গ্যাব্রিয়েল
গার্সিয়া মার্কোজ
খাঁচা
বানানো শেষ। বালথাসার স্বভাবসুলভ খাঁচাটি ঘরের ছাঁইচে ঝুলিয়ে রাখল। ইতিমধ্যে
দুপুরের খাবার খেয়ে নিয়েছে। সদ্য তৈরি খাঁচাটিকে নিয়ে লোকজনের এককথা—এমন সুন্দর খাঁচা
পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। এদিকে খাঁচাটিকে এক পলক দেখার জন্য এত লোক জড় হয়েছে যে, বাড়ির সামনে রীতিমতো জটলা জমে
গেছে। নিরুপায় বালথাসার অবশেষে ঝুলন্ত খাঁচাটি নামিয়ে দোকানের সাটার ফেলে দিতে
বাধ্য হলো।
বালথাসারের
স্ত্রী উরসুলা বলল,
'তোমাকে খুব বাজে দেখাচ্ছে। দাড়ি কামিয়ে ফেলো।'
'খাওয়ার পরে দাড়ি কামানো ভালো নয়।' ঝামেলা
এড়াতে চায় বালথাসার।
ঠিক
বটে, দু-সপ্তাহ
দাড়ি কামায়নি। ছোট ছোট শক্ত দাড়িগুলোকে খচ্চরের লোমের মতো মনে হচ্ছে। আর তাতে
মুখের অভিব্যক্তি হয়েছে ভয় পাওয়া বালকের মতো। তাই বলে এ অভিব্যক্তি আসল নয়,
নকল। গত ফেব্রুয়ারিতে তিরিশে পা দিয়েছে বালথাসার। উরসুলার সাথে
একসাথে থাকছে চার বছর হলো। বিয়ে করেনি অবশ্য। ছেলেপেলেও হয়নি। জীবনের চড়াই-উতরাই
তো আর কম পেরোতে হয়নি। তাই সে সদাসতর্ক। ভীতু হয়নি কখনো। সে এইমাত্র যে খাঁচটি
বানিয়েছে, তা অনেকের চোখে পৃথিবীর সর্বোত্তম খাঁচা। অথচ
এ তথ্যটি তাকে আলোড়িত করেনি। ছেলেবেলা থেকে খাঁচা বানিয়ে আসছে বালথাসার। তাই এ
নতুন খাঁচা বানানো তার কাছে এমন কিছু কষ্টকর মনে হয়নি।
'তা হলে একটু গড়িয়ে নাও', উরসুলা বলল, 'তোমার দাড়ির যা হাল, তা নিয়ে বাইরে বেরিয়ো
না যেন।'
খাটিয়ায়
বিশ্রাম নিতে নিতে বালথাসারকে বারকয়েক নামতে হলো। কৌতূহলী প্রতিবেশীরা যখন
খাঁচাটি দেখতে আসে,
তখন কষ্ট করে হলেও দেখাতে হয়। এ পর্যন্ত খাঁচাটির দিকে উরসুলা
ভালো করে তাকায়নি। সে এমনিতে যথেষ্ট বিরক্ত। খাঁচা বানানোর কাজে ব্যস্ত থাকায়
বালথাসার তার কাঠমিস্ত্রির কাজে যথেষ্ট গাফিলতি করেছে। শুধু এ কাজের কারণে
দু-সপ্তাহ ভালো ঘুমাতে পারেনি। বিছানায় শুয়ে এ কাত ও-কাত হয়েছে, এলোমেলো প্রলাপ বকেছে, দাড়ি কামানোর কথা
বেলামলুম ভুলে গেছে। কিন্তু খাঁচায় চোখ বোলানোর পর উরসুলার সব আক্ষেপ আর
বিরক্তি মুহূর্তে উবে গেল। বালথাসার ঘুম থেকে ওঠার আগেই উরসুলা একটি শার্ট ও
প্যান্ট ইস্ত্রি করে বিছানার কাছে চেয়ারের ওপর রেখে দিল। তারপর খাঁচাটিকে ডাইনিং
টেবিলের ওপর রাখল। চমত্কার কাজ করেছে তার স্বামী। উরসুলা নিঃশব্দে প্রশংসার দৃষ্টি
রাখে খাঁচাটির ওপর।
'কত দাম চাইবে, ঠিক করেছ?' জিজ্ঞেস করে উরসুলা।
'জানি না। ভাবছি তিরিশ পেসো চাইব কি না। তিরিশ চাইলে বিশ তো অন্তত
পাব।'
'না, পঞ্চাশ চাও। এ দু-সপ্তাহে তোমার শরীরের
ওপর কম ধকল যায়নি। তা ছাড়া খাঁচাটি বড়। শুধু বড় বললে ভুল হবে, এত বড় খাঁচা আমি জীবনেও দেখিনি।'
বালথাসার
দাড়ি কামানোতে মনোযোগ দিল।
'তুমি কি মনে করো, পঞ্চাশে বিক্রি হবে?'
