মোহাম্মদ মাকশুমুল হকের গল্প : মাছি

ফ্রন্টডোর খুলে ড্রাইভিং সিটে বসার সময়টুকুর মধ্যে ঢুকে পড়েছে বেআক্কেলে মাছিটা। পাওয়ার উইন্ডো সুইচ চেপে সামনের গ্লাস দুটো নামিয়ে দিল লোকটা। কাজ হল না। মাছি চলে গেছে পেছনের সিটে। ছয় পা আরামে দাঁড়াও ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে রইল। পেছনের গ্লাসগুলোও নামিয়ে দিল লোকটা। উঁহু, কাজ হচ্ছে না। মাছি পণ করেছে বের না হওয়ার। অফিসে ঢোকার জন্য সময় হাতে আছে আর তের মিনিট। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠছে। নাহ্, আর অপেক্ষা করা যায় না। অগত্যা গ্লাসগুলো তুলে দিয়ে ইঞ্জিন স্টার্ট দিল লোকটা।

১।

বারটা বিশ বাজে। নাতিকে স্কুল থেকে আনার জন্য বের হলেন মাসুদ সাহেব। বয়স সত্তর ছাড়িয়েছে কিছুদিন হল। ক্লান্তি আজকাল বেশ জেঁকে বসেছে। প্রতিটা দশের কোঠা পার হলে আপনা থেকেই যেন মানুষ নিজের অবস্থান বদলায়।শুনেছেন পৃথিবীর ভেতরের উত্তর দক্ষিণ বরাবর চুম্বকটাও নাকি ফি-বছর অবস্থান থেকে একটু একটু করে সরে যায়। তারপর একদিন পূর্ণ অবস্থান্তর ঘটে, উত্তর হয়ে যায় দক্ষিণ আর দক্ষিণ উত্তর। মানুষের অবস্থান বদলটাও কি সেরকম - আকস্মিক নয়, পূর্বনির্ধারিত ছক। ব্রেনের নিউরন সেলগুলোতে হয়ত ওভাবেই আঁকা হয়ে গেছে প্রজন্মান্তরে। মনের ইচ্ছার জোরে কিছুদিন জোর করে সেটা উপেক্ষা করে থাকা যায় কিন্ত সময়ের সাথে পারিপার্শ্বিক এর জালে ধীরে ধীরে আটকে ফেলবেই। অবসর নেয়ার পর ইচ্ছে ছিল গ্রামে ফিরে যাবেন তিনি। হেঁটে বেড়াবেন পরিচিত সব উঠোন আর চৌহদ্দি গুলো। শেষ বিকেলের আলো ঝাপসা হয়ে এলে, চৌধুরী বাড়ীর মুয়াজ্জিন যখন মাইকবিহিন খালি গলায় অপার্থিব আজান ধরবেন, মৃতপ্রায় সেই আলোয় জমির আল ধরে হেঁটে তিনি মসজিদের পথে রওনা হবেন। সন্ধ্যা হয়ে এলে বাজারের লতিফ মুন্সির দোকানে চা নিয়ে বসে গল্পগুজব করবেন ব্যস্ততা থেকে অবসর নেয়া সমবয়সী মানুষগুলোর সাথে। এই দিবাস্বপ্নগুলো আজকাল বেশী বেশী চলে আসছে দৃষ্টি ঝাপসা করে। বড় একটা শ্বাস ফেলে, চিন্তার পর্দা সরিয়ে দেন তিনি। আপাতত দায়িত্ব নিরাপদে নাতিকে নিয়ে ঘরে ফেরা। স্কুল ছুটির এই সময়টাতে বড্ড লাইন লেগে থাকে গাড়ি, রিকশা, সিএনজি ট্যাক্সি আর মানুষের।

২।

ডাইনিং এ মুন্তাহা হোমওয়ার্ক এর কাজ বিছিয়ে বসেছে। আজকের রেসিপি শিফন কাস্টার্ড কেক। চিনি, ডিম, ভ্যানিলা এসেন্স, গুঁড়ো দুধ ইত্যাদি ইত্যাদি সব এনে জমা করেছে টেবিল এর উপর। কি যেন একটা নেই। লিস্টটা আবার পড়ে নেয়া শুরু করল মুন্তাহা। ছেলেটা স্কুল থেকে এলেই খেতে চাইবে। আর প্রতিদিন আইটেমগুলো হতে হবে স্পেশাল। পরপর দুদিন একই আইটেম চলবেনা। এমনকি একই সপ্তাহে এক জিনিস তৃতীয়বার রিপিট করা যাবেনা। বাচ্চাগুলো আজকাল বড় চুজি। আমাদের সময় এত আবদার ছিল না, ভাবে মুন্তাহা। কোনেতে রাখা এক্যুরিয়ামের গোল্ড ফিশ দুটো আড়চোখে দেখছে তাকে। ঘরে এ সময়টাতে ওরা তিনজন ছাড়া সাধারণত কেউ থাকে না।৩।

