কথামুখ ও ভাষান্তর : এমদাদ রহমান
[ওয়াশিংটন আরভিং একাধারে ছোটগল্পকার, ঔপন্যাসিক, ঐতিহাসিক এবং
পর্যটক। আত্মজীবনী, ইতিহাস আর ভ্রমণ-অভিজ্ঞতা নিয়ে তাঁর রচনার পরিমাণ বিপুল।
জন্ম ৩ এপ্রিল ১৭৪৩, নিউইয়র্কে। পিতা-মাতার এগারোতম সন্তান আরভিংয়ের সারাজীবনের
প্রিয় বিষয় পর্যটন, রবিনসন ক্রুশোর দ্বারা মারাত্মকরকম প্রভাবিত ছিলেন তিনি।
পড়াশোনা করেছেন আইন বিষয়ে। আজীবন ভগ্নস্বাস্থ্যের অধিকারী আরভিং মারা যান ২৮ নভেম্বর
১৮৫৯ সালে। চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন নিউইয়র্কের টেরিটাউন অল্ড ডাচ্ চার্চের সমাধিস্থলে।
তাঁর রচনাবলী বিশ্বসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ সব লেখকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। চার্লস
ডিকেন্স, স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজ, লর্ড জর্জ গর্ডন বায়রন এবং তাঁর বন্ধু স্যার ওয়াল্টার স্কট
তাঁর উইট এবং হিউমারের প্রশংসা করেছেন। The Life and
Voyages of Christopher Columbus, The Legend of Sleepy Hollow, Rip Van Wrinkle,
The Specter Bridegroom তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা।]
If that severe doom of Synesius be true,-
ÔIt is a
greater offence to steal dead men's labor, than their clothes,Õ
Íwhat shall become of most writers?
Burton's Anatomy Of Melancholy.
ছাপাখানার চরম বিকাশ আর কীভাবে
যে বিষয়টা অগ্রসর হয়েছে বহুজনের চিন্তাধারার ফসল থেকে, সেই কথাটি ভেবেই আমি প্রতিনিয়ত
বিস্মিত হই। কী অদ্ভুতভাবেই না প্রকৃতির বন্ধ্যাত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়ে সৃষ্টির
বিপুল পরিমাণকে ধারণ করে আছে। একজন মানুষ যেমন করে পর্যটন করে-সে যেভাবেই হোক না কেন-জীবনের
চলার পথে তার বিস্ময়ের বস্তুগুলো প্রতিদিনই কমতে থাকে আর সে প্রতিনিয়তই খুঁজে বের করে
মহান আর আশ্চর্যজনক সরল কিছু যুক্তিকে। এইভাবে, অনেকটা দৈবক্রমেই, পরদেশে অবস্থানকালে, সেইসব অতিকায়
শহরগুলিতে, হঠাৎ করেই
মুখোমুখি হয়ে পড়েছিলাম কিছু দৃশ্যের, যে-দৃশ্যগুলি
আমাকে উন্মোচিত করে দেখিয়ে দিয়েছে বই-তৈরি-করার গূঢ়তম শিল্প কুশলতাগুলো এবং এটা আমাকে
মহাবিস্ময়ের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে। এক গ্রীষ্মের দিনে আমি ভবঘুরেদের মতো ইতস্তত
ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম ব্রিটিশ মিউজিয়ামের সুপরিসর কক্ষগুলোর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।
সেই অনীহাকে সঙ্গী করে, যা কিনা কোনো মিউজিয়ামের অভ্যন্তরের মোটামুটি উষ্ণ আবহাওয়াতে
এগিয়ে যাওয়ার প্রবণতাকে মন্থর করে দেয়। মাঝে মাঝে অলস দৃষ্টি মেলে আকরিকভর্তি কাচের
বাক্সগুলির দিকে তাকিয়ে আর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মিশরীয় মমির ওপর লিখিত গূঢ়লিপি হায়রোগ্লিফিক্স
পড়ার চেষ্টা করে ধ্যানস্থ হয়ে পড়েছিলাম। গভীর মনোযোগে উপলব্ধি করার চেষ্টা করছিলাম
