ঝিনুক ভীষণ সেজেছে। অতিরিক্তই। রগ্রগে।
চেহারা এখনো প্রায় গুড়িয়া জাপান কী! ফুটফুটে রঙ। কুচকুচে চুল। চেরাচেরা চোখ।
পার্লারে বাঁধা ফাঁপা খোঁপায় মালা। জরিদার ঢাকাই জামদানি। বেশ দামী। খুব গাঢ় নীল। ডিপ্কাট্ লাল ব্লাউজেও জরি। মোম মোম পিঠ। কুন্দনের সেটটা ফ্যাশন জুয়েলারির। লাল-নীল মেলানো টিপ। সিঁদুর। কাজল লাইনার আইশ্যাডো ম্যাস্কারা। পুরো মেক ওভার। ঢেকে গেছে চোখ। ডার্ক সার্কেলস্। গালে ব্লাশারের গুঁড়ো। ঠোঁটে লাল গ্লস্।
--মাই গড্! কী সেজেছে ও? মানাচ্ছে?
--দেখেছি। কেমন একটা দেখাচ্ছে। এই বয়সে।
--আটির্ফিশিয়াল। আগে কিন্তু খুব সিম্পল্ থাকত।
--কে জানে? তবে যাই বলো, বয়স অতো দেখায় না।
এগুলো চেনা মন্তব্য। ছুঁয়ে দিয়ে ঠিকরে যাচ্ছে। ঝিনুকের খোলা হাত খোঁপায়। বা ভারী কানের দুলে। কিম্বা ঘাড়ের পেছনে হারের ট্যাসেলে। ব্লাউজের পিঠের নটে। ঝিনুক হাসছে। গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে।
শমির্লা আর রণজিতের এ্যানিভার্সারি, কুড়ি বছর হল। ঝিনুকের দূরতর তুতো দাদা আর বৌ। রণজিত ঝিনুকের পিঠোপিঠি। বছর দুই বড়। ঝিনুকের দু’বছর পরে এদের বিয়ে।
--এ্যাই রণ, কাল সকালে সব বলবি। মানে হ্যাণ্ডওয়ার্ক এটসেটরা। ওয়ার্ক এডুকশন ঠিক ছিল কি না জানাবি!
বৌভাতের রাত্তিরে শমির্লা নোতুন বৌ। টকটকে লাল। রণজিত কথা ঘোরাচ্ছিল,
--ঝাড় খাবি ঝিঙ্কু! আমার নাম ধরছিস্ বৌদির সামনে? ইডিয়ট! দাদা হই।
--না গাধা? ইয়েস্ ডিয়ার ডঙ্কি। জানো শর্মি, হাঁদাটা না কিচ্ছু জানতো না। আমাকে জিজ্ঞেস করে ক-রে! কিরে তাই না? বলবো?
আলগা দুষ্টুমি। মাথা দুলিয়ে হাসছিল। রণজিত পালাচ্ছিল। কারন ছিল। কারন ছিলই। ভরসা ছিল ঝিনুকটা পেট আলগা নয়। তবু-।
--কিরে রণ! রণে ভঙ্গ? আচ্ছা আচ্ছা বলছি না।
শমির্লার ভুরুতে ভয় সেদিন। সম্বন্ধের বিয়ে। ঝিনুক ঠিক ধরেছিল।
--হ্যাল্লো শর্মি, স্কেয়ারড্? আরে, এগুলো আমাদের কোড ওয়ার্ড। জাস্ট লেগ্ পুল্। আমার বিয়ের সময় বরের সামনে রণটা...! এটা রিভেঞ্জ। ভেবো না। আমাদের কোনো ইন্টুমিন্টু...।
হাসতে হাসতে লুটোপুটি। কী মিষ্টি। শমির্লা মস্ত দুটো চোখ মেলে দেখেছিল। বয়স্ক কেউ সামলে দিয়েছিলেন।
--নারে নাতবৌ, একটুও ভয় পাস্না। দুটোই ভারী বজ্জাত। অসভ্য। দেখা হলেই এরকম। কোনোটা কম না!
শমির্লা শান্ত। আটপৌরে। মফঃস্বলের কলেজে পড়তো। নয়তো অনার্স গ্র্যাজুয়েট সে-ও। কনভেন্টে পড়া ঝল্মলে ঝিনুক। ছিপছিপে। স্মার্ট। উচ্ছল। চুল উলটে লম্বা বেনীতে একটাই লাল গোলাপ। রুপোলি জরির বেবি পিংক বেনারসী। মুক্তোর সেট্। হালকা গোলাপী লিপস্টিক। ছোট্ট লাল টিপ। শমির্লার নিজেকে জবুথবু বয়স্ক মনে হচ্ছিল। শমির্লার বিয়ের এ্যালবামে গাদা গুচ্ছের ঝিনুকের ছবি। সরু ঝিকমিকে চোখ। কুটিকুটি সাজানো দাঁত - হী হী!
সেদিন তাকিয়েই ছিল শমির্লা। ঝিনুকের পেছনে নবারুণ। সিলভার স্ট্র্যাপের হাই হিল, তাও ডিঙ্গি মেরে দু’হাতে বরের গলা জড়িয়ে দু’গালে চুমু খেয়েছিল।
--শর্মি, আমার বর। দ্যাখো রিয়েল হ্যাণ্ডসাম। পারফেক্ট ‘টি-ডি-এচ্’। তোমারটার মতো আলুভেতে না! অনেক কষ্টে ধ্যান ভেঙেছি! নজর দিও না।
নবারুণ শান্ত। লম্বাটে মুখ। চোখে চশমা। তুখোড় নয়, বুদ্ধিমান। ধীমান। পরিশীলিত।
তার পর পালা পাবর্ণে কতবার! মানে যতবার কোলকাতায় আসা হয়েছে দু’পক্ষের।
ঝিনুক এমনটাই।
ঝিনুকের মুক্তোটা রামধনুর মতো। ভীষণ জ্বলজ্বলে।
আজও ঝিনুকের দিকে স্থির তাকিয়ে ছিল শমির্লা। ঝিনুক তার চোখে চোখ ফেলল না। বছর তিনের ছোট শমির্লা ভরভরন্ত। ঝিনুক যেন ইচ্ছে করেই মুখ ফিরিয়ে আছে। হাসি মেখেছে পুরু করে।
--ও ঝিঙ্কুপিসি, খেয়েছ গো? মা ডাকছে তোমায়।
রণর মেয়েটা রণর মতো। দেখতে। স্বভাবে শমির্লা। মনটা ঘুরে গিয়েছিল। আনচান। তাড়াতাড়ি বলেছিল,
--হ্যাঁরে হ্যাঁ, যাচ্ছি! কতটুকু খাই? আমি অলওয়েজ্ অন্ ডায়েট সোনা। মেনটেন করি কেমন? বল্। বুড়ি বুড়ি দেখায় আমাকে?
আবার হেসে কুটিপাটি ঝিনুক। চোখ প্রায় দেখা যায় না। সতেরো বছরের হিয়া দু’হাতে জড়িয়ে ধরেছিল।
--সো সুইট ঝিঙ্কুপিসি। আমিও ট্রাই করি তোমার মতো? মা-টা তো অলরেডি নরম বাটার নান্। কত্তো বলি। আমিও, বাপিও। শোনেই না! চ-লো।
হিংসে হল বুঝি ঝিনুক? কুটকুট করল নাকি? বুকের ভেতরটা? ছটফটানি? চোখের পাতা ভিজলে ওয়াটার-প্রুফ কাজলও গাল বেয়ে...।
ঝিনুক বরং হাসল। তৈরি।
--যাচ্ছি ডিয়ার। জাস্ট একটু-।
--ঝিনুককে দেখছি না যে শর্মি?
--হিয়া তো ডেকে এলো এই মাত্তর। আসছি- বলে কোন্দিকে আবার!
--নবারুণদা’? নবারুণদা’র খাওয়া হয়েছে?