'কেন হবে না? মি. চেপ মন্তিয়েল যা বড়লোক,
এ দাম তাঁর কাছে তেমন কিছুই না। তা ছাড়া খাঁচাটি এ দামেরই
যোগ্য।' উরসুলা দ্রুত নিজেকে শুধরে নিয়ে যোগ করে,
'আচ্ছা, এক কাজ করলে হয় না—। তুমি বরং ষাট পেসোই
চাও।'
বাড়িটি
ছায়ার নিচে হলেও গরম কম নয়। শ্বাস বন্ধ হবার জোগাড়। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ
যাচ্ছে। ডাঁশপোকাগুলোর শব্দে ভরা রোদ্দুরকে আরাও অসহ্য মনে হচ্ছে। পোশাক পরা
শেষ হলে বালথাসার ভেতরের উঠোনের দিকের দরজাটি খুলে দিল। বদ্ধ ঘরে একটু হাওয়া
লাগুক, ঠান্ডা
হোক ভেতরটা। দরজা খোলার সাথে সাথে একঝাঁক বাচ্চা ছেলেমেয়ে ডাইনিং রুমে ঢুকে গেল।
খাঁচার
খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে দেরি হলো না। বুড়ো ডাক্তার অক্তাভিও জিরালদো তাঁর পেশায়
বিতশ্রদ্ধ হয়ে পড়লেও জীবনে অনুরাগ হারাননি। খবরটি নিয়ে তিনিও ভাবছিলেন, বিশেষ করে তাঁর রুগ্ন স্ত্রীর
সাথে দুপুরের খাবার খাওয়ার সময়। ভেতরের বারান্দার যে অংশে গরমকালে তাঁরা চেয়ার এনে
বসেন, সেখানে অনেক ফুলের টব রেখেছেন। আরও রেখেছেন
ক্যানারি পাখির দুটো খাঁচা। তাঁর স্ত্রী পাখি পছন্দ করেন। পাখির প্রতি মহিলার
ভালোবাসা এত তীব্র যে, তিনি দুচোখে বেড়াল দেখতে পারেন
না। কারণ, বজ্জাত বেড়ালগুলো পাখি খেতে ওস্তাদ। তাঁর স্ত্রীর
কথা ভেবেই জিরালদো বিকেলে রোগী দেখা ছেড়ে খাঁচাটি দেখার জন্য বালথাসারের বাড়ির
দিকে রওনা হলেন।
ডাইনিং
রুমে ততক্ষণে অনেক লোকের ভিড়। দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে খাঁচাটি টেবিলের ওপর রাখা
হয়েছে। তার দিয়ে বানানো সুদৃশ্য গম্বুজের মতো মনে হচ্ছে খাঁচাটিকে। ভেতরে তিন
তলা। ওঠানামার পথ রয়েছে। থাকা-খাওয়ার জন্য আলাদা আলাদা কামরা। শুধু তা-ই নয়, বিনোদনের জন্যে দোল খাওয়ার
ব্যবস্থাসত্ত্বেও রয়েছে আলাদা ঘর।
সবমিলিয়ে মনে হচ্ছিল বিশাল কোনো বরফকলের
ক্ষুদে মডেল যেন। ডাক্তার ছুঁয়ে দেখলেন না। চোখ দিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলেন আর ভাবছিলেন,
খাঁচাটি যতটা সুখ্যাতি পেয়েছে, তার চেয়ে
ঢের বেশি সুখ্যাতির যোগ্য। এমনকি তিনি তাঁর স্ত্রীকে যে খাঁচা উপহার দেবার কথা
মনে মনে ভাবছিলেন, বালথাসারের খাঁচা তার চেয়ে অনেক বেশি
