দুর্গাপুর-২
২৫শে জুন ১৯৬৮
শ্রীচরণেষু—
বাবা
তোমাকে আগেও একটি চিঠিতে জানিয়েছিলাম--ঐ বাসে যে-ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল উনি গতকাল আমাদের কোয়ার্টারে এসেছিলেন। চা-বিস্কিট খাওয়ালাম। উনি বললেন সত্যি মা, তোমাকে আমার এতো স্নেহ করতে ইচ্ছে হয় কেন জানি না। আমার চারটি মেয়ে ও একটি ছেলে। চার মেয়েকেই বিয়ে দিয়েছি। একজনের কোয়ার্টার আমাদের কোয়ার্টারের থেকে খুবই কাছে—খুবই বড়লোক।
উনি আমাকে তার মেয়ের কোয়ার্টারে নিয়ে যেতে চাইলেন—দাদামনি প্রথমে রাজী হয়নি, শেষে তার পীড়াপীড়িতে আমিও নিচের মেয়েটিকে (মাধবীকে) নিয়ে গেলাম। গিয়ে খুব ভালই হল। কি সুন্দর যে দেখতে তাঁর মেয়েটি তা আর বলার নয়—আর কি বড়লোক! সর্বদা যে কাপড় পরে তা দেখে আমার লজ্জা লাগছিল। আমি একা থাকি, তাই আমাকে সবসময় আসতে বলল এবং বললো, সে নিজেও যাবে সময় করে। কোন বাচ্চা হয়নি আজও, সবেমাত্র বিয়ে হয়েছে। তার জামাইর সঙ্গে দেখা হলো। বুড়ো ভদ্রলোক (আমাকে দেখিয়ে) জামাইকে বললেন—ও তোমার শালী, আমার হারানো একটি মেয়ে। আমরা সবাই হেসেছিলাম, জামাই খুব লাজুক, এসেই আমাকে বললো—নমস্কার। আমি বললাম—এ-কী! আমি আপনার শালী। ভদ্রলোক লাল হয়ে গেলেন। মেয়ে বিএ পাশ, কিন্তু কোনো অহঙ্কার নেই। তারপর দই মিষ্টি খেলাম। বুড়ো ভদ্রলোককে আমি মেসোমশাই ডাকতে তিনি আমাকে বললেন, না, তুই আমাকে বাবা ডাকবি। তোর এক বাপ পাকিস্তানে আর আমি এখানে। আমিই তোর ভালো দেখে বিয়ে দেবো। বুড়ো ভদ্রলোক দেখতে অনেকটা দাদুর (ব্রজেন্দ্র দত্ত) মতো। আমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে গেলেন। তোমার আঁকা ছবিগুলি দেখে খুব প্রশংসা করলেন। ভদ্রলোককে আমার খুবই ভালো লেগেছে। তোমার কাছে চিঠি লিখবেন বললেন। মেজদার (নির্মলেন্দু গুণ) কথা শুনে খুব দুঃখিত হলেন।।..