শমির্লা চুপ। রণজিত এতক্ষণ কোথায় ব্যস্ত ছিল? খেতে বসে মনে পড়ল? শমির্লা তার দিকে একবার তাকাল শুধু।
--দেখে আসছি।
শমির্লা হোমমেকার। লক্ষ্মীমন্ত বৌ। স্বামী কন্যায় পূতপবিত্র জড়িয়ে মড়িয়ে। খুব মায়াদয়া শরীরে। সবার জন্যে ভাবে। রণজিত বোঝে খুব অন্তর থেকে। শমির্লা টেবিলে বসা সকলকে জনে জনে অনুরোধ করে গেল,
--ঠিক করে খেও। আমি আসব এক্ষুণি।
ক্যাটারার বেশ নামী দামী। তবু বারবার বলে গেল,
--একটু দেখে দেখে দেবেন। জিজ্ঞেস করে করে।
যত দায় শমির্লার। যত দায়িত্ব তার একার। তুতে-সাদায় নোতুন ভারী ইক্কতটা সামলাতে সামলাতে সে কোণার ঘরে। ওখানে তার শাশুড়ি বয়ষ্কাদের আসরের মধ্যমণি। ভারি মডার্ণ মহিলা। খালি প্লেটগুলো মেঝেতে। খাওয়া শেষ। আইসক্রিমের কাঠি চুষছেন কেউ কেউ। একপাশে উপহারের পাহাড়।
--মা, ঝিনুক এসেছে এদিকে? খায়নি এখনো ওরা।
--সে কী! না শর্মিলা। এখানে আসেনি তো।
একদিনের জন্যে ভাড়া নেওয়া বাড়ির কোন্দিকে কী, কি করে জানে শমির্লা? অন্ধের মতো হাতড়াতে হাতড়াতে পেছনের ঘুপচি ব্যালকনিতে। অতিথিদের নজরে পড়ার কথাই না। প্ল্যাস্টিকের চেয়ার ডাঁই করে রাখা। বাড়তিগুলো।
মুখোমুখি চেয়ারে নবারুণ আর ঝিনুক।
নবারুণের গলা কান মাথায় জড়ানো সাদা মাফলার খোলা। মুখের অন্ধকার পাশটা বাইরের দিকে। ঝিনুকের হাতে বাটি চামচ প্লেট। স্যুপ অথবা চটকানো সবজি-ভাত। বাড়ি থেকে আনা! শমির্লা দরজার মুখে। কেমন করুণ করে তাকিয়ে ছিল,
--আমি করে দিতাম পারতাম না ওটুকুন? তুমি বারে বারে বললে দরকার নেই। তোমার দাদাও তো...!
গলায় কান্না ঝুলছিল শর্মিলার। হাতের প্লেট সামনের চেয়ারে নামিয়ে তড়াক্ ঝিনুক,
--এইরে! না না, দরকার ছিল না সত্যি। তাই বলি নি। আরে জানোই তো, স্পেশাল লোকেদের স্পেশাল খাদ্য। এই হয়ে এসছে। যাচ্ছি আমি। কিচ্ছু হয়নি... যাও, স্টার্ট করে দাও লক্ষীসোনা- প্লিজ্।
দু’হাতে শর্মিলার গলা জড়িয়ে ঝিনুক। খুব কাছাকাছি মুখ। চোখ। অনগর্ল হেসে যাচ্ছে। ছোট্টোছোট্টো দাঁত।
হাসি সবটাই?
আলো আঁধারিতে দেখতে না চাওয়াটা চোখে পড়ে যায় কেন? শমির্লা দেখে ফেলে! পড়ে। শিউরে ওঠে।
--কী গো? শর্মি?
--উঁহুঃ। কিছু না।
রাস্তার সাদা ত্রিফলা আলোগুলো বিচ্ছিরি ম্যাটম্যাটে হলুদ। ঝুলপড়া কালচে দেওয়ালটায় টিকটিকি এক কোণা থেকে অন্য কোণায় লাফ মারছে।
গাড়িতে তুলে দিচ্ছিল ঝিনুকদের। ঝিনুক একেবারে হাতটাত জোড় করে,
--শোনো, এবার যখন কোলকাতায় আসবে, আমাদের পাড়ায় এসো। গিফট্টা খুলে দেখো। পছন্দ কিনা জানিও। খুব আনন্দ করলাম। আর শোনো, তিন বছর আমাদের হুঁহুঁ - সিলভার... আসবিই আসবি। এখন থেকেই বলছি। হিয়া তোর বয়ফ্রেণ্ডের সঙ্গে ইনট্রোডিউস্ করাবি তখন। ইয়াং পিসি, হিংসে করিস না যেন!
শমির্লা নীরব। এতো কথা? পাতলা ব্যাণ্ডেজে কত রক্ত পড়া বন্ধ করা যায়!
--ঝিনুক! এবার চলো।
নবারুণের আওয়াজ বোঝা যায় না চট্ করে।
রণজিত কষ্ট পাচ্ছিল। ইজ্ শী নমার্ল?
বেহালা চৌরাস্তা ধরে খানিকটা ভেতরে পৈতৃক ভিটেতে নবারুণ বছর দুই হল। অফিসের গাড়িতে অফিসে অনিয়মিত হাজিরা। ঝিনুক বাগানে বসে গুটিকয়েক গরীব বাচ্চাকে ধরে বেঁধে লেখাপড়া শেখায়। নাচ-টাচ। অনেকবার নবারুণ বলেছে,
--এখন তো ঠিক আছি। কোথাও জয়েন করো আবার। কি করবে সারাদিন? ঘরে বসে মরোজ্ লাগবে। ডিপ্রেশন হবে!
--ম-রো-জ্! হায় কত্তা। খালি বাজে বকা। ভল্যান্টরি নিলাম কেন বুঝেছ? এনজয়মেন্ট, মেরিমেন্ট... তুমি কাজের লোক সেসব বুঝবে না।
নবারুণ নিঃশ্বাস ফেলে। তা হলে যা খুশি।
--আমারও অনেক কাজ থাকবে স্যার। হাউজ্ওয়াইফ্ না? নোতুন রোল! হী হী।
দুমদাম এগিয়ে এসে বরের গলা জড়িয়ে ধরে। চুমু খেতে ঠোঁট উঁচু করে। হঠাত থামে। হাসে।
--ধ্যা-ত্! বুড়ো বয়সে...। তুমি তো আবার আমার চেয়ে ছ’বছরের বড়ো। লজ্জার কথা।
উথলে ওঠা দুই সুগোল বাঁজা স্তনে নবারুণের হাত। আস্তে আস্তে পিঠে। শিরদাঁড়ায়। কোমর বেয়ে নামে। আঁটসাঁট পাছায়। ঝিনুকের মোমপালিশ দু’হাতে বিনবিনে কাঁটা ধরে। ঊরুর লুকোনো খাঁজ সামান্য ভিজে। এখনো তার ঋতু নিয়মিত। মেনোপজের লক্ষণ নেই। ঝিনুক বাধা দেয় না। জানে কতটা কী! উলটে বলে,
--এ্যাই! ছীঃ... বুড়ো হয়েছি না আমরা?
নবারুণের মস্ত টোল খাওয়া বাঁদিকের গাল। গভীর কাটা দাগ। ভেঙে পড়ে ঝিনুকের কাঁধের ওপরে। চোখ থেকে অনিয়ন্ত্রিত জল গড়াতেই থাকে। ঝিনুকের গলা ভেজে। কাঁধ ভেজে। ম্যাক্সির পিঠ ভেজে। ঝিনুক হাসতে হাসতে তাকে সোজা করে বসায়। কপালে ঘন চুমু খায়। আলতো করে বালিশে শুয়ে দেয়।
--আ রে! ছী ছী। বোকা ছেলেটা। আমার বুড়োটা-
মুখের সামনে দাড়ি কামানো ছোট্ট সুন্দর আয়না ধরে।
--দেখো তো, কত চুল হয়েছে মাথা ভরে। সল্ট এন পেপর স্টাইল। ভালো আছো তো এখন। মন খারাপ কেন? শুয়ে থাকো একটু। আসি স্নান সেরে... তার পর একসাথে খাবো।
ছড়ানো বাড়িটার নিজর্ন একদিকে ঝিনুকের বাথরুম। পেয়ারা গাছ দুললে জানালার কাঁচে দেখা যায়। পাখিগুলো ডাকে। বৃষ্টির ঝমঝম এ্যাস্বেস্টসের উঁচু চালে। ঝিনুকের শ্বশুরমাশাই করে দিয়ে গেছেন। মেঝে মাবের্লের। দেওয়ালে লম্বা আয়না। শাওয়ার। ঠাণ্ডা গরম জল। তেল সাবান টুকিটাকি রাখার ছোটো আলমারি। এলাহি। শুধু বাথটাব হয়নি। প্রায় পঁয়তাল্লিশে একমাত্র ছেলে। তার বৌ। ঝিনুকও খুব ভালোবাসত।
--আমার বাবা-মণি।
--হ্যাঁ মা... বলো মা! আমার নটি প্রিটি গার্ল।
শাশুড়িও ভালো ছিলেন। স্নিগ্ধ। মা-মা। নবারুণ স্বভাবে মায়ের মতো। দুই ননদ অনেক বড়। বাপের বাড়ি শিলচরে যাওয়াই হতোনা। মা অভিমান। দাদা-বৌদি অনুযোগ।
ঝিনুক পায়ের নীচে খসিয়ে দিল টুপটাপ। ম্যাক্সি, শায়া, ব্রেসিয়ার। তুলে ছোটো বালতিতে রাখল। মাথা ঝাঁকিয়ে খুলে দিল খোঁপা। আয়নাটা কি সত্যি বলে? ঝিনুক একই আছে? চব্বিশে আর ছেচল্লিশে? উঁহু। বেশ তফাত। রাজহাঁস গলা একটু মোটা। ব্রেসিয়ার দু’সাইজ বড়ো। তলপেটে মাখোমাখো মেদ। বাইরের লোক কতটা বোঝে? দু’হাত লম্বা করে ওপরে তোলে। এমনিই লোম কম। আজকাল ওয়্যাক্সিং করে টরে আরো...। ঝিনুক নিজেকে দেখে।
--ঠিক আছি একদম। পারফেক্ট্। তাই না? তাই না?