সুন্দর।
তিনি
বললেন, 'এ
খাঁচা কেবল স্বপ্নে কিংবা কল্পনায় সম্ভব।' তিনি অতঃপর লোকজনের
ভিড় থেকে বালথাসারকে খুঁজে বের করলেন। তারপর পিতৃস্নেহসিক্ত চোখে বালথাসারকে
দেখলেন অনেকক্ষণ। শেষে বললেন, 'বালথাসার, তুমি অসাধারণ স্থপতি হতে পারতে।'
লজ্জায়
বালথাসারের মুখ লাল হলো।
'আপনাকে ধন্যবাদ', কৃতার্থ শিল্পী সংক্ষিপ্ত
উত্তর দেয়।
'আমি মিথ্যা বলছি না', ডাক্তারের অকপট প্রশংসা।
ডাক্তারের দেহজুড়ে একদা-সুন্দরী-রমণীর যৌবনদীপ্ত মসৃণতা। নরম হাত। শরীরে খানিকটা
মেদের উপস্থিতি রয়েছে। তাঁর কণ্ঠ শুনে মনে হয়, ল্যাটিন
ভাষায় ভাষণ দিচ্ছেন কোনো এক মার্জিত যাজক। খাঁচাটি হাতে তুলে নিয়ে উপস্থিত সবার
দিকে সেটিকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখালেন। বললেন, 'এর ভেতর পাখি
রাখার দরকার নেই। এটাকে উঁচু গাছের মগডালে ঝুলিয়ে দাও। এ খাঁচা নিজেই পাখির মতো
গান গাইবে।' তারপর খাঁচাটিকে টেবিলের ওপর রেখে খানিকক্ষণ
কী যেন ভাবলেন। বললেন, 'সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, আমিই খাঁচাটি কিনে নেব।'
উরসুলা
সাথে সাথে জবাব দেয়,
'তা বিক্রি হয়ে গেছে।'
'হ্যাঁ, এটা এখন বস্তুত মি. চেপ মন্তিয়েলের
ছেলের। সে বিশেষ করে অর্ডার দিয়েছিল।' বালথাসার জানায়।
ডাক্তার
মুহূর্তের মধ্যে গম্ভীর হয়ে গেলেন,
'সে কি তোমাকে ডিজাইন দেখিয়ে দিয়েছিল?'
'না, তা দেবে কেন। সে একটা বড় খাঁচার কথা বলেছিল।
এটার মতো। ওর আবার একজোড়া শালিখ আছে কিনা, তাই...।'
ডাক্তার
খাঁচার ওপর চোখ বুলিয়ে বললেন, 'এ খাঁচা তো শালিখের নয়।'
'অবশ্যই শালিখের।' বালথাসার প্রতিবাদ করে বলে,
'আমি নিখুঁত মাপজোক করে বানিয়েছি।' তারপর
আঙুল দিয়ে বিভিন্ন খোপ দেখাতে লাগল। আঙুলের গাঁট দিয়ে টোকা মারল, অমনি মধুর ঝনঝন শব্দ চারদিক রাঙিয়ে গেল।
'এমন শক্ত তার আপনি কোথাও পাবেন না। বাঁধন এমন নিপুণভাবে আঁটা—খুব টেকসই হবে।' বালথাসার বোঝাতে থাকে।
একটি
ছোট ছেলে হঠাত্ বলে ওঠে,
'শালিখ কেন, এর চেয়ে আরও বড় পাখি এতে
অনায়াসে থাকতে পারবে।'
'ঠিক বলেছ।' বালথাসার সায় দেয়।
ডাক্তার
আবার পূর্বপ্রসঙ্গে ফিরে আসেন, 'বেশ তো, সে তোমাকে
ডিজাইন দেয়নি। কীভাবে বানাতে হবে, তা-ও বলেনি। শুধু বলেছে
একটি বড় খাঁচা চাই। তাই না?'
