দীপংকর গৌতমের গল্প : ফিঙ্গার প্রিন্ট

আজ ছিল অনিন্দ্য’র সাপ্তাহিক ছুটির দিন। কিন্তু কপিলার সাথে বার তিনেক ঝগড়ার হবার পরে বাইরে বেরোতে আর ইচ্ছা করে নি। প্রতিদিনের থেকে আজ একটু আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিল দু’জন। কিন্তু কী এক দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল অনিন্দ্যর। তারপরে বহু চেষ্টা করেছে ঘুমাবার। এমনকি চোখ বুজে সাসা বোর্ডে কালো কালি দিয়ে উল্টো করে ১০০ থেকে ১ পর্যন্ত লিখেছে বহুবার। কাজ হয়নি। এই মধ্যরাতে সে যাবেই বা কোথায়? জোছনা রাত হলে না হয় কপিলাকেও ডেকে তুলতে পারত। এখনো যে ডাকতে পারবে না তা নয়, কিন্তু একটা উদ্দেশ্য তো চাই। মাত্র ঘন্টা চারেক আগেও তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়ে গেছে শিলাবৃষ্টির মতো। তারপরও তাদের ঝগড়ার ভেতরেও একটা বন্ধন আছে। কেউ কাউকে ছাড়া পূর্ণ নয়। সংকট একটাই, বিয়ের পর কতগুলো বছর পার হলো। বহু চেষ্টা করার পরেও তাদের সন্তান আনে নি।


অনিন্দ্য কপিলাকে সন্তান নিতে বারণ করেছে। অনিন্দ্যর দু’টা ভয়। প্রথমটা হচ্ছে, বাচ্চা হলে দু’জনের দূরত্ব বাড়বে, আবার টানাটানিও বাড়তে পারে। সন্তানটি যদি রোগা টিংটিঙে হয় তাহলে তো কথাই নেই। এই সংকটে না যাওয়াই ভালো। আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে, কপিলার বান্ধবী মিথিলার মৃত্যুর ঘটনা। মিথিলার স্বামী চেয়েছিল অল্প টাকায় বাবা হতে। তাই মিথিলাকে গ্রামেই রেখেছিল। মিথিলাকে যে গ্রামে রাখা হয়েছিল আর দশ ক্রোশের মধ্যেও কোনো ডাক্তারখানা নেই। তুষের আগুন তাওয়ায় জ্বেলে নাড়ার ঘরে বানানো আঁতুরঘরে রাখা হয়েছিল তাকে। পাকা ধাত্রীও রাখা হয়েছিল। কিন্তু সন্তান আলো দেখলেও মিথিলাকে বছাচানো যায় নি। অনিন্দ্য মিথিলার সেই ফ্যাকাশে বেদনার্ত মুখখানা যতবার ভেবেছে ততবারই তার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠেছে। কপিলার যদি এমন হয়-- অনিন্দ্যর অবস্থাটা কী হবে? কিন্তু এই গভীর রাতে অনিন্দ্যর কেন যেন মনে হলো-- আবেগই সবকিছুই নয়। জীবনের জীবন বেঁধে পথ চলতে গেলে আরো কিছুর দরকার আছে।আর ওই প্রয়োজনীয় দরকারগুলো আবেগের প্রবল প্রতাপে নিগৃহীত হতে হতে একদিন জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। তখন করার কিছুই থাকে না। কপিলা ও তার মাঝখানে একদিন সে কোনো অস্তিত্বকে মানতে চাইত না। এমনকি ভাবতেও পারত না কোনো শিশুর কান্না আদের সুখনিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটাবে। অথচ বহুপথ পার করে আজ অনিন্দ্য কপিলার দিকে তাকিয়ে দেখছে কী নিশ্চিন্ত-নিরুপদ্রবে কপিলা ঘুমাচ্ছে। কাত হয়ে ঘমোচ্ছে কপিলা। তার বুকের উপরের কাপড় ছড়িয়ে আছে। অনিন্দ্য দেখছে কপিলার মায়াবী অবয়ব, পেলব শরীর। নিঃশ্বাসের সাথে দুলছে তার বুক, বুক উঠছে বুক নামছে। আজ কপিলার পাশে একটা সন্তান খুব মানাত। এমনো হতো ওই শিশুটি খুব ভোরে অনিন্দ্যর ঘুম ভাঙিয়ে দিত। কিংবা ঘুমন্ত অনিন্দ্য না উঠতে চাইলে চোখের ভেতরে আঙুল ঢুকিয়ে দিতে চাইতো।

