তৃষ্ণা বসাকের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার: বই নিয়ে--লেখা নিয়ে




তৃষ্ণা বসাক (জন্ম- ২৯ অগস্ট) কবি, গল্পকার, কল্পবিজ্ঞান লেখক, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক। কলকাতায় বাস করেন।

তিনি কলকাতায় ২৯ অগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। পৈতৃক সূত্রে তাঁর নাম তৃষ্ণা ভট্টাচার্য। বাবা চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট ও কবি। মা সঙ্গীত শিল্পী। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী তৃষ্ণা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.ই. (প্রিন্টিং এঞ্জিনিয়ারিং) ও এম.টেক (ন্যানোসায়েন্স ও টেকনোলজি) করেছেন। তৃষ্ণা পূর্ণসময়ের সাহিত্যকর্মের টানে ছেড়েছেন লোভনীয় অর্থকরী বহু পেশা। সরকারি মুদ্রণ সংস্থায় প্রশাসনিক পদ, উপদেষ্টা বৃত্তি,বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিদর্শী অধ্যাপনায় নিযুক্ত ছিলেন। দীর্ঘদিন সাহিত্য অকাদেমিতে আঞ্চলিক ভাষায় অভিধান প্রকল্পের দায়িত্ব সামলেছেন। বাংলা থেকে মৈথিলী, সাঁওতালি, ওড়ি⁷য়া, মণিপুরী, নেপালি, বোড়ো ও অসমীয়া ভাষার অভিধান সংকলন ও সম্পাদনা কর্মের পাশাপাশি মিজো, বোড়ো, গারো এবং ওড়িয়া ভাষায় অনুবাদ কর্মশালা আয়োজন করার অভিজ্ঞতাও আছে। ব র্তমানে কলকাতা ট্রান্সলেট্রর্স ফোরামের সচিব। বিচিত্র অভিজ্ঞতা তাঁর লেখনীকে এক বিশেষ স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।বিবাহিত ও এক কন্যার জননী।

তৃষ্ণা বসাক এই সময়ের বাংলা সাহিত্যের একজন একনিষ্ঠ কবি ও কথাকার। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, কল্পবিজ্ঞান, মৈথিলী অনুবাদকর্মে তিনি প্রতিমুহূর্তে পাঠকের সামনে খুলে দিচ্ছেন অনাস্বাদিত জগৎ। শৈশবে নাটক দিয়ে লেখালেখির শুরু, প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘সামগন্ধ রক্তের ভিতরে’, দেশ, ১৯৯২। প্রথম প্রকাশিত গল্প ‘আবার অমল’ রবিবাসরীয় আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৯৯৫।তাঁর অনেক গল্প ও কবিতা ইংরেজি, হিন্দি, মালয়ালম, মৈথিলী ও ওড়িয়ায় অনূদিত হয়েছে।গল্পপাঠের এমদাদ রহমান ২৫টি প্রশ্ন পাঠিয়েছিলেন তৃষ্ণা বসাককে। প্রশ্নগুলো বইপড়া ও লেখালিখি নিয়ে। লেখককে জানার জন্য এ প্রশ্নের উত্তরগুলো খুব দরকারী।



গল্পপাঠ:
কোন লেখক আপনাকে প্রভাবিত করেছেন এবং কীভাবে প্রভাবিত করেছেন?

