শিমুল মাহমুদের গল্প : একজন কবির ব্যক্তিগত জটিলতা

স্বপডানাশূন্য পরীর মতোই তুমি কবিতার শরীর সাঁতলিয়ে চলেছো; কবি কাবেরী কান্তা তোমাকে চাঁদরাত চুম্বন। চাঁদরাত হাসির আড়ালে তোমার নন্দন-নিষিক্ত হৃদয়। অথচ চারিধার আগাছা; আগাছাদের ভেতরই আমাদের হাঁটতে হয় চিরকাল; কখনও বা আগাছাদের ভেতরই বেড়ে ওঠে কাঠবৃক্ষ চন্দনবৃক্ষ। চারিধার কাঠচেরাইয়ের শব্দ। সেই কাঠে আসবাব হয়। কবির মৃত্যুর পর সেই আসবাবের ওপর দেহময় শরীরসর্বস্ব মানুষেরা শুয়ে থাকে। তারপর আবারো কবির মৃত্যু হলে আগুনের অভিমানকে বশে এনে বলতে হয়--- আগুন, এই নাও আঙুল, লেখার আঙুল; নোখ আর কবির হাতের শুভ্রতা; এই নাও আমার শূন্যতা--- এই নাও আমার পূর্ণতা; এই নাও আমার অভিমান। এই সেই আগুন, যে আগুন দহনক্ষণে হয়ে উঠেছিল প্রাঞ্জল; আমাকে করেছে অহঙ্কারী অথচ উদাস পথের বাউল--- একজন বাউলের পথ চলা। অথচ পেছন থেকে শুয়োরের বাচ্চারা ধাক্কা দিচ্ছে কেন?


তস্কর ঘাতকের দল মেহেরচণ্ডী বরাবর পালিয়েছে। ওরা আবার ফিরে আসবে; তখন ওদের নোখ, ওদের দাঁত, দাঁতাল শুয়োরের চেয়েও ভয়ানক হবে। ওরা একজন কবিকে প্রকৃত কবির মতো বেড়ে উঠতে দেবে না। চারিধার ভয়। ভয়ের বসতভিটা। অতঃপর প্রচলিত বিশ্ববিদ্যালয়কে ওরা বেশ্যাবিদ্যালয় বলে গালি দিলে দেশের সবকটি বিদ্যালয় মহাবিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয় ভয়ে কুকড়ে উঠে বন্ধ হয়ে যায়।

রাস্তায় রাস্তায় ধর্মীয় শাসন টহল দিতে থাকলে সেইদিন ভোররাতে সংবাদ পাওয়া যায় ছাত্র ইউনিয়নের স্বপন বিল্লার দুপায়ের রগ কেটে নিয়েছে ওরা। এবং আরও একটি হত্যা সংবাদ যখন কিছুতেই গোপন করা গেলো না তখন ভোরের সমস্ত পাখিরা গান হয়ে আকাশে ছড়িয়ে পড়ার আয়োজনে ঐক্যবদ্ধ হলে সমস্ত শহরে কারফিউ জারি করা হলো। তারপরও কাবেরী কান্তার সমস্ত কবিতা হয়ে উঠলো পবিত্র পাখির ডানা।


সময়ের অবিরত ভার বয়ে চলেছে গাছেরা। আর শাখাগুলো হাতে তুলে নেয় প্রেম। আমাদের মধ্যে একজন কবি আছেন; যার হৃদপি- লতিয়ে উঠতে শুরু করেছে; অন্তর ফুঁড়ে বাইরে আসতে চাইছে সবুজ পাতা। আর আমরাতো চেয়েছিলাম তার মতো সেই দ্বীপ, যে দ্বীপে কোনো প্রতিপক্ষ নেই; হাড়ের কোনো স্তুপ নেই। শুধু একজনই দেখতে পায় সেই দ্বীপের শরীরঘন দৃশ্য। প্রিয় কাবেরী কান্তা, এই শিক্ষাঙ্গনে ধ্বস নামার আগে, এই শহরে ধ্বস নামার আগে, এই পথে মিছিল নামার আগে তোমার কবিতার মতো এত আপন ছিলো না কিছু।

এই বুক তো শিখেছে কীভাবে শিল্পের অহম পুষে রাখতে হয় রাতভর, দিনভর। রাতভর, দিনভর আমরা বন্ধুপাগল। মৃত্যুকে আরো খানিকটা থামিয়ে রাখতে হবে। এই ফাঁকে পৌঁছে যাবো পাখিদের দেশে; যেখানে ঝাঁকঝাঁক পাখিদের ভাই-বোনেরা এখনো নিখোঁজ। আমরাই খুঁজে নেবো আমাদের আত্মীয়, শ্রেষ্ঠ কবিতা। বৃক্ষবন্ধু বোঝে এ যাতনা, মর্মকথা। আগুনের মতো বৃক্ষের উষ্ণতায় পুড়ছে পীড়িত রাত্রির চোখ। এসো, এই রাতে মিলিত হও। এসো, নদীর গভীরে হারিয়ে ফেলি পথ। এসো, দেখে যাও একজন কাবেরী কান্তা, যে মেয়েটি জন্মগতভাবেই কবি অথবা একজন শফিক আশরাফ, যে ছেলেটি প্রকৃতগতভাবেই গল্পকার; এসো দেখে যাও, একজন কাবেরী কান্তা অথবা একজন শফিক আশরাফ বুকের নিচে কীভাবে কতটুকু গোধূলি রেখেছে পুষে।

প্রিয় কাবেরী কান্তা, কবিতার অধিকার কতটুকু কোন সীমানায় পৌঁছে যেতে পারে, সেই পথের পরিচয় কী ভয়ানক মর্মার্থ বহন করে নিয়ে আসবে আমাদের জীবনে; ভেবে দেখেছো কখনো?

তারপর শফিক যখন অনির্দিষ্ট দিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মাদারবক্স হল থেকে টাঙ্গাইলের কালিহাতিতে ফিরে গেল; অবশ্য তার আগে তাকে কাবেরীর সাথে জয়পুরহাট পর্যন্ত যেতে হয়েছিল; তখন বাড়িতে ফেরার পর নীরব দুপর অথবা তাঁতশিল্পীদের ভিড়ে অথবা বন্ধুদের তাসের আড্ডায় এবং অতঃপর যখন কিছুতেই মস্তিষ্ক রিল্যাক্স পেলো না তখন টাঙ্গাইলের আধা শহরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ঠোঁটে গালে ভ্রুতে রঙ লাগানো অল্প বয়েসি, আধা বয়েসি, পূর্ণ যুবতি অথবা ঢলঢলে যৌবন, চিকন যৌবন অথবা দুর্বোধ্য যৌবনে ঠাসাঠাসি ভাড়া খাটা মেয়েগুলোকে বিরক্ত করবে কিনা ভাবছে অথবা সত্যি সত্যিই এক দুপুরে কাজরি নামের মেয়েটির কক্ষে, হয়তো নামটি সঠিক ছিল না অথবা যথার্থ ছিল; কাজরির ঘর থেকে সেদিন শফিক গোপনে অথবা উদভ্রান্ত বুক চেপে ধরে অথবা দিকভ্রান্ত ভীনদেশী একজন খালাসীর মতো, যে কিনা এইমাত্র কোনো পরিচিত বন্দরে নেমেছে এক ধরনের শরীরী খায়েশ নিয়ে অথচ শফিক খালাসিটির মতো কোনো প্রকার পুরুষালি কাজ না করেই মেয়েটির টেবিলের ওপর পঞ্চাশ টাকার একখানা নোট রেখে দ্রুত চলে আসে।

কাবেরী কান্তা যখন সত্যিকার অর্থেই সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দিল তখন শফিক মাত্র একুশ দিন আগের নাটকতুল্য দুর্ঘটনাটিকে নিয়ে নতুন দার্শনিকতায় ভাবতে শুরু করলো এবং সিদ্ধান্ত নিল বিষয়টি নিয়ে একখানা গল্প অবশ্যই লিখবে। অথচ শফিকের জানা ছিলো না, তার এই গল্পটি, যে গল্পটি এখনও লেখা হয়ে ওঠেনি; যে গল্পটি দীর্ঘ দীর্ঘ বছর পর লেখা হলে সেটি একটি নির্দিষ্ট লিটলম্যাগে ছাপা হলো। এবং সেই নির্দিষ্ট লিটলম্যাগের লেখক ছিল সুনির্দিষ্ট। লিটলম্যাগটি এক ধরনের অন্ধ অহঙ্কারে নির্দিষ্ট সংখ্যায় ছাপা হতো। ছাপাসংখ্যা ছিল ১২০। সংশ্লিষ্ট লেখকগণ বিশ্বাস করতেন তাদের লেখা পাঠ করার মতো যোগ্যতা মাত্র ১২০ জনেরই রয়েছে। সুতরাং সঙ্গত কারণেই জনসমাজে অপঠিত গল্পটির কারণেই কাবেরীর সাথে শফিকের যে আবার দেখা হওয়া সম্ভব তা শফিক সাম্যবাদতুল্য বিপ্ল¬বের মতো অসম্ভব বলেই জানতো।

