এবার যখন ধীরেণ নৌকা ছাড়ে কোথাও অমঙ্গলের কোনও চিহ্ন ছিল না।
নৌকাটাকে ঘসে মেজে পরিস্কার করে দুদিন ধরে। যেখানে যেখানে আলগা হয়ে পড়েছিল, পেরেক মেরে ঠিক করে। লগি বাঁধার দড়িটা পুরোনো হয়ে গেছিল, সেটাকে পালটায়। প্রত্যেকবারের মত এবারেও সনকা গলুইয়ে ফুল ছড়িয়ে পুজো দিয়েছিল। ধূপকাঠি গুঁজে দিয়েছিল। মাধব পুরুত ঘন্টা নেড়েছিল। পাড়ার কেউ নদীতে গেলেই খবর হয়ে যায়। দুটো চারটে লোক হয়েই যায়। তারা বটকেরা করেছিল, ‘কাকা যাও যাও, কাকীরে কেউ নিয়ে যাবে না। আমরা পাহারা দেবো খনে।‘ আকাশ পরিস্কার ছিল। ছোটো ছোটো ঢেউ ছলাৎ ছলাৎ করে কাদামাটির পাড়ে এসে পড়ছিল।
তবু ধীরেণ ফিরে এলো দুদিনের বাসী লাশ হয়ে। ফিরে এলো পৈঠায় মাথা রেখে। আকাশপানে বুক চিতিয়ে। মুখ অল্প হাঁ করা। চোখ খোলা। দু হাত দুদিকে ছড়িয়ে আছে। জলে অল্প অল্প ঠেকে ঠেকে যাচ্ছে।
শানু, কাজল আর পুস্পর বর সনৎ নৌকা ছেড়েছিল ধীরেণের দুদিন পরে। ওরা একসাথে যায় উজান বেয়ে। বিশ পঁচিশ মাইল গিয়ে সুবিধে মত জায়গায় নৌকো বাঁধে নদীর মাঝ বরাবর। তারপর ঘুরে ঘুরে খেপে খপে জাল ফেলে এখানে ওখানে সারাদিন ধরে। এক জায়গায় বেশীক্ষণ জাল ফেলে থাকতে পারে না। নয়তো নদী যাদের বাঁধা নেওয়া তারা দেখতে পেলে তাড়া করে। তাছাড়া সুতোর জালের কাজে এক জায়গায় বেশীক্ষণ জাল ফেলেও রাখতে নেই। নাইলন হলে অবশ্য আলাদা কথা।
ধীরেণের নৌকা ওরা ভাঁটিতে ভেসে আসতে দেখে। দূর থেকে এলোমেলো ভেসে আসছিল। সন্ধ্যের দিকে ওরা তখন নৌকায় রাঁধতে বসেছিল। বাকীরা বিড়ি টানছিল। মোবাইলে বাড়ির লোকের সাথে কথা বলছিল। বাজারের হাল হকিকত জানছিল। নৌকাটা কাছে আসতে ওরা লগি দিয়ে থামায়। কিন্তু ধীরেণকে ওইভাবে সন্ধ্যার ঝুঁঝকি আঁধারে আকাশপানে চোখ রেখে হাঁ করে মরে পড়ে থাকতে দেখে ওরা এতটাই বিহবল হয়ে যায় যে ধীরেণের লাশটাকে নৌকার ভেতরে নিয়ে গিয়ে ভালো করে শোয়ানোর কথে মনেই আসে না। পানুর নৌকার পেছনে বেঁধে গুণ টানার মত করে নিয়ে আসা হয় ধীরেণের নৌকা। ঘাটে ভেড়ানো হয় তখন প্রায় মাঝরাত। পানু আগেই মোবাইলে পাড়ায় খবর করে দিয়েছিল। গোটা হালদারপাড়া ভেঙ্গে পড়ে ঘাটে।
ধীরেণ কোনওদিন দলের সাথে নৌকা নিয়ে যেত না। বলত, নদীর ভেতরে দল বেঁধে গেলে নদী গোঁসা করে। আর মাছ ধরা তো হল গিয়ে লোকের বাড়ির ভেতর ঢুকে বাড়ির লোকজনকে জোর করে ধরে নিয়ে আসা। সেটা পাঁচজনকে নিয়ে গিয়ে হল্লা করে করতে নেই। একা একা যেতে হয়। রাতের পর রাত নদীর বুকে কান পেতে পড়ে থাকতে হয়। মাছেদের চলাফেরা, যে দুটো একটা শুশুক আছে, তাদের চলাফেরা জলের তলে --সব শোনা যায়। সব শুনতে হয়।
দেখতে গেলে ধীরেণের ধাতটাই লক্ষীছাড়া। তা না হলে হালদারপাড়ার কোনও ছেলে ব্যান্ডপার্টিতে ড্রাম বাজাতে গেছে বলে কেউ শুনেছে? বটতলায় যেসব তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকা বুড়োগুলো বসে থাকে, তাদের অনেকেরই মনে আছে লক্ষীপতি আগরয়ালার ছেলের বিয়েতে কেমন তিনদিন ধরে ব্যান্ড বেজেছিল। সে কলকাতার ব্যান্ডপার্টি। যেমন তাদের জাঁকালো পোশাক, তেমনি বাজনা। ধীরেণ নাওয়া খাওয়া ভুলে ওদের সাথে পড়েছিল। আর বিয়ে শেষে যখন ব্যান্ডপার্টি রওনা দিল, ধীরেণও ওদের পিছু নেয়। ব্যান্ডপার্টির ম্যানেজার দুই দিন পরে খেয়াল করে একটা আনখা ছেলে দলে ভিড়ে গেছে। সাথে সাথে ফিরিয়ে দিয়ে যায়। কচি ধীরেণ এই দুদিনের মধ্যেই বেশ তালে তালে টেবিল চেয়ার বাজাতে শিখে যায়।
সাকুল্যে কয়বার যে ধীরেণ বাড়ি থেকে পালিয়েছে, আর কি কি কাজ যে ও জানে, সে খবর কেউ সঠিক রাখে না। শোনা যায় মাঝখানে ডাকাতের দলেও ভীড়েছিল। মাঝখানে যে দুবছর একেবারে নিপাত্তা হয়েছিল, সে সময়টা না কি সে জেলেই কাটায়। বাড়ির লোক হাল ছেড়ে দিয়েছিল। একদিন দুম করে বিয়ে করে নিয়ে এসে হাজির। কুমারী মেয়ে বা অন্যের বৌ ফুসলে নিয়ে আসা নতুন কিছু ব্যাপার না। তবে শোনা যায় সনকা না কি খারাপ পাড়ার মেয়েছেলে। লোকে কিছুদিন গুজগুজ ফুসফুস করে। তারপরে সময়ের সাথে সাথে থেমে যায়। ধীরেণ সকলের সাথেই মেশে, নেশা করে। সনকাও ঘাটে যায় কলপাড়ে বাসন মাজে। কিন্তু পাড়ায় এমন কোনও মরদ কি মেয়েছেলে নেই যে বুক ঠুকে বলবে সে ধীরেণের দোস্ত কি সনকার সই।
বিয়ের পরেও ধীরেণের চালচলন কিছুই বদলায়নি। সে আগের মতই মাঝে মাঝে উধাও হয়ে যায়। বাপ মা আগেই ফৌত হয়ে যাওয়ায় সে পিছুটান আর নেই। সাতদিন দশদিন একমাস পরে ফিরে আসে। তখন ওর ঘর থেকে পেয়াজ রসুনের গন্ধ ভেসে আসে। পাড়ার মেয়েরা নিজেদের জটলাতে সনকার কাল্পনিক চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করে। ‘অমন মেয়েছেলে আবার সোয়ামীর কি বোঝে । দেখ অন্য কোথাও লটঘট বাধিয়ে আছে। নয়তো পুরুষ বার বার অমন বাড়ির বার হয়ে যায়!’ পুরুষেরা আড়ে আড়ে তাকায়। বেড়ার ফুটোয় চোখ রাখে। এমনি করেই সময় বয়ে গেছে। সনকারও বয়স দুকুড়ি দশ পার হতে চলল।
তিনটে নৌকা যখন ধীরেণের বডি নিয়ে ভিড়ল তখন নদীর পাড়ে সনকার আছড়ে পড়ে কান্না অনেকের কাছেই বাজে নাটক মনে হলেও তা দেখতে ভীড় কিছু কম হয়নি। লোকে অতীতের কেচ্ছা, সত্যি হোক মিথ্যা হোক মন থেকে মুছে ফেলতে চায় না। হ্যাজাক এমারজেন্সি লাইট টর্চ লন্ঠন টেমি- যে যা পেরেছে নিয়ে জড়ো হয়ে গেছে। আকাশের ক্ষয়াটে চাঁদ। অপার্থিব আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে চারিদিকে। নদীর ও পাড় থেকে দেখলে মনে হবে দশদিক জোড়া বিশাল অন্ধকারের মধ্যে একগোছা নানা রঙের জোনাকী নড়াচড়া করছে। আরো কাছ থেকে দেখলে তাদের আচরণ আরও অদ্ভুত। নানা আকারের ছায়ামুর্তি গাছের মত সারসার দাঁড়িয়ে আছে, উবু হয়ে বসে আছে। এই বিশাল অন্ধকার, নদীর ছলাৎ ছলাৎ, নৌকার পৈঠায় পেট উলটে পড়ে থাকা মড়া--সব মিলে যেন তাদের গলা টিপে ধরেছে। কেউ জোরে কথা বলছে না। এমনকি জোর দিয়ে কাঁদছেও না কেউ।
