুই-ই তার অনুকূলে। পরিস্থিতি সামাল হলো সহজে। পাঠক আমিও জানলাম কেবল দীপু নয় পাল্টেছে সবকিছু। ফিরতি পথে ফের মস্কোতে দীপু থামলো এবং আরও স্পষ্ট হলো বদলে যাওয়া সাতাশ বছর আগের সেই শহরটির নতুন রূপ। সব বদল স্বস্তি আনে না, যেমন ইউনিভার্সিটির কাছে সেই মলে প্রশ্বস্ত আইল সরু হয়ে গেছে পণ্যের প্রাচুর্য্যে। আর হোটেলের লবিতেই সূর্যমুখির ক্ষেতের আলো নিয়ে নয় বরং প্রজাপতির পাখার মতো নানা রঙের পোশাক পরা বিষণ্ন মেয়েরা দীপক মাহমুদের বন্ধু হতে চায় টাকার বিনিময়ে। প্লেনে কেমোর প্রভাবে চুল হারানো অল্প বয়েসী সহযাত্রী তরুণটি ভোদকায় বুঁদ হতে হতে জানিয়েছিল এই রাশিয়ায় চিকিৎসা-সেবা কিনতে হয় এবং তা সাধারণের ক্রয়ক্ষমতায় থাকে না সবসময়। দীপকের চোখে ভেসে উঠেছিল হাসপাতালের বেডে নিউমোনিয়া নিয়ে আধাঘোরে সে, সামনে দাঁড়িয়ে আছে লাল টিউলিপের গুচ্ছ হাতে স্বপ্নের আবছা আড়াল নিয়ে সবুজ চোখের সেই মেয়ে!

পাল্টেছে আরও অনেক কিছু। বিশ্ববিদ্যালয়ের দরদালান বিশাল হয়েছে। হয়েছে মোহনীয়। তবে অনুমতি ছাড়া ঢোকা নিষেধ সাধারণের। এক সময় সিমেন্টের যে সিঁড়ি হাজারবার উঠেছে-নেমেছে দীপু, সেই সিঁড়ির মান বেড়েছে লাল কার্পেটে। সেই কারণেই প্রাক্তন ছাত্রটি ইচ্ছে হলেই টপকে যেতে পারবে না স্মৃতির ভ্রমণে ; নানা নিয়মের বেড়া পেরিয়ে তবেই অনুমতি মিলবে। চোখে হাসি তোলা, সেকালের ঠাম্মার মতো বুড়ি গার্ডের “দুই পাক নাচ তবে চিঠি পাবি”র সহাস্য প্রশ্রয় রূপকথা এখন; মুখে হাসি, অবিশ্বাসী চোখ নিয়ে অতন্দ্র প্রহরী সৈনিকের উপস্থিতি জানিয়ে দেয়: এই রাশিয়া সেই রাশিয়া নয় আর।

ভিউস্কি গ্রামেও গিয়েছিল দিপু। এই গ্রামে সমবায় আছে এখনও। বুবকা নেই কিন্তু বুবকার মালিক পাঁচ বছরের নাতাশা এখন সোমত্ত তরুণী এবং এই গ্রামেরই চিকিৎসক। মিনতি নদীও বইছে আগের সুর তুলে। তবে কি সেই রাশিয়ার এক টুকরো রয়ে গেল সব এড়িয়ে পরিবর্তনের ধাক্কা সামলে! নাহ্‌, রেল স্টেশনেই হাতেনাতে পরিচয় হলো পরিবর্তনের সঙ্গে। সাতাশ বছর আগের “সেই রাশিয়ায়” তরুণ দীপুর দলকে কাকা ডেকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল যে বয়সের শিশুর দল, সাতাশ বছর পরে সেই বয়সেরই একটি শিশু প্রৌঢ় দীপক মাহমুদকে দেখিয়ে জানতে চাইল, “নিগ্রোটা এলো কোথা থেকে?”

দীপুর প্রেয়সী ইলিয়ানার তবে কী হলো?

“জলের অপার সিঁড়ি বেয়ে কোথায় যে চলে গেছে মেয়ে!”

কীভাবে? কেন? জানতে হলে পড়তে হবে খুররম মমতাজের অনন্য উপন্যাস,

“সেই রাশিয়া, এই রাশিয়া” ।

মুস্তাফিজ কারিগর দারুণ প্রচ্ছদ করেছেন বইয়ের। বইটি হাতে নিয়ে এবং পাঠশেষে প্রচ্ছদের আবেদন দু’রকম হবে মনোযোগী পাঠকের কাছে।


“সেই রাশিয়া, এই রাশিয়া” র প্রকাশক জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ।

লেখক পরিচিতি: 
রঞ্জনা ব্যানার্জী 
গল্পকার। অনুবাদক।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