আজ যখন অনিন্দ্যর ভেতরে এসব ইচ্ছেরা সাইবেরিয়ান পাখিদের মতো বর্ণিল ডানা মেলে ইড়ে আসছে তখন অনিন্দ্যর আর করার কিছু নেই। এত রাতে অনিন্দ্য কী করবে? অন্ধকারের ভেতরেই সে সিগারেট ধরায়। দু’আঙুলের ফাঁকে উঁকি দেয়া সিগারেট টানতে টানতে অনিন্দ্যর ভেতরে এক অদ্ভুত ঘটনা জন্ম নেয়। সে বুঝতে পারে তার মস্তিষ্কের ভেতরে একটা ভিডিও বাক্সের মতো কিছুর জন্ম হয়েছে। তার মধ্যে মাত্র চারটা মেয়ের ছবি। ফিল্মের মতো একের পর এক তার চোখে ছায়া ফেলতে থাকে। মহুয়া, সুহি, ডিনা, সুখী। এরা সবাই একদিন তার সবকিছু ছিল। কাইকেই সে বিয়ে করে নি। অথচ তাদের শরীর জুড়ে অনিন্দ্যর ছিল অবাধ বিচরণ। আজ কেন যেন সব গটনা পোস্টমর্টেম হয়ে ঢুকে যাচ্ছে তার মগজের কোষে। এর থেকে পালাবার পথ নেই। পালাবেই বা কোথায়?

পুরুষ ও মেয়েরা কি সবাই এমনভাবে প্রভাবিত হয় এবং প্রতারণা করে? সে নিজেকে ভালো করেই জানে। তাহলে কপিলাকে কি সে অবিশ্বস করবে? ভাবতেই সিগারেটের আগুনে ছ্যাঁকা লাগে তার হাতে। সে হতচকিত হয়ে যায়। না, কপিলাকে এমন ভাবা যায় না। কিন্তু নিজেকে? এসব কথা কি সে কপিলাকে খুলে বলবে? তাতে যতটা ফ্রেশ হবার কথা সে ভাবছে ততটা হতে যদি সে না পারে? কিংবা ওই সাথে কপিলাও যদি কোনো কাহিনী শোনায় সেটা সে সহ্য করতে পারবে না। সে পুরুষ-- সে আধিপত্যবাদী। কোথাও অংশীদারিত্ব তার ভালো লাগে না। তার চাই পুরো মালিকানা।

আসলে মানুষ কেমন? এ প্রশ্নের মুখোমুখি হতেই তার মনে পড়ে বহু আগের একটি ঘটনা। তখন সে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। তাদের বাড়ির পাশেই পালপাড়া। পালপাড়ার মেয়ে গীতা মরে গেছে গলায় দড়ি দিয়ে-- এ কথা চারদেকে রটে গেল সকালেই। পাশের গ্রামেই বিয়ে হয়েছিল গীতার। গীতার স্বামী বারবার শুধু যৌতুকের টাকা চাইত। বছর বছর গীতার বাবাকে এই যৌতুকের টাকা গুণতে হতো। কিন্তু গীতার বাবার মৃত্যুর পর তার ভাইয়েবা যৌতুক দিতে রাজি হয় নি। এ নিয়েই বহুদিন অশান্তি চলছিল গীতার সংসারে। গীতার স্বামী হরি সরা, সাজ ছাড়া অন্যকিছু বানাতে পারত না।আর এসব তো পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন মাস গেলে আর কেউ কিনতে চায় না। শীতকালে হরি নৌকা ভাড়া করে দক্ষিণ দেশে গাওয়ালে যেত। তারপর ফিরে নৌকা ভাড়া পরিশোধ করে বাকি টাকা দিয়ে বছর চালাতে চাইত। কিন্তু তাতে যখন চলত না তখন সাতা পাড়া থেকে সুদে টাকা আনত। সেই সুদ বাড়ত চক্রবৃদ্ধি হারে। আর এসব নিয়ে শ্যাম সাহার গালি শুনতে হতো প্রায়ই। যখনি শ্যাম হাসার টাকার তাগিত বাড়ত তখনি গীতার উপর বাড়ত নির্যাতন। কারণ গীতা কানে কম শোনে। হরি গীততাকে বিয়ে করে যে পুণ্য করিয়েছে গীতার বাবা-মাকে, তার ঋণ দিয়ে যখনি তারা অপারগ হলো গীতার মৃত্যু হলো তখনি। গীতাকে পাওয়া গিয়েছিল গাবগছের ডালে ফাঁস দিয়ে ঝুলন্ত অবস্থায়। সবাই ভেবেছিল গীতা গলায় দড়ি দিয়েছে। কিন্তু জেলা সদরে নিয়ে যখন লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করা হলো তখন জানা গেল গীতার স্বামী গীতাকে গলা টিপে হত্যা করে ওভাবে ঝুলিয়ে রেখেছে। তার আঙুলের ছাপ পর্যন্ত পাওয়া গেছে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট আবিষ্কার করা যায় এমন মেশিন নাকি মেডিকেলে রয়েছে।

