মূলঃ ইউ হুয়া
অনুবাদঃ ফজল হাসান
আমার বাবা ছিলেন একজন সার্জেন ডাক্তার । তার দেহের গড়ন ছিল সুঠাম এবং তার স্বাস্থ্য ছিল অটুট । কথা বলার সময় বাবার কন্ঠস্বর রীতিমত গমগম করতো । কখনো কখনো তিনি অপারেশন টেবিলের সামনে একনাগাড়ে দশ ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে পারতেন । কাজ শেষ করে যখন তিনি অপারেশন কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসতেন, তখন তার চোখেমুখে ক্লান্তি বা অবসাদের কোন চিহ্ন ফুটে উঠতো না । বরং হেঁটে বাড়ি ফেরার সময় তার পায়ের ভারী শব্দে সমস্ত সিঁড়িপথ থপথপ করতো । অ্যাপার্টমেন্টের কাছাকাছি এসে তিনি প্রায়ই পাশের দেওয়ালের দিকে মুখ করে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতেন । তখন হঠাৎ অঝোর ধারায় বৃষ্টি পতনের শব্দের মতো দেওয়ালে তার প্রশ্রাবের একটানা শব্দ শোনা যেত ।
বাবা যখন পঁচিশ বছরের তরতাজা যুবক ছিলেন, তখন তিনি অনিন্দ্য সুন্দরী একজন পোশাক তৈরি কারখানার কর্মীকে বিয়ে করেছিলেন । দু’বছর পর তাদের সংসার আলোকিত করে আসে এক পুত্র সন্তা। সে আমার বড় ভাই । তারপর আরো দু’বছর পরে জন্ম নেয় আরেক পুত্র সস্তান । বাবা-মায়ের সেই দ্বিতীয় পুত্র সন্তানই আমি ।
আমার বয়স যখন আট বছর, তখন আমাদের সার্জেন ডাক্তার বাবা মাঝে মাঝে তার কর্মব্যস্ত জীবন থেকে একদিনের ছুটি নিতেন । সেই সব ছুটির দিনে তিনি আলসেমীর মিহি চাদর গায়ে জড়িয়ে পুরো সকাল ঘুমিয়ে কাটাতেন এবং তাতে প্রচুর আনন্দ পেতেন । বিকেলে দু’ছেলেকে নিয়ে হাঁটতে যেতেন এবং সমুদ্র পাড়ে প্রায় তিন ঘন্টা আমাদের নিয়ে খেলাধূলা করতেন । বাড়ি ফেরার পথে এক ছেলেকে কাঁধে চড়াতেন এবং অন্য ছেলের হাত ধরে হাঁটতেন । যখন পরিবারের সবাই রাতের খাবার খেত, তখন আমাদের চারপাশে রাতের অন্ধকার নেমে আসতো । খাওয়া-দাওয়ার পর সার্জেন ডাক্তার, তার স্ত্রী এবং দু’ছেলে মিলে দরজার বাইরে উঠোনের এক পাশে গোল ছাতার মতো ছড়ানো গাছের নিচে বসে গল্প-গুজবে মশগুল থাকতো । গাছের ডালপালা এবং পাতার ফাঁক গলিয়ে সন্তর্পণে স্নিগ্ধ চাঁদের আলো এসে ঠিকড়ে পড়তো উঠোনে এবং পাতার ছায়া এসে ঢেকে দিত আমাদের পুরো শরীর । এছাড়া তখন আমাদের সবার শরীরে মৃদুমন্দ বাতাস এসে আলতো পরশ বুলিয়ে দিত ।
সেই অবসর সময় সার্জেন ডাক্তার বাঁশের তৈরি আরাম-কেদারায় আধ-শোয়া ভঙ্গিতে হেলান দিয়ে শুয়ে থাকতেন । বাবার একপাশে একটা বেতের চেয়ার তার প্রিয়তমা স্ত্রী বসতেন এবং অন্য পাশে বেঞ্চের উপর বাবা-মার দুই ছেলে, অর্থাৎ আমরা দু’ভাই, পাশাপাশি বসতাম । আমরা গভীর মনোযোগ দিয়ে বাবার কথা শুনতাম, বিশেষ করে যখন তিনি বলতেন যে প্রত্যেক মানুষের পেটের ভেতর একটা করে অ্যাপেনডিক্স আছে এবং কিভাবে তিনি প্রতিদিন কুড়িটার মতো অ্যাপেনডিক্সের অস্ত্রোপচার করতেন । অস্ত্রোপচার করতে তার সবচেয়ে কম সময় লেগেছিল মাত্র পনের মিনিট এবং এই সময়ে তিনি পুরো অস্ত্রোপচারের কাজ শেষ করেছিলেন । আমরা জিজ্ঞেস করি, অস্ত্রোপচারের পরে অ্যাপেনডিক্স দিয়ে আপনারা কি করেন ?
‘অ্যাপেনডিক্স কাটার পরে,’ বাবা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বললেন, ‘ওটা ফেলে দিই ।’
‘ফেলে দেন কেন ?’
বাবা বললেন, ‘অ্যাপেনডিক্সের এক রত্তিও মূল্য নেই ।’
তারপর বাবা পুনরায় আমাদের জিজ্ঞেস করেন, ‘ফুসফুসের কাজ কি ?’
উত্তরে আমার ভাই বললো, ‘নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য ।’
‘আর কি ?’
আমার ভাই এক মুহূর্তের জন্য কি যেন ভাবলো । তারপর ইতিউতি তাকিয়ে অস্পষ্ট গলায় বললো, ‘নিঃশ্বাস ছাড়ার জন্য ।’
‘এবং পাকস্থলী ? পাকস্থলীর কাজ কি ?’
‘পাকস্থলী ? আমরা যা কিছু খাই, তা পাকস্থলীতে গিয়ে হজম হয় ।’ এবারো আমার ভাই বললো ।
‘এবং হৃদপিন্ড ?’
এবার আমি প্রায় চিৎকার করে উঠি, ‘হৃদপিন্ডের মধ্যে হাপড়ের মতো অনবরত ঢিপ ঢিপ শব্দ হয় ।’
বাবা সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তা সত্যি । তোমরা দু’জনে যা যা বলেছ, তার সবই সত্যি । ফুসফুস, পাকস্থলী, হৃদপিন্ড, এমনকি ক্ষুদ্রান্ত, মলাশয়, বৃহদন্ত্র, গ্যুহদ্বার এবং অন্যান্য অংশের নিজস্ব কাজ আছে । মানব দেহে বক্ষনালীর শেষাংশে যে অংশ আছে, তার নাম অ্যাপেনডিক্স । তোমরা কি বলতে পারো, এই অ্যাপেনডিক্সের কাজ কি?’
ইতিমধ্যে আমার বড় ভাই একটা উত্তর তৈরি করে ফেলেছে । বাবার আগের কথা হুবহু নকল করে সে বললো, ‘অ্যাপেনডিক্সের এক রত্তিও মূল্য নেই ।’
বড় ভাইয়ের জবাব শুনে বাবা অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন । বাবার পাশে বসা মা-ও হো হো করে হেসে বাবার হাসির সঙ্গে যোগ দেন ।
যাহোক, একসময় হাসি থামিয়ে বাবা স্বাভাবিক গলায় বললেন, ‘ঠিক তাই । অ্যাপেনডিক্সের কোন দাম নেই । তোমরা যখন শ্বাস-প্রশ্বাস নাও, ঘুমাও কিংবা খাওয়ার পরে খাদ্যবস্তু হজম করো, তখন এগুলোর কোনটার জন্যই অ্যাপেনডিকসের প্রয়োজন পড়ে না । এছাড়া তোমরা যখন অতিরিক্ত খাবার খেয়ে ঢেঁকুর তোল অথবা কোন কারণে তোমাদের পেটে ব্যথা হয়, এমনকি দুর্গন্ধ বায়ু নিষ্কাশন করো, তখনও এসব কাজের জন্য অ্যাপেনডিক্সের কোনো দরকার পড়ে না ।’
বাবা যখন ঢেঁকুর তোলা এবং দুর্গন্ধ বায়ু নিষ্কাশনের কথা বলছিলেন, তখন আমার ভাই এবং আমি মুখ টিপে হাসছিলাম । বাবা আরাম কেদারায় আধ-শোওয়া থেকে উঠে বসলেন এবং আমাদের উদ্দেশ্য করে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘কিন্তু যদি কোন কারণে অ্যাপেনডিক্সে সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে পাকস্থলীতে খুব বেশি ব্যথা হয় । এছাড়া যদি ফুটো হয়, তবে অ্যাপেনডিক্সের পাতলা ঝিল্লিতে জ্বালা-পোড়া করে এবং সেটা অত্যন্ত মারাত্বক, এমনকি প্রাণনাশক হতে পারে । প্রাণনাশক কি, তোমরা বোঝ ?’
