লুতফুন নাহার লতা'র গল্প : কঙ্কনা ।।

মচমচে আলু করলা ভাজি করে জল রঙা সাদা কাঁচের বাটিতে ঢেলে রাখল কংকনা। ভাজা শুকনো মরিচ দুটো সবুজ করলা ভাঁজির উপরে শোভা হয়ে রইল । এক চুলোয় মুরগি আর অন্যটায় ভাত । ডাল দরকার ছিল কিন্তু আজ খুব তাড়া তার। ডাল বাদ । আজ ডাল ছাড়াই চলুক । সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে সে রান্না করে রেখে বের হবে এই ছিল ইচ্ছে ! সাহেদ এখনো ঘুমাচ্ছে । তা সে ঘুমাক । আজ শেষ রাত থেকে নিউইয়র্কের সারা গায়ে জ্যোৎস্নার সাথে চন্দন মাখা তুল তুল সাদা স্নো ঝরছে ।
বাইরে ঠান্ডা কিন্তু তা বলে কঙ্কনা তার প্ল্যান বাতিল করবে না। আজ তার ছুটির দিন সে কথা দিয়েছে সারা দিন স্নো'তে হেঁটে বেড়াবে ম্যানহাটানের রাস্তায় । টাইম স্কয়ারে গিয়ে মুভি দেখবে । বাইরে খাবে মেক্সিকান খাবার বুরিটোস। বড় সাইজের রুটির মধ্যে টমেটো পেস্ট দিয়ে রান্না গরম গরম ভাত, চিকেন, ব্ল্যাক বিন, লাল পেয়াজ ফ্রেস টমেটো মরিচ দিয়ে বানানো সালসা আর এভোকাডো দিয়ে বানান গুয়াকামোলে সব পেটের ভেতর ভরে রুটিটাকে সুন্দর করে মোড়ানো। আহা কি মজার খাবার। সাহেদের জন্যে সেদ্ধ আটার রুটি বেলতে বেলতে কঙ্কনা ভাবতে থাকে সারা দিন বাইরে সে কি কি করবে।

সাহেদ কে নিয়ে সে পড়েছে বিষম বিপদে, সে কিছুতেই এই দেশটাকে মেনে নিতে পারছে না । কাল রাতে এই নিয়ে হয়ে গেল মহা ঝগড়া। কঙ্কনাকে আজ কিছুতেই বাইরে যেতে দেবে না সাহেদ । কথায় কথায় সন্দেহ , গালাগালি,আজে বাজে কথা বলে বলে কঙ্কনার চরিত্র হনন ্করবে আবার তাঁর শত অনুরোধেও কিছুতেই সাথে যাবে না। এটা সাহেদেরএকটা রোগে দাঁড়িয়ে গেছে এখন। কঙ্কনা যত চেস্টা করে মানিয়ে নিতে সে ততোই খারাপ ব্যাবহারের মাত্রা বাড়ায়। সকাল থেকে মাথা ঘুরছে, কাল এই সব নিয়ে রাতের ঘুমটাও তার ভালো হয় নি । ভাবতে ভাবতে সে ঝড়ের মত বাথরুম থেকে বেরিয়ে গরম কাপড় পরে নিল । পায়ে হাটু সমান লম্বা বুট জোড়া গলিয়ে দিয়ে ওভার কোট পরে হাতে গ্লাভস আর হ্যাট নিয়ে বেরুতে যাবে এমন সময় পিছন থেকে সাহেদ ডাক দিল। বছর চারেক আগে কঙ্কনা সবার দেখাদেখি ডি ভি লটারির আবেদন করলেও তা যে সত্যি হবে সেকথা ঘুনাক্ষরেও ভাবেনি কোনদিন। শাশুড়ির মত না থাকলেও কঙ্কনার অতি উৎসাহে সাহেদ এসেছে বটে কিন্তু সে মোটেই খুশি হতে পারছে না। তিনতলা এপার্টমেন্ট বাড়ীর বেসমেন্টে এই এক রুমের বাসায় আজ প্রায় তিন বছর হয়ে গেল ওরা দেশ থেকে এসে উঠেছে। সাহেদ যেমন অলস তেমনি দায়িত্বহীন। বিয়ের পর থেকেই তা লক্ষ করছে কঙ্কনা কিন্তু সে চেস্টা করেছে সহজ ভাবে নেবার। দেশে তাও একটু কম ছিল কিন্তু নিউইয়র্ক আসার পরে এই এক অশান্তি । ঠিক মতো কাজ করবে না , যখন তখন কাজে সিক কল দিয়ে ঘরে ঘুমিয়ে থাকবে ! খাবারে একটু এদিক থেকে ও দিক হলেই আজে বাজে কথা বলে কঙ্কনাকে বিষাক্ত করে তুলবে। সকালে হাতে বানান রুটি ভাঁজি সুজির হালুয়া ছাড়া খাবে না । একদিন যদি মিষ্টি বা ঘি কম হল তো সেদিন খবর হয়ে যাবে । এই আমেরিকায় এসে যে কাজের লোক নেই সে ব্যাপারে কোন ছাড় নেই । কঙ্কনা ভোর বেলা কাজ করে একটা কফি শপে বেলা ১২ টা পর্যন্ত আর বেলা তিনটে থেকে কাজ করে সাবওয়ে স্টেশনের নীচে ছোট্ট নিউজ পেপার ম্যাগাজিন স্ট্যান্ডে রাত নয়টা পর্যন্ত। দিনে এই বারো ঘন্টা কাজ করেও তার রেহাই নেই ঘরে ফিরে আবার সেই একই যুদ্ধ প্রতিদিন।