যখন কবি কাবেরী কান্তা একজন বেঁটে মোটা এবং কালো মুখের টেকো ভদ্রলোকের স্ত্রী এবং তখন তারা স্বামী স্ত্রী উভয়েই একটি বেসরকারি কলেজের লেকচারার এবং ততদিনে স্বামী ভদ্রলোক জেনে গিয়েছেন গল্পকার শফিক আশরাফ তার স্ত্রীর শিক্ষাজীবনের ঘনিষ্ট ফ্রেন্ড। এই নির্দিষ্ট বন্ধুটির সাথে তার স্ত্রীর এক বিশেষ শিক্ষাস্তর অতিবাহিত হয়েছে; যার লিখিত প্রমাণ শফিক ও কাবেরী বিষয়ক একখানা ছাপানো ছোটগল্প। অথচ গল্পের শিল্পিত স্বার্থে শফিককে অনেকটা রঙ চড়াতে হয়েছিল এবং গল্পে এই রঙ চড়ানোটাই ছিল শফিকের জীবনের আরও একখানা নির্বোধ ভুল।

শফিককে যেতে হয়েছিল কাবেরীর সাথে বাসে। কেননা সেদিন স্বপন বিল্ল¬ার মৃত্যুর সংবাদে যখন ক্যাম্পাস পুলিশের নিয়ন্ত্রণে যেতে শুরু করেছে তখন সন্ধ্যার ভেতর ভারসিটির সবকটি হোস্টেল এমনকি মহিলা হোস্টেলের ছাত্রীদেরও হল ভ্যাকান্ট করতে বাধ্য করা হলে গ্রুপে গ্রুপে ছাত্র-ছাত্রীরা ট্রেন অথবা বাস অথবা শহরের আত্মীয় অথবা পরিচিত অথবা বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে আশ্রয় নিলে আর সবার মতো শফিকরা এগার জনের একটি দল; দলের পাঁচজনই কাবেরীর মতো কিছুটা অগোছালো অথবা শৃঙ্খল-উচ্ছৃঙ্খলতার মাঝামাঝিতে ঝুলতে থাকা কিছুটা ন্যাকা অথচ প্রয়োজনে বেটাছেলের মতো রুখে ওঠা অথবা বাম রাজনীতি করা অথবা ওদের মধ্যে শুবিধালোভি কেউ কেউ ডান অথবা সত্যিকার অর্থেই গণতন্ত্রের স্বপ্নে চৌকস অথবা কিছুটা মিডিয়াবাজ অথবা কখনো কখনো কেউ কেউ বেজায় সংস্কৃতিমনা; যেমন বুলাদি সত্যিকার অর্থেই একজন ভালো অথবা বলা যেতে পারে কিছুটা নাম করা শিল্পী; যে কিনা ইতিমধ্যেই মঞ্চে অথবা জলসায় জনপ্রিয়তা পেয়েছে; বুলাদি একজন উচ্চ মাত্রার রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী।

অবশেষে ওরা যখন ওদের বান্ধবীদের পৌঁছে দেবার আয়োজনে দূরপাল্লা অথবা মাঝারি পাল্লার বাসে উঠিয়ে নিয়ে যাত্রা শুরু করলো তখন শফিক কাবেরীকে নিয়ে বগুড়া উপস্থিত হলে সন্ধ্যা উত্তীর্ণ এবং ওরা যখন মঙ্গলবাড়িগামী লোকাল বাসের জন্য বাসস্ট্যান্ডের কাউন্টারে খোঁজ নিচ্ছে তখন মঙ্গলবাড়িগামী একখানা ঝুরঝুরে অনেকটা ল্যাংড়া কোনো ভিখেরীর মতো অথচ পেটভর্তি ক্ষুধা; ক্ষুধার ভেতর মানুষে ঠাঁসাঠাসি মাঝারি মাপের ৩৬ সিটের বাসের ছোট চৌকোণা জানালা দিয়ে ভেতরের অবস্থা ঠাহর করতে পেরে কাবেরী সিদ্ধান্ত নিলো আজকের মতো ওদের যাত্রা এ পর্যন্তই। যাত্রাবিরতি।

অবশেষে শফিক যখন বিষয়টি বুঝতে পারলো, কাবেরী কোনো বন্ধু অথবা আত্মীয়ের বাড়িতে রাত কাটাতে রাজি নয় তখন শফিকের কিছুটা মেজাজ খারাপ হলেও সে মেজাজ অচিরেই এক ধরনের আতঙ্কের ভেতর মিইয়ে যেতে থাকে। তারা বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন রেস্তোরার পর্দা মোড়ানো মহিলা কেবিনে গিয়ে উপস্থিত হলো; যেন বা অবশেষে একখানা প্রয়োজনীয় কাজ খুঁজে পাওয়া গেল অথবা পাওয়া গেলো একখানা যুতসই অজুহাত,-- এখন তো খাওয়ার সময়; না খেয়ে তো আর জার্নি করা সম্ভব নয়; এবং ঝালমশলায় জর্জরিত গরুর মাংসের চাপ সহযোগে যখন তারা তাদের রাতের খাবার সারছিল তখন শফিকের হুকুমদারিতে দুজন হোটেল বেয়ারা ব্যস্ত হয়ে উঠলে শফিক বেয়ারাদের মাঝ থেকে একজনকে নির্বাচিত করলো এবং তার হাতে পঞ্চাশ টাকার একখানা লাল নোট ধরিয়ে দিলে বেয়ারাটি কোল্ড ড্রিংস এবং কয়েক শলা বেনসন সিগারেট কিনে আনার জন্য দ্রুত বাইরে চলে গেল।

রিল্যাক্স। ইচ্ছে করলেও এখন মঙ্গলবাড়ি যাওয়া সম্ভব নয়। এখন আর কোনো বাস নেই। বরং রাত আটটা দশে সান্তাহারগামী ট্রেনে চাপা যেতে পারে। সান্তাহার জংশন থেকে ট্রেন পাল্টে জয়পুরহাট। জয়পুরহাট নেমে লোকালবাসে মঙ্গলবাড়ি ১৮ কিলো; এরপর ভ্যান অথবা ট্যাম্পুতে পল্লীবালা বাজার। শফিকের ভালো লাগতে শুরু করেছে। কাবেরীর চোখে-মুখে মায়াঝরানো চালাকি। শ্যামামুখের শ্যামাচোখে কতকালের রাতজাগা ক্লান্তির ভেতর একটা স্বপ্রতিভ মায়া জেগে আছে।

: কি দেখছিস?
: তোর চোখ।
: কেন?
: কেন আবার, এমনি।
: আজ রাতটা বগুড়া থাকবি?
: কোথায়? চল সঞ্জিবদের বাড়ি যাই।
: না।
: তাহলে?
: চল কোনো হোটেলে উঠি।
: তার মানে?
: তার মানে আমি সারারাত ঘুমাবো আর তুই তোর লেখাটা কমপ্লি¬ট করবি।
: তুই থাকলে আমি লিখতে পারবো না।
: কেন, ভয় পাচ্ছিস?

ওরা যখন রিক্সা থেকে নামছে তখন প্লাটফর্মে ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। অবশেষে ওরা বিনা টিকিটে প্রথম শ্রেণিতে নিজেদের জায়গা করে নিলে ট্রেন চলতে শুরু করে এবং শুরু হয় একটা দীর্ঘ রেলগাড়ির দীর্ঘ একটা অন্ধকারের ভেতর ক্রমাগত সেঁধিয়ে যাওয়ার পালা এবং পালাক্রমে অথবা একসাথে কথা বলতে থাকলে সামনের সিটে বসা বিশাল দেহের ভদ্রমহিলা এবং ভদ্রলোক বিরক্তচোখে ওদের দিকে তাকায়। তখন বাইরে ট্রেনের শব্দের সাথে তাল মিলিয়ে ঝরঝরে চাঁদ আর ঝকঝকে তারার দল চিৎকার করতে শুরু করেছে।

কলকাতা থেকে কবি সুনীল সোনা চিঠি লিখেছে কাবেরী কান্তাকে। কবি বিভাষ রায়চৌধুরী কাবেরী কান্তার কবিতার প্রশংসা করেছে। কাবেরী কান্তার বায়োডাটাসহ কবিতা চেয়ে পাঠিয়েছে। কাবেরী শফিককে চিঠিখানা বের করে দেখালে শফিক কাবেরীর প্রশংসায় অনবরত কথা বলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত শফিক কাবেরীকে কথা দেয় খুব দ্রুতই সে তার ছোটকাগজের জন্য সমকালীন কবিতার প্রবণতা বিষয়ে একখানা প্রবন্ধ লিখে দেবে। কাবেরী শফিকের ডান হাতে চাপ দেয়। সুনীল সোনাকে লেখা কাবেরীর চিঠিখানা শফিক বেশ আগ্রহ নিয়েই পড়তে থাকে।

পশ্চিমবঙ্গের বাংলা কবিতার বাঁক পরিবর্তন বিষয়ে যদি বিভাষ রায়চৌধুরীকে দিয়ে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখিয়ে নিতে পারেন তা হলে উপকৃত হবো। এ আমার দাবি। সেসাথে বিভাষ দা’র কবিতা। পশ্চিমবঙ্গে ছোটকাগজের উদ্ভব বিকাশ ও বাংলা কবিতার নেতিবাচক দিক বিষয়ক আলোচনা অর্থাৎ আপনার সাথে যেভাবে কথা হয়েছিল আশা করি অবশ্যই সেভাবে কাজটি কাউকে দিয়ে করিয়ে নেবেন আমাদের পত্রিকার জন্য। আপনি যে মুক্ত গদ্য লিখতে চেয়েছিলেন শেষ পর্যন্ত তা লিখবেন নিশ্চয়। বন্ধুত্বের দাবিতেই বলছি, আমাদের বাংলাদেশে আপনারা যাতে পঠিত হোন সে ব্যবস্থাই করা হবে; যদিও আমাদের দেশের প্রায় তরুণদেরই অবস্থান আপনাদের আনন্দবাজারের বিপরীতে; যদিও আমি কোনো গোষ্ঠী অথবা প্রতিষ্ঠান বিরোধী বাকোয়াজিতে বিশ্বাসী নই; একমাত্র বিশ্বাস ভালো কিছু লেখা...