“কোথায় যাবেন?”– ইশারায় গাড়ি দাঁড় করায় সানগ্লাস চোখে, ঈষৎ পোড়া চামড়ার অফিসার।

জানালা গলিয়ে মাথা বের করেন পেছনের সিটে বসা মাসুদ সাহেব। এই ধরনের পরিস্থিতি একেবারেই অপছন্দ তার। রিশাদ দাদুর গা ঘেঁষে আসে।

“এই গলিতেই আমার বাসা”।

“গাড়ির উইন্ডশিল্ড এ এত ডার্ক শেড কেন লাগিয়েছেন? জানেন না এটা আইনবিরোধী? গাড়ি সন্দেহজনক কাজে ব্যবহৃত হয় এমনটা অভিযোগ এনে এটা সিজ করতে পারি তা জানেন”?

অজান্তেই হৃদক্রিয়া বেড়ে যাচ্ছে একটু একটু করে মাসুদ সাহেবের।

“দেখুন এটা সম্পর্কে আমার জানা নেই। ড্রাইভার শখ করে লাগিয়েছে। সারাদিন তো ওকেই রোদে রোদে চালাতে হয়। তাই একটু বেশী ছায়া পাবার জন্য হয়তো”।

“স্যার, কেইস লেইখা দেন, থানায় আইসা ঘুইরা যাক একবার”– পাশ থেকে বলে ওঠে ভাঙ্গা চেহারার কনস্টেবল।

“আপনাকে গাড়ি থেকে নামতে হবে”– অফিসার

এবার হাল ছেড়ে দেন মাসুদ সাহেব। সারাজীবন সরকারি ছোট পদে চাকরি করেছেন। জানাশোনা কোন কালেই তেমন ছিলনা। নিজে তেমন কিছু করতে পারেননি বলে জানাশোনার ব্যপারটা কখনও মাথায় আসে নি। এখন ছেলে বিদেশে থাকার সুবাদে কিছু কিছু করে অপ্রাপ্তিগুলো পূরণ হচ্ছে। এ দেশে সম্পদ গড়ে তোলার সাথে সেটা রক্ষার জন্য কিছু জানাশোনাও প্রয়োজন। সিটে গা ছেড়ে দেন তিনি। ডান হাতে রিশাদকে জড়িয়ে নেন। রিশাদের ভয় আস্তে আস্তে কান্নায় রূপ নিচ্ছে। বাবাটা যদি আজ দেশে থাকত।

কামরুল (ড্রাইভার)–“নানা আপনে বসেন, আমি দেখতাসি”।

কামরুল সবে তরুণ। ছোকরা স্বভাবগুলো এখনও যায় নি। এটা একদিক থেকে ভালোই। ফাঁকিবাজি আর পেশাদারী ভাবটা এখনও রপ্ত করে উঠতে পারে নি। গত দুবছরে সে চতুর্থ ড্রাইভার। দুটো বেশী বেতন আর কম ডিউটির হিসেব করে আটটা পাঁচটা অফিসের চাকুরীরলোভে চলে গেছে। আর একজন দিন রাত নেশা করত। গাড়ি চালাতে গিয়ে দুবার মাসুদ সাহেব তাকে হাতেনাতে ঘুমিয়ে পড়তে দেখেছেন।

মাসুদ সাহেব কিছুটা আশ্বস্ত। কিন্ত নির্ভার হতে পারলেন না। কামরুল গিয়ে কনস্টেবল এর সামনে দাঁড়াল। মিনিট পাঁচেক পর ফিরে এল।

