সুদর্শনা রহমানের গল্প : কাব্য-কথা

শহরের এই অঞ্চলটিতে তখনো ফ্ল্যাট কালচারের বেনো জল হুহু করে ঢুকে পড়েনি তাই টিনের চৌচালা বাড়ি আর পাকা বাড়ির সহ অবস্থান অনেকটা বন্ধুর মতোই । এ পাড়াতেই কাব্যদের বাস, তাদের বাড়ির অধিবাসীরা যে সাধারণ একটি নিম্ন আয়ের পরিবার সেটা বুঝবার জন্য আলাদা করে মগজ খাটাবার প্রয়োজন নেই । তবে, বাড়ির সামনের সযত্নে লালিত ছোট্ট এক টুকরা বাগান, গেটের উপরে মাধবীলতার দোল খাওয়ানো বাঁশের গেট বাড়ির মানুষদের সুরুচির পরিচয় বহন করে । পথ চলতি মানুষের মন কাড়ে নানা মৌসুমি ফুলের বাহার, যাওয়া আসার পথে এক নজর হলে ও এই বাড়িটির দিকে চোখ তুলে চায় সবাই কামিনী, বেলি, হাস্নাহেনা, টগর, জুঁইয়ের সুবাস বুক ভরে টেনে নেয়, ছেলে বুড়ো সবাই মুহূর্তেই মনটা প্রফুল্ল হয়, ক্ষণিকের জন্য হলেও ভুলে যায় ঊর্ধ্বগামী বাজারদর আর নিত্য জ্বালা যন্ত্রণা । এ পাড়াতে কাব্যরা বেশ অনেক দিন ধরে আছে। তাই বাড়িটা কাব্যদের বাড়ি এই নামেই চেনে পাড়ার লোকে । কাব্যের বাবা ছাপোষা মধ্যম মানের একজন ব্যঙ্ক কেরানী, অফিস আর বাড়ি এই টুকুই তাঁর চৌহিদ্দি, নির্বিরোধী মানুষ। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে কারো সাথে মেশেন না ।



তিন ভাইবোনের মধ্যে কাব্য সবার বড়, ঢাকা ইউনির অনার্সের প্রথম বর্ষের ছাত্র, পাড়ার দুটি বাড়িতে টিউশন পড়ায়। তাতে তার নিজের হাত খরচ চলে যায়। ওর সমবয়সী ছেলেদের মতো কোনো বদাভ্যাস ওর নেই। নেশার মধ্যে এক হচ্ছে বই পড়া । তাই, মাঝে মাঝে মায়ের হাত খালি হলেও ওর সঞ্চিত ভাণ্ডার থেকে সংসারের রসদ আসে, ছোট ভাইবোনের টুকিটাকি আব্দার মেটে । সারা পাড়ায় কাব্যের প্রচুর খ্যাতি অন্ত্যন্ত ভদ্র, ভাল ছাত্র হিশাবে, লোকের যে কোনো আপদ বিপদে এক ডাকে পাশে এসে দাড়ায় কাব্য ওর বন্ধুদের সাথে নিয়ে তা, সে কারো বিয়ে বাড়িই হোক বা হোক বা মৃতবাড়ি । সে সময়ের পরিবেশ ও আজকালকার মতো এতোটা স্বার্থপর হয়ে ওঠেনি যে, পাশের বাড়িতে কারা বাস করছে তা নিয়ে কারো মাথা ঘামাবার সময় নেই, পাড়া পড়শিরা তখনো আত্মীয় হেনই ছিল, একে অপরের দুঃখে সুখে ।

কাব্যের ছোট দুটি স্কুলে পড়ুয়া ভাই বোন , ওদের সদাহাস্যময়ী মা, সংসারটিকে তিনি বুক দিয়ে আগলে রাখেন । সুনিপুণ গৃহিণীপনায় সংসারের কঠিন আগুনের আঁচ থেকে যথা সাধ্য সন্তানদের বাঁচিয়ে চলেন, তাঁর গুছিয়ে সংসার করবার গুন আর মধুর ব্যবহারে পাড়ার মহিলাদের বিশেষ প্রিয় তিনি।

কাব্যদের ঠিক পাশের সুদৃশ্য দোতালা বাড়িটি কথাদের, কথার বাবা আজান রহমান পৈতৃক সূত্রে একটা জমজমাট ব্যবসার মালিক। এই পাড়ার তাঁরা আদি বাসিন্দা । আজান রহমানের অন্য ভাইরা ঢাকার অভিজাত পাড়ায় উঠে গেলেও তিনিই শুধু মা বাবার স্মৃতি জড়ানো বাড়িটিতে রয়ে গেছেন। অন্য কেউ হলে এতদিনে এই পুরানো নকশার বাড়িটা হয়তো ভেঙ্গে ফেলে মাল্টিষ্টোর বাড়ি তৈরি করতো। তাঁর একটি মাত্র মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে ছোট্ট সংসার তাই ও নিয়ে কক্ষনো ভাবেননি । ছটফটে মিষ্টি চেহারার কথা, পাড়ার আর দশটা মেয়ের সাথে হেসে খেলে বড় হয়েছে, ওর মা বাবা কখনো ওকে কঠিন শাসনের বৃত্তে বাঁধেননি কিবা, দেননি এমন শিক্ষা যাতে ও সামাজিক শ্রেণীবিভাগকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে শেখে । কাব্যদের বাড়িতে ওর আর ওদের বাড়িতে কাব্যের অবাধ যাওয়া আসা, কাব্যের খালাতো বোন মেঘ আর ও একই স্কুল কলেজে পড়েছে। দুজনই এবার উচ্চমাধ্মিকের পরীক্ষা দিয়েছে ।