বলতে বলতে তার দমকে কান্না পায়। প্রচণ্ড। রোধহীন। কাঁদতে কাঁদতে শ্যাম্পু নেয়। হাতে ঢালে। শাওয়ার খোলে। কালো লম্বা নরম চুল ভরে শ্যাম্পুর ফেনা। চোখ বেয়ে ফেনা। ঝিনুক কাঁদে। আওয়াজ করে। শব্দ করে। হাউহাউ করে। ফেনা, নোন্তা জল, সব ধুয়ে নেয় জল। শাওয়ারের জল কাঠি কাঠি বরফ হয়ে জমে থাকে।
নবারুন জিজ্ঞেস করে,
--এতোক্ষণ বাথরুমে? চান? ঠাণ্ডা লেগে যাবে না?
--আর বোলো না, চোখে সাবান ঢুকে যা তা কাণ্ড! যাচ্ছিলই না।
ঝিনুক পেছন ফিরে আলগোছে কাচা শাড়ি পরে। গা খালি। মাথায় সিঁদুর ছোয়ায়। সোনা-মোড়ানো নোয়াতেও। হাসিতে চোখ ছোট হয়ে আসে,
--আর একটু। আসছি। ঠাকুরের ফুল জল দিয়েই।
--এই তুমি আজকাল এতো কম খাচ্ছো কেন গো? বলবান্?
ঝিনুক নিরীক্ষণ করে। একটু বকাবকিও,
--কত রোগা দেখাচ্ছে, জানো! জিমটাও ছেড়ে দিলে, ‘ভাল্লাগে না, টায়ার্ড্’-- বলে বলে। ফাঁকিবাজি?
--বুঝলে ঝিঙ্কু, বাঁ গালের ভেতরটায় এমন একটা জট ঠোস্...। নাম্ব্। বাট্, খাবার লাগলেই...!
--কই দেখি?
ঝিনুক উঠে দাঁড়িয়ে টর্চ ফেলে মুখের মধ্যে।
--নাঃ! কই? দেখতে পাচ্ছি না।
সরু আঙুলটা ঢুকিয়ে দেয় নবারুণের মুখে।
--এই দিকে? নাতো। ধুত্। মনের ভুল। হবে না? যা ঝগড়া করো আমার সাথে। ঠিক আছে, ডক্টর গুপ্তকে একবার...।
তারপর ডেন্টিস্ট। তারপর ওষুধ। মাউথওয়াশ। তারপর অঙ্কোলজিস্ট। তারপর টেস্ট। তারপর বায়োপ্সি।
--ইয়েস্ ম্যাডাম। ইটস্ ম্যালিগন্যান্ট।
--কী যা তা বলছেন? দিব্যি সুস্থ লোক! পুঁচ্কে ফুস্কুরি-! আপনারা না সত্যি, ভয় দেখান।
ঝিনুক হেসে অস্থির। ডাক্তার অবাক্। অসন্তুষ্টও।
--বী সিরিয়াস ম্যাডাম। এ্যাডভান্সড্। সার্জারি করতে হবে এ্যাজ্ সুন্ এ্যাজ্ পসিব্ল্। আরো স্প্রেড করে গেলে... নাউ ইয়োর চয়েস্।
--ওক্কে, মানে আপনি যখন বলছেন।
গোটা গোটা রাত্তিরগুলো কবে থেকে ঝিঁঝিঁ-ডাকা হয়ে গেল, ঝিনুক খেয়াল করতে পারে না। ডাক্তার বলেছেন রোগীকে জানিয়ে দিতে। বলুক গে যার খুশি। আশ্চর্য, এটাও ঝিনুকের দায় না কি? নবারুণের চেহারাটা কি দেখেন নি ডাক্তার? অত বড়ো পাঁচফিট এগারো... শুধু লিক্যুয়িডে। আচ্ছা তো!
রক্ত, কাটা, ছেঁড়া কোনোটা কাউকে বুঝি দেখাতে যাস্ ঝিনুক! চোখের পাশের অন্ধকারটাও! না না। প্রমিস্? প্রমিস্।
সার্জারির দিন শিলচর থেকে মা, দাদা। বন্ধু, অফিস কলিগ। শমির্লা রণজিত। আরো সব। ভিজিটার্স রুমে তাদের লোকেই ভর্তি। অপেক্ষা না প্রতীক্ষা।
এক সময়ে সিস্টার এসেছিল।
--পেশেণ্টকে বেডে দেওয়া হয়েছে। কে কে যাবেন যেতে পারেন।
ঝিনুক নীল ফুলফুল কামিজ পরা। সাদা সালোয়ার। মেরুন লিপস্টিক্। নীল নেলপলিশ। হাতের কার্ডদুটো হাওয়ায় নাচাচ্ছিল।
--কে যাবে আমার সাথে? দুটো কার্ড। আসবে দাদা?
সকলে মুখ চাওয়া চাওয়ি। রণজিত বলেছিল,
--চল্ ঝিঙ্কু।
বেডে শোয়া গাল কান মাথায় ব্যাণ্ডেজ জড়ানো। অচৈতন্য। নবারুণ নাকি ও! স্যালাইন। ড্রিপ। মাথাটা চরকি দিয়ে উঠেছিল রণজিতের। দেওয়াল ধরে সামলাল। ঝিনুক কড়া চোখে দেখল। রাগী রাগী গলা,
--এ্যাই হাঁদা, তুই নীচে যা তোর কার্ড নিয়ে। আমি আছি।
ঝিনুক আছে। ঠায়। কত দিন। কী কেমো, কী রেডিয়েশন, কী ওষুধপত্র। পর পর। ঝিনুক আছে। ঝিনুক রোজ। সকাল দুপুর বিকেল রাত্তির। চৌরাস্তা থেকে ঠাকুরপুকুর। ছুট্টে যায়। ছুট্টে আসে।
ঝিনুক খেয়েছিস? আরে ডায়েটিং। হী হী।
ঝিনুক স্নান? হ্যাঁ হ্যাঁ, নোতুন সাবান খুলেছি।
ঝিনুক কাজল? হুঁ, পারমানেন্টলিই।
ব্যাণ্ডেজ খোলা হল একদিন। গালে গভীর কাটা। ক্ষত সারে নি। ডায়াবেটিক। সব মিলিয়ে জটিল। নল দিয়ে খাবার। ড্রেসিং করে নার্স। রক্তমাখা তুলো ফেলে গামলায়। ঝিনুক পাশে থাকে। দেখে।
--সিস্টার!
--বলুন ম্যাডাম?
--না, এমনিই।
সিস্টার ব্যাণ্ডেজ খোলে। তুলো দিয়ে পরিষ্কার করে। নোতুন করে বাঁধে।
--কবে রিলিজ্? মানে আর কতো...?
--স্যারের সঙ্গে আপনি একবার-।
কতোদিন পরে স্টুটা খুব আস্তে আস্তে খাওয়ায় ঝিনুক।
--কেমন? ভালো হয়েছে? চিকেনটা ভালো পেলাম। আমিই রেঁধেছি। মঞ্জু পারত না।
অফিসে জয়েন করল নবারুণ। ঝিনুক রিজাইন করল। গালের দাগটা গাঢ়। মুখ বেঁকে যায়। কথা বোঝা যায় না। হাজারটা নিয়ম। লাখো রেস্ট্রিকশন।
--স্পিচ্ থেরাপি করতে হবে। ফিজিও-।
--হ্যাঁ, শিয়োর ডক্টর। ঠিক হয়ে যাবে নিশ্চয়ই।
--ডোন্ট ওয়ারি। আশা রাখুন। চীয়ারফুল রাখবেন। কথা বলাবেন। খাওয়াদাওয়া লক্ষ্য রাখুন।
--থ্যাঙ্কস্ ডক্টর।
লাভ হয়েছে। খানিকটা। নবারুণ অবশ্য এমনিতেই কম কথার লোক।
ঝিনুকরা আজকাল সব জায়গায় যায়। যে কোনো অনুষ্ঠানে। পিকনিকে। পার্টিতে। সঙ্গে নবারুণের খাবার। নবারুনের সাদা মাফ্লার।
--দেখেছো? হী ইজ্ এ ক্যান্সার পেশেন্ট!