হ্যাঁ-সূচক ভঙ্গিতে মাথা দুলিয়ে বড় ভাই বললো, ‘এটা মৃত্যুর কারণ হতে পারে ।’
যেইমাত্র শুনতে পেলাম ‘এটা মৃত্যুর কারণ হতে পারে’, তখনই ভয়ে আমি রীতিমত কাঁপতে শুরু করি এবং তা বাবার নজর এড়ায়নি । তিনি আমার মাথায় হালকা চাপড় দিয়ে বললেন, ‘সত্যি কথা বলতে কি, অ্যাপেনডিক্স কেটে ফেলা একটা মামুলি অস্ত্রোপচার । যতক্ষণ অ্যাপেনডিক্সে ফুটো নেই, ততক্ষণ কোন ঝামেলা নেই । একজন বৃটিশ সার্জেন ছিলেন ...’
কথা বলার এক ফাঁকে বাবা পুনরায় আরাম-কেদারায় গা এলিয়ে দেন । আমরা জানি, এখন তিনি একটা গল্প বলবেন । কি ভেবে যেন তিনি চোখের পাতা বন্ধ করেন এবং পরিপূর্ণ তৃপ্তির সঙ্গে একটা হাই তোলেন । তারপর তিনি আমাদের দিকে সরাসরি তাকালেন এবং বলতে শুরু করলেন যে একদিন সেই বৃটিশ সার্জেন ক্ষুদ্র একটা দ্বীপে পৌঁছুলেন । সেই দ্বীপে কোন হাসপাতাল ছিল না, কোন ডাক্তার ছিল না, এমনকি অস্ত্রোপচারের জন্য কোন যন্ত্রপাতি এবং সরঞ্জামও ছিল না । কিন্তু তার অ্যাপেনডিক্স ফুলে গিয়েছিল এবং প্রচন্ড ব্যাথায় সে সারা সকাল একটা পাম গাছের নিচে শুয়েছিল । সে জানতো যে যদি অস্ত্রোপচার করতে বিলম্ব করা হয়, তাহলে অ্যাপেনডিক্স ফুটো হয়ে যাবে ।
‘এবং জানো অ্যাপেনডিক্স ফুটো হলে কি হয় ?’ পলকে বাবা সটান হয়ে আমাদের জিজ্ঞেস করলেন ।
‘নির্ঘাত মৃত্যু ।’ আমার ভাই বললো ।
‘ফুটোর জন্য অ্যাপেনডিক্সের পাতলা ঝিল্লিতে জ্বালা-পোড়া করবে এবং একসময় সে মারা যাবে ।’ আমার ভাইয়ের কথাটা শুধরে বাবা বললেন ।
বাবা আরো বললেন, ‘নিজেকে অস্ত্রোপচার করা ছাড়া তখন সেই বৃটিশ সার্জেনের অন্য কোন পথ খোলা ছিল না । স্থানীয় দু’জন লোক একটা বড় আয়না তার সম্মুখে এমন ভাবে তুলে ধরেছিল যেন সে তার নির্দিষ্ট জায়গাটা স্পষ্ট দেখতে পারে ।’
বলার সঙ্গে সঙ্গে বাবা আঙুল উঁচিয়ে তার পাকস্থলীর ডান দিক দেখালেন । ‘এই নির্দিষ্ট জায়গায় তিনি চামড়া ফুটো করে চর্বি পাশে ঠেলে হাত ঢুকিয়ে বদ্ধনালী খুঁজতে থাকেন । অ্যাপেনডিক্স খুঁজে পেতে হলে এই বদ্ধনালীর অবস্থান জানতে হয় ।’
একজন বৃটিশ সার্জেন নিজেই নিজের অ্যাপেনডিক্স অপারেশন করেছে – এই অবিশ্বাস্য ঘটনা আমাদের রীতিমত স্তব্ধ করে দিয়েছে । যাহোক, একসময় বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে উত্তিজিত গলায় জিজ্ঞেস করি, ‘বাবা, আপনি কি সেই বৃটিশ সার্জেনের মতো নিজেই নিজের অস্ত্রোপচার করতে পারবেন ?’
বাবা বললেন, ‘তা পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে । তবে আমি যদি সেই বৃটিশ সার্জেনের মতো একটা ক্ষুদ্র দ্বীপে যাই এবং সেখানে ডাক্তার বা যন্ত্রপাতি না থাকে এবং আমার অ্যাপেনডিক্সে ফুটো হয়, তাহলে জীবন বাঁচানোর জন্য আমি অবশ্যই আমার অস্ত্রোপচার করবো ।’
বাবার কথা শুনে আমাদের শিরা-উপশিরায় রক্ত চলাচলের গতি আচমকা বেড়ে যায় । সবসময় আমরা ভাবতাম আমাদের বাবা খুব সাহসী এবং অত্যন্ত ভালো মানুষ । তার কথায় আমাদের বিশ্বাসের ভীত আরো বেশি পোক্ত হয় । এছাড়া আমাদের আত্মবিশ্বাস এত বেশি উঁচুতে উঠেছে যে আমরা বড়াই করে অন্যান্য বন্ধুদের বলেছি, ‘আমাদের বাবা নিজেই নিজের অস্ত্রোপচার করতে পারে ।’
আমার কথার জের টেনে বড় ভাই আমাকে দেখিয়ে আরো বলেছিল, ‘অস্ত্রোপচারের সময় আমরা দু’জনে আয়না তুলে ধরবো ।’
তারপর কয়েক মাস কেটে গেছে । সেই বছর শরৎকালে হঠাৎ আমাদের বাবার অ্যাপেনডিক্স ফুটো হয়ে যায় । সেদিন ছিল রোববার এবং সময় ছিল সকালবেলা । অতিরিক্ত কাজ করার জন্য মা সকালে কারখানায় গিয়েছেন এবং সারা রাত কাজ শেষে বাবা ঘরে ফিরে এসেছেন । তিনি যখন দরজার কাছে আসেন, ঠিক সেই সময় মা কাজে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন । বারান্দায় দাঁড়িয়ে মাকে উদ্দেশ্য করে বাবা বললেন, ‘রাতে আমি আদৌ ঘুমাতে পারিনি । একজনের মাথা ফাঁটা, দু’জনের হাঁড় ভাঙা এবং অন্য একজন বিষ খেয়েছিল । আমি অত্যন্ত ক্লান্ত এবং আমার বুকে চিনচিন ব্যথা করছে ।’
বাবা বুক চেপে ধরে ঘুমোনোর জন্য বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়েন । আমার ভাই এবং আমি অন্য ঘরে ব্যস্ত ছিলাম । প্রথমে আমরা কয়েকটা চেয়ারের উপর টেবিল রাখি এবং সেই টেবিলের উপর আরেকটা চেয়ার রাখি । ঠিকমত জিনিসপত্র গোছাতে আমাদের তিন থেকে চার ঘন্টা সময় লেগে যায় ।
একসময় পাশের ঘরে বাবার গোঙানির শব্দ শুনতে পাই । আমরা পা টিপে টিপ বাবার ঘরের দরজায় গিয়ে কান পাতি। একসময় শুনতে পেলাম, বাবা আমাদের নাম ধরে ডাকছেন । তৎক্ষণাৎ আমরা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকি । চিংড়ি মাছের মতো বাঁকা হয়ে বাবা বিছানায় শুয়ে প্রচন্ড যন্ত্রণায় দাঁতে দাঁত চেপে বিস্ফারিত চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন । কাতর গলায় তিনি আমাদের বললেন, ‘আমার অ্যাপেনডিক্স ... উফ্ ... অ্যাপেনডিক্স ব্যথা আমাকে শেষ করে দিচ্ছে । জলদি হাসপাতালে গিয়ে ডাঃ চেন অথবা ডাঃ ওয়াংকে আসতে বলো ... এক্ষুণি যাও ।’