কথাদের পরের গলিতেই মেঘেদের বাড়ি, ছোট বেলা থেকেই দুজন হরিহরাত্মা বন্ধু, বলতে গেলে ঘুমানোর সময়টুকু ছাড়া সারাদিন একসাথেই কাটে দুজনের । কলেজ ছাড়া আর কোথাও যেতে হলে কাব্যই তাদের চলনদার, প্রায়ই তিনজন দল বেঁধে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়, কখনো বই মেলায় তো কখনো বাণিজ্য মেলায় । কথার হয়তো চন্দিমা উদ্যানে ঘুরবার শখ হোলো তো কাব্যের উপর তলবজারী হোলো, ভাল কোনো মুভি রিলিজ হোলো তো কাব্যই তাদের জন্য টিকিট যোগাড় করতে ছুটল, পড়তে বসে হঠাৎ কথার চটপটি খেতে সাধ হোলো তো কাব্যকে খবর পাঠাও । ধীরে, ধীরে যে কাব্য আর কথা দুজনের প্রতি অনুরক্ত হয়ে উঠছে তা মেঘের নজর এড়ায় না, ওদের মাঝের অনুচ্চারিত ভালবাসার কথাটি ও মেঘের অগোচরে থাকে না, মনে, মনে ও পুলকিত বোধ করে, কি সুন্দর জুটিই না হবে দুটিতে মিলে, কথাকে ওর হবু ভাই বউ ভেবে মন ভরে ওঠে ওর । আর কাব্য ও মনে মনে ভবিষ্যতের রঙ্গিন ছবি আঁকে, আর মাত্র কয়েকটা বৎসর পড়া শেষে ও কোনো নাম করা কলেজে অধ্যাপনা করবে ততদিনে, কথার কলেজের পর্ব শেষ হয়ে যাবে তারপর দুটিতে মিলে ছোট্ট একটা নীড় বাঁধবে । আর কথাদের বাড়ির সবাই এমন কি, কথার রাশভারী বাবা তো ওকে এতো পছন্দ করে তাই এ বিষয়ে ওর মনে কোনো দ্বন্দ্ব থাকে না। কাব্য, কথার মায়ের ও ছেলের অভাব পূরণ করেছে, তাঁর যে কোনো ছোট খাট ফরমায়েশ ও কাব্য হাসি মুখে পালন করে । নির্জন অলস দুপুরে বাড়ির যখন পুরুষরা বাইরে বাচ্চারা স্কুল কলেজে, কথা আর কাব্যের মা গান শুনে বা খোস গল্পে দিব্যি সময় কাটান, দুজনেরই পাড়া বেড়ানি স্বভাব নয় তাই একে অপরের সংগ দারুণ ভাবে উপভোগ করেন, কখনো বা দুজন মিলে নূতন পাওয়া রান্নার রেসিপি পরখ করে দেখেন আবার হয়তো বা নূতন কোনো উলের প্যাটার্ন নিয়ে হিমশিম খান ।

কথা আর মেঘের উচ্চমাধ্মিক পরীক্ষা হয়ে গেছে, দুজনের হাতে তাই অফুরন্ত অবৎসর কখনো তারা কাব্যের মায়ের কাছে সংসারের ছোট খাট পাঠ নেয়। আবার কখনো বা কথার মায়ের কাছে বসে নূতন পড়া কোনো বই নিয়ে আলোচনা করে, আবার কখনো বা মেঘদের বাড়ির বিছানা শুয়ে গড়াগড়ি দিয়ে অলস সময় কাটাচ্ছিল । এর মাঝেই কথার ফুপি এলেন অস্ট্রেলিয়া থেকে অনেক বৎসর পর, হাসি গল্পে জমজমাট কথাদের বাড়ি । ফুপির ছেলে মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। ঝাড়া হাত পা, ফুপাও অবৎসর নিয়েছেন কাজ থেকে, দুজনেই হইচই প্রিয় মানু।ষ অল্প দিনেই কাব্যদের সাথে বেশ মিলে গেল। আর মেঘের ও পোয়াবারো। বলতে গেলে এখন এ বাড়িরই বাসিন্দা হয়ে গেছে ।