তৃষ্ণা বসাক:
বেদব্যাস,মীরাবাঈ, কবীর, গালিব, তুকারাম, চন্দ্রাবতী, বংকিমচন্দ্র,রবীন্দ্রনাথ, জ্যোতির্ময়ী দেবী, আশাপূর্ণা দেবী, লীলা মজুমদার, মহাশ্বেতা দেবী অদ্বৈত মল্লবর্মণ আর্থার কোনান ডয়েল, সমারসেট মম। গার্সিয়া মার্কেজ, মিলান কুন্দেরা, বিভূতিভূষণ জীবনানন্দ,মণীন্দ্র গুপ্ত। আর প্রথমেই যাঁর নাম আসবে তিনি হান্স অ্যান্ডারসন। আমি যখন সদ্য অক্ষর চিনলাম, বাক্য পড়তে শিখলাম, তখনি আমাকে আমাদের ছোট শহরের, বাড়ির কাছে যে লাইব্রেরিটি ছিল, তার কার্ড করে দেওয়া হয়েছিল। আর আমি প্রথম যে বইটি তুলি, তা হচ্ছে হান্স অ্যান্ডারসনের রূপকথার বাংলা অনুবাদ। ঠিক মনে নেই, এই বইটি আমি বেছেছিলাম না আমাকে লাইব্রেরিয়ান বেছে দিয়েছিলেন। কিন্তু মনে আছে বইটি পুরো কালো মলাটে বাঁধান ছিল, প্রচ্ছদ ঢেকে। ভেতরে প্রতিটি গল্পের আগে একটা করে সাদা কালো ছবি। অর্থাৎ এখনকার মতো রংচঙে ছবি দিয়ে বাচ্চাদের টানার কোন ব্যাপার ছিল না। গল্পগুলি শুধুমাত্র কন্টেন্টের জোরে আমার মনে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছিল। আমার আজও মনে আছে হারিকেনের আলোয় ঝুঁকে সদ্য শেখা অক্ষরের মধ্যে জীবনের চরম আনন্দ খুঁজে পাচ্ছি। শুধু আনন্দ নয়, আমার ভবিষ্যত লেখক জীবন আচ্ছন্ন করে থাকবেন হান্স অ্যান্ডারসন। ওই যে উড়ুক্কু কার্পেট গল্পে রান্নাঘরে চায়ের কেটলি, কাপার বাসনপ্ত্রের বৈঠকী আড্ডার মেজাজ, এটা আমাকে গল্পের আঙ্গিক নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষার কথা শিখিয়ে যাবে। আর একটা কথা আমি শিখব, যে যাই বলি না কেন, কন্টেন্ট যতই জটিল হোক না কেন, আমকে সরস করে বলতে হবে। অর্থাৎ পড়তে যেন ভালো লাগে। সহজ করে বলা কিন্তু খুব খুব কঠিন।

এরপর তো উপেন্দ্র কিশোরের টুন্টুনির বই, সুকুমার রায়। বাঙালি শিশুর জীবনে এরা না থাকলে কী যে হত। এখন বাচ্চারা এইসব বই পড়ে না, কিন্তু নাটক বা অডিও বুক করে অন্তত তাদের কানে দেওয়া দরকার। আমি প্রথাগত ভাবে বাংলা সাহিত্য তো স্নাতক স্তরে পড়িনি, আমার বিষয় ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং। ফলে ছন্দের কান তৈরি হয়েছে কবিতা শুনে শুনে। সুকুমার রায়, রবীন্দ্রনাথ- এঁরা স্তম্ভ । আর পারিবারিক সূত্রে গান ছিল। ফলে সবরকম গান শোনা, গান শুনলে তাল লয় ছন্দ সহজাতভাবে শেখা হয়। শুনেছি নানান কীর্তন আর পাঁচালি গান, দাশু রায়ের পাঁচালি, যা শুনে ছন্দের কান তৈরি হয়েছে।

আমার মনে হয় শুধু বই নয়, শ্রুতির গুরুত্বও অপরিসীম। আমার জীবনের প্রথম ১৮ টা বছর, আমি যত না বই নিজে পড়েছি, তার থেকে বোধহয় শুনেছি বেশি, । বাবার মুখে মুখে বিশ্ব সাহিত্যের পাঠ অক্ষর পরিচয়ের আগে। মপাসা চেকভ টলস্তয় এইসব নামের সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিখ্যাত সব বই, তাদের জীবনের সঙ্গে এইভাবেই পরিচয়।

ওইভাবে রামায়ণ মহাভারত উপনিষদের সঙ্গে, পরিচয় শুরু। পরে মহাভারত সংক্রান্ত যতগুলো বই পেয়েছি পড়েছি।

মহাভারতে যে জটিল শাখা প্রশাখায় ন্যারেটিভ এগোয়, সেটা আমার কাছে একটা চূড়ান্ত শৈল্পিক বিস্ফার মনে হয়। এটা আমার মনে হয় অনেক লেখককে প্রলুব্ধ করেছে, এখনো করছে, ভবিষ্যতেও করবে। আমার জীবনে এর অনিঃশেষ প্রভাব।