বড় ভাই আমার হাত ধরে এবং আমরা দু’জনে তড়িঘড়ি করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসি । তারপর চোখের পলকে দরজা পেরিয়ে রাস্তায় নেমে দৌঁড়ুতে থাকি । এখন আমি বুঝতে পারছি, আসলে বাবার কি হয়েছে । আমি জানি, বাবার অ্যাপেনডিক্স ফুলে গেছে এবং আমার ভাই আমাকে সঙ্গে করে হাসপাতালে যাচ্ছে । ডাঃ চেন অথবা ডাঃ ওয়াংকে খুঁজে বের করতে হবে ।
আমার যখন মনে হলো যে বাবার অ্যাপেনডিক্স ফুলে গেছে, তখন ভয়ে এবং উৎকন্ঠায় আমার বুকের ভেতর ধুকপুকানির গতি এবং ঢিবঢিব আওয়াজ ভীষণ বেড়ে যায় । তবুও কেন জানি আপনমনে ভাবলাম, শেষপর্যন্ত বাবার অ্যাপেনডিক্স ফুলেছে । তাহলে বাবা এখন নিজের অস্ত্রোপচার নিজেই করতে পারবে । অস্ত্রোপচারের সময় আমার ভাই এবং আমি মিলে বড় আয়না ধরবো ।
আমরা যখন সরু রাস্তার শেষ প্রান্তে পৌঁচেছি, তখন হঠাৎ বড় ভাই থেমে যায় । হাঁপাতে হাঁপাতে সে বললো, ‘আমরা যাবো না এবং ডাঃ চেন বা ডাঃ ওয়াংকে খুঁজবো না ।’
বড় ভাইয়ের সঙ্গে আমিও থেমে পড়ি এবং সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করি, ‘কেন যাবো না ?’
বড় ভাই বললো, ‘আমার যদি ডাঃ চেন বা ডাঃ ওয়াংকে নিয়ে যাই, তাহলে তো তারাই বাবার অস্ত্রোপচার করবে ।’
বড় ভাইয়ের কথার সঙ্গে সহমত পোষণ করে আমি মাথা নাড়ি ।
একসময় বড় ভাই জিজ্ঞেস করে, ‘তুই কি চাস না বাবা তার নিজের অস্ত্রোপচার নিজেই করুক ?’
‘হ্যাঁ, সত্যি আমি মনে প্রাণে চাই বাবা তার নিজের অস্ত্রোপচার নিজেই করুক,’ আমি বললাম ।
বড় ভাই বললো, ‘তাহলে ডাঃ চেন বা ডাঃ ওয়াংকে খোঁজার কোন দরকার নেই । তবে আমরা হাসপাতালে যাবো এবং অস্ত্রোপচার কক্ষ থেকে যন্ত্রপাতি আর প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেবো । বড় আয়না আমাদের ঘরেই আছে ।
বড় ভাইয়ের প্রস্তাব শুনে আমি এত বেশি উত্তেজিত হই যে রীতিমত চিৎকার করে উঠি, ‘তাহলে তো বাবা নিজের অস্ত্রোপচার নিজেই করতে পারবে ।’
আমরা যখন হাসপাতালে পৌঁছি, তখন সবাই দুপুরের খাবার খেতে ক্যাফেটরিয়াতে গিয়েছে । অস্ত্রোপচার কক্ষে মাত্র একজন নার্স আছে । তার সঙ্গে কথা বলার জন্য বড় ভাই আমাকে ঠেলে পাঠায় । আমি তার কাছে গিয়ে শুরুতেই আন্টি বলে সম্ভোধন করি । তারপর সরাসরি আমি আন্টির কাছে জানতে চাই, ‘আন্টি, তুমি কেন এত বেশি সুন্দরী ?’
আমার মুখে নার্স তার সৌন্দর্যের প্রশংসা শুনে শব্দহীন হাসতে থাকে এবং সেই ফাঁকে বড় ভাই অস্ত্রোপচারের জন্য একবাক্স যন্ত্রপাতি এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরিয়ে ফেলে ।
তারপর আমরা বাড়ি ফিরে আসি । আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে বাবা ভেতর থেকে হালকা স্বরে বললেন, ‘ডাঃ চেন, ডাঃ চেন । ডাঃ ওয়াং এসেছে ?’
আমরা ঘরের ভেতর প্রবেশ করে দেখি বাবার কপালে ঘামের ফোঁটা জমে আছে । ব্যথায় তিনি প্রচন্ড ঘামছেন । তিনি যখন দেখলেন যে ডাঃ চেন আসেনি, এমনকি ডাঃ ওয়াংও না, তখন তিনি আমাদের দেখে বাঘের মতো হুঙ্কার দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ডাঃ চেন কোথায় ? ডাঃ চেন আসেনি কেন ?’
বড় ভাই আমাকে যন্ত্রপাতির বাক্স খুলতে বলে নিজে বড় আয়না নিয়ে আসে । এই আয়না মা প্রতিদিন ব্যবহার করে । ঘূর্ণাক্ষরেও বাবা বুঝতে পারে না আমাদের আসল মতলব কি । বরং তিনি ক্রমাগত জিজ্ঞেস করছেন, ‘এবং ডাঃ ওয়াং? সে-ও কেন আসেনি ?’
বাবার ডানপাশে যন্ত্রপাতির বাক্স খুলে সরঞ্জাম বের করে রাখি । তারপর আমি অতি কষ্টে বিছানার উপর উঠি এবং আমার ভাই ও আমি আয়নার দু’পাশে দাঁড়িয়ে ওটা উপরের দিকে তুলে ধরি । আয়নায় বাবা নিজেকে পুরোপুরি দেখতে পারবে কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য বড় ভাই নিচু হয়ে পরীক্ষা করে । উত্তেজিত হয়ে বাবাকে বললাম, ‘বাবা, তাড়াতাড়ি করো ।’
প্রচন্ড ব্যথায় বাবা রীতিমত কাতরাতে থাকেন । প্রচন্ড যন্ত্রণায় হাঁপাতে হাঁপাতে তিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে পুনরায় ডাঃ চেন এবং ডাঃ ওয়াং সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন । আমরা চিৎকার করে বললাম, ‘বাবা, তাড়াতাড়ি করো । নইলে অ্যাপেনডিক্স কিন্তু ফুটো হয়ে যাবে ।’
সেই সময় আস্তে করে বাবা প্রথম জানতে চাইলেন, ‘তাড়াতাড়ি ... কিন্তু কি দিয়ে ?’