দিন তিনেক বাদে, রাতে খাবার টেবিলে ফুপি জানালেন তাঁর হাতে একটা ভাল ছেলের খবর আছে, ভাই ভাবী যদি রাজি থাকেন তাহলে তিনি অগ্রসর হতে পারেন । ফুপিদের শ্বশুর বাড়ির তরফের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের ছেলে রুদ্র, অস্ট্রেলিয়ায় সেটেল ভাল চাকরী করে, স্বভাব চরিত্র ভাল, বিধবা মায়ের একটিই ছেলে । অস্ট্রেলিয়ায় যখন প্রথম পড়তে গিয়েছিল তখন ওনাদের বাড়ির গ্র্যানি ফ্ল্যাটে ছিল বেশ কয়েক বৎসর । এখন শহরের অন্য এলাকায় উঠে গেছে। এক অস্ট্রেলীয় ছেলের সাথে ভাগাভাগি করে থাকে একটি ফ্ল্যাটে । রুদ্রদের ঢাকার গুলশানে নিজের বাড়ি গাড়ী আছে, বিধবা মা সেখানেই থাকেন । অল্প দিনের ছুটি নিয়ে ফুপিদের সাথেই এসে। রুদ্র বিয়ে করে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাগজ পত্র তৈরি করে বউকে সাথে নিয়ে যাবে, সংসারে কোনো ঝুট ঝামেলা নাই। কথা মহাসুখে থাকবে ।

ফুপির প্রস্তাব শুনে কথার গলায় ভাতের লোকমা আটকে গেল। কোনো রকমে পানি দিয়ে গিলে ও আস্তে টেবিল ছেড়ে উঠে গেল । বড়রা নিজেদের ভেতর আলোচনায় মশগুল তাই, কেউ ওকে তেমন ভাবে লক্ষ্য করলো না।


ভাবলো, বিয়ের কথায় লজ্জা পেয়েছে বোধহয় । সারা রাত নির্ঘুম কাটিয়ে ভাল করে ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই মেঘের বাড়িতে ছুটে গেল কথা । বন্ধুর আলুথালু বেশ কান্নায় রক্তিম ফোলা ফোলা চোখ, মেঘের বুকের রক্ত ছলকে ওঠে তবে, কি কোনো দুসংবাদ ? মেঘকে জড়িয়ে হাউমাউ কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে কথা, দুবন্ধু মিলে কতো যে এলো মেলো পরিকল্পনা করে এই বিপদ থেকে পরিত্রাণ পাবার । একবার ভাবে আজ বিকালেই কাব্য আর কথা কাজীর অফিসে গিয়ে বিয়ে করে ফেলবে, একবার বিয়ে হয়ে গেলে কেউ তাদের আলাদা করতে পারবে না । আবার ভাবে পালিয়ে দুজন কাব্যের দাদার বাড়িতে চলে যাবে। তারপর, ফুপি চলে গেলে ফিরে আসবে, কিন্তু ছেলেমানুষি কোনো পরিকল্পনাই দানা বাঁধে না । আর ওদিকে কাব্য ভোরের মধুর স্বপ্নে বিভোর হয়ে কথাকে নিয়ে গহীন নদীতে নাও ভাসায় ।

এরপরের ঘটনা বড় দ্রুত ঘটে যায়, ছেলে নিজে আসেনি কথাকে দেখ। ওর মা এসে কথার হাতে একজোড়া ভারী বহু বর্ণের পাথর বসানো বালা পরিয়ে আশীর্বাদ করে বিয়ে দিনক্ষণ পাকা করে গেছেন । সময় স্বল্প তাই সব কিছু সংক্ষিপ্ত করে করতে হচ্ছে বলে কথার মায়ের মনে খুঁত খুঁত করছিল । একটি মাত্র মেয়ে সেই কথা বড় হয়ে ওঠবার পর থেকে কথার মা কতো কিছু ভেবে রেখেছেন ওর বিয়ে উপলক্ষ করে । কিন্তু, কথার বাবা আর ফুপি তাতে কোনো আমলই দিলেন না, তাঁদের দুই ভাই বোনের একই মত এতো ভাল প্রস্তাব হেলায় হারানো বুদ্ধিমানের কাজ নয় । তবু, মায়ের জোরাজুরিতে একবার কথার মত নেবার কথা উঠলে ও তাতে কেউই তেমন গুরুত্ব দেবার প্রয়োজন মনে করলেন না । ফুপা ফুপি রুদ্রকে অনেক দিন ধরে চেনেন, কক্ষনো কোনো খারাপ কথা শোনা যায়নি তার সম্পর্কে, নেশা ভাং করে না, অন্য ছেলে মেয়েদের মতো বিদেশ গিয়ে অবাধ স্বাধীনতা পেয়ে তার অসৎব্যবহার করেছে বলে ও শোনা যায়নি । ফুপি কথাকে রুদ্রের ছবি দিয়ে গেলেন দেখবার জন্য, কথা একবারের জন্য ফিরে ও তাকালো না । ভাই ভাবীকে বললেন, "আজ কাল তো টেলিফোনে ও আকছার বিয়ে হচ্ছে, বিয়ের দিব্যি মানিয়ে গুছিয়ে সংসার ও করছে তারা । রুদ্রর স্বভাব চরিত্র ভাল, আচার আচরণেও খুবই ভদ্র গোছের । ও তো এলো না, চল তোমরা দুজন গিয়ে ওকে একবার চাক্ষুষ দেখে এস তাহলেই বুঝবে যে, আমরা একটু ও বাড়িয়ে বলছি না রুদ্র সম্পর্কে ।

