রমাপদ চৌধুরী'র গল্প : একটি হাসপাতালের জন্ম ও মৃত্যু

স্নেহের অনন্ত,

তোমার চিঠি যথাসময়েই পেয়েছিলাম, কিন্তু নানা কাজের ব্যস্ততায় উত্তর দিতে পারিনি। তোমরা জানো আমি ঠিকাদার মানুষ, ইট-সুরকি নিয়ে বাস করি। কিন্তু আমাদের গ্রামটির কথা আমার মন থেকে কখনো দূর হতে পারে না।

শহরে বড় বড় বাড়ি বানানো আমার কাজ হলেও খেলাই গ্রামের সেই মাটির ঘরের স্মৃতি কোনওদিনই ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। একটু অবসর পেলেই ওখানে ছুটে যাবার জন্যে মন হাঁসফাঁস করে। তোমার পরের চিঠিতে জানলাম একটা হাসপাতাল গড়ে তোলার কাজে তোমরা অনেকখানি এগিয়েছ। আমার কাছে দশ হাজার টাকা চেয়েছ, কিন্তু হয়তো বিশ্বাস করবে না, খরচ করার মতো দশটা পয়সাও আমাদের কন্ট্রাক্টরদের হাতে থাকে না। তবে যথাসাধ্য আমি নিশ্চয়ই সাহায্য করব।
কিন্তু গ্রামের ও আশেপাশের বড় জোতদার বা ব্যবসাদারদের দানে কোনও কিছু গড়ে তোলার দিন কি এখন আর আছে? সেসব এখন আর সম্ভব নয়। সরকার যদি এদিকে মন না দেয়, তা হলে কিছুই হবার নয়। তোমরা বরং মন্ত্রী ধরো, চারপাশের গ্রামের লোকদের দিয়ে দরখাস্ত করাও। চেষ্টা করলে সরকারী টাকায় বেশ বড় একটা হাসপাতাল ওখানে হতে পারে। তারপর আমি তো আছিই। ইতি

গুণময়দা


নুটুদা,

বারাসতের সেই ব্যাপারটা নিয়ে টেলিফোনে আপনার সঙ্গে কথা হবার পর একদিন যাব যাব করেও যেতে পারলাম না। তাই খেলাই গাঁয়ের এই ছেলে ক’টিকে আপনার কাছে পাঠালাম। ওরা ওখানে একটা হাসপাতারের জন্যে উঠে-পড়ে লেগেছে, আমি বলেছি আমিও যথাসাধ্য সাহায্য করব। স্বাধীনতার পর কত জায়গায় কত ইস্কুল-কলেজ-হাসপাতাল হল, অথচ আপনার গ্রামে কালিকাপুরের জন্যে কিছুই হল না। আপনি আমাদের শ্রদ্ধার পাত্র, তার ওপর মন্ত্রী, আপনার পক্ষে নিজের গ্রামের জন্যে কিছু করলে পক্ষপাতিত্ব মনে হবার সম্ভাবনা বলেই আপনি এদিকে নজর দেননি, একদিন বলেছিলেন। কিন্তু গ্রামের লোকদেরও তো একটা দাবি আছে। আপনি এদের কথা একটু ধৈর্য ধরে শুনবেন আশা করছি। আমার শ্রদ্ধাপূর্ণ নমস্কার জানবেন। ইতি

গুণময়



অনন্ত,
নুটুদার সঙ্গে তোমরা দেখা করার পর আমার কথাবার্তা হয়েছে। তোমরা হাজার পনেরো টাকা চাঁদা তুলতে পারলে বোধ হয় একটা সুরাহা হবে।
খবর দিও মাঝে মাঝে। ইতি

গুণময়দা

৪.
অনন্ত,

অনেক দিন তোমাদের চিঠি না পেয়ে ভেবেছিলাম তোমরা আশা ছেড়ে দিয়েছ। যাই হোক, টাকার প্রতিশ্রুতি যখন পেয়েছ তখন বাকী টাকাটা গভর্নমেন্ট থেকে পাবার চেষ্টা করতে হবে। নুটুদাদের কালিকাপুর থেকে আমাদের খেলাই পর্যন্ত বারো মাইলের মধ্যে একটাও হাসপাতাল নেই, গ্রামের লোকদের দুঃখ-কষ্ট ইত্যাদি জানিয়ে তোমরা খবরের কাগজে কয়েকখানা চিঠি ছাপানোর ব্যবস্থা করো। রমেশ নন্দীর ছেলে খবরের কাগজের লোক, তাকে গিয়ে ধরতে পারো। ইতি