শফিক চিঠির বক্তব্য বিষয়ে কাবেরীর সাথে তর্কে মেতে উঠলে শেষ পর্যন্ত কাবেরী শফিকের যুক্তি মেনে নিতে বাধ্য হয় অথচ তারপরও এক পর্যায়ে পরিষ্কার জানিয়ে দেয়, আমার লেখার পাঠকসংখ্যা বেশি হোক অথবা একাধিক ভাষায় পঠিত হোক অথবা নাম ছড়াক অথবা যা-ই বলিস না কেন এটাতো আমার ব্যক্তিগত শুধু নয় বরং জাতিগত অধিকার; সেক্ষেত্রে আমাকে তো মিডিয়ার কাছে, প্রতিষ্ঠানের কাছে যেতেই হচ্ছে...

শফিক ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলতে থাকে, সস্তা নামডাকের মোহে নিজেকে নষ্ট করিস না; এক সময় দেখবি লোভে পড়ে নিজেকে বিক্রি করে ফেলেছিস...

: তোর মতো গবেট লেখক আমি না, রাজকবিদের যুগ-যামানা শেষ হয়নি, এরশাদের রাজদরবারের হালুয়া-রুটির লোভে অনেকেই বাপবাপ বলে ভিড়ে গেছে; তাই বলে আমাকেও এক পাল্ল¬ায় ওজন করছিস? তোর লিটলম্যাগ আদর্শ নিয়ে তুই থাক, আমি সব জাগাতেই লিখবো।

: সব জাগাতেই লিখবি? রাজাকারদের কাগজেও? তোর নিজের লিটলম্যাগের ভবিষ্যৎ বলে কিছু থাকবে না?

: বাজে বকছিস কেন, আমি রাজাকারদের কথা বলি নি, এ কথা তুই পরিষ্কার করেই জানিস; আর আমাদের টেকনিকে আমরা যখন কাজ করছি তখন দৈনিকগুলো আমাদের ভাষার সাথে কমিউনিকেট করতে না পারায় আমাদের প্রতি উদাসিন; সুতরাং নিজেদের উপস্থাপন করার জন্য আমাদের কারো না কারো কাগজ করতেই হবে; তুই সবকিছুই বুঝিস তো গায়ে পড়ে তর্ক করছিস কেনো?

: এমনি, কথা বলতে ভালো লাগছে তাই।
: আমার ইচ্ছে করছে না।
: ঠিক আছে, আয় এখন আমরা কিছুক্ষণ ঝিমিয়ে নেই।
: কীভাবে? তোর কাধে মাথা রেখে ঝিমাবো?
: রাখতে পারিস।
: ক’টা বাজছে?
: মনে হয় দশটা মতো হবে।
: কোন স্টেশন এটা?
: মনে হয় আক্কেলপুর।

ওরা যখন জয়পুরহাট স্টেশনে ট্রেন থেকে নামলো তখন রাত সাড়ে দশ। মফস্বল শহরের এই রাতই যেন গভীর রাত। বাসস্ট্যান্ডে আসার পর মঙ্গলবাড়িগামী কোনো বাস অথবা টেম্পু পাওয়া গেল না। শফিক ভেতরে ভেতরে ঘাবড়ে যেতে শুরু করলেও কাবেরীর সাথে অপ্রাসঙ্গিক কথা বলতে বলতেই আবার রিক্সায় উঠে বসলো; যেন বা কিছুই হয় নি অথবা এ আর এমন কী রাত অথবা এ এমন কী আর ঘটনা যার জন্য উতলা হতে হবে; কাবেরীর কোনো আত্মীয়ের বাড়ি গিয়ে রাতটা কাটিয়ে দিলেই হলো; আর সকাল হলে তো মঙ্গলবাড়ি মাত্র ১৮ কিলো; মঙ্গলবাড়ি পৌঁছিতে পারলেই তো কাবেরীর চাচার কাপড়ের দোকান, তারপর জয়নাল চাচার ভ্যানে পল্লীবালা বাজারের ভেতর দিয়ে মজিবর চাচাদের বাড়ির তিন বাড়ি পর ওদের পৈত্রিক ভিটা। অনেক দিনের পুরোনো। তখন গ্রামের নাম পল্লীবালা হয়নি; ছিল পালকপুর।

পালকপুরকে কাবেরীর মনে নেই। কাবেরী দেখেছে পল্লীবালার ছবি; একেবারে সবটুকু মুখস্ত এবং অনেকটাই মুখস্ত এই জয়পুরহাট শহরটিও; কেননা পল্লীবালার প্রায় সবাইকেই প্রতি সপ্তাতে কোনো না কোনো কাজে সদরে আসতে হয়; সুতরাং হোটেলটির ছবি দীর্ঘদিন হলো কাবেরীর ভেতরে গাঁথা ছিলো এবং যখন হোটেলটিকে আধুনিক সাজে সাজিয়ে তোলা হচ্ছিল তখন তার ভেতরে এক ধরনের আকর্ষণ অথবা কৌতূহল অথবা সিদ্ধান্তহীনভাবেই কাবেরীর কাছে নির্বোধের মতো মনে হতো হোটেলের ভেতরকার সমস্ত রহস্যই তার নখদর্পণে; সুতরাং কাবেরী যখন হোটেল সৌরভ ইন্টারন্যাশনালের সামনে এসে রিক্সা বিদেয় করে শফিককে নিয়ে সাবলীল উঠে গেলো দোতালার কাউন্টার বরাবর তখনও শফিক ঘটনার আকস্মিকতায় কিছু বুঝে উঠতে পারে নি অথবা তখন চুপ থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ বিবেচনা করে ভেতরে ভেতরে এক ধরনের উত্তেজনা বোধ করতে থাকে।

: হেলাল আঙ্কেল কেমন আছেন?

ম্যানেজার লোকটা কাবেরীর কথায় কেমন যেনো অপ্রস্তুত হয়। তারপর মিনমিনে স্বরে বলে, আপনেদের তো ঠিক চিনতে পারিচ্ছি না!

কাবেরী সহাস্যে উচ্চারণ করে, ইজিবর উকিলের ভাস্তি, মঙ্গলবাড়ির ইজিবর উকিল। তারপর শফিককে দেখিয়ে বলে, আমার ভাই শওকত; ভারসিটি গন্ডোগলে ভ্যাকান্ট করে দিয়েছে; একটা ভালো রুমের ব্যবস্থা করেন।

ম্যানেজার ওদেরকে চিনতে পারলো কিনা বোঝা গেলো না। তার চোখে এক ধরনের অনিশ্চয়তা, ট্রেন লেট করিছে? মঙ্গলবাড়ির টেম্পু পাননি? ঠিক আছে আমি দেখিচ্ছি।

: এখন আর যাওয়া যাবে না, রাত হইছে।
: আচ্ছা ঠিক আছে, কুনো সমস্যা নাই।

অতঃপর ম্যানেজার সাহেবের সাথে শফিক হাত মিলিয়ে নেয়; যেন বা তাকে আশ্বস্ত করে, আসলে ঘটনা সঠিক এবং ভেতরে ভেতরে শফিক ঘামতে থাকলেও বাইরে কিছুটা স্মার্ট হয়ে ওঠে; যা ছিল স্বাভাবিক পরিবেশের জন্য কিছুটা ব্যতিক্রম; হয়তো বা এই ওভারস্মার্টনেসের বিষয়টি হোটেল বেয়ারা অথবা ম্যানেজার হেলাল আহমেদের চোখে ভালো ঠেকেনি। ম্যানেজারের সাথে শফিকও বেয়ারার প্রতি হুকুম চালায় তাদের লাগেজগুলো রুমে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তারপর তিন তলার একেবারে কর্নারের রুমটি বুঝে নেওয়ার পর; যে রুমের সাথে ছিল একটি চৌকোণো বেলকনি আর মোটামুটি প্রশস্ত একখানা বাথরুম; যার মেঝে এমনকি দেয়ালটিও ছিল নীল উজ্জ্বল অথচ কমদামি টাইলসে মোড়ানো এবং ফিটিংসগুলো ততটা যুতসই ছিলো না অথবা দেশীয় মাঝারি মানের কারণে তা দ্রুতই অকেজো হয়ে যেতে শুরু করেছে এবং যখন বেয়ারা দুজন বিছানার চাদরসহ বালিসের কভার পাল্টিয়ে চলে যেতে ঘুরে দাঁড়ালো তখন শফিক খাবার পানি নিয়ে আসার জন্য হুকুম ছুড়ে দিলো।