মূল ভীড়টার থেকে কিছু দূরে ছিল ছেলে ছোকরাদের ভীড়। ধীরেণজেঠা নদীতে বেরিয়ে মারা গেছে। তাকে সাপে কাটেনি, কামটে নেয়নি, নৌকাও ডোবেনি। তবু মরে গেছে। এতে তারা ভারী অবাক হয়ে গেছে। যারা ওদের মধ্যেই একটু বড়, বাবা কাকাদের কাছে শুনে বলছে, একে হাট এটাক বুলে। দম চাপি মরি যায় মানষে। অদের কেউ আসতে বারণ করেনি। আবার নিয়েও আসেনি। নানা বয়সী ছেলেমেয়ের দলটা তবু একটু দূরে একটা টিলা মতন উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল। কে জানে এরকম সময়ে কাছ থেকে দেখতে গিয়ে যদি চড়টা থাপ্পড়টা খেতে হয়। কাছে যাওয়ার সাহসও ছিল না কারোর।
এই দলের মধ্যে বুলানও ছিল। মাথায় বেঁটে বলে কখন যেন ঠেলেঠুলে ফাঁকফোকর দিয়ে সকলের সামনে চলে আসে । আর একেবারে সামনে থেকে দেখতে পায় পুরো ব্যাপারটা। আর সকলের মত ও সন্ধ্যে থেকে শুনেই আসছিল ধীরেণজেঠা মরে গেছে। বডি আনা হবে। আনা হবে না আনা হবে, ও অত ভেবে টেবে দেখেনি। এখন দেখতে পায়। ধীরেণজেঠার লাশ নিয়ে নৌকোদুটো পাড়ে ভেড়ার সাথে সাথে ভীড়টা হামলে পড়ল। সবাই দেখতে চায় এই আশ্চর্য মৃত্যু। পৈঠাতে মাথা রাখা। মুখ হাঁ। আকাশপানে খোলা চোখ। দু হাত দুদিকে ছড়িয়ে আছে। নৌকা ঢেউয়ে অল্প অল্প দুলছে আর হাত দুখানা জলে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে।
জেঠাইমা এসে আছড়ে পড়ে। হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। মুখে মাথায় চুলে কাদা লেগে যায়।পাড়ার মেয়েরা ধরাধরি করে সামলায়। কেউ কেউ অভ্যাস বশে, কাঁদতে হবে তাই রোল তুলে কেঁদে ফেলেই চারদিকে তাকিয়ে চুপ করে যায়। আধো অন্ধকারে ধরাধরি করে দুলতে থাকা নৌকা থেকে বডি নামায় তিন চার জন। হ্যাজাকের আলোয় লন্ঠনের আলোয় বোঝা যায় না ওরা কারা। বলহরি হরিবোল করে তুলে নিয়ে চলে যায় হালদারপাড়ার দিকে। এতসব বুলানের চোখের ওপর একে একে ঘটে। সব মিটে গেলে, ঘাট আস্তে আস্তে খালি। বুলান টিলার ওপর ঠায় বসে থাকে। দেখে রতন আর গৌতম খানিক পরে ফিরে এল। ধীরেণ জেঠার নৌকাটা তখনো বাঁধা আছে ঘাটে। এদিক ওদিক তাকিয়ে ওরা ধীরেণ জেঠার নৌকা থেকে তার মরে যাওয়ার আগে ধরা মাছগুলো নিজেদের নৌকায় নিয়ে গিয়ে রাখলো। জেঠার নৌকা থেকে আরো কিছু বের করে ওরা নিজেদের নৌকায় রাখে। ওদের চলাফেরা ভূতের মত লাগে।
বুলান যে সারারাত ফেরেনি, ডামাডোলের মধ্যে কেউ তা খেয়াল রাখে না। সকালে যখন ফেরে, সবাই ভাবল শ্মশান থেকেই ফিরল বোধহয়। বুলান কারোর সাথে কোনও কথা বলে না। লোহা ছোঁয়, নিমপাতা দাঁতে কাটে। আগুন ঠেকিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে।
হালদারপাড়ার দিনরাত একই ভাবে বহতা থাকে। না থেকে উপায়ও নেই। পেট কারোর জন্য থেমে থাকে না। মরদদের খালে বিলে নদীতে জাল হাতে বেরোতেই হয়। সনকা যে দুবাড়ি কাজ করে, সেখানে খবর পাঠায়। ছোটো ছেলেমেয়েগুলো যে কোথায় যায়, কি করে সে খবর কেউই রাখে না। ওরা রাস্তায় রাস্তায় মার্বেল খেলে, কুড়িয়ে পাওয়া সিগারেটের প্যাকেট দিয়ে মিথ্যে মিথ্যে তাস খেলে। তারপর একটু লায়েক হলে খালপাড়ের জুয়ার ঠেকে গিয়ে জোটে। বিড়ি টানতে শেখে। রাতে হালকা টলতে টলতে ঘরে ফেরে। মা বাবাকে খিস্তি করে। মেয়েরা মেয়ে হওয়ার কিছু আগেই ঘরে ঢুকে পড়ে। বিকেলে ম্যাক্সির ওপর ওড়না ফেলে হাওয়া খেতে বেরোয়। মা-দের সাথে বাড়ি বাড়ি কাজে যায়। কোনও কোনও ঘরে বিড়ি বাঁধার কাজ হয়। ছেলেমেয়েরা খুব ছোটো থেকেই কেন্দু পাতায় তামাক ঠাসতে শিখে যায়। অধিকাংশই পাড়া বেপাড়ার ছেলে ধরে ঝুলে পড়ে। যাদের সে মুরোদ হয় না তাদের বাবা মা কে এর ওর কাছে ধারধোর করে পার করতে হয়।
ধীরেণের বাড়িতে শ্রাদ্ধ শান্তির যোগাড় চলতে থাকে। মাধব পুরুত বিধান দেয়, অপঘাতে মৃত্যু যখন নয়, তখন এগারো দিনেই কাজ হবে। ধীরেণের দূর সম্পর্কের দাদা পলানের ছেলে প্রবীর মুখাগ্নি করেছে। কাছাও ধারণ করেছে। শ্রাদ্ধশান্তির কাজও ওই করবে। এতবড় একটা দায়িত্বের কাজ পেয়ে পাড়ার ছেলেছোকড়াদের কাছে ওর রেলা বেড়ে গেছে। পাড়ায় সকলেই কোনও না কোনও ভাবে সকলের আত্মীয়। এসব ব্যাপারে লোকের অভাব হয় না।
এর মধ্যেই বুলানের বাপ তারানাথের কাছে খবর আসে ছেলে মাঝে মাঝে নিপাত্তা হয়ে যাচ্ছে। প্রথমে ছেলের মা কিছুদিন ঘ্যানঘ্যান করছিল যে ছেলে সময়ে ঘরে ফিরছে না। ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করছে না। রাতের দিকে জেগে বসে থাকে। কারোর সাথে ঠিকমত কথা বলে না। খেলতে যায় না। চড়কের জন্য গোটা পাড়ার ছেলেরা ঝেঁটিয়ে চাঁদা তুলতে বেরোচ্ছে। ছেলে কিছুতেই ওদের সাথে বেরোতে চাইল না এবার। অথচ গতবার কতো উৎসাহের সাথে গেছিল। কিছু একটা তো হয়েছে ছেলের। তা ঘরের মাগের ঘ্যানঘ্যানানিতে কান দেবে, তারানাথ সে বান্দাই নয়। কিন্তু কয়দিন পরেই পাড়ার আরও লোকজনও একই কথা বলে। নলেন কুন্ডু একদিন রাস্তায় ধরে বলল, হ্যা রে তারা, তর ছেলেটাকে খালপাড়ের দিকে যেতে দেখলাম কেন রে?