অনিন্দ্যর চোখে আজ বহু ছবি একে একে ভেসে উঠছে। মহুয়া, সুহি, ডিনা কিংবা সুখী কে তার হতে পারত না? অথচ কেউ হয় নি। এ দোষ অনিন্দ্যরই। দশ বছর আগেও অনিন্দ্য নিজের কাছে নিজেও ধরা দিত না কখনো। মানতেই চাইত না যে, তার ফেলে আসা দিনগুলোর সব ঘটনার জন্যে সে দায়ী। কিন্তু তআজ সেসব সত্যকে অকপটে স্বীকার করছে স্বেচ্ছায়। অনিন্দ্যর ভাবনাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে আর সেই ঘুরপাকের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসছে অজস্র ঘটনা, অজস্র সত্য।

কলেজ জীবনে তার প্রথম পরিচয় ঘটে মহুয়ার সাথে। দু’জনেই তখন ইন্টারমিডিয়েটে পড়ে। ছাত্র হিসেবে অনিন্দ্য ভালো ছিল কিন্তু ছাত্রের পার্থক্যটা অনিন্দ্যর বেলায় পুরোপুরি প্রযোজ্য। সবাই যখন পরীক্ষার নোট নিয়ে ব্যস্ত তখন অর্নিদ্য লাইব্রেরিতে বসে উপন্যাস আর কবিতার বই পড়ে বেড়াত। ক্লাস বাদ দিয়ে খেলত ক্রিকেট কিংবা মিছিলে যেত। হাতে থাকত একগাদা বই। কিন্তু পরীক্ষার আগে পার্সেস্টেজের জন্যে দু’এক স্যারের কাছে প্রাইভেট গড়ার নামে যেত। ইংরেজি পড়তে গিয়েই একদিন তার পরিচয় হয় মহুয়ার সাথে। মহুয়া অনিন্দ্যর হাতের দামি দামি বই দেখে ওগুলো পড়তে আগ্রহী হয়ে একদিন একটা বই চেয়ে বসে। তারপর বইয়ের ভেতরে মন ঢুকে যায়। একদিন মহুয়া বইয়ের ভেতরে এক চিরকুটে লিখে দেয় ‘তুমি যে আমার’। তারপর উন্যাস পড়া কতটুকু হয়েছিল জানা যায় নি, তবে বই হয়ে উঠছিল ডাকবাক্স। তারপর একদিন শহরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেঁধে গেল। এর কয়েকদিন পরেই মহুয়া নিরুদ্দেশ হলো। অনিন্দ্যর পরে গুনেছে মহুয়ারা দেশ ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু কতার জীবনে প্রথম যে দাঞ মহুয়ার গেঁথে দিয়ে গিয়েছিল তা ক্রমশই দাউদাউ করে জ্বলতে থাকল। মহুয়ার ¯œানঘরে একদিন পুরো দু’ঘন্টা কেটি গিয়েছিল অনিন্দ্যর। অনিন্দ্য প্রথম ভয়ে পেলেও সুযোগ ছাড়তে চায় নি, আর মহুয়া ছিল নির্বাক। মহুয়ার বুক, নাক, মুখ কোথায় অনিন্দ্যর হাতের চিহ্ন নেই ভাবতে তার দম বন্ধ হয়ে আসে। তারপর থেকে মহুয়া ¯œান করেছে বহুবার বহুদিন, কিন্তু আঙুলের চিহ্নগুলো কি এতদিনে মুছে গেছে? আজ তার জানতে ইচ্ছে করে। এমন সময়ই একদিন গানের জলসায় পরিচিত হয় সুহি। অনিন্দ্য কলেজের সাংস্কৃতিক সপ্তাহে চ্যাম্পিয়ন হবার পরে তার সাংস্কৃতিক মান কতটা বদলেছিল তা বোধকরি কেউ বলতে পারবে না। তবে একদিন কলেজ ক্যাম্পাসের নির্জন কক্ষে ডেকে সহি অনিন্দ্যকে বলেছিল-- তালাতের ওই গানটা আমাকে একটু শিখিয়ে দেবেন? ওই যে কলেজে যেটা আপনি গাইলেন। অনিন্দ্য শিখিয়েছিল। তার এই গান শেখাতে শেখাতে তার পরস্পরকে ছুড়ে দিয়েছিল এক নতুন রাজ্যে যেখানে মানুষ সব প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য থাকে, বিনিময়ে শুধু একমুহূর্ত উত্তাপ সম্ভোগের কাঙালিপনা করে। অনিন্দ্য তাই করেছিল। কিন্তু যেদিন ওই জেলা শহর ছাড়তে হবে মনস্থির করল তারপর থেকে ছিটকে গেল সুহি। শুধু সুহির ওষ্ঠের সাব্দ, হাতে হাত, মুখের, শরীরের মানচিত্র জুড়ে তার আঙুলের অবাধ বিচরণই স্মৃতি হয়ে রইল। ঢাকয় আসার পরে সুহিকে সে এক পত্র্যের মাধ্যমে অস্বীকার করেছিল। অস্বীকারের বাষাজনিত ঘেন্নায় ও মানবিকতার এই বিপর্যয়ে যে সুহি আর বিয়ে করে নি সে খবর অনিন্দ্য জেনেছে। কিন্তু সেটা আজ শুধুই স্মৃতি।