দুটি অমলিন হৃদয়ের বুক নিংড়ানো হাহাকার কারো কানে পৌঁছায় না, শুধু মেঘ তার নীরব সাক্ষী হয়ে থাকে । বাড়িতে আত্মীয় স্বজনদের ভিড় উপচে পড়ছে, কাব্যদের বাড়ির লোকজনরা ও এবাড়ির মানুষদের সাথে পরম আত্মীয়র মতো সব কাজে অংশ নিচ্ছে। শুধু অলক্ষ্যে কাব্যের মায়ের বুক ভেঙ্গে দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে আহা, মেয়েটাকে তাঁর বড় পছন্দ ছিল। কাব্যের সাথে চমৎকার মানাতো । কথার মায়ের ফরমায়েশ মানতে চরকির মতো চক্কর কাটছে কাব্য তার শ্বাস ফেলবার ফুরসৎ নেই, তেমনই সময় নেই নিজের দুঃখ নিয়ে বিলাসিতা করবার, ভিতরে ভিতরে গুঁড়া গুঁড়া হয়ে ঝরে পড়তে থাকে ওর সযত্নে গড়া স্বপ্ন বাসর । সাজানো আলো ঝলমলে বাড়িতে বেজে চলেছে সানাইয়ের করুন বেহাগ যেন, কথা আর কাব্যের বেদনার সুর হয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে কেঁদে চলেছে । কাব্যের বড় সাধ ছিল কথাকে একবার কনের সাজে দেখব। কিন্তু, বিদায় বেলায় কিছুতেই প্রানে ধরে একনজর কথার দিকে তাকিয়ে দেখবার মতো মনের জোর জোটাতে পারে না ও । ভিড়ের ভেতর কোথাও ওকে খুঁজে পায় না কথার দৃষ্টি, সমস্ত অপূর্ণতা বুকে চেপে বিদায় নেয় কথা চোখের জলে ।

অচেনা বর ঘর, হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে কথার বুক শুকিয়ে কাঠ, জিভটাকে কেমন ভারী মনে হতে থাকে, আকণ্ঠ তৃষায় বুকের ছাতি ফেটে যেন চৌচির হয়ে যাবে । ধীরে ধীরে বাসর ঘর খালি হয়ে আসে, মাথায় ঘোমটা টেনে বসে আছে কথা যেন যুগ যুগ পেরিয়ে গেল, বর নামক মানুষটার তবুও কোনো দেখা নেই, ভয়ে উৎকণ্ঠায় কেমন যেন নির্জীব হয়ে পরে ও, কি বলে কথা শুরু করবে, কেমন হবে মানুষটা, এমন রাতে কি কি ঘটতে পারে সে সম্পর্কেও স্বচ্ছ কোনো ধারনা নেই, অনিশ্চয়তায় হাত পায়ের তালু ঘামতে থাকে ওর । রাত প্রায় শেষের দিকে ভেজানো দরজা খুলে কথার বর রুদ্র ঘরে ঢোকে, শুভদৃষ্টির সময় কথা চোখ খোলেনি তাই বরের চেহারা ওর অজানা, বিয়ের আগে যে ছবি দেয়া হয়েছিল ওকে তাও দেখবার মতো মন হয়নি ওর । ঘরে ঢুকেই নিঃশব্দে দরজা বন্ধ করে দেয় রুদ্র, বুকের ভেতর যেন ঘূর্ণি ঝড়ের মতো পাক দিয়ে ওঠে কথার, প্রানপণে আল্লাহ্কে ডাকতে থাকে ও । রুদ্র ওর কাছে এসে মৃদু স্বরে বলে, " কথা তুমি নিশ্চয় খুব ক্লান্ত যাও কাপড় বদলে শুয়ে পরো, বাঁদিকের দরজাটা বাথরুমের ওখানে দেখ তোমার রাত পোশাক রাখা আছে", সাজানো খাট থেকে একটা বালিশ উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে ঘরের আরেক কোনায় পাতা বড় সোফাটায় রাখে আলমারি খুলে একটা চাদর বের করে নিয়ে ওতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে রুদ্র । ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুক্ষণ পর্যন্ত বুঝতে পারে না কথা যে, আসলেই ও যা শুনেছে তা কি ঠিক শুনেছে, ওর যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে যায়, কোনো রকমে টলতে টলতে উঠে বাথরুমে যায় । দরজা বন্ধ করে দিয়ে একটা একটা করে সাজ পোশাক খুলে খুলে ফেলে, বড় অবহেলা ভরে খুলে ফেলে বহুমূল্য গহনা গুলো, ঘষে ঘষে সব মেকআপ ওঠায়, ঠাণ্ডা পানির তলায় ছেড়ে দেয় বিবশ শরীরটাকে । কোনো চিন্তাই ওর মাথায় খেলে না। শুধু আজ রাতের মতো ওর সাথে যে কোনো অঘটন ঘটেনি তারজন্য কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে ওর মন রুদ্রের প্রতি, যাক মানুষটা তাহলে খুব খারাপ নয় ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ।