তারানাথ প্রথমে ভেবেছিল ছেলে জুয়ার আড্ডায় যাওয়া ধরেছে বোধহয়। এতে খুব যে অবাক হয় বা দুঃখ পায় তা মোটেই না। এ পাড়ার সব ছেলেই একবার না একবার ওই আড্ডায় ঢুকেছে। যে বেরোতে পেরেছে, পেরেছে। পুলিশ পার্টি সবার সাথে সেটিং আছে। কে কি বলবে। আর ছেলেছোকরারা এই বয়সে একটুখানি নেশা করবে না, জূয়া খেলবে না, তা কি করে হয়!
তবু বাপের কর্তব্য বলে তো কিছু আছে। তারানাথ বুলানকে খুঁজতে বেরোয়। হিসেব মত প্রথমে খালপাড়ে যায়। গিয়ে দেখে সব ভোঁ ভাঁ। কেউ কোথাও নেই। বোধহয় কিছু খবর আছে। সময়মত কেটে গেছে। খালি হাওলা খালেদ বসে বসে গাঁজা বানাচ্ছে। জুয়া খেলতে খেলতে পয়সা না থাকলে লোক বুঝে খালেদ টাকা হাওলাত দেয়। তাই ওর নাম হাওলা খালেদ। খালেদের তেজিয়াল বিবি তাসমিরা ভাতারের জুয়ায় জেতা পয়সায় ভাত খাবে না বলে পোয়াতি অবস্থায় ঘর ছেড়ে যায়। সেই থেকে গোটা এলাকায় এটা চালু রসিকতা, খালেদের কাছে একবার হাওলাত করলে ঘরের বিবি আর কখনোই ইমানদারির ভাত খেতে পারবে না।
দু এক ছিলিম বোধহয় খালেদ আগেই চড়িয়ে ছিল। তারানাথকে দেখে খেঁচিয়ে ওঠে। “ কি চাই বে? শালা এখানে মন্তর ঝাড়তে এসেছো? পেছনে ভরে দেবো শালা তোমার ...।“ বোধহয় পুলিশ টুলিশ সামলাতে এখানে রয়ে গেছে। নয়ত এরকম করার কথা নয়। কতবার একসাথে বসে নেশা করেছে তারা। তারানাথ হাওয়া খারাপ বুঝে সরে পড়ে।
খুঁজতে খুঁজতে আদাড় বাদাড় ঘুরে শেষে বুলানকে পায় নদীর ধারে। একটা টিলার ওপর হাঁটুতে থুতনি রেখে বসে আছে। নদীর দিকে মুখ করা। দেখেই হাঁক পাড়ে।
বুলান সম্বিত হারিয়ে বসেছিল। দূর থেকে বাপের হাঁক শুনে এদিকে তাকায়। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বিনা বাক্যব্যায়ে উলটোদিকে দৌড় লাগায়। তারানাথ লুঙ্গি গুটিয়ে তাড়া করে। কিন্তু পারবে কেন। একে তো দূরত্ব অনেকটা। তার ওপর বয়সও তো হচ্ছে। এদিকে বাংলা আর বাবার প্রসাদ করে শরীরে তো আর কিছুই নেই। আচ্ছা, যেতে দাও। কতদূরে আর পালাবে! বাড়িতে তো একবার না একবার ফিরে আসতেই হবে। তারানাথ মাজায় হাত রেখে হাঁপাতে থাকে। তখনই খেয়াল পড়ে, বুলান যেখানে বসেছিল, সেখানেই কিছুদিন আগে ধীরেণদার অমন বেকায়দা ভাবে মরে থাকা দেহটাকে এনে ভেড়ানো হয়েছিল।
তারানাথের মনে কেমন একটা কু হাওয়া বইতে থাকে। ছেলে এসে এখানেই বসেছিল কেন? দূর থেকে মনে হল জগৎ সংসারের কিছুই খেয়াল নাই। তাকে দেখে মারের ভয়ে পালালো বটে, কিন্তু ছেলে তো কোনোদিন এরকম চুপচাপ একা একা বসে থাকার ছেলে না।
তারানাথ চিন্তায় পড়ে। পরশুদিনই সুবল গুনীন তাদের হ্যান্টাকালীর থানের চক্রে বলছিল, কয়দিন একটুকুন সামলে সুমলে থাকিও হে। উ শালা কুমড়ো বলি দেওয়া মাধব পুরুত আমার এইটা জানে। এটা লিশ্চয় অপঘাত। শালা, ঘরে লয়, বৌ পরিবার কেউ সাথে নাই, মাঝ দরিয়ায় জলের মাঝে পরাণডা বার হয়া গেল, আর উ কহিছে অপঘাত লয়!
সবাই সমস্বরে বলে ওঠে, অপঘাত। নিশ্চই অপঘাত।
সুবল ছিলিম বাঁশরীর হাত থেকে নিয়ে একটা দমভর টান দেয়। বলে, শুনো, ধীরেণ তো লোক সুবিধের ছিলোক নাই। আদ্যশ্রাদ্ধ যতদিন না হয়, ঘরের যোবতী মাগ আর বাচ্ছা ছেলিয়া মেইয়াগুলানকে চোখে চোখে রাখবা। সোমসারের টান মানুষে সহজে ছাড়ান দিতে পারে না। আশেপাশে ঘুর ঘুর করতে থাকে। যোবতী মেয়েছেলে আর বাচ্ছাগুলান হয় নরম জান। তখন তাদের ওপর এসে ভর করে।
তারানাথ ভাবে, তবে কি তার ছেলের ওপরই ভর করল ধীরেণদা মরার পরে। সে মনে করতে চেষ্টা করে ধীরেণদার সাথে তার কোনোদিন কোনও খিঁচ ছিল কি না। কিন্তু সেরকম কিছু মনে পড়ে না। সত্যি বলতে কি। ধীরেণদার সাথে কার যে ঝামেলা ছিল আর কার যে মিল ছিল সেটা কেউই স্পষ্ট করে বলতে পারবে না। বাচ্চাদের ওপরেও ধীরেণদার সেরকম কোনও টান ছিল বলে তো মনে হয় না যে সেই টানে তার ছেলেকে ধরবে। এই যে সনকা বৌদি, ছেলেপিলে হয়নি, তাকেও তো কোনওরকম নেই আঁকড়া ভাব হতে দেখেনি কেউ। আর বুলানকে ঠিক বাচ্চাও তো বলা যায় না।
এরকম সাতপাঁচ ভাবনার মধ্যে তার একরকম গর্বও হতে থাকে। আর সব ছেলেদের মধ্যে তার ছেলেকেই ভর করেছে ধীরেণ হালদারের আত্মা। সুবল তো তাকে বারবার বলে, ওরে তোর মধ্যে জিনিস আছে। তুই মায়ের কাজ করতে এসেছিস। আর কটা দিন যাক, দেখবি সব লক্ষণ ফুটে ফুটে বেরোচ্ছে।
তার হয়নি, তার ছেলের তো হল। ভালো আধার না হলে কি হয় এসব! সুবলের সাথে থাকতে থাকতে সে আধার চক্র জাগরণ এসব শিখেছে খুব। সে ভাবে আর দু-একদিন দেখবে। বলা যায় না, শ্রাদ্ধশান্তি চুকে গেলে সব ঠিক হয়েও যেতে পারে। তবে সুবলকে সব বলতে হবে।
তারানাথের হিসেব মত সব ঠিক হয়ে যায় না। শাদ্ধশান্তি মিটে গেলেও নানা লোকে মাঝে মাঝেই বুলানকে নদীর ধারে খুঁজে পায়। ইস্কুল টিস্কুল বন্ধ। খেলাধুলা নেই। দিনে দিনে আরো কথাবার্তা কম হয়ে যাচ্ছে ছেলের। দশটা প্রশ্ন করলে হয়তো একটার জবাব দেয়। এদিকে তারানাথ কিছু চুপচাপ থাকার লোক নয়। গোটা পাড়া জেনে যায়, বুলানের ওপর ধীরেণ হালদারের ভর হয়েছে। আর সে এতটাই শক্ত রকমের ভর যে শ্রাদ্ধকাজ পিন্ডদান সব হয়ে গেলেও ছেড়ে যাচ্ছে না। সবাই বলতে লাগল, ধীরেণদার নিশ্চই কিছু অপূর্ণ ইচ্ছে আছে। সেটা না পেলে মুক্তি হচ্ছে না। এভাবে বেশীদিন ফেলে রাখা ঠিক না। কখন কার ক্ষতি হয়ে যায়।