প্রণতা
সোনালি
ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়
হরিদাস কর
এ,ভি,বি কলোনী
দুর্গাপুর-৬
৭ই জুলাই ১৯৬৮
প্রিয় মহাশয়
শ্রদ্ধেয় সুখেন্দু বাবু, প্রথমে আপনি ও আমার বৌদি শ্রীযুক্তা গুণ চৌধুরাণী মহাশয়া আমার নমস্কার গ্রহণ করিবেন।
আপনাদের সহিত আমি সম্পূর্ণ অপরিচিত, তবে কিশোরগঞ্জে থাকিতে আমি আপনার নাম শুনিয়াছি। এখন আমার পরিচয় দেওয়ার মত কিছুই নাই, তবু লিখি, আমি কিশোরগঞ্জে মোক্তারী করা অবস্থায় প্রায় লাখ দেড়েক টাকা খরচ করিয়া ‘রঙ মহল’ নামে একটি সিনেমা হল তৈরী করি। তাহা তথায় ফেলে রেখে ১৯৫০ সালে ‘west Besngal’-এ চলে আসি এবং কৃষ্ণনগর কোর্টে Law Practice করতে থাকি। বর্তমানে আমার বয়েস ৬৪ বছর চলছে। আমার একমাত্র পুত্র এখানে এ,ভি,এতে কাজ করে। আমার ৪ মেয়ে। সবাইকে এখানে এনে বিবাহ দিয়েছি। এখন পুত্রের বিবাহ দিতে পারলেই মুক্ত। তখন একেবারে বৃন্দাবনবাসী। কী বলেন? তার মা আমার সঙ্গে থাকতে পারে ইচ্ছা করলে---ইচ্ছে করলে তার ছেলের সঙ্গেও থাকতে পারে। তখন আমাকে আর পায় কে? সব দ্বায়িত্ব শেষ।
আমি আজ ৩/৪ মাস যাবৎ ছেলের কাছে আছি—তার ইচ্ছে নয় যে আমি practice করি, যেহেতু আমার বয়স হয়েছে, আর পরিশ্রমের দরকার নাই। তবে ভাই, আমি ভগবানের কৃপায় কার্যক্ষম আছি।
এখন আপনার নিকট পত্র লিখবার প্রেরণা পাচ্ছি শ্রীমান পূর্ণেন্দু ও আমার মা সুনার (সোনালি) সহিত পরিচয় ও ঘনিষ্টতা হওয়ার জন্য। আমি শ্রীমতি সোনালির ছেলে হইয়াছি। সেও আমাকে মা’র মতই আদর-যত্ন করে এবং শ্রীমান পূর্নেন্দুও আমাকে শ্রদ্ধা করে। তাহাদের কোয়ার্টারের নিকট আমার এক মেয়েজামাই থাকে। সে সেখানকার একজন গভমেন্ট কন্ট্রাক্টর, সেখানে প্রায়ই যাই। সেখানে গেলেই শ্রীমানের বাসায় যাই এবং খানিকক্ষণ বেশ আনন্দে কাটাই। তারাও খুব আনন্দ পায়। আসতে দিতে চায় না। কয়েক দিন না গেলে পূর্ণেন্দু বাবাজী আমার মা’কে বলে—“কিরে সুনু, তোর ছেলে আসছে না কেন অনেক দিন ধরে—রাগ টাগ করেছেন নাকি।” আমি গেলেই তা নিয়ে হাসাহাসি হয়। আমি আমার মাকে বলি “—দেখতো মা, বিনাযত্নে কত বড় ছেলে পেয়েছ। এখন অন্তত ছেলেকে ভাল করে খেতে দিও।” এইভাবে সময়টুকু বেশ কাটে।
এখন আমার Retired Life। মনের চিন্তা-ভাবনা সব ছেড়ে দিয়েছি। শুধু ভগবানের চিন্তাই করি। এখন ভালোয় ভালোয় চলে যেতে পারলেই হয়।
শ্রীমান পূর্ণেন্দু ও শ্রীমতি, এখন তাকে মা-ই লিখি—তাদের সহিত এত ঘনিষ্ঠতা হয়েছে যে বেশ নিকটতম আত্মীয়তার মতই গড়ে উঠেছে। আমার মেয়ের বাসার সহিতও তাদের সর্বদাই যাতায়াত হচ্ছে।
আমি “জন্মান্তরবাদে” বিশ্বাসী, হয়ত পূর্বজন্মে ঘনিষ্ট আত্মীয়তা ছিল, তাই এ জন্মে তার সঙ্গে আমার মিলন হয়েছে। যাক অনেক বাজে কথা লিখিলাম—মনে কিছু করিবেন না।