গুণময়দা


৫.
অনন্ত,

খবরের কাগজের কাটিংগুলি পেলাম। আমাকে পাঠানোর দরকার ছিলো না, আমি আগেই দেখেছি। তাই ফেরত পাঠালাম। এগুলি নিয়ে জগৎপুরের নিশা ভট্টচার্যের সঙ্গে দেখা করো। উনি যদিও আমাদের পাশের নির্বাচন কেন্দ্র থেকে বিধানসভায় এসেছেন, তবুও খেলাইয়ের প্রতিবেশী গ্রামের লোক তো উনি। তা ছাড়া বিরোধী পক্ষের সদস্য হিসাবে ওঁর পক্ষে হাসপাতালের অভাবের কথাটা তোলা অনেক সহজ। নিশাবাবুকে আমিও চিঠি দিলাম। ইতি

গুণময়দা



অনন্ত,

কাল নুটুদার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হলো। নিশাবাবু বিধানসভায় আলোচনার সময় বেশ বুদ্ধি করে বলে নিয়েছেন। নুটুদার উত্তরটাও আশাপদ। তোমরা দু-একজন চিঠি পেয়েই নুটুদার সঙ্গে দেখা কোরো। আর নিশাবাবুকে ধন্যবাদ দিয়ে এসো। আমিও তাঁকে টেলিফোনে ধন্যবাদ জানিয়েছি। ইতি

গুণময়দা



নুটুদা,
শেষ পর্যন্ত যে ব্যবস্থা হল, তার জন্যে অশেষ ধন্যবাদ। আমরা সত্যিই আপনার জন্যে এতকাল গর্ববোধ করে এসেছি। এখন আরও কৃতজ্ঞ রইলাম। আমার কর্মচারী শিবেনবাবু চিঠি নিয়ে যাচ্ছে, ওর কাছে সব শুনবেন। আপনার লিভারের ব্যাথাটা এখন কমেছে কিনা জানাবেন। প্রতিদিন একচমচ কালোমেঘের রস খেয়ে দেখলে পারতেন। আমি উপকার পেয়েছিলাম। যদি না পান, আমাকে জানাবেন, প্রতিদিন টাটকা কালমেঘ পাঠানোর ব্যবস্থা করব। পরের সপ্তাহেই দেখা করছি। ইতি

গুণময়


প্রিয় শিবেন,

আমি রাঁচি থেকে এ সপ্তাহে ফিরতে পারব না। বারাসতের কাজ কতদূর এগিয়েছে, সিমেন্ট রাখার কি ব্যবস্থা করলে, যতীনবাবু ইস্কুল-বাড়ির প্ল্যান সাবমিট করেছেন কিনা-সব জানাবে। আর নুটুদার সেক্রেটারি ভদ্রলোক--নামটা ভুলে গেছি, তাঁর সঙ্গে দেখা করে খেলাইয়ের হাসপাতালের অর্ডার ইস্যু করার তাগাদা দেবে। একটু চা-টা খাইও। ইতি

গুণময় সেন



যতীনবাবু,

আমার ফিরতে আরও তিন-চারদিন লাগবে। এখানকার বিলটা আদায় হলেই যাব। কাজ করে টাকা আদায় করা একটা সমস্যা। ব্যবসাপত্র গুটিয়ে ফেলতে ইচ্ছে হয় মাঝে মাঝে। যাই হোক, আপনার ইস্কুল-বাড়ির প্ল্যানটা ওদের খুব পছন্দ হয়েছে শুনলাম।

আমাদের খেলাই গ্রামের মাঠে বড় রাস্তার ধারে একটা বড় হাসপাতাল হবার সম্ভাবনা আছে।সরকারী আপিসের কাজ তো জানেন, কত টাকা মোট খরচ হবে ঠিক করতেই আঠারো মাস লাগবে। অতএব আপনি একটা প্ল্যান এঁকে রেডি করে রাখুন, লাখ দেড়েক টাকার মতো খরচ করাতে চাই। হাতের কাছে প্ল্যানটা ফেলে দিয়ে অর্ডার পাস করানো সহজ হবে।