মিউজিয়ামের সুউচ্চ ছাদগুলোয় টানানো প্রতীকাশ্রয়ী চিত্রকর্মগুলিকে। যতক্ষণ না আমি স্থির
দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলাম আমার অভিনিবেশ আকৃষ্ট করছিল অনতিদূরের একটা দরোজা, যার অবস্থান ছিল
ভবনটির একেবারে শেষ কক্ষটির কাছে। দরোজাটা বন্ধ করাই ছিল, কিন্তু নিয়মিত বিরতিতে কেউ না কেউ
ধাক্কা মেরে খুলে ফেলছিল তাকে এবং দেখা যাচ্ছিল কালো আচ্ছাদনে ঢাকা কিছু কিম্ভুতদর্শন
জীবকে, তারা খুব সাবধানে এদিক ওদিক নড়াচড়া করছিল যেন কক্ষের ভেতরকার জিনিসগুলোকে তারা
তাদের অস্তিত্ব বুঝতে দিতে রাজি নয়। আর পুরো কক্ষের আবহাওয়াটিকে তারা আরো বেশি করে
রহস্য দিয়ে ঢেকে রেখেছে, যা কি না আমার জড়তা কাটিয়ে প্রচণ্ড কৌতূহল জাগিয়ে দেয়।
আর আমিও ঠিক করি যে গিয়ে দেখা যাক
দরদালানের একটুখানি জায়গায় আসলে ঠিক কী ঘটছে। ভেতরে অনাবিষ্কৃত কোনো ভূগোল আবিষ্কারের
একটা তীব্র আকাঙ্খাও জেগে উঠেছিল। দরোজাটি দখলকৃত কোনো কিছুর মতো আমার বশ্যতা স্বীকার
করে, যেন মন্ত্রবশীভূত কোনো দুর্গদ্বার বশ্যতা স্বীকার করে মধ্যযুগের সেইসব বীর যোদ্ধাদের
কাছে, যারা রোমাঞ্চকর অভিযানে বেরিয়ে পড়তেন কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে। আমি নিজেকে
খুঁজে পাই এক সুপ্রশস্ত দপ্তরের অভ্যন্তরে। যার চারপাশে পরম পূজনীয় গ্রন্থগুলোকে বাক্সে
বাক্সে বন্দি করে রাখা হয়েছে। বাক্সগুলোর ওপরে আর কার্নিশের ঠিক নিচের দিকে রয়েছে কালোরঙে
আঁকা প্রাচীন রচয়িতাদের বিপুলসংখ্যক প্রতিকৃতি। কক্ষটির ভেতর পাতা হয়েছে লম্বা লম্বা
টেবিল, যেগুলিতে রয়েছে একইসঙ্গে পাঠ আর লেখা চালিয়ে যাওয়ার বিশেষ ব্যবস্থা। আর সেখানে
ধ্যানস্থ বসে আছে বহুসংখ্যক বিষণ্নমুখ পাঠ-আসক্ত সম্মানীত ব্যক্তি। গভীর মনোনিবেশ আর
চিত্তের একাগ্রতায় তারা তাকিয়ে আছে ধূলিধূসরিত বইয়ের খণ্ডগুলির ওপর। তন্ন তন্ন করে
খুঁজে চলেছে মরচেধরা জরাজীর্ণ পাণ্ডুলিপিগুলি আর বিপুল পরিমাণ তথ্যকে সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ
করে নিচ্ছে টুকরো টুকরো কাগজে। রহস্যময় ভবনটির ভেতর চাপা নীরবতা যেন আধিপত্য বিস্তার
করে রেখেছে। শুধুমাত্র এটাই ব্যতিক্রম যে তুমি শুধু শুনতে পাচ্ছো কাগজের ওপর লেখনীর
দ্রুততম খসখস আর প্রাচীন জীর্ণ কাগজের ফর্দগুলোকে ওল্টানোর জন্য অবস্থান পরিবর্তনজনিত
জ্ঞানবৃদ্ধ ঋষিদের গভীর শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দগুলো। নিঃসংশয়ে বলা যায় যে, এইসব উদ্ভূত হয়
ফাঁপা, শূন্যগর্ভ, কপট পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণার উপাখ্যানগুলো থেকেই।
কখনো কখনো এইসব পাঠ-আসক্ত সম্মানিত
ব্যক্তিগণ কাগজের ছোট্ট টুকরোয় কিছু কিছু বিষয় লিপিবদ্ধ করে রাখে আর বিস্মৃত কোনো বিষয়কে
পুনরায় তাদের স্মৃতিতে জাগিয়ে তোলে। যার ফলে সৃষ্টি হয় এক অন্তরঙ্গ অভিনিবেশ। প্রগাঢ়
নীরবতার ভেতর তারা হাতে তুলে নিচ্ছে কাগজের খণ্ডগুলিকে, তারপর ধীরে ধীরে বের হয়ে পড়ছে কক্ষ
থেকে আর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই স্থূলকায় নীরস গ্রন্থগুলোর ওপর চড়াও হচ্ছে। যখন অন্যরা