--কী বলছো? হিজ্ ওয়াইফ!? সো ডেকড্ আপ্?
--এই অবস্থায় কি করে পারে গো? এরা না, যাকে বলে হৃদয়হীন।
--কথায় কথায় হাসে দেখো। হেসে গড়ায়। যেন কিচ্ছু ব্যাপার না।
--পাগল না কি গো?
অনেক কিছু বলার থাকে। চেপে যায়। মুখ বন্ধ রাখে। মহিলারা বলে বেশি। পুরুষেরা কম।
--শী হ্যাজ্ গাট্স্। খুব মনের জোর। বাট্-!
গাড়িটা গ্যারাজ করে চলে গেছে সুখেন। পাটর্টাইম ড্রাইভার। কাছেই থাকে কোথাও। ছড়ানো বাড়িটা খাঁখাঁ। নিঃঝুম। বড় বাগান। ওখানে টিনের ঘরে মঞ্জু থাকে। ওর বর কাতির্ক। কাতির্ক বাগান দেখে শোনে। কলাপ্সিবল গেটে তালা মেরে ঘরে আসে ঝিনুক। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে নবারুণের। চোখের পাতায় ভার। ঝিনুকেরও কি নয়? বিছানা টানটান করে পেতে রেখে গিয়েছিল বেরোনর আগেই। লাল টকটকে মেঝে। লম্বা জানালা। হলুদ গরাদ। বড় বড় খড়খড়িওয়ালা জানালা। সব বন্ধ। ঝিনুক এসি অন্ করে।
--তুমি আজ বেশ সেজেছিলে কিন্তু।
খুব আস্তে জড়িয়ে জড়িয়ে বলল নবারুণ।
--ওমা এতোক্ষণে বলছো?
আধ ছটাক অভিমান। এক পোয়া হাসি। দেড় পোয়া খুশি। কতটা নকল? পুরোটাই? নবারুণ চশমাটা খুলে রেখে চোখ ডলে।
--শোও। শুয়ে পড়ো। এসি আর একটু কমাবো না ঠিক আছে?
গুন্গুন্ করে ঝিনুক। রবীন্দ্রসঙ্গীত। ‘আমারে যে জাগতে হবে... কী জানি সে...’। ফুলের গন্ধ পারফ্যুমের গন্ধ ম’ম’। খোঁপার মোটা জুঁইয়ের মালাটা বাটিতে ভিজিয়ে রাখে। জামাকাপড় ভাঁজ করে তোলে। আয়নার ঠিক ওপরে ছোট্ট আলো জ্বালে। স্মাড্জ্-ফ্রি চোখের সাজ! হুঁহ্। লেবড়ে ধেবড়ে পেতনির মতো। তুলোয় ক্লেনজার দিয়ে ডলতেই থাকে। রগড়ে রগড়ে চোখ জ্বালা করে।
ঘর জুড়িয়ে এসেছে। ঝিনুক এসির কথা ভুলে কোণার দিকের জানালা খুলে দিয়ে দাঁড়ায়। সজনে গাছে ফুলের টুনি বালব। চকচক করছে গাছটা। ত্রয়োদশীর চাঁদ আকাশে। আলোর জলসা।
--ঝিঙ্কু! একবার কি মুম্বই...?
শোনাই যায় না। অন্ধকার আর অন্ধকারের আড়াল।
--ওকী, ঘুমোও নি? আমি ভাবলাম-! ঈস্ ঘুমের ওষুধটা দিতেই যে.. দাঁড়াও নিয়ে আসি।
গ্লাসে জল। হাতে ওষুধ। ঝিনুক হাসি হাসি। ঘেঁষে বসে।
--শোনো না! না বলবে নাতো?
--হুঁ!? ওরা বেশ ধুমধাম করেছিল।
--সেটাই তো বলছি... আর তিন বছর পরে আমরা আরো বেশি ধুমধাম-। এই, খুব সাজবো জানো? বুড়ি হলে কি হয়েছে? এখনো সবাই সুন্দরী বলে। বলে কি না? সেই যে মা’র কড়িয়াল বেনারসীটা... যেটা আমায় দিয়েছিলেন? মনে আছে? লাল জরিপাড়। ঘিয়ে রঙ। সোনালি বুটিতে ভর্তি। কী গজার্স্!
নবারুণ কিচ্ছু বলে না। একটা হ্যাঁ-হুঁও না। তাকিয়ে থাকে। ঝিনুকের চোখে।
একটা না একটা অনুষ্ঠান তো হবেই ঝিনুক! ছোটো বা বড়ো। কারণ যাই হোক্-।
--মুম্বাই যাবে ঝিঙ্কু? একটা শেষ কিছু...।
--কী গো বোকার মতো তাকিয়ে আছো? বলো? এখন তো খরচ যাচ্ছে। নোতুন আর কিনে কি হবে? ওটা তো প্রায় নোতুন।
অন্ধকার ঘরে দুজনেই প্রায় আবছা। বাইরের অসমান আলোটুকু সম্বল। ঘুম আসছে কি নবারুণের? সে অনেক ভালো আছে ইদানিং। তবু-! একটু খচখচ আবারো। মুখের মধ্যেটা থম্ মেরে যায় হঠাত। সাড়হীন। বিস্বাদ লাগে। হয়তো এমনিই। হয়তো ভয়ের থেকেই। মানসিক সবটাই। হতেও পারে। ডাক্তারকেও জানায় নি। ডাক্তার কিছু নিদান দিয়েছেন? না না।
আরো তিন বছর? আরো তিন? আরো? আর মুম্বই গেলে?
ঝিঙ্কু, শপিংমলে সেই শোরুমের কাঁচের দরজাটা কেমন ভেঙে গিয়েছিল মনে আছে? চুরচুর? কিন্তু মাটিতে পড়ে নি। কারনটা তুমি জানতে চাইছিলে। ল্যামিনেটেড্ কাঁচ ছিল। জালি জালি ফাটাগুলো বাইরে থেকে চোখে পড়ছিল। আজকাল ঘরেই দেখতে পাই। রোজ। অনেকবার করে।
সজনে ফুলের সঙ্গে আর কিসের গন্ধ আসছে। পাচ্ছে ঝিনুক। জানালাটা বন্ধ করতে ভুলে গেছে। পাতাগুলো খুলে যাচ্ছে একটার পর একটা। ঝিনুক অন্যদিকে পাশ ফিরে শোয়। বুকের মধ্যে রক্তের ঢেউ। স্রোতের বেগে গলগল করে আসছে। পার হয়ে যাচ্ছে। এরকম বছরের পর বছর! মুক্তোটার গায়ে প্রচুর শ্যাওলা। জমেই চলেছে। ঠাস্ঠাস্ করে জানালার পাল্লা খোলে বন্ধ হয়। খোলে কেন? ঝিনুক একেবারে চায়না। বড্ড ক্লান্ত। আধখানা চোখ মেলে নিজের হাতের তালু দেখে। আয়ুরেখা - টানা লম্বা গভীর।
ঝিঙ্কু!
ঝিঙ্কু হাসছিস্ বুঝি?
ঝিঙ্কু, সব্বাইকে বুদ্ধুরাম ভাবিস্?
ঝিঙ্কু, এতো নিখুঁত কেমন করে রে?
ঝিঙ্কু, বাইশ বছর ফুড়ুত! একসঙ্গে থাকাই যে হল না?
মেটে হলুদ টিমটিমে রাতবাতির নীচে হয়তো জল গড়িয়ে বালিশ ভেজে। ওদের ঘুম আসে। সজনে ফুল, নিম ফল, কাঁঠালি চাঁপা, পেয়ারা পাতা, আমের মুকুলের গন্ধের সাথে ওদের গায়ের গন্ধ মিশে থাকে। জবুথবু জড়োসড়ো হয়ে থাকে অনিশ্চিত নিশুতি রাত্তির।
চেহারা এখনো প্রায় গুড়িয়া জাপান কী! ফুটফুটে রঙ। কুচকুচে চুল। চেরাচেরা চোখ।
পার্লারে বাঁধা ফাঁপা খোঁপায় মালা। জরিদার ঢাকাই জামদানি। বেশ দামী। খুব গাঢ় নীল। ডিপ্কাট্ লাল ব্লাউজেও জরি। মোম মোম পিঠ। কুন্দনের সেটটা ফ্যাশন জুয়েলারির। লাল-নীল মেলানো টিপ। সিঁদুর। কাজল লাইনার আইশ্যাডো ম্যাস্কারা। পুরো মেক ওভার। ঢেকে গেছে চোখ। ডার্ক সার্কেলস্। গালে ব্লাশারের গুঁড়ো। ঠোঁটে লাল গ্লস্।
--মাই গড্! কী সেজেছে ও? মানাচ্ছে?