শাশুড়ির ডাকে ঘুম ভাঙ্গে কথার," বৌমা দেখবে এসো তোমার বাবার বাড়ি থেকে নাশতা এসেছে, তাড়াতাড়ি মুখ হাত ধুয়ে আস"। ধড়মড়িয়ে ওঠে কথা ছিঃ ছিঃ এতো বেলা হয়ে গেছে, চকিতে একবার ঘরের কোণে চোখ বোলায়, রুদ্র নেই রাতের বালিশটা ঠিক ওর বালিশের পাশেই রাখা, উফ বাচা গেল মানুষটার বিচক্ষণতা দেখে খুশী হয় মনে মনে। তা না হলে কি লজ্জায়ই পড়তে হতো আজ ওকে, ভেবেই মনে মনে কুঁকড়ে ওঠে ও । কোনো রকমে কাপড় বদলেই হুড়মুড় করে সিঁড়ি ভেঙ্গে খবার ঘরে প্রায় ছুটে আসে ও, কে এসেছে বাড়ি থেকে মনে হয় আহা কতদিন যেন কাউকে দেখেনি ও ।

টেবিল ভর্তি খাবার সাজানো, শুধু রুদ্রের মা বসে আছেন, ও মুখ খুলবার আগেই তিনি বললেন, "দেখ তো তোমার মায়ের কাণ্ড কতো কিছু পাঠিয়েছেন, কে খাবে এতো সব বলতো। কাজের লোক ছাড়া আমরা মাত্র তিনটি প্রাণী, আত্মীয়জনরা সব কাল রাতেই চলে গেছে, রুদ্রও সাত সকালে উঠে বের হোলো কাজী অফিস থেকে তোমাদের বিয়ের কাবীন নামা নিতে হবে, এমব্যাসিতে গিয়ে সব কাগজ পত্র জমা দিয়ে হবে তোমার ভিসার জন্য"।

কথার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল যে, জানতে চায় কে নিয়ে এলো খাবর গুলো আর ওর সাথেই না দেখা করে কেন বা চলে গেল । শাশুড়ি যেন বুঝতে পারলেন ওর মনের কথা তাই বললেন, " ওই যে, পাশের বাড়ির ছেলেটা কাব্য সে এসেছিল তোমাদের ড্রাইভারকে নিয়ে, কাজের তাড়া আছে বলে বসতে চাইলো না। এক কাপ চাও ওকে দিতে পারলাম না, বড় লক্ষ্মী ছেলে আজ কালের দিনে এমন প্রতিবেশী পাওয়া ভাগ্যের ব্যপার" ।

কথার যেন অনেকগুলো হৃদস্পন্দন মিস হয়ে গেল, কাব্য এসেছিল আর ওর সাথে না দেখা করেই চলে গেল, সেই বিয়ে ঠিক হবার পর থেকে ওর সাথে একবারও সরাসরি দেখা হয় নাই, বিয়ে বাড়ির কাজে এমন নিবেদিত প্রান হয়ে ছিল যে, দুর থেকে ওর ছুটাছুটিই শুধু দেখেছে, একবার লজ্জার মাথা খেয়ে মেঘকে বলেছিল ওকে যেন ডেকে দেয়, কিন্তু কাব্যকে তখন খুঁজে পাওয়া গেল না । বড় কষ্টে দীর্ঘশ্বাস চাপে, ওর প্রিয় সব খবার বানিয়ে পাঠিয়েছেন মা আর কাব্যের মা কাকিমা মিলে, চোখ বন্ধ করেও ও বলে দিতে পারে কোণটা কার রান্না, বিস্বাদ লাগে এতো সুস্বাদু খাবার গুলো, কোনো রকমে খানিকটা খবার মুখে গুঁজে নিজের ঘরে ফিরে আসে । শাশুড়ি বলেন, বিকেল হলেই পার্লার থেকে মেয়েরা আসবে ওকে সাজাতে, তাই ও যেন এবেলাটা ভাল করে রেস্ট করে নেয় । রুদ্র ইচ্ছেই ছিল না বৌভাতের ঝুঁটঝামেলা হোক, একমাত্র ছেলের বিয়ে তাই নিয়ম রক্ষার্থে ছোট করে বৌভাত আয়োজন করা হয়েছে । সন্ধ্যায় কথার বাপের লোকরা আসবে তবে, প্রথা অনুযায়ী ও বাপের বাড়িতে যাবেনা, ওর শাশুড়ি চান যে অল্প কটা দিন হাতে আছে কথা এ বাড়িতেই থাকুক। কথার মা বাবাও এতে আপত্তি করবার মতো কিছু খুঁজে পাননি বরং এই ভাল দুজন দুজনকে চেনবার জানবার সুযোগ পাবে ।


দশ বৎসর পর :

একদিন হঠাৎ বই মেলায় কথা আর কাব্যর দেখা । দুজনেই দুজনকে দেখে ভীষণ খুশী, প্রাথমিক উচ্ছাস কাটবার পর দুজনে মিলে একটা কফি শপে বসে একে অন্যর খোজখবর নেয় ।


কথা বলে," বাবা মারা গেছেন কয়েক বৎসর হলো, অল্প দিনের জন্য এসেছিলাম মাকে দেখতে, ফিরে যাবার সময় ও হয়ে গেছে প্রায়" ।

কল কল করে বলে চলে, "জানো আমি প্রচন্ড সুখী, রুদ্রের সাথে সাথে প্রায় সারা দুনিয়া ঘোরা হয়ে গেছে আমার ও, ঘোরাঘুরির কারণেই এখনো পরিবার নিয়ে পরিকল্পনা করা হয়ে ওঠেনি", বলতে গিয়ে ঝর ঝর করে হেসে ফেলে কথা । "বলতে পারো একেবারে ঝাড়া হাত পা", হাসতে হাসতেই বলে কথা, "ঢাকায় এবার আমি একাই এসেছি। ও প্রচণ্ড ব্যস্ত মানুষ। তাই এবার সাথে আসতে পারেনি", সামান্য থেমে বলে কথা ।

"তোমরা বাড়ি বদলে কোথায় উঠে গেলে কাব্য, মা তোমাদের এখনো খুব মিস করে। একটা ঠিকানা তো মানুষ রেখে যায়। এতো দিনের সম্পর্ক এভাবে কেউ ছিন্ন করে কাব্য ?"