আমরা বললাম, ‘বাবা, তাড়াতাড়ি । তুমি নিজেই তোমাকে অস্ত্রোপচার করো ।’
এখন তাহলে বাবা আসল ঘটনা বুঝতে পেরেছেন । অগ্নিমূর্তির দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, ‘উল্লুক কোথাকার ।’
বাবার চিৎকারে আমি রীতিমত ভড়কে যাই । কিছুতেই বুঝতে পারি না আমরা কোথায় ভুল করেছি । আড়চোখে আমি বড় ভাইয়ের মুখের দিকে তাকাই । তারও মুখ ভ্যাবলাকান্তের মতো ফ্যাকাসে । বড় ভাই বাবার দিকে তাকিয়ে আছে । যন্ত্রণায় বাবা এত বেশি কাতর যে মুখে কিছুই বলতে পারছেন না । তিনি শুধু অবাক দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন । তৎক্ষণাৎ বড় ভাই বুঝতে পারে যে কেন বাবা আমাদের গালি দিয়েছেন । বড় ভাই বললো, ‘এখনো আমরা বাবার পড়নের প্যান্ট খুলিনি ।’
বড় ভাই যখন বাবার পড়নের প্যান্ট খুলছিল, তখন আমি একাই আয়না ধরেছি । আচমকা বাবা বড় ভাইয়ের মুখে ভীষণ জোরে একটা চড় মেরে পুনরায় আমাদের গালি দেন, ‘উল্লুকের বাচ্চা ।’
বড় ভাই এত বেশি ভড়কে গেছে যে সে বিছানা থেকে পিছলে পড়ে যায় এবং আমিও তাকে অনুসরণ করে বাবার পায়ের পাশ কেটে নিচে নেমে আসি । তারপর আমরা দু’জনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে অসহায় বাবার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকি । আমি বড় ভাইকে জিজ্ঞেস করি, ‘তাহলে কি বাবা নিজে তার অস্ত্রপচার করতে চান না ?’
বড় ভাই বললেন, ‘আমি জানি না ।’
একসময় বাবা কান্নায় ভেঙে পড়েন । তার দু’চোখে অশ্রুকণা চকচক করে । প্রচন্ড যন্ত্রণায় দাঁতে দাঁত চেপে বাবা বললেন, ‘তাড়াতাড়ি ... তাড়াতাড়ি কর । জলদি মাকে এখানে আসতে বল ।’
আমরা আশা করেছিলাম যে বাবা একজন বীরের মতো নিজেই নিজের অস্ত্রোপচার করবেন । কিন্তু তার বদলে তিনি রীতিমত কাঁদছেন । আমার ভাই এবং আমি আরেকবার বাবার দিকে এক পলকের জন্য তাকাই । হঠৎ বড় ভাই আমার হাত ধরে হেঁচকা টান দেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে আমরা এক দৌঁড়ে দরজা পেরিয়ে নিচে নেমে এসে দৌঁড়ুতে থাকি । এবার আমরা নিজেরা নিজেদের জন্য কোন সিদ্ধান্ত নিইনি । সোজা মার কাছে কারখানার দিকে ছুটে যাই ।
বাবাকে হাসপাতালের অস্ত্রোপচার কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়েছে । ইতিমধ্যে তার অ্যাপেনডিক্স ফুটো হয়ে গিয়েছে এবং তার পাকস্থলীতে পুঁজ জমেছে । তার ‘পেরিট্যানাইটিস’ হয়েছে এবং এক মাস হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে । পুনরায় গায়ে অ্যাপ্রোন জড়ানোর আগে এবং ডাক্তারী পেশায় ফিরে যেতে হলে তাকে আরো এক মাস বাড়িতে পুরোপুরি বিশ্রাম করতে হবে । কিন্তু তিনি আর কখনই সার্জেন হতে পারবেন না । কেননা তিনি তার আগের কর্মশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন । সুস্থ হওয়ার পর তিনি যদি এক ঘন্টাও অস্ত্রপচার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন, তাহলে নির্ঘাত মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন এবং চোখে সর্ষে ফুল দেখবেন । এক রাতেই তার স্বাস্থ্য ভেঙে গিয়েছে এবং তিনি কোনদিনই তার হারানো স্বাস্থ্য ফিরে পাবেন না । হাঁটার সময় আগের মতো পায়ের ছন্দবদ্ধ শব্দ হবে না । যদিও তিনি বড় বড় পা ফেলে হাঁটেন, কিন্তু প্রতিটি কদমের দৈর্ঘ্য আগের তুলনায় মাত্র অর্ধেক ।
শীতের সময় প্রায় প্রতিদিনই বাবার সর্দি-কাশি লেগে থাকে । সেই থেকে বাবা একজন সাধারণ ডাক্তার হিসেবে কাজ শুরু করেন । প্রতিদিন তিনি টেবিলের সামনে বসে আগত রোগীদের রোগ-বালাইয়ের জন্য গতানুগতিক ঔষধের নাম লিখে দেন । কাজ শেষে তিনি একটা তুলার বল অ্যালকোহলে চুবিয়ে হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘষতে ঘষতে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকেন । রাতে যখন আমরা ঘুমোনোর জন্য বিছানায় যাই, তখন বাবা-মার কথোপকথন শুনতে পাই । বাবা অসন্তোষের সঙ্গে বিড়বিড় করে মাকে বলছেন, ‘লোকেরা মনে করে যে তুমি আমাকে দু’টি ছেলে উপহার দিয়েছ । জানো, আসলে কিন্তু তারা অ্যাপেনডিক্স । সাধারণ সময়ে অকর্মা এবং পরিস্থিতি যখন সংকটাপন্ন, তখন তারা তোমার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াবে ।’
লেখক পরিচিতিঃ
অনুবাদঃ ফজল হাসান
আমার বাবা ছিলেন একজন সার্জেন ডাক্তার । তার দেহের গড়ন ছিল সুঠাম এবং তার স্বাস্থ্য ছিল অটুট । কথা বলার সময় বাবার কন্ঠস্বর রীতিমত গমগম করতো । কখনো কখনো তিনি অপারেশন টেবিলের সামনে একনাগাড়ে দশ ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে পারতেন । কাজ শেষ করে যখন তিনি অপারেশন কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসতেন, তখন তার চোখেমুখে ক্লান্তি বা অবসাদের কোন চিহ্ন ফুটে উঠতো না । বরং হেঁটে বাড়ি ফেরার সময় তার পায়ের ভারী শব্দে সমস্ত সিঁড়িপথ থপথপ করতো । অ্যাপার্টমেন্টের কাছাকাছি এসে তিনি প্রায়ই পাশের দেওয়ালের দিকে মুখ করে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতেন । তখন হঠাৎ অঝোর ধারায় বৃষ্টি পতনের শব্দের মতো দেওয়ালে তার প্রশ্রাবের একটানা শব্দ শোনা যেত ।
বাবা যখন পঁচিশ বছরের তরতাজা যুবক ছিলেন, তখন তিনি অনিন্দ্য সুন্দরী একজন পোশাক তৈরি কারখানার কর্মীকে বিয়ে করেছিলেন । দু’বছর পর তাদের সংসার আলোকিত করে আসে এক পুত্র সন্তা। সে আমার বড় ভাই । তারপর আরো দু’বছর পরে জন্ম নেয় আরেক পুত্র সস্তান । বাবা-মায়ের সেই দ্বিতীয় পুত্র সন্তানই আমি ।
আমার বয়স যখন আট বছর, তখন আমাদের সার্জেন ডাক্তার বাবা মাঝে মাঝে তার কর্মব্যস্ত জীবন থেকে একদিনের ছুটি নিতেন । সেই সব ছুটির দিনে তিনি আলসেমীর মিহি চাদর গায়ে জড়িয়ে পুরো সকাল ঘুমিয়ে কাটাতেন এবং তাতে প্রচুর আনন্দ পেতেন । বিকেলে দু’ছেলেকে নিয়ে হাঁটতে যেতেন এবং সমুদ্র পাড়ে প্রায় তিন ঘন্টা আমাদের নিয়ে খেলাধূলা করতেন । বাড়ি ফেরার পথে এক ছেলেকে কাঁধে চড়াতেন এবং অন্য ছেলের হাত ধরে হাঁটতেন । যখন পরিবারের সবাই রাতের খাবার খেত, তখন আমাদের চারপাশে রাতের অন্ধকার নেমে আসতো । খাওয়া-দাওয়ার পর সার্জেন ডাক্তার, তার স্ত্রী এবং দু’ছেলে মিলে দরজার বাইরে উঠোনের এক পাশে গোল ছাতার মতো ছড়ানো গাছের নিচে বসে গল্প-গুজবে মশগুল থাকতো । গাছের ডালপালা এবং পাতার ফাঁক গলিয়ে সন্তর্পণে স্নিগ্ধ চাঁদের আলো এসে ঠিকড়ে পড়তো উঠোনে এবং পাতার ছায়া এসে ঢেকে দিত আমাদের পুরো শরীর । এছাড়া তখন আমাদের সবার শরীরে মৃদুমন্দ বাতাস এসে আলতো পরশ বুলিয়ে দিত ।
সেই অবসর সময় সার্জেন ডাক্তার বাঁশের তৈরি আরাম-কেদারায় আধ-শোয়া ভঙ্গিতে হেলান দিয়ে শুয়ে থাকতেন । বাবার একপাশে একটা বেতের চেয়ার তার প্রিয়তমা স্ত্রী বসতেন এবং অন্য পাশে বেঞ্চের উপর বাবা-মার দুই ছেলে, অর্থাৎ আমরা দু’ভাই, পাশাপাশি বসতাম । আমরা গভীর মনোযোগ দিয়ে বাবার কথা শুনতাম, বিশেষ করে যখন তিনি বলতেন যে প্রত্যেক মানুষের পেটের ভেতর একটা করে অ্যাপেনডিক্স আছে এবং কিভাবে তিনি প্রতিদিন কুড়িটার মতো অ্যাপেনডিক্সের অস্ত্রোপচার করতেন । অস্ত্রোপচার করতে তার সবচেয়ে কম সময় লেগেছিল মাত্র পনের মিনিট এবং এই সময়ে তিনি পুরো অস্ত্রোপচারের কাজ শেষ করেছিলেন । আমরা জিজ্ঞেস করি, অস্ত্রোপচারের পরে অ্যাপেনডিক্স দিয়ে আপনারা কি করেন ?