--দেখেছি। কেমন একটা দেখাচ্ছে। এই বয়সে।
--আটির্ফিশিয়াল। আগে কিন্তু খুব সিম্পল্ থাকত।
--কে জানে? তবে যাই বলো, বয়স অতো দেখায় না।
এগুলো চেনা মন্তব্য। ছুঁয়ে দিয়ে ঠিকরে যাচ্ছে। ঝিনুকের খোলা হাত খোঁপায়। বা ভারী কানের দুলে। কিম্বা ঘাড়ের পেছনে হারের ট্যাসেলে। ব্লাউজের পিঠের নটে। ঝিনুক হাসছে। গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে।
শমির্লা আর রণজিতের এ্যানিভার্সারি, কুড়ি বছর হল। ঝিনুকের দূরতর তুতো দাদা আর বৌ। রণজিত ঝিনুকের পিঠোপিঠি। বছর দুই বড়। ঝিনুকের দু’বছর পরে এদের বিয়ে।
--এ্যাই রণ, কাল সকালে সব বলবি। মানে হ্যাণ্ডওয়ার্ক এটসেটরা। ওয়ার্ক এডুকশন ঠিক ছিল কি না জানাবি!
বৌভাতের রাত্তিরে শমির্লা নোতুন বৌ। টকটকে লাল। রণজিত কথা ঘোরাচ্ছিল,
--ঝাড় খাবি ঝিঙ্কু! আমার নাম ধরছিস্ বৌদির সামনে? ইডিয়ট! দাদা হই।
--না গাধা? ইয়েস্ ডিয়ার ডঙ্কি। জানো শর্মি, হাঁদাটা না কিচ্ছু জানতো না। আমাকে জিজ্ঞেস করে ক-রে! কিরে তাই না? বলবো?
আলগা দুষ্টুমি। মাথা দুলিয়ে হাসছিল। রণজিত পালাচ্ছিল। কারন ছিল। কারন ছিলই। ভরসা ছিল ঝিনুকটা পেট আলগা নয়। তবু-।
--কিরে রণ! রণে ভঙ্গ? আচ্ছা আচ্ছা বলছি না।
শমির্লার ভুরুতে ভয় সেদিন। সম্বন্ধের বিয়ে। ঝিনুক ঠিক ধরেছিল।
--হ্যাল্লো শর্মি, স্কেয়ারড্? আরে, এগুলো আমাদের কোড ওয়ার্ড। জাস্ট লেগ্ পুল্। আমার বিয়ের সময় বরের সামনে রণটা...! এটা রিভেঞ্জ। ভেবো না। আমাদের কোনো ইন্টুমিন্টু...।
হাসতে হাসতে লুটোপুটি। কী মিষ্টি। শমির্লা মস্ত দুটো চোখ মেলে দেখেছিল। বয়স্ক কেউ সামলে দিয়েছিলেন।
--নারে নাতবৌ, একটুও ভয় পাস্না। দুটোই ভারী বজ্জাত। অসভ্য। দেখা হলেই এরকম। কোনোটা কম না!
শমির্লা শান্ত। আটপৌরে। মফঃস্বলের কলেজে পড়তো। নয়তো অনার্স গ্র্যাজুয়েট সে-ও। কনভেন্টে পড়া ঝল্মলে ঝিনুক। ছিপছিপে। স্মার্ট। উচ্ছল। চুল উলটে লম্বা বেনীতে একটাই লাল গোলাপ। রুপোলি জরির বেবি পিংক বেনারসী। মুক্তোর সেট্। হালকা গোলাপী লিপস্টিক। ছোট্ট লাল টিপ। শমির্লার নিজেকে জবুথবু বয়স্ক মনে হচ্ছিল। শমির্লার বিয়ের এ্যালবামে গাদা গুচ্ছের ঝিনুকের ছবি। সরু ঝিকমিকে চোখ। কুটিকুটি সাজানো দাঁত - হী হী!
সেদিন তাকিয়েই ছিল শমির্লা। ঝিনুকের পেছনে নবারুণ। সিলভার স্ট্র্যাপের হাই হিল, তাও ডিঙ্গি মেরে দু’হাতে বরের গলা জড়িয়ে দু’গালে চুমু খেয়েছিল।
--শর্মি, আমার বর। দ্যাখো রিয়েল হ্যাণ্ডসাম। পারফেক্ট ‘টি-ডি-এচ্’। তোমারটার মতো আলুভেতে না! অনেক কষ্টে ধ্যান ভেঙেছি! নজর দিও না।
নবারুণ শান্ত। লম্বাটে মুখ। চোখে চশমা। তুখোড় নয়, বুদ্ধিমান। ধীমান। পরিশীলিত।
তার পর পালা পাবর্ণে কতবার! মানে যতবার কোলকাতায় আসা হয়েছে দু’পক্ষের।
ঝিনুক এমনটাই।
ঝিনুকের মুক্তোটা রামধনুর মতো। ভীষণ জ্বলজ্বলে।
আজও ঝিনুকের দিকে স্থির তাকিয়ে ছিল শমির্লা। ঝিনুক তার চোখে চোখ ফেলল না। বছর তিনের ছোট শমির্লা ভরভরন্ত। ঝিনুক যেন ইচ্ছে করেই মুখ ফিরিয়ে আছে। হাসি মেখেছে পুরু করে।
--ও ঝিঙ্কুপিসি, খেয়েছ গো? মা ডাকছে তোমায়।
রণর মেয়েটা রণর মতো। দেখতে। স্বভাবে শমির্লা। মনটা ঘুরে গিয়েছিল। আনচান। তাড়াতাড়ি বলেছিল,
--হ্যাঁরে হ্যাঁ, যাচ্ছি! কতটুকু খাই? আমি অলওয়েজ্ অন্ ডায়েট সোনা। মেনটেন করি কেমন? বল্। বুড়ি বুড়ি দেখায় আমাকে?
আবার হেসে কুটিপাটি ঝিনুক। চোখ প্রায় দেখা যায় না। সতেরো বছরের হিয়া দু’হাতে জড়িয়ে ধরেছিল।
--সো সুইট ঝিঙ্কুপিসি। আমিও ট্রাই করি তোমার মতো? মা-টা তো অলরেডি নরম বাটার নান্। কত্তো বলি। আমিও, বাপিও। শোনেই না! চ-লো।
হিংসে হল বুঝি ঝিনুক? কুটকুট করল নাকি? বুকের ভেতরটা? ছটফটানি? চোখের পাতা ভিজলে ওয়াটার-প্রুফ কাজলও গাল বেয়ে...।
ঝিনুক বরং হাসল। তৈরি।
--যাচ্ছি ডিয়ার। জাস্ট একটু-।
--ঝিনুককে দেখছি না যে শর্মি?
--হিয়া তো ডেকে এলো এই মাত্তর। আসছি- বলে কোন্দিকে আবার!
--নবারুণদা’? নবারুণদা’র খাওয়া হয়েছে?