আমার মা’য়ের জন্য আপনারা মোটেই চিন্তা করিবেন না। শ্রীমান পূর্ণেন্দু তাহার সর্বপ্রকার সুখ-সুবিধা ও স্বাস্থ্যের জন্য সকল প্রকার ব্যবস্থাই করিতেছে এবং ভগবানের কৃপায় তার স্বাস্থ্যের অনেক উন্নতি হয়েছে। আমিও আপনার হিতাকাঙ্ক্ষী একজন আছি, যদিও বিশেষ কিছু করবার ক্ষমতা নাই।
এখন এখানেই শেষ করি। আমার নমস্কার গ্রহণ করিবেন এবং শ্রীমান-শ্রীমতিদের কুশলসহ সকলের সুশল সংবাদ দানে বাধিত করিবেন।
নিবেদন ইতি
শ্রী হরিদাস কর।
ওঁ
দুর্গাপুর
৮ই সেপ্টেম্বর ১৯৬৮
শ্রদ্ধাস্পদেষু
মাননীয় সুখেন্দু বাবু, আপনার ২৬ শে আগস্ট-এর পত্রখানা গতকল্য পাইয়া অত্যন্ত আনন্দিত হইলাম। আমার সুনা মা আজ প্রায় ১৫ দিন হইল বর্ধমানে তার মাসীর বাড়ি গিয়াছে, তথায় ভালো আছে। এখানে একা একা একঘেয়ে লাগে তাই ঐখানে খুব আনন্দেই আছে। আমিও বলিয়াছিলাম যে কয়েক দিন থেকে আসতে। খুব সম্ভবত ২/১ দিনের মধ্যেই চলে আসবে। আমি coke-oven এ গিয়েছিলাম। শ্রীমান পূর্ণেন্দুও তাই বললো। বর্ধমান যাওয়ার আগে সুনা মাকে একদিন আমার বাসায় আনিয়াছিলাম। সকালবেলা আসিয়াছিল—দুপুরটা থেকে আবার বিকেলে আমিই quarter—এ দিয়ে এসেছি। শ্রীমান পূর্ণেন্দুও আসিয়াছিল। আমি ২/১ দিন থাকতে বলেছিলাম। কিন্তু কিছুতেই থাকলো না। আবার যাইয়া একদিন নিয়া আসিব। আমার ইচ্ছা সে আমার কাছে সর্বদাই থাকুক। সুনা মাও আমাকে ছেলের মতোই ভালোবাসে—ভগবানের সুন্দর বিধান। আপনি লিখিয়াছেন যে এই অজানা মেয়ে আমার ঘাড়ে আসিয়া পড়িল। এইসব কথা আপনি লিখিবেন না—আমি খুব কষ্ট পাই, মা কি ছেলের কাছে অজানা হয়? আপনি অত্যন্ত ঠাকুরভক্ত। সুতরাং আপনি সহজেই বুঝেন যে সে আমার বহু জন্মেই বিশেষতঃ পূর্ব জন্মেই নিকটতমা আত্মীয় ছিল। কিছুদিন মাত্র ছাড়াছাড়ি ছিল। এখন পুনরায় হঠাৎ দেখা হইয়া গেল। একটা আশ্চর্য ব্যাপার, আমি কেন, আমার স্ত্রী ও মেয়েরাও আমার মাকে স্নেহ করে ও অত্যন্ত ভালবাসে। ইহাই আমাদের হিন্দু শাস্ত্রের জন্মান্তরবাদ। এই জন্মান্তরবাদে আমি অত্যন্ত বিশ্বাসী। যাক, সাক্ষাতে এই সব আলোচনা হইবে। অপর বিষয়, আপনি সাংসারিক বিশেষতঃ আর্থিক ক্ষয়-ক্ষতির জন্য খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হইয়া পড়িয়াছেন। আপনার এখনও অনেক কর্তব্য আছে। ভগবানের ওপর বিশ্বাস রাখিয়া শুধুমাত্র নিমিত্ত মাত্র হইয়া কার্য করিয়া যাইবেন। তাহার যাহা ইচ্ছা তাহাই হইবে। আর্থিক ক্ষতি ক্ষতিই না।
আমার কথা বলি—১৯৪৭ সালে কপর্দকশূন্য হয়ে এখানে চলে আসি। আজ পর্যন্ত এক কপর্দকও পাইনি। আর পাওয়ার সম্ভাবনাও নাই। এখানে ৮ জনের সংসার ভগবানই চালাইয়া নিয়াছেন। তাহার ওপর আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে এবং তাহাতেই আমি আত্মসমর্পন করিয়াছি। তাহার যাহা ইচ্ছা এবং আমার প্রারাদ্ধ কর্মফল ভোগ করিতেই হইবে। ইহা শুধু আমার নয়—এই জীবজগতে প্রত্যেকের জন্যই এই এক বিধান। প্রারাদ্ধ ভোগ করিতেই হইবে। এইজন্য ভাবনা কেন?