চড়তে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে নিচে পড়ে যায়, তখনই তারা সর্বগ্রাসী ক্ষুধা নিয়ে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে প্রাণান্ত
পরিশ্রম করে ফের বইগুলোর ওপর বেয়ে উঠবার জন্য। অল্পকিছুক্ষণের মধ্যেই আমার ভেতর জন্ম
নেয় এই সংশয়ের যে, আমি দৈবক্রমে পরিণত হয়ে গেছি পারসিক পুরোহিতমণ্ডলীর একজন, আর গভীর ধ্যানে
মগ্ন আছি গুপ্তবিদ্যার চর্চায়। আর এই ভাবনাটি আমাকে খুব দ্রুত মনে পড়িয়ে দেয় এক আরব্য
উপাখ্যান, যেখানে এক দার্শনিক পর্বতের গভীরতম জায়গায় জাদুবিদ্যার এক বিপুল সংগ্রহের গ্রন্থাগারে
দরোজা-জানলা বন্ধ করে বসে আছে, যে গ্রন্থাগারটির প্রবেশদ্বার খোলা হয় বছরে মাত্র একবার, আর দার্শনিকটি
অন্ধকার জ্ঞান থেকে জায়গাটির অন্তঃস্থিত অতিপ্রাকৃত সত্তাটিকে জাগিয়ে তোলে, যাতে করে বছরের
শেষ দিকে গ্রন্থাগারের মন্ত্রপূত প্রবেশদ্বারটি আর একবার তার কব্জাগুলোকে আন্দোলিত
করে খুলে যেতে পারে। দার্শনিকটি প্রাজ্ঞতার সঙ্গে আওড়াতে থাকে নিষিদ্ধ মন্ত্র, যাতে জায়গাটি
অগুন্তি মানুষের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যেতে সক্ষম হয় আর প্রকৃতির শক্তিমত্তাকে নিজ হাতে
নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা অর্জন করতে পারে।
আমার ঔৎসুক্য পুরোমাত্রায় জেগে
উঠেছে। বোধহয় কক্ষটি থেকে এখনই বেরিয়ে পড়বেন এমন একজনকে ফিসফিস করে আমার সম্মুখে ঘটে
যাওয়া অদ্ভুত দৃশ্যগুলির একটা ব্যাখ্যান প্রার্থনা করলাম। জানতে চাওয়ার জন্য অবশ্য
ফিসফিসানিটাই যথেষ্ট ছিল। আমি বুঝলাম যে এইসব অদ্ভুত রহস্যময় জ্ঞানী আর সম্মানিত ব্যক্তিগণ-যাদেরকে
আমি প্রাচীন পারসিক পুরোহিতমণ্ডলীর সভ্য বলে ভুল করেছিলাম--তারা মূলত লেখক। তাদেরকে
বই উৎপাদন করবার সময় আমি দেখে ফেলেছি। বস্তুত, আমি অবস্থান করছিলাম মহান ব্রিটিশ
গ্রন্থাগারের পাঠঘরে, যেখানে বিভিন্ন বয়সের আর ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় লিখিত বিপুলসংখ্যক
গ্রন্থ, যাদের মধ্যে অনেকগুলির কথা লোকে বেমালুম ভুলে গেছে আর কিছু কিছু বই আছে যেগুলিকে
লোকে হয়তো কালেভদ্রে হাতে নেয়। এইসব সেকেলে অপ্রচল বইয়ের একটি ঢিবিকে আধুনিককালের লেখকরা
মেরামত করছেন, আর বালতি ভরে নিয়ে আসছেন ধ্রুপদী লোক-বিদ্যা কিংবা ‘খাঁটি ইংরেজ, বিশুদ্ধ আর নিষ্কণ্টক’ বইগুলো, যেগুলোর সাহায্যে তারা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলবেন
তাদের টেনেটুনে কুলিয়ে যাওয়ার মতো চিন্তনের ক্ষুদ্রকায় নদীগুলিকে। অগোচরে কোনোকিছুর
অধিকারী বনে যাওয়ার মতো একটা কোণে বসে বসে বই তৈরির কারখানার বিচিত্র কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ
করছিলাম। প্রচুর উৎপাদন-অক্ষম একজন খিটখিটে রোগামতো লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। লোকটা
কোনো শব্দ করছে না অথচ বহুদিনের পুরোনো কীটদষ্ট জীর্ণ বইয়ের খণ্ডগুলিকে পুনরায় কালো
কালো অক্ষরে সে মুদ্রিত করছিল। সত্যিকার অর্থেই লোকটা এমন এক জ্ঞানগর্ভ বইকে পুনঃনির্মাণ