‘অ্যাপেনডিক্স কাটার পরে,’ বাবা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বললেন, ‘ওটা ফেলে দিই ।’
‘ফেলে দেন কেন ?’
বাবা বললেন, ‘অ্যাপেনডিক্সের এক রত্তিও মূল্য নেই ।’
তারপর বাবা পুনরায় আমাদের জিজ্ঞেস করেন, ‘ফুসফুসের কাজ কি ?’
উত্তরে আমার ভাই বললো, ‘নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য ।’
‘আর কি ?’
আমার ভাই এক মুহূর্তের জন্য কি যেন ভাবলো । তারপর ইতিউতি তাকিয়ে অস্পষ্ট গলায় বললো, ‘নিঃশ্বাস ছাড়ার জন্য ।’
‘এবং পাকস্থলী ? পাকস্থলীর কাজ কি ?’
‘পাকস্থলী ? আমরা যা কিছু খাই, তা পাকস্থলীতে গিয়ে হজম হয় ।’ এবারো আমার ভাই বললো ।
‘এবং হৃদপিন্ড ?’
এবার আমি প্রায় চিৎকার করে উঠি, ‘হৃদপিন্ডের মধ্যে হাপড়ের মতো অনবরত ঢিপ ঢিপ শব্দ হয় ।’
বাবা সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তা সত্যি । তোমরা দু’জনে যা যা বলেছ, তার সবই সত্যি । ফুসফুস, পাকস্থলী, হৃদপিন্ড, এমনকি ক্ষুদ্রান্ত, মলাশয়, বৃহদন্ত্র, গ্যুহদ্বার এবং অন্যান্য অংশের নিজস্ব কাজ আছে । মানব দেহে বক্ষনালীর শেষাংশে যে অংশ আছে, তার নাম অ্যাপেনডিক্স । তোমরা কি বলতে পারো, এই অ্যাপেনডিক্সের কাজ কি?’
ইতিমধ্যে আমার বড় ভাই একটা উত্তর তৈরি করে ফেলেছে । বাবার আগের কথা হুবহু নকল করে সে বললো, ‘অ্যাপেনডিক্সের এক রত্তিও মূল্য নেই ।’
বড় ভাইয়ের জবাব শুনে বাবা অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন । বাবার পাশে বসা মা-ও হো হো করে হেসে বাবার হাসির সঙ্গে যোগ দেন ।
যাহোক, একসময় হাসি থামিয়ে বাবা স্বাভাবিক গলায় বললেন, ‘ঠিক তাই । অ্যাপেনডিক্সের কোন দাম নেই । তোমরা যখন শ্বাস-প্রশ্বাস নাও, ঘুমাও কিংবা খাওয়ার পরে খাদ্যবস্তু হজম করো, তখন এগুলোর কোনটার জন্যই অ্যাপেনডিকসের প্রয়োজন পড়ে না । এছাড়া তোমরা যখন অতিরিক্ত খাবার খেয়ে ঢেঁকুর তোল অথবা কোন কারণে তোমাদের পেটে ব্যথা হয়, এমনকি দুর্গন্ধ বায়ু নিষ্কাশন করো, তখনও এসব কাজের জন্য অ্যাপেনডিক্সের কোনো দরকার পড়ে না ।’
বাবা যখন ঢেঁকুর তোলা এবং দুর্গন্ধ বায়ু নিষ্কাশনের কথা বলছিলেন, তখন আমার ভাই এবং আমি মুখ টিপে হাসছিলাম । বাবা আরাম কেদারায় আধ-শোওয়া থেকে উঠে বসলেন এবং আমাদের উদ্দেশ্য করে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘কিন্তু যদি কোন কারণে অ্যাপেনডিক্সে সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে পাকস্থলীতে খুব বেশি ব্যথা হয় । এছাড়া যদি ফুটো হয়, তবে অ্যাপেনডিক্সের পাতলা ঝিল্লিতে জ্বালা-পোড়া করে এবং সেটা অত্যন্ত মারাত্বক, এমনকি প্রাণনাশক হতে পারে । প্রাণনাশক কি, তোমরা বোঝ ?’
হ্যাঁ-সূচক ভঙ্গিতে মাথা দুলিয়ে বড় ভাই বললো, ‘এটা মৃত্যুর কারণ হতে পারে ।’
যেইমাত্র শুনতে পেলাম ‘এটা মৃত্যুর কারণ হতে পারে’, তখনই ভয়ে আমি রীতিমত কাঁপতে শুরু করি এবং তা বাবার নজর এড়ায়নি । তিনি আমার মাথায় হালকা চাপড় দিয়ে বললেন, ‘সত্যি কথা বলতে কি, অ্যাপেনডিক্স কেটে ফেলা একটা মামুলি অস্ত্রোপচার । যতক্ষণ অ্যাপেনডিক্সে ফুটো নেই, ততক্ষণ কোন ঝামেলা নেই । একজন বৃটিশ সার্জেন ছিলেন ...’