কাবেরী সাবলীল সেঁধিয়ে যায় বাথরুমে। শফিক বিছানায় বসে সিগারেট ধরায়। আর তখন হোটেল বেয়ারা এমদাদের সাথে আরো একজন ছুঁচোমুখো বসন্তের দাগে ভর্তি থেবড়া নাকের ছোকরাকে দেখা যায়। ছোকরা চুপচাপ সাপচোখে তাকিয়ে থাকে। অবশেষে শফিককে সালাম দেয়,

: স্যার যদি কিছু লাগে, আমি হোটেলেত আছি...
: নাম কী তোর?
: দরবেশ আলি।
: ঠিক আছে, এখন কিছু লাগবো না, দরকার হইলে সকালে দেখা যাইবো।
: স্যারের বাড়ি নাকি মঙ্গলবাড়ি?
: হ্যাঁ।
: কুন ইউনিয়ন?
: পল্লীবালা।
: আমার বাড়ি পত্নীতলা, চিনিচ্ছেন? ওই নজিপুর... তালে পল্লীবালা কুন বাড়ি?

শফিক বিরক্ত হয়; সন্দেহের চোখে তাকায়, বাড়ি দিয়া তোর দরকার কী, এখন যা, বিরক্ত করিস না।
: ঠিক আছে, তালে আমি আসিচ্ছি আসসালাম...

শফিকের ভেতরের সাতাশ আত্মা বিরবির করে ওঠে, কাজটা মোটেও ভালো হয় নি; হোটেলে ওঠাটা একটা আহম্মকের কাজ হয়েছে। ভেতরে ভেতরে একটা চিকন ভয় সরিসৃপের মতো সরসর করে উঠলেও অবচেতনে একটা অস্বস্তি অথচ উত্তেজনা অথবা একটা মায়া জাগানো সঙ্গীত, যার কথা ও সুর কিছুই ঠিক বোঝা না গেলেও কোথায় যেন একটা পৌরুষের ডাক, একটা মুক্তি, অথচ বাইরে ভীষণ রাত; ভারসিটিতে একশ চুয়াল্লিশ ধারা; দেশের প্রতিটি ভারসিটি একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে; হোটেল সৌরভের প্রায় সবকটি কক্ষই একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে; পাশের রুম থেকে জোর আওয়াজে টেলিভিশনে গান ভেসে আসছে; অনেকটা গজলের মতো অথচ গজল নয়; পুরোনো কোনো হিন্দি ছিনেমার গান; সুর অনেকটা উর্দু গানের মতো; শফিকের ভেতরে সুর ও কথা জট পাকাতে না পেরে দেয়ালের ওপর পিঠ ঘেঁষে কেবলি পিছলে যেতে থাকলে এক সময় কাবেরী কান্তা বাথরুম থেকে বের হয়। ওর চোখেমুখে হাজার বছরের ঘুমের ওপর একটা ওপরচালাকি, একটা ঝিলিক, একটা বেপোরোয়া ভাব এবং কাবেরী কান্তা এগিয়ে এসে শফিকের ঠোঁট থেকে সিগারেট টেনে নিয়ে একটা ছোট্ট টান দেয় আর তখন দরজায় শব্দ হয় পরপর দুবার। শফিক উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলে দরবেশ আলি ঠাণ্ডা চোখে তাকায়,

: আসসালাম, রাতে কি খাইছেন?
: এখানে আসার আগে বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি।
: ম্যানেজার কোলো, এটে কি কুনো আত্মীয় আছে?

কান্তা এগিয়ে আসে, কিছুটা ধমকের সুরে জানতে চায়, কেন? হেলাল আঙ্কেলের তো জানার কথা।

: না, ম্যানেজার সাবে আপনাদের চিনিচ্ছে না।
: ফুপুর বাড়ি আছে, পুরানাপৈলে, ফুপুদের সাথে যাওয়া আসা নাই।
: ঠিক আছে কুনো সমস্যা নাই, দরকারে বেল টিইপেন।

শফিক নার্ভাস ফিল করে। কাবেরী বিছানায় গিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে থাকে। শফিক বাথরুমে যাওয়ার তিন মিনিটের মাথায় বাথরুমের দরজায় পরপর দুবার শব্দ শুনতে পায় এবং দরজা খোলার পর কাবেরীর নার্ভাস মুখের ওপর ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,

: কী হলো?
: ভয় পাচ্ছে।
: কেন?
: এমনি।
: আগে মনে ছিল না, শুয়ে পর, ভয়ের কিছু নাই, আমি সারারাত জেগে থাকবো।
: আমার ঘুম আসবে না।
: তো, কি করতে হবে?
: আলেক্স হেলির বইটা কোথায় রেখেছিস?
: ওটা তো আমার পড়া হয়নি, তুই দেরিদা পড়তে পারিস।
: দেরিদা এখন মাথায় ঢুকবে না, আয় গল্প করে রাত পার করে দেই।

তখন রাত একটা কী দেড়টা হবে। কাবেরী ওর বিছানা থেকে উঠে এসে শফিকের বিছানায় জায়গা করে নেয়। ভয় পাচ্ছে? কাবেরী কিছু বলে না। শফিক বুঝতে পারে না তার এখন কী করা উচিত। শফিক বইয়ে মন বসাতে পারছে না। কাবেরী, টিভিটা ছেড়ে দিয়ে আয়। টিভি ছাড়ার পর লাইট নিভিয়ে কাবেরী শফিকের গা ঘেঁষে বসে। দুজনের চোখ টিভি পর্দায়। সিদ্ধান্তহীনভাবেই হয়তো বা অবচেতনে তারা ঘনিষ্ট হয় এবং হঠাৎই কাবেরী গুনে গুনে শফিকের ঠোঁটে তিনটি চুমু খাবার পর ফিসফিসিয়ে ওঠে, ফেরৎ দে। শফিক গুনে গুনে মাত্র তিনটি চুমুই তাকে ফেরৎ দেয় এবং ওদের মাথার ভেতর তখন সবুজ ট্রেন গতিশীল হলে রেলগাড়ি তীব্র শিস তুলে গড়াতে শুরু করে; পরবর্তি স্টেশনের স্বপ্ন ফুটে ওঠে ওদের মাথার ডান কুঠুরিতে; হয়তো বা বাম কুঠুরিতেও সেই স্বপ্ন ছড়িয়ে যেতে থাকলে ওরা টুকরো টুকরো গল্পে সময়কে অতিক্রম করতে থাকে এবং তাদের স্বপ্নে তারা দুজনই ডাকসাইটে দুজন লেখকে বিবর্তিত হতে থাকলে, লেখক জুটি, লেখক সংসার অথচ তারা সেই সীমাহীন দূরবর্তী স্বপ্নের ভেতরও ভয় পায়; যে ভয় ওদেরকে আরও শরীর সংলগ্ন করতে সহায়তা করলে শফিকের পুরুষ জেগে ওঠে এবং শফিক পরিষ্কার বুঝতে পারে দীর্ঘদিন তারা পরস্পর পরস্পরকে কামনা করেছে এমন একখানা গভীর আকাক্সক্ষা থেকে, যে আকাক্সক্ষাকে আদতে কোনো শিল্পের মানদ-ে অথবা কোনো নান্দনিক তুলাদ-ে পরিমাপ করা সম্ভব নয় এবং কবি কাবেরী কান্তা তার অবচেতন ইচ্ছের দাসত্বে নিজেকে সপে দিতে শুরু করলে শফিক নিজেকে প্রশ্ন করে, এই প্রাপ্তি কি চিরকালীন? হয়তো বা চিরকালীন এবং অবশ্যই; কিন্তু, এই কিন্তুর পর শফিক আর কোনো প্রশ্ন খুঁজে পায় না বরং তারা খুঁজে পায় পরস্পরকে।
নিকটেই সীমান্ত। হিলি বন্দর। পল্লীবালার গা ঘেঁষে সীমান্ত। সীমান্ত শেষে কাটাতার বাঁধা। তারপরও তারা বাধা অতিক্রম করার চেষ্টা করে। প্রেম। ভালোবাসা। বিষাদ। সীমান্ত ঘৃণা। জোছনা মায়া। এইসব নিমগ্ন চেতনার গভীরে কবি কাবেরী কান্তার দেহ জুড়ে শুধুই জ্যৈষ্ঠের ঝাঁকঝাঁক রোদ আর উষ্ণতা; যে উষ্ণতায় নেই কোনো মৃদুতা; শুধুই নন্দন অগ্নি। আর তখন দরজায় শোনা যায় প্রথমে পরপর দুটো টোকা। তারপর প্রায় মিনিট খানেক পর আরো দুটো আঘাত। যেন বা সরাসরি আঘাত, লক্ষভেদ।