আজ সকালে শিবেন ট্রাঙ্ক-কল করেছিল, তাকেও বুঝিয়েছি। ইতি

গুণময় সেন


১০
নুটুদা,

শিবেনকে আপনার কাছে হাসপাতালের প্ল্যান সমেত পাঠালাম। আপনি একটু দেখবেন। আপনাদের ইঞ্জিনীয়ারদের দিয়ে প্ল্যান করাতে গেলে আমরা আর হাসপাতাল দেখে যেতে পারব না। তাই নিজের খরচেই করালাম। প্রায় পঞ্চাশটি গ্রাম যখন উপকৃত হবে, তখন প্ল্যানের খরচ না-হয় আমিই দিলাম।

আমি কাল রাঁচি থেকে ফিরেছি। আজ রিষড়া যাচ্ছি। দু দিন থাকব।

ফিনান্স ডিপার্টমেন্টে আপনি একটু বলে দেবেন এ বিশ্বাস আমার আছে। আমার শ্রদ্ধাপূর্ণ নমস্কার জানবেন। ইতি

গুণময়

পুঃ-আপনার নির্দেশমতো শঙ্করের চাকরির কথা কলিন সাহেবকে বলেছি। বোধ করি হয়ে যাবে।


১১
শিবেন,

আমাদের করা হাসপাতালের প্লানটা একটু অদলবদল করে অ্যাকসেপ্টেড হয়েছে জেনে খুশী হলাম। টেন্ডার ইনভাইট করে বিজ্ঞাপন বের হবে আগে থেকে জেনে নিও। অদলবদল হবার ফলে এস্টিমেট কি দাঁড়াবে যতীনবাবুকে ভালো করে হিসেব করতে বলবে। খাঁকতি আজকাল সবারই বেড়ে যাচ্ছে, সেদিকটা মনে রাখতে বলবে। বসন্তবাবু লোকটাকে না ট্র্যান্সফার করাতে পারলে চলছে না। সামান্য এটুকু কাজের জন্যে এত টাকা? ইতি

গুণময় সেন

১২
বসন্তবাবু,

শিবেনবাবুকে আপনার কাছে পাঠালাম। শুনবেন। আপনি চিরকালই আমার উপকারী বন্ধু কৃতজ্ঞচিত্তে সে কথা আমি চিরকাল মনে রাখব। কে কে টেন্ডার দেবে আন্দাজ পেলে অনুগ্রহ করে জানাবেন। আর চিনি চাই? ইতি

গুণময়বাবু


১৩
শিবেন,

পরশুদিন দুর্গাপুর থেকে ফিরতে পারব আশা করছি। কিন্তু তার আগেই খেলাইয়ের হাসপাতালের টেন্ডার সাবমিট করতে হবে। বসন্তুবাবুর সঙ্গে ভেতরের খবর পেয়ে যতীনবাবুকে ফ্রেশ এস্টিমেট দিতে বলবে।

রিষড়ার বিলটা পাশ করাতে একবার যেতে হবে তোমাকে। আমি সেবার টু পারসেন্টের বেশী রাজী হইনি। তুমি দরকার হলে একটু বাড়িও। ইতি

গুণময় সেন


১৪
শিবেন,

টেন্ডার অ্যাকসেপ্টেড হয়েছে জেনে খুশী হলাম। নুটুদা কি কিছু বলে দিয়েছিলেন? ডিস্ট্রিক্ট ইঞ্জিনীয়ার দাশগুপ্তর সঙ্গে তুমি এখনো আলাপ করে উঠতে পারোনি কেন বুঝলাম না। অত্যন্ত অন্যায় করেছ। কাজটা হাতে পাবার আগেই আলাপ জমিয়ে রাখলে হত। এখন গেলে শুধুই টাকা-পয়সার সম্পর্ক। ইতি

গুণময় সেন


১৫
অনন্ত,

অনেকদিন তোমাদের কোনো খবরাখবর নেই। তোমরা কি আমাকে ভুলে গেলে? অথচ তোমাদের উৎসাহ দেখেই হাসপাতালের জন্যে আমি আজ ন’মাস ধরে কি পরিশ্রম করেছি ভাবতে পারবে না। শেষ পর্যন্ত হাসপাতাল হচ্ছে। যদিও গ্রামের হাসপাতালের বাড়িটা বানিয়ে ব্যবসায় বিশেষ কোনও লাভই হবে না, তবু এ কাজটা আমি নিজে হাতে নিয়েছি। ঠিকাদারদের কোনো বিশ্বাস নেই, জানো তো। শেষে এত চেষ্টায় হাসপাতালের স্যাংশন করিয়ে দু দিনে ধসে পড়বে এ আমি চাইনি। তাই কাজটা নিজেই নিয়েছি।