রবীন্দ্রনাথ তো এক বিস্ময়কর খনি। একটা সময় যখন মনে হল তাঁর কবিতা ডেটেড, তখন আবিস্কার করি আলোচক রবীন্দ্রনাথ কি চিঠিপ্ত্রের রবীন্দ্রনাথকে। তাঁর গল্পগুচ্ছ আমার কাছে ধর্মগ্রন্থের মতো মনে হয়। প্রতিটি শব্দ যেন নিক্তি মেপে লেখা। একটাও বাদ দেওয়া যাবে না। এবং ছোটগল্পের রবীন্দ্রনাথ একইসঙ্গে মাসের এবং ক্লাসের। আর রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে এক মহাদেশের মতো, যার এখনো অনেক কিছু অনাবিস্কৃত। একবার মুম্বাই থেকে ফিরে হঠাৎ রবীন্দ্র রচনাবলী ওল্টাতে ওলটাতে তাঁর বোম্বাই ভ্রমণ নিয়ে একটা ছোট লেখা পড়ে একেবারে আশ্চর্য হয়ে গেছিলাম। আমার অভিজ্ঞতার সঙ্গে কি অদ্ভুত মিল। আসলে আমার মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ মানে তাঁর এত লেখা নয়, তাঁর মেধাবী ও আধুনিক মনটা, যা আমরা সম্পূর্ণ বুঝতে পারিনি।

বংকিমচন্দ্র শিখিয়েছেন সাহিত্য মানে সৌন্দর্য, বিভূতিভূষণ অন্তরলোকের চাবিকাঠি দিয়েছেন, মিলান কুন্দেরা আমাকে অস্তিত্বের ভারহীনতা সম্পর্কে অবহিত করেছেন, মনীন্দ্র গুপ্ত দেখিয়েছেন লেখকের বয়স শরীরে নয়, মনে। নব্বই ছুঁইছুঁই বয়সেও কি আধুনিক আর সতেজ ছিল তাঁর কলম।




গল্পপাঠ:
এখন কোন বইগুলো পড়ছেন, খাটের পাশের টেবিলে কোন বইগুলো এনে রেখেছেন পড়বার জন্য?

তৃষ্ণা বসাক:
মহাভারত, মনোবিজ্ঞান, কবিতা সিংহের উপন্যাস, ও ভি বিজয়নের দা লিজেন্ডস অফ খাসাক, গৌরী ধর্মপাল সমগ্র, ই সন্তোষ কুমারের আ ফিস্টফুল অব মাস্টার্ড সিডস।

গল্পপাঠ:
সর্বশেষ কোন শ্রেষ্ঠ বইটি আপনি পড়েছেন?

তৃষ্ণা বসাক
মলয়ালম উপন্যাস সুফির কথা, মণীন্দ্র গুপ্তের গদ্য সমগ্র, অনিতা অগ্নিহোত্রীর মহাকান্তার, মহাশ্বেতা দেবীর গল্প, বিমল করের উপন্যাস সমগ্র, অশনি সঙ্কেত, সূর্য দীঘল বাড়ি


গল্পপাঠ:
আপনার প্রতিদিনকার পাঠের অভিজ্ঞতার কথা বলুন, কখন কোথায়, কী এবং কীভাবে পড়েন?

তৃষ্ণা বসাক:
আমি প্রতিদিন পড়ার মধ্যেই থাকি। তবে উদ্দেশ্যহীন পড়া কমে গেছে। হয় কোন লেখার সহায়ক পড়া, কিংবা কোন রিভিউ লেখার পড়া, বা অনুবাদ । আজকাল পড়ার এই ত্রিবিধ উদ্দেশ্য।

তবে স্রেফ আনন্দের জন্যে পড়া, যেমন অক্ষর পরিচয় হওয়ার পর থেকে পড়তাম, কারো বাড়ি থেকে চেয়ে আনা বই,কিংবা কারো আলমারি খুলিয়ে বার করা বই, অনেক সময় যে বই অর্ধেক পড়ে ফেলে আসতে হত, লাইব্রেরির বই, ছাদে বসে সন্ধে নেমে এসেছে, তারা ফুটে উঠেছে, সেই তারার আলোয় পড়া বই, সেই পড়াটা মাঝে মাঝে ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করি। স্রেফ আনন্দ করে পড়ব।