পাড়ার লোক বুলানকে চোখে চোখে রাখে। তারানাথ নিজে একদিন দেখে, ভর সন্ধ্যেবেলা ছেলে নদীর ধারে একটা নৌকার পৈঠার ওপর বসে হালটানার ভঙ্গী করছে। হালদারপাড়ায় থাকলেও তারানাথের কোনোকালে মাছমারার ব্যবসা নয়। ছেলেরও কোনও দিন জল জাল কাঁটার দিকে আগ্রহ নেই। তাকে ওরকম সন্ধ্যার আবছায়ায় ভূতের মত আচরণ করতে দেখে তারানাথ সত্যি সত্যি ভয় খেয়ে যায়। হাত ধরে হিড় হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে আসে। উঠোনের ধারে কাঠ ঘুঁটে রাখার ঘরটায় ঢুকিয়ে বাইরে থেকে শেকল তুলে দেয়। বাড়ির মেয়েদের বলে, খবরদার কেউ উঘর খুলবা না। আমি সুবল গুনীর কাছে যেছি। বলেই বেরিয়ে যায়। মেয়েদের মধ্যে কান্নার রোল পড়ে যায়।
সুবল গুনী বলে, আজ লয়, পরশু। পরশু অমাবস্যা। পরশু ঠিক দুপুর দুপুর হামি তুর বাড়ি যাবো। আর তুর ছেলাকে আরাম করে দিবো। বলে, তারানাথের হাতে সামগ্রীর একটা লম্বা ফর্দ ধরিয়ে দেয়। আরও বলে, ছেলেকে এই দুদিন ঘরের বার হতে দিবি না। মাছ মাংস খাবি না বাড়িতে। আর মানে, বৌমার সাথে একত্রে রাত্রিবাস... মানে বুঝলি কি না? আর তুর থেকে দক্ষিণে আর কি লিব। যা যা, কুনো চিন্তা নাই তুর, আরে ওরকম কতো ধীরেণ এই বগলের তলা দিতে পার হয়্যা গেল। আরে সি বার, সেই গো আইলের ওপরের কুশ ছুতারের ওপর ভর হল। সি একটা জবরদস্ত অপদেবতা পেয়াছিলাম বটে।
সবাই ঘন হয়ে আসে। ছিলিমে আরো ঘন ঘন ধোঁয়া উঠতে থাকে।
আশেপাশের পাড়ায় খবর হয়ে যায়। খালপাড়ের জুয়ায়ার ঠেকের থেকেও ভীড় হতে থাকে তারানাথের বাড়ি আর সুবল গুণীর আখড়ায়। সবাই বুলানকে দেখতে চায়। সনকাও আসে। তারানাথকে বলে, অ ভাই, একবার ছেলাটার সাথে দেখা করাও না। সবাই বুলছে তুমার দাদার ভর হয়াছে উর উপরে। দেখ না, যদি কিছু বলে তুমার দাদা। কেমন আছে টাছে...।
তারানাথ সকলকে হাতজোড় করে। বলে, হামার বেটাটাকে আপনেরা অমন ব্যাস্ত কইরেন না। উর উপর এমনিতেই মেলা ধকল যেছে। উরে ছাড়ি দেন।
বুলানের প্রাণের বন্ধু পূষণ আর সতে এর মধ্যেই একদিন লুকিয়ে লুকিয়ে বুলানের সাথে কথা বলতে পারে। চাঁচের বেড়ার ঘরে ফুটো থাকেই। পাটকাঠি ঢুকিয়ে পিঠে খোঁচা মারে ওর। বুলান ফুটোয় মুখ রাখে। বাইরে তখন বেজায় ভীড়।
বুলান বলে, কি হছে বুলতো? হামাকে লিয়ে কি কইরবে?
পূষণ বুলানের বয়সী। সতে আরো ছোট। ওরা ওদের মত বুঝেছে।
পূষণ বলে, তুর উপর ধীরেণ জেঠার ভর হয়াছে। সুবল গুণী কাল এসে তুকে ঝাইড়বে।
-- ঝাইড়বে মানে কি? মাইরবে না কি?
-- মাইরবে তো বটেই। তার আগে তুকে বাইন্ধবে। তারপরে সরষে পুড়ায়ে শুঙ্গাবে। তারপরে ঝাঁটা দিয়ে পিটবে।
সতে বলে, আরে না না, সরষে না, শুকনো মরিচ পুড়ায়ে শুঙ্গাবে।
সরষে না শুকনো লঙ্কা, কোনটা পুড়িয়ে শোঁকাবে, তাই নিয়ে ওদের মধ্যে ঝামেলা লেগে যায়। ঘরের পেছনে কি সব টিন ফিন ডাঁই করে রাখা ছিলো। হাতের ধাক্কায় পড়ে যায়। খুব জোরে শব্দ হয়। বাইরে থেকে কে যেন চেঁচিয়ে ওঠে, কে বে ঘরের পেছনে? ওরা পালিয়ে যায়। বুলান কেঁদে ফেলে। খুব কষে দড়জায় ধাক্কা দেয়। বাইরে হট্টগোল থেমে যায়। সবাই কাঁটা হয়ে দড়জার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু কেউ দড়জা খোলে না।
পরদিন দুপুর দুপুর যখন বুলানকে বের করে আনা হল, বাইরে চড়কের মেলার ভীড় জমে গেছে। চাই কি একটা বাদামওয়ালাও এসে হাজির। গোল করে ঘিরে ধরা ভীড়ের মাঝখানে সুবল তার কাজকর্ম আরম্ভ করে দিয়েছে। সামনে ধুণী থেকে গলগল করে ধোঁয়া ঊঠছে। সিঁদুর মাখানো মরার মাথা, হলদেটে হাড়, চামর, মুড়ো ঝাঁটা সব মজুত। বুলানকে দেখার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। সুবল আর একমুঠো ধুনো আগুনে ফেলে দেয়। সবার চোখ জ্বালা করছে।
এত ভীড় দেখে, লোক দেখে, মায়ের পিসির কান্না দেখে, সুবলের আয়োজন দেখে বুলান বুঝতে পারে, এবার তাকে নিয়ে টানা হেঁচড়া শুরু হবে। তাকে মরিচ পুড়িয়ে শোঁকানো হবে, সরষে পুড়িয়ে শোঁকানো হবে। তারপর ঝাঁটাপেটা করে তার ভেতর থেকে ভূত তাড়ানো হবে। আর যতক্ষণ না সে নিজে মুখে মেনে নেয় , যে তার ওপর ভর করেছিল সে চলে গেছে, সে ছাড়া পাবে না। তার পরেও কি পাবে?
সে চোখ বন্ধ করে।
এই কয়দিন আর কাল সারারাত ধরে যে ছবিগুলো সে মনের মধ্যে গড়ে তুলেছে, সেগুলোকে আর একবার শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। উধাও নদীর চর। ধু ধু জোছনায় নৌকো ভাসিয়ে ঊজান বা ভাঁটিতে বয়ে যাওয়া। ঢেউএর সাথে সাথে নৌকো অল্প অল্প দুলছে। জাল তো ফেলতে হয় তাই ফেলা। আসলে সারারাত ধরে এই নদী, এই বিশাল আকাশ, জ্বলজ্বল করতে থাকা তারাদের মাঝখানে বিভোর হয়ে, বুঁদ হয়ে থাকা। গায়ের ওপর দিয়ে গ্রীস্ম বয়ে যাবে বর্ষা বয়ে যাবে। নৌকার গায়ে আঁচড় লাগলে সে নিজের গায়ে টের পাবে। কোনো বাঁধন নেই। ঘর নেই। এই পাড়া নেই। ইস্কুল নেই। শুঘু জল, নদীর বুকে জোলো হাওয়া আর বুলান। আর তারপর একদিন যখন প্রাণটা বেরিয়ে যাবে, ধীরেণ জেঠার মতই, নদীর বুকে, নৌকার সাথে মিশে, আকাশপানে বুক চিতিয়ে, খোলা চোখ, হাত জলে ঠেকে ঠেকে যাচ্ছে।
এরপর সুবল যখন তাকে জামগাছের সাথে পিছমোড়া করে বেঁধে, ধুণীতে ধূপ চড়িয়ে জোরে জোরে মন্ত্র বলতে শুরু করল , বুলান ততক্ষণে লগি ঠেলে দিয়েছে। দূরে, আরও দূরে, মাঝনদীর দিকে।
লেখক পরিচিতি
অর্ণব রায়
জন্ম ৯ ডিসেম্বর ১৯৮২। পশ্চিমবঙ্গের মালদা শহরে। শৈশবে পিতৃবিয়োগ। বেড়ে ওঠা সীমান্ত জনপদ লালগোলায়। অতঃপর শিক্ষাসূত্রে মালদা, কলকাতা ও বারানসী। বর্তমানে রঘুনাথগঞ্জে শিক্ষকতা। লেখালেখির সূত্রপাত কবিতা দিয়ে।২০০১ সাল নাগাদ। একখানি বই আছে। ‘ঋজু চিকন বিস্মিত সরল’। ছোটগল্প লিখেছেন মূলতঃ ভাষাবন্ধন, গল্পচক্র ও খোঁজ পত্রিকায়। ভালোবাসেন বই পড়তে ও সিনেমা দেখতে।