তোমরা একটু সহযোগিতা করো। ইতি

গুণময়দা

১৬
শ্রদ্ধেয় নিশাবাবু

অনেকদিন আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। সাত কাজে এত ব্যস্ত থাকি যে সময় করে উঠতে পারি না। আজকাল কন্ট্রাক্টরদের অবস্থা তো জানেন, সরকারী আপিসের পেয়াদা থেকে মন্ত্রী অবধি সবাই ধমক দেয়। আর পদে পদে হাত বাড়িয়েই আছে। আপনারা তবু মাঝে মাঝে দু-একটা সত্যি কথা মুখের ওপর বলেন।

খেলাইয়ের হাসপাতালের কাজটা আমি নিয়েছি। লাভ হবে না, লাভ একমাত্র আমাদের ও তল্লাটের একটা বড় হাসপাতাল হবে। বুড়ো বয়সে ওখানে গিয়েই থাকব আমার সাধ, তাই হাসপাতালটা যাতে ভালো হয় তার চেষ্টা করছি। তবে, জানেন তো, সব সময় সব কাজ নিজে দেখতে পারি না। কর্মচারীদের ওপর নির্ভর করতে হয়। যদি হাপাতালের কাজে কোনও ভুলভ্রান্তি দেখেন, দয়া করে কোনও হইচই করবেন না। আমাকে জানাবেন, আমি ঠিক করে দেব।

সেদিন হঠাৎ কিছু গলদা চিংড়ি পেয়ে গেলাম, আপনাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। খারাপ হয়ে যায়নি তো? ইতি

গুণময় সেন

১৭
শিবেন,

ডিস্ট্রিক্ট ইঞ্জিনীয়ার দাশগুপ্ত দিন কয়েক কলকাতায় থাকবেন, ওঁকে কারনানি ম্যানসনের ফ্ল্যাটটা খুলে দিও, বগলাকে কাজকর্ম করে দিতে বলো। আর সব অনুষঙ্গিক ব্যবস্থা করে দিও। ইতি

গুণময় সেন

১৮
অনন্ত,

তুমি খেলাইয়ের ছেলে, আমিও খেলাইয়ের ছেলে। তোমার বাবা ও আমার বাবার মধ্যে কি সম্পর্ক ছিল, আমি আজও ভুলিনি। তা ছাড়া এই হাসপাতালের জন্যে কত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তুমি জানো না। সরকারী আপিসের এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে একটা চিঠি সরতে তিন মাস লাগে। আমার কন্ট্রাক্টররা চেষ্টা করি বলেই সেগুলো নড়াচড়া করে। এ-দেশে যদি কিছু কাজ হয়ে থাকে তা আমাদেরই চেষ্টায়। এর জন্যে এরই মধ্যে কত টাকা জলে গেছে তার হিসেবও জানি না। তবে সে টাকা জলে যায়নি বলে মনে করি, কারণ নিজের গ্রামের কাছে এত বড় হাসপাতাল হচ্ছে এইটুকুই অনন্দ। অন্তত পাশাপাশি পঞ্চাশটা গ্রাম ও থেকে উপকার পাবে।

শুনলাম ছেলেদের দল নাকি আমার রাজমিস্ত্রী ওভারসিয়ারদের নানাভাবে উত্ত্যক্ত করছে। তোমরা এর বিহিত করো। আর ইটের কোয়ালিটি, দরজা-জানালার কাঠ ইত্যাদি নিয়ে তাদের বাজে প্রশ্ন করার কোনও মানে হয় না। কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ, মিস্ত্রীরাই যদি জানত, তা হলে তারাই তো কনট্রাক্টর হয়ে যেত। বিশ্বাস রেখো, আমার গ্রামকে অন্তত আমি ঠকাব না। তা ছাড়া ইঞ্জিনীয়ার দাশগুপ্ত নিয়মিত ইন্সপেকশনে যাচ্ছেন।

তোমাদের সহযোগিতা কামনা করি। ইতি

গুণময়দা


পুঃ-হাসপাতাল সম্পূর্ণ হতে দাও, তখন দেখলে তোমরাও খুশী হবে। এখন খুঁটিনাটি ব্যাপারে বাধা দিলে শেষ অবধি হয়তো হাসপাতাল হওয়াই বন্ধ হয়ে যবে।