ঝম ঝম করতে করতে কঙ্কনা সামনে এসে দাঁড়ালো । সাহেদ ঘাড় ঘুরিয়ে কঙ্কনা কে দেখে চিৎকার করে উঠল ' আমি বলেছি না তুই যাবি না । আজ ঘর থেকে তুই বের হলে আর ফিরতে পারবি না ' কঙ্কনা এই বার ঝাঁঝিয়ে উঠল 'তার মানে? বাসাটা কি তোমার একার ? কেন ফিরতে পারব না ? আমি গুনে গুনে ভাড়ার টাকা দেই না ?' 'এমন চটকোনা মারব হারামজাদি তখন তুই বুঝবি! মুখে মুখে তর্ক ! আজ তোর একদিন কি আমার একদিন! আমেরিকান মাগী গুলার মতো পোশাক ধরেছেন! বেশ্যা কোথাকার ! সাহেদ কুৎসিত অঙ্গভঙ্গী করে পেট ফুলিয়ে, নাক ফুলিয়ে, গা ঘুলিয়ে গালাগাল দেয়।


বিয়ের পর থেকেই এ রকম নোংরা গালি শুনতে শুনতে কঙ্কনার গা সয়ে গেছে। পান থেকে চুন খসলেই সে খেপে আগুন হয়ে যায়। চিৎকার করে গালি দিয়ে প্লেট বাসন ভেঙে একাকার করে । কঙ্কনা সব কিছু দেখে কিন্তু সে সয়ে নেয়। অশান্তি ভাললাগে না তার । সে দুনিয়া দেখে সাহেদের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা ভাবে । সব কিছুতেই তার পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গি । ও যা দেখে তাই ওর ভাল লাগে । নতুন কিছু দেখলে সে শিখতে চায় ,জানতে চায় । নতুনের ভেতরে যাকিছু আছে তাকে সে দু'হাত তুলে স্বাগত জানায় । স্বপ্ন দেখে এবং স্বপ্ন দেখাতেও চায় সাহেদকে। কিন্তু কি ভাবে ? সাহেদ ঠিক তার উল্টো। অথচ ছয় ফুট লম্বা, ফর্সা নায়কের মতো সাহেদ কে দেখে তার প্রেমে পড়ে গুলু গুলু হয়ে বিয়ে করার জন্য সে পাগল হয়ে যায় । মা বাবা অমত করায় বিশ্বযুদ্ধ ঘোষণা করে মাত্র দুই মাসের প্রেমে তিন মাস না হতেই বিয়ে করে ফেলে।

এখন কঙ্কনা বোঝে কি ভীষণ ভুলটাই না করেছে । ইচ্ছে করে মাইক লাগিয়ে সব মেয়েকে বলে, ভাল করে না জেনে শুনে কেবল মাত্র প্রেমে পড়েই যেন তারা বিয়ে না করে । বিয়ে হল সমস্ত জীবনের ব্যাপার! সময় নিয়ে একে অপরকে চেনা দরকার। এ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা উচিত না । সাত জনমে বিয়ে না হওয়াও ভাল এই রকম যন্ত্রনার চেয়ে।