আমি দুপুরবেলা একা একা খাই সপ্তায় পাঁচদিন, সেই সময় কোন না কোন বই সঙ্গে থাকে। সে সময় সাধারণত পড়ি রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ, বিভূতিভূষণ, লীলা মজুমদার, কেতকী কুশারী ডাইসনের ‘নোটন নোটন পায়রাগুলি’, অনিতা অগ্নিহোত্রীর ‘রোদ বাতাসের পথ’। এইরকম কমফোর্ট রিডিং শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। খেয়ে উঠে, লিখি না। তখন পড়ি। একটু শক্ত বই, বিজ্ঞান দর্শন সংস্কৃতি, ভাষা বিষয়ক নিবন্ধের বই, আঞ্চলিক ইতিহাসের বই, ধর্মের বিবর্তনের ইতিহাস। পড়ি ভারতীয় ভাষা সাহিত্য, যা আমার বিশেষ অনুধ্যানের বিষয়। কোন উপন্যাস, হয়তো ছাড়তে পারছি না, সারাদিন পড়ে চলি। যেমন হেমেন বরগোহাইয়ের সদাগরের নৌকা বয়ে যায় (অসমীয়া উপন্যাস)।



গল্পপাঠ:
কোন বইটি আপনার খুব প্রিয় কিন্তু অনেকেই বইটির কথা জানে না

তৃষ্ণা বসাক:
রামমোহন রচনাবলী, প্রম্থ চৌধুরীর ছোটগল্প, অ্যাল্ভিন টফলারের ফিউচার শক, শৈলেন্দ্র নারায়ণ ঘোষাল শাস্ত্রীর তপোভূমি নর্মদা, শরৎকুমারী চৌধুরানীর রচনা সমগ্র, আগাথা ক্রিস্টির আত্মজীবনী, রামচন্দ্র প্রামাণিকের নাটক ‘তুঘলক’, ‘কালপক্কব’। রামচন্দ্রের আত্মকথা ‘হাথক দর্পণ’
কল্যাণী দত্তর থোড় বড়ি খাড়া, অষ্টরম্ভা।

গল্পপাঠ:
কোন বইটি জীবনে একবার হলেও প্রত্যেকের পড়া উচিৎ?

তৃষ্ণা বসাক:
রামকৃষ্ণ কথামৃত। আমার মনে হয় রামকৃষ্ণ যে ভাষা ব্যবহার করতেন, লৌকিক জীবন থেকে যে উদাহরণ উপমা দিতেন, তা খুব মৌলিক এবং লোকজ উপাদানে ভরা। আরও দুটো ব্যাপার এর মধ্যে আছে। এক তো রসবোধ, দুই নিক্তি মাপা শব্দ। আর আরও বড় কথা গল্প ব্যবহার করে বোধের ভেতরে আলো ফেলা, আমার মনে হয় আঙ্গিক হিসেবে এটা নিয়ে তেমন পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়নি।

এইরকম একটি আশ্চর্য বই আমার কাছে কমল কুমার মজুমদারের ঈশ্বর কোটির রঙ্গ রস। এটি এক আশ্চর্য গ্রন্থ। সাধু সন্ন্যাসীদের আপাত গাম্ভীর্যের আড়ালে ফল্গুনদীর মতো যে রসের ধারাটি প্রবাহিত রয়েছে, তার সন্ধান দেয় এই গ্রন্থ। ঈশ্বর যে রসের আকর, শুখনো সন্ন্যাসে তাঁকে পাওয়া যায় না, আর শিল্প সাহিত্যও তো রস বোধ ছাড়া হয় না। এই গ্রন্থটি অতি প্রিয়।

আমার বাবা বলতেন তাঁর তিনটি প্রিয় বই- গীতা, চণ্ডী এবং শার্লক হোমস। প্রথম দুটি বইয়ের খুব গভীরে আমি ঢুকতে পারিনি, তবে শার্লক হোমস অবশ্য পাঠ্য মনে হয় আমার।

আর চার্লি চ্যাপলিনের আত্মজীবনী। আসলে আত্মজীবনী, কোন অখ্যাত লোকের লেখা হলেও তার বিশেষ গুরুতব আছে বলে আমার মনে হয়।

গল্পপাঠ:
ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, সমালোচক এবং কবিদের মধ্যে এখনও লিখছেন এমন কাকে আপনি সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করেন? কেন করেন?