১৯
শিবেন,

ইঞ্জিনীয়ার দাশগুপ্তের জন্যে চারখানা টিকিট যেভাবে পারো জোগাড় করে তাঁকে পৌঁছে দেবে। ইতি

গুণময় সেন


২০
অনন্ত,

তোমার চিঠি পেলাম, তুমি যে আমার কথা বুঝতে পেরেছ জেনে খুশী হলাম। আমার চিঠিতে আমি কি তোমার ওপর দোষারোপ করেছিলাম? আসলে আমার সন্দেহ বিরোধী পক্ষের সদস্য নিশা ভটচায কয়েকটি ছেলেকে নাচিয়েছিল। গভর্নমেন্ট কোনও ভালো কাজ করে, এ তো ওরা সহ্য করতে পারে না, যে-কোনও প্রকারে বাধা দিতে চায়। তোমরা তাদের বোঝাবার চেষ্টা করো। ইতি

গুণময়দা


২১
শ্রদ্ধেয় নিশাবাবু,

কাল আপনার বাড়ি থেকে ফেরার পর আপনার কথাগুলি আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। সত্যি, এভাবে চললে এ-দেশের কোনও উপকার হওয়া সম্ভবই নয়। আপনাদের পার্টির ফান্ডে পাঁচ শো টাকা দিতে বলেছিলেন, আমি আজ শিবেনের হাতে এক হাজার টাকা পাঠালাম। আমার পক্ষে যেটুকু সাধ্য সেইটুকুই বা করব না কেন। আপনারা হয়তো ভাবেন আমরা অনেক লাভ করি। কিন্তু ধারণাটা ভুল। একদিকে ট্যাক্স সতেরো রকমের, অন্যদিকে পদে পদে ঘুষ। ব্যবসা করতে ইচ্ছে হয় না। আর দিশী জিনিসের যা হাল হচ্ছে আজকাল, আমরা নিরুপায় বলে ব্যবহার করি, লোকে দোষ দেয়।

আগামী ইলেকশনে আপনি দাঁড়াবেন না বলছিলেন। কিন্তু হাজার হাজার মানুষ যে আপনার মুখ চেয়ে আছে এ কথা ভুলবেন না। সশ্রদ্ধ নমস্কার জানবেন। ইতি

গুণময় সেন


২২
মাই ডিয়ার দাশগুপ্ত,

লঞ্চে করে দিন কয়েক সুন্দরবনের দিকে বেড়াতে যাচ্ছি, পাখি শিকার করা যাবে। ইঠকাঠের জগৎ কি আপনারই ভালো লাগে, না আমার ভালো লাগে। মিসেস ও বাচ্চাদের নিয়ে চলুন না, ঘুরে আসি। খুব ভালো লাগবে।

মিসেসকে আমার সশ্রদ্ধ নমস্কার জানাবেন, বাচ্চাদের আমার স্নেহ। ইতি

সেন

পুঃ-- বেনারসীখানা মিসেসের পছন্দ হয়েছে কি না জানাবেন।


২৩
নুটুদা,

খেলাই-কালিকাপুর হাসপাতালের কাজ অনেকদূর এগিয়েছে, কিন্তু এবার বোধ হয় কাজ বন্ধ রাখতে হবে। প্রথম কিস্তির বিলটার এখনো পেমেণ্ট পেলাম না। অনেক চেষ্টা করেছি। মুকুজ্যে সাহেবকে একটু ফোনে বলে দিন না দয়া করে।

সেদিন আপনার ওখান থেকে আসার পর ভীষণ সর্দিকাশিতে কাহিল ছিলাম। আপনি কেমন আছেন? ইতি

গুণময়

পুঃ-জমিটা কিনে ফেলুন, বাড়ির জন্যে ভাববেন না।


২৪
শিবেন,

মুকুজ্যে সাহেব কি চায় স্পষ্টাস্পষ্টি জেনে নাও ক্লার্কটার কাছে। এই জন্যেই বলেছিলাম যতীনবাবুকে এস্টিমেট বাড়িয়ে করতে।