এদেশে আসার পরে সাহেদ যে আরো কি সব শুরু করেছে তা আর বলার নয় কিছু কিনতে গিয়ে দাম দেবার সময় সাহেদ কিছুতেই লাইনে দাঁড়াবে না । সে লাইন ভেঙ্গে আগে যাবার চেষ্টা করে সবার বিরক্তির কারন হবে। কাউকে থ্যাঙ্ক ইউ , প্লিজ,এক্সকিউজ মি বলবে না । এতে তার ইগোতে বাঁধে । প্রথম এসে যখন ওরা ড্রাইভিং রোড টেস্ট দিতে গেল কিছুতেই তার প্যারালাল পার্কিং সোজা হয় না। তিন তিন বার সে ফেল করল বলে যতো গালি এসে জুটল কঙ্কনার ঘাড়ে কারন কঙ্কনা একবারে পাশ করে গেল । আর তো সে টেস্ট দেবেই না , কঙ্কনা অনেক বলে কয়ে চতুর্থ বার নিয়ে গেলে সে যাহোক করে পাশ করলো।এক পরিচিত ভদ্রলোক অনেক খুঁজে একটা গ্যাস স্টেশনে সাহেদের জন্য কাজের ব্যাবস্থা করলেন। তিনি খুব খুশি মনে বাসায় এসে যেই না সে কথা বলতে গেলেন ওমনি সাহেদ এতো রেগে গেল যে সে ভদ্রলোক কে জুতো খুলে মারতে গেল, আর একটু হলেই কেলেংকারীর আর বাকী থাকত না ।

এই সব যন্ত্রণা বহুত সহ্য করেছে কঙ্কনা এখন সে স্থির করেছে আর কোন ভাবেই সাহেদের সাথে থাকবে না । বাংলা নিউজ পেপার দেখে বান্ধবী লিনার সাথে গিয়ে বাসাও দেখে এসেছে। সামনের মাসের এক তারিখে সে চলে যাবে কিন্তু তবুও সে যতোটা সম্ভব ধৈর্য রাখাকেই সমীচীন মনে করছে । সাহেদ কে সে বলেও দিয়েছে আলাদা বাসা নেবার কথা আর তাতেই সাহেদ খেপেছে আরো বেশী । আজ কঙ্কনা কোন কিছুই কেয়ার করবে না । সে দব দবিয়ে বুটের শব্দ তুলে ধম করে দরোজা বন্ধ করে বেরিয়ে গেল। তার জন্য একজন ম্যানহাটানগামী ট্রেনের ধারে সেভেন্টি ফোর রূজভেল্ট স্টেশনে অপেক্ষা করছে । সে এখন আর ট্রেন ধরে সেখানে গিয়ে নেমে দুজনে এক হয়ে আবার ই ট্রেন ধরবে । সারা দিন হেঁটে বেড়াবে নানান জায়গায়। ম্যানহাটানের ফোরটিন স্ট্রিটে মহাত্মা গান্ধীজীর একটা মূর্তি আছে সেটার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলবে, এইটথ স্ট্রিটে নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি , সেখান থেকে ইষ্ট ভিলেজ ঘুরে যাবে ক্যানাল ষ্ট্রীটে। রাস্তার উপরে স্প্যানিশ মেয়েরা ছোট ঠ্যালা গাড়িতে করে মিষ্টির প্রলেপ দেয়া বাদাম বিক্রি করে, ডলারে এক প্যাকেট। সেটা কিনে খাবে । চায়না টাউন থেকে থানকুনি পাতা কিনবে ব্যাগ ভরে। আজ সে সিমোন দ্য বোভয়ার, আজ সে স্বাধীন মানুষ ,তাঁর দেহ , তাঁর মন একান্তই তাঁর নিজের ।

চিনি গুড়ির মত স্নো ঝরতে থাকে তার মাথার উপর, সে এখন ব্যাটারি পার্কের দোলনায় দোল খাচ্ছে আর জোরে জোরে গাইছে " হারে রেরে রেরে আমায় ছেড়ে দে রে দে রে, যেমন ছাড়া বনের পাখী মনের আনন্দে রে ...হারে রেরে রেরে আমায় বাঁধবে ধরে কে রে ।" মনে হচ্ছে তার বয়স দশ বছর কমে গেছে । দোলনার ঝুলন দড়িগাছি ধরে হেঁসে গলে গলে পড়ছে কঙ্কনা । হঠাত তার মাথা ঘুরিয়ে গা ঘুলিয়ে কেমন পাক খেয়ে উঠল ! বমি লাগছে ! দোলনা সহ সারা ব্যাটারীপার্ক ,কুলুকুলু হাডসন , দুরন্ত মশাল হাতে স্ট্যাচু অব লিবার্টি বন বন করে ঘুরছে, সে কি তবে প্রেগন্যান্ট !



লেখক পরিচিতি
লুতফুন নাহার লতা
গল্পকার। কবি। 
আবৃত্তিকার। অভিনেত্রী। একটিভিস্ট।
সদ্য প্রকাশিত কবিতার বই : চাঁদের উঠোন।
গল্পের বই : জীবন ও যুদ্ধের কোলাজ
নিউ ইয়র্কে থাকেন। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