শমির্লা চুপ। রণজিত এতক্ষণ কোথায় ব্যস্ত ছিল? খেতে বসে মনে পড়ল? শমির্লা তার দিকে একবার তাকাল শুধু।
--দেখে আসছি।
শমির্লা হোমমেকার। লক্ষ্মীমন্ত বৌ। স্বামী কন্যায় পূতপবিত্র জড়িয়ে মড়িয়ে। খুব মায়াদয়া শরীরে। সবার জন্যে ভাবে। রণজিত বোঝে খুব অন্তর থেকে। শমির্লা টেবিলে বসা সকলকে জনে জনে অনুরোধ করে গেল,
--ঠিক করে খেও। আমি আসব এক্ষুণি।
ক্যাটারার বেশ নামী দামী। তবু বারবার বলে গেল,
--একটু দেখে দেখে দেবেন। জিজ্ঞেস করে করে।
যত দায় শমির্লার। যত দায়িত্ব তার একার। তুতে-সাদায় নোতুন ভারী ইক্কতটা সামলাতে সামলাতে সে কোণার ঘরে। ওখানে তার শাশুড়ি বয়ষ্কাদের আসরের মধ্যমণি। ভারি মডার্ণ মহিলা। খালি প্লেটগুলো মেঝেতে। খাওয়া শেষ। আইসক্রিমের কাঠি চুষছেন কেউ কেউ। একপাশে উপহারের পাহাড়।
--মা, ঝিনুক এসেছে এদিকে? খায়নি এখনো ওরা।
--সে কী! না শর্মিলা। এখানে আসেনি তো।
একদিনের জন্যে ভাড়া নেওয়া বাড়ির কোন্দিকে কী, কি করে জানে শমির্লা? অন্ধের মতো হাতড়াতে হাতড়াতে পেছনের ঘুপচি ব্যালকনিতে। অতিথিদের নজরে পড়ার কথাই না। প্ল্যাস্টিকের চেয়ার ডাঁই করে রাখা। বাড়তিগুলো।
মুখোমুখি চেয়ারে নবারুণ আর ঝিনুক।
নবারুণের গলা কান মাথায় জড়ানো সাদা মাফলার খোলা। মুখের অন্ধকার পাশটা বাইরের দিকে। ঝিনুকের হাতে বাটি চামচ প্লেট। স্যুপ অথবা চটকানো সবজি-ভাত। বাড়ি থেকে আনা! শমির্লা দরজার মুখে। কেমন করুণ করে তাকিয়ে ছিল,
--আমি করে দিতাম পারতাম না ওটুকুন? তুমি বারে বারে বললে দরকার নেই। তোমার দাদাও তো...!
গলায় কান্না ঝুলছিল শর্মিলার। হাতের প্লেট সামনের চেয়ারে নামিয়ে তড়াক্ ঝিনুক,
--এইরে! না না, দরকার ছিল না সত্যি। তাই বলি নি। আরে জানোই তো, স্পেশাল লোকেদের স্পেশাল খাদ্য। এই হয়ে এসছে। যাচ্ছি আমি। কিচ্ছু হয়নি... যাও, স্টার্ট করে দাও লক্ষীসোনা- প্লিজ্।
দু’হাতে শর্মিলার গলা জড়িয়ে ঝিনুক। খুব কাছাকাছি মুখ। চোখ। অনগর্ল হেসে যাচ্ছে। ছোট্টোছোট্টো দাঁত।
হাসি সবটাই?
আলো আঁধারিতে দেখতে না চাওয়াটা চোখে পড়ে যায় কেন? শমির্লা দেখে ফেলে! পড়ে। শিউরে ওঠে।
--কী গো? শর্মি?
--উঁহুঃ। কিছু না।
রাস্তার সাদা ত্রিফলা আলোগুলো বিচ্ছিরি ম্যাটম্যাটে হলুদ। ঝুলপড়া কালচে দেওয়ালটায় টিকটিকি এক কোণা থেকে অন্য কোণায় লাফ মারছে।
গাড়িতে তুলে দিচ্ছিল ঝিনুকদের। ঝিনুক একেবারে হাতটাত জোড় করে,
--শোনো, এবার যখন কোলকাতায় আসবে, আমাদের পাড়ায় এসো। গিফট্টা খুলে দেখো। পছন্দ কিনা জানিও। খুব আনন্দ করলাম। আর শোনো, তিন বছর আমাদের হুঁহুঁ - সিলভার... আসবিই আসবি। এখন থেকেই বলছি। হিয়া তোর বয়ফ্রেণ্ডের সঙ্গে ইনট্রোডিউস্ করাবি তখন। ইয়াং পিসি, হিংসে করিস না যেন!
শমির্লা নীরব। এতো কথা? পাতলা ব্যাণ্ডেজে কত রক্ত পড়া বন্ধ করা যায়!
--ঝিনুক! এবার চলো।
নবারুণের আওয়াজ বোঝা যায় না চট্ করে।
রণজিত কষ্ট পাচ্ছিল। ইজ্ শী নমার্ল?
বেহালা চৌরাস্তা ধরে খানিকটা ভেতরে পৈতৃক ভিটেতে নবারুণ বছর দুই হল। অফিসের গাড়িতে অফিসে অনিয়মিত হাজিরা। ঝিনুক বাগানে বসে গুটিকয়েক গরীব বাচ্চাকে ধরে বেঁধে লেখাপড়া শেখায়। নাচ-টাচ। অনেকবার নবারুণ বলেছে,
--এখন তো ঠিক আছি। কোথাও জয়েন করো আবার। কি করবে সারাদিন? ঘরে বসে মরোজ্ লাগবে। ডিপ্রেশন হবে!
--ম-রো-জ্! হায় কত্তা। খালি বাজে বকা। ভল্যান্টরি নিলাম কেন বুঝেছ? এনজয়মেন্ট, মেরিমেন্ট... তুমি কাজের লোক সেসব বুঝবে না।
নবারুণ নিঃশ্বাস ফেলে। তা হলে যা খুশি।
--আমারও অনেক কাজ থাকবে স্যার। হাউজ্ওয়াইফ্ না? নোতুন রোল! হী হী।
দুমদাম এগিয়ে এসে বরের গলা জড়িয়ে ধরে। চুমু খেতে ঠোঁট উঁচু করে। হঠাত থামে। হাসে।
--ধ্যা-ত্! বুড়ো বয়সে...। তুমি তো আবার আমার চেয়ে ছ’বছরের বড়ো। লজ্জার কথা।
উথলে ওঠা দুই সুগোল বাঁজা স্তনে নবারুণের হাত। আস্তে আস্তে পিঠে। শিরদাঁড়ায়। কোমর বেয়ে নামে। আঁটসাঁট পাছায়। ঝিনুকের মোমপালিশ দু’হাতে বিনবিনে কাঁটা ধরে। ঊরুর লুকোনো খাঁজ সামান্য ভিজে। এখনো তার ঋতু নিয়মিত। মেনোপজের লক্ষণ নেই। ঝিনুক বাধা দেয় না। জানে কতটা কী! উলটে বলে,
--এ্যাই! ছীঃ... বুড়ো হয়েছি না আমরা?
নবারুণের মস্ত টোল খাওয়া বাঁদিকের গাল। গভীর কাটা দাগ। ভেঙে পড়ে ঝিনুকের কাঁধের ওপরে। চোখ থেকে অনিয়ন্ত্রিত জল গড়াতেই থাকে। ঝিনুকের গলা ভেজে। কাঁধ ভেজে। ম্যাক্সির পিঠ ভেজে। ঝিনুক হাসতে হাসতে তাকে সোজা করে বসায়। কপালে ঘন চুমু খায়। আলতো করে বালিশে শুয়ে দেয়।
--আ রে! ছী ছী। বোকা ছেলেটা। আমার বুড়োটা-
মুখের সামনে দাড়ি কামানো ছোট্ট সুন্দর আয়না ধরে।
--দেখো তো, কত চুল হয়েছে মাথা ভরে। সল্ট এন পেপর স্টাইল। ভালো আছো তো এখন। মন খারাপ কেন? শুয়ে থাকো একটু। আসি স্নান সেরে... তার পর একসাথে খাবো।
ছড়ানো বাড়িটার নিজর্ন একদিকে ঝিনুকের বাথরুম। পেয়ারা গাছ দুললে জানালার কাঁচে দেখা যায়। পাখিগুলো ডাকে। বৃষ্টির ঝমঝম এ্যাস্বেস্টসের উঁচু চালে। ঝিনুকের শ্বশুরমাশাই করে দিয়ে গেছেন। মেঝে মাবের্লের। দেওয়ালে লম্বা আয়না। শাওয়ার। ঠাণ্ডা গরম জল। তেল সাবান টুকিটাকি রাখার ছোটো আলমারি। এলাহি। শুধু বাথটাব হয়নি। প্রায় পঁয়তাল্লিশে একমাত্র ছেলে। তার বৌ। ঝিনুকও খুব ভালোবাসত।
--আমার বাবা-মণি।
--হ্যাঁ মা... বলো মা! আমার নটি প্রিটি গার্ল।
শাশুড়িও ভালো ছিলেন। স্নিগ্ধ। মা-মা। নবারুণ স্বভাবে মায়ের মতো। দুই ননদ অনেক বড়। বাপের বাড়ি শিলচরে যাওয়াই হতোনা। মা অভিমান। দাদা-বৌদি অনুযোগ।
ঝিনুক পায়ের নীচে খসিয়ে দিল টুপটাপ। ম্যাক্সি, শায়া, ব্রেসিয়ার। তুলে ছোটো বালতিতে রাখল। মাথা ঝাঁকিয়ে খুলে দিল খোঁপা। আয়নাটা কি সত্যি বলে? ঝিনুক একই আছে? চব্বিশে আর ছেচল্লিশে? উঁহু। বেশ তফাত। রাজহাঁস গলা একটু মোটা। ব্রেসিয়ার দু’সাইজ বড়ো। তলপেটে মাখোমাখো মেদ। বাইরের লোক কতটা বোঝে? দু’হাত লম্বা করে ওপরে তোলে। এমনিই লোম কম। আজকাল ওয়্যাক্সিং করে টরে আরো...। ঝিনুক নিজেকে দেখে।
--ঠিক আছি একদম। পারফেক্ট্। তাই না? তাই না?