কাব্য বলে, " তুমি তো জানই কথা-- সেই যে সেবার অফিস থেকে ফিরবার পথে বাবা বাস চাপা পড়ে মারা গেলেন, সে ধাক্কা মা সইতে পারেননি । খানিকটা দম নিয়ে বলে কাব্য, " শ্লোক আর কবিতার সবে স্কুল আর কলেজের গণ্ডী পার করছে । সেই সময় যদি আমার বিধবা খালা এসে সংসারের হাল না ধরতেন, তাহলে কথা আমরা কোথায় ভেসে যেতাম । মা থাকতে তো কক্ষনো বুঝিনি কি ভাবে তিনি সংসার চালিয়েছেন এতো স্বল্প আয়ে । বাবার সামান্য পেনশনের টাকা আর গ্রামের বাড়ি থেকে যে টুকু ক্ষুদ কুঁড়ো আসতো তাই দিয়ে কি কোনো ভদ্র এলাকায় থাকা যায় বল? বাধ্য হয়ে তাই আধাবস্তি একলায় উঠে গিয়েছিলাম আমরা । মাকেও অবশ্য আর খুব বেশীদিন বৈধব্যের জ্বালা সইতে হয়নি । মাত্র দুদিনের জ্বরে একজন তরতাজা মানুষ যে এমন ভাবে মরে যেতে পারে এখন ও বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় । কাকিমাকে দুঃখ পাবে জেনে ও ঠিকানা দিতে মন সরেনি কথা"।

"তাছাড়া আমার তো তখন মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল হবার অবস্থা কথা, নিজের পড়াশোনা, শ্লোক আর কবিতার দায়িত্ব, কয়েকটা টিউশানি নিয়ে হিমশিম খাচ্ছি তখন । খালা গ্রাম্য মানুষ পথ ঘাট চেনেন না বলতে পা্রো। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডী পাঠ সবই এক হাতে সামলাতে হয়েছে"।

একটু খন চুপ করে থেকে বলে কাব্য," বি, এ পাস করবার পর মেঘের ও বিয়ে হয়ে গেল, মা মারা যাবার পর কবিতাকে বলতে গেলে ওই তো সামলাচ্ছিল । বিয়ের পর পর মেঘ ও চলে গেল সুইডেনে ওর বরের কাছে । উঃফ সে কি দিন গেছে কথা, ভাবলে এখন ও শিউরে উঠি তবে, ওই যে বলে না দুঃখের দিন যতো লম্বাই হোক একসময় ঠিকই কেটে যায়"।

"কবিতার বিয়ে হয়ে গেছে বরের সাথে ও সিলেটে থাকে, ওদের একটি মেয়ে । শ্লোক পড়াশোনা শেষ করে জাহাঙ্গীর নগর ইউনিতে চাকরী পেয়েছে, বউ নিয়ে ওখানে থাকে মাস্টার্স কোয়াটারে", একনাগাড়ে বলে চুপ করে কাব্য ।

"আর তুমি ?" পুরা বাক্য শেষ করে না কথা উৎসুক মুখ তুলে তাকিয়ে থাকে কাব্যের দিকে ।

হো হো করে হেসে ফেলে কাব্য, "আরে বাবা তোমার বিরহে যে দেবদাস হয়ে যাইনি তাতো দেখতেই পাচ্ছ, তোমার মতো সুন্দরী না হলেও মন্দ নয় দেখতে, সে বেচারা বাচ্চাদের সামলাতে ব্যস্ত তাই সাথে আসতে পারেনি। আমি ও আজকাল কলেজের কাজ নিয়ে দম ফেলবার ফুরসৎ পাই না । বই মেলার সময় নানা লেখকের প্রচুর নূতন বই বের হয়, বেশ ভাল ডিসকাউণ্ট ও পাওয়া যায় তাই, কষ্ট করে হলেও কলেজ লাইব্রেরীর জন্য প্রতি বৎসর বই কিনতে আসি। ভাগ্যিস এসেছিলাম তাই তো তোমার সাথে দেখা হয়ে গেল" ।

"এবার তো আর সময় নেই সামনের বার যখন আসবো ঠিক তোমার ওখানে গিয়ে হাজির হবো দেখো,'' কেমন যেন আনমনা সুরে বলে কথা ।



২ বৎসর পর : 

কথার সাথে মেঘের দেখা মলে, দুবদ্ধু দুজনকে জড়িয়ে হই,হই করে ওঠে । মেঘও বিদেশে থাকে। ব্যস্ত জীবন, বহুদিন পর বাড়ী এসেছে জানায়, পরস্পরকে দোষারোপ করে যোগাযোগ না রাখার জন্য। দুজনেই সতর্ক ভাবে এড়িয়ে যায় কাব্যর প্রসঙ্গ । কথা আর মেঘ দুজনেই কিছুদিন পর বিদেশে ফিরে যাবে, তাই আবার সহসাই দেখার করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাড়ী যায় দুজনে ।