তৃষ্ণা বসাক:
বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, আবু সৈয়দ আইয়ুব, জীবনানন্দ,বিভূতিভূষণ, ইসমত চুঘতাই, মান্টো, কুরতুলুন হায়দার- এঁরা আর নেই। তবু এঁদের ছাড়া আমার পাঠক জীবন অসম্পূর্ণ। এখনকার মধ্যে অজিত কৌর (পঞ্জাবী লেখিকা), অনামিকা (হিন্দি কবি), রাস্কিন বন্ড, অরুন্ধতী রায়, অমিতাভ ঘোষ, অনিতা অগ্নিহোত্রী, দেবর্ষি সারগী, রামচন্দ প্রামাণিক, সুধীর দত্ত।

গল্পপাঠ:
লেখক হিসেবে তৈরি হতে কোন বইটি আপনার মনকে শৈল্পিক করে তুলেছে এবং কীভাবে?

তৃষ্ণা বসাক:
সমারসেট মমের মুন অ্যান্ড দা সিক্স পেন্স। এটা একদিন সারারাত পড়ে শেষ করি এবং সরকারি চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিই।

মনে হয়েছিল শিল্প সাহিত্য করতে গেলে এইভাবে শূন্যে ঝাঁপ দিতে হয়। হয়তো এর জন্যে আমার জীবনে আর আর্থিক নিশ্চয়তা আসেনি, কিন্তু এই সিদ্ধান্ত নিয়ে আমার কোন অনুতাপ নেই।

অ্যাল্ভিন টফলার -র ফিউচার শক। এই বইটি আমার জীবনকে দেখার ধরন পালটিয়ে দিয়েছে।সভ্যতার সঙ্গে প্রযুক্তির সম্পর্ক তাদের বিবর্তন, ভবিষ্যত পৃথিবীর চেহারা- এসব অন্য ভাবে দেখতে শিখলাম। মেয়েদের কাছে যন্ত্র বরাবরের পরপুরুষ। তাঁদের যন্ত্রের ব্যবহার ধীরে ধীরে বাড়লেও যন্ত্রের উদ্ভাবনে আজো তাঁদের সংখ্যা হাতে গোণা। এর পেছনে কারণগুলি কী কী? কল রাখি না কুল রাখি এমন একটা সঙ্কট ঘনিয়ে উঠেছিল শুধু যে ঔপনিবেশিক বাংলায় তা নয়, সারা বিশ্ব জুড়েই ঐতিহ্যিক ধারণায় বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে এখনো ব্রাত্য নারী। নানা সংঘাত আর সমঝোতার মধ্যে দিয়ে কোথায় এসে দাঁড়াল আজ নারী এবং প্রযুক্তির সম্পর্ক? তার বহুকৌণিক এবং বহুস্তরীয় ইতিহাসের পাঠোদ্ধারের চেষ্টা বাংলাভাষায় প্রথম করেছি নারী ও প্রযুক্তি গ্রন্থে।



গল্পপাঠ:
কোন বিশেষ ভাব কিংবা পরিবেশ কিংবা পরিস্থিতি আপনাকে লিখতে বাধ্য করে?

তৃষ্ণা বসাক:
মনের নির্জনতা।
সাহিত্য অকাদেমর জার্নালের ব্যাক কভারে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের একটা কথা লেখা থাকে- সাহিত্য হচ্ছে নির্জন মনের কাজ। বাড়িতে অন্য ঘরে লোকজন থাকলেও আমার অসুবিধে হয় না। আমি মনের মধ্যে একলা হতে পারলেই লিখতে পারি।


গল্পপাঠ:
আপনি কীভাবে আপনার বইগুলোকে গুছিয়ে রাখেন?

তৃষ্ণা বসাক:
গুছিয়ে রাখি না। মাঝে মাঝে ভাবি রাখব। আর সেই বাসনা থেকে গল্প লেখা হয়। যেমন লেখো আয়ু। এই গল্পটা একটা লোককে নিয়ে লেখা যে বলছে প্রতি রবিবার সে তার বইয়ের তাক গুছিয়ে রাখবে। এক তাকে ভ্রমণ, এক তাকে ইতিহাস। আসলে তার কোন তাক নেই, আদপে তার জীবনে কোন রবিবার নেই। সে একটা জুট্মিলে কাজ করে আর স্বপ্ন দেখে তার বাড়িতে প্রচুর বই থাকবে। মৃত্যুর বিপরীত কথা বই। আয়ু মানে বই।

গল্পপাঠ:
এই বইগুলো পড়ার পর কোন বইগুলো পড়বেন বলে ভেবেছেন?