ঢাকা এসে অন্দ্যি দেখল নতুন এক জগৎ। এখানে রাস্তার এপারে বসে গান গাইলে ওপারের মানুষ শোনে না। যন্ত্রদানবের উৎকট চিৎকারে সব ভাবনা ভুল হয়ে আসে। জেলার অনিন্দ্য রাজধানীতে অযুত। এখানে সে ভীষণ একাকিত্বে ভুগল। আর বারবার মনে হতো তার জেলা শহরে তার আধিপত্যের কথা। মানুষের একাকিত্ব কতটা সেটা স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে মূর্ত হয়ে ওঠে। ক্রমশ দৈন্যদশা তাকে আঁকড়ে ধরল। এখানে কেউ কারো নয়-- এ সত্য বুঝতে তার একটু দেরি হলেও ধীরে সে তার জীবিকার সংস্থান করে ফেলল। এখানে একটি দশম শ্রেণীর মেয়েকে সে পড়ানোর সুযোগ পায় হলের এক বড়ভাইয়ের প্রক্সি দিতে এসে। স্কুলগামী ওই ছাত্রীর যে বোনটি কলেজে পড়ে তার সাথে ইতোমধ্যেই পরিচয় হয়ে যায় অনিন্দ্যর। তার এক বৃষ্টির দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরেই এক যাত্রী ছাউনিতে দু’জনের কথাবার্তা জমে ওঠে। এভাবে ছাত্রীর বোন ডিনা অনিন্দ্যর ঢাকার প্রথম পাত্রী। ডিনার বাবা-মা চাকুরিজীবী। তারা অফিসে গেলে ডিনার সাথে অনিন্দ্যর ভালোবাসা চলত। রিকশায় বসে ডিগনার চুল একদিন বাতাসে উড়ে মুখ ঢেকে গেলে অনিন্দ্য চুল সরিয়ে দিতে বিব্রত বোধ করছিল। কিন্তু পরে চুল, মুখ হয়ে যেন তার হাত উঠে আসত জলের অধিকার নিয়ে। কিছুকাল পার হবার পরে অনিন্দ্যর আর প্রক্সি দিতে হলো না। সে-ই হয়ে গেল হাউজ টিউটর এবং পরিবারের বিশ্বস্ত লোক। এই সুযোগ নিল অনিন্দ্য। ডিনাকে সে বহু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কিন্তু ডিনার বিয়ের প্রস্তাব এলে অনিন্দ্য একটি চিরকুট পাঠিয়ে কিছুকাল নিজ গ্রামের বাড়িতে চলে আসে। ডিনার বিয়ে হয়ে যায় কিন্তু একটি চিরকুট তাকে যেভাবে দংশন করেছিল তার বিষে নীল হয়ে যাওয়া ডিনাকে শেষ পর্যন্ত নাকি মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল। খবর পেলেও অনিন্দ্য আর পিছু ফেরে নি। এরমধ্যে অনিন্দ্যর চাকরি হয়ে গেল একটা বিদেশী কোম্পানিতে। চাকরিটা পেয়ে সে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। জীবনের বহু স্মৃতি এবং স্মৃতিদংশন থেকে নিষ্কৃতি পেতে এই চাকরিটা তার খুব জরুরি ছিল। চাকরি তার জীবনের পুরনো মানচিত্র বদলে দিলেও মহুয়া তার ভেতরে জীবনের শুরুতে যে রোদ্দুরের দহন প্রোথিত করেছিল সে দহন কমে নি কখনোই, বরং বেড়েছিল দিন দিন। গভীর রাতে ঘুমের ভেতরে নিরাপদ দূরত্বে এগিয়ে যেতে যেতে অনিন্দ্য উঠে বসত। ইলেকট্রিক পাখা তাকে শান্তি দিতে পারছে না। সে সারা শরীরে জল মেখে এসে ইলেকট্রিক পাখার সামনে দাঁড়ালেও সুখ মিলত না। রেডিও, টিভিতে তার রেকর্ডিং হয়। সে গান গায়, অফিস করে, অফিসে তাকে সমীহ করে সবাই কিন্তু মাংসের ভেতরের দহন সে কীভাবে থামাবে? রাতে তার ঘুম হয় না। আর এভাবেই একদিন তার পাশের টেবিলের সুখী তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল রাতে তার বাসায় গান শোনানোর। গান শুনিয়ে বহুরাত হবার পরে অনিন্দ্য সে-রাতে আর ফেরে নি। সুখীর বাসায়ই ছিল। গভীর রাত অবধির তার ঘুম আসছিল না। সেদিন পূর্ণিমা ছিল। আকাশে তারাদের ছিল হাটবার। জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে ছিল অনিন্দ্য। কিন্তু পাশে তাকাতেই দেখল নৈশকালীন পোশাকে আবৃত সুখী তার পাশেই দাঁড়ানো। সুখীর ছেলে-মেয়ে সবাই ঘুমোচ্ছে। অনিন্দ্যর সাথে সুখীর পরিচয় চাকরিতে ঢোকার পরেই, কিন্তু এত তাড়াতাড়ি যে অনিন্দ্যর একটা হিল্লে হয়ে যাবে তা সে বুঝতে পারে নি। প্রথমে অনিন্দ্য হতচকিত হয়ে গিয়েছিল। সুখীর সাথে সে একই কোম্পানিতে চাকরি করে। দুই ছেলেমেয়ের মা। স্বামী বহুদিন প্রবাসে। মাসে মাসে টাকা পাঠায়। কিন্তু সুখী অনিন্দ্যকে আজ এই গভীর রাতে শুধু প্রশ্ন করে, অনিন্দ্য, টাকাই কি সব? অনিন্দ্য তাকায় সুখীর দিকে। চাঁদের ছায়া গিয়ে পড়েছে সুখীর ঘাড়ে, গ্রীবায়, চোখে-মুখে। ঘাড়ের পাশে সতেজ পশমগুলো যেন শুশুকের মতো বারবার চিল্কাচ্ছে। চুলের সুশোভিত বিন্যাস বেয়ে নেমে আসছে চমৎকার গন্ধ। হালকা গোলাপি রঙের ড্রেসের ভেতরে সুখীর শরীরটা কাঁচা শশার মতো মনে হচ্ছিল। বিস্মিত হয়ে ওঠে অনিন্দ্য, ওই ধারালো রূপ বিঁধে যায় অনিন্দ্যর চোখের ভেতর। অনিন্দ্য এইবার মনে করে তার শৈশববেলা। খেজুরতলায় তারা দল বেঁধে গিয়েছিল অনন্ত ময়রাকে পোড়ানো দেখতে। সেদিন অনিন্দ্য দেখেছিল উপরের চামড়া পুড়ে যাবার পরে ডোমরা সূঁচালো দন্ডের বাঁশ দিয়ে বারবার খোঁচাচ্ছিল অনন্ত ময়রার শীরটাকে, যাতে সে দ্রুত আগুনে পুড়ে যায়।

