বেন ওকরি'র গল্প : সোনালী নরক

অনুবাদঃ বিকাশ গণ চৌধুরী 
(বেন ওকরি, জন্ম : ১৯৫৯, নাইজেরিয়ার কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, সেই “The Famished Road”- এর বিখ্যাত লেখক, আমাদের খুব চেনা নাম। যাদের কাছে ইনি নতুন, তাদের বলি, আফ্রিকার উত্তর-আধুনিক এবং উত্তর-ঔপনিবেশিকলেখালেখির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র এই ভাষাশিল্পী লেখেন ইংরেজিতে। বেন-এর যখন দু’বছর বয়স তখন উচ্চশিক্ষার জন্য তার বাবা সপরিবারে লন্ডনে চলে যান ,১৯৬৮তে জীবিকার জন্য ফিরে আসেন লাগোস-এ; বেন-এর প্রথম স্কুলে যাওয়া লন্ডনে, তারপর লাগোস-এ। লাগোসেই শুরু হয় তাঁর নিজস্ব শিকড়ের পরিচয়, গৃহযুদ্ধের অভিজ্ঞতা, আর এই সংস্কৃতিক মিশেলই ভবিষ্যতে বেন-এর রচনায় প্রাণ সঞ্চার করতে থাকে।২০০৯ সালে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর “Tales of Freedom”, যেখানে লেখক হাইকু আর গল্পকে মিশিয়েছেন, এবং লেখালেখির এই বর্গকে নাম দিচ্ছেন “stoku”; এখানে রইল এরকমই একটি ‘স্টোকু’র নমুনা, হে পাঠক, আপনারই পাঠের অপেক্ষায়...)

১.
বাড়িটা ছিল একটা দেশ, আর বাড়িটার সামনে ছিল একটা আস্তাকুঁড়। আর সেই আস্তাকুঁড়ে জমে ছিল এমন সব জিনিষ যা বাতাসে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল। ওখানে ছিল কাদা-জল থেকে পা বের করা একটা মরা গরু। ওটা সব কিছু বিষিয়ে দিচ্ছিল। ওখানে, ওই আস্তকুঁড়ে জলে ডুবে ছিল মোটামোটা সব বই। মনে হয় ওখানে মরা মানুষের লাশও ছিল, কোনমতে হাত-পা বলে চেনা যাওয়া হাত-পাগুলো আস্তাকুঁড় থেকে বেরিয়ে ছিল। এসব আবর্জনার ওপরে ছিল একদিক উঁচু একদিক নিচু একটা হাসপাতালের খাট। আর সেই খাটের ওপর ছিল সেইসব লোকজন যারা সেই আস্তাকুঁড়ের জমে থাকা আবর্জনার দুর্গন্ধে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, আর সেই দুর্গন্ধ ওখান থেকে ছড়িয়ে পড়ছিল বিশ্বময়।

সেই দেশে যা ছিল একটা বাড়ি আমি দেখেছিলাম হাজার হাজার টেবিল আর খড়ে বোনা মাদুর। আর সেইসবের ওপর কখনই সারবে না এরকম রোগে ভোগা অসংখ্য নারী আর পুরুষ। তারা ছিল দুঃস্বপ্নে দেখা মুমুর্ষ লোকজনের শরীরের একটা নরক, যে দুঃস্বপ্ন থেকে মৃত্যু ছাড়া আর কোন জাগরণ নেই। অসীম ছিল তাদের সেই কাতার।

অনেক গন্যমান্য সন্মানীয় লোকজনের সামনে একটা মঞ্চে দাঁড়িয়ে আর্চবিশপ মাইক্রোফোনে একই কথা আউড়ে যাচ্ছিলেন :

“ব্যাপারটা স্বামী-স্ত্রীর মতো, একটা ব্যাপার যা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেই থাকে”।

মনেহয় উনি জানতেন না আর কি বলা যেতে পারে। উনি সমস্যাটা সহজ করার চেষ্টা করছিলেন যাতে করে ওটা ভাগে ভাগে মোকাবিলা করা যায়।

লোকে ভীড় করে দাড়িঁয়ে ছিল। একটা বিষাদ ছেয়ে ছিল তাদের।

হঠাৎ প্লেগ এসে পৃথিবিটাকে বিষণ্ণ করে তুলল।


২.
অবশেষে তারা বাড়ির সামনের সেই বিখ্যাত আস্তাকুঁড়ে, যা ছিল একটা দেশ, মরা গরু, জলে ডোবা বইগুলোর আর মরা মানুষ পাশে জেগে উঠল। একজন বিশ্ববিখ্যাত পপস্টার সেই বাড়িটায় আগ্রহ দেখাল আর খুব মনোযোগ দিতে লাগল। এই ঘটনায় বাড়িটা যেন নিজেই নিজেতে আরো সচেতন হয়ে উঠল। আর এই ঘটনা ঘটতে সময় লাগলো অনেক। আস্তাকুঁড়টার সামনে খেলত বাচ্চারা, আর একটা রহস্যময় অসুখে তারা মরে যেতে লাগলো। অনেকদিন কেউ কিছু করে নি।সবাই এমন ভাব করতো যেন কিছু হয় নি। কিংবা ওটা ওখানে ছিলই না।

টেবিল আর মাদুরগুলোর ওপরে মহিলারা ছিল নগ্ন আর মরছিল দুঃস্বপ্নের ভিতর নির্দয় অসুখের গ্রাসে। একজন মহিলা নড়ে চলেছিল সঙ্গমের ভঙ্গিতে, শরীরটাকে বেঁকিয়ে-চুরিয়ে ও সঙ্গম করছিল হাওয়ার সঙ্গে। করতে ইচ্ছে করছিল বলে ও ওটা করছিল না, ও ওটা করছিল কারণ ওই নড়াচড়া ওর ক্লেশটাকে সহনীয় করে তুলছিল।