'হ্যাঁ, তাই।'
'তাহলে তো কোনো সমস্যা নেই। শালিখের মাপসই যেকোনো একটি খাঁচা আর এই
খাঁচা—দুটো ভিন্ন ব্যাপার। এমন
কোনো প্রমাণ নেই যে,
সে যে খাঁচা বানাতে বলেছিল, এ খাঁচাটি
সেই খাঁচা। অতএব আমাকে দিতে অসুবিধা কোথায়?'
বালথাসার
থতমতো খেয়ে বলে,
'না, না, আপনি
কী বলছেন। এ খাঁচা ওরই অর্ডার দেওয়া খাঁচা। সে জন্যই তো আমি বানিয়েছি।'
ডাক্তার
বিরক্তিসূচক মুখভঙ্গি করলেন।
উরসুলা
একবার ওর স্বামীর দিকে,
আরেকবার ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বলল, 'বালথাসার,
তুমি চাইলে ডাক্তার সাহেবকে আরেকটি বানিয়ে দিতে পারো। আর
ডাক্তার সাহেব, আপনার তো তাড়া নেই। কদিন সবুর করুন।'
'কিছুটা তাড়া আছে বলা যায়। আমার স্ত্রীকে কথা দিয়েছি, আজ সন্ধ্যায় খাঁচাটি ওকে প্রেজেন্ট করব।' ডাক্তার
বললেন।
বালথাসার
ডাক্তারকে বোঝাতে চেষ্টা করে, 'ডাক্তার সাহেব, 'আমি
সত্যিই দুঃখিত। যে জিনিস একবার বিক্রি করে ফেলেছি, তা কি
পুনরায় বিক্রি করা যায়?'
ডাক্তার
অসহিষ্ণু বোধ করেন। রুমাল দিয়ে ঘাড়ের ঘাম মুছে, খাঁচাটির ওপর নীরবে চেয়ে থাকলেন। গভীর সমুদ্রে
ক্রমাগত দূরে ভেসে যওয়া জাহাজের দিকে তীরের দর্শক যেমন চেয়ে থাকে।
'ওরা এ খাঁচার জন্য তোমাকে কত দাম দিল?'
বালথাসার
উরসুলার চোখে উত্তর খোঁজে।
'ষাট পেসো।' উরসুলা জবাব দেয়।
ডাক্তারের
চোখ দুটো খাঁচা থেকে সরে না। তিনি বিড়বিড় করে বলতে থাকেন, 'খুবই চমত্কার। অদ্ভুত সুন্দর
এ খাঁচা।' তাঁর কণ্ঠস্বরে এক অব্যক্ত ব্যথা ধ্বনিত হলো।
তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজার দিকে পা বাড়ালেন। তাঁর হঠাত্ খুব গরম লাগছিল। তিনি
রুমাল দিয়ে জোরে বাতাস করতে লাগলেন। তারপর তাঁর ঠোঁটের এক কোণে এক চিলতে হাসি
ফুটে ওঠে। তিনি তাঁর স্মৃতি থেকে খাঁচাসংক্রান্ত সব দুর্বলতা মুছে রাস্তায় নামতে
নামতে বললেন, 'মন্তিয়েলের অনেক টাকা।'
আসলে
হোসে মন্তিয়েলকে যতখানি ধনী মনে হয়, তিনি ততটা ধনী নন। ধনী হওয়ার জন্য যা যা করণীয়,
সবটাই করেছেন। বালথাসারের বাড়ির কয়েকটি বাড়ির পরে মন্তিয়েল
থাকেন। তাঁর ঘরের পাশ দিয়ে গেলে নানা রকম গন্ধ নাকে আসে। মন্তিয়েল এ পর্যন্ত
খাঁচার সংবাদে নিষ্পৃহ থেকেছেন। তাঁর স্ত্রী সবর্দা মৃত্যুভয়ে কাতর থাকেন বলে
দুপুরের খাবারের পর দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘণ্টা দুয়েক চোখ বন্ধ করে থাকেন। আর তখন
মন্তিয়েল ঘুমান। অনেক কণ্ঠস্বরের সম্মিলিত শব্দে ম্যাডাম মন্তিয়েল বিস্মিত হন।
তিনি বসার ঘরের দরজা খুলে দেখেন, ঘরের সামনে রীতিমতো ভিড়