নৌকাটাকে ঘসে মেজে পরিস্কার করে দুদিন ধরে। যেখানে যেখানে আলগা হয়ে পড়েছিল, পেরেক মেরে ঠিক করে। লগি বাঁধার দড়িটা পুরোনো হয়ে গেছিল, সেটাকে পালটায়। প্রত্যেকবারের মত এবারেও সনকা গলুইয়ে ফুল ছড়িয়ে পুজো দিয়েছিল। ধূপকাঠি গুঁজে দিয়েছিল। মাধব পুরুত ঘন্টা নেড়েছিল। পাড়ার কেউ নদীতে গেলেই খবর হয়ে যায়। দুটো চারটে লোক হয়েই যায়। তারা বটকেরা করেছিল, ‘কাকা যাও যাও, কাকীরে কেউ নিয়ে যাবে না। আমরা পাহারা দেবো খনে।‘ আকাশ পরিস্কার ছিল। ছোটো ছোটো ঢেউ ছলাৎ ছলাৎ করে কাদামাটির পাড়ে এসে পড়ছিল।
তবু ধীরেণ ফিরে এলো দুদিনের বাসী লাশ হয়ে। ফিরে এলো পৈঠায় মাথা রেখে। আকাশপানে বুক চিতিয়ে। মুখ অল্প হাঁ করা। চোখ খোলা। দু হাত দুদিকে ছড়িয়ে আছে। জলে অল্প অল্প ঠেকে ঠেকে যাচ্ছে।
শানু, কাজল আর পুস্পর বর সনৎ নৌকা ছেড়েছিল ধীরেণের দুদিন পরে। ওরা একসাথে যায় উজান বেয়ে। বিশ পঁচিশ মাইল গিয়ে সুবিধে মত জায়গায় নৌকো বাঁধে নদীর মাঝ বরাবর। তারপর ঘুরে ঘুরে খেপে খপে জাল ফেলে এখানে ওখানে সারাদিন ধরে। এক জায়গায় বেশীক্ষণ জাল ফেলে থাকতে পারে না। নয়তো নদী যাদের বাঁধা নেওয়া তারা দেখতে পেলে তাড়া করে। তাছাড়া সুতোর জালের কাজে এক জায়গায় বেশীক্ষণ জাল ফেলেও রাখতে নেই। নাইলন হলে অবশ্য আলাদা কথা।
ধীরেণের নৌকা ওরা ভাঁটিতে ভেসে আসতে দেখে। দূর থেকে এলোমেলো ভেসে আসছিল। সন্ধ্যের দিকে ওরা তখন নৌকায় রাঁধতে বসেছিল। বাকীরা বিড়ি টানছিল। মোবাইলে বাড়ির লোকের সাথে কথা বলছিল। বাজারের হাল হকিকত জানছিল। নৌকাটা কাছে আসতে ওরা লগি দিয়ে থামায়। কিন্তু ধীরেণকে ওইভাবে সন্ধ্যার ঝুঁঝকি আঁধারে আকাশপানে চোখ রেখে হাঁ করে মরে পড়ে থাকতে দেখে ওরা এতটাই বিহবল হয়ে যায় যে ধীরেণের লাশটাকে নৌকার ভেতরে নিয়ে গিয়ে ভালো করে শোয়ানোর কথে মনেই আসে না। পানুর নৌকার পেছনে বেঁধে গুণ টানার মত করে নিয়ে আসা হয় ধীরেণের নৌকা। ঘাটে ভেড়ানো হয় তখন প্রায় মাঝরাত। পানু আগেই মোবাইলে পাড়ায় খবর করে দিয়েছিল। গোটা হালদারপাড়া ভেঙ্গে পড়ে ঘাটে।
ধীরেণ কোনওদিন দলের সাথে নৌকা নিয়ে যেত না। বলত, নদীর ভেতরে দল বেঁধে গেলে নদী গোঁসা করে। আর মাছ ধরা তো হল গিয়ে লোকের বাড়ির ভেতর ঢুকে বাড়ির লোকজনকে জোর করে ধরে নিয়ে আসা। সেটা পাঁচজনকে নিয়ে গিয়ে হল্লা করে করতে নেই। একা একা যেতে হয়। রাতের পর রাত নদীর বুকে কান পেতে পড়ে থাকতে হয়। মাছেদের চলাফেরা, যে দুটো একটা শুশুক আছে, তাদের চলাফেরা জলের তলে --সব শোনা যায়। সব শুনতে হয়।
দেখতে গেলে ধীরেণের ধাতটাই লক্ষীছাড়া। তা না হলে হালদারপাড়ার কোনও ছেলে ব্যান্ডপার্টিতে ড্রাম বাজাতে গেছে বলে কেউ শুনেছে? বটতলায় যেসব তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকা বুড়োগুলো বসে থাকে, তাদের অনেকেরই মনে আছে লক্ষীপতি আগরয়ালার ছেলের বিয়েতে কেমন তিনদিন ধরে ব্যান্ড বেজেছিল। সে কলকাতার ব্যান্ডপার্টি। যেমন তাদের জাঁকালো পোশাক, তেমনি বাজনা। ধীরেণ নাওয়া খাওয়া ভুলে ওদের সাথে পড়েছিল। আর বিয়ে শেষে যখন ব্যান্ডপার্টি রওনা দিল, ধীরেণও ওদের পিছু নেয়। ব্যান্ডপার্টির ম্যানেজার দুই দিন পরে খেয়াল করে একটা আনখা ছেলে দলে ভিড়ে গেছে। সাথে সাথে ফিরিয়ে দিয়ে যায়। কচি ধীরেণ এই দুদিনের মধ্যেই বেশ তালে তালে টেবিল চেয়ার বাজাতে শিখে যায়।
সাকুল্যে কয়বার যে ধীরেণ বাড়ি থেকে পালিয়েছে, আর কি কি কাজ যে ও জানে, সে খবর কেউ সঠিক রাখে না। শোনা যায় মাঝখানে ডাকাতের দলেও ভীড়েছিল। মাঝখানে যে দুবছর একেবারে নিপাত্তা হয়েছিল, সে সময়টা না কি সে জেলেই কাটায়। বাড়ির লোক হাল ছেড়ে দিয়েছিল। একদিন দুম করে বিয়ে করে নিয়ে এসে হাজির। কুমারী মেয়ে বা অন্যের বৌ ফুসলে নিয়ে আসা নতুন কিছু ব্যাপার না। তবে শোনা যায় সনকা না কি খারাপ পাড়ার মেয়েছেলে। লোকে কিছুদিন গুজগুজ ফুসফুস করে। তারপরে সময়ের সাথে সাথে থেমে যায়। ধীরেণ সকলের সাথেই মেশে, নেশা করে। সনকাও ঘাটে যায় কলপাড়ে বাসন মাজে। কিন্তু পাড়ায় এমন কোনও মরদ কি মেয়েছেলে নেই যে বুক ঠুকে বলবে সে ধীরেণের দোস্ত কি সনকার সই।
বিয়ের পরেও ধীরেণের চালচলন কিছুই বদলায়নি। সে আগের মতই মাঝে মাঝে উধাও হয়ে যায়। বাপ মা আগেই ফৌত হয়ে যাওয়ায় সে পিছুটান আর নেই। সাতদিন দশদিন একমাস পরে ফিরে আসে। তখন ওর ঘর থেকে পেয়াজ রসুনের গন্ধ ভেসে আসে। পাড়ার মেয়েরা নিজেদের জটলাতে সনকার কাল্পনিক চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করে। ‘অমন মেয়েছেলে আবার সোয়ামীর কি বোঝে । দেখ অন্য কোথাও লটঘট বাধিয়ে আছে। নয়তো পুরুষ বার বার অমন বাড়ির বার হয়ে যায়!’ পুরুষেরা আড়ে আড়ে তাকায়। বেড়ার ফুটোয় চোখ রাখে। এমনি করেই সময় বয়ে গেছে। সনকারও বয়স দুকুড়ি দশ পার হতে চলল।
তিনটে নৌকা যখন ধীরেণের বডি নিয়ে ভিড়ল তখন নদীর পাড়ে সনকার আছড়ে পড়ে কান্না অনেকের কাছেই বাজে নাটক মনে হলেও তা দেখতে ভীড় কিছু কম হয়নি। লোকে অতীতের কেচ্ছা, সত্যি হোক মিথ্যা হোক মন থেকে মুছে ফেলতে চায় না। হ্যাজাক এমারজেন্সি লাইট টর্চ লন্ঠন টেমি- যে যা পেরেছে নিয়ে জড়ো হয়ে গেছে। আকাশের ক্ষয়াটে চাঁদ। অপার্থিব আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে চারিদিকে। নদীর ও পাড় থেকে দেখলে মনে হবে দশদিক জোড়া বিশাল অন্ধকারের মধ্যে একগোছা নানা রঙের জোনাকী নড়াচড়া করছে। আরো কাছ থেকে দেখলে তাদের আচরণ আরও অদ্ভুত। নানা আকারের ছায়ামুর্তি গাছের মত সারসার দাঁড়িয়ে আছে, উবু হয়ে বসে আছে। এই বিশাল অন্ধকার, নদীর ছলাৎ ছলাৎ, নৌকার পৈঠায় পেট উলটে পড়ে থাকা মড়া--সব মিলে যেন তাদের গলা টিপে ধরেছে। কেউ জোরে কথা বলছে না। এমনকি জোর দিয়ে কাঁদছেও না কেউ।