অনিন্দ্য বহুদিন পর এই দৃশ্য ভাবতে থাকলেও সুখী তাকে এই ভর রাতদুপুরে দাঁড়িয়ে থেকে ঠান্ডা লাগাতে দিতে রাজি নয়। অনিন্দ্য একসময় সুখীর জ্বলজ্বলে মুখটা দু’হাত দিয়ে ধরে পূর্ণিমা চাঁদটার দিকে ফিরিয়ে ধরে। অনিন্দ্যর স্পর্শে সুখীর শরীরে কোনো হাড় আছে বলে মনে হয় নি। মনে হয়েছে শরীরটা একটি মাংসপিন্ড যার ভেতরে জ্বলছে লেলিহান আগুন। তারপর সেই পূর্ণিমার আদিম আগুনে সূর্যটা পুড়ে গিয়েছিল। এইভাবে সুখীর সাথে অনিন্দ্যর জীবন শুরু হয়। কিন্তু সংকট বাঁধল তখনি যখন সুখীর স্বামী দেশে ফিরে আসে। সুখী তার সাথে ঘর করতে রাজি নয়। অনিন্দ্যর অফিসেও তখন বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেছে। অতঃপর অনিন্দ্য দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যায়। প্রথমে সেখানে কিছু একটা করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু চেষ্টার ফলে সে খুশি হতে পারে নি। অনিন্দ্যর এই পলায়ন সুখীকে ঘর ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করলেও অবিশ্বাসের আগুন রোপিত হয় তার স্বামীর ভেতরে। এভাবে প্রবাহিত হতে থাকে তাদের জীবনের ভেলা।