ওরা কেঁপে ওঠে; তারপর জমে যায় একেবারে হীমশীতল; যেন বা হঠাৎই পৃথিবীতে বিনা ঘোষণায় নেমে এসেছে নোংরা ঋতু মাঘ; কুয়াশা, হীম, চারিধার বরফ, শুধুই বরফ; অথবা টিভির পর্দায় দেখা বরফদেশের কোনো এক গুহায় ওরা বরফের ভেতর জমে গেছে নীরবে, একান্ত গোপনে। অথচ তারপরও ওদের সেই গোপন গুহা থেকে বেরিয়ে আসতে হয়; ওরা বাধ্য হয়। শফিক নার্ভাস গলায় কথা বলার চেষ্টা করে; যেন বা হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠেছে অথবা অনিচ্ছা সত্ত্বেও কথা বলতে হচ্ছে অথবা অসম্ভব রকম কোনো দুর্ঘটনার মুখোমুখিতে ইচ্ছাকৃত ভয় লুকানো কোনো কণ্ঠে, কে?

: আমি দরবেশ আলি।
: এত রাতে কী চাই?
: পুলিশ।

তারপর সবকিছু একদম চুপচাপ। সিদ্ধান্তহীনভাবেই কাবেরীকে একলা রেখে শফিক আস্তে করে আরেক খাটে চলে যায় এবং হয়তো পাঁচ অথবা দশ অথবা পনেরো মিনিট পর আবারো দরজায় পরপর দুবার শব্দ শোনা গেলে শফিক উঠে বসে আর কোনোকিছু না বুঝেই দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে দরজার ছিটকিনি খুলে ফেলে।

: এটে আসেন।
শফিক অন্ধকারে দরবেশ আলি বরাবর এগিয়ে যায়।

: আপনারা কি স্বামী-স্ত্রী?
: কেন?
: তালে এ-লা কি করিচ্ছেন?

শফিকের গলা দিয়ে কথা সরে না, একদম চুপ, একটা কথা বলবি না, আর একটা কথা বললে ঠাইত মাইরা ফালামু।

: চিল্লাবেন না, পুলিশ আলে কী কোব? ভদ্দরলোকের হোটেল এটা, এ-লা কাজ এটে হয় না।

: তোদের রেজিস্ট্রিবুকে যা লেখা আছে তাই বলবি।
: ভাই-বুন? কেঙ্কা ভাই-বুন?

শফিক সচেতন হয়। মুখে প্রশ্রয়ের হাসি, ওই মিয়া, নাম দরবেশ কামেও দরবেশ হও, যাও ঘুমাও গিয়া, যা ম্যানেজ করার আমি করবানে, আমারে ভয় দেখানোর কিছু নাই, আমরা চাচাত ভাই বোন, সামনের মাসে আমাদের বিয়া, আমাদের নিয়া তোমার ভয় পাওনের কিছু নাই, যাও এখন, সময় মতো তোমার বকশিস তুমি নিবা, এখন যাও; আর শোনো ভারসিটির স্যারেগোর লগে ফাজলামি করতে আইসো না; পুলিশের ভয় কারে দেখাও, দুইচারটা পুলিশ আমার পকেটেই থাকে, যা এহন, ঘুমাইতে দে।

: ঠিক আছে, টেকা দেন, আর আসিচ্ছি না।

শফিক দরবেশ আলির হাতে টাকা ধরিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। নিজের খাটে বসে থাকে। তারপর হঠাৎই এক গ্লাস পানি খায়। একটা সিগারেট ধরায়। নিজে নিজেই কথা বলে, শালা হারামজাদা, দরবেশ আলি, টাকা হাতানোর ধান্ধা। শফিক স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে। যেন বা চুরি করে ধরা পরার পর ইজ্জত ফিরিয়ে আনার ফাঁকা আওয়াজ। মেজাজ খারাপ হয়। কাবেরীর ফোঁপানীতে মেজাজটা আরও খানিকটা খারাপ হলে চূড়ান্ত খারাপের আগে বিছানায় ওপাশ ফিরে শুয়ে থাকা আর কেঁপে কেঁপে ওঠা পিঠের ওপর যেন বা একটা মায়াঘেরা মিহি অদৃশ্য আবরণ দেখতে পেয়ে ওর ভেতরে আবেগ কাজ করতে থাকে। আর তখন বড় রাস্তা ধরে একটা মালবাহী ট্রাক ছুটে গেলে রাস্তার লাইটপোস্টের ইলেকট্রিক তারগুলো যেন বা একবার ঝনঝন করে ওঠে।


হয়তো বা মনের ভুল। কান্তা উঠে বসে। তারপর লাইট জ্বালায়। বাথরুমে গিয়ে চোখমুখ ধুয়ে এসে টিভি চালিয়ে দেয়। খুব স্বাভাবিক গলায় উচ্চারণ করে, ক্ষুধা পেয়েছে। শফিক শুকনো হাসিতে সবকিছু স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করে; যেন বা হাসপাতালে ওদের বন্ধুর মৃত্যু সংবাদটা ভুয়া মিথ্যে বানোয়াট একটা রাজনৈতিক চাল। স্বপন বিল্লা আসলে মারা যায় নি অথবা ফারুকের মৃত্যু সংবাদটা ছিল বানোয়াট; রেজারটাও। শফিক পরিষ্কার কণ্ঠে কথা বলার চেষ্টা করে; শফিককে থামিয়ে দিয়ে কাবেরী অনেকটা ধমকের সুরে জানতে চায়, তুই ভয় পাচ্ছিস? ওই জানোয়ারটাকে তুই টাকা দিতে গেলি কেন? একটা বিশ্রী ভুল করলি তুই; প্রশ্রয় পেয়েছে, আবার আসবে; তুই একটা আহাম্মক, একটা গবেট, একটা ভীতুর ডিম; তোর আসলে হোটেলে থাকার অভিজ্ঞতা নেই।

শফিক কিছু বলার মতো খুঁজে পায় না। কিছুক্ষণ পর কথা বলতে ইচ্ছে না করলেও হোটেলে রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা আছে কিনা জানার জন্য যখন শফিক কাবেরীর দিকে পূর্ণ চোখে তাকায় তখন বাইরে একাধিক মানুষের ফিসফিসানি শোনা যায়। কাবেরী হঠাৎই যেন বা উদভ্রান্ত অথবা অতিরিক্ত বুদ্ধিমান অথবা কিংকর্তব্যবিমূঢ়তার কারণে দরজার কাছে ছুটে গিয়ে দরজা খুলে ফেলে, চিৎকার করে ওঠে, স্টুপিড, কী চাই এখানে?

ওরা প্রথমে ভড়কে যায়। তারপর কাবেরীকে উপেক্ষা করে অপ্রত্যাশিত ভাবে; যেন বা হঠাৎ করেই অথবা কাবেরী এবং শফিক কিছু বুঝে ওঠার আগেই অথবা কাবেরী এবং শফিক ঠিক বুঝে উঠতে পারে নি যে ওরা দুজন কীভাবে রুমের ভেতর ঢুকে গেলো এবং ওরা দুজন সোজা পেছন জানালার সামনে গিয়ে শফিক আর কাবেরীর দিকে মুখ করে পরিষ্কার দাঁড়িয়ে থাকলো; ওদের মুখে কোনো কথা অথবা ওদের নড়াচড়ার কোনো লক্ষণ দেখা গেলো না। শফিক প্রশ্রয়ের হাসি হাসার চেষ্টা করে। কাবেরী সোফার ওপর বসে পড়ে, চেঁচাতে গিয়ে থেমে যায় আর তখন শফিক জানতে চায়, কী ব্যাপার, এভাবে সারারাত বিরক্ত করার মানেটা কী? ম্যানেজারকে ডাক...। কথার মাঝে ওরা শফিককে থামিয়ে দেয়,

: ভাগ দেন
: মানে? কিসের ভাগ?

শফিককে কাবেরী থামিয়ে দেয়, পরিষ্কার গলায় উচ্চারণ করে, ওই তোরা কত টাকা নিবি? এরম ফান্দে ফেলার শিক্ষা দিয়ে ছাড়বো, সকাল হোক, ভাবিচ্ছিস এটে আমাদের কেউ নাই?

: চিল্লাবেন না, মাল দেখেই বুঝিছি।

কাবেরী ওর গলা থেকে চেইন খুলে ফেলে, টেবিলের ওপর শফিকের ঘড়ি আর মানি ব্যাগের পাশে রাখে, এগুলো নিয়ে এক্ষনি বেরিয়ে যা...

ওদের নড়াচড়ার কোনো লক্ষণ দেখা গেলো না,

: ট্যাকা কে লিবে?