মূল ভীড়টার থেকে কিছু দূরে ছিল ছেলে ছোকরাদের ভীড়। ধীরেণজেঠা নদীতে বেরিয়ে মারা গেছে। তাকে সাপে কাটেনি, কামটে নেয়নি, নৌকাও ডোবেনি। তবু মরে গেছে। এতে তারা ভারী অবাক হয়ে গেছে। যারা ওদের মধ্যেই একটু বড়, বাবা কাকাদের কাছে শুনে বলছে, একে হাট এটাক বুলে। দম চাপি মরি যায় মানষে। অদের কেউ আসতে বারণ করেনি। আবার নিয়েও আসেনি। নানা বয়সী ছেলেমেয়ের দলটা তবু একটু দূরে একটা টিলা মতন উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল। কে জানে এরকম সময়ে কাছ থেকে দেখতে গিয়ে যদি চড়টা থাপ্পড়টা খেতে হয়। কাছে যাওয়ার সাহসও ছিল না কারোর।
এই দলের মধ্যে বুলানও ছিল। মাথায় বেঁটে বলে কখন যেন ঠেলেঠুলে ফাঁকফোকর দিয়ে সকলের সামনে চলে আসে । আর একেবারে সামনে থেকে দেখতে পায় পুরো ব্যাপারটা। আর সকলের মত ও সন্ধ্যে থেকে শুনেই আসছিল ধীরেণজেঠা মরে গেছে। বডি আনা হবে। আনা হবে না আনা হবে, ও অত ভেবে টেবে দেখেনি। এখন দেখতে পায়। ধীরেণজেঠার লাশ নিয়ে নৌকোদুটো পাড়ে ভেড়ার সাথে সাথে ভীড়টা হামলে পড়ল। সবাই দেখতে চায় এই আশ্চর্য মৃত্যু। পৈঠাতে মাথা রাখা। মুখ হাঁ। আকাশপানে খোলা চোখ। দু হাত দুদিকে ছড়িয়ে আছে। নৌকা ঢেউয়ে অল্প অল্প দুলছে আর হাত দুখানা জলে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে।
জেঠাইমা এসে আছড়ে পড়ে। হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। মুখে মাথায় চুলে কাদা লেগে যায়।পাড়ার মেয়েরা ধরাধরি করে সামলায়। কেউ কেউ অভ্যাস বশে, কাঁদতে হবে তাই রোল তুলে কেঁদে ফেলেই চারদিকে তাকিয়ে চুপ করে যায়। আধো অন্ধকারে ধরাধরি করে দুলতে থাকা নৌকা থেকে বডি নামায় তিন চার জন। হ্যাজাকের আলোয় লন্ঠনের আলোয় বোঝা যায় না ওরা কারা। বলহরি হরিবোল করে তুলে নিয়ে চলে যায় হালদারপাড়ার দিকে। এতসব বুলানের চোখের ওপর একে একে ঘটে। সব মিটে গেলে, ঘাট আস্তে আস্তে খালি। বুলান টিলার ওপর ঠায় বসে থাকে। দেখে রতন আর গৌতম খানিক পরে ফিরে এল। ধীরেণ জেঠার নৌকাটা তখনো বাঁধা আছে ঘাটে। এদিক ওদিক তাকিয়ে ওরা ধীরেণ জেঠার নৌকা থেকে তার মরে যাওয়ার আগে ধরা মাছগুলো নিজেদের নৌকায় নিয়ে গিয়ে রাখলো। জেঠার নৌকা থেকে আরো কিছু বের করে ওরা নিজেদের নৌকায় রাখে। ওদের চলাফেরা ভূতের মত লাগে।
বুলান যে সারারাত ফেরেনি, ডামাডোলের মধ্যে কেউ তা খেয়াল রাখে না। সকালে যখন ফেরে, সবাই ভাবল শ্মশান থেকেই ফিরল বোধহয়। বুলান কারোর সাথে কোনও কথা বলে না। লোহা ছোঁয়, নিমপাতা দাঁতে কাটে। আগুন ঠেকিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে।
হালদারপাড়ার দিনরাত একই ভাবে বহতা থাকে। না থেকে উপায়ও নেই। পেট কারোর জন্য থেমে থাকে না। মরদদের খালে বিলে নদীতে জাল হাতে বেরোতেই হয়। সনকা যে দুবাড়ি কাজ করে, সেখানে খবর পাঠায়। ছোটো ছেলেমেয়েগুলো যে কোথায় যায়, কি করে সে খবর কেউই রাখে না। ওরা রাস্তায় রাস্তায় মার্বেল খেলে, কুড়িয়ে পাওয়া সিগারেটের প্যাকেট দিয়ে মিথ্যে মিথ্যে তাস খেলে। তারপর একটু লায়েক হলে খালপাড়ের জুয়ার ঠেকে গিয়ে জোটে। বিড়ি টানতে শেখে। রাতে হালকা টলতে টলতে ঘরে ফেরে। মা বাবাকে খিস্তি করে। মেয়েরা মেয়ে হওয়ার কিছু আগেই ঘরে ঢুকে পড়ে। বিকেলে ম্যাক্সির ওপর ওড়না ফেলে হাওয়া খেতে বেরোয়। মা-দের সাথে বাড়ি বাড়ি কাজে যায়। কোনও কোনও ঘরে বিড়ি বাঁধার কাজ হয়। ছেলেমেয়েরা খুব ছোটো থেকেই কেন্দু পাতায় তামাক ঠাসতে শিখে যায়। অধিকাংশই পাড়া বেপাড়ার ছেলে ধরে ঝুলে পড়ে। যাদের সে মুরোদ হয় না তাদের বাবা মা কে এর ওর কাছে ধারধোর করে পার করতে হয়।
ধীরেণের বাড়িতে শ্রাদ্ধ শান্তির যোগাড় চলতে থাকে। মাধব পুরুত বিধান দেয়, অপঘাতে মৃত্যু যখন নয়, তখন এগারো দিনেই কাজ হবে। ধীরেণের দূর সম্পর্কের দাদা পলানের ছেলে প্রবীর মুখাগ্নি করেছে। কাছাও ধারণ করেছে। শ্রাদ্ধশান্তির কাজও ওই করবে। এতবড় একটা দায়িত্বের কাজ পেয়ে পাড়ার ছেলেছোকড়াদের কাছে ওর রেলা বেড়ে গেছে। পাড়ায় সকলেই কোনও না কোনও ভাবে সকলের আত্মীয়। এসব ব্যাপারে লোকের অভাব হয় না।
এর মধ্যেই বুলানের বাপ তারানাথের কাছে খবর আসে ছেলে মাঝে মাঝে নিপাত্তা হয়ে যাচ্ছে। প্রথমে ছেলের মা কিছুদিন ঘ্যানঘ্যান করছিল যে ছেলে সময়ে ঘরে ফিরছে না। ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করছে না। রাতের দিকে জেগে বসে থাকে। কারোর সাথে ঠিকমত কথা বলে না। খেলতে যায় না। চড়কের জন্য গোটা পাড়ার ছেলেরা ঝেঁটিয়ে চাঁদা তুলতে বেরোচ্ছে। ছেলে কিছুতেই ওদের সাথে বেরোতে চাইল না এবার। অথচ গতবার কতো উৎসাহের সাথে গেছিল। কিছু একটা তো হয়েছে ছেলের। তা ঘরের মাগের ঘ্যানঘ্যানানিতে কান দেবে, তারানাথ সে বান্দাই নয়। কিন্তু কয়দিন পরেই পাড়ার আরও লোকজনও একই কথা বলে। নলেন কুন্ডু একদিন রাস্তায় ধরে বলল, হ্যা রে তারা, তর ছেলেটাকে খালপাড়ের দিকে যেতে দেখলাম কেন রে?