কপিলাকে সে বিয়ে করেছিল ভারতে বসে। ভালোবেসে সেখানে থেকেও অনিন্দ্য পালাতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কপিলা কালিঘাটে নিয়ে অনিন্দ্যকে পরাজিত করেছে। কপিলা অনিন্দ্যর এসব ইতিহাস জানে না। কিন্তু কপিলাকে ভালো না বাসা ছাড়া তার আর গতি নেই-- এ বোধ ঢোকার পর থেকে সে উজাড় হয়ে গেছে। অনিন্দ্যর ভালোবাসার তীব্রতা কপিলাকে দ্বিতীয় কোনো ভাবনার দিকে ধাবিত করে নি। কপিলার চুলের ভেতরে অনিন্দ্য আঙুলগুলো যখন চিরুনির দাঁতের মতো করে আলতোভাবে বুলিয়ে আনে তখনো কোনো নারী ভাবতেই চায় না যে এ আঙুল এমন কায়দায় চুল বুলাতে অভ্যস্ত হয়েছে অনেক আগে থেকেই। অনিন্দ্য চাকরি করে, তার অভাব নেই অথবা অভাব আসে মিটে যায় কিন্তু সেইসব মুখ আজ সবাই কেমন আছে? মহুয়া, সুহি, ডিনা, সুখী সবার বয়স বেড়েছে। তাদের চিন্তার পরিধিতে অনিন্দ্যর অবস্থানটা কোথায়? অনিন্দ্যর আজ তা ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে।

গীতার সুরতহাল রিপোর্ট তৈরির সময় যে মেশিনে ফিঙ্গারপ্রিন্ট নির্ণয় করেছিল, সে মেশিনের যদি প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এতকালে ঘটে থাকে তাহলে হয়তো প্রত্যেকটা মানুষের শরীরে ওই মেশিন লাগালে পাওয়া যাবে অজস্র রকমের আলামত যাতে মনে হবে প্রত্যেকটি শরীরেই রয়েছে অজস্র আঙুল, অজস্র ওষ্ঠ কিংবা অজস্র রকমের আলামত যাতে মনে হবে প্রত্যেকটি শরীরেই রয়েছে রয়েছে অজস্র রকমের চিহ্ন। এরমধ্যে কতটা স্নেহের, কতটা প্রতারণার, কতটা মনোদৈহিক বিপর্যয়ের সেটার ভাগ নয় নাইবা করা গেল। কিন্তু এ সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, প্রতিটি মানুষের শরীরে অজস্র দাগ রয়ে গেছে এবং প্রতিনিয়ত জন্ম নিচ্ছে নিত্যনতুন দাগ। কতকাল পর্যন্ত এ দাগ জন্ম নেয়-- নেবে? ক্রমশ এসব প্রশ্ন জিউসের ঈগলের মতো ছোবল হানতে থাকে অনিন্দ্যর হৎপিন্ডে।