করছিল, যারা নিজেদেরকে পণ্ডিত বা
বিদ্বান হিসেবে ভেবে থাকে তারা এই জ্ঞানকে বাজার থেকে কিনে নিয়ে যাবে আর এমনভাবে তুলে
রাখবে বই রাখবার তাকিয়াগুলোয়, যাতে
তা খুব সহজেই অন্যের নজরে পড়ে অথবা সেগুলিকে তারা ঘুম পাড়িয়ে রাখবে পড়ার টেবিলে-কিন্তু
ভুলেও কখনো পড়ে দেখবে না। আমি এমন একজনকে দেখতে পাচ্ছিলাম,
যে তার জেব থেকে বের করছে বিস্কুটের টুকরো আর তাতে কামড়াচ্ছে
একনাগাড়ে। ধরে নিই যে এটাই তার দিনের প্রধান খাবার। সে তার পাকস্থলীটাকে বাঁচাতে কিংবা
তৃষ্ণা উদ্রেককারী কোনো কিছুর হাত থেকে রক্ষার জন্য বিস্কুট খাওয়াটাকেই এখন উত্তম বলে
ভাবছে। আমি তার এই অসহায় অবস্থার কথা বিবেচনা করে
এই প্রচণ্ড পরিশ্রমী ছাত্রটির কাছ
থেকে পালিয়ে বাঁচি।
এখানে আছেন একজন ভদ্দরলোক, ছোটখাটো আর চৌকস
চেহারা, অত্যন্ত পরিপাটি পোশাকে আবৃত কিন্তু পরচর্চায় মশগুল এক প্রসন্ন অভিব্যক্তি তার
পুরো চেহারায় মূর্ত। তার রয়েছে এমন একজন লেখকের মতো হাবভাব, যার সঙ্গে পুস্তক
প্রকাশক ও বিক্রেতাদের রয়েছে চমৎকার বোঝাপড়া। মনোযোগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করে আমি বুঝতে
পারলাম যে তিনি একজন বহুপ্রসবিনী লেখক, যার মধ্যে রয়েছে পাঁচমিশালি ধরনের প্রচুর লেখালেখির কঠোর
অধ্যবসায়, যা ব্যবসায়িক দিক থেকে তুমুল হৈচৈ ফেলে দেবার মতোই একটা কিমাকার ব্যাপার। আমি
প্রচণ্ড কৌতূহলী হই এটা দেখে যে
কীভাবে তিনি তার পণ্যসামগ্রীগুলি
উৎপাদন করেছেন! তিনি তৈরি করেছেন চরম উত্তেজনা আর চমৎকার এক ব্যবসায়িক প্রদর্শনী; অন্য লেখকদের
তুলনায়। বিভিন্ন লেখকের বইপত্র ঘেটে তিনি বারবার চমক সৃষ্টি করছেন। পাণ্ডুলিপির পাতাগুলির
ওপর তার মন প্রচণ্ড অস্থির। টান মেরে বিভিন্ন পাণ্ডুলিপির ভেতর থেকে তিনি ছোট ছোট টুকরো
বের করে আনছেন, ‘পঙ্ক্তির ওপর
পঙ্ক্তি চাপছে, বিধির ওপর চেপে যাচ্ছে বিধান, একমুঠো একমুঠো করে, এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে,’ আর এই লেখক-রচিত
গ্রন্থটির বিষয়বস্তুটাও এমন কিম্ভূত যে মনে হচ্ছে ম্যাকবেথের ডাইনীরা সব ঢুকে পড়েছে
বিশাল এক কড়াইয়ের ভেতর। এটা এমনই জবরজঙ্গ, যেন ব্যাঙের পায়ের আঙুল আর কেঁচোর
হুল। তার খোশগল্পের সঙ্গে বাহিত হচ্ছে কুকুরমুখী বানরের রক্ত, ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির
জিনিস দিয়ে তৈরি এক কিমাকার মিশ্রণ।
এসব সত্ত্বেও, আমার ভাবনা হলো, এইসব চৌর্যবৃত্তিক
প্রবণতা কি রচয়িতাদের ভেতর জেগে ওঠে কোনো বিচক্ষণ উদ্দেশ্য থেকে? যদি এটা না হয়, তাহলে এই ধরনের
পদ্ধতিতে কি দূরদর্শিতাই মূল ভূমিকা পালন করে? জ্ঞান আর প্রজ্ঞার বীজ কালের পর
কাল ধরে সংরক্ষিত হয় এইসব কর্মকাণ্ডের অনিবার্য ধ্বংস আর ক্ষয় সত্ত্বেও। আমরা দেখেছি
যে প্রকৃতি বিচক্ষণতার সঙ্গে তার খেয়ালি মর্জির মাধ্যমে যথার্থভাবেই ভূখণ্ড থেকে ভূখণ্ডে
আর ঋতু থেকে ঋতুতে বীজগুলো পরিবহন করে। আর এই প্রক্রিয়াটির বাহক হয় বিভিন্ন ধরনের প্রাণীর
পাকস্থলী। যে-প্রাণীগুলো গলিত শব খেয়ে বাঁচে, বাহক-প্রাণীগুলো তাদের চেয়ে খানিকটা