তারানাথ প্রথমে ভেবেছিল ছেলে জুয়ার আড্ডায় যাওয়া ধরেছে বোধহয়। এতে খুব যে অবাক হয় বা দুঃখ পায় তা মোটেই না। এ পাড়ার সব ছেলেই একবার না একবার ওই আড্ডায় ঢুকেছে। যে বেরোতে পেরেছে, পেরেছে। পুলিশ পার্টি সবার সাথে সেটিং আছে। কে কি বলবে। আর ছেলেছোকরারা এই বয়সে একটুখানি নেশা করবে না, জূয়া খেলবে না, তা কি করে হয়!
তবু বাপের কর্তব্য বলে তো কিছু আছে। তারানাথ বুলানকে খুঁজতে বেরোয়। হিসেব মত প্রথমে খালপাড়ে যায়। গিয়ে দেখে সব ভোঁ ভাঁ। কেউ কোথাও নেই। বোধহয় কিছু খবর আছে। সময়মত কেটে গেছে। খালি হাওলা খালেদ বসে বসে গাঁজা বানাচ্ছে। জুয়া খেলতে খেলতে পয়সা না থাকলে লোক বুঝে খালেদ টাকা হাওলাত দেয়। তাই ওর নাম হাওলা খালেদ। খালেদের তেজিয়াল বিবি তাসমিরা ভাতারের জুয়ায় জেতা পয়সায় ভাত খাবে না বলে পোয়াতি অবস্থায় ঘর ছেড়ে যায়। সেই থেকে গোটা এলাকায় এটা চালু রসিকতা, খালেদের কাছে একবার হাওলাত করলে ঘরের বিবি আর কখনোই ইমানদারির ভাত খেতে পারবে না।
দু এক ছিলিম বোধহয় খালেদ আগেই চড়িয়ে ছিল। তারানাথকে দেখে খেঁচিয়ে ওঠে। “ কি চাই বে? শালা এখানে মন্তর ঝাড়তে এসেছো? পেছনে ভরে দেবো শালা তোমার ...।“ বোধহয় পুলিশ টুলিশ সামলাতে এখানে রয়ে গেছে। নয়ত এরকম করার কথা নয়। কতবার একসাথে বসে নেশা করেছে তারা। তারানাথ হাওয়া খারাপ বুঝে সরে পড়ে।
খুঁজতে খুঁজতে আদাড় বাদাড় ঘুরে শেষে বুলানকে পায় নদীর ধারে। একটা টিলার ওপর হাঁটুতে থুতনি রেখে বসে আছে। নদীর দিকে মুখ করা। দেখেই হাঁক পাড়ে।
বুলান সম্বিত হারিয়ে বসেছিল। দূর থেকে বাপের হাঁক শুনে এদিকে তাকায়। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বিনা বাক্যব্যায়ে উলটোদিকে দৌড় লাগায়। তারানাথ লুঙ্গি গুটিয়ে তাড়া করে। কিন্তু পারবে কেন। একে তো দূরত্ব অনেকটা। তার ওপর বয়সও তো হচ্ছে। এদিকে বাংলা আর বাবার প্রসাদ করে শরীরে তো আর কিছুই নেই। আচ্ছা, যেতে দাও। কতদূরে আর পালাবে! বাড়িতে তো একবার না একবার ফিরে আসতেই হবে। তারানাথ মাজায় হাত রেখে হাঁপাতে থাকে। তখনই খেয়াল পড়ে, বুলান যেখানে বসেছিল, সেখানেই কিছুদিন আগে ধীরেণদার অমন বেকায়দা ভাবে মরে থাকা দেহটাকে এনে ভেড়ানো হয়েছিল।
তারানাথের মনে কেমন একটা কু হাওয়া বইতে থাকে। ছেলে এসে এখানেই বসেছিল কেন? দূর থেকে মনে হল জগৎ সংসারের কিছুই খেয়াল নাই। তাকে দেখে মারের ভয়ে পালালো বটে, কিন্তু ছেলে তো কোনোদিন এরকম চুপচাপ একা একা বসে থাকার ছেলে না।
তারানাথ চিন্তায় পড়ে। পরশুদিনই সুবল গুনীন তাদের হ্যান্টাকালীর থানের চক্রে বলছিল, কয়দিন একটুকুন সামলে সুমলে থাকিও হে। উ শালা কুমড়ো বলি দেওয়া মাধব পুরুত আমার এইটা জানে। এটা লিশ্চয় অপঘাত। শালা, ঘরে লয়, বৌ পরিবার কেউ সাথে নাই, মাঝ দরিয়ায় জলের মাঝে পরাণডা বার হয়া গেল, আর উ কহিছে অপঘাত লয়!
সবাই সমস্বরে বলে ওঠে, অপঘাত। নিশ্চই অপঘাত।
সুবল ছিলিম বাঁশরীর হাত থেকে নিয়ে একটা দমভর টান দেয়। বলে, শুনো, ধীরেণ তো লোক সুবিধের ছিলোক নাই। আদ্যশ্রাদ্ধ যতদিন না হয়, ঘরের যোবতী মাগ আর বাচ্ছা ছেলিয়া মেইয়াগুলানকে চোখে চোখে রাখবা। সোমসারের টান মানুষে সহজে ছাড়ান দিতে পারে না। আশেপাশে ঘুর ঘুর করতে থাকে। যোবতী মেয়েছেলে আর বাচ্ছাগুলান হয় নরম জান। তখন তাদের ওপর এসে ভর করে।
তারানাথ ভাবে, তবে কি তার ছেলের ওপরই ভর করল ধীরেণদা মরার পরে। সে মনে করতে চেষ্টা করে ধীরেণদার সাথে তার কোনোদিন কোনও খিঁচ ছিল কি না। কিন্তু সেরকম কিছু মনে পড়ে না। সত্যি বলতে কি। ধীরেণদার সাথে কার যে ঝামেলা ছিল আর কার যে মিল ছিল সেটা কেউই স্পষ্ট করে বলতে পারবে না। বাচ্চাদের ওপরেও ধীরেণদার সেরকম কোনও টান ছিল বলে তো মনে হয় না যে সেই টানে তার ছেলেকে ধরবে। এই যে সনকা বৌদি, ছেলেপিলে হয়নি, তাকেও তো কোনওরকম নেই আঁকড়া ভাব হতে দেখেনি কেউ। আর বুলানকে ঠিক বাচ্চাও তো বলা যায় না।
এরকম সাতপাঁচ ভাবনার মধ্যে তার একরকম গর্বও হতে থাকে। আর সব ছেলেদের মধ্যে তার ছেলেকেই ভর করেছে ধীরেণ হালদারের আত্মা। সুবল তো তাকে বারবার বলে, ওরে তোর মধ্যে জিনিস আছে। তুই মায়ের কাজ করতে এসেছিস। আর কটা দিন যাক, দেখবি সব লক্ষণ ফুটে ফুটে বেরোচ্ছে।
তার হয়নি, তার ছেলের তো হল। ভালো আধার না হলে কি হয় এসব! সুবলের সাথে থাকতে থাকতে সে আধার চক্র জাগরণ এসব শিখেছে খুব। সে ভাবে আর দু-একদিন দেখবে। বলা যায় না, শ্রাদ্ধশান্তি চুকে গেলে সব ঠিক হয়েও যেতে পারে। তবে সুবলকে সব বলতে হবে।
তারানাথের হিসেব মত সব ঠিক হয়ে যায় না। শাদ্ধশান্তি মিটে গেলেও নানা লোকে মাঝে মাঝেই বুলানকে নদীর ধারে খুঁজে পায়। ইস্কুল টিস্কুল বন্ধ। খেলাধুলা নেই। দিনে দিনে আরো কথাবার্তা কম হয়ে যাচ্ছে ছেলের। দশটা প্রশ্ন করলে হয়তো একটার জবাব দেয়। এদিকে তারানাথ কিছু চুপচাপ থাকার লোক নয়। গোটা পাড়া জেনে যায়, বুলানের ওপর ধীরেণ হালদারের ভর হয়েছে। আর সে এতটাই শক্ত রকমের ভর যে শ্রাদ্ধকাজ পিন্ডদান সব হয়ে গেলেও ছেড়ে যাচ্ছে না। সবাই বলতে লাগল, ধীরেণদার নিশ্চই কিছু অপূর্ণ ইচ্ছে আছে। সেটা না পেলে মুক্তি হচ্ছে না। এভাবে বেশীদিন ফেলে রাখা ঠিক না। কখন কার ক্ষতি হয়ে যায়।