ঐসব দোমড়ানো মোচড়ানো, যেন কল্পনারও অতীত এমন নরকে পতিত, শরীরগুলোর ওপর কুয়াশার একটা আবরণ। বিলুপ্তির পথে চলা ঐরকম লক্ষ লক্ষ মানুষ। পৃথিবীর সবাই একাকী এক বোবা কষ্টের মধ্যে মরতে থাকা এইসব মানুষদের দেখে চলেছে।

কারো কারো ভাবনাচিন্তা ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে, কিন্তু প্রকাশ পাচ্ছে না। কেউ কেউ ভিতরে ভিতরে শয়তান।ভাবনাটা এরকম : ওদের মেরে ফেলা উচিৎ।

কে পালের বাতাস দেবে এরকম একটা গণহত্যার ভাবনার, এরকম একটা গণ-বিতারনের চিন্তার ?



৩.
ওদের এই দীর্ঘ নিঃসঙ্গ মৃত্যুর দিকে তাকিয়ে থাকতে আমরা বাধ্য ছিলাম।

আরো লোকজ়ন যাতে এই সংখ্যা না বাড়ায় আমরা তা আটকানোর চেষ্টা করছিলাম।

বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল নানান ভাবনা। আমাদের দুঃখের নিচু-পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াচ্ছিল সেইসব কিছু চরম, কিছু আধ্যাত্মিক, কিছু বাস্তব ভাবনারা :

‘আমাদের বদলাতে হবেই।লিঙ্গ কখনই পুরো জনজাতির মৃত্যুর দৃষ্টিকোণ হতে পারে না। কামনা-বাসনার উর্দ্ধে উঠতে পারলে আমরা আমাদের পাল্টাতে পারবো। আমরা হয়ে উঠতে পারবো আমাদের প্রভু, নতুন ভবিষ্যতের একটা দারুণ আকষর্ণ।’



৪.
একদিন সেইদিনটা এল যেদিন ঐ বাড়ির লোকজনদের মনে হল অনেক হয়েছে। একজন ভদ্রমহিলা একজোড়া বুটজুতো যোগাড় করে সেই আস্তাকুঁড়ে গেল আর খুঁজে খুঁজে সব তুলতে লাগল। পুঁতিগন্ধময় জল ঢুকতে লাগল বুটের ভিতর, সহ্যাতীত সে দুর্গন্ধ, কিন্তু মহিলা অটল। তিনি একহাতে দারুন পরিশ্রমে সব পরিষ্কার করতে থাকলেন। একা। আমরা তাকে দেখছিলাম আবার দেখছিলামও না। আর তারপর, ক্রমে ক্রমে, লোকজন যোগ দিতে লাগল। অনেক কষ্ট করে তারা সেই বিখ্যাত আস্তাকুঁড়টায় ঢুকল। তারা তুলে ফেলল সেই হাসপাতালের বিছানা, বের করে আনলো ডুবন্ত সব বই। তারা দড়ি বেঁধে সেই মরা গরুটা তুলে একটা ট্রাকের পিছনে ফেলে দিল। অনেক দূরে নিয়ে গিয়ে তারা সেটাকে একটা গভীর গর্ত খুঁড়ে পুঁতে ফেললো, কেউ কেউ ভাবল ওটাকে পুরিয়ে ফেলা উচিৎ। তারা যে বাতাসে নিঃশ্বাস নেবে সেটা মৃত্যুতে ভরে থাকবে তা অন্যরা ভাবতেই পারলো না। তারা আস্তাকুঁড় থেকে সব লাশ

খুঁড়ে বার করে ওগুলোকেও সন্মান দিয়ে কবর দিল।

একদিনের জন্য অনেক কাজ হল। একটা প্রতীক-দিন। যদিও, সেই আস্তাকুঁড়টার অন্য অনেক বিষণ্ণ রহস্য ছিল। তখনও ওখানে কাদা আর অনেক নোংরার মধ্যে হাসপাতালের সেই বিছানাটা পড়ে ছিল। তবে এখন আস্তাকুঁড়টা আগের থেকে অনেক ফাকাঁ। খুব কম লোক এখন মারা যাচ্ছে। খুব কম লোক আক্রান্ত হচ্ছে সেই রহস্যময় রোগে। নিজেদের সম্পর্কে ভালো বোধ করছে লোকজন। সেই দীর্ঘ নেতির অবসান হয়েছে। সাময়িকভাবে, শিশুরা আবার খেলতে শুরু করতে পারে সেই বাড়িতে যা ছিল একটা দেশ।





অনুবাদক পরিচিতি
বিকাশ গণ চৌধুরী

আদি নিবাস কুমিল্লা জেলার বুড়িচং গ্রাম হলেও, পাহাড় ঘেরা একটা ছোট্ট শহর দেরাদুনে ১৯৬১ সালে জন্ম, ছোটবেলার অনেকটা সেখানে কাটিয়ে বড় হওয়া কলকাতায়, চাকরিসূত্রে অনেকটা সময় কেটেছে এলাহাবাদ আর মধ্যপ্রদেশের রায়পুরে। বর্তমানে কলকাতার বাসিন্দা... লেখেন কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ; ফরাসি, হিস্পানি, ইংরেজি প্রভৃতি ভাষা থেকে অনুবাদ করেছেন মন্‌পসন্দ নানান লেখা, সম্প্রতি শেষ করেছেন পাবলো নেরুদার শেষ কবিতার বই ‘El libro de las preguntas’ –এর পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ ‘প্রশ্ন-পুঁথি’। দীর্ঘদিন যুগ্মভাবে সম্পাদনা করেছেন সবুজপত্র ‘বিষয়মুখ’।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