জমে গেছে। ভিড়ের মধ্যমণি হয়ে সদ্য দাড়িকামানো, সাদা
পোশাক পরিহিত বালথাসার একটি খাঁচা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ধনীর দরজার সামনে দণ্ডায়মান
বালথাসারের মুখে দরিদ্রদের সরল অভিব্যক্তি।
'কী চমত্কার জিনিস!' হোসে মন্তিয়েলের স্ত্রীর
মুখে খুশির ছাপ। তিনি বালথাসারকে ভেতরে ঢোকার পথ ছেড়ে দিলেন। আবারও তাঁর বিস্মিত
উচ্চারণ, 'আমার জীবনে এ রকম খাঁচা আর একটিও দেখিনি।'
ওদিকে দরজার পাশে ভিড় করা লোকজন দেখে তিনি বিরক্ত হলেন,
'চলো, ভেতের যাই। মানুষে জায়গাটা
গিজগিজ করছে।'
মন্তিয়েলের
ঘরে বালথাসার আগন্তুক নয়। অতীতেও এসেছে। বিভিন্ন সময়ে কাঠমিস্ত্রি হিসেবে তার
দক্ষতা ও অমায়িক ব্যবহারের কারণে এ বাড়ির ছোটখাটো কাজে তার ডাক পড়েছিল। তবে বিত্তবানের
ঘরে এসে সে কখনো স্বস্তি বোধ করেনি। সে ভাবত, ওদের বউগুলো কেমন কুশ্রী, কেমন তর্ক করে, কথায় কথায় ডাক্তারি অপারেশন
করিয়ে বসে। বস্তুত তাদের জন্য বালথাসারের মায়া হয়। ওদের ঘরের চৌহদ্দিতে
ঢোকামাত্র তার পা জড়িয়ে আসে। অস্বস্তি আর দ্বিধা জাঁকিয়ে বসে।
'পেপে বাসায় আছে?' সে জানতে চায়।
ডাইনিং
টেবিলের ওপর খাঁচাটি বসিয়ে রাখে।
'সে এখন স্কুলে', হোসে মন্তিয়েলের স্ত্রী
জানালেন, 'অবশ্য ফেরার সময় হয়ে এসেছে। আর মন্তিয়েল স্নান
করছে।'
মূলত
মন্তিয়েল স্নান করছেন না। তাঁর স্নান করার অবসর কোথায়। তিনি লোকজনের সামনে আসার
আগে এক চুমুক গিলে নিচ্ছেন। অত্যন্ত সতর্ক ব্যক্তি তিনি। রাতে নিজের ফ্যানটি বন্ধ
করে দেন যেন ঘরে কোথায় কী হচ্ছে, টের পান।
মন্তিয়েল
চেঁচিয়ে জানতে চাইলেন,
'এডেলেইড, কী হচ্ছে ওখানে?'
'হ্যাঁ গো, বাইরে এসে দেখো, কী চমত্কার জিনিস!' ম্যাডাম মন্তিয়েল জবাব
দেন।
মোটা, চুলওয়ালা উদোম শরীর, হোসে মন্তিয়েল শোবার ঘরের জানালার কাছে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর কাঁধে
তোয়ালে ঝোলানো।
'ওটা কী জিনিস?' মি. মন্তিয়েল জানতে চান।
'পেপের জন্য খাঁচা বানিয়ে এনেছি', বালথাসার
উত্তর দেয়। ম্যাডাম মন্তিয়েল তাঁর স্বামীর দিকে হতবুদ্ধির মতো তাকিয়ে থাকেন।
'কার জন্য বললে?'
'পেপের জন্য', হোসে মন্তিয়েলের দিকে ঘুরে
বালথাসার বলে, 'পেপে এটি বানানোর জন্য অর্ডার দিয়েছিল।'
তাত্ক্ষণিকভাবে
মি. মন্তিয়েল কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না বটে, কিন্তু কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে বলে মনে হলো
বালথাসারের কাছে। হোসে মন্তিয়েল বেডরুমের দরজা খুলে বোরোলেন। তাঁর পরনে
অন্তর্বাস। এসেই হাঁক দিলেন 'পেপে!'