বলতে বলতে তার দমকে কান্না পায়। প্রচণ্ড। রোধহীন। কাঁদতে কাঁদতে শ্যাম্পু নেয়। হাতে ঢালে। শাওয়ার খোলে। কালো লম্বা নরম চুল ভরে শ্যাম্পুর ফেনা। চোখ বেয়ে ফেনা। ঝিনুক কাঁদে। আওয়াজ করে। শব্দ করে। হাউহাউ করে। ফেনা, নোন্তা জল, সব ধুয়ে নেয় জল। শাওয়ারের জল কাঠি কাঠি বরফ হয়ে জমে থাকে।
নবারুন জিজ্ঞেস করে,
--এতোক্ষণ বাথরুমে? চান? ঠাণ্ডা লেগে যাবে না?
--আর বোলো না, চোখে সাবান ঢুকে যা তা কাণ্ড! যাচ্ছিলই না।
ঝিনুক পেছন ফিরে আলগোছে কাচা শাড়ি পরে। গা খালি। মাথায় সিঁদুর ছোয়ায়। সোনা-মোড়ানো নোয়াতেও। হাসিতে চোখ ছোট হয়ে আসে,
--আর একটু। আসছি। ঠাকুরের ফুল জল দিয়েই।
--এই তুমি আজকাল এতো কম খাচ্ছো কেন গো? বলবান্?
ঝিনুক নিরীক্ষণ করে। একটু বকাবকিও,
--কত রোগা দেখাচ্ছে, জানো! জিমটাও ছেড়ে দিলে, ‘ভাল্লাগে না, টায়ার্ড্’-- বলে বলে। ফাঁকিবাজি?
--বুঝলে ঝিঙ্কু, বাঁ গালের ভেতরটায় এমন একটা জট ঠোস্...। নাম্ব্। বাট্, খাবার লাগলেই...!
--কই দেখি?
ঝিনুক উঠে দাঁড়িয়ে টর্চ ফেলে মুখের মধ্যে।
--নাঃ! কই? দেখতে পাচ্ছি না।
সরু আঙুলটা ঢুকিয়ে দেয় নবারুণের মুখে।
--এই দিকে? নাতো। ধুত্। মনের ভুল। হবে না? যা ঝগড়া করো আমার সাথে। ঠিক আছে, ডক্টর গুপ্তকে একবার...।
তারপর ডেন্টিস্ট। তারপর ওষুধ। মাউথওয়াশ। তারপর অঙ্কোলজিস্ট। তারপর টেস্ট। তারপর বায়োপ্সি।
--ইয়েস্ ম্যাডাম। ইটস্ ম্যালিগন্যান্ট।
--কী যা তা বলছেন? দিব্যি সুস্থ লোক! পুঁচ্কে ফুস্কুরি-! আপনারা না সত্যি, ভয় দেখান।
ঝিনুক হেসে অস্থির। ডাক্তার অবাক্। অসন্তুষ্টও।
--বী সিরিয়াস ম্যাডাম। এ্যাডভান্সড্। সার্জারি করতে হবে এ্যাজ্ সুন্ এ্যাজ্ পসিব্ল্। আরো স্প্রেড করে গেলে... নাউ ইয়োর চয়েস্।
--ওক্কে, মানে আপনি যখন বলছেন।
গোটা গোটা রাত্তিরগুলো কবে থেকে ঝিঁঝিঁ-ডাকা হয়ে গেল, ঝিনুক খেয়াল করতে পারে না। ডাক্তার বলেছেন রোগীকে জানিয়ে দিতে। বলুক গে যার খুশি। আশ্চর্য, এটাও ঝিনুকের দায় না কি? নবারুণের চেহারাটা কি দেখেন নি ডাক্তার? অত বড়ো পাঁচফিট এগারো... শুধু লিক্যুয়িডে। আচ্ছা তো!
রক্ত, কাটা, ছেঁড়া কোনোটা কাউকে বুঝি দেখাতে যাস্ ঝিনুক! চোখের পাশের অন্ধকারটাও! না না। প্রমিস্? প্রমিস্।
সার্জারির দিন শিলচর থেকে মা, দাদা। বন্ধু, অফিস কলিগ। শমির্লা রণজিত। আরো সব। ভিজিটার্স রুমে তাদের লোকেই ভর্তি। অপেক্ষা না প্রতীক্ষা।
এক সময়ে সিস্টার এসেছিল।
--পেশেণ্টকে বেডে দেওয়া হয়েছে। কে কে যাবেন যেতে পারেন।
ঝিনুক নীল ফুলফুল কামিজ পরা। সাদা সালোয়ার। মেরুন লিপস্টিক্। নীল নেলপলিশ। হাতের কার্ডদুটো হাওয়ায় নাচাচ্ছিল।
--কে যাবে আমার সাথে? দুটো কার্ড। আসবে দাদা?
সকলে মুখ চাওয়া চাওয়ি। রণজিত বলেছিল,
--চল্ ঝিঙ্কু।
বেডে শোয়া গাল কান মাথায় ব্যাণ্ডেজ জড়ানো। অচৈতন্য। নবারুণ নাকি ও! স্যালাইন। ড্রিপ। মাথাটা চরকি দিয়ে উঠেছিল রণজিতের। দেওয়াল ধরে সামলাল। ঝিনুক কড়া চোখে দেখল। রাগী রাগী গলা,
--এ্যাই হাঁদা, তুই নীচে যা তোর কার্ড নিয়ে। আমি আছি।
ঝিনুক আছে। ঠায়। কত দিন। কী কেমো, কী রেডিয়েশন, কী ওষুধপত্র। পর পর। ঝিনুক আছে। ঝিনুক রোজ। সকাল দুপুর বিকেল রাত্তির। চৌরাস্তা থেকে ঠাকুরপুকুর। ছুট্টে যায়। ছুট্টে আসে।
ঝিনুক খেয়েছিস? আরে ডায়েটিং। হী হী।
ঝিনুক স্নান? হ্যাঁ হ্যাঁ, নোতুন সাবান খুলেছি।
ঝিনুক কাজল? হুঁ, পারমানেন্টলিই।
ব্যাণ্ডেজ খোলা হল একদিন। গালে গভীর কাটা। ক্ষত সারে নি। ডায়াবেটিক। সব মিলিয়ে জটিল। নল দিয়ে খাবার। ড্রেসিং করে নার্স। রক্তমাখা তুলো ফেলে গামলায়। ঝিনুক পাশে থাকে। দেখে।
--সিস্টার!
--বলুন ম্যাডাম?
--না, এমনিই।
সিস্টার ব্যাণ্ডেজ খোলে। তুলো দিয়ে পরিষ্কার করে। নোতুন করে বাঁধে।
--কবে রিলিজ্? মানে আর কতো...?
--স্যারের সঙ্গে আপনি একবার-।
কতোদিন পরে স্টুটা খুব আস্তে আস্তে খাওয়ায় ঝিনুক।
--কেমন? ভালো হয়েছে? চিকেনটা ভালো পেলাম। আমিই রেঁধেছি। মঞ্জু পারত না।
অফিসে জয়েন করল নবারুণ। ঝিনুক রিজাইন করল। গালের দাগটা গাঢ়। মুখ বেঁকে যায়। কথা বোঝা যায় না। হাজারটা নিয়ম। লাখো রেস্ট্রিকশন।
--স্পিচ্ থেরাপি করতে হবে। ফিজিও-।
--হ্যাঁ, শিয়োর ডক্টর। ঠিক হয়ে যাবে নিশ্চয়ই।
--ডোন্ট ওয়ারি। আশা রাখুন। চীয়ারফুল রাখবেন। কথা বলাবেন। খাওয়াদাওয়া লক্ষ্য রাখুন।
--থ্যাঙ্কস্ ডক্টর।
লাভ হয়েছে। খানিকটা। নবারুণ অবশ্য এমনিতেই কম কথার লোক।
ঝিনুকরা আজকাল সব জায়গায় যায়। যে কোনো অনুষ্ঠানে। পিকনিকে। পার্টিতে। সঙ্গে নবারুণের খাবার। নবারুনের সাদা মাফ্লার।
--দেখেছো? হী ইজ্ এ ক্যান্সার পেশেন্ট!