কথা বলার এক ফাঁকে বাবা পুনরায় আরাম-কেদারায় গা এলিয়ে দেন । আমরা জানি, এখন তিনি একটা গল্প বলবেন । কি ভেবে যেন তিনি চোখের পাতা বন্ধ করেন এবং পরিপূর্ণ তৃপ্তির সঙ্গে একটা হাই তোলেন । তারপর তিনি আমাদের দিকে সরাসরি তাকালেন এবং বলতে শুরু করলেন যে একদিন সেই বৃটিশ সার্জেন ক্ষুদ্র একটা দ্বীপে পৌঁছুলেন । সেই দ্বীপে কোন হাসপাতাল ছিল না, কোন ডাক্তার ছিল না, এমনকি অস্ত্রোপচারের জন্য কোন যন্ত্রপাতি এবং সরঞ্জামও ছিল না । কিন্তু তার অ্যাপেনডিক্স ফুলে গিয়েছিল এবং প্রচন্ড ব্যাথায় সে সারা সকাল একটা পাম গাছের নিচে শুয়েছিল । সে জানতো যে যদি অস্ত্রোপচার করতে বিলম্ব করা হয়, তাহলে অ্যাপেনডিক্স ফুটো হয়ে যাবে ।
‘এবং জানো অ্যাপেনডিক্স ফুটো হলে কি হয় ?’ পলকে বাবা সটান হয়ে আমাদের জিজ্ঞেস করলেন ।
‘নির্ঘাত মৃত্যু ।’ আমার ভাই বললো ।
‘ফুটোর জন্য অ্যাপেনডিক্সের পাতলা ঝিল্লিতে জ্বালা-পোড়া করবে এবং একসময় সে মারা যাবে ।’ আমার ভাইয়ের কথাটা শুধরে বাবা বললেন ।
বাবা আরো বললেন, ‘নিজেকে অস্ত্রোপচার করা ছাড়া তখন সেই বৃটিশ সার্জেনের অন্য কোন পথ খোলা ছিল না । স্থানীয় দু’জন লোক একটা বড় আয়না তার সম্মুখে এমন ভাবে তুলে ধরেছিল যেন সে তার নির্দিষ্ট জায়গাটা স্পষ্ট দেখতে পারে ।’
বলার সঙ্গে সঙ্গে বাবা আঙুল উঁচিয়ে তার পাকস্থলীর ডান দিক দেখালেন । ‘এই নির্দিষ্ট জায়গায় তিনি চামড়া ফুটো করে চর্বি পাশে ঠেলে হাত ঢুকিয়ে বদ্ধনালী খুঁজতে থাকেন । অ্যাপেনডিক্স খুঁজে পেতে হলে এই বদ্ধনালীর অবস্থান জানতে হয় ।’
একজন বৃটিশ সার্জেন নিজেই নিজের অ্যাপেনডিক্স অপারেশন করেছে – এই অবিশ্বাস্য ঘটনা আমাদের রীতিমত স্তব্ধ করে দিয়েছে । যাহোক, একসময় বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে উত্তিজিত গলায় জিজ্ঞেস করি, ‘বাবা, আপনি কি সেই বৃটিশ সার্জেনের মতো নিজেই নিজের অস্ত্রোপচার করতে পারবেন ?’
বাবা বললেন, ‘তা পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে । তবে আমি যদি সেই বৃটিশ সার্জেনের মতো একটা ক্ষুদ্র দ্বীপে যাই এবং সেখানে ডাক্তার বা যন্ত্রপাতি না থাকে এবং আমার অ্যাপেনডিক্সে ফুটো হয়, তাহলে জীবন বাঁচানোর জন্য আমি অবশ্যই আমার অস্ত্রোপচার করবো ।’
বাবার কথা শুনে আমাদের শিরা-উপশিরায় রক্ত চলাচলের গতি আচমকা বেড়ে যায় । সবসময় আমরা ভাবতাম আমাদের বাবা খুব সাহসী এবং অত্যন্ত ভালো মানুষ । তার কথায় আমাদের বিশ্বাসের ভীত আরো বেশি পোক্ত হয় । এছাড়া আমাদের আত্মবিশ্বাস এত বেশি উঁচুতে উঠেছে যে আমরা বড়াই করে অন্যান্য বন্ধুদের বলেছি, ‘আমাদের বাবা নিজেই নিজের অস্ত্রোপচার করতে পারে ।’
আমার কথার জের টেনে বড় ভাই আমাকে দেখিয়ে আরো বলেছিল, ‘অস্ত্রোপচারের সময় আমরা দু’জনে আয়না তুলে ধরবো ।’
তারপর কয়েক মাস কেটে গেছে । সেই বছর শরৎকালে হঠাৎ আমাদের বাবার অ্যাপেনডিক্স ফুটো হয়ে যায় । সেদিন ছিল রোববার এবং সময় ছিল সকালবেলা । অতিরিক্ত কাজ করার জন্য মা সকালে কারখানায় গিয়েছেন এবং সারা রাত কাজ শেষে বাবা ঘরে ফিরে এসেছেন । তিনি যখন দরজার কাছে আসেন, ঠিক সেই সময় মা কাজে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন । বারান্দায় দাঁড়িয়ে মাকে উদ্দেশ্য করে বাবা বললেন, ‘রাতে আমি আদৌ ঘুমাতে পারিনি । একজনের মাথা ফাঁটা, দু’জনের হাঁড় ভাঙা এবং অন্য একজন বিষ খেয়েছিল । আমি অত্যন্ত ক্লান্ত এবং আমার বুকে চিনচিন ব্যথা করছে ।’
বাবা বুক চেপে ধরে ঘুমোনোর জন্য বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়েন । আমার ভাই এবং আমি অন্য ঘরে ব্যস্ত ছিলাম । প্রথমে আমরা কয়েকটা চেয়ারের উপর টেবিল রাখি এবং সেই টেবিলের উপর আরেকটা চেয়ার রাখি । ঠিকমত জিনিসপত্র গোছাতে আমাদের তিন থেকে চার ঘন্টা সময় লেগে যায় ।
একসময় পাশের ঘরে বাবার গোঙানির শব্দ শুনতে পাই । আমরা পা টিপে টিপ বাবার ঘরের দরজায় গিয়ে কান পাতি। একসময় শুনতে পেলাম, বাবা আমাদের নাম ধরে ডাকছেন । তৎক্ষণাৎ আমরা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকি । চিংড়ি মাছের মতো বাঁকা হয়ে বাবা বিছানায় শুয়ে প্রচন্ড যন্ত্রণায় দাঁতে দাঁত চেপে বিস্ফারিত চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন । কাতর গলায় তিনি আমাদের বললেন, ‘আমার অ্যাপেনডিক্স ... উফ্ ... অ্যাপেনডিক্স ব্যথা আমাকে শেষ করে দিচ্ছে । জলদি হাসপাতালে গিয়ে ডাঃ চেন অথবা ডাঃ ওয়াংকে আসতে বলো ... এক্ষুণি যাও ।’
বড় ভাই আমার হাত ধরে এবং আমরা দু’জনে তড়িঘড়ি করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসি । তারপর চোখের পলকে দরজা পেরিয়ে রাস্তায় নেমে দৌঁড়ুতে থাকি । এখন আমি বুঝতে পারছি, আসলে বাবার কি হয়েছে । আমি জানি, বাবার অ্যাপেনডিক্স ফুলে গেছে এবং আমার ভাই আমাকে সঙ্গে করে হাসপাতালে যাচ্ছে । ডাঃ চেন অথবা ডাঃ ওয়াংকে খুঁজে বের করতে হবে ।
আমার যখন মনে হলো যে বাবার অ্যাপেনডিক্স ফুলে গেছে, তখন ভয়ে এবং উৎকন্ঠায় আমার বুকের ভেতর ধুকপুকানির গতি এবং ঢিবঢিব আওয়াজ ভীষণ বেড়ে যায় । তবুও কেন জানি আপনমনে ভাবলাম, শেষপর্যন্ত বাবার অ্যাপেনডিক্স ফুলেছে । তাহলে বাবা এখন নিজের অস্ত্রোপচার নিজেই করতে পারবে । অস্ত্রোপচারের সময় আমার ভাই এবং আমি মিলে বড় আয়না ধরবো ।
আমরা যখন সরু রাস্তার শেষ প্রান্তে পৌঁচেছি, তখন হঠাৎ বড় ভাই থেমে যায় । হাঁপাতে হাঁপাতে সে বললো, ‘আমরা যাবো না এবং ডাঃ চেন বা ডাঃ ওয়াংকে খুঁজবো না ।’
বড় ভাইয়ের সঙ্গে আমিও থেমে পড়ি এবং সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করি, ‘কেন যাবো না ?’
বড় ভাই বললো, ‘আমার যদি ডাঃ চেন বা ডাঃ ওয়াংকে নিয়ে যাই, তাহলে তো তারাই বাবার অস্ত্রোপচার করবে ।’
বড় ভাইয়ের কথার সঙ্গে সহমত পোষণ করে আমি মাথা নাড়ি ।
একসময় বড় ভাই জিজ্ঞেস করে, ‘তুই কি চাস না বাবা তার নিজের অস্ত্রোপচার নিজেই করুক ?’