এবারে শফিক ওদের দিকে দু পা এগিয়ে খুব চাপা স্বরে বলে ওঠে, এখনও সময় আছে ঘর থাইকা বাইর হ, এক টানে টেঙ্গি ছিইড়া ফালামু...

: চিল্লাবেন, মাল একা খাচ্ছিস আবার ডায়লগ মারিচ্ছিস?

ওদের কথার মাঝে কাবেরী চিৎকার করে ওঠে; তারপর শোনা যায় কান্নার একটা নিয়মহীন আওয়াজ; যেন বা গোপন কোনো বিপদ, যে বিপদে প্রতিবেশীদের ডাকা সমীচিন নয় অথবা অবৈধ কোনো ভ্রƒণ এবরশনের ব্যথা গোপন করতে গিয়ে অসাবধানে হঠাৎই চাঁপা গোঙানির পরিবর্তে উচ্চস্বরে কেঁদে ওঠা।


কান্নার আকস্মিকতায় দরবেশ আলিরা দরজা গলে বেরিয়ে গেলে শফিক দ্রুত দরজার ছিটকিনি তুলে দেয়। আর তখন কাবেরী শফিকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ফোঁপাতে শুরু করলে শফিক আশ্চর্য নির্লিপ্ততায় ওকে বুকে টেনে নেয় খুব নীরবে, খুব গোপনে, খুব নির্ভরতার সাথে চুমু খায়; তারপর ওরা আশ্চর্য নির্ভরতায় শান্ত হবার পরিবর্তে সেই ঝকঝকে লাইটের ভেতরেই বিছানায় আছড়ে পড়লে বাইরে দরবেশ আলির কণ্ঠস্বর শোনা যায়, ওই শালী, কি করিচ্ছিস, তুই বুলে বুন হোস?


দরজায় শব্দ হয়। বিশৃঙ্খলভাবে ক্রমাগত দরজা খোলার জন্য হুমকি দিতে থাকে। দরজা ঠেলে ভেঙে ফেলার চেষ্টা করলে শফিক উঠে দাঁড়ায়; দরজার গায়ে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চেপে ধরে এবং হঠাৎই বাইরে কিছুটা নীরবতা দেখা দিলে শফিক টেবিলটাকে ঠেলে এনে দরজার সাথে লাগিয়ে দিয়ে টেবিলের ওপর উঠে বসে হাঁপাতে থাকে। কাবেরীর চেহারায় ঘৃণা আর ক্রোধের মিশ্রণ; সেসাথে এমন এক ধরনের বিধ্বস্ত অবস্থা যেন বা দৌড়ে পিছিয়ে পড়া কোনো লোকাল বাস, অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিকটবর্তী কোনো গেঁয়ো বাজারের উদ্দেশ্যে দৌড়াতে গিয়ে মাঝপথে থেমে গেছে অথবা আদৌ আর কোনো বাজারি প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার ইচ্ছে নেই অথচ তারপরও কাবেরী সটান উঠে দাঁড়ায়; বাথরুমে গিয়ে তরতাজা হয়ে আসে; নিজেকে গুছিয়ে তোলে; টেবিলে রাখা সোনার চেইন গলায় গলিয়ে দেয়; মাথা আঁচড়ায়, যেন বা কিছুই হয়নি অথবা তাড়া নেই; কেননা সে যেন নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই নিজেকে তৈরি করতে বসেছে অথবা যেহেতু তার তেমন কোনো জরুরি কাজ নেই। তারপর লাগেজগুলো মেঝে থেকে খাটের ওপর তুলে ঠিক করে নেয়। পার্সের ভেতরটা হাতিয়ে কিছু একটা খুঁজতে থাকে। ছোট্ট আয়নাটা বের করে খুব স্বাভাবিক ভাবেই নতুন করে ঠোঁট আর ভ্রু আঁকে। তারপর চেয়ারে গিয়ে বসে। কী মনে করে উঠে দাঁড়ায়; শেষ সিগারেটে আগুন ধরিয়ে শফিকের ঠোঁটে গুজে দেয়।

আর মাত্র দুই ঘণ্টা। আর মাত্র পৌনে দুই ঘণ্টা। আর মাত্র দেড় ঘণ্টা। অথবা এক অথবা ঊনষাট মিনিট অথবা শেষ মিনিটখানা হয়তো নিকটেই অপেক্ষারত। দরবেশ আলিরা এখন কোথায়, কী করছে; এখনো কি ওৎ পেতে আছে; মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষায়; শেষরাতে সেই সুযোগ মিলবে অথবা? অথবা আর কিছু ভাবতে চায় না শফিক। আজকের সূর্য কতদূর থেকে দৌড়ে আসছে? এত সময় লাগছে কেনো? শেষরাতে, ভোররাতে, ভোরের আধা আলো আধা অন্ধকারে হোটেলের প্যাসেজে অথবা সিড়িতে অথবা একটা মফস্বল শহরের ভোরের রাস্তায় কবি কাবেরী কান্তা কি রেপ হয়ে যাবে? আর তখন পৌরসভার ঝাড়–দার বেটিরা ওকে কুড়িয়ে নিয়ে যাবে নিকটের কোনো হাতুড়ে ক্লিনিকে; সারারাত বাংলা গিলতে থাকা ঝাড়–দার মেথরাণীগুলো ওকে সান্ত¦না দেবে; প্রকৃত ঘটনা গোপন রাখার জন্য প্রবোধ দিবে আর নিজেদের মধ্যে এক ধরনের গা ঢলানী পেয়ে বসলে কবি কাবেরী কান্তা লজ্জায় ঘৃণায় ক্রোধে অসভ্য পাবলিকের উদ্দেশ্যে চিৎকার করতে গিয়ে থেমে যাবে। কাবেরী কান্তা খুব স্বভাবিক ভাবেই উচ্চারণ করে, আর কত মিনিট পর সূর্য উঠতে পারে বলে মনে করেন আপনি মিস্টার শফিক আশরাফ?

: সম্ভবত কোনো দিনই উঠবে না।
: কারণ?
: কারণ আমাদের ব্যর্থতা, অদূরদর্শিতা, সীদ্ধান্তহীনতা অথবা বলতে পারেন বাস্তবতা বর্জিত পরিকল্পনা অথবা বলতে পারেন আপনার প্রোজেক্ট প্রোফাইলটির র‌্যাশান্যালটি ছিল না, থাকলেও তা ছিল ত্রুটিপূর্ণ।

শফিক এবং কাবেরী জোরে জোরে কথা বলতে থাকে, নাটকের সংলাপ আউড়াতে থাকে; হাসতে চেষ্টা করে এবং ওরা বুঝতে পারে এভাবেই ওদের জেগে থাকতে হবে এবং এভাবে যতবেশি নাটকের সংলাপ আউড়াবে প্রতিপক্ষ ততবেশি দূরে সরে থাকবে। দুজন লেখক এখন শৃঙ্খলাবদ্ধ নাট্যমঞ্চে সংলাপ রচনায় ব্যস্ত।

অভিনয়ের অভিঘাতে ভেতরে ভেতরে শফিক সত্যিকার অর্থেই ভাবালুতায় অথবা মানবীয় আবেগে অথবা নৈতিক চেতনায় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, কবি কাবেরী কান্তাকে সে বিয়ে করবে। এবং আজই এবং সকাল হলেই এবং বিয়ে করেই সে কাবেরী কান্তাকে নিয়ে মঙ্গলবাড়ি পৌঁছিবে অথবা এমন হতে পারে মঙ্গলবাড়ি গিয়ে কাবেরীর গার্জিয়ানদের বিয়ের প্রস্তাব দেবে এবং একটা পাকা ব্যবস্থা করে তবেই সে টাঙ্গাইল ফিরে গিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। তারপক্ষে এখন কোনোক্রমেই কাবেরীকে অবহেলা করা সম্ভব নয়; কাবেরীর অমর্যাদা সে হতে দেবে না। কান্তাকে এখন বিয়ে করাই উচিত অথবা এমন একটা বাসটার্ড অবস্থার প্রতিবাদ অথবা ঘৃণা জানাতে হলেও তাদের এখন বিয়ে করা উচিত এবং যেন বা বিয়ের আসরে কোনো অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনার মতো দরজায় আবারো শব্দ শোনা গেলে শফিক লাফ দিয়ে টেবিল থেকে নেমে খাটের স্টেন্ড খুলে চেঁচিয়ে ওঠে, কুত্তার বাচ্চারা আয় একটাকেও আস্ত রাখবো না। শফিক দরজায় লাথি মারে; টেবিল ঠেলে দরজার ছিটকিনি খুলে ফেলে; ছুটে যায় স্ট্যান্ড হাতে।

কাবেরী চোখ কুঁচকে ছুটে যাওয়া শফিকের দিকে তাকিয়ে থাকে। দরবেশ আলিরা সিদ্ধান্তহীনভাবেই ভড়কে গিয়ে পিছিয়ে যায় এবং হঠাৎই সিড়ি ভেঙে নিচে নামতে থাকে; বিরবির শব্দে একটানা অশ্লী¬ল শব্দ-বাক্য-পদ, গল্প-কবিতা-উপন্যাস, ছিনেমা-নাটক-গান, ছবি-ছায়াছবি-ড্রামা-মেলোড্রামা আউড়াতে আউড়াতে তালাবদ্ধ কলাপসিবল গেটের কাছে অবস্থান নেয়।