তৃষ্ণা বসাক:
উপনিষদ। তাছাড়া ইচ্ছে আছে হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশের মহাভারত ৩৫ খণ্ড পড়ে ফেলার। এটা আমার জীবনের চরম উচ্চাকাঙ্খা। অ্যাল্ভিন টফলারের থার্ড ওয়েভ আর মার্কেজের আত্মজীবনী আর জুলি ওস্ক -র ওম্যান অ্যান্ড মেশিন। অনেকদিন ধরেই এটি বইটা পড়তে চাইছি।

গল্পপাঠ:
শব্দকে আপনি কীভাবে অনুভব করেন? আপনি কি কখনও শব্দের গন্ধ পেয়েছেন?

তৃষ্ণা বসাক:
আমি শব্দকে দেখতে পাই।
শব্দের গন্ধ পাই, তার চেহারাও খুব স্পষ্ট দেখতে পাই। ‘জেদি’ -এই শব্দ বললে যে ছবি আসে, ‘হিজলদাগড়া’ বললে কিন্তু সেই ছবি আসে না। আমার ‘চরের মানুষ’ উপন্যাসে টাঙ্গাইলের একটি নদীর কথা আছে, তার নাম লৌহজঙ্গ। শুনলেই কেমন কাঠখোট্টা মনে হয়, আদতে নদীটা কিন্তু তেমন নয়।

গল্পপাঠ:
সাম্প্রতিক কোন ক্ল্যাসিক উপন্যাসটি আপনি পড়েছেন?

তৃষ্ণা বসাক:
রাজনগর, সূর্যদীঘল বাড়ি, অশনিসঙ্কেত


গল্পপাঠ:
আপনি যখন একটি বইয়ের কাজ করছেন, লিখছেন, সম্পাদনা করছেন, কাটাকাটি করছেন, সেই সময়টায় আপনি কোন ধরণের লেখাপত্র পড়েন? আবার ঠিক এরকম পরিস্থিতিতে কী ধরণের লেখা আপনি এড়িয়ে চলেন?

তৃষ্ণা বসাক:
এই সময় সাধারণত আমি ছোট প্ত্রিকার গভীর প্রবন্ধ পড়ি, বা প্রবন্ধের বই। যেমন ট্রান্সলেশন স্টাডিজ, প্রযুক্তির ইতিহাস। বা কবিতা। কবিতা আমার স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে। আর আমি বিভিন্ন ধরনের অভিধানের পাতা উল্টোই। সাহিত্য অকাদেমির অভিধান প্রকল্পের কাজ আমার কাছে অভিধানকে খুব আকর্ষণীয় পাঠ্য করে তুলেছে।

এইরকম সময়ে এবং সবসময়েই আমি প্রোপাগান্ডা মূলক বই এড়িয়ে চলি।


গল্পপাঠ:
সম্প্রতি পঠিত বইগুলো থেকে এমন কোনও বিস্ময়কর ব্যাপার কি জেনেছেন যা আপনার লেখক- জীবনকে ঋদ্ধ করেছে?

তৃষ্ণা বসাক:
সম্প্রতি আমি শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তীর মনোবিজ্ঞানের একটি বই পড়ছি। এখানে যেমন মনোবিজ্ঞানের টেকনিকাল দিকগুলি জানতে পারছি, তেমনি বাংলা সাহিত্যে কীভাবে মনের অসুখের নিরাময়ের অজস্র উপাদান ছড়িয়ে আছে, তা জেনে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি।

গল্পপাঠ:
আপনি কোন ধরণের লেখা পড়তে আগ্রহ বোধ করেন, আর কোন ধরণটি এড়িয়ে চলেন?