রাঁচির ব্যাপারটায় আই টি ও মূর্তি এটা কি করল? হাতে মাথা কাটতে শুধু বাকী। ইতি

গুণময় সেন


২৫
শিবেন,

প্রথম কিস্তির টাকাটা পেমেন্ট পেয়েছ জেনে খুশী হলাম। দাশগুপ্ত আবার পার্সেন্টেজ বাড়াতে চায়। দিয়ে দিও, উপায় তো নেই। যত ঝামেলা আমরা পোয়াব আর লাভের ভাগ ওরাই পাঁচ ভুতে লুটেপুটে নেবে।

হাসপাতালের অ্যাকাউন্টের এক শো টন কাপুরকে দেবে। নগদ। ইতি

গুণময় সেন

২৬
শিবেন,

হাসপাতালের কাজটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতে হবে। আরও মিস্ত্রী লাগাও। দুর্গাপুরে আরেকটা টেন্ডার অ্যাকসেপ্টড হয়েছে। লোক পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে সব বেকার বেকার বলে, অথচ কেউ কাজ করতে চায় না। লোক পেলেই নিয়ে নিও।

হাসপাতালের জানালা-দরজাগুলো তাড়াতাড়ি রং করিয়ে দিও, আর চুনকাম। কে কখন এসে দেখে যাবে, শেষে কাঠের কোয়ালিটি নিয়ে গোলমাল করবে। ইতি

গুণময় সেন


২৭
অনন্ত,

তোমার চিঠি পেলাম। চারপাশের গ্রামের লোকে হাসপাতাল-বাড়িটা দেখে খুশী হয়েছে জেনে আমিও খুশি হলাম।

আমার যেটুকু কর্তব্য সেইটুকুই করেছি। শুভেচ্ছা জেনো। ইতি

গুণময় দা


২৮
শিবেন,

বসিরহাটের টেন্ডার দেবার ব্যবস্থা করো। যতীনবাবুকে বোলো মার্জিন বেশী রাখতে। খেলাইয়ের ব্যাপারে দেখলে তো এস্টিমেটের চেয়ে কত বেশী উপরি খরচ হয়ে গেল। এদিকে আবার ইনকাম ট্যাক্সের খাঁড়া ঝুলছে। ওদের তো ধারণা হাতে যা পাই সবই লাভ।

যাক, খেলাইয়ের দ্বিতীয় বিলটার পেমেন্ট পেয়েছ এই সান্ত্বনা। ইতি

গুণময় সেন


২৯
ভাই অনন্ত,

তোমার তিনখানি চিঠিই পেয়েছিলাম। এই এক মাস নানা কাজে এতই ব্যস্ত ছিলাম যে উত্তর দিতে পারিনি। খেলাইয়ের হাসপাতালের যে কথা লিখেছ তা শুনে সত্যিই খারাপ লাগছে। কিন্তু আমি আর কি করতে পারি বলো। যেটুকু ভার নিয়েছিলাম তা আমি করে দিয়েছি। শুনে আশ্চর্য হবে, এখনো তার সব টাকা পাইনি। তোমরা নুটুদাকে ধরো। উনি যদি কিছু করতে পারেন। অবশ্য উনিই বা কি করবেন। সরকারী ব্যাপারই এমনি। কন্ট্রাক্টরদের সকলে গালাগাল দেয়, বলে গভর্নমেন্ট নিজে করলে নাকি অনেক ভালো হবে। দেখছ তো সরকারী আপিসের কাণ্ড। আমি হাসপাতালের বিল্ডিং তৈরির দায়িত্ব নিয়েছিলাম, করে দিয়েছি। ডাক্তার, নার্স, যন্ত্রপাতি--এসব তো আমার কাছ কাজ নয়। যন্ত্রপাতি আর ওষুধপত্র যদি আসে শেষ অবধি, সেও জেনো কোনও কন্ট্রাক্টরের কল্যাণে। এখন তো মনে হচ্ছে ডাক্তার নার্স যোগাড় করার কাজটার জন্যেও যদি টেন্ডার ইনভাইট করে তবেই কাজ হবে।

এ-দেশে যেটুকু কাজ হয়েছে তা আমাদের চেষ্টায়। যেখানেই কন্ট্রাক্টর নেই, সেখানেই কাজ পড়ে থাকে। তোমার নুটুটার সঙ্গেই দেখা কোরো। ইতি

গুণময় দা


৩০
শিবেন,

খেলাই হাসপাতালের সব পেমেণ্ট পেয়ে গেছ শুনে খুশী হলাম। বসিরহাটের টেন্ডার অ্যাকসেপ্টেড হল কিনা জানাবে।