অনিন্দ্যর বয়স কম হয় নি। এখন আর ছলে-ছুঁতোয় যে-কোনো নারীর সাথে কথা বলতে তার ইচ্ছে করে না। সে বরং এড়িয়ে যায়। ছোট্ট বাচ্চা কিংবা কোনো কিশোরী বই নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে মায়ের হাতে হাত রেখে এমন দেখলে তার ভেতরে কাঁপন লাগে, তার চোখে তখন অযুত স্বপ্নভরা এক ভেলা নিরন্তর রয়ে চলে কষ্টের পথ। কী এক দহন তার ভেতরে জ্বলে ওঠে, সে তা টের পায় কিন্তু শব্দহীন পথের সাথে মিলে-মিশে হারিয়ে যায়।

এবার অনিন্দ্য তার নিজের দিকে পুনরায় তাকায় এবং ভাবে একটা সময় পর্যন্ত মানুষের প্রতারণা কিংবা আদিম দহনের বয়স থাকে। এ পর্যন্ত তার শরীরের ফিঙ্গারপ্রিন্টগুলো সম্ভবত সবচেয়ে উজ্বল থাকে। আর সেই বয়স পর্যন্তই তার বাঁচার অধিকার থাকে। এ সিদ্ধান্ত যদি সত্য হয় তাহলে কি তার বাঁচা উচিত? জীবনে অজস্র ভুল, অজস্র দহন, অজস্র পরাজয় তার মগজে এসে তখন ভিড় করতে থাকে। মহুয়া, সুহি, ডিনা, সুখীরা তাকে দেখে পালাতে থাকে এমন দৃশ্য তার চোখে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠে। অনিন্দ্য আত্মহননের কথা ভাবতে থাকে। কী হবে মরে গেলে? সহজে মৃত্যুবরণ করার উপায় কী? এজন্য সবচেয়ে ভালো পথ হলো বিদ্যুস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণ করা। অনিন্দ্য একটা স্ক্রু-ড্রাইভার খুঁজতে থাকে।

আকাশে তখনো নক্ষত্রের হাট মিলেছে। ক্যাসিওপিয়া তারাটা অদৃশ্য হয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে। দক্ষিণের জানালা দিয়ে বিছানার উপরে এক চিলতে জোছনা এসে পড়েছে। সে জোছনায় কপিলার আবক্ষ দেখা যাচ্ছে। তার বুকে কাপড় নেই, চুলগুলোতে মুখ ঢেকে আছে, তার মধ্যেও চোখের নিচে তিলটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ঘুমের আগে অনিন্দ্যর সাথে ঝগড়া করে কপিলা কেঁদেছিল খুব। অবোধ শিশুর মতো ঘুমিয়ে পড়েছিল এভাবেই। চোখ শুকনো জলের ধারা দেখা যাচ্ছে। সুস্বাস্থ্যের অধিকারিণী কপিলার উন্নত বক্ষ তখনো শঙ্কহীন নিঃশ্বাসের সাথে সাথে উঠছে নামছে, নামছে উঠছে। অনিন্দ্য তখনো একটি স্ক্রু-ডাইভার খুঁজছে। ০





লেখক পরিচিতি
দীপংকর গৌতম
কোটালীপাড়া, গোপালগঞ্জ।

ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিকে কর্মরত। বাংলাদেশের বামপন্থী রাজনীতির সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত। কবিতা, প্রবন্ধ, অনুবাদ, গবেষণাসহ প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১২টি। সাংবাদিকতা ও সাহিত্যের জন্য পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার।
+৮৮ ০১৭১৫ ৮১৬১৬৯

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