তাঁর
স্ত্রী স্থির দাঁড়িয়ে ফিসফিস গলায় জবাব দিলেন, 'সে এখনো ফিরেনি!'
পেপে
ইতিমধ্যে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। পেপের বয়স বারোর মতো। বাঁকা ভ্রূ। ওর মায়ের
মতো গোবেচারা। করুণ চেহারা।
হোসে
মন্তিয়েল বললেন, 'এদিকে এসো। তুমি কি এটা অর্ডার দিয়েছিলে?'
ছেলেটি
মাথা নিচু করে থাকল। কোনো জবাব নেই মুখে। হোসে মন্তিয়েল পেপের চুলের মুঠি আঁকড়ে
ধরে ওর মুখ তুলে ধরলেন নিজের চোখ বরাবর।
'চুপ করে আছো কেন? জবাব দাও।'
উত্তর
না দিয়ে ছেলেটি ঠোঁট কামড়ে ধরে অপেক্ষা করতে থাকে।
ম্যাডাম
মন্তিয়েল স্বামীকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। চুলের মুঠি ছেড়ে দিয়ে মন্তিয়েল এবার
বালথাসারের মুখোমুখি হলেন। 'আমি দুঃখিত, বালথাসার।
তোমার উচিত ছিল কাজ শুরু করার আগে আমাকে জানানো। তোমার খেয়াল করা উচিত ছিল,
একটি ছোট্ট বাচ্চার সাথে চুক্তির কোনো মূল্য নেই।' কথা বলতে বলতে মন্তিয়েলের ক্রোধ ক্রমেই গলে গিয়ে স্বাভাবিক হয়ে এল।
তিনি খাঁচাটি তুলে নিলেন। একবারও তাকিয়ে দেখলেন না। তারপর বালথাসারের হাতে তুলে
দিয়ে বললেন, 'এটা নিয়ে এক্ষুণি চলে যাও। যার কাছে খুশি
বিক্রি করে দাও। আর অনুরোধ করব, এ ব্যাপারে কোনো তর্ক
করতে চেয়ো না।'
বালথাসারের
পিঠে হাত বুলিয়ে তিনি প্রসঙ্গের ইতি টেনে বললেন, 'বুঝতেই পারছ, আমার রাগ
করা উচিত নয়। ডাক্তারের বারণ আছে।'
ছেলেটি
রোবটের মতো দাঁড়িয়ে আছে। চোখের পলক পর্যন্ত পড়ছে না। খাঁচা হাতে বালথাসার
ছেলেটিকে দেখছে। বালথাসার কী করবে, বুঝে উঠতে পারছে না। ঠিক সেই মুহূর্তে ছেলেটি
কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করে মেঝের ওপর লাফ দিয়ে শুয়ে হাউমাউ কান্না জুড়ে দিল।
হোসে
মন্তিয়েল যথাস্থানে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। ছেলের মা কান্না থামানোর চেষ্টা করছেন।
মন্তিয়েল চেঁচিয়ে উঠলেন,
'ওকে তুলবার চেষ্টা কোরো না। কাঁদুক, যত
খুশি। পারলে মেঝেয় মাথা ফাটিয়ে ফেলুক। তখন লবণ-লেবু ছিটিয়ে দিয়ো। মনের সুখে আরও
বেশি গর্জাতে পারবে।' পেপের চোখে এক ফোঁটা জল নেই,
কিন্তু হাত-পা নেড়ে সমানে কেঁদে চলেছে। ওর মা হাত দুটো চেপে ধরে
থামাতে চাইছেন।
মন্তিয়েল
আবারো গর্জন করে উঠলেন,
'ওকে ছেড়ে দাও।'
কোনো
জলাতঙ্ক-আক্রান্ত রোগী মৃত্যুযন্ত্রণায় কষ্ট পেলে সে যেমনভাবে দেখত, তেমন কষ্ট নিয়ে বালথাসার
ছেলেটিকে পর্যবেক্ষণ করছিল। চারটা বাজে প্রায়। আর ঠিক এ সময় উরসুলা পেঁয়াজ কাটছিল।
আর গুনগুন করে একটি পুরোনো দিনের গান গাইছিল।
'পেপে', বালথাসার সস্নেহে ডাকে।
সে
ছেলেটির কাছে এগিয়ে গেল। হাসিমুখে খাঁচাটি ওর সামনে এগিয়ে ধরল। ছেলেটি তত্ক্ষণাত্
উঠে দাঁড়াল। তার দ্বিগুণ বড় খাঁচাটিকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরল। তারপর খাঁচার রূপালি
তারের ফাঁক দিয়ে একদৃষ্টিতে বালথাসারের দিকে চেয়ে রইল। ওর মুখে কথা নেই। ও জানে না, কীভাবে ধন্যবাদ জানাবে। যদিও
চোখে এক ফোঁটা অশ্রু নেই। সব অশ্রু কি দেখা যায়?