সুনা মা’র বিয়ের চেষ্টা করিতেছি। শ্রীমান পূর্ণেন্দু বলিল যে বর্তমানে তার নাকি বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা নাই। ১টা চাকুরী-টাকুরী করিবে। যাক আপনি যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি চলে আসতে চেষ্টা করবেন, সাক্ষাতে আলোচনা করা যাবে।
আমি এর মধ্যে এক কর্ম করিয়াছি। বিষয়টা এই যে-কৃষ্ণনগরে থাকিতে আমি Law practice করিতাম। আমার বয়েস হয়েছে বলে আমার পুত্র আমাকে ও তার মাকে এখানে তাহার নিকট আনিয়া রাখিয়াছে। আমি শুধু খাই, ঘুমাই, বেড়াই, এইভাবে কি ভালো লাগে? গত বৈশাখ মাস হইতে দুর্গাপুর একটি আলাদা Sub Division হইয়া নতুন কোর্ট খুলিয়াছে। আমাদের কোয়ার্টার হইতে মাত্র ১৫ নয়া পয়সা বাস-ভাড়া—সেখানে Practice আরম্ভ করিয়াছি। ভগবানের ইচ্ছায় বেশ তাই টাকার লোভ ছাড়তে পারছি না। যখন এখনও কর্মঠ-- আছি যতদিন পারি practice করি না কেন। ছেলের অবশ্য খুবই বারণ। তবে ভাই এখানে বড় গরম পড়িয়াছে। অসহ্য গরম।
যাক, অনেক বাজে কথা লিখিলাম, আসার সময় বৌদিকেও নিয়ে আসবেন—আমার সুনা মা ও পূর্ণেন্দু সবসময়ই তার মা’র কথা বলে।
আপনারা আসিলেই শ্রীমান পুর্ণেন্দু ও সুনা মা’র বিয়ের ব্যবস্থা করা যাইবে। আমাকে যা আদেশ করিবেন সর্বদাই তাহা করিব। আমাকে আপনি পর মনে করিবেন না। বর্তমানে ভগবান-কৃপায় ভাল আছি। দুর্বলতা অনেকটা কাটিয়াছে। হাজার হইলেও বয়স তো হইয়াছে।
এদিকে আমার পুত্রের এখনও বিয়ে দেই নাই। এতদিন তাহার বোনের বিবাহ ইত্যাদির ন্য সেও বিবাহ করিতে অনিচ্ছুক ছিল। তাই এখন বিবাহ দেওয়া নিতান্ত প্রয়োজন। তাই এই চেষ্টায় আছি। নানা জায়গা হইতে প্রস্তাব আসিতেছে—ওই সকল স্থানে যাতায়াত, মেয়ে দেখা ও কোর্টের কার্য্য করা ইত্যাদি কারণে খুবই পরিশ্রম হইতেছে। court হহিতে ৫টা/৬টার পূর্বে কোনদিনই ফিরিতে পারি না। আজও কোথাও বাহির হই নাই। অনেক পত্রের জবাব অদ্য বসে বসে লিখিলাম, হয়ত আপনার পড়ার ধৈর্য্য থাকিবে না। আপনি ও বৌদি আমার নমস্কার গ্রহণ করিবেন আর ছোটদের আমার স্নেহাশীষ দিবেন।