বিদেশে ফিরে যাবার আগে মেঘ এসেছে কথার বাড়িতে, কথা বাড়ি ছিলনা অনেক্ষ।ণ ওর মার সাথে গল্প করে ফিরে যায় । কাব্যর বাড়িতে আসে। মেঘ সেদিন বিকেলে, ও কিছু বলারর আগেই কাব্য জানায়, "জানিস আমার সাথে কথার দেখা হয়েছিল বৎসর দুয়েক আগে বই মেলায় , ও এখনো সেই আগের মতোই আছেরে, কথাকে দেখে খুব ভাল লাগলো, খুশী হলাম জেনে ওর সুন্দর বিবাহিত জীবনের কাহিনী" ।

মেঘের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া জল দেখে থতমত খায় কাব্য, "কি হোলো কাঁদছিস কেন বোকার মতো, কোথায় বন্ধুর সুখে সুখী হবি তা নয় হাপুস নয়নে কেঁদে ভাসালি" ।

মেঘ তখন কান্না জড়ানো গলায় খুলে বলে কথার আসল ঘটনা যা ও কথার মার কাছে জেনেছে । বিয়ের পর কাব্য একাই ফিরে যায়। কিন্তু দীর্ঘ দিন যখন সে কথাকে ওখানে নেবার নাম করে না তখন রুদ্রের মা ছেলের উপর চাপ সৃষ্টি করেন । কথা ভেবেছিল হয়তো, রুদ্রের জীবনে অন্য কোনো মেয়ে আছে অথবা ও আগে থেকেই কোনো অজি মেয়েকে বিয়ে করেছে, এমন তো কতো জন করে বিদেশে নাগরিকত্ব পাবার লোভে আবার দেশে গিয়ে আর একটা বিয়ে করে পরিবারের পছন্দে । অস্ট্রলিয়ায় যেয়ে জানতে পারে কথা, ওর বর তার অজি মেয়ে নয়-- ছেলে বন্ধুর সঙ্গে দীর্ঘ্য দিন ধরে সহবাস করে আসছে । সেই ক্লাস এইট থেকে রুদ্র হস্টেলে থেকে পড়াশুনা করছে। কখনো ছেলে ছাড়া অন্য মেয়ের সাথে মেশবার সুযোগ পায়নি ও, ক্লাস টেনে উঠবার পর থেকেই ও সমকামিতায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, মেয়েরা ওকে একেবারেই টানে না, বিয়ে করবার কোনো ইচ্ছেই ওর ছিল না । ছেলেবেলায় রুদ্র বাবাকে হারিয়েছে, স্বামীর মৃত্যুর পর রুদ্রের মা একা থেকেছেন ছেলের কল্যাণের জন্য । ওকে একা হাতে ঠিক মতো মানুষ করতে পারবেন না ভেবে, আত্মীয়দের সাথে পরামর্শ করে নাম করা বোর্ডিং স্কুলে রেখে পড়িয়েছেন । মায়ের এত আত্মত্যাগ কি করে অস্বীকার করে রুদ্র তাই, বিধবা মায়ের কাছে সত্য বলার সাহস হয়নি, প্রানে ধরে তাঁকে দুঃখ দিতে পারেনি । অনেক চেষ্টা করেছিল বিয়েটাকে এড়িয়ে যাবার। কিন্তু, মায়ের অনুরোধ উপরোধে লোকদেখানো বিয়ে করতে বাধ্য হয় । কথার কাছে হাত জোড় করে মাফ চায় রুদ্র, দেশে যেন কাউকে না জানায় এসব ঘটনা তার জন্য কাকুতি মিনতি জানায় ।