হোসে
মন্তিয়েল বালথাসারকে লক্ষ করে মৃদুস্বরে বললেন, 'বালথাসার, তোমাকে তো
আগেই বলেছি, খাঁচাটি নিয়ে যাও।'
'ফেরত দিয়ে দাও', ছেলেটির মা বললেন।
'না, তুমি রেখে দাও পেপে।' তারপর মন্তিয়েলকে সম্বোধন করে বলল, 'আমি তো
আসলে খাঁচাটি ওর জন্য বানিয়েছি। অতএব ওর কাছেই থাক।'
এই
বলে বালথাসার বাইরে যাবার জন্যে পা বাড়াল। হোসে মন্তিয়েল পিছু পিছু বসার ঘর অব্দি
এলেন। তারপর হঠাত্ করে বালথাসারের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালেন। বললেন, 'বোকামি কোরো না, বালথাসার, তোমার খাঁচাটি নিয়ে যাও।
নির্বোধের মতো কাজ কোরো না। আমি তোমাকে এর জন্য একটি কানাকড়িও দেব না।'
'তাতে কী। আমি এটা পেপের জন্য বিশেষভাবে বানিয়েছি। এটার জন্য আমি কোনো
মূল্য প্রত্যাশা করিনি। চাইও নি।'
দরজার
সামনে সমবেত দর্শকদের পাশ কাটিয়ে বালথাসার যখন রাস্তায় নামছিল, তখন বসার ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে
হোসে মন্তিয়েল চেঁচাচ্ছিলেন। তাঁর চেহারার সবটুকু রঙ কে যেন শুষে নিয়েছে। তাঁর
চোখ দুটো তখন রক্তলাল। তিনি চেঁচিয়ে বলছিলেন, 'হারামজাদা,
এখান থেকে নিয়ে যা তোর যক্ষের ধন। আমার ঘরে আমাকে না জানিয়ে খবরদারি
করা হয়েছে। শয়তানের চেলা...।'
শুঁড়িখানায়
বালথাসারকে বীরোচিত সংবর্ধনা দেয়া হলো। ক্ষণিক আগেও সে ভাবেনি যে, সে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ খাঁচাটি
বানিয়েছে।। কিংবা এটাও ভাবেনি যে, সে খাঁচাটিকে হোসে
মন্তিয়েলের ছেলেকে কান্না থামানোর জন্য দিয়ে দেবে। অথবা ভাবেনি যে, ঘটে যাওয়া সবকিছুই এত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। কিন্তু এ মুহূর্তে মনে
হচ্ছে, এসবের কোনোটাই ফেলনা নয়। লোকজনের কাছে এসবের
মূল্য রয়েছে। অর্থের এ পালাবদলে সে খুবই উত্তেজিত বোধ করে।
সবাই
জানতে চাইল, 'তাহলে খাঁচাটির জন্য তোমাকে পঞ্চাশ পেসো দিল?'