আমি ২/১ দিনের মধ্যেই coke-oven এ যাইব—আমার মাকে দেখিয় আসিয়া আপনাকে পুনঃ লিখিব। যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি যাতে পাসপোর্ট পাওয়া যায় আপনারা তাহার চেষ্টা করিবেন। আপনারা আসিলেই আমার শ্রীমান পূর্ণেন্দু ও সুনা মা’র বিবাহ এক সঙ্গে দিবার বন্দোবস্ত করিব। অবশ্য নিয়তির বিধান ভগবান জানেন কি হইবে! তবে আমার মন যেন বলিতেছে তাহাদের উভয়েরই এক সঙ্গে বিবাহ হইবে। আর বিশেষ কী? আপনাদের কুশলপ্রার্থী।।
ইতি
Yours
Haridas Kar
ওঁ কালী
এ/ভি/বি কলোনী
দুর্গাপুর—৬
৭ই আগস্ট ১৯৬৮
প্রিয় সুখেন্দু বাবু,
আমি বিগত ১৫ই আগস্ট এখান হইতে কৃষ্ণনগর যাই এবং ৬ই আগস্ট এখানে ফিরে আসি। আসিয়া আপনার দু’খানা পত্র পাই। তাই উত্তর দিতে দেরী হইল, সেজন্য কিছু মনে করিবেন না।
আপনি মা সুনালিসহ শ্রীমান পূর্ণেন্দুর জন্য যাহা যাহা করিতে লিখিয়াছেন আমি তাহা অক্ষরে অক্ষরে পালিন করিব। এখন ভগবানের কৃপা। আমি পরশু দিন সুনা মা’র ওখানে গিয়াছিলাম, তাহারা ভালোই। বিস্তারিত পরে লিখিতেছি। আপনাদের সকলের কুশলপ্রার্থী—
ইতি নিবেদক
শ্রী হরিদাস কর।
বর্ধমান
৫ই অক্টোবর ১৯৬৮
শ্রীচরণেষু—
বাবা,
যে মেশোমহাশয় আমাকে ঠিক মেয়ের মত স্নেহ করিতেন তিনি আর কোনোদিন আমাকে সুনা মা বলিয়া ডাকিবেন না। পুজোর ৩ দিন আগে পরম শ্রদ্ধেয় হরিদাস করের মৃত্যু হইয়াছে। শনিবার দিন আমাকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যাবার কথা, কিন্তু মঙ্গলবার রাত ৪টার সময় উনি মারা যান। মৃত্যুর সময় নাকি আমাকে ডাকিয়াছিলেন। আমি উনার জন্য দুইদিন খুব কাঁদিয়াছি—দাদামনি আমাকে বর্ধমান দিয়া গিয়াছে। এবং কান্নাকাটি করি বলে আমাকে উনার বাসায়ও নিয়া যায় নাই। উনার ছেলের নিকট তুমি চিঠি দিও। উনার নিকট যা স্নেহ পেয়েছি তা পত্রে লিখার নয়। উনি বলতেন, তোর হাতের রান্না খাবো—তোর বাপ আসলে। বাবা, উনি তো আর কোনদিনই আমার হাতের রান্না খেতে পারবেন না। উনার সে আশা পূর্ণ হলো না। উনি মারা গেলে তার জামাই এসে দাদামনিকে খবর জানায়, দাদামনি উনাকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে ফুলের মালা দিয়ে নতুন জামা-কাপড় পরিয়ে শ্মশানে নিয়ে গিয়েছিল। উনি দাদামনিকেও নিজের ছেলের মতো স্নেহ করিতেন। উনি বলতেন-- পরকে আপন করতে হলে নাকি নিজের চেয়েও অপরকে ভালবাসতে হয়। দাদামনি তাঁর শেষ কাজে যে একটু কর্তব্য করিতে পারিয়াছে তাতেই শান্তি।