“নানা, পাঁচশ টাকা দিতে হইব”।

দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে মাসুদ সাহেবের।

“কিন্ত আমার কাছে তো এত টাকা নেই। শ দুয়েকের মত আছে”।

“নানা আমারে দেন। বাকিটা আমার কাছে আছে। পরে দিয়া দিয়েন”।

কনস্টেবল এর হাতে টাকাটা গুঁজে দিয়ে ফিরে এলো কামরুল। অফিসার সাহেব ততক্ষনে মোবাইল ফোন কানে তুলে খোশগল্পে মশগুল হয়ে গেছেন। ঠোঁটের কোনে হাসিটা চোরা। ফোনের ওপাশে সম্ভবত কোন নারী।

৪।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল। মাছিটা তার জায়গা পরিবর্তন করে সামনের ড্যাশবোর্ডে নিরাপদ দূরত্বে বসেছে। সামনের দিকে মুখ করে। শীত আসতে এখনও বেশ কিছু দিন বাকী। বাতাসে ধুলোর পর্দা ঝুলছে যেন ধূসর শিফনের মত। দুপুরে অনেক উত্তাপ হলেও সারাদিনের ক্লান্তিতে রোদের আঁচটা ধরে এসেছে। অফিসের কাজে লোকটা ছুটছে শেখ জায়েদ রোড ধরে দুবাই মেরিনার পথে। ট্রেড সেন্টার মেট্রো স্টেশন ছাড়াতেই ধুলোর পর্দার মাঝ দিয়ে ডিসল্ভড হয়ে ভেসে উঠতে লাগলো বুর্জ খলিফা। এ দেশে আসার পর এই রাস্তা কতবার যে আসা যাওয়া করতে হয়েছে তা অগুনিত। তবুও ক্লান্তি লাগে না লোকটার কখনো। আজ কেন যেন একটু লাগছে। ডানের সাইড মিররে চোখ রেখে ট্র্যাক বদলাতে গিয়ে মাছিটাকে দেখল লোকটা। ভুলেই গিয়েছিল ওটার উপস্থিতি, ব্যস্ততার মাঝে। সে রকমই স্থির বসে আছে। খুব ছোটবেলায় রোযার সময় গলির মোড়ে বরফ-অলা বসত। সরকারি কলোনিটা ছিল নিম্ন মধ্যবিত্তের বাস। দ্বিতীয় আর তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীরাই মূলত বাসিন্দা। রেফ্রিজারেটর তখনও এই শ্রেণীর মানুষের কাছে স্বপ্ন। তাই বরফওলার ব্যবসা মন্দ ছিল না। ইফতার এর ঘণ্টা দুয়েক আগ থেকে কেটে কেটে বরফ বিক্রি চলত। সেই বরফের ওপর সবসময় কয়েকটা মাছি নির্মোহের মতো বসে থাকত। ভিড়ে দাঁড়িয়েঅপেক্ষার পর কাগজে মোড়ানো এক টাকার বরফ নিয়ে ফেরার সময় মনে হত পৃথিবীর সব চাওয়াগুলো যেন হাতের মুঠোয়। ইফতারের সময় গাড় লাল রঙের রুহ আফজার সাথে কুচি বরফের চিন্তায় চোখ চকচক করত।

হালকা ভলিউমে লোকটা গান ছেড়ে দিল।

Why does it always rain on me?

Oh, where did the blue sky go?
Oh, and why is it raining so?
It's so cold, so cold
Why does it always rain on me?

৫।

‘ম্যথস এ বি প্লাস কেন?’ – স্পষ্ট হতাশা মুন্তাহার চোখে ‘কাল যখন পড়া ধরতে চাইলাম তখন তো খুব বললে যে সব পার’

“সব পারি তো, কিন্ত রিভিশন দিতে পারি নাই, দুইটা ভুল হয়ে গেছে”– রিশাদের মনোযোগ এখন কাস্টার্ড কেক এ।

“রিভিশন দিতে পার নাই না এমনিতেই দাও নাই? দিন দিন তোমার সিরিয়াসনেস্ কমে যাচ্ছে। বাবা এবার এলে তুমি সাথে করে চলে যেও। আমি আর পারব না”

“মা, বাবা কোন মাসে আসবে? ওখানে গেলে কি ক্লাস ফোর এ আবার পড়তে হবে?”

“বাবা আসবে জুলাইতে”– বালিশ টা ঝাড়া দিতে দিতে উত্তর দেয় মুন্তাহা

“নাহ্, আমি যাব না”

“কেন?”