আমি এখন দুর্গাপুরেই থাকব। ইতি

গুণময় সেন


৩১
অনন্ত,

তোমার কয়েকখানা চিঠিই পর পর পেয়েছি। আমার যা বলার তা তোমাকে আগেই জানিয়েছি। ডাক্তার নার্সের ব্যাপারে আমার কিছুই করার নেই।

লিখেছ, হাপাতালের বিল্ডিং-এর একটা দেয়াল ধসে পড়ছে। এ ব্যাপারেও আমাদের কিছুই কারা নেই। যথারীতি ইন্স্পেকশন হয়েছিল, তখন কেউ কোনও ত্রুটি পায়নি। বাড়ির যত্ন না নিলে বাড়ি তো ধসে পড়বেই। ইতি

গুণময়দা


৩২
অনন্ত,

তুমি বারবার আমাকে বিরক্ত করছ কেন বুঝলাম না। এ ব্যাপারে আমার কিছুই করার নেই। ইতি

গুণময়দা


৩৩
শিবেন,

অনন্তর চিঠি এলেই ছিঁড়ে ফেলে দিও। রিডাইরেক্ট করে আমাকে পাঠানোর প্রয়োজন নেই। ইতি

গুণময় সেন



‘একটি হাসপাতালের জন্ম ও মৃত্যু’ অলাত এহসানের  আলোচনা: ‘একটি হাসপাতালের জন্ম ও মৃত্যু’র লিঙ্ক--
কাল্পনিক নির্মাণে বাস্তবতাকে আত্মস্থ করার চেষ্টা


লেখক পরিচিতি
রমাপদ চৌধুরী

জন্ম ১৯২২ সালে খড়গপুরে। পড়াশুনা কোলকাতায়। মূলত ঔপন্যাসিক।
ছোটোগল্পে অত্যাধুনিক রীতির উদ্ভাবক।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লেখা শুরু করেন।তার অনেক গল্প নিয়ে অনেক চলচ্চিত্র হয়েছে। তার মধ্যে বনপালাশির পদাবলী , এখনই,খারিজ, একদিন অচানক ,সুন্দরী উল্লেখযোগ্য। ১৯৮৮ সালে তিনি বাড়ি বদলে যায় উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমী পুরস্কার পান। এছাড়াও আনন্দ পুরস্কার ১৯৩৬,রবীন্দ্র পুরস্কার ১৯৭১ | কলকতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পুরস্কার ও পদক |শ্রেষ্ঠকাহিনীর জন্যও কয়েকটি পুরস্কার পেয়েছেন. |

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

5 মন্তব্যসমূহ

  1. কী অসাধারণ! আমার অতি প্রিয় লেখক। একটা ছোট্টো কথা খেয়াল হলো, সাল-তারিখের উল্লেখ নেই বলে, একটু অস্বস্তি।
    শ্রাবণী দাশগুপ্ত।

    উত্তরমুছুন
  2. শুধু কন্ট্রাক্টারের চিঠির মধ্যে দিয়েই ঘটনা এবং চরিত্রগুলি নির্মান করেছেন অসামান্য দক্ষতায়। প্রণাম বরেণ্য সাহিত্যিককে।

    উত্তরমুছুন
  3. কেবল কন্ট্রাক্টারের চিঠিগুলির ভিতর দিয়েই কাহিনী ও চরিত্রগুলি নির্মান করেছেন অসামান্য দক্ষতায়। বরেন্য সাহিত্যিককে প্রণাম জানাই।

    উত্তরমুছুন
  4. রমাপদ চৌধুরীকে পড়া হয়নি এতদিন! এটা আমার জন্য চরম লজ্জার। এত সুন্দর করে যিনি গল্প নির্মাণ করতে পারেন, তাঁর শক্তিমত্তা কল্পনাতীত। অভিভূত আমি। বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই তাঁর পবিত্র স্মৃতির উদ্দেশে।

    উত্তরমুছুন
  5. সম্পাদনা
    Unknown বলেছেন...
    রমাপদ চৌধুরী একটি বিশেষ ঘরানার গল্পকথক। তাঁর সেই পরিচয় এই গল্পেতেও। খুব ভাল লাগল। আপনাদের কাছে অনুরোধ রাখছি, বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের ছোট গল্পের এমন সব মণি-মুক্ত আরও পরিবেশন করুন। এতে মানুষের নতুন করে গল্প পড়া শুরু করার আগ্রহ জাগবে।

    উত্তরমুছুন