উনি মৃত্যুর আগের দিনও কোর্ট থেকে এসেছিলেন। খুব কর্মঠ লোক ছিলেন। তোমার খুব প্রশংসা করতেন। উনি আজ নাই—কিন্তু উনার কথাগুলি আমার মনের মধ্যে চিরদিনের মত রয়ে গেল। হঠাৎ তিনি এভাবে মারা যাইবেন তা আমি কল্পনা করি নাই। উনি রবিবারে এসেছিলেন এবং মঙ্গলবারে মারা যান। রবিবারে উনাকে সরবত করে দিয়াছিলাম, চা, বিস্কিট, কলা ইত্যাদি দিয়াছিলাম। যাবার সময় উনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন—তুমি তৈরী থাকবে। আমি পুঁজোতে তোমাকে আমার বাসায় নিয়ে যাবো। একা একা থাকবি তাই। আমি বলেছিলাম—আচ্ছা। পুঁজোতে তার মেয়েদের অনেক কিছু দিয়েছিলেন, আমাকে বললেন, তুই আমার মেয়ের মতো, আমার কাছ থেকে দাবী করে চেয়ে নিবি। আজ আমি কার কাছে দেবী জানাবো?
আমি জানি তুমিও আঘাত পাবে—তোমার যা বয়স তাতে তুমি ভেঙ্গে পড়বে। কিন্তু তাঁর মৃত্যু এমনি নির্মম যে আমার কাছে এখনও মনে হচ্ছে অবিশ্বাস্য।
প্রণতা
সোনালি
গল্পকার নির্মলেন্দু গুণের পাদটীকা
হরিদাস কর মারা গেলে, বাবা কেঁদেছিলেন। অসুখ করেছিলো তাঁরও। কিন্তু আমার বাবা হরিদাস কর নন বলেই তিনি বেঁচে গেলেন হয়ত—নাহলে মৃত্যুর ভোটার তালিকায় তাঁর নাম ওঠার বয়স অনেক আগেই শুরু হয়েছে। সুখ-দুঃখের কাঁধে ভর রেখে বেঁচে থেকে তিনি অদ্যাবধি আমার কবিতার ক্রুর সমালোচক হলেও অন্তত এ গল্পে তিনি পুত্রের তেইশ বছরের অন্যায়, সাত বছরের পাপ, দু’ বছরের অক্ষমতা, এক বছরের অন্ধকারযাত্রা-কে ক্ষমা করবেন। ক্ষমা করবেন এই জন্যে যে, হরিদাস করের মৃত্যুতে বাবার সঙ্গে সঙ্গে আমিও যে দুঃখ পেয়েছি তারই প্রমাণ এই গল্প। কিন্তু লেখক দু’ জন, একজন মৃত—অন্যজন জীবিত। একজন হরিদাস কর, অন্যজন আমার ভগ্নী শ্রীমতি সোনালি গুণ। পূর্বাপর সামঞ্জস্য রেখে কোন বিশেষ ঘটনাকে চিহ্নিত করে রাখার জন্যে চিঠি সংরক্ষণের ব্যাপারে বাবার একটা নিষ্ঠা আছে। গল্প সাজানোর কৃতিত্বও তাঁর। গল্পের সবগুলি চিঠিই বাবার ড্রয়ারে এমনিভাবেই সাজানো ছিলো। শেষের চিঠিটা পড়তে দিয়ে টেবিলের সবগুলি চিঠি টেনে বের করেছিলেন। আমি সবগুলি চিঠিই পড়েছিলাম একে একে। তারপর আমার যা কৃতিত্ব ছিলো-- তা হলো একটা গল্পের সম্ভাবনাকে প্রত্যক্ষ করার কৃতিত্ব আর ছোটগল্পের সম্পাদকের সঙ্গে স্নেহ ও বন্ধুত্বের সম্পর্কোন্নয়নের কৃতিত্ব। যার জন্যে বানান ভুল ও ভাষার জগাখিচুড়ি থাকা সত্ত্বেও তিনি গল্পটা ছাপলেন এই জন্যে যে পাঠক বুঝুন যে, কত রিয়ালিস্টিক হলে গাল্পিক এমন সত্য লিখতে পারেন। কেননা, আমাদের গল্পের নায়ক-নায়িকারাও গাল্পিকের মতোই সব কথা শুদ্ধ করে বলবে, দক্ষ গাল্পিকের মতোই শুদ্ধ করে চিঠি লিখবে এটা আশা করার যৌক্তিকতা সম্বন্ধে আমার সন্দেহ আছে। এবং কামাল বিন মাহতাব তা সমর্থন করেন