‘হ্যাঁ, সত্যি আমি মনে প্রাণে চাই বাবা তার নিজের অস্ত্রোপচার নিজেই করুক,’ আমি বললাম ।
বড় ভাই বললো, ‘তাহলে ডাঃ চেন বা ডাঃ ওয়াংকে খোঁজার কোন দরকার নেই । তবে আমরা হাসপাতালে যাবো এবং অস্ত্রোপচার কক্ষ থেকে যন্ত্রপাতি আর প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেবো । বড় আয়না আমাদের ঘরেই আছে ।
বড় ভাইয়ের প্রস্তাব শুনে আমি এত বেশি উত্তেজিত হই যে রীতিমত চিৎকার করে উঠি, ‘তাহলে তো বাবা নিজের অস্ত্রোপচার নিজেই করতে পারবে ।’
আমরা যখন হাসপাতালে পৌঁছি, তখন সবাই দুপুরের খাবার খেতে ক্যাফেটরিয়াতে গিয়েছে । অস্ত্রোপচার কক্ষে মাত্র একজন নার্স আছে । তার সঙ্গে কথা বলার জন্য বড় ভাই আমাকে ঠেলে পাঠায় । আমি তার কাছে গিয়ে শুরুতেই আন্টি বলে সম্ভোধন করি । তারপর সরাসরি আমি আন্টির কাছে জানতে চাই, ‘আন্টি, তুমি কেন এত বেশি সুন্দরী ?’
আমার মুখে নার্স তার সৌন্দর্যের প্রশংসা শুনে শব্দহীন হাসতে থাকে এবং সেই ফাঁকে বড় ভাই অস্ত্রোপচারের জন্য একবাক্স যন্ত্রপাতি এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরিয়ে ফেলে ।
তারপর আমরা বাড়ি ফিরে আসি । আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে বাবা ভেতর থেকে হালকা স্বরে বললেন, ‘ডাঃ চেন, ডাঃ চেন । ডাঃ ওয়াং এসেছে ?’
আমরা ঘরের ভেতর প্রবেশ করে দেখি বাবার কপালে ঘামের ফোঁটা জমে আছে । ব্যথায় তিনি প্রচন্ড ঘামছেন । তিনি যখন দেখলেন যে ডাঃ চেন আসেনি, এমনকি ডাঃ ওয়াংও না, তখন তিনি আমাদের দেখে বাঘের মতো হুঙ্কার দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ডাঃ চেন কোথায় ? ডাঃ চেন আসেনি কেন ?’
বড় ভাই আমাকে যন্ত্রপাতির বাক্স খুলতে বলে নিজে বড় আয়না নিয়ে আসে । এই আয়না মা প্রতিদিন ব্যবহার করে । ঘূর্ণাক্ষরেও বাবা বুঝতে পারে না আমাদের আসল মতলব কি । বরং তিনি ক্রমাগত জিজ্ঞেস করছেন, ‘এবং ডাঃ ওয়াং? সে-ও কেন আসেনি ?’
বাবার ডানপাশে যন্ত্রপাতির বাক্স খুলে সরঞ্জাম বের করে রাখি । তারপর আমি অতি কষ্টে বিছানার উপর উঠি এবং আমার ভাই ও আমি আয়নার দু’পাশে দাঁড়িয়ে ওটা উপরের দিকে তুলে ধরি । আয়নায় বাবা নিজেকে পুরোপুরি দেখতে পারবে কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য বড় ভাই নিচু হয়ে পরীক্ষা করে । উত্তেজিত হয়ে বাবাকে বললাম, ‘বাবা, তাড়াতাড়ি করো ।’
প্রচন্ড ব্যথায় বাবা রীতিমত কাতরাতে থাকেন । প্রচন্ড যন্ত্রণায় হাঁপাতে হাঁপাতে তিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে পুনরায় ডাঃ চেন এবং ডাঃ ওয়াং সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন । আমরা চিৎকার করে বললাম, ‘বাবা, তাড়াতাড়ি করো । নইলে অ্যাপেনডিক্স কিন্তু ফুটো হয়ে যাবে ।’
সেই সময় আস্তে করে বাবা প্রথম জানতে চাইলেন, ‘তাড়াতাড়ি ... কিন্তু কি দিয়ে ?’
আমরা বললাম, ‘বাবা, তাড়াতাড়ি । তুমি নিজেই তোমাকে অস্ত্রোপচার করো ।’
এখন তাহলে বাবা আসল ঘটনা বুঝতে পেরেছেন । অগ্নিমূর্তির দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, ‘উল্লুক কোথাকার ।’
বাবার চিৎকারে আমি রীতিমত ভড়কে যাই । কিছুতেই বুঝতে পারি না আমরা কোথায় ভুল করেছি । আড়চোখে আমি বড় ভাইয়ের মুখের দিকে তাকাই । তারও মুখ ভ্যাবলাকান্তের মতো ফ্যাকাসে । বড় ভাই বাবার দিকে তাকিয়ে আছে । যন্ত্রণায় বাবা এত বেশি কাতর যে মুখে কিছুই বলতে পারছেন না । তিনি শুধু অবাক দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন । তৎক্ষণাৎ বড় ভাই বুঝতে পারে যে কেন বাবা আমাদের গালি দিয়েছেন । বড় ভাই বললো, ‘এখনো আমরা বাবার পড়নের প্যান্ট খুলিনি ।’
বড় ভাই যখন বাবার পড়নের প্যান্ট খুলছিল, তখন আমি একাই আয়না ধরেছি । আচমকা বাবা বড় ভাইয়ের মুখে ভীষণ জোরে একটা চড় মেরে পুনরায় আমাদের গালি দেন, ‘উল্লুকের বাচ্চা ।’
বড় ভাই এত বেশি ভড়কে গেছে যে সে বিছানা থেকে পিছলে পড়ে যায় এবং আমিও তাকে অনুসরণ করে বাবার পায়ের পাশ কেটে নিচে নেমে আসি । তারপর আমরা দু’জনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে অসহায় বাবার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকি । আমি বড় ভাইকে জিজ্ঞেস করি, ‘তাহলে কি বাবা নিজে তার অস্ত্রপচার করতে চান না ?’