উত্তম আর স্পষ্টতই, যথেচ্ছাচারী লুটেরাদের দ্বারা দখলকরা ফুলবাগান আর ভুট্টাক্ষেতগুলোর
চারপাশে প্রকৃতিই তার বীজগুলো ছড়িয়ে দেয়; বিস্মৃতি আর বিলোপের হাত থেকে সবকিছুকে বাঁচিয়ে রাখে তার
মহান অনুগ্রহে। বিভিন্ন ধরনের কৌশল আর প্রকরণের মতোই প্রাচীন আর অপ্রচল রচয়িতাদের সৌন্দর্য
আর সূক্ষ্ম চিন্তনগুলি লুটেরা উড়ন্ত লেখকদের দ্বারা হয়তো টিকে থাকে আর সামনেও এগিয়ে
যায়, পুনর্বার জেগে ওঠে আর তার ফল বাহিত হয় বহুদূরবর্তী অদৃষ্ট কোনো সময়ের গতিপথে।
কাল-পরিক্রমায় প্রাচীন রচয়িতাদের বহু কাজ মানুষের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই পুনর্জন্ম লাভ
করে এবং নতুন রূপে আর ধরনে আমাদের কালের সামনে উপস্থিত হয়। কী রকম ছিল আদিকালের স্থূলকায়
ইতিহাস, প্রাচীন উপাখ্যানগুলোর বিলুপ্ত গড়ন আর লেখন-কুশলতা? প্রাচীন আখ্যানের একজন বীর বদলে
যাচ্ছে আজকের রঙ্গমঞ্চে, আর গুরুগম্ভীর দার্শনিক আলোচনাগ্রন্থগুলি ঘষামাজা হয়ে তৈরি
হচ্ছে দ্যুতিময় প্রবন্ধগুচ্ছ; ব্যাপারটা ঠিক এইরকম-আমাদের আমেরিকার বনভূমিগুলি সাফ করে
তৈরি করা হচ্ছে খোলামেলা জায়গা, আমরা আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছি দৃষ্টিনন্দন চিরহরিৎ পাইনের সারি
আর ছোট্ট ওকের সন্তান-সন্ততিরা আমাদের অবাক করে দিয়ে পুনর্বার মাথা তুলে জেগে উঠেছে
আর আমরা কোনোভাবেই দেখতে পাচ্ছি না মাটিতে মিশে যাওয়া বৃক্ষের পচা গুঁড়িগুলিকে, কিন্তু ঝুরঝুরে
উর্বর মৃত্তিকা অগোচরেই জন্ম সম্ভব করে ফেলেছে একরাশ সবুজ ছত্রাক!
ধ্বংসের জন্য বিলাপ আর বিস্মরণই
আমাদের নিয়তি এখন, যেমনটি করে গেছেন প্রাচীন রচয়িতারা, কিন্তু তারা সমর্পিত
হয়ে গেছেন প্রকৃতির মহান নিয়মের কাছে, যা এটাই ঘোষণা করছে যে সমস্ত পার্থিব বস্তুর গড়ন তাদের স্থিতিকালে
খুবই নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু কারো আদেশে তাদের মৌল উপাদানগুলো কখনোই বিলুপ্ত হয় না। প্রজন্মের
পর প্রজন্ম ধরে প্রাণী আর গাছগাছড়াগুলি জন্ম নেয় আর ধ্বংস হয়, কিন্তু মৌলিক
বিধিবিধানগুলি প্রজন্ম পরম্পরায় বাহিত হতে থাকে, তাতে প্রজাতিগুলি বেড়ে চলে নিয়মিতভাবেই।
প্রক্রিয়াটা এমন যে এভাবেই এক লেখকের ভেতর থেকে জন্ম নেন আরেক লেখক, আর বারবার তাদের
কাছ থেকে জন্ম হয় তাদের সন্তান-সন্ততিদের, ঠিক যেমনভাবে পৃথিবীর আদিম দিনগুলোয়
সন্ততিরা ঘুমিয়ে থাকতো তাদের পিতার পাশে। বলা যায়, লেখকের হাত ধরেই লেখক এগিয়ে যায়, আজকের লেখকরা
যাদের রচনাকে অনরবত চুরি করছে।
স্তুপ করে রাখা মুদ্রিত পৃষ্ঠাগুলি
সম্পর্কে আমার ভেতর কিছু অলীক ধারণা জন্ম নিচ্ছিল, মাথার ভেতর ক্রমেই জেঁকে বসছিল
আর ভেতরে জেগে উঠছিল এক ধরনের পরিতৃপ্তি, এর কারণ হয়তো পাঠঘরের ভেতরকার প্রগাঢ় নীরবতা অথবা প্রচণ্ড
বিস্ময় থেকে জন্ম নেয়া ক্লান্তি; অথবা, দৈহিক বা মানসিক দিক দিয়ে নিদারুণ ক্লেশের সঙ্গে সময় আর স্থানের
ভ্রান্তিজনিত দুর্ভোগ ডেকে আনা কোনও ‘অশুভ’ অভ্যাস।
ফলে আমি তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম। যদিও, বাস্তবিক অর্থেই, আমার