তৃষ্ণা বসাক:
স্মৃতিকথা, আঞ্চলিক ইতিহাস, বংশ কুলুজী , বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, দর্শন। আমি ঠোঙ্গাও পড়ি, পড়ি হোর্ডিং -র বিজ্ঞাপনের ভাষা। এড়িয়ে চলি শিকারের কাহিনি, যেকোন প্রোপাগান্ডা মূলক বই।

গল্পপাঠ:
আপনার জীবনে উপহার হিসেবে পাওয়া শ্রেষ্ঠ বই কোনটি?

তৃষ্ণা বসাক:
নোটন নোটন পায়রাগুলি, কেতকী কুশারী ডাইসন
আমাদের চিড়িয়াখানা, ভেরা চাপলিনা।
মহাভারতের কথা, বুদ্ধদেব বসু।
গল্পমালা, নরেন্দ্রনাথ মিত্র।
আরও কত কত বই।

গল্পপাঠ:
ছোটবেলায় কেমন বই পড়তেন? সেই সময়ে পড়া কোন বই এবং কোন লেখক আপনাকে আজও মুগ্ধ করে রেখেছে?

তৃষ্ণা বসাক:
প্রথম লাইব্রেরি থেকে তোলা বই- হ্যান্স আন্ডারসনের রূপকথা। তারপর উপেন্দ্রকিশর, সুকুমার রায়, লীলা মজুমদার, দেব সাহিত্য কুটীরের পূজাবার্ষিকী, দীনেশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দুরন্ত ঈগল, রাদুগা ভোস্তকের রাশিয়ান বই, শার্লক হোমস সমগ্র। এছাড়া বিশ্ব সাহিত্যের অনুবাদ খণ্ডে খণ্ডে। রবীন্দ্রনাথ, বংকিমচন্দ্র খুব অল্প বয়সেই শেষ। মুন্সী প্রেমচন্দ্রের অসামান্য গল্প। কার্ল মার্ক্সের কবিতা। তুলনায় শরৎচন্দ্র টানেননি সেই সময়। পরে তাঁকে আবিস্কার করেছি। তেমন ছোটবেলায় আমি নবকভের ললিতাও পড়েছি। যে কারণে নিষিদ্ধ, তা আমাকে স্পর্শ করেনি, ভেসে গেছি ভাষার সৌন্দর্যে।
লেখকের নাম মনে পড়ছে না, এমন একটি উপন্যাস ড্যাডি লং লেগস, তারপর ফরাসি উপন্যাস ডিজায়ারি।

গল্পপাঠ:
এ পর্যন্ত কতগুলো বই অর্ধেক কিংবা পড়া শুরু করে শেষ না করেই ফেলে রেখেছেন?

তৃষ্ণা বসাক:
বাঙালি মুসলমান সমাজের বিয়ের গীত। ধর্মমতের ক্রমবিবর্তন, সরলা দেবী চৌধুরানীর ওপর একটি গবেষণামূলক বই এমন অনেক বই। তামিল দলিত লেখিকা বামার আত্মজীবনী কারুক্কু।

গল্পপাঠ:
কোন বইগুলোয় আপনি নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন?

তৃষ্ণা বসাক:
কপালকুণ্ডলা, নোটন নোটন পায়রাগুলিতে।
কপাল কুণ্ডলার চরিত্রে কিন্তু পুরুষতন্ত্রের বা সামাজিক শোধন যন্ত্রের ছাপ নেই, তা একেবারেই মুক্ত ও স্বতন্ত্র, এটার সঙ্গে আমার নিজের খুব মিল পাই। আমি বাড়িতে থেকেও অনেকটাই সমাজের বাইরে অরণ্যে বেড়ে ওঠার মতো শৈশব, কৈশোর কাটিয়েছি। অন্যদিকে নোটন নোটন পায়রাগুলিতে একজন অতি উচ্চ শিক্ষিত মেয়ে যেভাবে প্রথাসিদ্ধ কেরিয়ার করতে পারছে না নানা কারণে, সেটা আমারও জীবনের একটা প র্ব।

গল্পপাঠ:
কোন বইগুলো জীবনে বারবার পড়েছেন এবং আরও বহুবার পুনর্পাঠ করবেন?