বড় ভাই বললেন, ‘আমি জানি না ।’
একসময় বাবা কান্নায় ভেঙে পড়েন । তার দু’চোখে অশ্রুকণা চকচক করে । প্রচন্ড যন্ত্রণায় দাঁতে দাঁত চেপে বাবা বললেন, ‘তাড়াতাড়ি ... তাড়াতাড়ি কর । জলদি মাকে এখানে আসতে বল ।’
আমরা আশা করেছিলাম যে বাবা একজন বীরের মতো নিজেই নিজের অস্ত্রোপচার করবেন । কিন্তু তার বদলে তিনি রীতিমত কাঁদছেন । আমার ভাই এবং আমি আরেকবার বাবার দিকে এক পলকের জন্য তাকাই । হঠৎ বড় ভাই আমার হাত ধরে হেঁচকা টান দেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে আমরা এক দৌঁড়ে দরজা পেরিয়ে নিচে নেমে এসে দৌঁড়ুতে থাকি । এবার আমরা নিজেরা নিজেদের জন্য কোন সিদ্ধান্ত নিইনি । সোজা মার কাছে কারখানার দিকে ছুটে যাই ।
বাবাকে হাসপাতালের অস্ত্রোপচার কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়েছে । ইতিমধ্যে তার অ্যাপেনডিক্স ফুটো হয়ে গিয়েছে এবং তার পাকস্থলীতে পুঁজ জমেছে । তার ‘পেরিট্যানাইটিস’ হয়েছে এবং এক মাস হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে । পুনরায় গায়ে অ্যাপ্রোন জড়ানোর আগে এবং ডাক্তারী পেশায় ফিরে যেতে হলে তাকে আরো এক মাস বাড়িতে পুরোপুরি বিশ্রাম করতে হবে । কিন্তু তিনি আর কখনই সার্জেন হতে পারবেন না । কেননা তিনি তার আগের কর্মশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন । সুস্থ হওয়ার পর তিনি যদি এক ঘন্টাও অস্ত্রপচার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন, তাহলে নির্ঘাত মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন এবং চোখে সর্ষে ফুল দেখবেন । এক রাতেই তার স্বাস্থ্য ভেঙে গিয়েছে এবং তিনি কোনদিনই তার হারানো স্বাস্থ্য ফিরে পাবেন না । হাঁটার সময় আগের মতো পায়ের ছন্দবদ্ধ শব্দ হবে না । যদিও তিনি বড় বড় পা ফেলে হাঁটেন, কিন্তু প্রতিটি কদমের দৈর্ঘ্য আগের তুলনায় মাত্র অর্ধেক ।
শীতের সময় প্রায় প্রতিদিনই বাবার সর্দি-কাশি লেগে থাকে । সেই থেকে বাবা একজন সাধারণ ডাক্তার হিসেবে কাজ শুরু করেন । প্রতিদিন তিনি টেবিলের সামনে বসে আগত রোগীদের রোগ-বালাইয়ের জন্য গতানুগতিক ঔষধের নাম লিখে দেন । কাজ শেষে তিনি একটা তুলার বল অ্যালকোহলে চুবিয়ে হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘষতে ঘষতে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকেন । রাতে যখন আমরা ঘুমোনোর জন্য বিছানায় যাই, তখন বাবা-মার কথোপকথন শুনতে পাই । বাবা অসন্তোষের সঙ্গে বিড়বিড় করে মাকে বলছেন, ‘লোকেরা মনে করে যে তুমি আমাকে দু’টি ছেলে উপহার দিয়েছ । জানো, আসলে কিন্তু তারা অ্যাপেনডিক্স । সাধারণ সময়ে অকর্মা এবং পরিস্থিতি যখন সংকটাপন্ন, তখন তারা তোমার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াবে ।’
লেখক পরিচিতিঃ
সমকালীন চীনা কথাসাহিত্যের অন্যতম লেখক ইউ হুয়া ১৯৬০ সালে জোজিয়াং শহরে জন্মগ্রহণ করেন । কর্মজীনের শুরুতে তিনি ছিলেন একজন দন্তচিকিৎসক । পাঁচ বছর কাজ করার পর দন্তচিকিৎসায় ইস্তফা দিয়ে তিনি ১৯৮৩ সালে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন । চীনের সর্বপ্রথম লেখক হিসেবে তিনি ২০০২ সালে সম্মানিত ‘জেমস্ জয়েস ফাউন্ডেশন অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন । তার লেখা উপন্যাস এং ছোটগল্প বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায়, বিশেষ করে ফরাসী, জার্মান, ইতালিয়ান, ডাচ, জাপানী এবং কোরিয়ান, অনুদিত হয়েছে । ‘টু লিভ’ উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়, যা ১৯৯৪ সালে ক্যানস্ ফিলম্ ফেষ্টিভেলে ‘গ্র্যান্ড প্রাইজ’ অর্জণ করে । বর্তমানে তিনি বেইজিংয়ে বসবাস করেন ।
গল্পসূত্রঃ ‘অ্যাপেনডিক্স’ গল্পটি ইউ হুয়ার ইংরেজিতে ‘অ্যাপেনডিক্স’ গল্পের অনুবাদ । চীনা ভাষা থেকে গল্পটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন অ্যালান বার । গল্পটি ২০০৪ সালের মে সংখ্যা ‘ওয়ার্ডস্ উইদআউট বর্ডার্স’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় । পরবর্তীতে গল্পটি ‘বয় ইন দ্য টোয়েলাইটঃ শর্ট স্টোরিজ অব দ্য হিডেন চায়না’ (২০১৪) ছোটগল্প সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করা হয় ।

ফজল হাসান
গল্পলেখক, অনুবাদক এবং ছড়াকার
ফজল হাসান সাহিত্যিক ছদ্মনাম । পোশাকী নাম ডঃ আফজল হোসেন ।
জন্মঃ মুন্সিগঞ্জ, বাংলাদেশ ।
শিক্ষাঃ বিএসসি অনার্স এবং এমএসসি (ঢাবি), পিএইচডি (অষ্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি) ।
বর্তমান আবাসস্থলঃ ক্যানবেরা, অষ্ট্রেলিয়া ।
পেশাঃ অষ্ট্রেলিয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মচারী ।
লেখালেখিঃ বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকী, সাপ্তাহিক ও পাক্ষিক ম্যাগাজিন এবং দেশ-বিদেশের
অনলাইন ম্যাগাজিন ।
প্রকাশিত ছোটগল্প সংকলনঃ ‘চন্দ্রপুকুর’ ও ‘কতোটা পথ পেরোলে তবে’ (মৌলিক); ‘আফগানিস্তানের
শ্রেষ্ঠ গল্প’, ‘নির্বাচিত নোবেল বিজয়ীদের সেরা গল্প’ এবং ‘ইরানের শ্রেষ্ঠ গল্প’ (অনুবাদ) ।
প্রাপ্ত পুরস্কারঃ ‘প্রিয় লেখক পুরস্কার’ (২০০৬) (‘প্রিয় অষ্ট্রেলিয়া’ অনলাইন ম্যাগাজিন) এবং ‘বাসভূমি
পুরস্কার’ (অধুনালুপ্ত ‘বাসভূমি’ অনলাইন ম্যাগাজিন) ।
*****
গল্পসূত্রঃ ‘অ্যাপেনডিক্স’ গল্পটি ইউ হুয়ার ইংরেজিতে ‘অ্যাপেনডিক্স’ গল্পের অনুবাদ । চীনা ভাষা থেকে গল্পটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন অ্যালান বার । গল্পটি ২০০৪ সালের মে সংখ্যা ‘ওয়ার্ডস্ উইদআউট বর্ডার্স’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় । পরবর্তীতে গল্পটি ‘বয় ইন দ্য টোয়েলাইটঃ শর্ট স্টোরিজ অব দ্য হিডেন চায়না’ (২০১৪) ছোটগল্প সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করা হয় ।

ফজল হাসান
গল্পলেখক, অনুবাদক এবং ছড়াকার
ফজল হাসান সাহিত্যিক ছদ্মনাম । পোশাকী নাম ডঃ আফজল হোসেন ।
জন্মঃ মুন্সিগঞ্জ, বাংলাদেশ ।
শিক্ষাঃ বিএসসি অনার্স এবং এমএসসি (ঢাবি), পিএইচডি (অষ্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি) ।
বর্তমান আবাসস্থলঃ ক্যানবেরা, অষ্ট্রেলিয়া ।
পেশাঃ অষ্ট্রেলিয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মচারী ।
লেখালেখিঃ বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকী, সাপ্তাহিক ও পাক্ষিক ম্যাগাজিন এবং দেশ-বিদেশের
অনলাইন ম্যাগাজিন ।
প্রকাশিত ছোটগল্প সংকলনঃ ‘চন্দ্রপুকুর’ ও ‘কতোটা পথ পেরোলে তবে’ (মৌলিক); ‘আফগানিস্তানের
শ্রেষ্ঠ গল্প’, ‘নির্বাচিত নোবেল বিজয়ীদের সেরা গল্প’ এবং ‘ইরানের শ্রেষ্ঠ গল্প’ (অনুবাদ) ।
প্রাপ্ত পুরস্কারঃ ‘প্রিয় লেখক পুরস্কার’ (২০০৬) (‘প্রিয় অষ্ট্রেলিয়া’ অনলাইন ম্যাগাজিন) এবং ‘বাসভূমি
পুরস্কার’ (অধুনালুপ্ত ‘বাসভূমি’ অনলাইন ম্যাগাজিন) ।
*****
1 মন্তব্যসমূহ
চমৎকার গল্প
উত্তরমুছুন