কল্পনাশক্তি অবিরত কাজ করছিল আর একইরকম দৃশ্যাবলী যেন মনের চোখে খেলা করছিল, শুধু তাদের বিস্তৃতিতেই খানিকটা বদল ঘটছিল। আমি
স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো দেখছিলাম যে পাঠঘরটি এখনও প্রাচীন রচয়িতাদের প্রতিকৃতি দিয়েই সাজানো
রয়েছে, শুধু সংখ্যায় তা আগের চেয়ে
অনেক বেড়ে গেছে। লম্বা টেবিলগুলি অন্তর্ধান করেছে আর সেখানে মহাজ্ঞানী পুরোহিতগণ বসে
আছেন। আমার মনে হলো জীর্ণ আর মলিন পোশাক পরে বসে আছে জনতার একটি সংঘ, যেন মুনমাউথ সড়কের কোনো রঙ্গমঞ্চ, যেখানে গুদামঘরে রক্ষিত পরিত্যক্ত পোশাকের প্রদর্শনী
চলছে। যখনই তারা কোনো বইকে হাতের নাগালে পাচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে চড়াও হচ্ছে তার ওপর। যেন এক অসমঞ্জস স্বপ্ন রূপান্তরিত হচ্ছে
ভিনদেশী কিংবা পুরোনোরীতির এক পোশাকে, যার দ্বারা সজ্জিত হয়ে সবাই সামনে অগ্রসর হচ্ছে। আমার ধারণা যে, কেউই পোশাক পরতে গিয়ে কোনো ভান বা ছল করছে না, নিজেদের জন্য উপযোগী পোশাকটি দিয়েই তারা নিজেদের
সজ্জিত করছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা একটা জামা থেকে নিচ্ছে তার হাতা, বাকি অংশ নিচ্ছে অন্য জামাটি থেকে আর এভাবে নিজেদের
তারা খণ্ডিত করে ধ্বংস করে ফেলছে। তবে, ‘খাঁটি’ কিছু ছেঁড়া
টুকরো উঁকি মারছে তাদের ধার-করা জমকালো পোশাক থেকে।
পাঠঘরে আরেকজন আছেন, যিনি ননীর পুতুলের
মতো গোলগাল আর গোলাপরঙা, যাকে নিরীক্ষণ করছিলাম চশমার কাচের ভেতর দিয়ে। তিনি লোলুপ
দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিলেন আর বসে ছিলেন বাক্চতুর লেখকদের ভিড়ে। মনে হচ্ছিল যে তিনি প্রাচীন
পিতাদের বিপুলায়তন আলখাল্লার ভেতর এখনই ঢুকে পড়বেন আর তাদের একজনের ধূসর দাড়িগুলিকে
লুট করবেন, চেষ্টা করবেন প্রতিভার চূড়ান্ত রূপটা ফুটিয়ে তুলতে, কিন্তু তাতে কী হবে? বৈশিষ্ট্যহীন
কপট আত্মতৃপ্ত হাসিকে অবজ্ঞা করে জেগে উঠবে প্রজ্ঞার কৃত্রিম প্রতীক।
এক রোগা ভদ্রলোক সোনালি সুতোয় একটা
ফিনফিনে পোশাক সেলাইয়ে ব্যস্ত ছিলেন, যে-সোনালি সুতো সংগৃহীত হয়েছে রানি এলিজাবেথের আমলের আদালতের
পোশাক থেকে। আরেকজন এক অলংকৃত পাণ্ডুলিপি থেকে নিজেকে জমকালো রঙে সজ্জিত করছেন। তিনি
তার বুকে ধরে রেখেছেন এক তোড়া সুগন্ধি ফুল, যা সংগৃহীত হয়েছে দ্য প্যারাডাইজ
অব ডেইন্টি ডিভাইজ থেকে আর স্যার ফিলিপ সিডনির টুপিকে মাথার একপাশে হেলিয়ে রেখেছেন, যেন এভাবেই দূর
হয় পোশাকের অশ্লীলতা। তৃতীয় একজন, যিনি মাত্রার দিক থেকে দেখলে খুবই ক্ষুদ্র, যিনি খুব সাহসের
সঙ্গেই দর্শনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুস্তিকাগুলিকে মোকাবেলা করছেন। তার সামনের দিকটা দৃষ্টিনন্দন
আর দুঃখজনকভাবে তার পাছা থেকে জীর্ণ ন্যাকড়ার ফালিগুলি বের হয়ে আছে। আমি উপলব্ধি করলাম
যে তিনি তার পোশাকটিতে তালি মেরেছেন একজন লাতিন লেখকের চামড়ায় লিখিত পাণ্ডুলিপির টুটাফাটা
অংশ দিয়ে। এদিকে আরো কিছু চমৎকার পোশাকের ভদ্রজনকে দেখা যাচ্ছে যারা নিজেদেরকে সাহায্য