কোন উত্তর না দিয়ে কেক এ পূর্ণ মনোযোগ দিল রিশাদ।

বাবা আসার আগের কয়েকটা দিন যেন কাটতেই চায়না রিশাদের। অনেক দুর থেকে ছোট বিন্দু হয়ে আসা ট্রেনের মত ধীরে ধীরে বড় হয়ে ওঠা ট্রেনটা তার সমস্ত প্রকট শব্দ আর ঝংকারে আছড়ে পড়েই পরমুহূর্তেই যেমন হুশ করে বেরিয়ে যায় পেছনে সব অনুরণন রেখে - হতচকিতের মত চেয়ে থাকে সে যাবার বেলায়। খারাপ লাগার অনুভূতিটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।

আচ্ছা, মানুষ বিদেশে যায় কেন? বাবাকে জিজ্ঞেস করলে খালি উল্টাপাল্টা দুষ্টুমি করে। নাহ, এবার খুব করে ধরে উত্তরটা জেনে নিতে হবে।

৬।

সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে। গত দুটো মাস যেন শেষই হচ্ছে না। প্রচণ্ড কাজের চাপ আর টেনশন। কর্পোরেট সি.ই.ও. নতুন এসেই নানান পরিবর্তন আনছেন। মূল মন্ত্র হলকনজারভেটিভ এপ্রোচ। খরচ কমাও, সে যেখান থেকেই হোক, ওয়াশরুমের লিকুইড সোপ এ কৃচ্ছতাসাধন থেকে শুরু করেনন-পারফর্মার কর্মচারী ছাঁটাই পর্যন্ত। এমনিতেই কোম্পানি চলছিল ন্যূনতম লোক দিয়ে, আর এখন তো কাহিল অবস্থা। তিনজনের কাজ দুজন করছে। প্রতিদিনই তাই অতিরিক্ত সময় দেয়া, সারাদিনের পরিশ্রমের পর ক্লান্তিতে বিছানায় পড়ে থাকা। মাঝরাতে উঠে কিছু একটা মুখে দেয়া। তারপর আর ঘুম আসতে চায় না। এ ঘর ও ঘর পায়চারি, রিমোট চেপে চ্যানেল গুলো বদলাতে থাকা নয়তো বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরানো। বারান্দা থেকে বড় হাইওয়ে টা দেখা যায়। শেষ রাতেও কিছু গাড়ী ছুটে চলে, ট্র্যাক থেকে ছিটকে পড়া পথহারানো পিঁপড়ের মত ছোটাছুটি করে দিগ্বিদিক। চূড়ান্ত মৌনতায় একদৃষ্টে চেয়ে থাকে নিয়ন বাতিরা।

একটু কি অস্বস্তি লাগছে আজ?হাল্কা ঘামছে লোকটা। এসি বাড়িয়ে দিয়ে শার্টের উপরের বোতাম খুলে দিল। সন্ধ্যে ধীরে ধীরে ব্ল্যাকহোলের মত শুষে নিচ্ছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আলোগুলো। বেশীরভাগ মানুষই ঘরমূখী এখন। মিট মিট করে জ্বলে উঠছে হাইওয়ে ধরে ছুটে চলা গাড়ীগুলোর লো-বীম। লোকটা বাঁ হাতে নিজেরটা জ্বালিয়ে নিতে চাইল। হাতটা কেমন অসাড় ঠেকছে। একটা হাল্কা চিনচিনে অনুভূতি বাঁ পাশে, সুঁই ফোটানোর মত। এসি কি ঠিকঠাক কাজ করছে না? অগুনিত বাতিগুলো কেমন যেন তীক্ষ্ণতা হারিয়ে ফেলে ধীরে ধীরে জলরঙ এর মতো লেপ্টে যাচ্ছে।

মাছি সেই একই অবস্থানে - নির্মোহ, উদাস।



লেখক পরিচিতি
মোহাম্মদ মাকশুমুল হক

জন্মস্থান - ঢাকা, বাংলাদেশ
জন্মসাল - ১৯৭৪
বর্তমান আবাসস্থল - আজমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত

পেশা - তথ্যপ্রযুক্তি
কোন শাখায় লিখার চেষ্টা করি - ছোট গল্প
ইমেইল - makshumul@yahoo.com



ফোন নং - ০০৯৭১৫০৯৬৫২১৪১

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

4 মন্তব্যসমূহ