পাথর হয়ে যায় শুনে কথা, অন্য একটা মেয়ে যদি ওর প্রতিদ্বন্দ্বী হতো তাও হয়তো ও নিজের মনকে সান্ত্বনা দিতে পারতো, কথাও তো কাব্যকে ভালবেসেছিল কিন্তু, একটা ছেলের জন্য রুদ্র তাকে প্রতারণা করে বিয়ে করেছে এটা যেন তার নারীত্বের অপমান । যদিও, কথাকে নিজের মতো করে জীবন যাপন করতে সব রকম সাহায্য করবার প্রতিশ্রুতি দেয় রুদ্র ওকে । ইংরেজি শেখবার কলেজে ভর্তি করে দেয়। নিয়মিত হাত খরচ দেয়। কোনো দিকে কোনো রকম ঘাটতি রাখে না । কিন্তু, দোতালা বাড়ি ওপর তলায় পাশাপাশি দুটি ঘর, একঘরে রুদ্র আর তার পার্টনার অন্য ঘরে কথা, রাতে তাঁদের সংগমের শীৎকার কথার কানে এসে পৌঁছায় । কখনো আবার নীচের তলার বসবার বা রান্না ঘরে ওদের খোলামেলা জীবন যাত্রার চলমান চালচিত্র নজরে পড়ে কথার । কথা দুহাতে নিজের কান চাপা দিয়ে রাখে। রাতের পর রাত কাটে তার নির্ঘুম ভোর হবার অপেক্ষায়, সকাল হতেই সে অন্যেরা ঘুম থেকে উঠবার আগেই বাড়ি ছেড়ে যায় । বিশাল ওর কলেজের ক্যাম্পাসে একাকী ঘুরে ঘুরে বেড়ায়, ক্লাস শেষে কলেজের লাগোয়া নদীর পাড়ে চুপ চাপ বসে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, অচেনা অজানা বন্ধুহীন শহর দূরে কোথাও যেতে ভরসা পায় না । নিজেকেই বার বার আসামীর কাঠ গড়ায় দাঁড় করায় কি ওর দোষ ? কিছুতেই হিসাব মেলেনা, না মা বাবাকে না শাশুড়িকে কাউকেই খুলে বলতে পারে না । কথার ফুপিরা ও হয় দেশে না হয় ছেলে মেয়েদের কাছে বিদেশে ঘুরে ঘুরে বেড়ান । আর তাঁদের দোষটাই বা কি, ওনারা তো আর জেনে শুনে কথাকে আগুনে ফেলে দেননি । কোন মুখে কথা কাউকে বলবে যে, ঘরে যুবতী বউ থাকতে স্বামী তার পরনারী নয় পরপুরুষে আসক্ত, আর কেই বা বিশ্বাস করবে শুনে এমন সৃষ্টিছাড়া গল্প । কথা তাই বেশীর ভাগ সময় বাড়ির বাইরে কাটিয়ে দেয়, সন্ধ্যা হলে ও আর বাড়ি ফিরতে মন ওঠে না ওর, রাত গুলো ক্রমশই দুর্বিষহ হয়ে ওঠে ওর, দাঁতে দাঁত কামড়ে পরে থাকে কথা একটি মাত্র লক্ষ্য ওর সামনে, নিজের পায়ে দাঁড়ানো ।

একাকী জীবন ওর কাছে অসহ্য হয়ে ওঠে কথার। রুদ্র পারতপক্ষে কোনো বাঙ্গালীর ছায়া মাড়ায় না, নিজের ভেতর গুটিয়ে থাকে বলে তেমন কোনো বন্ধু জোটেনি কথার ও। প্রবাস কোনদিনই ওর কাছে আকর্ষণীয় ছিলোনা, শাশুড়িও মারা গেছেন ইতিমধ্যে তাই আর কোনো বন্ধন নেই রুদ্রের, অবশেষে পড়াশোনা শেষ করে রুদ্রকে ডিভোর্স করে দেশে ফিরবে বলে স্থির করে কথা ।

কথা দেশে ফেরে, গোপনে শুধু মাকে জানায় আসল ঘটনা। তবে, হাজার অনুরোধ শর্তেও আর বিয়ে করতে রাজী হয়নি। পুরনো সব যোগাযোগ সচেতন ভাবে এড়িয়ে চলে কথা, ওর জন্য মা বাবা বাড়ি বদল করে অন্য অঞ্চলে উঠে গেছেন, পাড়ার লোকের অশোভনীয় কৌতূহল থেকে মেয়েকে বাঁচাতে । আত্মীয়রা জানে বনিবনা হয়নি বলে কথা ফিরে এসেছে, নানা জন ওর জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়েছে এসেছে বিভিন্ন সময়ে কিন্তু, কথার এক গো আর বিয়ে করবে না । নিজের মতো করে জীবন কাটাবে ও। বেশী জোর করলে বাড়ি ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে বলে জানিয়েছে, তাই মা বাবা ও হাল ছেড়ে দেন শেষ পর্যন্ত । মেয়ের এই সন্নাসী জীবন আজান রহমান কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি, তিনি মানসিক অবসাদে বেশ ক'বৎসর ভুগে মারা যান সময়ের অনেক আগেই। কথা অস্ট্রেলিয়া থেকে বয়স্ক পরিচর্যা উপর কোর্স করে এসেছিল, গাজী পুরের 'আপন নিবাস' কেন্দ্রটিতে কাজ করে এখন আর মায়ের দেখাশোনা করে দিন পার করছে ।


কাব্য তখন কথাকে নিজের মন গড়া স্বপ্ন কাহিনী বলার ঘটনা জানায় মেঘকে।

" জানিস মেঘ, কথা কষ্ট পাবে ভেবে আমি বলতে পারিনি কি ভাবে বাবা মা চলে যাবার পর ভাই বোনদের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আর নিজের জন্য সময় হয়ে ওঠেনি আমার । তাই সংসার জীবনে এখনও আমি একা, ঢাকা থেকে দূরে এই পূবাইলে এসে ডেরা বেঁধেছি, কলেজে আর বাড়ি ছাড়া তেমন কোথাও যাই না, আজকাল খুব দরকার ছাড়া ঢাকাতে ও যাই না আর"।

সামনে খোলা বই নিয়ে পুরানো দিনের স্মৃতি রোমন্থন করে কাব্য, এমন সময় দরজায় জোরে কড়া নাড়ার শব্দ শুনে চমকে ওঠে, ঘর ছেড়ে বাইরে এসে দেখে রূপোলি জোছনায় ভিজে যাচ্ছে কথা, কাব্য হাত বাড়ায়, "এসো"

২১/০৪/১৩


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