করেছেন মণিরত্ন দিয়ে, যেগুলো ঝলকাচ্ছে তাদের গহনাগুলোর সঙ্গে। কয়েকজনকে দেখলাম
প্রাচীন রচয়িতাদের পোশাক-আশাকের প্রতি গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন শুধুমাত্র তাদের
রচিত মূল তত্ত্ব আর সূত্রগুলিকে আত্মসাৎ করার জন্য এবং তাদের শক্তিমত্তাকে ধরে ফেলবার
জন্য, কিন্তু অতীব দুঃখের সঙ্গে বলতে চাচ্ছি যে অনেকেই মাথা থেকে পা পর্যন্ত জোড়াতালি
দিয়ে কোনো কিছু তৈরি করার পদ্ধতির মতো নিজেদেরকে
সজ্জিত করার প্রবণতাটুকু জাগিয়ে রেখেছেন। তবে কিছুতেই আরেকজন প্রতিভাবান সম্পর্কে কিছু
বলার লোভ সামলাতে পারছি না। লোকটার গায়ে মেটেরঙ আটোসাটো পোশাক, মাথায় আর্কেডিয়ার
টুপি, গ্রামীণ জনপদের প্রতি তার রয়েছে অসীম অনুরাগ, কিন্তু গ্রামীণ পরিবেশে তার দীর্ঘ
ভ্রমণের অভিজ্ঞতাটি একালের ঘুরে ফিরে মনে আসা চিরায়ত প্রমিজ হিল আর রিজেন্ট পার্কের
নির্জনতাতেই সীমাবদ্ধ। নিজেকে তিনি সাজিয়ে নিয়েছেন মালা আর রঙিন ফিতা দিয়ে, যা সংগৃহীত হয়েছে
আদিকালের পল্লীকবিদের কাছ থেকে। তার মাথাটা একপাশে ঝুলে আছে। ‘সবুজ ক্ষেতের
ভেতর আগড়ম বাগড়ম’ ধরনের আজগুবি আর ভাবপ্রবণ চিন্তা গ্রহণ করে তিনি পাঠঘর থেকে
বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু যে জ্ঞানী ব্যক্তিটি আমার মনোযোগ বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছেন, তিনি একজন গোঁড়া প্রয়োগবাদী ভদ্রলোক। পরে আছেন
কেরানিদের মতো ঢিলেঢালা পোশাক, সঙ্গে
আছে বিশেষভাবে উল্লেখ করবার মতো বিশাল এক চৌকো টাকপড়া মস্তক। তিনি হাঁপানী রোগীর মতো নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে
পাঠঘরের ভেতর ঢুকে পড়লেন। ভীষণ আত্মপ্রত্যয়ী ভাবভঙ্গির কল্যাণে জনতার ভিড় তাকে খানিকটা
জায়গা ছেড়ে দিল। আট পাতায় মুদ্রিত গ্রিক কোয়ার্টোগুলোর ওপর তিনি হাত রাখলেন, তারপর সেগুলোকে মাথার টাকে ছুঁয়ালেন, রাজকীয় ভঙ্গিতে ভীতিকর কুঞ্চিত পরচুলাটি সরালেন
যেন ঝাঁটা দিয়ে জঞ্জাল সাফ করছেন।
এইসব সাহিত্যাশ্রয়ী ছদ্মবেশী লোকদের
ভিড়ে, আচমকা পাঠঘরের চারপাশ থেকে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে-‘চোর, চোর! একদল চোর...!’ দেখো, চেয়ে দেখো, দেয়ালের প্রতিকৃতিগুলি যেন হঠাৎ করে জীবন্ত হয়ে গেছে! প্রাচীন
লেখকগণ প্রবল বেগে বেরিয়ে আসছেন, ক্যানভাসের ভেতর থেকে প্রথমে মাথা, তারপর কাঁধ। তারা
মুহূর্তের কৌতূহলে তাকিয়ে দেখছেন বিচিত্র জোব্বা পরিহিত ভাঁড়দের, অতঃপর ঝাঁপিয়ে
পড়ছেন, তাদের চোখেমুখে প্রতিহিংসার দাউদাউ আগুন। লুণ্ঠিত সম্পত্তি ফিরে পেতে নিজেদের
মালিকানার দাবি জানাচ্ছেন। হঠাৎ এইরকম দৌড়াদৌড়ি আর হৈহট্টগোল সবাইকে যেন ধাঁধার ভেতর
ফেলে দেয় আর হতভাগ্য অপরাধীরা লুটতরাজ ফেলে চেষ্টা করে পালিয়ে যাওয়ার। তখন পাঠঘরের
একপাশে দেখা যায় একালের অধ্যাপকদের মতো দেখতে কয়েকজন ভিক্ষু আর অন্যপাশে বিষণ্নতায়
ধ্বংস হয়ে যাওয়া একালের চমকসৃষ্টিকারী লেখকসম্প্রদায়। বিমাউন্ট আর ফ্লেচার, একত্রে পাশাপাশি, যেন পুরো এলাকা