নি. গুণ।
গল্পপাঠ-সম্পাদকের টীকা.
১. কামাল বিন মাহতাব ষাটের দশকে প্রকাশিত ছোটগল্প নামের পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তিনি নিজেও গল্পকার ছিলেন। তিনি মনে করতেন-- গল্পকে কবিতার হাত থেকে বাঁচাতে হবে। তিনি বেশ কয়েকজন কবিকে দিয়ে গল্প লিখিয়েছিলেন। তিনি ১৯৯৯ সালে মারা যান। ছোটগল্প নামে পত্রিকায় কামাল বিন মাহতাবের অনুরোধে নির্মলেন্দু দুটি গল্প লেখেন। একটি ‘হরিদাস কর মারা গেলেন’ এবং অন্যটি ‘কবিতার গল্প’।
লেখক পরিচিতি
নির্মলেন্দু গুণ
(জন্ম: জুন ২১, ১৯৪৫, আষাঢ় ৭, ১৩৫২ বঙ্গাব্দ)।
বারহাট্টা, নেত্রকোণা, বাংলাদেশ।
বাংলাদেশী কবি এবং চিত্রশিল্পী। কবিতার পাশাপাশি তিনি গদ্য এবং ভ্রমণকাহিনীও লিখেছেন। তাঁর কবিতায় মূলত নারীপ্রেম, শ্রেণী-সংগ্রাম এবং স্বৈরাচার বিরোধীতা, এ-বিষয়সমূহ প্রকাশ পেয়েছে। ১৯৭০ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রেমাংশুর রক্ত চাই প্রকাশিত হবার পর জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এ-গ্রন্থের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে লেখা হুলিয়া কবিতাটি ব্যাপক জরপ্রিয়তা অর্জন করে এবং পরবর্তীতে এর উপর ভিত্তি করে তানভীর মোকাম্মেল একটি পরীক্ষামূলক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। এছাড়াও তাঁর স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো কবিতাটি বাংলাদেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তকে পাঠ্য। তিনি ১৯৮২ সালে বাংলা একাডেমী এবং ২০০১ সালে একুশে পদক পুরস্কার অর্জন করেন।
গল্পগ্রন্থ : আপন দলের মানুষ।
উপন্যাস : দেশান্তর।
আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ
আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ
----------------------
আমার ছেলেবেলা
আমার কণ্ঠস্বর
আত্মকথা ১৯৭১(২০০৮)
আমার ছেলেবেলা
আমার কণ্ঠস্বর
আত্মকথা ১৯৭১(২০০৮)
1 মন্তব্যসমূহ
খুব ভালো লাগল। গল্পপাঠ-সম্পাদকের কাছে কৃতজ্ঞ রইলাম,
উত্তরমুছুনশ্রাবণী দাশগুপ্ত।