জয়পুরহাট। আধাশহর অথবা পাতিশহর। গলিঘুপচি অথবা খোলা রাস্তা। পাকা শহর অথবা আধা পাকা অথবা চৌচালা টিনের প্রাচীন দেয়াল যেন বা প্রাচীন গন্ধে আচ্ছন্ন কোনো মন্দিরের ভয়হীম ছায়া; পরিপূর্ণ গভীর ছায়াশীতল অন্ধকারের ভেতর সেঁধিয়ে থাকা বসতভিটার পাশে অহঙ্কারী মসজিদ থেকে সুগভীর রাশভারি সুরে হয়তো বা মোঘল বাদশাহের মসজিদের বিশাল মিনার থেকে, হাজার বছর দূর থেকে ভেসে আসতে থাকে একটানা একটা সুর। আরবি ভাষায় সেই সুর সমগ্র মানব জাতির মধ্য থেকে একটা বিশেষ জাতির উদ্দেশ্যে একটা মায়াবী আহ্বান জানায়।

আর সেই মায়াকাতর অথবা জিহাদকাতর জাতির একটা অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশমাত্র বাংলাদেশের একটা গ্রামে, বাংলাদেশের একটা জেলাশহরে, একটা বিশেষ জনগোষ্ঠীকে সুরে ও বাণীতে পবিত্র করে তুলতে ব্যস্ত হলে শফিক এবং কাবেরী কান্তা যেন বা নতুন কিছুর ইশারা পায়; হয়তো বা একটা সাহস ফুটে উঠতে থাকে সুবেহ সাদেকের তাজাঘ্রাণ গন্ধে।

সূর্যোদয়ের সন্ধিক্ষণে ওরা দাঁড়িয়ে আছে একটা ব্যবসায়িক অট্টালিকার শৃঙ্খলিত ইট-সুরকির ভেতর; যেমনটা বাংলার শেষ নবাব তার মোঘল অট্টালিকার ভেতর একটা দীর্ঘ ক্লান্তিকর রাত্রির শেষে জেগে ওঠার তাড়নায় তার শেষরাতের স্বপ্নকে একেবারে কাহিল করে দিয়ে শয্যাত্যাগে বাধ্য হয়েছিল; কেননা প্রতিদিনের শুরুতেই তার জন্য জমে উঠতে শুরু করেছিল অজস্র কাজ আর অজস্র জীবন; যে জীবনের বিনিময়েও নবাব শেষ পর্যন্ত পরাজিত হতে বাধ্য হয়েছিলেন; যার একমাত্র কারণ ছিল বাঙালি জাতির সীমাহীন আকাক্সক্ষা অথবা দরবেশ আলিদের সীমাহীন লোভ।

অথচ শফিকের ভেতরে তখন শেষ রক্ষার একটা প্রচ- তাগিদ তাকে ভেতরে ভেতরে সেনাপতির পদে উন্নীত করতে শুরু করলে শফিক ধীর পদক্ষেপে তৈরি হতে থাকে চূড়ান্ত ক্ষোভ উগড়ে দিতে অথবা প্রতিপক্ষের বিষদাঁত উপড়ে ফেলতে সে তার সঞ্চিত সাহসকে কাজে লাগাবে; প্রয়োজনে এখন কোনো প্রকার গোপনীয়তাকে সে তোয়াক্কা করবে না। শফিক প্রচণ্ড নির্ভরতায় কাবেরী কান্তাকে কাছে টানে; জড়িয়ে ধরে এবং অবশেষে একটা গভীর চুম্বনে তাকে বিহ্বল করে তুললে কান্তা শফিকের দিকে তাকায় কেমন একটা ভয়াতুর অথচ নতুন দৃষ্টিতে। সেইচোখে জীবনানন্দের কোনো পাখি অথবা ডানা ঝাঁপটানো কোনো সমুদ্র পাখির ব্যাকুলতা ছিল না অথবা ছিল না কোনো নতুন ইশারা; শুধু ছিল ক্লান্তি এবং অনিশ্চিত ভয় এবং উদ্দেশ্যহীন একটা আকুলতা। কাবেরী ফিসফিসিয়ে ওঠে, এখনো ভোর হয় নি।

বাইরে তাদের জন্য ওৎ পেতে আছে ঘৃণা; ওৎ পেতে আছে অশ্লীল কোনো সূর্যের আলো। এরপর এই একটিমাত্র চূড়ান্ত ভোরের অপেক্ষায়, যে ভোরের পর আরও হাজারবার বাংলাদেশে ভোর এসেছে এবং আরও হয়তো হাজার রাতের পর, যে রাতগুলো শফিকের জীবনে আরব্য-রজনীর হাজার রাত্রির মতো কোনো ফ্যান্টাসি ঘটনার জন্ম দিতে অক্ষম অথচ শেষাবধি এই একটিমাত্র রাত শফিকের জীবনে একটা ভয়ানক দ্বন্দ্বমুখর; অনেকটা ধর্মপুস্তক কথিত নরকতুল্য; যেন বা তা শেষ পর্যন্ত আরব্য-রজনীর রাতগুলোকেও মিথ্যে প্রমাণিত করেছিল।

সুতরাং শফিক একদিন নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হলে কবি কাবেরী কান্তাকে লিখতে বাধ্য হলো। কেননা তাকে লিখতে হয়েছিল; যেহেতু শফিক তার জীবনের একটা দীর্ঘ ক্লান্তিকর সময় অবধি তার নিউরোনে বহন করছিল কবি কাবেরী কান্তা বিষয়ক বিষ। সুতরাং তাকে লিখতে হয়েছে কবি কাবেরী কান্তার উদ্দেশ্যে এবং যেহেতু কবি কাবেরী কান্তা এখন সংসার করছে; অথবা যেহেতু শিল্পের বিষ যখন প্রেম বিষয়ক বিষের সমসত্তে একটা মহাবটিকা হিসেবে শফিককে কেবলি উজ্জীবিত করে তুলতে শুরু করলো সেহেতু শফিককে তখন লিখতে হলো।

প্রিয় কবি, তোমার বিচক্ষণ আবেগের প্রতি আমার অভিনন্দন। শিল্পের ক্ষমতাকে আমি শ্রদ্ধা করি। মানুষের ক্ষমতাকে আমি ভালোবাসি। মানুষের ক্ষমতাকে আমি ভয় পাই। মানুষের ক্ষমতাকে আমি ঘৃণা করি এবং সেই ঘৃণা থেকে তোমাকে ভালোবাসি। তোমার পুত্র কেমন আছে? কেমন আছে তোমার কবিতারা? জীবনের চূড়ান্ত চূড়ায় পৌঁছিতে হলে ভেতরে ভেতরে এতটা অস্থিরতা পুষতে নেই; তারচেয়ে এসো চাঁদ-জোছনার পথ ধরে যাওয়া যাক বসন্তের ওপারে কোথাও। তুষারপাত থেমে গেলে মাটির শরীর বুঝে যায় প্রসব যন্ত্রণার কতটুকু প্রয়োজন; কতটুকু ক্ষত হতে ক’ ফোটা রক্ত ঝরে; আর বুঝে নাও শ্যামল মেয়ে ওহে, রক্ত ঝরার গান কণ্ঠে নিতে নেই, রাখতে হয় মানুষের আত্মার কাছাকাছি। আত্মার সীমানার সবটুকু দেখতে নেই, আভাসে প্রতিভাসে বুঝে নিতে হয় রক্তেরা কীভাবে অস্থি-মজ্জা-হাড্ডি বেয়ে নাভিতে নেমে আসে সন্ধ্যা হলে। এমন সন্ধ্যা আলোয় প্রাণ খুলে কথা বলতে নেই হে মেয়ে! তারচেয়ে বরং খানিকটা জিরিয়ে নেই এসো; তারপর যাওয়া যাবে চাঁদ জোছনার পথ ধরে সমুদ্রের ওপারে কোথাও।