প্রচণ্ড ক্ষোভে ক্যাস্টর আর পোলাক্সের মতো দুর্বার ক্রোধে উন্মত্ত আর দৃঢ়াঙ্গ বেন জনসন দেখাচ্ছেন
দারুণ সব চমক, যেমনটি ফ্লেন্ডারের সেনাবাহিনীর স্বেচ্ছাসেবকরা দেখিয়ে থাকে। একজন ছোটখাটো জগাখিচুড়ির
সম্পাদকের কথা প্রায়ই মনে পড়ে, যে নিজেকে সজ্জিত করে কমেডিগুলোয় আবির্ভূত বিচিত্র পোশাকের
ভাঁড়দের মতো। নিজের সম্পর্কে তর্ক-বিতর্কে ভয়াবহ যুক্তি প্রর্দশনকারী হিসেবে দাবি করবার
স্বভাব আছে তার, পেট্টোক্লাসের মরদেহ নিয়ে ভাবতে বসলে ঠিক যে-রকম হয়। এমন বহুজনকে দেখে আমি তীব্র
শোক অনুভব করলাম, যারা তাদের নগ্নতা ঢেকে ফেলবার জন্য দুষ্পাপ্য ন্যাকড়া নিয়ে আহ্লাদিত। আমার চোখ সেই গ্রিসের পরচুলা
পরিহিত গোঁড়া ভদ্রলোকটিকে দেখতে থাকে, যে কিনা দুর্গম বন্ধুর ভূমিতে হামাগুড়ি দিতে দিতে দূরে চলে
গেছে লেখকদের চিৎকার থেকে জেগে ওঠা আকস্মিক বেদনায়। লেখকরা লোকটির পেছনে জড়ো হন, আর তখন তার পরচুলাটি
দীপ্তি ছড়াতে থাকে। তার পোশাকের টুকরোগুলি এমনভাবে দুলছে যেন শরীরকে এখনই নগ্ন করে
ফেলবে। পাছা থেকে লটকে থাকা জীর্ণ কাপড়ের ফালি পাঠঘর থেকে তার চলে যাবার দৃশ্যটিকে
সাজিয়ে নেয়।
এমন এক হাস্যকর আকস্মিক বিপর্যয়
লুকিয়ে রয়েছে শিক্ষিত থীবস্ অধিবাসীটির মধ্যে যে আমি অপরিমিত দমকা হাসিতে কথা বলতে
শুরু করলাম, যা পাঠঘরের সমস্ত বিভ্রমকে খানখান করে ভেঙে ফেলল। তুমুল বিক্ষোভ আর মারপিট সমাপ্ত হলো এখানেই।
ঘরটিও তার পূর্বের গুরুগম্ভীর পরিবেশ ফিরে পেল। প্রাচীন রচয়িতাগণ পুনরায় ফিরে যেতে
লাগলেন ছবির ফ্রেমের ভেতর আর ভাবগম্ভীর ছায়াচ্ছন্নতায় তারা ঝুলে পড়লেন দেয়ালের গায়ে
গায়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেকে সজাগ-সতর্ক অবস্থায় নিয়ে এলাম ঘরের কোণের দিকে। গ্রন্থখেকো
কৃমিকীটগুলোও আমার সঙ্গে বিস্ময়বিহ্বল হয়ে রইল। স্বপ্নের কোনোকিছুই বাস্তব নয় কিন্তু
আমার এভাবে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ার শব্দ কেউ কোনোদিন এই পবিত্র কবরস্থানে কখনোই শুনেনি
আর প্রজ্ঞাময় কানগুলোয় তা এতো বিতৃষ্ণাও জাগাতে পারেনি কোনোদিন। মনে হলো লেখকসম্প্রদায়
আমার এই অট্টহাসিতে বিদ্যুতায়িত!
গ্রন্থাগারিক এগিয়ে আসছেন এটা দেখতে
যে আমার কাছে প্রবেশপত্র আছে কিনা। আমি বিষয়টা প্রথমে বুঝতেই পারিনি, কিন্তু পরে যেটা
বুঝতে পারলাম তা হলো গ্রন্থাগার হচ্ছে এক ধরনের সাহিত্যিক ‘সংরক্ষণ’, বিধিবিধানের অনুবর্তী হওয়া, যাতে কারো পক্ষেই বিশেষ অনুমোদন
আর অনুমতিপত্র না নিয়ে স্বাধীনভাবে শিকার করার ধৃষ্টতা দেখাতে না পারে। এক কথায় বললে, আমি দাঁড়িয়ে আছি
পুরোদস্তুর অনধিকার প্রবেশকারী দণ্ডিত এক অপরাধীর মতো। তাই, আনন্দচিত্তে পশ্চাদপসরণ
করতে লাগলাম, পাছে বন্দীশালার শিকলমুক্ত এক বোঁচকা লেখক আমার ওপর পতিত না হন।
অনুবাদক পরিচিতি
এমদাদ রহমান
গল্পকার
অনুবাদক।
জন্ম সিলেট, বাংলাদেশ।
বর্তমানে ইংলন্ডে থাকেন।
জন্ম সিলেট, বাংলাদেশ।
বর্তমানে ইংলন্ডে থাকেন।
প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ : পাতালভূমি ও অন্যান্য গল্প।
0 মন্তব্যসমূহ