তৃষ্ণা বসাক:
মহাভারত,লীলা মজুমদার, নোটন নোটন পায়রাগুলি, বিভূতিভূষণ, রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ, প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ের সরস গল্প, অক্ষয় মালবেরি, আগাথা ক্রিস্টির আত্মজীবনী।


গল্পপাঠ:
লেখালেখির নিরন্তর প্রক্রিয়ার সঙ্গে কীভাবে একাত্ম থাকেন?

তৃষ্ণা বসাক:
আমি যাই করি না কেন, আমার মন সবসময় লিখতে থাকে, লেখা কাটাকুটি করে, বিষয় বাছে বা বিষয় বাদ দেয়। রামকৃষ্ণ বলেছিলেন যো সো করে ঈশ্বর কে ধরে রাখবে। , সেই যে একটা সংসারী লোক তেলের বাটি হাতে নিয়ে চলতে চলতে ঈশ্বরের কথা ভেবে যাচ্ছিল, ওইভাবেই আমি লেখায় লগ্ন থাকার চেষ্টা করে যাই। পারি না হয়তো সবসময়, তবু লেগে থাকি। সেই যে স্ত্রীর প্ত্রে মৃণাল বলেছিল লেগে থাকাই বেঁচে থাকা।

গল্পপাঠ:
কে সেই লেখক যাকে আপনি পাঠ করেন গভীর আনন্দের সঙ্গে, যিনি আপনার ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেন?

তৃষ্ণা বসাক:
রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ, মিলান কুন্দেরা, লীলা মজুমদার, সতীনাথ ভাদুড়ী, সমারসেট মম।



গল্পপাঠ:
গল্প লিখতে শুরু করেন কীভাবে? একজন রিপোর্টারের মতোই কি আপনি চারপাশটাকে অবিরাম পর্যবেক্ষণে রাখেন? আপনি কি নোট নেন?

তৃষ্ণা বসাক:
আমি মুখে মুখে কবিতা বানাতাম। তারপর একটি নাটক লিখি, তখন হয়তো আট ন বছর বয়স। বাড়িতে নানা প্রান্তজন আসতেন, তারা আর সবার মতো চা জলখাবার খেতেন, যতদূর মনে পড়ে তাঁদের জন্যে আলাদা চায়ের কাপ ছিল না। মার সঙ্গে তাঁদের সুখ দুঃখের গল্প ছিল। আমি তাঁদের কথা শুনতাম । শুধু যে তাঁদের জীবন কাহিনি, তা নয়, আমাকে আকৃষ্ট করত তাঁদের বাচন ভঙ্গি, শব্দ ব্যবহার, শরীরী অভিব্যক্তি। আমি খুব ছোট থেকেই খেয়াল করেছিলাম তাঁদের শব্দ ব্যবহার কত অব্যর্থ। যাঁরা স্কুল কলেজে যাননি, প্রথাগত ভাবে ডিগ্রি অর্জন করেননি, তাঁদের ভাবনা চিন্তার গভীরতা, মৌলিকতা এবং অদম্য লড়াকু মানসিকতা থেকে আমি জীবনের এবং সাহিত্যের রস সংগ্রহ করেছি। এঁদের আমি জীবন্ত গ্রন্থ ভাবি। এঁদের আমি পাঠ করে চলি নিয়মিত। শুধু দেখা না, শোনাও সমান জরুরি। কারণ এদের কথার ধরন আমি অবিকল ধরে রাখার চেষ্টা করি। এঁরা যেভাবে কথা বলেন, যে গালিগালাজ ব্যবহার করেন, এবং যেভাবে একটা ঘটনাকে দেখেন, সেটা না ধরতে পারলে সব মাটি।

নোট নিই যে খুব তা না। বরঞ্চ ভুলে যেতেই দি। ভুলে যাবার পর যেটুকু পড়ে থাকে সেটাতে আমার কল্পনা ও চিন্তনের প্রযুক্তি কৌশল অর্থাৎ নির্মাণ করেই চূড়ান্ত লেখা।

গল্পপাঠ:
লেখালেখির সবচেয়ে কঠিন দিক হিসেবে কোনটিকে চিহ্নিত করবেন?

তৃষ্ণা বসাক:
নিজেকে জাগিয়ে রাখা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. ভালো লাগল। তবে খুব বেশি স্পষ্ট কোনো দিশা পেলাম না। ব‍্যক্তব‍্যপ্রধান দোষে দুষ্ট।

    উত্তরমুছুন