প্রিয় কবি, এই জোছনার অনুসন্ধানে কেটেছে অনেকগুলো বছর; এখন জোছনাতে নাইতে নামার সময়। সাথে থাকবে প্রিয় বন্ধু, প্রিয় পুস্তক আর প্রিয় কবিগণ। কবির মর্যাদা আর বন্ধুত্বের মর্যাদা এতদিন পর তোমাকে নতুন করে মনে করিয়ে দিতে চাই না। তোমার অন্তরে, তোমার চোখে যে চাঁদজোছনার দ্বীপ্তি আমি একদিন দেখেছি, সেখানে বিশ্বাস ছিল, ছিল প্রেম; সেই থাকাটুকুতেই আমার এতটা জীবন চলেছে; বাকি জীবনটাও চলবে। তোমাকে আবারও লিখতে হবে। আবারও ফিরতে হবে। ভালো লেখার মর্যাদা এই অশ্লীল সময় আর আধা-অসভ্য জাতির চেয়েও অনেক বেশি জীবন্ত। একজন জীবন্ত কবির চেয়ে একটা কবিতা অনেক অনেক বেশি সজীব। কাব্যরাতে দেখা হবে পাখিমেলার ভিড়ে। ভালো থেকো। ভালো লিখো।
কবি শাসন করে শব্দ আর কবিকে শাসন করে ভালোবাসা। আমি তোমাকে আজও ভালোবাসি; আজও তোমাকে আমার ভেতরে বাঁচিয়ে রেখেছি; আগলিয়ে রেখেছি দরবেশ আলিদের কাছ থেকে। তাই তোমাকে শাসন করছি, তুমি লিখছ না কেন? তোমার সম্পাদিত পত্রিকায় তোমার লেখা নেই। প্রেমই মোদ্দা কথা; আর দরকার লেখার প্রতিভা। এ দুটোই প্রকৃতি একটু বেশি মাত্রাতেই তোমাকে দিয়েছে। প্রয়োজন জীবনের সমান প্রতিভা; প্রকৃত জীবনকে উল্টে পাল্টে দেখতে পারার মতো প্রতিভা।
পরগাছাদের ঝেঁটে ফেলো। গোষ্ঠীর দরকার নেই। প্রয়োজন মাত্র পাঁচজন মেধাবী লেখকের। অধিকাংশের কবিতাই আমাকে মাতাল করতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে মজনু শাহ-র কবিতায় সত্যিকার অর্থেই আত্মা আছে, জীবন আছে। আর পাবলো শাহী অথবা শামীম রেজার মতো আমিও যেন প্রতœ কাহিনী থেকে যেটুকু ঘ্রাণ পাই তা যেন আমাকেই দেশান্তর করে; নিয়ে যায় উচ্ছ্বল অতীতে। ‘হননের কোলে আমার প্রথম আত্মাহুতি’ তোমার পত্রিকার শ্রেষ্ঠ কবিতা। রিঙ্কু অনিমেখ কবিতা লিখতে জানে। আর আবারও বলছি প্রতিভাশূন্য পরগাছাদের সনাক্ত করতে শেখো; আর না হলে সম্পাদনার দায়িত্ব ছেড়ে দাও। কেননা তোমার কোনো অধিকার নেই অলেখকদের লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার। বরং এসো আমরা প্রকৃত শিল্পকে স্বাগত জানানোর পরিবেশ তৈরি করি। কোনো কোনো মূর্খ আছেন যারা কিছু না বুঝেই সাহিত্য করতে আসেন; শিল্পের ঘোড়ায় সওয়ার হতে চান; মিডিয়াবাজি এবং লবিঙের পাকা দরবেশ।
মাসুদুল হক আমার লেখক সত্তার আরও একটা অংশ। হুমায়ূন মালিক আরও অধিক পঠিত হওয়া উচিত। হুমায়ূন মালিকের মতো লেখক থাকার কারণেই আমি ভালো কিছু লেখার সাহস পাচ্ছি। যদিও আমার জানা আছে আমার পাঠক সংখ্যা নগণ্য। তারপরও একজন লেখকের একজন চূড়ান্ত বন্ধু একজন চূড়ান্ত পাঠক থাকা খুব জরুরি। সালিম সাবরিনের মতো মেধাবী সমালোচকের বড্ড অভাব। সাবরিনের ওড়ার আকাশটা অনেক বড়; সেই আকাশে আমরাও একদিন ঠাই পাবো নিশ্চয়। কাবেরী, আমরা কি এখন আর বন্ধু নই? আজ এত বছর পর তোমার সেই ভারসিটি জীবনের লিটলম্যাগ নতুন আঙ্গিকে আজিজ মার্কেটে দেখতে পেয়ে বুকের ভেতর রক্ত ছলাৎ। আমরা কি সেই ভারসিটি জীবনের উচ্ছ্বলতায় কবিতার সামগ্রিকতায় ফিরে যেতে পারি না? হয়তো পারি। হয়তো গোটা জীবনটাই একটা গোলক ধাঁধা। তাহলে, তুমি আবার লেখার জগতে ফিরছো?

সেদিন ভোর হবার আগেই ওরা হোটেল সৌরভ থেকে একটা দমকা বাতাসের মতো রাতজাগা বিশৃঙ্খল চেহারা নিয়ে ছুটে বের হয়ে এসেছিল রাস্তায় এবং মঙ্গলবাড়িগামী প্রথম লোকাল বাস, যে বাসটির নাম অসভ্যরকমের একটা অশ্লীলতায় পৌঁছে গিয়েছিল অন্তত কাবেরী অথবা শফিকের কাছে; বাসটির নাম ছিল ‘দরবেশ পরিবহন’। সেই বাসটাতে কাবেরী কান্তা উঠে বসলে কাবেরী কান্তার অপ্রত্যাশিত অনুরোধে, যা ছিল অনেকটা আদেশের মতো; শফিক নেমে এসেছিল বাস থেকে। কান্তা একাই তার গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিল; কেননা তাকে একাই যেতে হয়েছিল, কারণ হোটেল সৌরভকে ঘিরে শফিক বিষয়ক কোনো নাটক তার পরিবারে অথবা তার এলাকায় প্রচারিত হোক তা কান্তার জন্য মেনে নেয়া ছিল অসম্ভবরকমের আত্মঘাতিমূলক একটা বিষয়। অথচ শফিক তা বুঝতে অক্ষম; বিধায় শফিককে দুঃখ পেতে হয়েছিল ভয়ানকরকম একটা মাত্রায়; যেন বা তা যে কোন বৈজ্ঞানিক পরিমাপকের মাত্রাকে অতিক্রম করেছিল; সুতরাং প্রকৃতিবিরুদ্ধ যে কোনো ধরনের একটা দুর্ঘটনার জন্য যেন বা সকলেই অপেক্ষারত।

কাবেরীর চোখে কি জল ফুটে উঠেছে? হয়তো ওর চোখ জলময় অথবা জলহীন, শুধুই শূন্যতা। তবে শফিকের কাছে মনে হয়েছিল কাবেরী একটা অসম্ভবরকম যন্ত্রণায় ওর চোখের জল গোপন করতে গিয়ে পক্ষান্তরে ওর চোখের পাপড়ি ঝরিয়ে ফেলতে শুরু করেছে। শফিক জানালা গলিয়ে কাবেরীর হাত চেপে রেখেছিল যতক্ষণ না দরবেশ নামের বিদঘুটে বাসটা চলতে শুরু করেছিল। আর সেই অতি প্রত্যূষে বাসভর্তি গুটিকয়েক গেঁয়ো লোক গবেট চেহারার হেলপার আর বাবাজি বাসড্রাইভার ওদের দিকে যখন ঘন ঘন সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছিল তখন সবকিছুকে উপেক্ষা করে শফিকের কেবলি মনে হতে থাকে জীবনের সবচেয়ে দরকারি আর মূল্যবান কিছু ওর হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে; বিদঘুটে বাসটা ওর জীবনের চূড়ান্ত প্রয়োজনকে ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে মঙ্গলবাড়ি বরাবর পল্লীবালা নামের একটা পুরোনো ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্যে। সে কি পরের বাসে চেপে বসবে? পল্লীবালাতে গিয়ে হাজির হবে?

আর হঠাৎই বিনা আয়োজনে বাসটা গড়াতে শুরু করলে হাজার বছরের বিষাদ, কোটি বছরের ক্লান্তি আর সীমাহীন সময়ের অর্থহীন ঘৃণা শফিককে টেনে নিয়ে গিয়ে একটা চায়ের দোকানের উলঙ্গ বেঞ্চের ওপর আছড়ে ফেললো।



লেখক পরিচিতি
শিমুল মাহমুদ

জন্ম ৩ মে ১৯৬৭। নাড়িমাটি যমুনাপারে, সিরাজগঞ্জের কাজিপুর। বাংলাদেশ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। পৌরাণিক বিষয়াদি নিয়ে উচ্চতর গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে লাভ করেছেন পিএইচ-ডি. ডিগ্রি। কবি হিসেবে আবির্ভাব গত শতকের আশির দশকে। স্বৈরশাসনের দুঃসহকালে কবিতার সাথে তাঁর সখ্য; সমান্তরালে কথাসাহিত্যে রেখেছেন নির্মোহ ছাপ; অধ্যাপনা পেশার সাথে মিলিয়ে নেন সমসাময়িক পাঠ; ফলে সমালোচনাতেও সিদ্ধহস্ত। এখন থিতু রংপুরে; বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। দীর্ঘদিন ধরে সম্পাদনা করছেন সাহিত্যের কাগজ ‘কারুজ’। স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন ‘কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা পুরস্কার ২০০০’। সেইসাথে সাহিত্যকর্মের জন্য ২০১২ তে ‘বগুড়া লেখকচক্র’ এবং ২০১৫ তে পশ্চিমবঙ্গের ‘অচেনা যাত্রী ও দ্বৈপায়ন’ কর্তৃক সন্মাননা প্রাপ্ত হন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