'পঞ্চাশ নয়, ষাট', বালথাসার
জবাব দেয়।
'ধন্য ধন্য, বালথাসার', একজন বলে উঠল, 'তুমিই একমাত্র ব্যক্তি,
যে মি. মন্তিয়েলের কাছ থেকে এতগুলো টাকা খসাতে পেরেছে। আমরা
সেলিব্রেট করতে চাই।'
সবাই
মিলে বালথাসারের জন্য এক বোতল বিয়ার কিনল। বালথাসার সৌজন্য দেখাল সবাইকে এক
রাউন্ড খাইয়ে দিয়ে। এই প্রথমবারের মতো বালথাসার পানশালায় এসেছে বিধায় সন্ধ্যা পার
না হতেই সে মাতাল হয়ে গেল। নেশার ঘোরে বালথাসার হিসেব করতে লাগল, সে হাজারখানেক খাঁচার সংখ্যা
অনায়াসে মিলিয়নে নিয়ে যাবে। ষাট গুণন এক মিলিয়ন। ষাট মিলিয়ন পেসো। বালথাসার
চেঁচিয়ে বলে, 'শালার পয়সাওয়ালাগুলো সব মরে ভূত হবার আগে
ওদের কাছে বিক্রি করা চাই।' বেহেড মাতালের মতো সে নিজেকে
সুস্থ ভাবে, 'দেখো, ব্যাটারা সব
অসুস্থ। সব নির্ঘাত মরবে। সবাই এমন ভোঁতা যে, রাগ করার
মেরুদণ্ড পর্যন্ত ভেঙে গেছে।' সে দু-ঘণ্টা ধরে একনাগাড়ে
জ্যুকবক্সে পয়সা ফেলে গান শুনল। সবাই বালথাসারের সুস্বাস্থ্য, সৌভাগ্য ও পয়সাওয়ালাদের মৃত্যু কামনা করে মদের পেয়ালায় ঠোঁট ঠেকাল।
ডিনারের সময় দেখা গেল, জুয়া ও পানের আড্ডায় বন্ধুরা
বালথাসারকে ফেলে কেটে পড়েছে
মাংসের
ফ্রাইভর্তি ডিশের ওপর চাক চাক পেঁয়াজকাটা ছড়িয়ে উরসুলা রাত আটটা পর্যন্ত স্বামীর
অপেক্ষায় বসে ছিল। এক লোক খবর দিয়ে গেল, তার স্বামী শুঁড়িখানায় খুশিতে আত্মহারা হয়ে মদ
গিলছে আর সবাইকে বিলাচ্ছে। উরসুলা বিশ্বাস করেনি। কারণ সে তার স্বামীকে কখনো
মাতাল হতে দেখেনি। সে যখন শুতে গেল, তখন মধ্যরাত। আর
বালথাসার তখন আলোকশোভিত জুয়া ও পানশালার চেয়ারে বসে আছে। ছোট ছোট টেবিলের
চারপাশে চারটি করে চেয়ার। বাইরের বারান্দার মতো চিলতে-জায়গাটি নাচঘর। সেখানে
আপাতত টিট্টিভ পাখিগুলো মাটি শুকে বেড়াচ্ছে। বালথাসারের সারামুখে কেউ যেন রঙ
মাখিয়ে দিয়েছে। সে এক পা-ও এগোতে পারছিল না। ইচ্ছে হলো, মেয়েলোক দুটোর মাঝখানে শুয়ে পড়তে। বিল এত বড় অংকের এসেছে, শেষতক হাতঘড়িটি জামানত হিসেবে রেখে আসতে হলো। অবশ্য কথা দিল, আগামীকাল এসে শোধ করে দিয়ে যাবে। দু-পা না যেতেই সে হুমড়ি খেয়ে
রাস্তায় পড়ে গেল। টের পেল, কে যেন পা থেকে জুতোজোড়া
খুলে নিচ্ছে। তাই বলে জীবনের সবচেয়ে সুখস্বপ্নটি ভেঙে যাক, তা চাইল না বালথাসার। জাহান্নামে যাক জুতা। কাকডাকা ভোরে সাধ্বী
রমণীরা যখন গির্জায় প্রার্থনা করতে যাচ্ছিল, বালথাসারের
নিথর দেহের দিকে তারা তাকাতে সাহস পেল না। ভাবল, সে মরে
গেছে।
বাংলায়
রূপান্তর : তুষার তালুকদার
0 মন্তব্যসমূহ