--কী বলছো? হিজ্ ওয়াইফ!? সো ডেকড্ আপ্?
--এই অবস্থায় কি করে পারে গো? এরা না, যাকে বলে হৃদয়হীন।
--কথায় কথায় হাসে দেখো। হেসে গড়ায়। যেন কিচ্ছু ব্যাপার না।
--পাগল না কি গো?
অনেক কিছু বলার থাকে। চেপে যায়। মুখ বন্ধ রাখে। মহিলারা বলে বেশি। পুরুষেরা কম।
--শী হ্যাজ্ গাট্স্। খুব মনের জোর। বাট্-!
গাড়িটা গ্যারাজ করে চলে গেছে সুখেন। পাটর্টাইম ড্রাইভার। কাছেই থাকে কোথাও। ছড়ানো বাড়িটা খাঁখাঁ। নিঃঝুম। বড় বাগান। ওখানে টিনের ঘরে মঞ্জু থাকে। ওর বর কাতির্ক। কাতির্ক বাগান দেখে শোনে। কলাপ্সিবল গেটে তালা মেরে ঘরে আসে ঝিনুক। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে নবারুণের। চোখের পাতায় ভার। ঝিনুকেরও কি নয়? বিছানা টানটান করে পেতে রেখে গিয়েছিল বেরোনর আগেই। লাল টকটকে মেঝে। লম্বা জানালা। হলুদ গরাদ। বড় বড় খড়খড়িওয়ালা জানালা। সব বন্ধ। ঝিনুক এসি অন্ করে।
--তুমি আজ বেশ সেজেছিলে কিন্তু।
খুব আস্তে জড়িয়ে জড়িয়ে বলল নবারুণ।
--ওমা এতোক্ষণে বলছো?
আধ ছটাক অভিমান। এক পোয়া হাসি। দেড় পোয়া খুশি। কতটা নকল? পুরোটাই? নবারুণ চশমাটা খুলে রেখে চোখ ডলে।
--শোও। শুয়ে পড়ো। এসি আর একটু কমাবো না ঠিক আছে?
গুন্গুন্ করে ঝিনুক। রবীন্দ্রসঙ্গীত। ‘আমারে যে জাগতে হবে... কী জানি সে...’। ফুলের গন্ধ পারফ্যুমের গন্ধ ম’ম’। খোঁপার মোটা জুঁইয়ের মালাটা বাটিতে ভিজিয়ে রাখে। জামাকাপড় ভাঁজ করে তোলে। আয়নার ঠিক ওপরে ছোট্ট আলো জ্বালে। স্মাড্জ্-ফ্রি চোখের সাজ! হুঁহ্। লেবড়ে ধেবড়ে পেতনির মতো। তুলোয় ক্লেনজার দিয়ে ডলতেই থাকে। রগড়ে রগড়ে চোখ জ্বালা করে।
ঘর জুড়িয়ে এসেছে। ঝিনুক এসির কথা ভুলে কোণার দিকের জানালা খুলে দিয়ে দাঁড়ায়। সজনে গাছে ফুলের টুনি বালব। চকচক করছে গাছটা। ত্রয়োদশীর চাঁদ আকাশে। আলোর জলসা।
--ঝিঙ্কু! একবার কি মুম্বই...?
শোনাই যায় না। অন্ধকার আর অন্ধকারের আড়াল।
--ওকী, ঘুমোও নি? আমি ভাবলাম-! ঈস্ ঘুমের ওষুধটা দিতেই যে.. দাঁড়াও নিয়ে আসি।
গ্লাসে জল। হাতে ওষুধ। ঝিনুক হাসি হাসি। ঘেঁষে বসে।
--শোনো না! না বলবে নাতো?
--হুঁ!? ওরা বেশ ধুমধাম করেছিল।
--সেটাই তো বলছি... আর তিন বছর পরে আমরা আরো বেশি ধুমধাম-। এই, খুব সাজবো জানো? বুড়ি হলে কি হয়েছে? এখনো সবাই সুন্দরী বলে। বলে কি না? সেই যে মা’র কড়িয়াল বেনারসীটা... যেটা আমায় দিয়েছিলেন? মনে আছে? লাল জরিপাড়। ঘিয়ে রঙ। সোনালি বুটিতে ভর্তি। কী গজার্স্!
নবারুণ কিচ্ছু বলে না। একটা হ্যাঁ-হুঁও না। তাকিয়ে থাকে। ঝিনুকের চোখে।
একটা না একটা অনুষ্ঠান তো হবেই ঝিনুক! ছোটো বা বড়ো। কারণ যাই হোক্-।
--মুম্বাই যাবে ঝিঙ্কু? একটা শেষ কিছু...।
--কী গো বোকার মতো তাকিয়ে আছো? বলো? এখন তো খরচ যাচ্ছে। নোতুন আর কিনে কি হবে? ওটা তো প্রায় নোতুন।
অন্ধকার ঘরে দুজনেই প্রায় আবছা। বাইরের অসমান আলোটুকু সম্বল। ঘুম আসছে কি নবারুণের? সে অনেক ভালো আছে ইদানিং। তবু-! একটু খচখচ আবারো। মুখের মধ্যেটা থম্ মেরে যায় হঠাত। সাড়হীন। বিস্বাদ লাগে। হয়তো এমনিই। হয়তো ভয়ের থেকেই। মানসিক সবটাই। হতেও পারে। ডাক্তারকেও জানায় নি। ডাক্তার কিছু নিদান দিয়েছেন? না না।
আরো তিন বছর? আরো তিন? আরো? আর মুম্বই গেলে?
ঝিঙ্কু, শপিংমলে সেই শোরুমের কাঁচের দরজাটা কেমন ভেঙে গিয়েছিল মনে আছে? চুরচুর? কিন্তু মাটিতে পড়ে নি। কারনটা তুমি জানতে চাইছিলে। ল্যামিনেটেড্ কাঁচ ছিল। জালি জালি ফাটাগুলো বাইরে থেকে চোখে পড়ছিল। আজকাল ঘরেই দেখতে পাই। রোজ। অনেকবার করে।
সজনে ফুলের সঙ্গে আর কিসের গন্ধ আসছে। পাচ্ছে ঝিনুক। জানালাটা বন্ধ করতে ভুলে গেছে। পাতাগুলো খুলে যাচ্ছে একটার পর একটা। ঝিনুক অন্যদিকে পাশ ফিরে শোয়। বুকের মধ্যে রক্তের ঢেউ। স্রোতের বেগে গলগল করে আসছে। পার হয়ে যাচ্ছে। এরকম বছরের পর বছর! মুক্তোটার গায়ে প্রচুর শ্যাওলা। জমেই চলেছে। ঠাস্ঠাস্ করে জানালার পাল্লা খোলে বন্ধ হয়। খোলে কেন? ঝিনুক একেবারে চায়না। বড্ড ক্লান্ত। আধখানা চোখ মেলে নিজের হাতের তালু দেখে। আয়ুরেখা - টানা লম্বা গভীর।
ঝিঙ্কু!
ঝিঙ্কু হাসছিস্ বুঝি?
ঝিঙ্কু, সব্বাইকে বুদ্ধুরাম ভাবিস্?
ঝিঙ্কু, এতো নিখুঁত কেমন করে রে?
ঝিঙ্কু, বাইশ বছর ফুড়ুত! একসঙ্গে থাকাই যে হল না?
মেটে হলুদ টিমটিমে রাতবাতির নীচে হয়তো জল গড়িয়ে বালিশ ভেজে। ওদের ঘুম আসে। সজনে ফুল, নিম ফল, কাঁঠালি চাঁপা, পেয়ারা পাতা, আমের মুকুলের গন্ধের সাথে ওদের গায়ের গন্ধ মিশে থাকে। জবুথবু জড়োসড়ো হয়ে থাকে অনিশ্চিত নিশুতি রাত্তির।
লেখক পরিচিতি
শ্রাবণী দাশগুপ্ত
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন।
এখন রাঁচিতে থাকেন।
শ্রাবণী দাশগুপ্ত
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন।
এখন রাঁচিতে থাকেন।
3 মন্তব্যসমূহ
গভীর দাগ... ল্যামিনেটেড কাঁচ ( কাচ)---
উত্তরমুছুনধন্যবাদ জানালাম। শ্রাবণী।
মুছুনJhinuk khunje pelam, upri paona mukto. ........Thom mere geche buk. .....
উত্তরমুছুন