পাড়ার লোক বুলানকে চোখে চোখে রাখে। তারানাথ নিজে একদিন দেখে, ভর সন্ধ্যেবেলা ছেলে নদীর ধারে একটা নৌকার পৈঠার ওপর বসে হালটানার ভঙ্গী করছে। হালদারপাড়ায় থাকলেও তারানাথের কোনোকালে মাছমারার ব্যবসা নয়। ছেলেরও কোনও দিন জল জাল কাঁটার দিকে আগ্রহ নেই। তাকে ওরকম সন্ধ্যার আবছায়ায় ভূতের মত আচরণ করতে দেখে তারানাথ সত্যি সত্যি ভয় খেয়ে যায়। হাত ধরে হিড় হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে আসে। উঠোনের ধারে কাঠ ঘুঁটে রাখার ঘরটায় ঢুকিয়ে বাইরে থেকে শেকল তুলে দেয়। বাড়ির মেয়েদের বলে, খবরদার কেউ উঘর খুলবা না। আমি সুবল গুনীর কাছে যেছি। বলেই বেরিয়ে যায়। মেয়েদের মধ্যে কান্নার রোল পড়ে যায়।
সুবল গুনী বলে, আজ লয়, পরশু। পরশু অমাবস্যা। পরশু ঠিক দুপুর দুপুর হামি তুর বাড়ি যাবো। আর তুর ছেলাকে আরাম করে দিবো। বলে, তারানাথের হাতে সামগ্রীর একটা লম্বা ফর্দ ধরিয়ে দেয়। আরও বলে, ছেলেকে এই দুদিন ঘরের বার হতে দিবি না। মাছ মাংস খাবি না বাড়িতে। আর মানে, বৌমার সাথে একত্রে রাত্রিবাস... মানে বুঝলি কি না? আর তুর থেকে দক্ষিণে আর কি লিব। যা যা, কুনো চিন্তা নাই তুর, আরে ওরকম কতো ধীরেণ এই বগলের তলা দিতে পার হয়্যা গেল। আরে সি বার, সেই গো আইলের ওপরের কুশ ছুতারের ওপর ভর হল। সি একটা জবরদস্ত অপদেবতা পেয়াছিলাম বটে।
সবাই ঘন হয়ে আসে। ছিলিমে আরো ঘন ঘন ধোঁয়া উঠতে থাকে।
আশেপাশের পাড়ায় খবর হয়ে যায়। খালপাড়ের জুয়ায়ার ঠেকের থেকেও ভীড় হতে থাকে তারানাথের বাড়ি আর সুবল গুণীর আখড়ায়। সবাই বুলানকে দেখতে চায়। সনকাও আসে। তারানাথকে বলে, অ ভাই, একবার ছেলাটার সাথে দেখা করাও না। সবাই বুলছে তুমার দাদার ভর হয়াছে উর উপরে। দেখ না, যদি কিছু বলে তুমার দাদা। কেমন আছে টাছে...।
তারানাথ সকলকে হাতজোড় করে। বলে, হামার বেটাটাকে আপনেরা অমন ব্যাস্ত কইরেন না। উর উপর এমনিতেই মেলা ধকল যেছে। উরে ছাড়ি দেন।
বুলানের প্রাণের বন্ধু পূষণ আর সতে এর মধ্যেই একদিন লুকিয়ে লুকিয়ে বুলানের সাথে কথা বলতে পারে। চাঁচের বেড়ার ঘরে ফুটো থাকেই। পাটকাঠি ঢুকিয়ে পিঠে খোঁচা মারে ওর। বুলান ফুটোয় মুখ রাখে। বাইরে তখন বেজায় ভীড়।
বুলান বলে, কি হছে বুলতো? হামাকে লিয়ে কি কইরবে?
পূষণ বুলানের বয়সী। সতে আরো ছোট। ওরা ওদের মত বুঝেছে।
পূষণ বলে, তুর উপর ধীরেণ জেঠার ভর হয়াছে। সুবল গুণী কাল এসে তুকে ঝাইড়বে।
-- ঝাইড়বে মানে কি? মাইরবে না কি?
-- মাইরবে তো বটেই। তার আগে তুকে বাইন্ধবে। তারপরে সরষে পুড়ায়ে শুঙ্গাবে। তারপরে ঝাঁটা দিয়ে পিটবে।
সতে বলে, আরে না না, সরষে না, শুকনো মরিচ পুড়ায়ে শুঙ্গাবে।
সরষে না শুকনো লঙ্কা, কোনটা পুড়িয়ে শোঁকাবে, তাই নিয়ে ওদের মধ্যে ঝামেলা লেগে যায়। ঘরের পেছনে কি সব টিন ফিন ডাঁই করে রাখা ছিলো। হাতের ধাক্কায় পড়ে যায়। খুব জোরে শব্দ হয়। বাইরে থেকে কে যেন চেঁচিয়ে ওঠে, কে বে ঘরের পেছনে? ওরা পালিয়ে যায়। বুলান কেঁদে ফেলে। খুব কষে দড়জায় ধাক্কা দেয়। বাইরে হট্টগোল থেমে যায়। সবাই কাঁটা হয়ে দড়জার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু কেউ দড়জা খোলে না।
পরদিন দুপুর দুপুর যখন বুলানকে বের করে আনা হল, বাইরে চড়কের মেলার ভীড় জমে গেছে। চাই কি একটা বাদামওয়ালাও এসে হাজির। গোল করে ঘিরে ধরা ভীড়ের মাঝখানে সুবল তার কাজকর্ম আরম্ভ করে দিয়েছে। সামনে ধুণী থেকে গলগল করে ধোঁয়া ঊঠছে। সিঁদুর মাখানো মরার মাথা, হলদেটে হাড়, চামর, মুড়ো ঝাঁটা সব মজুত। বুলানকে দেখার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। সুবল আর একমুঠো ধুনো আগুনে ফেলে দেয়। সবার চোখ জ্বালা করছে।
এত ভীড় দেখে, লোক দেখে, মায়ের পিসির কান্না দেখে, সুবলের আয়োজন দেখে বুলান বুঝতে পারে, এবার তাকে নিয়ে টানা হেঁচড়া শুরু হবে। তাকে মরিচ পুড়িয়ে শোঁকানো হবে, সরষে পুড়িয়ে শোঁকানো হবে। তারপর ঝাঁটাপেটা করে তার ভেতর থেকে ভূত তাড়ানো হবে। আর যতক্ষণ না সে নিজে মুখে মেনে নেয় , যে তার ওপর ভর করেছিল সে চলে গেছে, সে ছাড়া পাবে না। তার পরেও কি পাবে?
সে চোখ বন্ধ করে।
এই কয়দিন আর কাল সারারাত ধরে যে ছবিগুলো সে মনের মধ্যে গড়ে তুলেছে, সেগুলোকে আর একবার শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। উধাও নদীর চর। ধু ধু জোছনায় নৌকো ভাসিয়ে ঊজান বা ভাঁটিতে বয়ে যাওয়া। ঢেউএর সাথে সাথে নৌকো অল্প অল্প দুলছে। জাল তো ফেলতে হয় তাই ফেলা। আসলে সারারাত ধরে এই নদী, এই বিশাল আকাশ, জ্বলজ্বল করতে থাকা তারাদের মাঝখানে বিভোর হয়ে, বুঁদ হয়ে থাকা। গায়ের ওপর দিয়ে গ্রীস্ম বয়ে যাবে বর্ষা বয়ে যাবে। নৌকার গায়ে আঁচড় লাগলে সে নিজের গায়ে টের পাবে। কোনো বাঁধন নেই। ঘর নেই। এই পাড়া নেই। ইস্কুল নেই। শুঘু জল, নদীর বুকে জোলো হাওয়া আর বুলান। আর তারপর একদিন যখন প্রাণটা বেরিয়ে যাবে, ধীরেণ জেঠার মতই, নদীর বুকে, নৌকার সাথে মিশে, আকাশপানে বুক চিতিয়ে, খোলা চোখ, হাত জলে ঠেকে ঠেকে যাচ্ছে।
এরপর সুবল যখন তাকে জামগাছের সাথে পিছমোড়া করে বেঁধে, ধুণীতে ধূপ চড়িয়ে জোরে জোরে মন্ত্র বলতে শুরু করল , বুলান ততক্ষণে লগি ঠেলে দিয়েছে। দূরে, আরও দূরে, মাঝনদীর দিকে।
লেখক পরিচিতি
অর্ণব রায়
জন্ম ৯ ডিসেম্বর ১৯৮২। পশ্চিমবঙ্গের মালদা শহরে। শৈশবে পিতৃবিয়োগ। বেড়ে ওঠা সীমান্ত জনপদ লালগোলায়। অতঃপর শিক্ষাসূত্রে মালদা, কলকাতা ও বারানসী। বর্তমানে রঘুনাথগঞ্জে শিক্ষকতা। লেখালেখির সূত্রপাত কবিতা দিয়ে।২০০১ সাল নাগাদ। একখানি বই আছে। ‘ঋজু চিকন বিস্মিত সরল’। ছোটগল্প লিখেছেন মূলতঃ ভাষাবন্ধন, গল্পচক্র ও খোঁজ পত্রিকায়। ভালোবাসেন বই পড়তে ও সিনেমা দেখতে।
0 মন্তব্যসমূহ